সৃষ্টি ও বিবর্তনের পথে
পৃথিবী। আরও আটটা গ্রহ। সবাই ঘুরছে। মাঝে সূর্য। কত ধূমকেতু! ধূলোর ঘূর্ণি। সব মিলিয়ে সৌরজগত। মাঝখানে ফাঁকা। দূর-আরও দূরে প্রক্সিমা সেন্টরী। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। তাকে ঘিরেও তৈরি হয়েছে নক্ষত্রজগৎ। এরকম লাখ-লাখ নক্ষত্রজগৎ নিয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। আবার ফাঁকা। আরও ফাঁকা। ঐ যে অ্যান্ড্রোমিডা ! আমাদের গ্যালাক্সির সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি। এরকম লাখো গ্যালাক্সির সমাহার মানেই ব্রহ্মাণ্ড। তারও বাইরে আর কী আছে তা ধরার যন্ত্র বিজ্ঞানে এখনও বেরোয়নি। এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সি কত দূর? কোটি কোটি আলোকবর্ষ। এক আলোকবর্ষ মানে বছরে আলো যতদূর যায়। বছর তো বিরাট। সেকেণ্ডেই আলো যায় এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল। আর মানুষের দৌড়? দিল্লী, আমেরিকা ছাড়িয়ে ঐ চাঁদ পর্যন্তই। মানুষের বাহন ‘মহাকাশযান’ যদিও প্লুটোমুখি। মহাকাশীয় দূরত্ব তাই কল্পনায় আনাও কল্পনা। একদা এই কল্পনাসাগরে হাবুডুবু খেয়েছেন নিউটন, আইনস্টাইন, গ্যামো। ভয়ানক সুপার কম্পিউটার নিয়ে এখনও তার তল খুঁজে পাননি ষ্টিফেন হকিং। মহাকাশ নাকি ফুলছে, বাড়ছে। গ্যালাক্সিরা প্রচণ্ড গতিতে (সেকেণ্ডে নাকি শ’ থেকে হাজার মাইল ) দূরে সরে যাচ্ছে। একটা আরেকটার থেকে। বাইরের দিকে। আঁচটা পেয়েছিলেন হাবল । সেটা ১৯২৪ সাল। দূরের নানান গ্যালাক্সির নক্ষত্র থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশ্লেষণ’ করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন। সেই আলোর রঙ লালমুখো । প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন বেরিয়ে গেলে হুইলের আওয়াজ কমে আসে। তেমনি, নক্ষত্র থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মত পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার অর্থও নক্ষত্র পৃথিবী থেকেদূরে সরে যাচ্ছে। এটা তরঙ্গ-বিজ্ঞানের কথা। আসল কথাটা এবার বললেন অনেকে, একসাথে। বেলজিয়ামের অঙ্কজানা পাদ্রীবিজ্ঞানী লেমাত্র নিশ্চয়ই অন্যতম। ব্রহ্মাণ্ড প্রসারণশীল। নক্ষত্রেরা প্রতি মুহূর্ত্তে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তার মানে, আজ যারা দূরে কাল তারা কাছে ছিল, পরশু আরও কাছে। তারও আগে...আরও আগে...আগে ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি সব পুঞ্জীভূত ছিল একটা জায়গায় । সেটা নাকি প্রায় হাজার পনের কোটি বছর আগে। পুঞ্জীভূত দানবীয় সেই ভরের আরেক নাম,— ‘মহাডিম্ব’। ‘কসমিক্ এগ’(Cosmic Egg)। সেই জমাট বাঁধা শক্তি সৃষ্টির ঊষালগ্নে সম্মুখীন হল বিরাট বিস্ফোরণের। সেই থেকে সময়ের শুরু। মহাবিস্ফোরণের ১/১০০ সেকেণ্ড পরে তাপমাত্রা দাঁড়াল ১০০০০০০০০০০০ C । এই বিরাট তাপমাত্রায় ভরের কোন অস্তিত্বই থাকতে পারে না। সবই যেন শক্তি! তিন মিনিট পর উষ্ণতা দাঁড়াল একশো কোটি ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে। শক্তি থেকে তৈরি হল প্রোটন-ইলেকট্রন-নিউট্রন... । পাঁচ মিনিট পর তাপমাত্রা আরও কমল। পঞ্চান্ন কোটি ডিগ্রীসে ন্টিগ্রেড। প্রোটন-ইলেকট্রন-নিউট্রন জমাট বেঁধে তৈরি হতে লাগল পরমাণু-অণু। আধ ঘন্টার মধ্যেই নানান মৌলের পরমাণুর সৃষ্টি হল। একই সাথে চলতে লাগল বিস্ফোরণের ঠেলায় ওদের দূরে সরে যাওয়া। নানান মৌলের অণু-পরমাণু মিলে মহাকাশে সৃষ্টি করতে লাগল গতিশীল ধূলোর বিক্ষিপ্ত মেঘ। একেকটি বিরাট মেঘের যাবতীয় ধূলো (নানান মৌলের অণু পরমাণু) মহাকর্ষের টানে কাছে এসে তৈরি করল নক্ষত্র বা তারা। দূরে সরে যাওয়াকে অব্যাহত রেখেই। সৃষ্টি তাই এখনও চলছে। কিন্তু কারণ-উৎস রহস্যে মোড়া। ‘মহাডিম্ব’ থেকেই যদি সবের সৃষ্টি তবে ঐ ‘মহাডিম্ব’ এল কোত্থেকে? তার আগেই বা কী ছিল ? বিজ্ঞান এখনও তা খুঁজছে। হাতড়ে বেড়াচ্ছে। উত্তর জানা নেই। সৃষ্টির এই ধারণার বিপক্ষের বিজ্ঞানী ‘হয়েল’ তাই ব্যঙ্গ করে ‘মহাবিস্ফোরণে’র নাম দিলেন ‘BIG BANG’ । এটাই যদি সত্য হয় তবে কতদিন চলবে এই মহাবিশ্বের মহাপ্রসারণ ?
তিনটে সম্ভাবনার কথা বলা হল।
১) এই প্রসারণ চলতেই থাকবে। ২) প্রসারণ হতে হতে এক সময়ে তো থেমে যাবে। ৩) প্রসারণ হতে হতে এক সময়ে তা থামবে এবং মহাকর্ষের টানে গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জ আবার কাছে আসতে শুরু করবে। সমানে কাছে আসবে। আবার তৈরি হবে ‘মহাডিম্ব’। আবার ঘটবে ‘BIG BANG’ । আবার প্রসারণ সংকোচন....প্রসারণ....। চলতেই থাকবে।
ঠাকুর (১৮৮৮–১৯৬৯) বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন। তাঁর নানান বইয়ে তা ছড়িয়ে। ডাক্তারি বিদ্যার ছাত্র হয়েও আপন-বোধে সৃষ্টিরহস্য প্রসঙ্গে তাঁর মত দিয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত্ত উন্মাদনায় বলে উঠেছেন—
“ক্ষুব্ধ সম্বেগে
অব্যক্তের বুকে
দ্রুত ব্যঞ্জনায়
বিঘূর্ণিত সত্তার উচ্ছিষ্ট-বিচ্ছুরণ-সংবিদ্ধ
সংঘাত কম্পিত
ছন্দে ভাসমান
শক্তি-শরীরী প্রতিধ্বনিই
আদিবাক্—
সৃষ্টির প্রথম প্রগতি।”
সৃষ্টির শুরুতে ছিল স্পন্দন। মানে, শব্দ। কিংবা বাক। স্পন্দন শক্তির ক্রমবিবর্তনেই আজকের যা কিছু সব। স্পন্দনের সৃষ্টি শূন্য থেকেই ‘মহাবিস্ফোরণ’ ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত এই তত্ত্বের কিছুটা মিলে গেল পাঁচের দশকে ‘হয়েল-বণ্ড-গোল্ডি’র থিওরি কিংবা ১৯৬৫-এর ‘হয়েল- নারলিকার’ গবেষণার সঙ্গে। ওঁদের মতে, মহাবিশ্ব যদি সমানেই বাড়বে, তবে শূন্যস্থানও বাড়তে থাকবে। তা সম্ভব নয়। ঐ শূন্যস্থান থেকে ক্রমাগত সৃষ্টি হয়ে চলেছে জড়। মহাবিশ্ব বাইরের দিকে বাড়ছে। ভেতরে জড়ও সৃষ্টি হয়ে চলেছে। ঐ শূন্য থেকেই। শূন্য থেকে জড় আসবে কী ভাবে? ঠাকুর বললেন, – শূন্যে স্পন্দন থেকে শক্তির জন্ম। শক্তি থেকে এলো জড়।
তবে শূন্যে ঐ স্পন্দন এলো কোথা থেকে? তাঁর মতে,—
“ছিল না’র সঙ্গর্ভ শায়িত হয়ে
অস্তিত্ব যখন
আপনহারা হয়েছিল,
‘আছে’র সংঘাতে
ব্যক্ত হয়ে উঠতে না পেরে
‘ছিল না’য় নিমজ্জিত হয়েছিল
যখন সে,
স্থাণুর স্থির অবিরল
আত্ম-নিমজ্জনী উদ্দাম উদগতির অববেলায়িত
উত্তাল জাগৃতি
স্ফুরিত হয়ে ওঠেনি তখনও;
ঐ ‘ছিলনা’র আবর্তনের ভিতর দিয়ে
‘অস্তি’র বোধ-দীপনার এই আবেগে
আত্মপ্রকাশের উন্মাদনায়
আনতিনৰ্ত্তনে,
উদাত্ত হয়ে উঠল চরিষ্ণুতে ......
এই বিস্তারণার আত্মসংঘাতের মাধ্যমে
উদ্ভিন্ন হয়ে উঠল বাক্ ।”
বাক্ বা স্পন্দন সৃষ্টির মূলে ছিল অস্তিত্ব-আবির্ভাবের চরম আবেগ (Urge) আর ইচ্ছা (Will) । আবেগ আর ইচ্ছার সমবায়ে স্থামু (Positive) ও চরিষ্ণুর (Negative) মধ্যে দিয়ে উদ্ভিন্ন হয়ে উঠল, বাক্স্পন্দন।
ঠাকুরের কথার সমর্থন মেলে বাইবেলে। “In the begining there was word and the word was with God and the word was God” (The Holy Bible, St. John).
স্যার জেম্স জীনসের কথায়, “The background of universe, the reality is Mind. “ মানে, বিশ্বদুনিয়ার সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মন। বিজ্ঞানী সালিভান বলেন— “The ultimate nature of universe is mental”. বিশ্বের চূড়ান্ত রূপই যেন মানসিক। ঠাকুর হয়ত একেই ‘আবেগ’ বা ‘ইচ্ছা” কিংবা ‘আকুতি’ বলেছেন। ঋকবেদের বর্ণনা, — In the beginning there was neither nought nor ought then there was niether sky, nor atmosphere above only the Existence. One breathed calmly self contained. Nought else but there was not else above, beyond, then turning inwards, He by self developed force of inner fervour and intense obstruction grew First in his mind was formed Desire, the primal germ, Productive which the wise, profoundly searching, Is the first subtle bond connecting Entity with Nullity.”
-(Rigveda Mondal x 129 ) From
“Hinduism” by Monier William.
এর মূল কথাই -- ‘সোহং পুরুষের ইচ্ছে থেকেই সৃষ্টির শুরু।
‘মহাবিস্ফোরণ’ তত্ত্ব নিয়ে বহু হৈচৈ ও সমর্থন থাকলেও এর বিরুদ্ধেও মতামত আছে এবং তৈরি হচ্ছে। দূর নক্ষত্র থেকে আসা আলোকতরঙ্গের দৈর্ঘ্য লালমুখো (বা লাল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মত), এটিই - “Big Bang’ থিওরির মূলে। কিন্তু ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী সুইকি “ক্লান্ত আলোক তত্ত্ব” প্রকাশ করেন। তাঁর মতে নক্ষত্র দূরে না সরে গেলেও, বহুদূরের ঐ নক্ষত্র থেকে আলো অনেক পথ অতিক্রম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মত হয়ে যেতে পারে। আর, নক্ষত্র দূরে সরে না গেলে নিশ্চয়ই আগে ওরা কাছে ছিল না। “Big Bang” ও তাই অসম্ভব। আবার, আলোর এই ক্লান্তি তত্ত্বও যে অব্যর্থ প্রমাণিত তা কিন্তু নয়। হাল আমলে, - উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে নানান পরীক্ষায় - ‘Big Bang’ তত্ত্বের বিরোধী সমস্ত ফলাফল আসছে। সেই ফলাফল মানতে গিয়ে ‘Big Bang’ তত্ত্বকে নানাভাবে পরিবর্তিত করতে হচ্ছে। জটিলতাও বাড়ছে ক্রমশঃ। বিজ্ঞানী সুমনারের পরীক্ষা ‘Big Bang’ তত্ত্বকে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিজ্ঞানের পথ যুক্তির পথ ।
পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে সত্য বেরিয়ে আসুক। এটাই কাম্য। ঠাকুরও তাই চাইতেন।
মাঝে মাঝে ভয় হয়, এই কারণসত্তার যান্ত্রিক অন্বেষণে আমরা যেন জীবনের মাধুর্য্যকে হারিয়ে না ফেলি। মহাসৃষ্টির কত আর পেছনে যাব? তার শেষ আছে কি? যেখান থেকে যেই শুরু করুক তার আগেও তো শুরু আছে। দয়াল ঠাকুর একদিন বসেছিলেন পার্লারে। স্বর্গীয় কেষ্টদার (রমনের সহযোগী যে স্বভাব-বিজ্ঞানী বলতেন, - ঠাকুরের সাথে একঘন্টা আলোচনা করার জন্যে আমাকে তার বহুগুণ সময় ধরে সেই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে হয়) সাথে সৃষ্টিরহস্য নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন। প্রচণ্ড ভাবাবেগে সৃষ্টির ক্রমশঃ পেছনে চলে যেতে যেতে ঠাকুর থমকে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ চুপ করে বলে উঠলেন, -
“কেষ্টদা, যত জানবেন তত জ্বালা ।” আনন্দের উপায় হল, – “To love, to serve, to surrender. “
ঠাকুরের মতে পর্যায়ক্রমিক সৃষ্টিধারা
‘পুণ্য-পুথি’ ও ‘বিজ্ঞান-বিভূতি’ বই থেকে যেমন বুঝেছি
______________________________________________
পাঠকদের সংগ্রহ
“প্রকৃত মানুষ হতে হলেই আমার জীবনে থাকা চাই একজন প্রেয় (Beloved the Lord)। আর তাঁতে হওয়া চাই concentric with indomitable, unrepelling adherence ( কেন্দ্রায়িত অদম্য ও অচ্যুত অনুরাগ নিয়ে)। মানুষের complex (বৃত্তি) গুলি মানুষকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তাঁতে যদি ভালবাসা বেশী থাকে তবে সেগুলি adjusted (নিয়ন্ত্রিত) হয়। আর ঐ অনুরাগদীপ্ত সক্রিয় শক্তির আগ্রহে মস্তিষ্কের fine traits (সূক্ষ্মগুণদীপনা) গুলি সব জেগে উঠে এবং individuality যাকে বলে ‘অখণ্ড ব্যক্তিত্ব’ তারও উদ্বোধন হয় ঐ পথে।” — শ্রীশ্রীঠাকুর
#সৃষ্টি_ও_বিবর্তনের_পথে
#thakurear_Aloke_bighean
#শ্রীশ্রীঠাকুরের_আলোকে_বিজ্ঞান
তৃতীয় সংস্করণ
#মণিলাল_চক্রবর্তী
https://www.amritokatha.in/
https://www.facebook.com/Amritokathaa
10