প্রজনন প্রসঙ্গে :-
পুরুষ আর নারী। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী। দু’জনে মিলে নিয়ে এল সন্তান। এরই নাম প্রজনন। প্রতিভাধরের ছেলে সবসময় প্রতিভাবান হয় না। সাধারণ বাবা-মার ঘরে জন্ম হয় ‘জিনিয়াস’দের। শুধুই কি পরিবেশ (ভালো স্কুল, স্বাচ্ছন্দ্যতা কিংবা অন্যান্য প্রভাব) একজনকে আমূল পাল্টে দিতে পারে? মোটেই না। তাহলে, অনেক ভালো ভালো কোচিং-এ পড়ে ছাত্ররা ফেল করত না। পরিবেশের প্রভাব কিছুটা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটাই সব নয়। পরিবেশ সহায়ক হলে (বা ক্ষেত্রবিশেষে কম হলেও) ‘জীন’গত বৈশিষ্ট্যের ওপরই মানুষের প্রতিভার বিকাশ নির্ভরশীল।
আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক্। মানুষের জন্মের (মায়ের জরায়ুর ভেতরে) ঠিক আগে থাকে দুটো কোষ। শুক্রাণু আর ডিম্বাণু। শুক্রাণু আসে বাবার কাছ থেকে। মিলনের সময়। ডিম্বাণু মা-র নিজস্ব সম্পত্তি। প্রতিমাসে একটা করে ডিম্বাণু তৈরি হয়। ডিম্বাশয় থেকে বেরিয়ে সে অপেক্ষা করতে থাকে তার প্রেমিক-শুক্রাণুর জন্যে। আর, শুক্রাণুরা বাবার মাধ্যমে যখন জরায়ুতে ঢুকল তখন ওদের সংখ্যা গড়ে পনের- তিরিশ কোটি। কিন্তু ডিম্বাণু ঐ একটিই। তার দরকার মাত্র একটি শুক্রাণুকেই। কোন্ শুক্রাণুকে সে কাছে টেনে নেবে?
আধুনিক বৈজ্ঞানিক মত
একটি শুক্রাণু হল একটি কোষ। গোল মাথার সাথে বিরাট লম্বা লেজ লাগালে যেমন দেখতে হয় আর কী। ঐ গোল মাথায় তেইশটা ক্রোমোজোম। এক একটি ক্রোমোজোমের ছোট ছোট খণ্ড একেকটি 'জীন'। প্রত্যেক জীন নির্দিষ্ট উৎসেচক (মানে, বিশেষ প্রোটিন) তৈরি করে ঐ কোষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়। ডিম্বাণুর বেলাতেও তাই। সেই তেইশটি ক্রোমোজোম। জরায়ুর পিচ্ছিল পথে কোটি কোটি শুক্রাণু তাদের লম্বা লেজ দিয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ডিম্বাণুর দিকে এগিয়ে আসে। কে আগে আসতে পারে? এ যেন অলিম্পিকে সোনা জয়ের লক্ষ্যে প্রচণ্ড দৌড়। আবার, আগে এলেই হবে না । তাকে হতে হবে রীতিমতো শক্তিশালী। শুক্রাণুর মাথার ঢাকনীর নাম 'অ্যাক্রোজোম'। প্রথমদিকে আসা শক্তিশালীতম শুক্রাণুটির 'অ্যাক্রোজোম' থেকে এবার বেরিয়ে পড়ল উৎসেচক রস। মুহূর্ত্তে তা গলিয়ে দিল ডিম্বাণুকে ঘিরে থাকা আবরণীর কোন একটি জায়গাকে। সেই ফাঁক দিয়ে ছোট্ট শুক্রাণু ঢুকে পড়ল প্রেমিকা-ডিম্বাণুর কোষহৃদয়ে। কেল্লা ফতে। ডিম্বাণু-শুক্রাণু মিলেমিশে তৈরি করল ‘জাইগোট’। ভবিষ্যৎ মানুষটির জীবন শুরু হল ঐ ‘জাইগোট’ কোষ দিয়ে। এর ক্রোমোজোম সংখ্যা দাঁড়াল ৪৬ (ছেচল্লিশ)। শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর যাবতীয় 'জীন' আশ্রয় পেল জাইগোটে। মোটামুটি সমধর্মী ক্রোমোজোমগুলি জোড়ায় জোড়ায় থাকতে শুরু করল। এবার শুরু হল 'জাইগোট' কোষের বিভাজন। একটি থেকে দু'টি। দু'টি থেকে চারটি। চারটি থেকে ... চলতেই থাকল। তার সাথে বিভিন্ন সময়ে ঐসব নানান 'জীনের' প্রকাশ ঘটতে থাকল।
“পুং বা স্ত্রী বীজাণুর অন্তরে থাকে ক্রমজম। মানে ক্ৰমান্বয়ী তাৎপর্যে উদ্গতি বা বর্দ্ধনায় অনুপ্রেরণ-সম্বেগ যার ভিতর নিহিত থাকে; এই ক্রমজমের অন্তরে আবার থাকে জনি, এই জনির ভিতরই অন্বিত বোধি তাৎপর্য নিয়ে অম্বিত গুণের চিতী-
সম্বেগ নিহিত থাকে। এই জনি-ক্ষরণ হতেই রজো বীজে মিলিত জৈবী-সংস্থিতি শারীর-জীবনে তদনুপাতিকভাবে উদ্ভিন্ন হয়ে উঠবার প্রেরণা পেয়ে থাকে, এমনি করেই প্রত্যেকটি বিশেষ বীজ ব্যষ্টিতে উদ্ভিন্ন হয়ে বিশেষ অভিব্যক্তিতে ব্যক্ত হয়ে ওঠে।”
—শ্রীশ্রীঠাকুর
এখানে,
ক্রমজম = ক্রোমোজোম
জনি = জীন
পুং বীজাণু = শুক্রাণু
স্ত্রী বীজাণু = ডিম্বাণু
'অন্বিত গুণের চিতী-সম্বেগ' কথাটি অনেকটা 'জেনেটিক কোড প্রকাশের উদ্যোগে'র সমার্থক।
মানুষটি লম্বা হবে না বেঁটে, ফর্সা না কালো, নীরোগ না অসুস্থ, বোকা না বুদ্ধিমান .... আরও কত কী! মনে রাখা দরকার ঐ ডিম্বাণুর দিকে এগিয়ে আসা কোটি কোটি শুক্রাণুর 'জীন'গত গঠন কিন্তু প্রত্যেকটার থেকে প্রত্যেকটা আলাদা। শুক্রাণু তৈরির বিশেষ পদ্ধতির (মিয়োসিসের ক্রসিংওভার) জন্যে এটি হয়ে থাকে। আমার জন্মের সময় ‘আমি শুক্রাণু’টি ডিম্বাণুকে না বিদ্ধ করলে আমি আর জন্মাতাম না। অন্য মানুষ সেখানে জন্ম নিত।
ঠাকুর বলেন—
সারা জীবন ধরে মানুষ স্মৃতি সঞ্চয় করে। মাথায় তার ছাপ থেকে যায়। মৃত্যুর সময় সেই স্মৃতিভাবগুলি মানুষটির চেতনায় ভেসে ওঠে। সারাজীবনের কর্মচিত্তার ভিত্তিতে সবশেষে একটি বিশেষ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী স্মৃতিভাবই শেষ সময়ের চেতনায় স্থায়িত্ব পায়। সেই সময় আত্মা (সূক্ষ্ম কম্পনশরীর) ঐ বিশেষ ভাবস্পন্দনটি নিয়ে দেহ ছেড়ে চলে যায়। স্পন্দনরূপ আকারে জীবদেহের সংস্করণ হিসেবে আত্মা ঘুরে বেড়ায়। নারী-পুরুষের মিলনকালে ঐ আত্মা সমভাববিশিষ্ট শুক্রাণুতে আবিষ্ট হয়। আবার মিলনের সময় মা-র মানসিক ভাব যেমন থাকে মায়ের ডিম্বাণুটিও সেই ভাব পায়। এবার, — ডিম্বাণুটি সেই শুক্রাণুকেই জড়িয়ে ধরে যার ভাব ডিম্বাণুটির সদৃশভাবাপন্ন। সেজন্যে, ডিম্বাণু- শুক্রাণুর মিলনে অন্য অনেক ‘ফ্যাক্টরের সাথে 'ভাব' নামেরও একটি 'ফ্যাক্টর' জড়িয়ে রয়েছে।
‘সন্তান' শব্দকে ভাঙলে পাওয়া যায়, সম + তান্। তান্ মানে সুর বা স্পন্দন। মিলনকালে, পিতামাতার ভাবভূমির সমতানসম্পন্ন বিদেহী আত্মা মায়ের গর্ভে আসে বলে তার নাম 'সন্তান'।
“মৃত্যুকালে যে ভাব ধ'রে
ছেড়ে শরীর যায় জীবন ।
জন্মে আবার তেমনই স্থানে
সেই ভাবের পথ পায় যখন।”
“অতিদৈহিক সত্তা জানিস
কাম-কামনার ভরে
ঘন হয়ে শুক্রাণুতে
বীজ শরীরটি ধরে;
শুক্রাণুটি সঙ্গত তার
ডিম্বকোষে মেশে,
কোষ-বিভাগে বেড়ে ওঠে
বৈশিষ্ট্যতে ভেসে।”
—অনুশ্ৰুতি ১ম খণ্ড, জনন-নীতি
সুপ্রজননে স্ত্রীর গুরুত্ব অনেক। স্ত্রীর পরিণতি ‘মা'তে। ‘ডিকশানারি’ বলে,— যিনি সন্তানকে পরিমাপিত করে দেন, তিনিই মা। তার মানে সন্তানের ক্ষমতা ঠিক হয়ে যায় মিলনকালে। মায়ের ভূমিকা যেখানে বিরাট। ঐ সময়ে স্ত্রী যে ভাবের দ্বারা স্বামীকে উদ্দীপ্ত করবে বা স্বামীর যে বৈশিষ্ট্যগুলিতে সবচেয়ে আকর্ষিত হবে, সেই ভাবেরই (বা - বৈশিষ্ট্যের) শুক্রাণুকে সে ডিম্বাণুতে ডেকে নেবে। তার মানে, স্বামীর ভালো গুণগুলির প্রতি স্ত্রীর অনুরাগ দরকার। সেই অনুরাগের ফলে, মিলনকালে স্ত্রী স্বামীর ততটুকু তেমনতরভাবে সন্তানে ফুটিয়ে তুলতে পারে। তাই, সুসন্তান জন্মানোর অন্যতম উপায় স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অনে- এ-এ-ক নিখাদ ভালোবাসা। এবং তেমনি গুণবান স্বামীও।
“স্বামীর প্রতি টান যেমনি
ছেলেও জীবন পায় তেমনি।”
—শ্রীশ্রীঠাকুর, উপাসনা’ ৩৫ পৃষ্ঠা।
স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এই উন্মুখ টানই সন্তানের নানান বৈশিষ্ট্যের “measuring factor.”
আর, স্বামী-স্ত্রী প্রতিদিন ঝগড়া-ঝাঁটি লেগে থাকলে মিলনকালে স্ত্রী স্বামীর ভালো গুণগুলির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে না। করতে পারে না। ফলে, স্ত্রী সেইভাবে স্বামীকে উদ্দীপ্ত করতেও ব্যর্থ হয়। তাই, সন্তান
সেখানে মানসিক বিকৃতি (সেই ভাবের সদৃশ) নিয়ে জন্মায়।
আবার ঠাকুর বলেন—
“অনুরাগী আবেগ-টানে
পেতে গিয়ে স্বামীর প্রীতি,
পাওয়ার পথের বাধার তোড়ে
ঘটলে মনের কু-বিকৃতি,
যেমন ভাবে যে অঙ্গেতে
নারীর যেমন বিকার ফলে,
সন্তানেরও সে অঙ্গটি
বিকৃতি পায় তেমনি হলে।”
—অনুশ্রুতি ১ম খণ্ড, জনন-নীতি ১৯
সহজ বোধে ঠাকুর জন্মপ্রতিবন্ধী সন্তান হওয়ার অন্যতম কারণের দিকে আঙুল তুললেন। প্রজনন-বিজ্ঞানের এমন কথা গবেষণার পরম সম্পদ।
ডিম্বাণু কোষ যেন মাটির মতন। সযত্নে বাড়িয়ে তোলে শুক্রাণুরূপ চারাগাছটিকে। মাটি ভালো না হলে গাছ বাড়বে কিভাবে? ভালো আম ফলাতে গেলে মালদা-র মাটি চাই। তরমুজ গাছে বেলেমাটি। ধানের জন্যে উপযুক্ত পলি। ডিম্বাণুকোষের ক্রোমোজোম পোষণ দিয়ে যাবে শুক্রাণুর ক্রোমোজোমকে। মাটি বৃদ্ধি করায়, গাছ বৃদ্ধি পায়।
হঠাৎই সহজিয়া ঠাকুর তাই বলে চলেন,— “প্রতিমার কাঠামো দেখেছিস তো? শুধু সেখানে কতকগুলি কাঠ দিয়ে তা তৈরি হয়। তাই কিন্তু আসল জিনিস। কুম্ভকার তার ওপর খড়, মাটি, রং-চং করে
প্রতিমাকে সুন্দর করে তৈরি করে দেয়। মায়ের ভূমিকাও তেমনতর।
এতদিন ধরে ইউজেনিক্স' কিংবা সুপ্রজননবিদ্যা জমিতে অনেক ধান ফলিয়েছে। সবুজ বিপ্লব ঘটিয়েছে। গরুর দুধ বাড়িয়েছে। কুকুরকে তেজী করেছে। মুরগীর মাংস বাড়িয়েছে। কিন্তু, চরিত্র সৃষ্টিতে সে বড় অসহায়! মানুষের কোষে তেমনভাবে তার হাত পড়েনি। ভবিষ্যতে আমাদের চাহিদা হবে কর্মোচ্ছল, উদ্যমী, স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান মানুষের। দেশী-বিদেশী নানান স্পার্মব্যাঙ্কে সঞ্চিত রাখা হয়েছে খেলোয়াড়- বিজ্ঞানী-রাজনীতিবিদদের শুক্রাণু। এগিয়ে চলেছে 'জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং'। নানান রাসায়নিকের গোলকধাঁধায় কখনও বিভ্রান্ত বিজ্ঞানীকূল, কখনও নতুন পথের সন্ধানী। ঠাকুরের বলা প্রজনন-তত্ত্ব এখনও তাঁদের চিন্তায় অধরা। সময়ের দাবিতে সত্য উদ্ঘাটিত হোক । ঋষির ধ্যানোপলব্ধি আর বিজ্ঞানীর গবেষণা মিলে যাক 'ইউরেকা' শব্দে।
“যে ভাবেতে স্বামীকে স্ত্রী
করবে উদ্দীপিত
সেই রকমই ছেলে পাবে
তেমনি সঞ্জীবিত।”
"বিয়ে ব্যাপারে সবার আগে
বর্ণের হিসেব করিস্
তার সাথেতেই বংশটিকে
বেশ খতিয়ে দেখিস্ ;
বংশ দেখে শ্রদ্ধা হলেই
স্বাস্থ্য দেখিস্ কেমন তা'র,
তার সাথে তুই বাজিয়ে নিবি
স্বভাব-অভ্যাস- ব্যবহার;
এ সবগুলির সুসঙ্গতি
মিলেই যদি যায়,
বিদ্যা দেখিস্ নজর কারে কর্ম্মের ওজন তায়;
পারম্পর্য্যে এইগুলি সব
মিলিয়ে দিলে বিয়ে,
প্রায়ই দেখিস্ ঠক্বি না তুই
মরবি না বিষিয়ে । ”
—অনুশ্ৰুতি ১ম খণ্ড, বিবাহ-২
#প্রজনন_প্রসঙ্গে
#শ্রীশ্রীঠাকুরের_আলোকে_বিজ্ঞান
#thakurear_Aloke_bighean
তৃতীয় সংস্করণ
মণিলাল চক্রবর্তী
https://www.amritokatha.in/
https://www.facebook.com/Amritokathaa
10