বিজ্ঞান ও ধর্ম :-
এ শতাব্দী বিজ্ঞানেরই। যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ। বিজ্ঞানের নেশায় মানুষ ছুটে চলেছে। নিত্য নতুন জিনিস আবিষ্কার করে দেশের, পৃথিবীর সম্পদ বৃদ্ধি করছে। আপাত অবাস্তবকে বাস্তবে রূপায়িত করে অসম্ভব সম্ভব করছে। ওষুধ বের করে মৃত্যুকে রোধ করে জীবন আহ্বান করছে। বিস্ময়কর পারমাণবিক বোমা বানিয়ে শক্তির বড়াই করছে। সেই বোমাই দেশের এত সম্পদ আর প্রাচুর্যের মাঝেও শান্তিপ্রিয় নাগরিককে ত্রস্ত করে তুলছে। এত সবের মধ্যে ধর্মচিন্তার অবকাশ কোথায়? ঐসব পুরানো জিনিসের আর দরকার কি? তবে, এ-দু’য়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য আছে কিনা, একটাকে বাদ দিয়ে আর একটা চলতে পারে কিনা একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখাই যাক না।
প্রথমেই ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’ কথা দু’টির মানে জানা দরকার। ধর্ম হল তাই, যা অবলম্বন করে চললে জীবনটা ধারণ করার অর্থাৎ বাঁচিয়ে রাখবার পক্ষে সহায়ক হয়। (’ধর্ম’ কথার উৎপত্তি সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতু থেকে যার মানে ‘ধারণ করা’)। আবার বাঁচাটাই শুধু ধর্ম নয়। বিবর্তনের প্রথম দিন থেকেই স্বীয় সত্তাকে রক্ষা করে কেমন করে তাঁকে বর্দ্ধনমুখর করে রাখা যায়, উত্তরোত্তর তারও চেষ্টা চলেছিল ঐ ক্ষুদ্র জীবকণিকার মধ্যে। তাই ধর্মের মধ্যে অস্তিত্ব রক্ষা আর তার বিকাশ দুই-ই রয়েছে। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন — “সপরিবেশ স্বীয় সত্তাকে যেমন করে ধারণ ও পোষণ করা যায় বর্দ্ধন ও সংরক্ষণ করা যায়, বৈশিষ্ট্যপালী আপুরয়মাণ সুকেন্দ্রিক অনুচর্যা নিয়ে, তাই কিন্তু ধর্ম।”
আর ‘বিজ্ঞান’ তো ‘বিশেষ জ্ঞান’। শ্রীশ্রীঠাকুর এই বিশেষ জ্ঞান বলতে বলেছেন যে, “কোন কিছু কেমন সংস্থান ও সঙ্গতির ভিতর দিয়ে কী পরিণতি বা ফল প্রসব করে, তা জানাই তো বিজ্ঞান।”
বাঁচতে গেলে ও বাড়তে গেলে কীভাবে বাঁচা যায়, তার জ্ঞান দরকার। বাঁচতে গেলে খেতে হবে। খেতে গেলে শস্য উৎপাদন করতে হবে। তাই কৃষিবিদ্যা বা কৃষিবিজ্ঞান জানা দরকার। আবার কৃষিকাজ করতে গেলে লাঙল বা ট্রাক্টর দরকার। আর তার সাথে জমিকে উর্বরা করে তোলবার জন্য সার এবং জলসেচের ব্যবস্থা করাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। লাঙল তৈরির জন্য কামারের কাজ এবং ট্রাক্টর তৈরির জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান দরকার। কামারের কাজ জানা বা ইঞ্জিনিয়ারিং জানা এ দু’টোই এসে পড়ে নেহাৎ কৃষিকাজ করার তাগিদেই। তেমনি আবার সার উৎপাদনের জন্য রসায়ন-শাস্ত্র সম্বন্ধে পারদর্শিতা দরকার যার দরুন হয়ত সিন্ধ্রি ফারটিলাইজিং ট্যাঙ্কের মত আরো বহু সার উৎপাদক কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন হয়ে ওঠে। আলো, বাতাস, জল এই তিনটি জিনিসের দরকার শস্য উৎপাদন করার জন্যে। বাতাস ও আলো প্রকৃতি প্রদত্ত এবং তা না হয় স্বাভাবিক উপায়েই পাওয়া গেল। কিন্তু জলের অনটন অনেক সময়ই কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটায়। তাই বর্তমান বিজ্ঞান কৃত্রিম উপায়ে জলসেচের ব্যবস্থা করে অনাবাদী জমিকে শস্য-শ্যামলা করে তুলছে। এই জলসেচের জন্য বৈদ্যুতিক জলপ্রবাহের বা বাঁধের ব্যবস্থা করে জলাভাব মেটানো হচ্ছে। পাঞ্জাবের ভাক্রা-নাঙ্গাল, পশ্চিমবঙ্গের দামোদর বাঁধ প্রভৃতি সেচবিজ্ঞানের অপূর্ব নিদর্শন। একটি বৈদ্যুতিক বোতাম টিপলেই সারা মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, গ্রাম চতুর্দিকেই পরিমিত জলরাশির প্রাচুর্য সম্ভবপর হয়ে উঠছে। কি আশ্চর্য! মানুষের বাঁচবার তাগিদে কত-শত অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কৃত হয়ে গেলো! এরই সাথে আবার উপযুক্ত শিক্ষার দরকার, আচরণশীল হবার দরকার, সুনিয়ন্ত্রিত হবার দরকার। এইজন্যে শিক্ষা- বিজ্ঞান তার বহুমুখী প্রতিভা ও দিক্ নিয়ে মানুষের সামনে এসে হাজির হচ্ছে। কৃষিবিজ্ঞান, যন্ত্রবিজ্ঞান, শিল্পবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান ইত্যাদি সবই মানুষের বাঁচবার ও বাড়বার জন্যে অপরিহার্য ও স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয়ে এসেছে। অতএব, বিজ্ঞান বাঁচা-বাড়ার প্রয়োজনই আমন্ত্রিত। আর আগেই বলা হয়েছে— বাঁচা বাড়াই ধর্ম। তাই, বিজ্ঞান না জানলে ধর্মের গতিও শ্লথ হয়ে পড়ে। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন,—
“যে বিজ্ঞান সত্তা সংস্থিতিকে বিধ্বস্ত করে তোলে তা অধর্ম । আর যে বিজ্ঞান সত্তা-সংস্থিতিকে অর্থাৎ সত্তার রক্ষণ, শোষণ, পূরণকে আবাহন করে তাই ধর্ম।”
আমাদের দেশের রসায়নবিদ কণাদ পরমাণুতত্ত্বের নানান দিকের কথা বলেছিলেন। মহর্ষি ভরদ্বাজ বিমানশাস্ত্র সম্বন্ধে অপূর্ব তথ্য আবিষ্কার করে গেছেন। তাঁরই রচিত ‘যন্ত্রসর্বস্যম্’ বিমান গবেষণার ওপর প্রামাণ্য গ্রন্থ। যে ধাতুর সংমিশ্রণে সে যুগে বিমান তৈরি হত সেগুলি ছিল অদাহ্য। দু’টি বিমান আকাশে পাশাপাশি যাবার সময় সংবাদ আদান- প্রদান করার কথাও এখানে আছে। চালকদের কেমন খাদ্য নেওয়া দরকার এবং কেমন করে বিমান দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ইত্যাদির বিবরণও ঐ পুস্তকে বর্ণিত । খবরের কাগজেও ঐ বই সম্বন্ধে অনেক তথ্য বেরিয়েছিল। ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে তখন ঐ পুস্তকের সম্বন্ধে আরও তথ্যাদি জানবার জন্য আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলাম।
চিকিৎসা-বিজ্ঞানে চরক, সুশ্রুত আজও সর্বজন পূজ্য। বুদ্ধদেবের গৃহ-চিকিৎসক ছিলেন জীবক। তিনি শল্যবিদ্যায় এত পারদর্শী ছিলেন। যে মাথার করোটী খুলে তার অভ্যন্তরস্থ রোগ সারিয়ে আবার করোটী জুড়ে রোগীকে ভালো করে তুলতেন। একসময় তক্ষশীলায় আচার্য আত্রেয় জীবককে ও অন্যান্য শিষ্যদের আশেপাশের স্থানে ৮।১০ মাইলের মধ্যে নির্গুণ কোন উদ্ভিদ পাওয়া যায় কিনা তা অনুসন্ধান করতে আদেশ দেন। অন্যান্য শিষ্যগণ একাধিক উদ্ভিদ সংগ্রহ করে গুরুর নিকট এসে দেখালেন। বহু বিলম্বে রিক্ত হস্তে ফিরলেন জীবক। ভেষজ হিসাবে নির্গুণ কোন বৃক্ষ তাঁর চোখে পড়েনি। আচার্যদের বুঝলেন, গুণাগুণ সম্বন্ধে জীবকের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়েছে (’বিজ্ঞানের ইতিহাস’— শ্রীসমরেন্দ্র নাথ সেন)। এ দ্বারা বোঝা যায় যে, জীবকের জ্ঞান কত গভীর ও ব্যাপক ছিল। বলা বাহুল্য, শ্রীশ্রীঠাকুরের ঘরে চরক ও সুশ্রূত প্রণীত গ্রন্থাদি সযত্নে রক্ষিত। তা তিনি প্রয়োজনবোধে ব্যবহার করতেন।
জ্যোতিষশাস্ত্রেও ঠাকুরের অনুসন্ধিৎসা ছিল প্রগাঢ়। বিভিন্ন জ্যোতিষশাস্ত্রের গ্রন্থ তিনি সংগ্রহ করে এনে শিষ্যদের দিয়ে পড়াতেন। নিজে তাদের সাথে ঐসব বিষয়ে আলোচনা করে শিক্ষা দিতেন ও শাস্ত্রীয় তুক্ গুলি উদ্ঘাটন করতে সহায়তা করতেন।
জ্যোতিষশাস্ত্রে পাল, বিপল, অনুপল ইত্যাদি সময়ের সূক্ষ্মাতি- সূক্ষ্ম অংশ নিয়ে জ্যোতিষীরা যে হিসাবপত্র করতেন, তাতে মনে হয় হিসাবপত্র সম্বন্ধেও তাদের জ্ঞান খুব সূক্ষ্ম ছিল এবং তাতে তাঁদের সূক্ষ্ম মস্তিষ্কের পরিচয় দেয়। তা ছাড়া ভৃগুমুনির কোষ্ঠী তৈরিও এক আশ্চর্য ব্যাপার । বর্তমান জীবনের কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের বাস্তব ছক আজও তৈরি করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে ভৃগুসংহিতাকে অবলম্বন করে। তা ঠিক না বেঠিক
বলার জন্যে আরও গবেষণার প্রয়োজন। এসব থেকেও বোঝা যায়। —আমাদের দেশে বিজ্ঞানের সাধনা একসময়ে অনেক উঁচুতে পৌঁছেছিল। -
তবে তাঁরা যেমন বিজ্ঞানী ছিলেন তেমনি আবার সাধকও ছিলেন। সেজন্যেই তাঁদের ঋষি বা আচার্য বলে অভিহিত করা হত। তাঁদের যে জ্ঞান ছিল তা সংশ্লেষণাত্মক ও বিশ্লেষণাত্মক উভয়মুখীই। সংশ্লেষণাত্মক মানে, কোন জিনিস সূক্ষ্মতম অবস্থা হতে কেমন করে বিন্যাস ও সান্বয়ী সমাবেশে সম্পূর্ণাঙ্গ হয়ে ফুটে উঠেছে সেই জ্ঞান। আর বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞান মানে, সম্পূর্ণ একটা জিনিসকে বিশ্লেষণ করে তার মূল সূত্রটির দিকে অগ্রসর হওয়া। যেমন জল, কী অবস্থায় কী কী উপাদান দিয়ে কেমন করে বিন্যাস ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে জলে (প্রোটন— ইলেকট্রন— নিউক্লিয়াস— পরমাণু— অণু— হাইড্রোজেন — অক্সিজেন — জল) রূপান্তরিত হল, তার নাম সংশ্লেষণাত্মক জ্ঞান। অপর পক্ষে, জলের গঠনের জন্যে দায়ী সূক্ষ্মতম উপাদানগুলিকে ক্রম পর্যায়ে (জল— অক্সিজেন— হাইড্রোজেন অণু পরমাণু — নিউক্লিয়াস— প্রোটন— ইলেকট্রন ... ইত্যাদি) জানার নাম বিশ্লেষণাত্মক জ্ঞান।
তাই ঋষিদের জ্ঞানের মধ্যে কিছু বাদ যেত না। আর তাঁদের সূক্ষ্ম সংবেদনশীল শারীরিক বিধানগুলিই ছিল তাঁদের শ্রেষ্ঠ যন্ত্র। নামধ্যান বা তপস্যাই ছিল তাঁদের হাতিয়ার যার মাধ্যমে তাঁরা অগ্রসর হতেন। কোন জিনিসকে বোধের পাল্লায় আনার জন্যে ঐ ‘নাম’ই ছিল তাঁদের পরম সম্বল। ‘নাম-ধ্যান-প্রার্থনা’ প্রবন্ধে নাম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কারণ ‘বীজাত্মক নাম’ তাঁরা আচার্য-সকাশে পরম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসার সহিত গ্রহণ করতেন। ঐ সৎনাম নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় জপ করে এবং তার সাথে আচার্যে সক্রিয় ভালবাসা ও অনুরতির আকুল আবেগে মস্তিষ্ককোষ সমূহকে সাড়াবাহী ও বোধপ্রবণ করে তুলতেন। এটা অবিজ্ঞান নয়। এটাও বিজ্ঞানসম্মত বাস্তব পদ্ধতি। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন যে, “সৎনাম নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় জপ করার দরুন মস্তিষ্ক কোষ আন্দোলিত হয়ে একটা আন্তঃকৌষিক দহন (Intercellular combustion) সৃষ্টি করে। এতে কোষগুলির সুসামঞ্জস্য পূর্ণ গতিসম্বেগ বেড়ে যায় এবং প্রত্যেকটি কোষের সাথে প্রত্যেকটি কোষের একটা যোগসূত্র রচিত হয়। আর ঐ যোগসূত্র রচনা হওয়ার দরুন কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে সমস্ত কোষগুলিই ঐদিকে নিবিষ্ট হয় এবং তার তত্ত্ব উদ্ঘাটন করতে সহায়তা করে।” ফলে, কোন কিছু খুব তাড়াতাড়ি বোধগম্য হয়। এ জিনিসটা এখনও অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। করে না দেখলে ঠিক ঠিক বোধ হয় না। জলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আছে, তা কথায় বললে কিছুই বোঝা যায় না। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে ও যান্ত্রিক উপায়ে তা বুঝতে হয়। এও ঠিক তেমনি করে দেখার জিনিস। যারা করেছেন, তাঁরাই বুঝেছেন ও বলে গেছেন।
ঋষিরা বোধপ্রবাহী স্নায়ু (Sensory nerve) সহায়তায় একটা জিনিসকে বোধের পাল্লায় এনে যেমনভাবে রূপ দেবার দরকার ঠিক তেমনভাবেই যান্ত্রিক জিনিসপত্রের সহায়তায় তার রূপও দিতেন। তাঁরা মানবসমাজে শ্রদ্ধার ও পূজার পাত্র হয়ে থাকতেন আচরণসিদ্ধ আচার্য বা দ্রষ্টা হয়ে।
অপরপক্ষে জড়বিজ্ঞানের বর্তমান বৈজ্ঞানিকগণ যন্ত্রকে তাঁদের আবিষ্কারের মুখ্য উপায় বলে ধরে নিয়েছেন এবং তার মাধ্যমেই তাঁরা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে অগ্রসর হন। ফলে, বহু জিনিস সম্বন্ধে তাঁদের জানার খাঁকৃতি থাকাও অসম্ভব না। কারণ, এমন বহু জিনিস আছে যা যন্ত্রের সাহায্যে ধরা অসম্ভব এবং তেমন সুক্ষ্মযন্ত্র আজও আবিষ্কৃত হয়নি। অবশ্য বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের তীব্র তন্ময়তা আর চিত্তাপরায়ণতার দরুন অনেক অসম্ভব জিনিস যে তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডারে আসছে তাতে সন্দেহ নেই।
তবে, বিজ্ঞানীদের সাথে ঋষিদের পার্থক্য এই যে, ঋষিদের চিত্তা বাস্তব জীবনদর্শনকে নিয়ে। জীবন্ত আদর্শকে কেন্দ্র করে, এবং তাঁকে অনুসরণ করে, ভালবেসে ও তাঁর পরিপূরণের চাহিদায় তাঁরা একটা ক্রমবর্ধমান জীবনসম্বেগ নিয়ে এগিয়ে চলেন। অপরপক্ষে বিজ্ঞানীরা একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে তৎচিন্তা পরায়ণতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন। পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করে তার কার্য-কারণ সম্বন্ধও নির্ণয় করেন। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁদের তন্ময়তা নিবদ্ধ থাকে বলে ঐ বিষয়ের মধ্যেই তাদের জ্ঞানটা সীমাবদ্ধ থেকে যায়। হয়ত পরমাণু নিয়ে যিনি গবেষণা করেন তার জ্ঞানটা বিশেষ করে পরমাণু-তত্ত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এর সাথে অন্যান্য বিষয়ের বা তত্ত্বের কী সম্বন্ধ থাকে তার বাস্তব যোগসূত্রটা তাঁদের কাছে প্রায়শঃই অনুদ্ভাসিত হয়ে থাকে। কিন্তু যাঁরা ধর্ম ও বিজ্ঞানের মূর্ত প্রতীক, যাঁদের কাছে দুই-ই একটা সহজ সমন্বয়ে সার্থক হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তা দেখা যায় না। বোধ ও ধারণ ক্ষমতা তাঁদের প্রবল বলে এবং নিয়ত অভ্যাসযোগের সহায়তায় সমস্ত কোষকে সাড়াবাহী করার দরুন সামগ্রিক একটা বিকাশ তাঁদের মধ্যে প্রায়শঃই পরিলক্ষিত হয়। যেমন, মহর্ষি পাণিনি বৈয়াকরণ ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রণীত ব্যাকরণের মধ্যে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের একটা সামগ্রিক সমন্বয়ও দেখা যায়।
বিজ্ঞানী যে একচিত্তাপরায়ণতার দরুন অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করে চলেছে সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আর্কিমিডিস্ আপেক্ষিক লঘিমা নিয়ে এত তন্ময় হয়ে থাকতেন যে, স্নান করতে চৌবাচ্চায় নেমে এক নতুন সত্য আবিষ্কার করে ফেললেন। বিজ্ঞানী কেকুলের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। তিনি একসময়ে বেঞ্জিন নামের যৌগিক পদার্থের গঠনতত্ত্ব নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিছুতেই তা বের করতে পারছিলেন না। এ নিয়ে বহুদিন তিনি গবেষণাও করেন। অবশেষে তিনি যখন একদিন শ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে গবেষণাগার থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছিলেন, তখন হঠাৎ রাস্তার মাঝে তাঁর চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল নর্তনরত বেঞ্জিন অণুর পরমাণুকণাগুলি। এগুলি বৃত্তাকারে সজ্জিত অবস্থায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোক-কণাবৎ পর্যায়ক্রমে নাচতে লাগল। তা দেখে কেকুলে অবাক হয়ে গেলেন। ঐ মানস-দর্শনের সাহায্যে তিনি বেঞ্জিন অণুর গঠন আবিষ্কার করেন। আর এ গঠন আবিষ্কার হওয়ার দরুন আজ অসংখ্য যৌগিক পদার্থ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানলাভের সুবিধা হয়েছে। বহু ওষুধপত্র, গন্ধদ্রব্য, প্রয়োজনীয় রাসায়নিকে বেঞ্জিনের প্রভাব প্রত্যক্ষ ।
আপাতদৃষ্টিতে কেকুলের এই দর্শনকে অলৌকিক ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কিন্তু মনোবৈজ্ঞানিকগণ বলেন যে, মস্তিষ্কের বৃহত্তর অগ্রভাগের মধ্যে যে শ্রবণ এবং দৃষ্টি সম্পর্কিত স্নায়বিক কেন্দ্র আছে তারই স্বয়ংক্রিয় উত্তেজনার দরুন শব্দ ও জ্যোতির অনুভব হয়ে থাকে (Perception of light and sound is due to the auto- stimulation of the auditory and optic nerve centres in the cerebrum)। অপরপক্ষে ঋষিরা বলেন, আমাদের শারীরিক বিধানের মধ্যে ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার দরুন বিশেষ বিশেষ প্রকার শব্দ ও জ্যোতি অনুভব হয়ে থাকে। কেকুলের পরমাণুরূপ জ্যোতিদর্শন তারই ইঙ্গিত করে। ঐকান্তিক আগ্রহই তাঁর এই আবিষ্কারের মূল।
টমাস হেনরী হাক্সলে বলেন, অলৌকিক বা আকস্মিক ঘটনা বলে কিছু নাই। তা অজ্ঞতারই একটা বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গী মাত্র।’ (”Chances and accidents are only allies of our ignorance”) প্রত্যেক ঘটনারই একটা কার্য-কারণ সম্বন্ধ আছে। যেমন রাত্রিবেলায় বৈদ্যুতিক বোতাম টিপলে আমরা বিদ্যুতের আলো দেখতে পাই। তার মানে, ঐ আলোক কণাগুলি ছুটে এসে আমাদের অক্ষিপটে ধাক্কা দেয় । তারপর সেটা দৃষ্টি সম্পর্কিত স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে তড়িৎবেগে দর্শনকেন্দ্রে চলে যায় এবং সেখানকার কোষ ও স্নায়ুগুলিকে বিশেষ বিশেষভাবে উত্তেজিত করে। তখনই আমরা বুঝতে পারি যে আলোটা বিদ্যুতের। এতখানি ব্যাপার মুহূর্তের মধ্যে সংগঠিত হয়ে গেল। তবেই বোঝা গেল যে, আমাদের মস্তিষ্কের যন্ত্রপাতিগুলি ও বিধানসমূহ কত সূক্ষ্ম ও বোধপ্রবণ, কর্মঠ ও ন্যায়পরায়ণ।
সে যাই হোক, তবে চোখের সামনে ঐ বিদ্যুতের আলো না থাকা সত্ত্বেও আলো দেখা সম্ভব, যদি বিজ্ঞানসম্মতভাবে দর্শনকেন্দ্রের কোষ ও স্নায়ুগুলিকে তদনুরূপ উত্তেজিত করা যায় বাইরের ঐ প্রকারের বৈদুতিক আলোর সাড়া না পেয়েও। শুধুমাত্র আলো নয়— বহু রকমের শ্রবণ, দর্শন জ্যোতি ইত্যাদির আবির্ভাবও অসম্ভব নয় যদি ঐ শ্রবণ ও দৃষ্টিসম্বন্ধীয় স্নায়বিক কেন্দ্রকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে স্বয়ং উত্তেজিত ও আন্দোলিত করা যায়। তারও একটা নির্দিষ্ট পন্থা আছে। তা আবোল- তাবোল ভাবে নয়। সেজন্যে দ্রষ্টা পুরুষ বা ঋষিগণ ঐ সকল মরকোচ (Mechanism) আয়ত্ত্বে এনে আমাদের সোজা কথায় ইষ্টকেন্দ্রিক বা শ্রেয়কেন্দ্রিক হওয়ার কথা বিশ্লেষভাবে বলে গেছেন। বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন জ্ঞানেন্দ্রিয়াদির শক্তি ও বোধপ্রবাহী স্নায়ুর বোধক্ষমতা বাড়াবার কথা বলে গেছেন। শুধু তাই নয়, তার উপায় নির্ধারণ করাই হচ্ছে বৈজ্ঞানিকদের একটা অতি প্রধান ও দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য। সে কথাও তিনি বলেছেন।
যুগ যুগ ধরেই ধর্মপন্থীরা তার উপায় উদ্ঘাটন করে এসেছেন। আর আজকের দিনে শ্রীশ্রীঠাকুর স্নায়ুর বোধক্ষমতা ও সক্রিয়তা বাড়াবার বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার কথা বলে গেছেন। কিভাবে ইন্দ্রিয়ানুভব ও ক্ষমতাকে বাড়ান যায় তার কথাও শ্রীশ্রীঠাকুর বলে গেছেন। সবার জন্যেই এ পন্থা উন্মুক্ত। শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত আশ্রমটিও ছিল বিরাট কর্মের যজ্ঞশালা। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন, “বিজ্ঞান নিজেই অমৃতের পথপ্রদর্শক। বিজ্ঞান দেখিয়ে দেয় আমরা কী করে সুখে থাকব, বৃদ্ধি পাব, বেঁচে থাকব। তাই ধর্ম নিজেই বিজ্ঞানকে নিমন্ত্রণ করে।’ শ্রীশ্রীঠাকুর আরো বলেন যে, বিজ্ঞানী যদি যুগপৎ সাধক এবং গবেষক হন তবে যে সমস্ত সাত্বত কল্যাণময় দর্শন তাঁর সম্মুখে এসে হাজির হয় তা Sensation (ইন্দ্রিয়ানুভূতি) দিয়ে আসে এবং সেগুলিকে যখন তিনি বাস্তবে গবেষণার ভেতর দিয়ে মূর্ত করে দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন তখন তাঁকে সংশ্লেষণের পথ অবলম্বন করতে হয়। যখন একজন মানুষের মধ্যে এই দুটি জিনিসের (অনুভূতি ও সংশ্লেষণাত্মক বিন্যাস) সার্থক সমন্বয় হয়, তিনিই হয়ে ওঠেন একাধারে সাধক ও বিজ্ঞানী।
#শ্রীশ্রীঠাকুরের_আলোকে_বিজ্ঞান
#thakurear_Aloke_bighean
তৃতীয় সংস্করণ
মণিলাল চক্রবর্তী
https://www.amritokatha.in/
10