[P-1] দুর্ভোগের কারণ । অশ্বমেধ যজ্ঞের তাৎপর্য । শম্বুক । শ্রীরামকৃষ্ণদেব । হিটলার । স্বস্তয়নী। আর্য্যসভ্যতা । আশ্রমেকাজের প্রয়োজনীয় মানুষ
ইদানীং প্রচণ্ড গরম পড়েছে — দুপুরের দিকে আশ্রম - সংলগ্ন চরের বালু তেতে আশ্রমের সামনের দিকের আবহাওয়াটা অগ্নিময় করে তােলে । বেলা প'ড়ে আসলে অবস্থাটা ধীরে - ধীরে সহনীয় হয়ে ওঠে ।
আজ বিকালে শ্রীশ্রীঠাকুর কিশােরীদার ঘরের পাশে বাবলাতলায় কাঠের ঘরে ( Philanthropy Office- এ ) আসর বিছিয়েছেন — দেখতে - দেখতে ভিড় জমে উঠলাে — আলাপ - আলোচনা জমাট বাধতে লাগলো - হেমদা ( দে ) হিটলারের আত্মজীবনীর কথা শ্রীশ্রীঠাকুরকে বলছিলেন — শ্রীশ্রীঠাকুর একটা জায়গা দাগিয়ে রাখতে বললেন — হিটলার সেখানে বলেছেন- Upstart ( হঠাৎ বড়লােক ) যারা তারা হীন অবস্থার লোকের সঙ্গে মিশতে পারে না , ভয় হয় , তাদের পূর্বেকার দুরবস্থা বুঝি লােকে টের পাবে - তাদের সম্মান কমে যাবে । শ্রীশ্রীঠাকুর এই কথা শুনে বললেন— “ কিন্তু সত্যিকার বড়লােকের এমনটি হয় না । ” হেমদা হিটলারের জীবনী থেকে দেখালেন যে হিটলার ঠিক সেই কথাই লিখেছেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — এই inferiority complex ( হীনম্মন্যতাবােধ ) চ'লে গেলে তারা কিন্তু খুব বড় হয়ে ওঠে । ( কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন ) বাইরে থেকে আমরা গরীব লোকের যে problem ( সমস্যা ) মনে করি , সেটা কিন্তু আদত problem ( সমস্যা ) নয় । ওদের সঙ্গে এক হয়ে মিশলে তবে বােঝা যায় , তাদের অসুবিধা কী ও কোথায় এবং তার প্রতিকার কী । মানুষের দুর্ভোগের পিছনে থাকে সাধারণতঃ কতকগুলি চরিত্রগত ত্রুটি , তার নিরাকরণ না হ'লে দুর্ভোগ যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর নিজে কুলী সেজে , কুলীর দলে মিশে , কুলীর কাজ করে তাদের দুঃখের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন কিভাবে , সেই গল্প করলেন ।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব - সম্বন্ধে কথায় - কথায় বললেন — রামকৃষ্ণঠাকুর যে কী দিয়ে গেলেন , কেউ বুঝলো না । অনেকে তাকে নকল করবার চেষ্টা করে কিন্তু নকল ক'রে কি আর তা হওয়া যায় ?
কালীদা ( সেন ) একজনের কথা তুললেন — হাবভাব - ভঙ্গীতে তিনি নাকি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে অনুকরণ করতেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন— Admiration
(শ্রদ্ধা ) থাকলেই বাঁচোয়া , নচেৎ ও - রকম করা অনেক সময় বিপজ্জনক । বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়ে হীনত্ববোধের তাড়নায় , কৃত্রিম চালচলন নিয়ে চলা ভাল নয় । ওতে মানুষ আত্মপ্রতারণার পথে এগিয়ে চলে ।
শিশুপালের কথাও এই প্রসঙ্গে হ'লো ।
প্রফুল্ল— “ স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ ” কি এইজন্যই বলে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — হ্যা । তারপর আৰ্যসভ্যতার কথা উঠলো , বললেন — আৰ্যদের যে কী জিনিস ছিলো তা কল্পনায়ই আনা যায় না । Cabinet formed ( মন্ত্রীপরিষদ গঠন ) হ'ত বিপ্র , ক্ষত্রিয় , বৈশ্যদের প্রধানদের নিয়ে । প্রধানের প্রধান , তাদের প্রধান , এইরকমভাবে একটা সুন্দর gradation ( পৰ্যায় ) ছিলো । যারা যত বেশীকে পূরণ করতো তারা তত বড় প্রধান । প্রধান মন্ত্রী সর্বদা ঠিক হয়েই থাকতাে , উপযুক্ত লােক নির্বাচন নিয়ে কোন গণ্ডগোল উপস্থিত হতো না । অন্যদেশ ভারতবর্ষকে আক্রমণ করার সাহসই পেতাে না । সব জাতটা দারুণ compact ( সংহত ) থাকতো । অনুলোম বিয়ে থাকার দরুন সারা জাতটা যেন দানা বেঁধে থাকতাে , আর এতে evolution- এর ( ক্রমােন্নতির সুবিধা হতো যথাক্রমে পাঁচ , সাত ও চৌদ্দপুরুষ ধ'রে ক্ষত্রিয় , বৈশ্য ও শূদ্রের ভিতর যদি Brahmanic instinct ( ব্রহ্মণ্য - সংস্কার ) দেখা যেতো — তাদের বিপ্র করে দেওয়া হতো । উন্নতির পথ সব দিক থেকে খোলা ছিল । আগের কালে টাকা দিয়ে একজনের সামাজিক position ঠিক করা হতাে না । কারও হয়তো ৫০ লাখ টাকা আছে , কিন্তু কেউ হয়তো পাঁচ টাকায় সংসার চালাচ্ছে — অথচ instinct ( সহজাত সংস্কার ) বড় — সেই বড় বলে গণ্য হতাে । Instinct , habit , behaviour , activity ( সংস্কার , অভ্যাস , ব্যবহার ও কর্ম ) এইগুলিই ছিল মাপকাঠি । Learning ( লেখাপড়া ) -কে কখনও শিক্ষা বলা হতো না । চরিত্রগত না হলে তথাকথিত পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য দেওয়া হতো না । সব সময় লক্ষ্য ছিল — জ্ঞান , গুণ যাতে জন্মগত সংস্কার ও সম্পদে পরিণত হয় । বর্ণাশ্রমধর্ম এত সূক্ষ্ম , উন্নত ও বৈজ্ঞানিক ব্যাপার যে অনেকে এর অন্তনিহিত তথ্য বুঝতে না পেরে একে বৈষম্যমূলক বলে মনে করে — এর চেয়ে বড় ভুল আর নেই । যারা বিজ্ঞানসম্মত বর্ণাশ্রমধর্মকে বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্যে generous pose ( উদারতার ভঙ্গী ) নিয়ে inferior ( অসমর্থ ) : দের ক্ষেপিয়ে তোলে , তারা সমাজের মহাশত্রু । শ্রীরামচন্দ্র শম্বুকের প্রতি অতাে কঠোর হয়েছিলেন — কারণ , শম্বুককের movement ( আন্দোলন ) -টা বর্ণাশ্রম - ধর্ম্মের“ বিরুদ্ধে একটা passionate raid ( প্রবৃত্তি - প্ররােচিত অভিযান ) বই আর - কিছু নয় । অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা উঠতে বললেন — যজ্ঞে বহু লোক একত্রে সমবেত হ'তাে , তাই ঘি পােড়ন হতো , atmosphere ( আবহাওয়া ) টা ionised ( পরিশােধিত ) হয়ে যেত , ত ’ স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব ভাল । ঐ জিনিস inhale ( আগ্রাণ ) করলে আয়ু বেড়ে যেত । যজ্ঞে হােতা , উদগাতা , ব্রহ্মা ইত্যাদি থাকতাে - ওটা কতকটা demonstration ( প্রদর্শন ) -এর মত । উদগাতারা শ্লোগান গেয়ে বেড়াত , তা লোকের মনে গেঁথে যেত । Principles ( atf গুলি ) শ্লোগানের আকারে জনসাধারণের কানে বারবার না ঢুকালে তারা তা, গ্রহণ করতে পারে না ।
এক দাদা বিদায় নিতে এসেছিলেন , তিনি চলে যাবেন । তাকে স্বস্ত্যয়নীর পাঁচটি বিধি নিখুতভাবে পালন করতে বলে দিলেন , সেই সঙ্গে আরাে বললেন স্বস্ত্যয়নী পালা মানে যুগপৎ পাঁচটি নীতি সক্রিয়ভাবে মেনে চলা , তাতে উন্নতি অনিবার্য হয়ে ওঠে । উক্ত দাদা চলে যাবার পর পূর্ব - প্রসঙ্গ ধরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — আমার মনে হয় , অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্বকে বলি দেওয়া হতো না — বরং ঐক্য ও মিলনের প্রতীকরূপে অশ্বকে nurture ও nourish ( পালন ও পােষণ ) করা হতো , মেধ - ধাতুর অর্থ মিলিত হওয়া । অশ্বকে সমাদর করে অশ্বপ্রেরক রাজার supremacy with due regards accept ( রাজার প্রভুত্ব যথােচিত সম্মানের সহিত স্বীকার করতাে , সকলে যে রাজার অনুগামী এবং তার সঙ্গে ঐক্য ও মিলনকামী — এই বোঝা যেত ।
আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথম খণ্ড
৩২ শে জ্যৈষ্ঠ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৬ ( ইং ১৫/৬/১৯৩৯ )
Alochona prosonge part 1
আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথম খণ্ড
ষষ্ঠ সংস্করণ
10