★ মানুষের প্রধান চাহিদা কী কী ?
★ বেশ সুখে - স্বাচ্ছন্দ্যে যারা থাকে , তারা যে অনেক সময় ইষ্টের প্রয়োজনই বােধ করে না । সেখানে কী করা ?
★ভগবান মানুষকে তার দিকে টেনে রাখেন না কেন ?
★বিশ্বরূপ ও বিষ্ণুরুপ - সম্বন্ধে কথা....
২৪ শে অগ্রহায়ণ , মঙ্গলবার , ১৩৪৮ ( ইং ৯/১২/১৯৪১ )
ইষ্টের স্মরণ , মনন , কীৰ্ত্তন , উপাসনা , পরিষেবন , অনুবৰ্ত্তন , —তঁৎস্বার্থ প্রতিষ্ঠামূলক পরিচিত্তন ও কর্মঠ উপচয়ী প্রয়াস — এইতাে মানুষের কর্ম । তাকে বাদ দিয়ে যা ’ তাই তো অকর্ম — অশেষ দুঃখ ও বন্ধনের কারণ — এই সত্যটি আশ্রমবাসিগণের মধ্যে অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করেছেন , তাই তার প্রত্যক্ষ সঙ্গ ও সান্নিধ্যলাভের সুযােগ গ্রহণ করতে তারা সদাই উন্মুখ । তার কাছে যাবার জন্য মন তাদের আঁকুপাকু করে , তাই ভাের হ’তে না - হ'তেই , রাত থাকতেই তারা শীতের জড়তা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন , প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনান্তে তাঁর দরবারে গিয়ে হাজির হন । আকাশে তখনও নক্ষত্ররাজি বিরাজ করে , কুয়াসা ও অন্ধকার তখনও ঘনীভূত হয়ে থাকে , দিগন্তবিসারী পদ্মাচর স্তব্ধতায় থমথম করে , আশ্রম প্রাঙ্গণের বকুল ও বাবলা গাছগুলি মৌন প্রহরীর মতাে দাড়িয়ে থাকে , শিশির সিক্ত আঁকাবাকা আশ্রম - পথ - যে - পথ গিয়ে শেষ হয়েছে তার আঙ্গিনায় , নীরবে পথিককে তারই দ্বারে আহ্বান করে , যাত্রী ছােটে পরম সঙ্গম - তীর্থে । তারা গিয়ে দেখে , তীর্থপতি স্বয়ং জেগে ব'সে আছেন তাদের প্রতীক্ষায় । এই যে ভক্ত ও বাঞ্ছিতের মিলন — এরই মধ্যেদিয়ে যেন সৃষ্টির শাশ্বত লীলারসটি উথলে ওঠে ; উভয়কে পেয়ে উভয়েই খুশি , উভয়েরই আনন্দ , এমনটি না হলে কি আর উপভােগ মধুর হয়ে ওঠে ? এই আনন্দের আস্বাদন চলে প্রশ্ন , পরিপ্রশ্ন ও সংলাপের ভিতর - দিয়ে ; ফাকে - ফাকে চলে দৃষ্টি - বিনিময় , ঠারেঠোরে , হাবে ভাবে , আকারে - ইঙ্গিতে কত অকহ কথা কওয়া হয়ে যায় , মনের মণিকোঠায় ভ'রে ওঠে অমৃত - সঞ্চয় , ভাববাের প্রাণ আরাে - আরো অবগাহন করতে চায় তাতে । সুর হয় মধুর আলাপন ।
ধূর্জটিদা — মানুষ convinced ( সন্দেহ-ভঞ্জন ) হবার পরেও অন্যরকম বলে কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর- Convinced ( সন্দেহ - ভঞ্জন ) হওয়া আর conviction (দৃঢ় প্রত্যয় ) আসা এক কথা নয় । সত্তায় গেঁথে না উঠলে conviction ( দৃঢ় প্রত্যয় ) হয় না । আর , conviction ( দৃঢ় প্রত্যয় ) না হলে বুঝ পাকা হয় না — এখন বুঝে গেল , পরে আবার অন্য consideration ( বিবেচনা ) অসিতে পারে , বিরুদ্ধ environment- এ ( পরিবেশে ) stand করতে ( অবিচলিত থাকতে) পারে না । তখন বিপরীত চিন্তা আসে । Conviction ( দৃঢ় প্রত্যয় ) হ'লে কিন্তু কিছুতেই সংশয় আসে না , সবাইকে face করতে ( সম্মুখীন হতে পারে । তখন যুক্তি - বুদ্ধি ঠেলে বেরােয় , আত্মসমর্থনের জন্য মানুষ যেমন মরিয়া হয়ে লাগে , ইষ্টের যা - কিছুকে সমর্থনের জন্যও সে তেমনি পাগল হয়ে ওঠে । ইষ্টের কোন - কোন আচরণের তাৎপৰ্য সে হয়তো বুদ্ধি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম না - ও করতে পারে , কিন্তু তার এই বিশ্বাস অটুট থাকে যে তিনি যা - কিছু করছেন , তা ব্যষ্টির ও সমষ্টির সর্বোত্তম মঙ্গলের জন্য এবং এই বিশ্বাসই সেখানে তাকে যুক্তিবুদ্ধির যােগান দেয় । আর , এমন কোন কথা , চিন্তা বা কাৰ্যকে প্রশ্রয় দিতে নাই , যা কিনা প্রত্যয়কে শিথিল করে তােলে , এমন কি ঠাট্টাচ্ছলেও নয় । অসতর্ক মুহূর্তের ঐ সব চিন্তা , চলন , বাক্য , কাৰ্য্য ও সঙ্গ অজানিতে মানুষের অনেকখানি ক্ষতি করে । কতখানি যে ক্ষতি করে , সেটা crisis- এর ( সঙ্কটের ) মুহ ছাড়া বোঝা যায় না । এমনি হয়তো মানুষ আছে বেশ , কিন্তু ইষ্টানুসরণের ক্ষেত্রে যেখানে প্রবল বাধা বিপত্তি , দুঃখ , কষ্ট , নির্যাতন , স্বার্থত্যাগ , প্রবৃত্তি বা ইচ্ছা - দমনের সম্মুখীন হতে হয় , সেখানে সে কাবু হয়ে পড়ে , পিছিয়ে পড়ে । ভিতরে কিন্তু - কিন্তু ভাব থাকলে ঐ অবস্থায় মাথা উচু করে ইষ্টের জন্য রুখে দাড়াতে পারে না ।
বীরেনদা ভট্টাচাৰ্য মানুষকে ভাল করে বােঝানর পর সে হয়তো সদগুরু গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করলাে । কিন্তু তখন যদি বলে — আপনি যেমন বলেন , আরাে অনেকেও তাে বলে , আমি দশ জায়গায় দেখে - শুনে যা হয় করবো । শ্রীশ্রীঠাকুর — তার মানে , তার right chord- এ ( ঠিক তারে ) তুমি ঘা দিতে পারনি । তার sentiment ( ভাবানুকল্পিত ) -কে excite ( উদ্বোধিত ) করে , সত্তার ক্ষুধাকে জাগিয়ে দিয়ে যদি একটা দাউদহনী টানের সৃষ্টি করে না দিতে পারলে , —উপর আলোচনায় কিছু হবে না । মানুষের চাহিদাকে আবিষ্কার করে একটা রসাল ধারায় কথাবার্তা কইতে হয় । তার সঙ্গে থাকবে অকাট্য যুক্তি ও তথ্য , সেগুলি আবার তার পরিচিত জীবনের এলাকাভুক্ত হওয়া চাই । কথাগুলির সুর হবে এমন — যাতে তার ভিতর - দিয়ে তার জীবন - চাহিদার পরিপূরণী আভাস পায় সে , আর তােমাকে নিজেকে এমন করে গড়ে তুলতে হবে যাতে তােমার কাছে এসে তােমার দেখে , তােমার কথাবার্তা শুনে প্রত্যেকের চোখ , কান , প্রাণ , মন — তৃপ্ত ও মুগ্ধ হয়ে যায় , তােমার সান্নিধ্যে সে স্বর্গসুখ অনুভব করে , এমনটি হলে তখন নেশা জমে ওঠে । উভয়েরই উপভােগ হয় । সে আগ্রহ - বিধুর হয়ে পড়ে , তার যেন তখনই না হলে চলছে না — একটা কঠোর চাওয়া তাকে পাগলপারা করে তোলে । নিজে যদি সেই pitch- এ ( উচ্চগ্রামে ) থাক , মানুষকে তুমি মুহুত্তে গলিয়ে দিতে পারবে ।
কথা বলছেন তিনি , চোখে - মুখে তার করুণা ঝরে পড়ছে । তন্ময় মশগুল হয়ে গেছেন তিনি — মন তার উৎস - প্রেমে মাতোয়ারা । যজনের যে সঙ্কেত তিনি দিলেন , তার পূর্ণতম , নিখুত চিত্র ফুটে উঠেছে তার মাঝে । সাধুজন বলেন— হরিকথায় রুচি মানুষের পরম কল্যাণ - নিদান । হরিকথা বলায় রুচি তাে দুরের কথা , হরিকথা শ্রবণে যে মানুষের রুচি জন্মাবে , তেমন প্রাণবন্ত মনােলােভা রুচির ভঙ্গীতে হরিকথা বলতে পারেন ক’জন ? -পারেন সেই হরি - অনুশায়ী মুর্ত্ত শ্রীহরি — যিনি সর্ববন্ধন - বিমােচক , ভুভারহারী , ত্রিতাপহারী , আর পারেন তদগতচিত্ত যাঁরা ।
প্রফুল্ল — কীত্তনেই তো মানুষকে সহজে অনুপ্রাণিত করে দেওয়া যায় বেশ একটা atmosphere ( আবহাওয়া ) created ( সৃষ্টি) হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- তুমি একলাই একটা atmosphere ( আবহাওয়া ) —যার সঙ্গে মিশবে , সেই ভিজে যাবে , bedewed ( নিষিক্ত ) হয়ে যাবে । মানুষের আছে চাহিদা , আছে টান , সবগুলি সমবায়ী concentration- এ ( একাগ্রতায় ) এনে ইষ্টকে পরিবেষণ করবে । রান্নাঘরে খাবার প্রচুর থাকলেই কেবল হয় না , পরিবেষক চাই , পরিবেষণের দোষে কত লােকে পেট ভরে খেতে পায় না , কতজনের আবার পেট খারাপ করে যায় , কতজনে তাদের রুচিমাফিক জিনিস প্রয়ােজনমতাে না পাওয়ায় তাদের খেয়ে তৃপ্তি হয় না , আবার এদিকে খাবারও নষ্ট হয়। তোমাদের যেন তেমনতর না হয় । পরমপিতা তোমাদের মাল - মশলা প্রচুর দিয়েছেন । সব রকম প্রশ্ন ও সমস্যার সমাধানই তোমাদের কাছে আছে । এখন যদি জায়গামতো সেখানে যার কাছে যেমনভাবে যতটুকু যা পরিবেষণ করা দরকার , তা করতে পারি তাহ'লেই হয় । তোমরাও মানুষকে পাও , মানুষও তোমাদের পায় । উভয়েরই সুখ হয় ।
প্রশ্ন — মানুষের প্রধান চাহিদা কী কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আহার , নিদ্রা , ভয় , মৈথুন , অহং — এই পাঁচটা জিনিস প্রধান । তাই এইগুলির আবার আধ্যাত্মিক , মানসিক , শারীরিক এবং সাত্ত্বিক , রাজসিক তামসিক ইত্যাদি নানা রূপ আছে । সব ক'টা প্রত্যেকের মধ্যে থাকলেও এর এক - একদিক এক - একজনের মধ্যে prominent ( প্রধান ) থাকে । ধর , আহারের ইচ্ছা সকলেরই থাকে , কারাে হয়তো spiritual food ( আধ্যাত্মিক আহার ) -এর ইচ্ছা প্রবল থাকে , সে স্বতঃই নাম , ধ্যান , ভজন ও ভগবচ্চিন্তায় অনুরাগসম্পন্ন আবার সাত্ত্বিক আহারের প্রতি হয়তাে তার স্বাভাবিক প্রীতি থাকে , কারও হয়তো মনের খাদ্যের প্রতি লোভ বেশী থাকে , তার হয়তো জ্ঞানাহরণের স্পৃহা প্রবল হয় , হয়তাে সে সাত্ত্বিক বা রাজসিক আহার পছন্দ করে , আবার কারও হয়তাে স্থূল আহাৰ্য্যের প্রতি আগ্রহ বেশী থাকে — সে খাবার পেলেই মহখুশি - জ্ঞানের বা আনন্দের রাজ্যের উন্নততর খােরাকের প্রয়ােজন অত তীব্রভাবে সে অনুভব করে না । আবার , রাজসিক বা তামসিক আহারই হয়তাে তার খুব প্রিয় এবং সে হয়তাে খাদ্য - সমস্যাকেই জীবনের সর্বোচ্চ সমস্যা ব'লেই মনে করে — এই সমস্যা আবার কারও হয়তাে নিজের পেটের জন্য , কারও হয়তাে গুরুজন ও প্রিয়জনের জন্য , কারও হয়তো বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকের Spiritual ( আধ্যাত্মিক ) ও intellectual ( মানসিক ) hankering ( আকাঙ্ক্ষা ) ও অমনি কারও - কারও শুধু নিজের জন্য , কারও - কারও নিজের সঙ্গে , প্রিয় - পরিজনের জন্য , কারও - কারও বৃহৎ হ'তে বৃহত্তর পরিবেশের জন্য । আহার , নিদ্রা , ভয় , মৈথুন , অস্মিতা — ইত্যাদির প্রত্যেকটি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ব্যক্তিভেদে এইরকম বিভিন্ন রূপ নেয় এবং তার মধ্যে একটা
থাকে guiding . বা goading complex ( পরিচালক প্রবৃত্তি ) । সেই অনুপাতে কথা বললেই হয় , তখন দেখবে সে আর তােমাকে ছাড়ছে না । একবার রস লাগিয়ে দিতে পারলে , তুমি তাড়িয়ে দিতে চাইলেও সে যাবে না । ফলকথা , মানুষ ক'য়েই দেয় , তোমার কী বলতে হবে , একটু ; watch ( লক্ষ্য) করলেই টের পাবে ।
কালুদা ( আইচ ) কিছু তরকারী নিয়ে আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর উল্লাসের সঙ্গে বলে উঠলেন — তোফা মাল এনেছিস তো ! যা , বড় - বৌয়ের কাছে দিয়ে আয় ।- এই বলে তামাকে টান দিলেন ।
শরৎদা আলোচনা - প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন — মানুষ নিজের মনের কথা না বলে যেখানে বুদ্ধি করে নানা কথা বলে , তার মধ্যদিয়ে কী করে তার চাহিদা বােঝা যায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওর মধ্যেই বােঝা যায় । মানুষ যত কথাই কো’ক , তার inclination ( অনতি ) যে - দিকে , ঘুরে - ফিরে সেখানেই আসতে চায় । যুদ্ধের আলোচনা করতে গিয়ে হয়তো বলবে , রাশিয়ার মেয়েরা কেমন যুদ্ধে নেমে গেছে , পুরুষের পাশে দাড়িয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিচ্ছে , আমাদের দেশে কি তা হবার ও জো আছে ? —এমন সমাজ - ব্যবস্থা আমাদের । এই চললো— তাই একটু , নজর রাখলেই বােঝা যায় । একজনের guiding complex ( পরিচালক প্রবৃত্তি ) তােমার মনোমতো না হলেও , তাকে নিরুৎসাহ করতে নেই — তারই সার্থক প্রয়ােগে , সে কেমন ক'রে জীবনে ধন্য হয়ে উঠতে পারে , সেইটেই তার সামনে তুলে ধরতে হয় । ফলকথা , যার যে প্রবৃত্তিই থাক — সেইটে যদি ইষ্টম্বার্থ প্রতিষ্ঠায় নিযুক্ত হয় , তার ভিতর দিয়েই সে অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে , তার ঐ প্রবৃত্তিই লােককল্যাণকর হয়ে ওঠে । ধর , একজন হিংস্র ও হিংসুটে প্রকৃতির ; অসৎ , অন্যায় ও পাপ যা , তার বিরুদ্ধে তার ঐ ভাব যদি প্রযুক্ত হয় , তাতে তারও মঙ্গল , অন্যেরও মগল । সৎ কাউকে ভাল না বাসলে এই মোড় ফেরানটুকু সম্ভব হয় না । তাই , মানুষকে ইষ্টে যুক্ত করার কথা বলি , ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠাপন্ন করে তোলার কথা বলি । যেমন শুনি তাতে মনে হয় , শিবাজীর ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতি । এই প্রকৃতি যদি সে নিজের স্বার্থপ্রতিষ্ঠায় লাগাতো , তাহলে সে মানুষের স্বার্থ । সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে ব্যাহতই করতে পারতো , কিন্তু গড়ে তুলতে পারতাে না কিছু । কিন্তু রামদাসকে ভালবাসার দরুন অতো বিরুদ্ধতার মধ্যেও মারাঠা সাম্রাজ্যের মতাে অমন একটা আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তােলা তার পক্ষে সম্ভব হলো । তাই , ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠার সহায়ক করে কাজে লাগাতে পারলে কিছুই ফেলান যায় না ।
একটা কুকুরকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — ও কালিদাসী ! ওর পেটটা পড়ে গেছে , ওকে কিছু খেতে দে । কালিদাসীমা কুকুরটাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা মােয়া খেতে দিলেন ।
শৈলেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) বেশ সুখে - স্বাচ্ছন্দ্যে যারা থাকে , তারা যে অনেক সময় ইষ্টের প্রয়োজনই বােধ করে না । সেখানে কী করা ?
শ্রীশ্রীঠাকুর বুকের মধ্যে মানুষের একটা খালি - খালি , শূন্য - শূন্য বোধ থাকেই , সেখানটা ধরে নাড়া দিতে হয় । Will to live and grow ( বাচাঁ বাড়ার ইচ্ছা ) মানুষের আছেই । যার উৎসপ্রাণতা যত তরতরে , তার activity ( কৰ্ম্ম ) ও adjustment ( নিয়ন্ত্রণ ) তত গভীর ও ব্যাপক , সে হয় great man ( মহান মানুষ ) ! এই আরোতরের ক্ষুধা মানুষের আছেই । এই ক্ষুধার পরিপূরণের জন্যই দরকার হয় বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ জীবন্ত ইষ্ট বা আদর্শের শরণাগতি । এই বোধটা তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে হয় । আর , যাদের সে - ক্ষুধা নেই , তাদের সে - ক্ষুধা সুকৌশলে জাগিয়ে তুলতে হয় । যে basis- এর ( ভিত্তির) উপর দাড়িয়ে তারা সুখে - স্বচ্ছন্দে আছে , সেই basis ( ভিত্তি ) -টাকে পাকা - পোক্ত করতে গেলে যে যােগ্যতার প্রয়ােজন , আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন , তা ধরিয়ে দিতে হয় । একটা বিশেষ বিপর্যয়ে মানুষের বিষয় - আশয় চলে যেতে পারে , ব্যবসা - বাণিজ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে , এমনতর কত ব্যক্তি , পরিবার ও জাতির জীবনে ঘটে থাকে । কিন্তু সব বিপর্যয়ের মধ্যে কালের বক্ষে জয়ী হয় তারাই , যারা সুকেন্দ্রিক , সুনিয়ন্ত্রিত , সুযােগ্য ও সুসংহত । এই কথাটা বােধে এনে দিতে হয় । মানুষ একক যে ভাল থাকতে পারে না , ভাল থাকার জন্য পরিবেশকেও ভাল রাখতে হয় এবং এই পবিবেশের ভাল করতে গেলে , তাদের যোগ্যতা বাড়াতে গেলে যে তাদের মধ্যে ধর্মদান প্রয়ােজন , আর এই ধর্মের মূলস্তম্ভ যে ইষ্টপ্রাণতা , আবার অন্যকে ইষ্টপ্রাণ করে তুলতে গেলে যে আগে নিজে ইষ্টপ্রাণ হ'তে হয় , —এইদিক দিয়ে অগ্রসর হতে পার । মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও প্রবৃত্তিবশতা যে কতখানি অস্বস্তি , অশান্তি , জ্বালাযন্ত্রণা ও বিপাক সৃষ্টি করতে পারে , এগুলির জীবন্ত ও জ্বলন্ত চিত্রও তার সামনে একে দেখাতে পার । এবং একমাত্র ইষ্টানুগত্যের ভিতর দিয়ে এ হ’তে নিষ্কৃতি মিলতে পারে , তা ’ factfully ( তথ্যপূর্ণভাবে ) discuss (আলোচনা ) করতে পার । যত কথাই যার সঙ্গে বল না কেন , তার অন্তরতম চাহিদা , যেটা তার পরিচালক - প্রবৃত্তি , সেই দিকে লক্ষ্য রেখে বলবে । আর উচ্চতর , সার্থকতর জীবনের প্রতি , বিবর্তনের প্রতি একটা লোভ জন্মিয়ে দিতে হয় , যাতে অনিবাৰ্য্য আকর্ষণে সেই দিকে ছােটে । ইষ্টের প্রতি আকর্ষণ যত আমাদের সত্তাগত হয় , ঐ আকর্ষণ যত আমাদের চলন - চরিত্রের নিয়ামক হয় তা’তেঁ সক্রিয়ভাবে মুগ্ধ ও বুদ্ধ হয়ে নিরবচ্ছিন্ন চলনে যত চলি , ততই আমাদের স্পর্শে মানুষের অন্তর্নিহিত স্বচ্ছ ও নির্মল বুদ্ধি জেগে ওঠে এবং সেই মন নিয়ে তারা বুঝতে পারে অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি এবং সহজভাবে । তোমার চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের সেই radiation ( বিকিরণ ) যদি না থাকে , তবে লাখ - লাখ কথা বলেও তুমি মানুষের মন ছুতে পারবে না ।
প্রশ্ন — শ্রেষ্ঠের প্রতি সক্রিয় টান যার নাই , তার যে অবনতি হচ্ছেই তা যে সে হাতে - হাতে বুঝতে পারে না ; জীবনের মূলে ঘা পড়ে যখন , তখন বললে হয়তো খেয়াল হয় , সে অবস্থা আসতেও তো দেরী লাগে । শ্রেষ্ঠের প্রতি টান ছাড়াও তো মানুষ বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ফল হাতে - হতেই পায় কিন্তুু সাধারণতঃ মানুষ যেখানে ঝুলে থাকে , অর্থাৎ যাদের উপর টান পড়ে , তাদের হয়তাে উন্নত টান কিছু থাকে , সেই তাদের টানের হিল্লেয় যুক্ত থাকে বলে টিকে থাকে । তুলসীদাস তাে বৌ - পাগলা ছিল , বৌ - এর কথাতেই আবার রামভক্ত হয়ে উঠলো । এইরকম transference ( পরিবর্তন) ও হয় । ফলকথা , মানুষ যদি প্রতিলােমদুষ্ট , কৃতঘ্ন ও distorted ( বিকৃত) না হয় , তবে তার পথ সব সময়ই প্রশস্ত । যে - কোন obsession ( অভিভূতি ) মানুষের আসুক না কেন , সেটা থেকে কাটিয়ে উঠে শ্রেয়পন্থী হওয়া তার পক্ষে কঠিন কিছু নয় , বাচা - বাড়ার তাগিদেই সে তা করে থাকে । তাই নিজেদের ইষ্টানুগ ভাস্বর চরিত্রের প্রভাবে মানুষের obsession ( অভিভূতি ) -কে হাল্কা করে দিয়ে , তার বাঁচা - বাড়ার will ( ইচ্ছা ) -কে keen (তীব্র ) ক'রে তোলাই যাজনের প্রধান কাজ । উপযুক্ত যাজক পেলে দুনিয়ার পাপ - তাপ অনেক কমিয়ে দেওয়া যায় । যাজনের উপর রাখলে মানুষের অন্তরের দেবভাবকে অনেকখানি জাগিয়ে রাখা যায় । কিন্তু প্রতিলোম - জাতক যারা , কৃতঘ্ন যারা , distorted ( বিকৃত ) যারা , যাজন তাদের অন্তরে পৌঁছাতে পারে কমই , শরীর - মনের যে - পথ দিয়ে পৌছাবে , তার মাঝেই অনেক ছেদ , অনেক কাটাছেড়া , অনেক উল্টো সমাবেশ থাকে । তাদের কিছু করতে গেলে তাদের পেছনে অনেক খাটা লাগে , খেটেও স্থায়ী ফল কিছু হয় কিনা বলা শক্ত । Distorted ( বিকৃত ) যারা , তাদের শোধরন বরং সম্ভব , কিন্তু প্রতিলােমজ ও বিশ্বাসঘাতকদের সংশোধন প্রায় অসম্ভব । বিশ্বাসঘাতকতা আবার প্রতিলোম সংশ্রবের সঙ্গে জড়িত , সুতরাং প্রতিলােমজাতক যারা আছে দুনিয়ায় , তাদের প্রতিলোম - দোষ সংশােধনের কোন উপায় যদি করা যায় , তবে বিশ্বাসঘাতকতাকেও দুনিয়া থেকে হয়তো তাড়ান যেতে পারে । এর সমাধান শাস্ত্রে কিছু লেখেনি , তবে আমার মনে হয় , প্রতিলোম - জাত কন্যাদের বংশপরম্পরায় উচ্চঘরে বিয়ে দিয়ে উন্নততর বীজ - প্রভাবে তাদের সন্তান - সন্ততিকে বহুপুরুষ ধ'রে ক্রমশঃ দোষমুক্ত ক'রে তোলা যেতে পারে ।
ভূদেবদা ( মুখােপাধ্যায় ) —ভগবান মানুষকে তার দিকে টেনে রাখেন না কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তিনি তো বুকে ক'রেই রেখেছেন , তা না হলে মানুষ বেঁচে আছে কী করে ? তার প্রাণশক্তি সে পেল কোথায় ? কিসের বলে সে চলে - ফেরে , হেকমতি দেখায় ? এমন কি , সে যে খােসখেয়ালে চলে , তাও সে পারতো না , যদি পরমপিতা তার মধ্যে জীবন - স্বরূপ হ'য়ে না থাকতেন । কিন্তু পরমপিতাই যে মানুষের অস্তিত্বের উপাদান , তিনিই যে তার সবকিছু , তা সে উপলব্ধি করতে পারে না — যতদিন না সে তার তরফ থেকে তাকে বরণ করে । এইজন্য রামকৃষ্ণদেব বলেছেন — কৃপাবাতাস তো বইছেই , তুই পাল তুলে দে না । বিদেহ পরমপিতাকে মানুষ ধরতে পারে না , তাই নর - বিগ্রহে তিনি বারবার আসেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথা বলছেন আর মাঝে - মাঝে তামাক চেয়ে খাচ্ছেন । হরিপদদা তামাক সেজে দিচ্ছেন । তামাক খেয়ে আবার গামছা দিয়ে মুখটা পুছে ফেলছেন । ধীরে - ধীরে সুৰ্য জেগে উঠলো , অন্ধকার ভেদ করে উদ্ভিন্ন হয়ে উঠলাে আলাে , দুর বনানীর অস্পষ্ট কালোরেখা বর্ণাঢ্য আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠলো । তার প্রত্যেকটি জিনিস লক্ষ্য করার — খাওয়া , পরা , শােয়া , বসা , হাটা , চলা , কাজ কৰ্ম্ম , আলাপ , ব্যবহার যাবতীয় যা - কিছু । মশারিটা কেমন নিখুতভাবে টাঙান , চারিদিকে টানটান , কোথাও একটু ঘোচঘাচ নেই , বিছানাটি পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন , পাখীর পালকের মতাে সাদা ধবধবে , কোথাও একটি দাগ পর্যন্ত নেই । চাদরটি চারিদিকে সমানভাবে গোঁজা , কাপড়খানিও শুভ্র , স্বচ্ছ , বসার ভঙ্গীটি কী অনবদ্য অপূর্ব ; তার সবকিছুর মধ্যে একটি নিখুত সুষম সৌন্দৰ্য - প্রকৃতির মতােই তা ’ সহজ , অনাড়ম্বর , সুসমঞ্জস , সুঠাম ও মনোরম । ক্ৰমে দাদাদের মধ্যে আরো অনেকে আসলেন । মানদা - মা , দুলালী - মা , কালিষষ্টীমা এবং অন্যান্য মায়েরও আসলেন ।
বিশ্বরূপ ও বিষ্ণুরুপ - সম্বন্ধে কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - বিশ্বরূপে আছে — বহু যে এক , এই বােধ , আর বিষ্ণুরূপে আছে —একই যে বহু , এই বোধ । বিশ্ব এসেছে বিশ্ - ধাতু হ'তে । বিশ্ ধাতু মানে প্রবেশ । বিশ্বরূপে মানে সেই রূপ , যেখানে যাবতীয় রূপ অনুপ্রবিষ্ট হয়ে সংহত হয়ে আছে । আর বিষ্ণু মানে তিনি , যিনি সর্ব ও প্রত্যেকের ভিতর বিশেষভাবে পরিব্যাপ্ত । এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদির জন্য উঠে পড়লেন ।
________________________________________
10