- প্রফুল্ল -- ব্যাকুলতা জিনিসটা কী ?
- সতীশদা — সবই যদি তার সৃষ্টি , তবে পাপ আসলো কোথেকে ?
- প্রফুল্লভগবান গােড়ায় তো একা ছিলেন , সৃষ্টি করলেন কেমন করে ?
১৮ ই অগ্রহায়ণ , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ৩/১২/১৯৪১ )
পাবনা মানুষের সব পেয়েছিল দেশ , সত্তার ক্ষুধার খােরাক মেলেনি যাদের কোথাও , দিশেহারার মতাে পথ হাতড়ে বেড়িয়েছে যারা , অথচ পথ পায়নি , পায়নি যারা আনন্দের আস্বাদ , পায়নি যারা প্রেম - ভালবাসা , পায়নি যারা উজ্জ্বল - নিৰ্ম্মল সত্তাসম্বৰ্ধনী জ্ঞানের আলো , পায়নি যারা জীবনে উদ্দীপনা , কর্মে প্রেরণা , চলার পথের হদিশ , আৰ্ত্তবেদনায় গুমরে মরছে যারা , পায়নি যারা স্নেহসরস সােহাগ - সিঞ্চিত শান্তির সংশ্রয় -- তারা সব পেয়েছে পাবনা - পদ্মাতীরের পক্ষিকূজিত , দিগন্তপ্রান্তর - মেখলা , বকুল , বাবলা , বাঁশবনেঘেরা ইষ্টকৃষ্টি - অধ্যুষিত , বেদবিজ্ঞানদীপ্ত শান্ত , কর্মমুখর , পুণ্যভূমি — সৎসঙ্গ আশ্রমে । তাই আশ্রমের প্রাণকেন্দ্র যিনি — কি যেন এক অজানা আকর্ষণে মানুষ বারংবার ছুটে আসে তার কাছে । এমনি ক'রে নিরন্তর মানুষের ভিড় জমে ওঠে তার চরণপ্রান্তে । তিনিও মানুষের কাঙ্গাল , ক্ষুধিত কোলের শিশুকে নিয়ে স্তন্যদানে মা যেমন পরিতৃপ্ত ও প্রসন্ন হয়ে ওঠেন , ব্যথাতুর মানুষকে , নিপীড়িত প্রাণসত্তাকে স্নেহবেষ্টনে আলিঙ্গন ক'রে তিনিও তেমনি খুশি ও সুখী হ'য়ে ওঠেন — এ ছাড়া যেন তার বুক খালি - খালি লাগে — এই আমার ঠাকুর । মানুষ তার কাছে যাবে না তো যাবে কোথায় ? তাই , রাত্রি প্রভাত হ'তে না হতেই তার আঙ্গিনায় আনন্দের মেলা বসে , তাকে ঘিরে মধুচক্র রচনা হয় , আসে আর্ত , আসে অর্থার্থী , আসে জিজ্ঞাসু , আসে জ্ঞানী সুধাসত্রে চলতে থাকে সুধাবিতরণ । আজও তার ব্যত্যয় হয়নি এসেছেন সবাই ।
কথাবার্তা শুরু হলাে ।
ছেলে - মেয়েদের যৌন - বিজ্ঞান - সম্পর্কে কেমন করে শিক্ষা দেওয়া যায় , সেই সম্বন্ধে কথা উঠলো । শ্রীশ্রীঠাকুর — যৌন - বিজ্ঞান ও প্রজনন - বিজ্ঞান সম্বন্ধে ভাল বই লিখতে হয় , আর শেখাতে গেলে খুব সুরুচি - সঙ্গত পন্থায় শেখাতে হয় । অযথা গােপনতা ভাল নয় , সহজ ও পবিত্রভাবে জীবনের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব উদঘাটিত করে স্বচ্ছ করে বুঝিয়ে দিতে হয় । Distortion ( বিকৃতি ) ও abnormality ( অস্বাভাবিকতা ) -র প্রতি যাতে একটা বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয় , সে - পথ দিয়ে যা'তে কেউ না মাড়ায় , তেমন মনোভাব পাকা করে দিতে হয় । আবার , স্বাভাবিক যৌন - বোধের উন্মেষ ও অভিব্যক্তিতে তারা যাতে নিজেদিগকে অপরাধী মনে করে দুৰ্বল , অবসন্ন ও দিশেহারা হয়ে না পড়ে , বরং ঐ সম্বেগকে সুষ্ঠভাবে পরিচালিত ক'রে জীবনকে উদ্বদ্ধন - মুখর করে তুলতে পারে , সেইভাবে তাদের শিক্ষিত করে স্বাস্থ্য ও সদাচার - সম্বন্ধে কখন কোন অবস্থায় কী করণীয় , সেই সম্বন্ধেও ছেলে - মেয়েদের ওয়াকিবহাল ও অভ্যস্ত করে তুলতে হয় । আবার শারীরিক , মানসিক ও আধ্যাত্মিক সদাচারের পরিপোষণী আবহাওয়া সৃষ্টি করতে হয় — পরিবার , পরিবেশ , বিদ্যালয় — সর্বত্র ।
প্যারীদা ( নন্দী ) ভাগবতের একটা শ্লোক ব্যাখ্যা করতে নিয়ে আসলেন । তাই নিয়ে অনেক আলাপ - আলোচনা নিজেদের মধ্যে হলো । পরে শ্রীশ্রীঠাকুর সেই প্রসঙ্গে বললেন — তিনি আমার সব করবেন , এটা ভক্তির অন্তরায় । ভক্তের মনের ভাব — আমার জন্য প্রভু যেন কষ্ট না পান , বরং আমিই তার কষ্টের লাঘব করব , তার ভার বহণ করব , তাকে সোয়াস্তি দেব , তার দায়িত্ব মাথা পেতে নেব , তার ইচ্ছা পূরণ করব । এই আগ্রহ - উন্মাদনার ভিতর দিয়েই তার শক্তি বেড়ে ওঠে , সে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলে প্রতি মুহূর্তে গুরুর দয়া অনুভব করে , আর সহস্র মুখে তার গুণগান কার । তা না করে গুরুর কাছে যারা দেহি ‘ দেহি ’ করে , স্বার্থ - প্রত্যাশা পূরণের জন্য তার কাছে ঘোরে , তাদের শক্তি খর্ব হয়ে যায় , তারা শান্তি পায় না , অভাবও মেটে না তাদের । হনুমান রামচন্দ্রের relief- এর ( স্বস্তির ) জন্য কী না করেছে ? এতে কিন্তু তার আত্মপ্রসাদ বই কষ্ট ছিল না , আর এমনি করেই সে বেড়ে উঠেছিল , কিন্তু তার ইতর অহঙ্কার ছিল না । একমাত্র গর্ব ছিল তার রামচন্দ্রকে নিয়ে , তাঁকে নিয়েই বুক ভরেছিল তার , চাওয়া - পাওয়ার বালাই ছিল না । একমাত্র চাওয়া ছিল — তার পরিপূরণ । তাই শান্তি , সন্তোষ ও শক্তি কোনদিন তাকে ত্যাগ করেনি । নয়নাভিরাম রামচন্দ্রের একটুখানি মুখের হাসি , একটুখানি সস্নেহ দৃষ্টি তার মনে যে কী আনন্দের ঢেউ তুলতো , সে সে - ই জানে । ফল কথা , fulfilling urge (পরিপূরণী সম্বেগ ) নিয়ে তার জন্য করাটা আমাদের যত keen ( তীব্র ) হয় , তাঁর ভালবাসাটাও আমরা তত অনুভব করতে পারি , নচেৎ আমাদের জন্য তার লাখ ভালবাসা , লাখ করা আমরা বােধ করতে পারি না , উপভােগও করতে পারি না । আবার , আমরা যদি করিও এবং সে করাটা যদি হয় নিজেদের কেরামতি দেখাবার জন্য তার ভালবাসায় নয় — তাহলেও তাকে উপভােগ করা যায় না ।
প্রফুল্ল -- ব্যাকুলতা জিনিসটা কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ব্যাকুলতা হলো urge (সম্বেগ ) , সত্যিকার ব্যাকুলতা থাকলে তপস্যা ফুটবেই , করা বাদ দিয়ে শুধু ব্যাকুলতায় , শুধু কান্নায় তাকে পাওয়া যায় না । আবার , করার সঙ্গে যদি সন্বেগ বা ব্যাকুলতা না থাকে , তবে নিজেরও মন ভেজে না , অপরেরও মন ভেজান যায় না — নীরস শুষ্ক হয়ে যায় সব । ব্যাকুলতাটা যেন driving force ( সঞ্চারণী শক্তি ) , তাই - ই বৃহৎ সৃষ্টিকে সম্ভব করে তোলে । বৈধী করণের মধ্যে দিয়েও অনেক সময় ধীরে - ধীরে ব্যাকুলতা ফুটে ওঠে ।
শরৎদা ( হালদার ) —কেউ যদি সব কথাতেই বলে— “ তিনি করাচ্ছেন , তখন কী করা ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ও - সব তাে ফাকিবাজি । বলতে হয় , তিনিই করান , আর যিনিই করান , তুমি এই - এই চাও কিনা , আর কিছু পেতে গেলে তো তদনুপাতিক করতে হয় । আবার , তিনি করছেন যদি বল , তবে তিনি তো তুমি হয়ে আছেন , তুমি - তিনি যা করবে , তার ফল তাে তুমি - তিনির উপরই গড়াবে । তুমি - তিনির যদি কিছু কাম্য থাকে , বিধিমাফিক করার ভিতর - দিয়ে তা আয়ত্ত করার দায়িত্বও তুমি - তিনিরই । ফলকথা , তিনি নিজেকে যা - কিছুতে উৎসৃষ্ট করছেন , আমরা যে বেঁচে চলেছি , সে তার শক্তিতেই । আমাদের যা - কিছু তারই , ইচ্ছা করলে তা ’ দিয়ে আমরা তন্মুখী চলনায় চলে সার্থকও হতে পারি , আবার তার দিকে পিছনে ফিরে খোশখেয়াল মতাে চলে ঐ চলার দোষ তার ইচ্ছার উপরই চাপাতে পারি । কিন্তু বিধি বড় কঠিন বান্দা , সে কাউকে রেহাই দেয় না ।
শরৎদা— Predestination ( নিয়তি ) ও free will ( পুরুষকার ) এর কোনটা কতখানি act ( ক্রিয়া ) করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — রামকেষ্ট - ঠাকুর যে গরুর দড়ির উপমা দিয়েছেন — এইটেই ঠিক । গরু সেই দড়ির শেষ সীমা পর্যন্ত এবং এর মাঝখানে যে - কোন জায়গায় চ'রে ঘাস খেতে পারে । আর , যদি গলার দড়ি একেবারে খুলতে হয় , তাও ঐ এলাকার মধ্যে থেকে কারও সাহায্যে খুলতে হবে । মানুষও তেমনি predestination ( নিয়তি ) -কে অতিক্রম করতে পারে । Predestination (নিয়তি ) বলতে আমি বুঝি , যেমন করে যে সীমায়িত হয়ে আছে তাই , আর এক কথায় তাকে বলা যায় মায়া । গীতায় আছে— “ মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে ” —তিনি ছাড়া উপায় নেই । With all our passions and complexes ( সমস্ত বৃত্তি) - প্রবৃত্তি নিয়ে । তাতে interested ( অন্তরাসী ) হ'তে হবে , তবেই আমরা মায়ার পারে যেতে পারব । কারণ , একমাত্র তিনিই মায়ার পারে দাড়িয়ে আছেন , মায়া তারই সৃষ্ট । কিন্তু এই limitation- এর (সীমার ) ঊদ্ধে উঠতে গেলে limitation- এর ( সীমার ) মধ্যদিয়েই যেতে হবে । গরু যেমন একমাত্র গলার দড়ির range- এর ( সীমার) মধ্যে দাড়িয়েই গলার দড়ি খুলতে পারে , মানুষকেও তেমনি প্রকৃতিদত্ত বৈশিষ্ট্যের উপর দাড়িয়ে , সেই অনুযায়ী ইষ্টকে অনুসরণ করে ব্রহ্মবোধে উপনীত হ'তে Parabolic line- এর (অধিবৃত্তের রেখার ) মতো original line infinitely extend ( মূল রেখা) অনন্তপ্রসারিত করা চলে । আমাদের শাস্ত্রে আছে , শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে , কিন্তু শুদ্রত্ব বাদ দিয়ে নয় , শুদ্ৰত্বের উপর দাড়িয়ে । আবার শরীর , মন , প্রবৃত্তি , সংস্কার , সামর্থ্য , যা নিয়ে যেমনভাবে দাড়িয়ে আছে , তাও তার ইচ্ছা ও কর্মেরই সৃষ্টি । তাই , মানুষ যা হয়ে আছে বা হয়ে উঠেছে তার উপর দাড়িয়ে আরাে হওয়ার পথ খােলাই আছে । এই সম্ভাব্যতার ইতি নেই মানুষের । ঈশ্বর যেমন অনন্ত শক্তির আধার , মানুষও তেমনি — অবশ্য যদি তার উৎসের সঙ্গে যোগসূত্র অক্ষুন্ন থাকে । " God created man after his own image . ” ( ভগবান মানুষকে নিজের প্রতিকৃতি - অনুযায়ী সৃষ্টি করেছেন । )
শ্রীশ্রীঠাকুর — ভূষণদাকে দিয়ে অটলদার বৌদিকে ডাকিয়ে বললেন - বড় সাইজের পাচ সের রসগােল্লা করবি , ভিতরে ক্ষীরের পুর দিবি ( সৰ্ব্ব - অঙ্গের অভিব্যক্তি দিয়ে ) — একেবারে গন্ধে - বরণে - গানে মাত করে দেওয়া চাই । বাইরে পাঠাব , মনে থাকে যেন । শরৎদা — আমাদের সঙ্গে কারও মতভেদ হলেই আমরা inferiority complex ( হীনম্মন্যতা ) ব'লে দোষ দিই , এটা কেন হয় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর- Inferiority complex ( হীনম্মন্যতা ) অনেক সময় দুইজনেরই থাকে । Egoistic knot- এর ( অহমিকার গেরোর ) দরুন অকারণ গণ্ডগোল বাধে । ‘ বােধয়ন্তঃ পরস্পর হ'লে misunderstanding ( ভুল বোঝা ) হয় না । পরস্পরের প্রতি regard ( শ্রদ্ধা ) থাকলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের stand - point ( দৃষ্টিভঙ্গী ) -টা বুঝতে চেষ্টা করে । সেখানে বিরােধের অবকাশ কমই থাকে । আবার , যারা খাঁটি মানুষ , কেউ তাদের ভুল - ভ্রান্তি , দোষ - ত্রুটি ধরিয়ে দিলে তারা চটে যায় না , বরং নিজেদের adjust ( নিয়ন্ত্রণ ) করতে চেষ্টা করে , এবং যে ভুল ধরিয়ে দেয় , তার প্রতি আরো বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে । তবে ভুল ধরনটাও প্রীতির সঙ্গে হওয়া চাই । মানুষের অন্যায়ের প্রতি যখন কঠোর হই , তখন স্মরণ রাখা লাগবে , মানুষটা কিন্তু আমার আপন , তাকে যেন পর করে না দিই । আবার , আমরা অন্যায় করলে মানুষের কাছে কী ব্যবহার প্রত্যাশা করি , সেটাও মনে রাখা লাগবে , তবে মাত্রা ঠিক থাকবে । হীনম্মন্যতা যে কতভাবে আত্মপ্রকাশ করে , তার লেখাজোখা নেই । আমি হয়তো অনেক অপরাধে অপরাধী । কিন্তু লােকের কাছে জানাতে চাই যে , সে - অপরাধের নামগন্ধও আমার চরিত্রে নেই , তখন সেই অপরাধে কাউকে অপরাধী দেখতে পেলে তাকে হয়তাে শাসন করতে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে উঠি , ভিতরের উদ্দেশ্য , আমি যে তেমনতর অপরাধের উর্দ্ধে , লােকসমক্ষে সেইটে জাহির করা । এর উল্টো রকমটা অনেকের মধ্যে দেখা যায় , সেটাও হীনম্মন্যতারই ক্রিয়া । মানুষ যেমনতর অপরাধে অপরাধী , অনন্যর ভিতর তেমনতর অপরাধ দেখলে অনেক সময় সেটাকেই সমর্থন করতে উদগ্র হয়ে ওঠে । এর কোনটার মধ্যেই আত্মসত্তায় বা পরসত্তায় প্রীতি নেই — আছে নিজের প্রবৃত্তির প্রতি প্রীতি , প্রবৃত্তিকে সত্তা করে নিয়ে তারই পােষকতার কণ্ডূয়ন । কেউ - কেউ আবার মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে সব সময় জানিয়ে দিতে চায় যে সে মস্তবড় ভক্ত ; তার ভক্তির তুলনা নেই — সেইটে দেখাতে গিয়ে সে কারও সঙ্গে সহজভাবে চলতে পারে না , ছুতানাতায় অন্যের খুত ধ'রে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায় । এমনি করে অযথা খটাখটি বাধায় । তাই বলে এ - কথা কেউ মনে করাে না যে , ভক্তির পথে চলতে গেলে অসৎ বা অন্যায়কেও সমর্থন করতে হবে , তা নিরোধ করাই লাগবে — কিন্তু তা শুভবুদ্ধি - প্রণােদিত হ'য়ে — আত্মিপ্রতিষ্ঠার জন্যও নয় , কাউকে হীন প্রতিপন্ন করা বা জব্দ করবার জন্য নয় — সকলের মঙ্গলের জন্য , ইষ্ট স্বার্থ - প্রতিষ্ঠার জন্য ।
শরৎদা — কৃতঘ্নতাকে সবচেয়ে বড় পাপ বলা হয় কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ও ছাড়া তাে দুনিয়ায় পাপ বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই । Sex - complex ( কাম - প্রবৃত্তি ) যেমন আদি রস , কৃতঘ্নতা তেমনি আদি মাল নরকের , ওর থেকেই যত পাপের সৃষ্টি । পাপ মানে তাই , যা আমাদের সত্তাকে , পালন থেকে পতিত করে । আর , কৃতঘ্নতার প্রধান কৃতিত্ব হ'লাে , নিজের সামান্য স্বার্থের জন্য উপকারীর উপকার লোকসমক্ষে অস্বীকার করা , প্রয়ােজন হ'লে প্রত্যক্ষভাবে তার অপকার করা । উপকারীর বিপদে - আপদে তার পাশে দাড়িয়ে তাকে ছেড়ে যাওয়া , হয়তো তার বিরোধী বা শত্রু ; যে , তার সঙ্গে যোগ দিয়ে তার ( উপকারীর ) সৰ্ব্বনাশ সাধন করা । সত্তাপলিক ও সত্তাপোষক যে , তাকে যদি আমরা এইভাবে বিসর্জন দিই , তবে আমাদের সত্তা রক্ষা পাবে কিভাবে ? তাই , এর থেকে বড় পাপ আর কী হতে পারে ? তারপর আমাদের সমস্ত পাপ ও বিভ্রান্ত চলনের মূলেই আছে উৎসবিমুখতা । শ্রেয়বিধায়ক পিতা মাতা , গুরুজন ও গুরুর প্রতি যতই আমরা বিমুখ হই , আচরণের ভিতর দিয়ে ততই তাদের অস্বীকার করতে থাকি , তাদের নীতি লঙ্ঘন করতে তখন আমাদের বিবেকে বাধে না । এটাও একধরণের অকৃতজ্ঞতা , এবং এর থেকেই বহু দোষ দুর্বলতা আমাদের চরিত্রে বাসা বাঁধার সুযোগ পায় , তখন আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসংশােধনের বুদ্ধি থাকে না । কিন্তু গুরুজন বা গুরুর প্রতি সত্যিকার কৃতজ্ঞতাবোধ যদি থাকে তখন আমাদের সবকিছু দিয়ে তাদের নন্দিত করার আগ্রহই প্রবল হয়ে ওঠে , তার ফলে ভুলভ্রান্তি আপনিই শুধরে যেতে থাকে । তবে গুরুজন বা উপকারক কেউ যদি ইষ্টপরিপন্থী হয় , সেখানে তার বিরােধী হলে অন্যায় হবে না । বিভীষণ যেমন রাবণকে ছেড়েছিল রামচন্দ্রের জন্য । তা যদি সে না করত , তাহলেই অন্যায় হ'ত । কৃতঘ্নতা বড় কঠিন রােগ । অনেকে heredity ( বংশগতি ) থেকে পায় , purposely ( ইচ্ছা করে ) ঐ রকম করে - না ক'রে যেন পারে না । ফলকথা , প্রতিলোম সন্তান হলে treacherous ( কৃতঘ্ন ) হবেই , তারা কিছুতেই ওটা ছাড়তে পারে না । কারও কারও acquisition ( অর্জন ) হয় , - environment- এর ( পারিপার্শ্বিকের ) মধ্যে পড়ে , ইচ্ছা করলে তারা তা শােধরাতে পারে , অবশ্য যদি উপযুক্ত সংসর্গ পায় ।
শরৎদা— Heredity ( বংশগতি ) ও environment ( পারিপার্শ্বিক ) -এর মধ্যে কোনটি prominent ( প্রধান ) ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষ heredity ( বংশগতি ) থেকে পায় instinct ( সহজাত সংস্কার ) , environment ( পারিপার্শ্বিক ) দেয় তাকে nurture ( পােষণ ) । ছেলে জন্মাতে যেমন বাপ - মা দুই - ই লাগে , মানুষের জীবনে তেমনি heredity ( বংশগতি ) , environment ( পারিপার্শ্বিক ) দুটো factor ( জিনিস ) -ই লাগে । পরিবেশের মধ্যে অনেক কিছুই থাকে , কিন্তু মানুষ সাধারণতঃ তার instinct ( সহজাত - সংস্কার ) অনুযায়ীই Pick up ( গ্রহণ করে । প্রত্যেকের specific instinct ( বিশিষ্ট সংস্কার ) পােষণ পায় যাতে তেমনতর পারিবেশিক বিন্যাস যত হয় ততই ভাল ।
বৃত্তির গোলকধাঁধায় পড়ে মানুষ যে কেমন অসহায় হয়ে পড়ে , সে - সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — আমার মনে হয় , মানুষ এক - একটা complex- এর (প্রবৃত্তির ) দশায় পড়ে obsessed ( অভিভূত ) হয়ে যায় । সেই complex (প্রবৃত্তি ) একটার পর একটা অবস্থা সৃষ্টি করে চলে , একটা complex ( প্রবৃত্তি ) আর - একটা complex ( প্রবৃত্তি ) -কে ডেকে নিয়ে আসে । Complex (প্রবৃত্তি) -গুলি being ( সত্তা ) -কে absorb ( শোষণ) করে যেন ego ( অহং ) হয়ে দাড়ায় , individuality ( ব্যক্তিত্ব ) বলে কিছু তার থাকে না , being ( সত্তা ) -ই complex- এর ( প্রবৃত্তির ) control- এ ( বশে ) চলে যায় । মানুষ তখন স্রোতের মাঝে গা ঢেলে দেয় , সেই দশার ভােগকাল শেষ হবার আগে , হাজার বােঝালেও যেন সে - কথা তার মাথায় ধরে না , কারণ , ঐ অভিভূতিকে আঁকড়ে ধরে তাতেই আবিষ্ট হয়ে থাকতে ভালাে লাগে তার , পরে আবার সামান্য কথাতেই তার মোহ ছুটে যায় , চৈতন্য খুলে যায় । স্বস্তির বিষয় এই যে , will to live is constant ( বাচবার ইচ্ছা মানুষের চিরন্তন) , তার being ( সত্তা ) -কে touch ( স্পর্শ ) ক'রে দিতে পারলে , will to live (বাঁচবার ইচ্ছা ) excite করে ( উস্কে) দিতে পারলে সে সাড়া দেয়ই । ধর্মদানের মরকোচ এর ভিতরই নিহিত । বাচবার ও প্রকৃত উপভোগের কৌশল দেখিয়ে দেওয়াই সত্যিকার ধর্মদান । বিবর্তনের প্রতি একটা উদগ্র আগ্রহ জন্মিয়ে দিতে হয় , সঙ্গে - সঙ্গে সৰ্বমঙ্গল - মূৰ্ত্তি ইষ্টের চিত্র এমন মনোমোহন ভাবে তার সামনে তুলে ধরতে হয় - যা’তে সমগ্র সত্তার সন্বেগ নিয়ে সে তা'তে আনত হওয়ার জন্য উদ্দাম হয়ে ওঠে । যাজনের মরকোচ তো এইটুকু । কিন্তু আমার জীবনে ইষ্টের জন্য যদি ইষ্ট না হন , আমার কোনকিছুর জন্য যদি তাকে অনুসরণ করি , তবে ঐ নির্মল , নিভাজ অমৃত - আবেগটুকু মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে পারব না । “ স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্ৰায়তে মহততা ভয়াৎ । ” এ ধর্ম অনুরাগের ধর্ম । নিখাদ অনুরাগের ছিটেফোঁটাও যার জীবনে জেগেছে , তার আর ভয় - ভাবনার কিছু নেই । অনুরাগের বাতি যার নয়ন - কোণে জ্বলেছে , সৰ্বস্ব তেয়াগিয়া সে গুরুকে সার করেছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথাগুলি বলছেন ভাবে ডগমগ হ'য়েললিত - মধুর ভঙ্গীতে । তার চোখমুখ ও সারা অঙ্গ থেকে শুদ্ধা ভক্তির দিব্য প্রবাহ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠছে । উপস্থিত সবার অন্তর তখন বিগলিত , দ্রবীভূত , নির্মল ভাবভূমিতে আরূঢ় ।
শরৎদা - অন্যের বাচা - বাড়াকে অক্ষুন্ন রেখে বাচবার পথে চলাই তাে ধর্ম , কিন্তু সব সময় কি তা সম্ভব ? শ্রীকৃষ্ণকেও তো কত লোককে হত্যা করতে হয়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এত ধস্তাধস্তি , লােকসংগ্রহ , আন্দোলন কিসের জন্য ? বঁচিয়ে বাচাই তাে আমাদের উদ্দেশ্য । শ্রীকৃষ্ণ সব সময়েই চেষ্টা করছেন যুদ্ধবিগ্রহ avoid ( পরিহার ) করতে , কিন্তু তার environment ( পরিবেশ ) তাকে সে scope ( সুযোগ ) দিল না । আর , শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ — মৃত্যুকে মারবার Gangrene - affected part of the body ( শরীরের দুষ্টক্ষতযুক্ত স্থান ) অমরা যেমন কেটে ফেলি জীবন বাচাবার জন্য , তিনিও তেমনি মৃত্যু ও মরণের মূর্ত প্রতীকস্বরুপ যারা ছিল তাদের মেরেছিলেন সমগ্র সমাজকে বাচাবার জন্য ।
প্রফুল্ল — শ্রীকষ্ণ পরমপুরুষ হ'য়েও সমগ্র পরিবেশ আয়ত্তে আনতে পারলেন না, তিনিও তাে এতগুলি লোক মারতে বাধ্য হলেন — এ কেমন কথা ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাকে এই plane ( স্তর ) -এ কাজ করতে গেলে , মানুষের শরীর নিয়ে এসে যেমন - যেমন করতে হয় তাই করতে হবে , সময় ও সীমার মধ্যে ,আসলে তদনুযায়ীই চলতে হবে । তার ইচ্ছা অমােঘ , তার প্রয়ােজন তিনি সিদ্ধ করবেনই , কোনটায় অকৃতকার্য হন না । বাইরে থেকে যেটাকে অকৃতকাৰ্যতা মনে হয় , সেটাকেও তিনি এমনভাবে কাজে লাগিয়ে দেন যে তাও তার মূল জীবননান্দেশ্যকে আরাে অগ্রগতির পথে ঠেলে নিয়ে যায় , তিনি আফলোদয়কৰ্ম্ম , উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তার বিরতি নেই । কিন্তু তার ইচ্ছা ও প্রয়ােজন এবং বিধি - এর মধ্যে রয়েছে গভীর একতানতা ।
তার পরম মধুর অমৃতকথা শুনে কারও যেন আশ মেটে না , যত শোনা যায় ততই শুনতে ইচ্ছা করে । তাই , যারা ছিলেন তারা তাে কেউ উঠছেনই না , বরং সূর্যোদয়ের আগে - পরে আরো অনেকে এসে তার ভিতর - বাইরে ঘিরে বসলেন । আগের মতন প্রশ্নোত্তর চলতে লাগলো ।
শরৎদা — ক্ষর , অক্ষর দুইভাব transcend ( অতিক্রম করে পুরুষােত্তম থাকেন , তার মানে কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সেই আদিকারণ স্ব অর্থাৎ নিজের ভিতরে অনস্যূত বৃত্তির অভিধ্যান ও তপস্যা দ্বারাই যা - কিছু হয়েছেন , এই হওয়ার পিছনে আছে আবার তার ইচ্ছা । তার ইচ্ছাই বৈধী - করণের পথে প্রবাহিত হয়ে হওয়ায় উদ্ভিন্ন হয়ে উঠেছে । তাই , দুনিয়ায় যা - কিছু হয় , ইচ্ছা ও বৈধী - করণের পথেই হয় । পুরুষােত্তমও এই নিয়মের বহিভূত নন , সে - হিসাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার কোন পার্থক্য নাই । আবার , প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকেই সচ্চিদানন্দঘনবিগ্রহ , “ God made after His own image , ” কেষ্টঠাকুর গীতায় বলেছেন , “ বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্ণ্জুন , তান্যহং বেদ সর্ব্বাণি ন ' ত্বং বেথ পরন্তপ " । তফাৎ এই , তিনি সব জানেন , Universal I- এর ( বিশ্বাত্বার ) full consciousness ( পূর্ণচেতনা ) তার মধ্যে আছে , সেই light- এ ( আলােকে ) তিনি চলেন , উৎসের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে চির - যােগযুক্ত তিনি , তার কাছে সবটার meaning ( অর্থ ) আছে , আমাদের তা নাই । নচেৎ human barrier (মানবীয় পরিমিতি ) সবটুকুই তাঁর আছে , তিনি যে হাগবেন না , মুতবেন না , খাবেন না , মা - বাপ - স্ত্রী - পুত্রকে ভালবাসবেন না , সংসার - যাত্রা নির্বাহ করবেন না , সুখ - দুঃখ বােধ করবেন না এমন কিছু নয় । তিনি সহজ মানুষ , আর পুরােপুরি মানুষ না হলে মানুষ তাকে অনুসরণ করতে পারতো না , করলেও লাভবান হতাে না । সৃষ্টি - সম্ভূত জীবের ক্ষরত্ব তার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান , কোন অলৌকিকত্বের ধার ধারেন না তিনি , সাধারণ মানুষের মতাে রােগ , শােক , আধি , ব্যাধি , মৃত্যু সবই তার আছে , এ যেমন সত্য , তার ভূতমহেশ্বরত্ব ও অক্ষরত্বও তেমনি সত্য । সেই পরম চেতনা সহজ হয়ে বিদ্যমান তার চরিত্রে , তাই - ই তাকে প্রতিমুহূর্তে পরিচালিত করে । এ তার মধ্যে নিঃশ্বাস - প্রশ্বাসের মতাে সলীল ও বেমালুম , তাই সবকিছু নিয়েও তিনি সহজ , স্বভাব - সুন্দর , চির আত্মভােলা , সর্বাকর্ষক , ভালবাসার কাঙ্গাল । তিনিই মানুষের মুক্তির রাজপথ , তাকে বাদ দিয়ে এই নরলোকে ঈশ্বরলাভের অন্য কোন পন্থা নেই মানুষের । তাই , অধুনাতম যুগ - পুরুষোত্তমই মানুষের উপাসনার বেদী , তাঁর উপাসনায় পূর্বতন সকলেরই উপাসনা হয় , আর তিনি যদি বর্তমান না থাকেন তবে তদনুবর্তনশীল উপযুক্ত আচার্যের কাছে দীক্ষিত হ'য়ে তঁন্নিৰ্দেশিত নিয়মনে ঐ পুরুষােত্তম - পূজারী হয়ে চলাই মানুষের কল্যাণের পথ ।
সতীশদা — সবই যদি তার সৃষ্টি , তবে পাপ আসলো কোথেকে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষ উৎসবমুখ হয়ে উঠলে বৃত্তি তাকে চেপে ধরে । মানুষ বৃত্তি - অভিভূত হলে সত্তাপােষণী চলন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে , ঐ বৃত্তি সত্তারই রস নিঙড়ে তা দিয়ে আত্মপুষ্টি করতে চায় । আমরাও বৃত্তি - স্বরুপ লাভ করে ঐ বৃত্তিকেই সত্তা মনে করে তারই পুষ্টিসাধনে তৎপর হয়ে চলি । ফলে যা হবার তা হয় । পাপ মানে — এমনতর চলনা । ফল কথা , ঈশ্বর সৃষ্টি করলেও মানুষের ইচ্ছার উপর তার কোন হাত নেই । তিনি নিজে যেমন স্বরাট , স্বাধীন , প্রত্যেককে তেমনি স্বরাট , স্বাধীন করে দিয়েছেন , কাউকে কম করে দেননি কিছু । প্রত্যেককে তার মতো করে ভ'রে উজাড় করেই দিয়েছেন । এখন সে স্বেচ্ছায় তৎপ্রদত্ত সম্পদ যে - কোন দিকেই নিয়োজিত করতে পারে । এ - নিয়ে সে তঁন্মূখী চলনেও চলতে পারে , আবার তাকে অস্বীকার করে , তার দিকে পিছন ফিরিয়ে খেয়াল ও ভােগোন্মত্ততার পিছনেও ছুটে চলতে পারে । দুনিয়ার দিকে চাইলেও এটা আমরা স্পষ্ট বোধ করতে পারি । বাপের থেকে জন্মেও বাপের অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা ছেলের আছে , এ - স্বাধীনতা থাকলেও , এ - স্বাধীনতার সুযােগ গ্রহণ না করে যে পিতাকে মান্য করে চলে — সদভিদীপনা নিয়ে , সেই - ই উন্নতি লাভ করে । মানব - জাতির উন্নতি বা শান্তির বেলায়ও ঐ কথা — যত তারা উৎসমুখী হবে ততই তারা কল্যাণের অধিকারী হবে ।
অনেকে বলে , ঈশ্বর - পরিপন্থী চলনে চলবার স্বাধীনতা ঈশ্বর মানুষকে দিলেন কেন ?
তার জন্যই তো যত দুঃখকষ্ট । কিন্তু এ কথার উত্তর হল , জবরদস্তির ভিতর দিয়ে পীরিত হয় না , আর হলেও তা উপভােগ্য হয় না । মানুষের অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃত্তি - চলনের সম্ভাব্যতা থাকা সত্ত্বেও সে যখন তা উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় ইষ্টমুখী হ'য়ে চলে , ঈশ্বরমুখী হ'য়ে চলে - অনুরাগনিবদ্ধ হ'য়ে , বৃত্তি - প্রবৃত্তির সুনিয়ন্ত্রণে তৎপর থেকে , সেই অনুরাগ উভয়ের কাছে উপভােগ্য হয়ে ওঠে , লীলারসের আস্বাদন সম্ভব হয় অমনতর স্থলেই । নচেৎ , যন্ত্রচালিতবৎ গত্যন্তর - বিহীন হ'য়ে , বােধহারা আবর্তনে মানুষকে যদি তথাকথিত ভালর পথে চলতে হত , সে ভাল হত না । কারণ , কেন্দ্রানুগ অনুরাগে ভালমন্দের দ্বন্দ্ব - সংঘাতের মাঝখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিতর - দিয়ে মানুষের বােধের যে বিকাশ হয় , বিন্যাস - ক্ষমতা যেমন বেড়ে যায় , তা বাড়তে পারত না । মানুষের বিবর্তনও হত না । উপভােগও থাকতো না । তাছাড়া , অমনতর হলে চারিত্রিক দৃঢ়তা , ইচ্ছাশক্তি ও ব্যক্তিত্বের অভ্যুত্থানও সম্ভব হত না ।
ভবানীদা ( সাহা ) একটা টেলিগ্রাম নিয়ে আসলেন — একজন অসুস্থ , শ্রীশ্রীঠাকুরের আশীৰ্বাদ প্রার্থনা করে টেলিগ্রাম করেছেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন —এখনই জবাব দিয়ে দাও । কী অসুখ বিস্তারিত জানাতে বল ।
প্রফুল্লভগবান গােড়ায় তো একা ছিলেন , সৃষ্টি করলেন কেমন করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তার মধ্যে বৃত্তি ছিল । তিনি এবং তার বৃত্তি যেন positive (ঋজী সম্বেগ ) ও negative ( রিচী সম্বেগ ) , পুরুষ ও নারী । এই দুইয়ের আকর্ষণ - বিকর্ষণ ও আবেগদীপ্ত সহযােগ ও সম্মেলনের ভিতর দিয়ে সৃষ্টি গুণিত হ'য়ে চললাে তার বুকে । আকর্ষণ , বিকর্ষণ দুই আছে বলেই positive (ঋজী সম্বেগ ) ও negative ( রিচী সম্লেগ ) দুই - ই রয়ে যাচ্ছে , একটা আর একটাকে আকৃষ্ট করলেও তার সত্তা ও স্বতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে দিতে পারছে না । তাই সৃষ্টির সম্ভাব্যতা চিরস্রোতা হয়েই বয়ে চলেছে । Positive ( ঋজী সম্বেগ ) যেখানে যেমনতরভাবে বিদ্যমান তার counter part ( বিপরীত অংশ ) হিসাবে রয়ে গেছে তদনুপাতিক negative ( রিচী সম্বেগ ) । এই দুইয়ের ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়ার ভিতর - দিয়ে সুষ্ঠ সৃষ্টি লীলায়িত হয়ে ওঠে । আমাদের শাস্ত্রেও তাই মনোবৃত্তানুসারিণী স্ত্রীর কথা বলেছে , স্ত্রী যেন স্বামীর বৃত্তি অর্থাৎ ঐ পুরুষের প্রকৃতি - অংশ এবং স্বামী যেন স্ত্রীর স্ব অর্থাৎ অস্তিত্ব । এমনতর সাত্ত্বিক মিলন যেখানে , সেখানেই উদ্বর্দ্ধন ও সুপ্রজনন দুই - ই সার্থক হয়ে ওঠে ।
10