- সৰ্বজ্ঞত্ববীজ কী ?
- বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —মানুষ ত্রিকালজ্ঞ হয় কখন ?
- শরৎদা — বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে , জীব কৃষ্ণের নিত্যদাস , তার অর্থ কী ?
- গুরুই ভগবানের সাকার মূৰ্ত্তি , এ - কথা সদগুরু সম্বন্ধে না হয় খাটে , কিন্তু সব গুরু - সম্পর্কে কি এ - কথা বলা চলে ?
- প্রশ্ন করা হ'লাে — আপনি পারিবারিক চাহিদাকে উপেক্ষা করে ইষ্টের কাজে লাগতে বলেছেন ?
১৯ শে অগ্রহায়ণ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ৪/১২/১৯৪১ )
ভােরে শ্রীশ্রীঠাকুর - সমীপে বাঁধের ধারে তাসুতে আজও বৈঠক বসেছে । শরৎদা ( হালদার ) , হরিপদদা ( সাহা ) , প্যারীদা ( নন্দী ) , বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , ইলুদা ( বসু ) , বিমলদা মুখোপাধ্যায় ) , ঈষদাদা ( বিশ্বাস ) , শৈলেনদা
( ভট্টাচাৰ্য ) , ধূস্ক্রটিদা ( নিয়ােগী ) , কালিদাসীমা , মনিদামা , সরােজিনীমা , কালীষষ্ঠিমা প্রভৃতি অনেক দাদা ও মা - ই উপস্থিত আছেন ।
সৰ্বজ্ঞত্ববীজসম্বন্ধে কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — সর্বজ্ঞত্ব বীজাকারে থাকে , affair- এর (বিষয়ের ) মধ্যে পড়লে সেটা ফটে বেরােয় । সৃষ্টির উদ্ভেদ যা ’ হতে , তার মরকোচ যার অধিগত হয় সুকেন্দ্রিক তপশ্চৰ্যার ভিতর - দিয়ে , তার কিছুই অজানা থাকে না । সে একটু অভিনিবেশ - সহকারে যা - কিছু অনুধাবন করে , তারই মূলতত্ত্ব উদঘাটন করতে পারে । এটা কারও একচেটিয়া অধিকার নয় , প্রত্যেকেরই এটা হতে পারে তার বৈশিষ্ট্যমাফিক । তােমরা ভাল করে নাম - টাম করই না । অনুরাগমুখর হয়ে নামধ্যান খুব স্ফূর্তিতে চালিয়ে যাও , চলও প্রতিটি কাজে ইষ্টসন্ধিৎসু আগ্রহ নিয়ে , নিজের জীবনকে ইষ্ট - সৰ্বস্ব করে ফেল , দেখবে তোমাদের মধ্যেই কত জিনিস জেগে উঠবে । অবশ্য , কোন কিছুর লােভ রেখাে না , তখন ঐ লােভই পা ফেলে দেবে , এগুতে দেবে না । ফলকথা , সর্বজ্ঞত্ববীজ প্রকট য'তে তাকেই ভালবাস মণপ্রাণ দিয়ে , তার সঙ্গ কর , তাকে অনুসরণ কর , তার ইচ্ছা পূরণ কর সক্রিয়ভাবে , তার জন্য স্বেচ্ছায় সানন্দে দায়িত্ব গ্রহণ কর এবং তা ’ কৃতিত্বের সঙ্গে নিষ্পন্ন কর , এই স্রোতের মধ্যে ফেলে দাও নিজেদেরকে , নিজের - নিজের পুটলির ভাবনাটা ছাড় , তার যা - কিছুকে নিজের করে নিয়ে তারই জন্যে খাট , তারই প্রীতি ও প্রতিষ্ঠা - কামনায় প্রত্যেককে সেবা দাও তার বৈশিষ্ট্যমাফিক , —এই হিল্লেয় প'ড়ে তােমরা দেখতে পাবে , তোমাদের অজান্তে তোমরা অনেক কিছু জেনে ফেলেছ — পরিপূর্ণ বােধ - সঙ্গতি নিয়ে । এই চলনের পথেই সর্বজ্ঞত্ববীজ , ব্রহ্মজ্ঞান ইত্যাদি উদ্ভিন্ন হয়ে ওঠে । ও - সব কোন অজগবী বা এই জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয় ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —মানুষ ত্রিকালজ্ঞ হয় কখন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - ত্রিকালজ্ঞ মানে , একটা অবস্থা দেখে তার পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পরিণতি হবে , তা যে বুঝতে পারে সেই । জগতের কোনকিছুই বিচ্ছিন্ন ও অহেতুক নয় — একটা কাৰ্যকারণ - শঙ্খলায় জড়িত হয়ে আছে যা - কিছু , এই কাৰ্যকারণ গড়িয়ে - গড়িয়ে চলেছে কালের বুকে আরাে - আরাে কাৰ্যকারণের বীজ সৃষ্টি করে , এর সঙ্গে আবার মিশে আছে পরিস্থিতির চাপ , প্রত্যেকের স্ব - স্ব বৈশিষ্ট্য , প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি । এইগুলির ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া , পূর্বাপর পারম্পৰ্য্য বিবেচনা করলে , বৰ্ত্তমান বাস্তব যা ’ , তা দেখে অতীত ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যায় । অন্ধের মতাে নির্ভুলভাবে বলে দেওয়া যায় , astrologer ( জ্যোতিষীরা) যেমন বলে তার থেকে অনেক ভাল করে বলে দেওয়া যায় । এ কঠিন কিছু নয় । নিজেকে ভাল করে দেখা ও পড়ার অভ্যাস আছে যার , সে - ই অনেকখানি পারে । তবে প্রবৃত্তি - অভিভূতি যাদের নেই এক - কথায় , যারা মুক্ত পুরুষ , তাদের সম্বন্ধে কিছু নিশ্চয় করে বলা মুশকিল হয়ে পড়ে । যাহােক , ও - সব বলাবলির কথা নয় , তােমরা তোমাদের অতীত ও বর্তমানকে কার্যকারণ - সহ বিশ্লেষণ করে যতই বিশদভাবে অনুধাবন করতে পারবে ততই তােমাদের লাভ । ওতে নিজেদের চলনা নিয়ন্ত্রিত করার পক্ষে সুবিধা হবে , এমন - কি ঐ পশ্চাদপসারিনী চিন্তা ও বিশ্লেষণের ভিতর - দিয়ে তোমাদের স্মৃতিবাহী চেতনার উদ্বোধন হ'তে পারে ।
শরৎদা — বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে , জীব কৃষ্ণের নিত্যদাস , তার অর্থ কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - জীব কখনও কৃষ্ণ হয় না । আপনি কি আপনার বাবা হতে পারেন ? ছেলে বাবারই দাস । কারণ , সে বাবারই দান , বাবা থেকেই তার উৎপত্তি । জীবও তেমনি ঈশ্বরের দান , ঈশ্বর - কতৃক সৃষ্ট , তাই সে তার দান । আবার , সে যত ঈশ্বরের প্রতি এই আনুগত্য - বােধ নিয়ে চলে , ততই জীবনে অক্ষত অবস্থায় চলতে পারে , নচেৎ দুনিয়ার নানান টানে পড়ে কোথায় সে ছিন্ন - বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তার কি ঠিক আছে ? তাই বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে
“ জীব নিত্য কৃষ্ণদাস ইহা ভুলি গেল ।
মায়া - পিশাচী তায় গলায় বেড়িল ৷ ”
ঈশ্বরােপাসনার বেদী আবার ঐ পুরুষোত্তম , তাই জীবকে কৃষ্ণদাস বলা হয়েছে , ঈশ্বরদাস বলে ছেড়ে দেওয়া হয়নি । কারণ , অমূর্ত ঈশ্বরের উপাসনায় মানুষের বৃত্তিপ্রবৃত্তির গায়ে হাত পড়ে না । এটাকে আবার নিত্যসম্বন্ধ বলা হয়েছে এইজন্য যে , জীব যতই উন্নত ভরে উঠুক না কেন , সে জীবই এবং ঈশ্বর তার প্রভু । এই ভক্তি , অনুরতি ও অনুগতিই তার জীবন । সাধনার সম্পদ বা সঞ্চয় তার যতই থাক না কেন , যে - মুহূর্তে সে অহমিকায় মূলের সঙ্গে সংযােগ হারা হবে , সেই মুহূর্তেই সে শুকিয়ে উঠবে । ফলকথা , ঈশ্বর তার সত্তার সত্ত্ব , ঈশ্বর চিরপ্রভু , জীব চিরদাস । আমার এই রকমটাই ভাল লাগে । তাছাড়া দেখুন না , আপনি আপনার ছেলের বাবা হতে পারেন , কিন্তু আপনার বাবার কাছে আপনি ছেলেই — তা ’ আপনি যত বড়ই হন না কেন , এজন্মের মতো এ সম্বন্ধ অপরিবর্তনীয় । ঈশ্বরের সঙ্গে জীবেরও তেমনি চিরকালের মতো অপরিবর্তনীয় সম্বন্ধ ।
শরৎদা — আপনার অনুভূতির বর্ণনার শেষে লিখেছেন , ইষ্টপ্রতীকে তিনি আবির্ভূত হলেন , তা ’ কেন হয় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমরা সেই অকহ , অলখ , অগম রাজ্যে যখন প্রায় merge ক'রে ( ডুবে ) যাই , কেবল হয়ে উঠি , তখন কোন বােধই যেন থাকে না , যা থাকে তা বলা যায় না । অতােখানি সূক্ষ্ম ও গভীর স্তরে , ভিতরের টান , অর্থাৎ সৃষ্টির সঙ্কোচনী প্রভাব এতই প্রবল ও অনিবার্য হয় যে , আমাদের সত্তা যেন সেখানে গায়েব হয়ে যেতে চায় । ঐ মুহূত্তেও অনুস্যত চেতনাকে জীইয়ে রেখে , আবার স্থূলে প্রত্যাবর্তন করতে গেলে , ঐ ইষ্টসূত্রকে অবলম্বন করে ছাড়া তা ’ হবার উপায় নেই , সেখানে আমাদের চেতনা হ'তে আর সবই বিলীন হয়ে যায় । তাই , ইষ্টমূৰ্ত্তিই তাে ভেসে উঠবে , ইষ্টকে নিয়েই তাে আমি - বােধ । এ কাঠামো থাকতে , আমার এই রূপ থাকতে তার রুপ ছেড়ে যাবার জো নাই । তিনি যদি পরে অন্য রুপ নিয়ে আসেন এবং আমিও অন্য দেহ নিয়ে আসি তখন অবশ্য সেইরূপই বড় হবে । গুরুই ভগবানের সাকার মূর্তি । তাই যীশু বলোছেন --- “ I am the way , the truth , the life , none can come to the Father but by me . ” গীতায় আছে , “ বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্ মাং প্রপদ্যতে , বাসুদেবঃ সৰ্বমিতি স মহাত্মা সুদুলভঃ ” । আরো আছে— “ মন্মনা ভব , মদ্ভক্তঃ , মদ্ ষাজী মাং নমস্কুরু , মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে ” । বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে- “ কৃষ্ণের যতেক লীলা , সর্বোত্তম নরলীলা , নরবপু তাহার স্বরূপ । ”
নরবপু তাঁরই বপু । আবার শাস্ত্রে বলেছে , “ ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মৈব ভবতি ” , তাই তাকে বাদ দিয়ে দাঁড়াই কোথায় ?
প্রফুল্ল — গুরুই ভগবানের সাকার মূৰ্ত্তি , এ - কথা সদগুরু সম্বন্ধে না হয় খাটে , কিন্তু সব গুরু - সম্পর্কে কি এ - কথা বলা চলে ?
শ্রীশ্রীঠাকুরগুরু মানেই সদগুরু , আচাৰ্য্য । গুরু - পুরুষোত্তমই সচ্চিদানন্দের মূৰ্ত্ত বিগ্রহ , তিনিই রূপায়িত ঈশ্বর - প্রেরণা , তিনিই আত্মিক শক্তির প্রােজ্জ্বল প্রকাশ , অস্তিবৃদ্ধির পরম অমৃতপথ । দুনিয়ার যত দ্বন্দ্বের মাঝে অন্বয়ী সার্থকতার সারকেন্দ্র তিনিই । তাকে ভালবেসে , তার ইচ্ছা পরিপূরণ ক'রে তদনুগ আত্মনিয়ন্ত্রণে , তারই সঙ্গ , সাহচর্য ও সেবার ভিতর - দিয়ে মানুষ ঈশীস্পর্শ লাভে ধন্য হয় । আর , গুরু - পুরুষােত্তমকে direct ( সরাসরি ) যারা পায় , তারা তদনুবর্তী আচাৰ্য্য - পরম্পরার ভিতর দিয়ে তার ভাবটাই কিছু - না কিছু পায় । ঐ ভাব যখন মলিন ও ম্লান হয়ে যায় , উবে যাবার মতো হয় , বিকৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে , মানুষকে ঈশীস্পর্শে সঞ্জীবিত করে তোলবার জন্য তখন তিনি আবার মানুষ হয়ে আসেন , মানুষের মধ্যে তাদেরই একজন হয়ে ' বিচরণ করেন , আর নিজের আচরণ দিয়ে প্রতি - পদক্ষেপেই দেখিয়ে দেন , কেমন করে মানুষে ঈশ্বরেরই হয়ে চলতে পারে সবকিছুর মধ্যে । তাই গুরু তিনিই , আর তার অভাবে তাবভাবিত , তৎচলননিরত যাঁরা তাঁর । যেখানে কারও কিছু হয়েছে , কেউ কিছু পেয়েছে — তা ’ অমনতর গুরুকে ধরেই । নামকো - ওয়াস্তে ধরলে হবে না , তাকে অনুরাগভরে অনুসরণ করা চাই । আবার , এ - কথাও স্মরণ রাখতে হবে — সদ্গুর শুধু means ( উপায় ) নন , তিনি নিজেই goal ( উদ্দেশ্য ) ।
নরেনদাকে ( চক্রবত্তী ) শ্রীশ্রীঠাকুর একখানি ছবি আঁকতে দিয়েছেন । সেটা শেষ করতে দেরী হচ্ছে । তাই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — কাজ যদি তাড়াতাড়ি সুন্দরভাবে না করতে পারিস , তবে কিন্তু ঢিলেমিই পেয়ে বসবে । করবি , কিন্তু তাতে তুই লাভবান হতে পারবি না ।
প্রশ্ন করা হ'লাে — আপনি পারিবারিক চাহিদাকে উপেক্ষা করে ইষ্টের কাজে লাগতে বলেছেন , আবার বলেছেন , যারা সাংসারিক জীবনে অকৃতকাৰ্য্য তাদের আধ্যাত্মিক চক্ষু তমসাচ্ছন্ন — এর সামঞ্জস্য কোথায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ইষ্টের জন্য আপ্রাণ হ'য়ে উঠলে তখন সংসারও ইষ্টাৰ্থে হয়ে ওঠে । কিছুদিন অভাব - অভিযােগ , struggling period ( টানাটানি অবস্থা ) চললেও ইষ্টের কাজ ঠিক - ঠিক উপচয়ীভাবে করতে লাগলে — তাতেই ঠিক - ঠিক interested ( অন্তরাসী ) হয়ে উঠলে বেশীদিন তা থাকে না । তখন আমাদের চরিত্রবল , যোগ্যতা , মানুষ - সম্পদ সব - কিছুই বেড়ে যায় , দুঃখ থাকে না । যতক্ষণ আমরা নিজেদের নিয়ে বিব্রত থাকি , ততক্ষণ কেউ আমাদের আপন হয় না , কিন্তু যে - মুহূর্তে আমর ইষ্টকে নিয়ে মেতে উঠি , তারই স্বার্থ - প্রতিষ্ঠাকল্পে পারিপার্শ্বিকের সেবায় উন্মুখ হয়ে উঠি , তখনই সবাই আপন হয়ে ধরা দেয় , তারাই আমাদের দুঃখ দূরীকরণের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে দাঁড়ায় । আবার , যে ঠিক - ঠিক ইষ্টপ্রাণ সে পরিবারের সকলকেও ঐ - ভাবে অনুপ্রাণিত করে তােলে , তাতে পরিবারের মধ্যেও একটা integration ও consolidation ( সংহতি ও সংঘবদ্ধতা ) আসতে থাকে , প্রত্যেকে ইষ্টের জন্য ও পরস্পরের জন্য করে । ঐ loving urge ( প্রীতিপ্রাণ আকূতি ) -ই প্রত্যেকের কর্মশক্তিকে বাড়িয়ে তোলে , আবার concentric (সুকেন্দ্রিক ) হবার দরুন কাজগুলিও হয় well - adjusted ও profitable ( সুনিয়ন্ত্রিত লাভজনক ) । ধর , ইষ্টভৃতির ভিতর দিয়ে সংসারের প্রত্যেকের মধ্যে কেমন একটা excess urge (বাড়তি আকুতি ) এসে হাজির হয় , সেই দীপনবেগে চলন ও করণ সংসারকে
সচ্ছলতায় উজ্জ্বল করে তোলে । তখন ইষ্টের চাহিদা পূরণের জন্য তারা সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে , তিনি কোন সময় কী চান , তার জন্য আগে থাকতেই কিছু কিছু সংগ্রহ করে রাখে । ইষ্টেরটা যদি ঠিক থাকে , সংসার তো তার তলায় , সেটাও ঠিক থাকে । যেমন , একজনের নিজের সংসারের জন্য লাগে মাত্র ৩০ টাকা , কিন্তু ইষ্টের জন্য আর ১০ টাকা সংগ্রহ যদি করতে হয় , তবে ৪০ টাকার urge ( আকূতি ) নিয়ে চলে তাকে তা সংগ্রহ করতেই হবে । কারণ , ইষ্টকে না দিয়ে , খাইয়ে তার তৃপ্তিই নেই । আর , ইষ্টের স্বার্থপ্রতিষ্ঠার জন্য , ইষ্টকে এই দেওয়া বজায় রাখার জন্য নিজেদের বাচা বাঁচিয়ে রাখতে হবে , তাই সমগ্র অর্জনটাই যেন ইষ্টের জন্য । ৪০ টাকার মধ্যে তাে ৩০ টাকা আছেই , তাই অভাব থাকে না । ইষ্টকে দেওয়ার , ইষ্টম্বার্থপ্রতিষ্ঠার urge- এর ( আকুতির ) দৌলতেই কিন্তু তুমি সচ্ছলতায় উচ্ছল হয়ে উঠলে । ইষ্টকেও দিলে , পারিবারিক সংস্থানও করলে , drudgery ( দিগদারি ) বা বিভ্রান্তি আর থাকলো না । গােড়ায় ইষ্ট থাকার দরুন সব কাজ মিষ্টি মোহন সুঠাম হয়ে উঠলাে । আবার , এই পথে লাখ ঐশ্বর্যের অধিকারীও যদি হও , তাও তুমি তাতে আবদ্ধ হয়ে পড়বে না , তুমি সবটার মধ্যে থেকেও উপরে থাকবে । কারণ , তুমি জান , তোমার সবকিছুই তারই সেবার জন্য , তাই ঐশ্বৰ্য্য তোমাকে অভিভূত বা বিমূঢ় করতে পারবে না । আবার , খানিকটা কৃচ্ছতার মধ্যদিয়েও যদি তোমাকে চলতে হয় , তাতেও তুমি ক্লিষ্ট , সন্তপ্ত বা দিশেহারা হয়ে পড়বে না । কারণ , তাকে নিয়ে তুমি এতই ভরপুর হয়ে থাকবে যে , অভাব - বোধ তােমাকে পীড়া দিতে পারবে না । তবে কোন প্রত্যাশার কাঙাল হ'য়ে তার ভরণ - পূরণ করতে যেও না । তা'তে রস পাবে না , অন্তরের ঐ দৈন্যই তােমাকে তন্ময় হতে দেবে না , তাই বুকও ভরবে না , তৃপ্তির সন্ধানও পাবে না ।
বীরেনদা — মানুষ যে তথাকথিত সৎকাজের বন্ধনে আটকে যায় তার উপায় কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষ ক্ষুদ্র ভালর মধ্যে আটকে থাকে , সেটা যদি কারও প্রীত্যর্থে না হয় রসগােল্লা খুব ভাল জিনিস , কিন্তু রসগোল্লার লােভ যদি আমাকে পেয়ে বসে , তাহলে রসগোল্লা আমাকে আটকে রাখল । আত্মতৃপ্তি ও আত্মপ্রীতি যেখানে মুখ্য , সেখানেই আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়ি , তার গণ্ডী কেটে বেরুতে পারি না , আমাদের অগ্রগতিও রুদ্ধ হতে থাকে । আমা - অতিরিক্ত কোন জীয়ন্ত মানুষ আমার উপাস্য না হয়ে যদি আমার কোন কামনা বা ধারণা আমার উপাস্য , অনুসরণীয় হয় , তবে আমি তাতেই তাে আরাে করে নিমজ্জিত হব। কারও তৃপ্তির জন্য না হলে , মানুষ নিজের ego ( অহং ) ও whim (খেয়াল ) -কে satisfy ( তুষ্ট ) করবার জন্য তার ধারণামাফিক ভাল নিয়ে rigid ( অনমনীয় ) হ'য়ে বসে থাকে । শ্রেষ্ঠের প্রীতির জন্য হ'লে সে চায় আরো , অরো , আরাে কোন একটা জায়গায় সমাপ্তিরেখা টানতে চায় না । কারণ , ঐ তার পরিপূরণের জন্য আরােতরের পথ তার খোলা রাখতেই হয় , মানুষ এইভাবে eternal becoming ( অনন্ত বিবর্ধন ) -এর পথে চলে । ইষ্টস্বার্থ , ইষ্টপ্রতিষ্ঠা হ'ল ভব - সমুদ্রের compass ( দিঙনির্ণয় - যন্ত্র ) , ওর ভিতর দিয়েই আসে ব্রহ্মজ্ঞান বা বৃদ্ধির জ্ঞান , আত্মজ্ঞান অর্থাৎ চলৎ - জ্ঞান । ইষ্টার্থ - অপূরণী ধান্ধা যদি না থাকে তৎপূরণী বাস্তব কর্মের দায়িত্ব যদি মানুষ গ্রহণ না করে , তবে চোখ বুজে সাধনা সে যতই করুক না কেন , তার কিন্তু ঐ জ্ঞান ফোটে না । করার ভিতর - দিয়ে , চলার ভিতর দিয়ে আসে অভিজ্ঞতা , আসে ভূয়ােদর্শন , তা ’ যার যত একসূত্ৰসঙ্গত তার জ্ঞান তত পাকা ।
একটি মা দরজার পাশ জুড়ে বসেছিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে বললেন — সব সময় লক্ষ্য রাখবি অন্যের সুবিধা কিসে হয় । সব ব্যাপারে এইটে যদি লক্ষ্য রাখিস তাহ'লে সুখী হতে পারবি ।
ধূর্জটিদা - ভগবান সর্বশক্তিমান হয়েও এত ছোট জিনিস থেকে সৃষ্টি সুর করেছেন কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সৃষ্টি হলাে তাঁর লীলা — আলিঙ্গন ও গ্রহণ , ‘ ছিল না’র বক্ষ বিদারণ করে সত্তার ফুটে ওঠার মধ্যেই তাে আনন্দ , এর মধ্যেই তাে শক্তি । উপাদান যত সূক্ষ্মই হােক না কেন , এই ধর্ম যেখানে আছে , বুঝতে হবে , সেখানেই শক্তি নিহিত আছে । আমরা যে এক - একজন এত বড় হয়েছি , আমরা গোড়ায় তাে একটা zygote ( জীবন - কোষ ) ছাড়া আর কিছু না । কিন্তু ওর মধ্যে এতখানি সম্ভাব্যতা লুকিয়ে ছিল , তাই আমরা এত বড় হতে পেরেছি । সব ব্যাপারেই এই রকম । আর , সবকিছুর মূল যা ’ , তা যদি আমরা বুঝতে পারি , তখন আমাদের কিছুই বুঝতে বাকী থাকে না । সেই সৰ্ব্বকারণকারণ মানুষী তনূ ; ধ'রে আসেন , সেই কারণ - সত্তার বাচক যে বীজনাম , তাও তিনি আমাদের কাছে ঘােষণা করেন । এই নামের অনুশীলন যদি আমরা করি নামীতে অনুরক্ত হয়ে , আমাদের চলা , বলা , করা যদি নাম ও নামী - অনুগ হয় , তখনই আমাদের কাছে সব খুলে যেতে থাকে ।
১৩০ টাকার স্বাক্ষরকারী উপযুক্ত সংখ্যক সংগ্রহ করার পথে কী - কী অসুবিধা হচ্ছে সেই সম্বন্ধে কথা উঠলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর তাতে বললেন — যা আমাদের করণীয় তা করতেই হবে , কোনরকম negative consideration (নেতিবাচক বিবেচনা ) -কে অমিল দিলে চলবে না , সমস্ত বিরুদ্ধতাকে ছাপিয়ে উঠবে আমাদের উদগ্রীবতা , আমাদের উৎসাহ , তাই - ই ‘ না’কে ‘ হাতে পর্যবসিত করবে । উদ গ্রীবতা , উৎসাহই হলো আদত জিনিস , ও যার আছে , সে কিসের ভিতর - দিয়ে কী ক'রে ফেলবে তার ঠিক নাই । মানুষ যখনই বলে অভাব - অভিযােগের কথা , তখনই বুঝবে — তার unwillingness ( অনিচ্ছা ) আছে । Sentiment ( ভাবানুকম্পিতা ) হ'লো মানুষের আসল , sentiment- কে ( ভাবানুকম্পিতাকে ) এমন করে চেতিয়ে দিতে হবে যে , সেটা যেন তাকে ভূতের মতো পেয়ে বসে , সব কাজের মধ্যে তাকে pursue ( অনুসরণ) করে এবং all rationality ( সমস্ত যুক্তি ) যেন সেই sentiment- কে ( ভাবানুকম্পিতাকে ) support ( সমর্থন ) করে । আমাদের নিজেদের মধ্যে যতখানি উদগ্রীবতা থাকে ততটা অন্যের ভিতর সৃষ্টি করে দিতে পারি । আমি যে পাই , পাওয়ার mechanism ( মরকোচ ) -টা আমি জানি । আমার সব সময় উদ্দেশ্য থাকে — প্রত্যেকে যাতে আরো পারে , আরাে পায় , আমাকে দেওয়াটা যাতে তার পাওয়ার পথ খুলে দেয় , ঐ দেওয়াটাই যাতে তার উদ্বদ্ধনের কারণ হয় । দুনিয়ায় urge ( আকুতি ) -ই তাে যা - কিছু সৃষ্টি করে , সেই urge ( অকুতি ) গজিয়ে মানুষকে বাঁচা বাড়ায় উন্নীত করে তােলাই ধৰ্মদান । পাওয়ার urge- এর ( আকূতির ) থেকে দেওয়ার urge ( আকৃতি ) যত ফুটিয়ে দেওয়া যায় এবং তাও আবার যত শ্রেয়কেন্দ্রিক হয় , ততই মানুষের মঙ্গল হয় । মানুষ যে exercise ( ব্যায়াম ) করে , সে তাে শক্তিক্ষয় , কিন্তু শক্তিবৃদ্ধির জন্য সেই শক্তিক্ষয় প্রয়ােজন , দেওয়াটাও তাই পাওয়ার জন্য দরকার হয় । ফলকথা , তুমি যদি তেমনতর হও , তোমার ঐ উদ্দীপ্ত ভাব , চেহারা , চাল - চলন , কথাবার্তা অনন্যর মধ্যেও সেই উদ্দীপনা সঞ্চারিত করে তুলবে , তারাও convinced ( প্রত্যয় - প্রবুদ্ধ ) হয়ে উঠবে , একটা positive ( ইতিবাচক ) ভাব এসে যাবে তাদের মনে , সমস্ত negative ( নেতিবাচক ) ভাব ও pessimism (দুঃখবাদ ) উবে যাবে তাদের অন্তর থেকে ।
10