* এক-একজনের ব্যবহারে চ'টে যাই, প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে, এর উপায় কী ?
* বিশ্বাসঘাতক ) কিনা তা বুঝবো কী ক'রে ?
* ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে কী ?
১৭ই অগ্রহায়ণ, মঙ্গলবার, ১৩৪৮ (ইং ২। ১২। ১৯৪১ )
ভোরে বাঁধের ধারে তাসুতে মধুময়কে ঘিরে মধুচক্র জমে উঠেছে—বিভোর হ'য়ে সবাই সেই মধুময়ের মধুক্ষরা বচনসুধা পান করছেন, আর উপভোগ করছেন তাঁর মধুর হাসি, মধুর কথা, মধুর চাউনি, মধুর স্নেহ । উপস্থিত সবার কাছে এখন—‘সুন্দর আজি সবই সুমধুর, এইতো পূর্ণ এ হৃদয়পুর । একটু বেসুরোভাবেই প্রশ্ন করা হ’লো—হঠাৎ অনেক সময় এক-একজনের ব্যবহারে চ'টে যাই, প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে, এর উপায় কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর—আমাদের উদ্দেশ্য হ'লো মানুষকে জয় করা, তার হৃদয় অধিকার করা, তার ego-কে ( অহংকে ) কাবু ক'রে ফেলা, repentance ( অনুতাপ ) জাগান । তা' যদি না পারলাম, আমাদের জিদের কিম্মত কী? আর, পারষ্পরিক সুখই বা কোথায় ? যার উপর প্রতিশোধ নেবো, সেও যদি ব্যথার মধ্যে সুখবোধ না করে, তাহ'লে কি সুখ হয় ? আমরা মানুষটাকে পেতে চাই, একটা মানুষকে হারিয়ে লাভ নেই, তবে তার মধ্যে সত্তাসম্বদ্ধনার পরিপন্থী যা আছে তার নিয়ন্ত্রণ বা নিরসন প্রয়োজন। সেইজন্য তাকে শাসনে সংযত করা দরকার হতে পারে। এই শাসন হবে আবার প্রীতির শাসন, কঠোরতার মধ্যেও প্রীতি থাকবে। তার প্রতি তোমার প্রীতি যদি তার ভিতর তোমার প্রতি প্রীতি উদ্দীপ্ত ক'রে তুলতে পারে, তাহ'লেই তুমি তাকে সংশোধন করার পথ পেলে । তবে কারও ভিতর obsession ( অভিভূতি ) থাকলেও বারংবার চেষ্টায় তাকে ফেরান যায়, কিন্তু treacherous habit ( বিশ্বাসঘাতী অভ্যাস) ও instinct ( সংস্কার ) থাকলে তাদের হৃদয় জয় ক'রে তাদের ভিতর পরিবর্তন আনা কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে পারাই যায় না ।
প্রশ্ন—Treacherous ( বিশ্বাসঘাতক ) কিনা তা বুঝবো কী ক'রে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — Treacherous ( বিশ্বাসঘাতক )-এর একটা লক্ষণ — সবটার মধ্যে সে directly মুখ্যভাবে ), indirectly ( গৌণভাবে ) নিজেকে establish ( প্রতিষ্ঠা) করতে চায়, তার জন্য কে যে কত করছে সে-কথা মুক্ত কণ্ঠে ব'লে কৃতজ্ঞতা জানায় না, সে যে একটা অসাধারণ কৃতী-মানুষ এবং তার গুণের জন্যই যে সর্বত্র তার সমাদর—এই কথাটাই সে কায়দা করণে, হাবেভাবে, প্রকারান্তরে প্রতিনিয়ত জাহির করতে চায়। ফলকথা, কারও মমতায় সে কিছু করে না, নিজের হীনম্মন্যতার মমতায় যা কিছু করে।
কথায়-কথায় শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন – আর কিছু না, তোরা যা ঠিক করেছিস্ সেইমতো heart and soul (প্রাণপণ ) খেটে ১৩০ টাকার signatory ( স্বাক্ষরকারী ) ৫। ৭ হাজার জোগাড় কর, আমি কিছুই বাকী রাখব না। এরপর অন্য কথা উঠলো ।
প্রফুল্ল –ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের কথা এত জোর দিয়ে আমরা বলি, সে জিনিসটা কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর—প্রত্যেক মানুষ আলাদা হয়েছে যা দিয়ে—সেইটেই তার বৈশিষ্ট্য। বর্ণ ও বংশ এর মধ্যে বিশেষভাবে ক্রিয়া করে, তারপর জন্মকালে পিতা-মাতার মানসিক ভঙ্গী ও ভাবভূমিরও অনেকখানি অবদান আছে এতে। আর চারটে complex (গ্রন্থি) আছে—OEdipus complex ( এডিপাশ গ্রন্থি ), এর স্বস্থরূপ হ'লো ছেলের মায়ের প্রতি অনুরাগ ; Narcissus complex ( নার্সিসাস গ্রন্থি ), এর স্বস্থরূপ হলো আত্মপ্রীতি, আত্মপ্রত্যয়, আত্মমর্য্যাদা- বোধ—এর মধ্যে কিন্তু হীনম্মন্যতা নেই, অন্যকে খাটো করার প্রবৃত্তি নেই ; Homo Sexual complex ( সম যৌনগ্রন্থি ), এর স্বস্থরূপ হলো মানুষের সামাজিকতাবোধ ; আর আছে Hetero-Sexual complex ( অসম যৌনগ্রন্থি ) । সুস্থ যৌন আকাঙ্ক্ষা যেখানে ধর্মসঙ্গত বিহিত পথে আত্মপ্রকাশ ক'রে নর- নারীর বৈধী মিলনের ভিতর দিয়ে সুপ্রজননে সাৰ্থক হ'তে চায়, তার মধ্যে এর স্বস্থ অভিব্যক্তি দেখা যায়। এগুলির বিকৃতিও ঢের হয়। Psychology-তে (মনোবিজ্ঞানে) কী বলে আমি ঠিক জানি না, তবে আমি এইরকম বুঝি। যাহোক, প্রত্যেকের মধ্যে সব ক'টা complex ( গ্রন্থি) থাকলেও, এক-একজনের মধ্যে এক-একটা prominent (প্রধান)। এইগুলি watch ( লক্ষ্য ) করে বৈশিষ্ট্য বুঝা যায়, আর সেই অনুযায়ী মানুষকে deal (ব্যবহার) করতে পারলে মানুষ elated (খুশি) হ'য়ে যায়—একটা expression ( কথা ) শূনেই বলবে, বাঃ, beautiful (সুন্দর), কী চমৎকার লোক, কেমন কথাটা বললো ! এই যে একজনের বৈশিষ্ট্য ধরা—তাও নিজে obsessed (প্রবৃত্তি)-অভিভূত হয়ে থাকলে পারা যায় না-
'রঙ্গিল দৃষ্টি নয়কো যখন ।
' আগ্রহ-নত মন,
তেমন মনই ধরতে পারে
সংস্কার কেমন
ইষ্টের রঙে যে যত রঙিয়ে থাকে সে তত uncoloured ( অরঙ্গিল ) অবস্থায় প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করতে পারে। প্রায় লোকেই প্রবৃত্তির ঘোরে চলে, তাই বিশ বছর যার সঙ্গে একসঙ্গে একঘরে থাকে, তারও বৈশিষ্ট্যটা হয়তো বোঝে না । এই না-বোঝার দরুন কত ঠোকাঠুকি বাধায়, আবার শুধু মাথায় বুঝ হ'লেই যে হয় তা' নয়। প্রবৃত্তি-অভিভূতির কবলে যখন আমরা প'ড়ে যাই তখন কোথায় কার সঙ্গে কী ব্যবহার সমীচীন—তা জানা সত্ত্বেও আচরণে ফুটিয়ে তুলতে পারি না। তাই, একটু বুদ্ধিমান লোক যারা তারা সর্ব্বক্ষিণ ইষ্টরত হ'য়ে প্রবৃত্তি-অভিভূতির মুঠ,ম-হাত উপরে থাকতে চেষ্টা করে ।
ফরিদপুর থেকে একটি দাদা আসলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর কাছে ফরিদ- পুরের অনেকের খবরাখবর জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি কুষ্ঠিয়া হ'য়ে এসেছেন শুনে ডাক্তারবাবার কথাও জিজ্ঞাসা করলেন ।
শরৎদা ( হালদার ) পূর্ব্বপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন—ক্লাশে পড়াতে গিয়ে বা সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে কী ভাবে বলতে হবে ? সেখানে তো নানা বৈশিষ্ট্যের বহু লোকের সমাবেশ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— প্রত্যেকটা musical instrument -এ ( বাদ্য যন্ত্রে ) কতকগুলি ঘাট থাকে, গ্রাম থাকে, তার সাহায্যে সব গৎ যেমন বাজান যায়, নানাবিধ প্রকৃতি- ওয়ালা একটা group ( দল )-এর কাছে বলতে গেলে তেমনি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য nourishment ( পোষণ) পায়—তেমন ধরণের ঢেউ তুলতে হয় । সব ক'টা pose ( ভঙ্গী ) নিতে পারলে, tune (সুর) ও touch (স্পর্শ) দিতে পারলে, প্রত্যেকে interested ( অন্তরাসী ) হবেই । Sublime language- (গুরুত্বপূর্ণ মনোজ্ঞ ভাষায় ) topic ( বিষয় )-এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে tactfully ( সুকৌশলে ) বলতে হয় ৷ হয়তো বললেন—তোমার ছেলে, তোমার স্ত্রী না খেতে পেয়ে আজ পথে এসে দাড়াতে বসেছে—এর সমাধান কি তুমি চাও না ?” ছেলে-বৌয়ের কথা বলেছ না অমনি তার complex ( প্রবৃত্তি ) interested (অন্তরাসী) হ'য়ে উঠল—তার মন চেতে উঠল, সে ভাবলো—কী কয় শুনে দেখি । তবে শুধু প্রবৃত্তিতে উস্কানি দিয়ে লাভ নেই, আর মানুষের হীন প্রবৃত্তি যেমন আছে, উন্নত প্রবৃত্তিও তেমনি ঢের আছে । বলতে গিয়ে সেগুলিকে আগুন ক'রে তুলতে হয়—ইষ্ট, কৃষ্টি, ধর্ম, বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকের স্বার্থ ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের আগ্রহকে উদ্দীপিত করে তুলতে হয়। সুকেন্দ্রিক মঙ্গলকৰ্ম্মে মানুষকে যতই উন্মাদ ক'রে তুলতে পারবে ততই বোঝা যাবে তোমার বলা সার্থক হ'লো । মানুষ complex -এর ( প্রবৃত্তির) রাজ্যে যেমন দাড়িয়ে আছে তেমনি প্রবৃত্তিকে sublimate ( ভূমায়িত) করার ইচ্ছাও তার আছে। তাই, বাস্তবের সঙ্গে যোগ রেখে বললে সৎ-এর প্রতি নেশা ধরিয়ে দেওয়া কঠিন কিছু নয় ৷ মানুষের যেমন স্বার্থপরতা আছে, পরার্থপরতার প্রবৃত্তিও তা'তে কম নেই এবং সেটা তা'তে কম প্রবল নয় । প্রকৃতপক্ষে, পরার্থপরতাই তার স্বার্থের ভিত্তি । মানুষের যেমন আরামপ্রিয়তা ও তথাকথিত ভোগাকাঙ্ক্ষা আছে, ইষ্টার্থী ক্লেশ- সুখ-প্রিয়তা, ত্যাগ ও দুঃখ-বরণের পাহাও যে তার না আছে, তাও নয়। দরকার ঐগুলিকে উস্কে দেওয়া, ওগুলির প্রতি লোভ জন্মিয়ে দেওয়া । শিল্পীর কাজ হ'লো তাই। প্রত্যেকটি আঙ্গিনা থেকেই এর কর্ষণ যদি চলে, জাতের মধ্যে progressive mood ( প্রকৃত প্রগতিমুখী মনোভাব) চারিয়ে যেতে বেশী দেরী লাগে না।
10