* শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রং কেমন ছিল ?
* শ্রীশ্রী ঠাকুরের কালী মা দর্শন...
* গুপ্তচরদের বিপদের সময় সাহায্য...

২৬ শে আশ্বিন , শুক্রবার , ১৩৪৬ ( ইং ১৩/১০/১৯৩৯ )
সকালে শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃমন্দিরের পিছনে আশ্রম - প্রাঙ্গণে বাবলাতলায় বেঞ্চিটির উপর এসে বসেছেন । এক - এক করে লােক জমতে লাগলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এক দাদাকে কাজ - কর্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করছিলেন , তিনি বললেন — সহকর্মীর ঔদাসীন্য ও গাফিলতির দরুন কাজ অশানুরুপ হয়নি । সেই প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর ললিতগম্ভীর ভঙ্গীতে বলতে লাগলেন - আমরা principle- এ ( আদর্শে ) যদি খুব strong ( অটুট ) হই — তাহলে আমরা পারিপার্শ্বিকের কাছে yield ( বশ্যতাস্বীকার করি না , বরং পারিপার্শ্বিক আমাদের কাছে yield ( বশ্যতাস্বীকার করে । অামাদের যদি এমন ঝোঁক থাকে যে , যা করার তা করবই , আর সত্যি - সত্যি তা যদি করি এবং সে - কাজে যদি পারিপাশ্বিককে নিয়ে চলা প্রয়ােজন হয় , তবে পারিপার্শ্বিকের সকলেও উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে —
যারা চায় না , তারা আপনা থেকে খসে পড়ে । আমি আর বীরুদা ( রায় ) একদিন একসঙ্গে যাচ্ছি — বীরুদা কিছুদূর গিয়ে tired ( ক্লান্ত ) হয়ে বসে পড়ল — আমি তার জন্য wait ( অপেক্ষা না করে সােজা হাঁটতে লাগলাম , বীরুদাও উপায়ান্তর না দেখে হাঁটতে সুরু করল । তাই , ঢিলেমি বা গাফিলতিকে প্রশ্রয় দিতে নেই । মজা এমনি — মানুষের ইচ্ছাকৃত এটি অবশভাবে ভুল - ত্রুটিকেই ডেকে আনে । কেউ হয়তো কোথায়ও যাবে কোন কাজের জন্য পাকে - চক্রে হয়তো মঘার দিনই যাত্রা করল — আগে - পরে যাওয়ার সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তা ঘটে উঠলো না — ঐ দিন গিয়ে অনেক বাধা - বিপত্তির পর তবে হয়তাে কাৰ্য্য সমাধা হলাে — এমন দেখলে বুঝতে হবে , তাদের principle ( আদর্শ ) -মুখী motor - sensory co - ordination ( বােধ ও কর্মস্নাযু়র সঙ্গতি ) সম্বন্ধে কোন - না - কোন গণ্ডগোল আছে — হয়তাে immediatet motor - sensory co - ordination ( ত্বরিত - সঙ্গতি ) নেই ,
পারিপার্শ্বিকের influence ( প্রভাব ) হয়তাে original intention then and there fulfil ( মূল উদ্দেশ্য তখন তখন পূরণ করতে দেয়নি , গােড়ায় একটা intention ( অভিপ্রায় ) ব্যাহত হবার দরুন brain- এ ( মস্তিকে ) একটা blundering twist ( ভুলের গেরো ) পড়ে —পরে একটা intention ( অভিপ্রায় ) -মাফিক কাজ করার সময় সেই twist : ( গেরাে ) -টাই ভুল ও বেঘােরের সৃষ্টি করে তােলে ।
তবে কাজের পথে বাধা - বিঘ্ন থাকলেও ঘাবড়ে যেতে নাই । আমাকে একবার কুষ্টিয়ার D. S. P. ( ভি . এস . পি . ) ডেকে নিয়ে বললেন — তােমার কাছে সকল রকম লােককে আসতে দিতে পারবে না । নানারকম ভয় দেখালেন । কিন্তু আমি বললাম — আমি কাউকে বারণ করতে পারব না , আর আপনারও এমন কথা বলা উচিত না । পরে তিনিই দু'বেলা আসতেন , দু'বেলা না হলেও একবেলা তাে আসতেনই । এইরকম হয় ।
আগে যখন আমরা কথাবার্তা বলতাম , আলাপ - আলোচনা করতাম , কত spy ( গুপ্তচর ) আসত , সব টুকে - টুকে নিত । একটা বাক্স তৈরী করেছিলাম , steamer- এর passenger ( ষ্টীমারের যাত্রী ) -দের কাছে থেকে ভিক্ষা করা হতো — সেই টাকা দিয়ে কতজনের সাহায্য করতাম — কত spy ( গুপ্তচর ) -দের পর্যন্ত তাদের বিপদ - আপদে সাহায্য করেছি — তারাই আবার আমার পিছনে লাগত , আমি বুঝতাম সব , তবু দিতাম ।
প্রফুল্ল — তাতে তো তাদের ক্ষতিই করা হতাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি ভাবতাম , ওদের যদি না দেখি — ওরা বাঁচবে না । রােগী যে কুপথ্য করে , সে কি আর বুঝে করে — ব্যাধিতে করায় । ওদেরও সেইরকম । আমি ভাবতাম — বেঁচে তো থাক , বেঁচে থাকলে তবে আস্তে - আস্তে correction ( সংশোধন ) হবে , পথ খোলা থাকবে — যদি সাবাড়ই হয়ে যায় , তাহলে তাে কোন আশাই থাকে না ।
তপোবনের শৈলমাকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন — কি রে , কী খবর ?
শৈলমা — ভাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আজকাল বড় এক ড্যাগ ভাত নামাতে পারিস ?
শৈলমা — তা বােধ হয় পারি , তবে কষ্ট হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাের ঐ বুড়ো হাড়ে যা পারিস , অনেক চ্যাংড়াও তা পারে না।
শৈলমা — সে আপনার দয়া ( ব'লে হাসতে লাগলেন ) ।
শৈলমার বিমর্ষ মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলাে ।
এরপর দেবদেবী - সম্বন্ধে কথা উঠলাে — শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীকৃষ্ণ - সম্বন্ধে বলছিলেন—
আমি যখন বসে - বসে নাম করতাম , কেষ্টঠাকুর এসে বাশী বাজাতেন — একেবারে কান enchantingly ( মোহন ভঙ্গীতে ) ঝালাপালা করে দিতেন । শ্রীকৃষ্ণকে দেখতাম আমার বয়সী , তবে রং কিন্তু কালো নয় — দূর্বা যদি কিছু দিয়ে ঢেকে রাখা যায় , কিছুদিন পরে তার যেমন রং হয় , অনেকটা সেইরকম । মা - কালীকে অনেকবার দেখেছি , দেখামাত্র মনে হতাে যে আমার মা । আমার মা'র সঙ্গে কোন পার্থক্য মনে হতাে না — তাই বােধহয় মা’র উপর অত টান বেড়ে গিয়েছিল । একবার দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিলাম — গিয়ে খুব পিপাসা পেয়েছিল । একজন অনেককে জল দিল , আমাকে দিল না — আমার বড় রাগ ও দুঃখ হ'লো । রামকৃষ্ণদেবের ঘরের দিকটায় গেলাম — গিয়ে যেন খুব পরিচিত মনে হলো । অবশ্য ও - কিছু নয় , আগে শােনার দরুনও হতে পারে , তারপর আমি পঞ্চবটী তলায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম — দেখলাম , মা - কালী আসছেন । কালো তবু অত্যন্ত soothing ( স্নিগ্ধ ) রূপ , কাছে এসে আমার মাথাটা তুলে নিজের হাঁটুর উপর রাখলেন — তার স্পর্শে কেমন হয়ে গেলাম তার কথার প্রতিবাদ করতে পারলাম না — যা বলেন তাই করি । আদর করে বললেন তুই সবার সামনে খেতে চাইলে আমি কি তা দিতে পারি ? লক্ষ্মী , এইগুলি খা ! দেখি , সােনার মতাে উজ্জ্বল থালায় লুচি , বরফীর মতো সন্দেশ ইত্যাদি খাইয়ে দিলেন । খেলাম , খেয়ে বড় তৃপ্তি পেলাম । জল - টল যখন খাওয়া হয়েছে , তখন কে এসে আমাকে ডাকল , ঘুম ভেঙ্গে গেল , দেখি , ক্ষিদে - তেষ্টা নেই । রাত দশটা পর্যন্ত কত হাটলাম তবু ক্ষিদে পেল না — শুনেছিলাম , এ - সব কথা কাউকে বলত। নেই , তাই কাউকে তখন বলিনি ।
কথা চলছে । শ্রীশ্রীঠাকুর কথার ফাকে - ফাকে মাঝে - মাঝে তামাক , সুপুরি , জল চেয়ে খাচ্ছেন । আরো লোক এসে জড় হয়েছে — সবাই সেই আনন্দমধুর বচন - সুধাপানে বিভাের ।
ইতিমধ্যে সুশীলদা আসলেন । জাতিস্মর - সম্পর্কে তিনি বললেন — জাতি স্মরত্ব যদি জাগেও , তাহলেও তাে দুঃখ ! অনেক ক্ষেত্রে পরজীবনে মিলিত হবার সম্ভাবনা খুব কমই থাকে — শান্তি মেয়েটির পূর্বজীবনের স্বামী হ'লো ব্রাহ্মণ আর শান্তি হয়েছে কায়স্থ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — অসুবিধা হয় সমাজ - ব্যবস্থার দরুন ; তা না হলে অসুবিধা হবার তো কথা নয় । যে ক'টা মেয়ের কথা জানা গেছে , প্রায়ক্ষেত্রেই তো অনু লােম হয় — আর নিম্নবর্ণ কিংবা সুবর্ণ না হয়ে যদি মেয়ে উচ্চবর্ণে জাত হয় এবং তার যদি স্বামীর স্মৃতি জ্বলজ্বলে থাকে তার বিয়ে করাই উচিত নয় ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর স্নানে গেলেন । স্নানের অাগে হরিপদদা বেশ ক'রে তেল মাখিয়ে দিলেন । চৌবাচ্চায় নেমে স্নান করতে - করতে বললেন — সুশীলদা ! জাতিস্মরতার secret ( রহস্য ) -টা বের করে সকলকে জানিয়ে দিন — বলুন , পেয়েছি অমৃত , লভিয়াছি পথ । আমি নিজে অনেক দেখেছি — কেষ্ট ঠাকুর -টাকুর ইত্যাদি , কিছুতে আমি সন্তুষ্ট হয়ে যাইনি — এই যেমন আমি আছি , আমাকে একজন দেখছে — অার একজন দেখছে না , এমনটা হচ্ছে না — অর্থাৎ সবাই দেখছে আমি যেমন ইচ্ছে করছি , তারা যে তাই করছে তাও নয় — যে - কোন ব্যাপার এইরকম সব্বসাধারণের বোধগম্য ও বাস্তব না হলে আমার তৃপ্তি আসে না । সেটা কারও ব্যক্তিগত সাধনলব্ধ শক্তির উপর নির্ভর করবে না — তা ’ হবে একটা normal phenomenon ( স্বাভাবিক ব্যাপার ) ; আর , এই যে জাতিস্মর জন্মেছে , এরা খুব সাধারণ ঘরেই জন্মেছে — এর জন্য যে খুব সাধনার দরকার হয় তা’ও মনে হয় না - কি - একটা কারণ আছে সেটা আবিষ্কার করতে পারলেই ঘরে ঘরে , জনে - জনে এটা সম্ভব ।
গােপালদা - সুশীলদা বলছিলেন , একজনের জাতিস্মরত্ব ছিল না , অসুখের পর জাতিস্মরত্ব জেগে উঠলাে — এও তাে ভারী মজা ! তাহলে electricity ( তড়িৎ ) কিংবা অন্য কোন stimulus or shock ( ধাক্কা দিয়ে brain- এর ( মস্তিষ্কের ) নূতনতর arrangement ও adjustment ( সমাবেশ ও নিয়ন্ত্রণ ) করে যা ' latent ( সুপ্ত ) ছিল তাকে তত potent ( সক্রিয় করা যায় — তেমন হ'লে তাে জাতিস্মরত্ব আমরা এ জীবনে লাভ করতে পারি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর উল্লাসের সঙ্গে বললেন — অসম্ভব কিছু না । যেমন করে পার , কাজ হাসিল হলে হয় ।
10