★ প্রশ্ন — এ জীবনে যদি কিছু না করি ?
★ ক্লান্তির স্তর ) pass ( ভেদ ) করা যায় কী ভাবে ?
২৩ শে অগ্রহায়ণ , সােমবার , ১৩৪৮ ( ইং ৮/১২/১৯৪১ )
রাত্রির মৌনতার মাঝে অন্তরের বেদনা মুখর হয়ে ওঠে — তার কাছ থেকে এত পেলাম , তার জন্য করলাম কী ? ক্লান্তি কেন স্তিমিত করে তােলে প্রচেষ্টাকে ? ব্যথায় মনটা মোচড় কেটে ওঠে , অসহায় প্রাণ তারই সঙ্গ - লালসায় আতুর হয়ে ভাবে , তার কাছেই এর কিনারা পাওয়া যাবে , প্রতীক্ষায় প্রহরের পর প্রহর গণে — কখন ভাের হবে , কখন তার কাছে গিয়ে আর - একবার নিজেকে ঢেলে তার পূত - স্পর্শে পরিস্নাত হয়ে নিজের দৈন্য , গ্লানি , অক্ষমতাকে ধুয়ে - মুছে ফেলবে , পরিশুদ্ধ হয়ে দাড়াবে তার পাশে — তার বল হ'য়ে , বােঝা হয়ে নয় । রাত্রি কেটে যায় , নেশার টানে ছুটে আসে সবাই পদ্মাচরের ছোট্ট ঐ টিনের তাসুতে , ঐখানেই যে দুনিয়ার যত অমৃত - মদিরা পুঞ্জীভূত হ'য়ে আছে একখানে — একদেহে ; পিয়াসী - প্রাণ তাই সমবেত হয় ঐ পরম সঙ্গমতীর্থে । প্রত্যেকে নিজেকে অবারিত করে , উন্মুক্ত করে তার কাছে , তৃষ্ণা তাদের পরিতৃপ্ত হয় । তারা সুখে ডগমগ হ'য়ে ঘরে ফেরে , তারই রেশ চলে সারাদিন ধরে প্রতিটি কাজের ভিতর , জীবনের গভীরে তা ’ দাগ কেটে যায় চিরতরে ।
প্রশ্ন হ'লে— Fatigue - layer ( ক্লান্তির স্তর ) pass ( ভেদ ) করা যায় কী ভাবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - একজনকে হয়তাে ভিক্ষা করতে বলা হলো , সে ! অভ্যস্ত নয় , চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারছে না , ঘরে - ঘরে দেহমনে fatigued ( ক্লান্ত ) হয়ে পড়েছে , — fatigued ( ক্লান্ত ) আর depressed ( অবসন্ন) । কিন্তু এক কথা নয় , তখনও সে মাথা খাটাচ্ছে , এইভাবে চিন্তা - চেষ্টা করতে - করতে সে একটা সুষ্ঠ পন্থা বের করলাে , সেই অনুযায়ী ক'রে successful ( কৃতকাৰ্য ) হলাে তার energy ( শক্তি ) যেন খুলে গেল , confidence ( প্রত্যয় ) আসলো , আরাে বড় - বড় কাজের দায়িত্ব নিয়ে সহজে করতে লাগলাে । আবার , পরে হয়তাে অন্য difficulty ( অসুবিধা ) আসলো , সেটাও pass ( অতিক্রম ) করলো , এইভাবে বাস্তব কাজের ভিতর - দিয়ে fatigue - layer ( ক্লান্তির স্তর ) pass ( অতিক্রম) করে । না করে শুধু বসে - বসে ভেবে আর হা - হুতাশ করে এটা কিন্তু হয় না । করাই পারার পথ খুলে দেয় , করতে গেলে আবার বিহিত পন্থায় করা চাই , তাই তম্মুখী ধ্যান , মনন ও চিত্তনও লাগে । সে এক জিনিস , আর নিষ্ফল নেতিবাচক দুশ্চিন্তা আর - এক জিনিস । তার মধ্যে কোন সজনী আবেগ থাকে না , তাই তাতে কাৰ্যসিদ্ধিও হয় না ! Nothing succeeds
মানুষের অভিজ্ঞতা । like success ( কৃতকাৰ্যতা) যেমন কৃতকাৰ্যতাকে আবাহন করে , অমন আর কিছুতে করে না ) । ফলকথা , সাফল্যই সাফল্যকে ডেকে আনে । কারণ , সাফল্যে মানুষের যেমন উৎসাহ বাড়ে , তেমনি তার অভিজ্ঞতাও বাড়ে । কোন কিছুতে সফল হতে গেলেই তা নিখুতভাবে করতে হয় । ওর ভিতর - দিয়ে হয় , বোধ বাড়ে , আর ঐ নিখুত করার অভ্যাসই তাকে পরবর্তী কাজে কৃতকাৰ্যতার দিকে নিয়ে যায় । তবে গােড়ার কথা হ'লাে Ideal- এ (আদর্শে ) interested ( অন্তরাসী ) হওয়া ।
“ নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা ।
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম , ॥ ”
মানুষ যে স্থিরমস্তিষ্কে লেগে থেকে কাজ করবে , তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে আরো - আরো বাস্তব কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবে , তা সে পারে না — যদি এই করার মূলে কেউ না থাকে । কোন - একটা প্রবৃত্তির তাগিদে যদি মানুষ কোন কাজে প্রবৃত্ত হয় , মাঝপথে আর - একটা প্রবৃত্তি এসে তাতে লণ্ডভণ্ড বাধিয়ে দেবে , সেইটের তাগিদ হয়তো তখন এত প্রবল হয়ে উঠবে যে আগেরটা ছেড়ে দিয়ে সেইদিকে ঝুঁকবে , এইভাবে মানুষ সঙ্গতিহারা ব্যর্থ চলন নিয়ে চলে । সাধনার একাগ্রতা ব'লে যে জিনিস , তা তার জীবনে ফুটে ওঠে না , সেই তন্ময়তা ছাড়া শক্তিও খােলে না । শ্রেয় - প্রিয়ে অন্তরের অনুরাগ নিয়ে যুক্ত থাকা ছাড়া এ জিনিসটি হবার নয় । কারণ , প্রিয় যেখানে প্রবৃত্তি - উপভােগের বিষয়ীভূত , সেখানে সেই প্রিয়ের প্রতি টানে অন্য প্রবৃত্তিগুলির অাকর্ষণ ও বিক্ষেপ হ'তে আত্মরক্ষা করে নিবিষ্ট সাধনায় রত থাকার মতো সামর্থ্য জন্মায় না , কোন সময় যে কী ওলটপালট হয়ে যায় , তা সে নিজেই ঠিক পায় না । অহঙ্কার , মান , দম্ভ , কাম , ক্রোধ , লােভ , ঈর্ষা , দ্বেষ , পরশ্রীকাতরতা আচমকা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারে । এ গেল একদিককার কথা । আর , পারার বুদ্ধিই পরিয়ে দেয় । তােমাকে যদি ২৫ টা টাকা আনতে বলি , তুমি যদি গােড়াতে বল ‘ পাই কিনা— তা ’ হ'লে পাওয়াও মুশকিল । পারায় দ্বিধাশূন্য হয়ে চেষ্টা করলে পারা যায় । ভাল ব্যাপারে ‘ না ’ - এর form- এ ( অাকারে ) চিন্তা করাই ভাল না ।
প্রফুল্ল — আমাদের সময় ও সামর্থ্য কম , কাজ বিরাট ও বহুল , করি কী করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— Co - ordination ( সঙ্গতি ) অসলেই হয় । তখন ভাবা , বলা , করা , muscle ( পেশী ) , nerve ( স্নায়ু ) সবই একযোগে purpose ( উদ্দেশ্য ) fulfil ( পরিপূরণ ) করার জন্য উঠে - পড়ে লাগে । তখন একসঙ্গে দশটা দিকে তল দেওয়া যায় । স্মৃতিও তখন তুখােড় হয়ে ওঠে , কোনটা মাথার থেকে সরে যায় না এবং যাকে দিয়ে যখন যেটা করানোর , টকাটক মাথায় এসে যায় , একটা সুযোগও এড়িয়ে যেতে পারে না । পারিপার্শ্বিকের প্রত্যেকটি বস্তুু ও বোধও তখন প্রখর হয়ে ওঠে , কে বা কী কোথায় কোন কাজে লাগে , কার বা কিসের উপযােগিতা কোথায় , কোন্ ক্ষেত্রে , কোথায় কোন্ - কোন্ মানুষ বা জিনিসের কোন রকম সমাবেশে ও প্রয়ােগে কী কাৰ্য উদ্ধার হয় , সবই মাথায় খেলতে থাকে । এইভাবে একটা মানুষই অযুত কাজ করতে পারে । আবার , প্রত্যেকেরই প্রকৃতি ও প্রয়ােজনকে লক্ষ্য করে , তার পোষণ ও পূরণে যথাসম্ভব যত্নবান হতে হয় । এতে প্রত্যেকটা মানুষই আপন হয়ে ওঠে । তখন ঐ মানুষগুলির সহায়তায় তুমি অসম্ভব সম্ভব করতে পার । অবশ্য , তোমার নিজের বিশিষ্ট করণীয়গুলি ঠিকভাবে করা চাই । এমনতর চলন ও করণকেই বলে organisation ( সংগঠন ) । আবার , এই organisation ( সংগঠন ) -এর প্রাণই হলো একপ্রাণতা বা আদর্শপ্রাণতা । তােমরা আদর্শপ্রাণতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তৎস্বার্থ - প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় স্বার্থান্বিত হয়ে অন্যকেও যতটা ঐরকম করে তুলতে পারবে — প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুন্ন রেখে , ততই তোমরা সংগঠিত হয়ে উঠবে । নিজের ব্যক্তিত্ব অদর্শানুপূরণে সুসংহত ও সুসংগঠিত না হলে , অন্যকেও সংহত ও সংগঠিত করা যায় না । তাই বলি , সংহত ও সংগঠিত চরিত্র - সম্পন্ন যদি হও , তখন সমগ্র বিচ্ছিন্ন দুনিয়াটাকেই তুমি দানা বেঁধে তুলতে পারবে , তখন তোমার অভাব কোথায় ? তখন দেখবে , প্রত্যেকের হাত তোমার হাত , প্রত্যেকের মাথা তােমার মাথা , প্রত্যেকের শক্তি - সম্পদ তােমারও শক্তি - সম্পদ , একা তুমি বহু হ'য়ে আছ , এই রকম প্রতি - পরস্পরে , তখন আর শক্তি - সামর্থ্যের কমতি কোথায় ? Collective volition- এর ( সমবেত ইচ্ছার ) অভূত্থান অমনি ক'রেই হয়ে ওঠে । একেই বলে ভূমায়িত জীবন , একেই বলে ব্রহ্মানুভূতি । এই ব্রাহ্মীচলন তোমাদের চরিত্রগত হোক । “ ময়ি সৰ্বাণি কৰ্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্ম- চেতসা , নিরাশীর্নিৰ্ম্মমাে ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ । ” নিজস্ব ক্ষুদ্র - ক্ষুদ্র স্বার্থ , প্রত্যাশা ও মমত্বমােহে আটকে থেকে নিজেদের বৃহৎ জীবন হ'তে বঞ্চিত করো না ।
ইন্দুদা ( বসু) আমাদের মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে না কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সক্রিয় ইষ্টানুধ্যায়িতা নিয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতি । interested ( অন্তরাসী ) হ'য়ে উঠলেই ‘ সূত্রে মণিগণা ইব ’ হয় । বাধা হয় designing inferiority ( দূরভিসন্ধিমূলক হীনম্মন্যতা ) থাকার দরুন , অনেকে ঐ প্রবৃত্তির দরুন বড়কে ছােট করতে চায় , ইষ্টের কাজের চাইতে অহং - এর প্রতিষ্ঠা বেশী করে চায় । অনেকে যেমন ভাবে , আমাকে দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়
তাে হোক , না হয় দেশ গােল্লায় যাক ' , — ঐ ধরণের ভাবে , তাই কাজের দায়িত্ব যাদের উপর থাকে , তাদের help ( সাহায্য ) করে না , ভাবে , কাজে successful ( কৃতকাৰ্য ) হ'লে ঐ ওদেরই তাে সুনাম হবে , তাদের সাহায্যের কথা কেউ খতাবেও না , অতএব করে লাভ কী ?
এরপর আবার সহানুভূতিশূন্য হ'য়ে দোষ দেয় , আবার দোষ ধরে , কাজে সাহায্য তো করেই না , আবার অনেকসময় বাধা সৃষ্টি করার তালে থাকে । অর্থাৎ , তাদের মধ্যে curative urge ( নিরাময়ী আবেগ ) , constructive urge ( সংগঠনী আবেগ ) কম । এই curative urge ( নিরাময়ী আবেগ) । ও constructive urge ( সংগঠনী আবেগ ) -ওয়ালা মানুষের সংখ্যা না বাড়লে , মানুষকে দানা বেঁধে তোলা খুব মুশকিল ব্যাপার । দোষ দেখে যারা সহজেই দুষ্ট হয় , দোষ - নিরাকরণ প্রচেষ্টা যাদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে প্রবল হয়ে ওঠে না , ভাঙ্গনমুখী যা ' তাকে গঠনমুখী করে তােলার স্বপ্ন যারা দেখে না , এবং ভাঙ্গনকে গঠনে পৰ্য্যবসিত করার মধ্যে যারা আনন্দ পায় না , ভাঙ্গন - স্রোতের সংস্পর্শে যাদের অন্তরের সংগঠনী সঙ্কল্প ভেঙ্গে যেতে থাকে , ক'ষে হা'ল ধরার রােখ গজিয়ে ওঠে না , তারা মানুষকে সংহত করে তুলতে পারে না । কর্ম্মীদের অন্ততঃ এই গুণগুলি থাকাই চাই , আর কর্মীরা পরস্পর পরস্পরের গুণগ্রাহী হবে , ‘ বোধয়ন্তঃ পরষ্পরম ' হবে । প্রশংসার কাঙ্গাল হওয়া যেমন খারাপ , হীনম্মন্য আত্মপ্রতিষ্ঠার লালসা যেমন নিন্দনীয় , প্রত্যেককে তার ন্যায্য প্রাপ্য শ্রদ্ধা , স্নেহ , প্রীতি , সম্মান , মর্যাদা ও প্রশংসা - দানে কার্পণ্য ও কুণ্ঠাও তেমনি অবাঞ্ছনীয় । একটা পরিবারকে একত্র মিলিয়ে রাখতে গেলে কর্তা ও কত্ৰীন্থানীয় যারা , তাদের যেমন প্রত্যেকের প্রতি অনেকখানি বোধ , বিবেচনা , নজর ও সহানুভূতি নিয়ে চলতে হয় , সঙ্ঘ - পরিবারে কর্ত্তাস্থানীয় যারা তাদেরও তেমনি সবার প্রতি চার চোখে দৃষ্টি নিয়ে চলা লাগে । তোমরা কয়েকজন যদি ইষ্টনিষ্ঠায় অটুট হ'য়ে নিজেদের মধ্যে সংহত হ'য়ে ওঠ - সেবা , সহানুভূতি , নিরাময়ী ও সংগঠনী আবেগ নিয়ে সংহতি - বিরােধী যেখানে যা - কিছু আছে , নিরন্তর শ্যেনদৃষ্টিতে তাকে সমূলে উৎপাটিত করে — নিজেদের মিলন - বিধায়ক চরিত্র দিয়ে , —তাহ'লে দেখবে , সবাই ঠিক হ'য়ে গেছে । ফলকথা , তোমাদের মধ্যে অনেকখানি ঠিক আছে , তােমরা দুইজনে মারামারি করে , পরক্ষণে গলাগলি করে একসঙ্গে গিয়ে রসগোল্লা খেতে পার , এ দৃশ্য তােমাদের মধ্যে হামেশাই দেখা যায় , আবার যার সঙ্গে তুমি হয়তাে রাগে বা অভিমানে কথা বল না , তাকে বাইরের একটা লোক যদি অপদস্থ করে , সেখানে কিন্তু তুমি স্থির থাকতে পার না , বুক দিয়ে গিয়ে পড় ,। এ তোমাদের মধ্যে আছে ঐ ইষ্টসূত্র থাকার দরুন , বাইরে এমনটি বড় বেশী পাবে না তবে ইষ্টে interested ( অন্তরাসী ) না হয়ে যারা কেবল নিজেদের হীন স্বার্থ - চাহিদাপূরণের জন্য ইষ্টকে ধরে , ইষ্ট ও সঙ্ঘকে ভাঙ্গিয়ে আত্মস্বার্থ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়ােজন সিদ্ধ করতে চায় , তাদের নিয়েই মুশকিল হয় । কিন্তু একনিষ্ঠ যারা , তারা যদি হু’শিরার থাকে , ঐ দল কিছু করতে পারে না । তাদের দুষ্ট বুদ্ধিই তাদের দুর্বল করে তােলে , তারা কোথাও আমল পায় না , তাই তারা ভাঙ্গন ধরিয়ে নিজেদের প্রাধান্য - স্থাপন বা স্বার্থ - সাধন করতে চাইলেও তা ’ পারে না । মানুষ এমন বেকুব - ইষ্টের প্রতি normally actively interes ted ( সহজ সক্রিয়ভাবে অন্তরাসী ) হলে যে সহজেই সব পায় , এই কথাটাই বােঝে না , তাই যাতে ব্যর্থ হবে , সেই পথই বেছে নেয় । মানুষ বাস্তব করণসহ মুখ্যতঃ ইষ্টপ্রেমী ও ইষ্টস্বার্থী হ'লে , তার ঐ চরিত্রই তাকে সব পাইয়ে দেয় । যেমন মনে কর , কেউ যদি শুধু অঙ্ক শেখার জন্য তােমার কাছে না এসে তােমাকেই ভালবেসে ফেলে , তার কিন্তু অঙ্ক শেখাটাও ঢের বেশী হয় । কত ফন্দী নিয়ে প্রথমে এসেছিল , কিন্তু পরে রামচন্দ্রে interested ( অন্তরাসী ) হয়ে উঠলো । ভাল instinct ( সংস্কার ) থাকলে ওমনি হয় ।
কথাপ্রসঙ্গে ইন্দুদা বললেন — বিমলদা কাজে নামলে আহার - নিদ্রার দিকে খেয়াল থাকে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাতে বললেন — শরীর ঠিক রাখার জন্য যতটুকু করণীয় , তা না করা কিন্তু ভাল নয় । ওতে কাজই পণ্ড হয় ।
প্রশ্ন করা হলো — আপনার কাছে থেকে যে এত impulse ( প্রেরণা ) পাচ্ছি —তার কি effect ( ফল ) হবে না ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — হ্যা , নিশ্চয়ই ! তা ’ ‘ অদ্য বর্ষে শতান্তে বা ’ । কাজে লাগলে এখনও টের পাও । তােমাদের অজ্ঞাতে ওরই ঝলক ঠিকরে বেরােয় তোমাদেরই ভেতর - দিয়ে — তােমাদের বৈশিষ্ট্যমাফিক । আমার চাউনি , চালচলন , হাবভাব , ক্রিয়াকরণ , আচরণ — যা দেখেছ — সব in toto ( সম্পূর্ণভাবে ) মাথায় গেঁজা থাকছে । আমার কথাগুলি যতই responsibly ( দায়িত্ব - সহকারে ) work out (নিম্পাদন ) করতে থাকবে , ততই ঐ সংহত সম্পদ রাশ ঠেলে দেবে । ঐগুলি আরাে intelligently ( বুদ্ধিমত্তার সহিত ) বোধ ও উপভােগ করতে পারবে । ধ্যান , ধারণা , আত্মবিশ্লেষণ , আত্মনিয়ন্ত্রণ , ইষ্টানুপূরণী বাস্তব কর্ম ইত্যাদির ভিতর - দিয়ে সবকিছুর গুঢ়ার্থ তােমার কাছে পরিস্ফুট হয়ে উঠবে ।
প্রশ্ন — এ জীবনে যদি কিছু না করি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর চকিতে অভয় ভঙ্গীতে দক্ষিণ হস্তখানি উত্তোলন করে দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন — মৃত্যুর পর যদি জীবন থাকে , সেখানেও তা ’ সঙ্গে - সঙ্গেই থাকবে । কিছুই ব্যর্থ যাবে না ।
তার এই প্রেরণাঘন দিব্য অভয়বাণী শুনে কারও মুখে বাক্য - ফুৰ্ত্তি হচ্ছিল না ! তার অপার করুণার কথা স্মরণ করে সকলেরই চোখ তখন অশ্রুসজল । পদ্মাচরের দিগন্তে পূর্ব - আকাশে তখন সবে মাত্র সূর্য উঠেছে , তারই কনক - কিরণে তাসুর ভিতরটা উদ্ভাসিত , সবিতৃদেব তার বাঞ্ছিতের পূণ্য - অঙ্গ - পর্শে আজ প্রভাতে যেন পুর্ণকাম পূর্ণকাম , পূর্ণমনােরথ আজ সবাই — তারই শ্রীচরণস্পর্শে ।
প্যারীদা তামাক সেজে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর আনমনাভাবে তামাক খেতে লাগলেন । তার মন যেন তখন অন্য রাজ্যে চলে গেছে । বাইরে আশ্রম - প্রাঙ্গণে তখন একটা কুকুর একটা পাখীর ছানা ধরতে ছুটে যাচ্ছিল , কারও সেদিকে লক্ষ্য পড়েনি । শ্রীশ্রীঠাকুর আর্ত্তভাবে তাড়াতাড়ি উপস্থিত সকলের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করলেন । কয়েকজন ছুটে গিয়ে কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে পাখীর আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন ! শ্রীশ্রীঠাকুর তখন শান্ত হলেন । তুরীয়ভাবে অবস্থিত যিনি , —সেই ভাবরুঢ় অবস্থায়ও একটা সামান্য জীবের কষ্টও যার চোখ এড়ায় না , —দুনিয়ার সবার প্রতি এই এমনতর সক্রিয় সুকেন্দ্রিক মৈত্রীবন্ধন একেই কি বলে মুক্তি ?
এরপর সুশীলদা বৌদ্ধধর্ম , খ্রীষ্টধর্ম ইত্যাদি সম্বন্ধে কথা তুললেন । শ্রীশ্রীঠাকুর— Real Christianity ( প্রকৃত খ্রীষ্টধর্ম ) , Real Buddhism ( প্রকৃত বৌদ্ধধর্ম্ম ) চাপা পড়ে গেছে । Clan ( বংশ ) , cult ( কৃষ্টি ) এবং বৈশিষ্ট্যপালী আপুয়মাণ পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণকে মানা যদি ঠিক থাকে , তাহলে সেখানে গলদ জমতে পারে না । বিকৃতি যা জমে ওঠে , পরবর্তীর পুণ্যস্পর্শে তা দুরীভূত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন একটা গভীর সম্প্রতি বিরাজ করে । সে - অবস্থায় লাখ সম্প্রদায় থাকলেও আটকায় না , সেখানে সম্প্রদায় থেকেও সাম্প্রদায়িকতা থাকে না , তারা পরস্পর পরস্পরের স্বাৰ্ধান্বিত হয়ে ওঠে । কারণ , তারা জানে , বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ ধর্মপ্রবর্তকগণ সকলেই একবার্তাবাহী — শুধু একবাত্তাবাহী নয় , একসত্তাবাহীও । তাই তারা দ্বেষ - হিংসার কথা ভাবতে পারে না , তা হলে যে প্রভুকেই অবমাননা করা হবে , তার গায়েই আঘাত লাগবে । কিন্তু বৈশিষ্ট্যপালী আপূয়মাণ বর্তমান ও পরবর্তীদের স্বীকার করার অভ্যাস না থাকলে এ ভাবটা সঞ্জীবিত থাকে না । তারপর ঐ কুল ও কৃষ্টি মানারও একটা গভীর প্রয়ােজন আছে , নইলে আচারবিহীন হওয়ায় মানুষ বৈশিষ্ট্যভ্রষ্ট হয়ে ওঠে । তাছাড়া , কুল না মানার ফলে যদি কোনভাবে কোথাও প্রতিলোম ঢুকে যায় , তাহলে মূল - ধারাই তাে বিপর্যস্ত হয়ে যায় , ঐ বিধ্বস্ত ও বিকৃত জৈবী - সংস্থিতি নিয়ে মানুষ কিছুই করতে পারে না , সে ধৰ্ম , কৃষ্টি , সমাজ ও নিজের শত্রু হয়ে দাড়ায় ।
Alochona prosonge part 1
আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথম খণ্ড
ষষ্ঠ সংস্করণ
10