* ঋন দান ও গ্রহণের নীতি
* বুদ্ধদেব
* ব্যাবসা ঠাকুরের কথা.
* স্বামী ভক্তির স্বরূপ
* হজরত মুহাম্মদ
১৯শে আশ্বিন,শুক্রবার, ১৩৪৬ (ইং ৬/১০/১৯৩৯)
আশ্বিনের রৌদ্র-ঝলমল সুন্দর সুপ্রভাত। শ্রীশ্রীঠাকুর আশ্রম-প্রাঙ্গনে বাবলাতলার একটি বেঞ্চিতে বসেআছেন। মুখেতার মধুর হাসি, চোখে যেন কোন সুদুরের স্বপ্ন — পরম স্নেহভরে সমবেত ভক্তবৃন্দের সঙ্গে বাক্যালাপ করছেন-তাদে
র ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধার কথা সুনে’ যার যেমন প্রয়োজন, ব্যবস্থা ক’রে দিচ্ছেন। সাধন-ভজন সম্বন্ধে কথা উঠলো।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-inferiority complex(হীনম্মন্যতা বোধ)থেকে সাধনা সুরু করলে সব পণ্ড হয়—‘আমি সাধক’ এই Consciousness (বোধ) আসলেই সর্ব্বনাশ! অনেক সময় এই সব সাধক নিজের শক্তিমত্তার বাহাদুরি করে, কিন্তু ইষ্টানুরাগ না থাকলে কিছুই হলনা —ইষ্টের টানে যে যা’ করে তাই হয় Normal (সহজ স্বাভাবিক); নচেত লাখ সাধনাও চরিত্রে গাঁথেনা, সত্তাকে স্পর্শ করেনা।
সন্ধ্যায় একটি দাদা তাঁর অভাব-অভিযোগ ও ঋনের কথা বললেন।
তার উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন -আমার একটা রকম আছে, সবাইকে মনে হয় যেন আমি। কারও অসুবিধা দেখলে প্রথমেই আমার মনে হয়—আমি ও অবস্থায় পড়লে আমার কেমন লাগতো। অন্যের অভাব নিজের অভাব বলেই মনে হয়—নিজের স্বার্থ আছে ব’লে তাই তা’দূর করতে চেষ্টা করি। এইভাবে ভালোবেসে, সেবাদিয়ে মানুষকে আপন ক’রে নিতে হয়।
পরে বললেন— আমি সাধারণতঃ ঋণ করি না, দরকার হলে চেয়ে নিই, তবে তাকে দেবার রোখ থাকে প্রবল, আরদেওটাই আমার Interest (স্বার্থ) ব’লে মনে করি। ঋণ না করাই ভাল-ঋণ ক’রে সময়মতো যদি না দেওয়া যায় তা’ বড় খারাপ। আর, আমি নিজে যাকে যা’ দিই, তা ফিরে পাবার আশায় দিইনা। তাই বলি, মানুষ আপন ক’রে নিতে পারলে ভাবনা কী?
এই কথা-কটির মধ্যে দাদাটি তাঁর সমস্যার সমাধান পেয়ে পুলকিত অন্তরে গোত্রোন্থান করলেন।
২০ শে আশ্বিন , শনিবার , ১৩৪৬ ( ইং ৭/১০/১৯৩৯)
কথায় - কথায় শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — আজ পায়খানায় গিয়ে অনেকগুলি কথা মনে আসছিল — এখন ভুলে গেছি । কে যেন টক্-টক্ করে বলে দিচ্ছিল , পায়খানায় গেলে অনেক সময় এই রকম হয় ।
মহাপুরুষ - প্রসঙ্গ উঠল । পূর্ববর্তীকে পরিপূরণের কথায় শ্রদ্ধেয় কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) বললেন — ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের মধ্যেই এইটে খুব distinct and prominent ( পরিষ্কার ও প্রবল ) দেখা যায় । অামার মনে হয় , বুদ্ধদেবের মধ্যে এই দিকটা স্পষ্ট নয় , তাই বুদ্ধদেব আস্তে - আস্তে বাদ পড়লেন , বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কমে গেল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - বাদ পড়া তাে কথা নয় ! বুদ্ধদেব ও হজরত মহম্মদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে blasphemy ( অপবাদ ) চলছে তার নিরাকরণ করতে হবে । বুদ্ধদেবের নিজের লেখা কোন বই নেই ? তার থেকে draw ( খোঁজ ) করতে হয় । বুদ্ধদেব তাে শুনেছি , বর্ণধৰ্ম্ম মানতেন , যিনি ‘ আৰ্য্যসত্য ’ , ‘ আৰ্যসত্য করে অতাে বলেছেন— Aryan culture- এর ( আৰ্য্যকৃষ্টির ) উপর তার সব কিছু based ( প্রতিষ্ঠিত ) ।
কেষ্টদা — ধম্মপদ তাে বুদ্ধদেবের লেখা , তার থেকে নজির দেখান তাে মুশকিল ! বর্ণভেদ তিনি মানতেন এমন তাে পাওয়া যায় না , তবে তার বিরুদ্ধেও কোন কথা সেখানে পাওয়া যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওরও একটা মুশকিল আছে , হয়তো বিশিষ্ট কতকগুলি ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলা তার কতকগুলি কথা লিপিবদ্ধ আছে , তার থেকে প্রত্যেকটা বিষয় সম্বন্ধে তার নিজস্ব মতামত বোঝা যায় না ।
বিকালে শ্রীশ্রীঠাকুর বাঁধের ধারে একখানি চৌকিতে বসেছেন — বিনতি প্রার্থনার পর আ বহু দাদা ও মায়েরা সমবেত হয়েছেন । কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , প্যারীদা ( নন্দী ) , প্রফুল্ল , কালিদাসীমা প্রভৃতি অাগে থাকতেই উপস্থিত ছিলেন । একজন মৌলভী সাহেব আসলেন , তার সঙ্গে ইসলাম - সম্পর্কে কথা উঠলাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কোরাণ এমন জিনিস , রসুল কত পরিষ্কারভাবে সব কথা বলে গেছেন । কারু সঙ্গে কোন বিরােধ নেই , অথচ আমি একটা মুসলমানের মতাে মুসলমান কমই দেখতে পাই । রসুল কি কখনো এ - কথা বলেছেন যে , মুসলমান বা ইসলামপন্থী হতে গেলে কারু hereditary culture- কে ( বংশানুক্রমিক
কৃষ্টিকে ) অস্বীকার করতে হবে ? পূর্ববর্তীকে betray ( বিশ্বাসঘাতকতা ) করে যাকে accept ( গ্রহণ করতে যাই , প্রকৃতপক্ষে তাকেই কি betray করা ( ঠকান ) হয় না ? আমি ইচ্ছা করলেই তাে ইস্লামের সেবক এই অবস্থায় হ'তে পারি — প্রত্যেকেই প্রত্যেক অবস্থায় পারে — আর তা ’ উচিতও , কিন্তু conversion ( ধর্মান্তর ) -এর কথা রসুলের মধ্যে নেই , বরং তিনি পূর্ববর্তীকে কত মান্য দিয়েছেন । রসুলের কথা যারা অমান্য করে , তারাই কি কাফের নয় ? পরবর্তীদের কথাও হাদীসে আছে , এমন - কি এও আছে — তিনি যদি হাবসীদের ক্রীতদাস হন — তবু তাকে গ্রহণ করবে । আর , ঐ যে খতমনা খাতেমের কি মানের গণ্ডগোল আছে ? পরবর্ত্তীর কথা যখন আছে তখন রসুলেই সব খতম , অর্থাৎ শেষ — এ - কথা তাে বলা চলে না , বরং continuity ( ক্রমাগতি ) ব্যাহত হয় , এইরকম মনে করাই সমীচীন । অবশ্য , পরবর্তী যখন আসেন তখন পূর্ববত্তী খতমই হন । তার কারণ , তিনি তাে পূৰ্ব্ববত্তীর রূপ নিয়ে আসেন । তবে এটা ঠিক যে , সেই একই প্রেরণা বিভিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেন একই মূর্তিতে আসেন না । কিন্তু যিনি আসেন তিনি তাঁরই continuation ( পরবর্তী ) , তাঁকেই base ( ভিত্তি করে সেই প্রেরণারই further fulfilment ( অধিক পরিপূরক ) ।
মৌলভী - সাহেব প্রত্যেক কথাই অনুমোদন করলেন এবং কোরাণের নানা শ্লোক উল্লেখ ক'রে শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা সমর্থন করতে লাগলেন । পরবর্তী সাধু মহাপুরুষের কথা যে ইসলামে আছে তা ’ মুক্তকণ্ঠেই স্বীকার করলেন ।
২১ শে আশ্বিন , রবিবার , ১৩৪৬ ( ইং ৮/১০/১৯৩৯ )
সকালে শ্রীশ্রীঠাকুর খুব হাসিখুশি হ'য়ে গল্প করছিলেন — যখন স্বামী মারা যায় তখন স্ত্রী সুর করে এই বলে কাদে — তুমি আমার কী করে গেলে গাে , কাচ্চা - বাচ্চা নিয়ে আমি কোথায় দাড়াব , ইত্যাদি । এখানে স্বামীর প্রতি ভালবাসার চাইতে স্বামীর টাকা - পয়সার প্রতি ভালবাসাই যেন বেশী । কিন্তু সাধারণতঃ স্ত্রী মারা গেলে পুরুষ বলে — আমার আর কেউ নেই , আমাকে একেবারে একলা ফেলে গেছে । তাই মনে হয় , পুরুষের দিক দিয়ে sincerity ( আন্তরিকতা ) মেয়েরা আবার অল্পদিনেই ছেলেপুলে , ঘর - সংসার নিয়ে বেশ থাকে— সব ভুলে যায় । অবশ্য সব ক্ষেত্রেই যে এমন , একথা বলি না ।
সত্যিকার স্বামিভক্তি - সম্বন্ধে কথা উঠতে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — এমন মেয়ে খুব কম দেখা যায় যে , স্বামীর জন্য স্বামীর মুখ চেয়ে তাঁর সঙ্গে গিয়ে গাছতলায় বাস বেশী ।করতে প্রস্তুত — যে কিনা নিজের বুক দিয়ে স্বামীর দুঃখ - কষ্ট ঢেকে রাখতে চায় । তেমন মেয়ে যদি কেউ থাকে — সে এদেশের নয় — স্বর্গ না কি বলে , সেই রাজ্যের মানুষ সে ।
কারখানার সুধীরদাকে শ্রীশ্রীঠাকুর বিশেষ একটা কাজের ভার দিয়েছেন । সুধীরদাও নিরন্তর সেই কাজে লেগে আছেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সারাদিন ৪৫ বার লােক পাঠিয়েছেন , বিকালে নিজে এসে কাজের কাছে বসলেন । মাঝে - মাঝে উৎসাহ - সূচক কথা বলছেন ।
10