শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 2 :-
॥ দুই ॥
১৯৪৭ সালের জুন মাসের শেষ দিক। তখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশভাগ হয়নি, সব ঠিকঠাক হয়ে আছে। ঠাকুরের বুদ্ধি নিয়ে কোন নেতা কাজ করতে নামলো না, বিভাজনের বিরুদ্ধে কোন বাস্তব প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠলো না। তাই, কিছু করা গেল না। সেই দুঃখটা ঠাকুরের মনকে এখনও পীড়া দেয়।
এখন তিনি দেওঘরে, ভাড়া-নেওয়া বড়াল বাংলার চত্বরে একখানা তক্তপোষে অর্ধশায়িত। তখন প্রচণ্ড গ্রীষ্ম। সাঁওতাল-পরগনার লু-হাওয়ার কবলে দেওঘরের জন-জীবনও ক্লান্ত, দুঃসহ। যারা পূর্ববঙ্গ থেকে নতুন এসেছে এখানে, তাদের কাছে এই গরম হাওয়াটা বেশি কষ্টদায়ক মনে হয়। সন্ধ্যার আগে বাতাসের অগ্নিতাপ কমে না। তাই, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেলে ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে কখনো ফাঁকা হাতায়, কখনো বা একেবারে বাইরে মাঠের দিকে গিয়ে বসেন।
সেদিন তিনি হাতার মধ্যেই একটা গাছের নিচে তক্তপোষে আধশোয়া হয়ে জিরোচ্ছেন। দিনের বেলায় খানিকটা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় আজকের হাওয়াটা মোটামুটি স্নিগ্ধ এবং আরামপ্রদ।
দেশভাগ অতি আসন্ন। সেই বেদনায় এবং হতাশায় তিনি অতিশয় ক্লান্ত, বিমর্ষ এবং বিহ্বল। সেই দুঃখের ক্ষতাঘাত মনে নিয়েই তিনি হঠাৎ বলতে লাগলেন, 'নেতার পিছনে দ্রষ্টাপুরুষ না থাকলে এমনই হয়, ভালো করতে গিয়ে মন্দ করে ফেলে।'
'অবস্থাগতিকে দেশ-ভাগ হতে চলেছে। হিন্দু-মুসলমান কারও পক্ষেই এটা ভালো হবে না।'
বলতে লাগলেন, 'মুসলমানের ক্ষতি হয়ে হিন্দুর ভালো হোক, তাও আমি চাই না আবার হিন্দুর ক্ষতি হয়ে মুসলমানের ভালো হোক সেটাও আমি চাই না। কারো ক্ষতি করে কারও ভালো হয়, এমন বিশ্বাস আমার নেই। এক পক্ষের ক্ষতি হলে অপর পক্ষেরও ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। সব পরস্পর যুক্ত।'
কথাগুলি বলে নিয়ে জামাই সুধাংশু মৈত্রের কাছ থেকে রেডিওর প্রচারিত খবরটা শুনে নিলেন।
তারপরে বললেন, 'এ অবস্থায় দীক্ষা বাড়ানোর দিকে সবাই মন দাও। এ ছাড়া বাঁচার আর কোন পথ নেই।'
'দীক্ষিতের সংখ্যা বাড়লে এবং তাদের ইষ্টস্বার্থে সংগঠিত করে তুলতে পারলে কৃষ্টিটা রক্ষা পাবে-দেশ টুকরো হয়ে যাবার পরেও ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণের একটা পথ খোলা থাকবে।'
আবার এক সময়ে কথাপ্রসঙ্গে বললেন, আসল হলো শ্রদ্ধা-উদ্দীপী চরিত্র। এই চরিত্রই লোকজীবনের উদ্ধাতা। এক ডজন দু'ডজন খাঁটি মানুষ হলে সারা ভারতের ভোল ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
এই সূত্র ধরে আরও বলেছেন, ব্রাহ্মণত্বই আদর্শ। ব্রাহ্মণত্ব মানে ব্রহ্মজ্ঞত্ব। বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সবাইকেই ব্রহ্মজ্ঞ হতে হবে। তবে ব্রহ্মকে জানতে হবে নিজ-নিজ বৈশিষ্ট্যের উপরে দাঁড়িয়ে। বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়ে সব একাকার করার কথা আমি বলি না। তা কার্যকরীও হয় না। রকমারি যেমন আছে, তেমনই থাকবে। নিজত্ব না হারিয়ে ব্রহ্মবিৎ হতে হবে।
অনেক সময়ে উন্নত বীজজ মানুষকেও খারাপ পরিবেশে পড়ে খারাপ হয়ে যেতে দেখা যায়। কিন্তু তার ভিতরটা একেবারে নষ্ট হয়ে যায় না। তাকে তালিম দিয়ে নিতে পারলে সে আবার আপন বৈশিষ্ট্যে ফুটে ওঠে। উদাহরণ দিলেন রত্নাকর দস্যুর। রত্নাকরের মধ্যেই ছিল বাল্মীকি মুনি। নারদ-গুরুর হাতে পড়ে দস্যু রত্নাকরের খোলস থেকে আত্মপ্রকাশ করে মহামুনি বাল্মীকি।
ভারত-ভাঙ্গা কাজের আর এক বছর বাকি। ঠাকুর সেদিন সকালে বড়াল বাংলোর বারান্দায় আসীন। বাতাসে মেদুরতা আছে, মাঝেমাঝেই বারিবিধৌত হাওয়া এসে সবাইকে আরাম দিয়ে যাচ্ছে। এই বৈঠকে ঠাকুর আবার সব কর্মীকে মনে করিয়ে দিলেন- 'দ্যাখো, কিছুই তো করা গেল না, আমি যা চেয়েছিলাম, তা হলো না। সবাই আমাকে ভুল বুঝলো। যা হোক, মন্দের মধ্য থেকেই ভালোটা সম্ভব করে তুলতে হবে। এ জন্যে, অল্পদিনের মধ্যেই অন্ততঃ দেড় লাখ মানুষকে ইষ্টে যুক্ত করে তোলো। ইষ্টনিষ্ঠ আরও দেড় লাখ মানুষ পেলে তার উপর দাঁড়িয়েই অনেক কিছু করা যাবে।'
এই দিনের বিকেলের বৈঠকটা দু'টো দিক দিয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয়।
সেই বৈকালিক বৈঠকে হাউজারম্যানের সাথে বললেন, 'আমি যদি বৃটিশ রাজনীতিবিদ হতাম, কখনোই বৃটিশ সরকারকে ভারত-ভাঙ্গার পরামর্শ দিতাম না। বরং বোঝাতাম, ভারতকে অখণ্ড রেখে স্বাধীনতা দিলেই বৃটিশ সরকার ও বৃটিশ জাতির লাভ বেশি। ভারতের কল্যাণ হলে বৃটিশেরও কল্যাণ হতে বাধ্য।'
দ্বিতীয় স্মরণীয় মনে রাখার মতো ঘটনা হলো, তাঁর সঙ্গে আব্দুল গণি নামক এক শিক্ষিত মুসলমান ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার।
আব্দুল গণি সাহেব অত্যন্ত ভদ্রলোক, ঠাকুরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।
ঠাকুর গণি সাহেবকে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন 'আপনাদের মধ্যে বর্ণ বিভাগ আছে নাকি? অর্থাৎ সংস্কার ভিত্তিক গোষ্ঠিবিভাগ?'
গণি সাহেব একটু ভেবে নিয়ে বললেন, 'হ্যাঁ, আপনার কথার অর্থ বুঝলাম। আছে, আপনাদের ও-জিনিসটা আমাদের মধ্যেও আছে।'
বস্তুতঃ গোষ্ঠিগত রকমারিত্ব সর্বত্রই আছে। মনুষ্যেতর প্রাণীর মধ্যে এমন কি. এক জাতীয় উদ্ভিদাদির মধ্যেও রকমফের বিদ্যমান। সব গাছের আমই এক আম নয়, সব ধানগাছেও এক ধান হয় না। সব কুকুরের বাচ্চা এক জাতের নয়, স্বভাব-চরিত্রে অনেক ফারাক থাকে।
এসব কথার পরে গণি সাহেব একটা খুব দামি কথা বললেন, সনাতন ধর্মে সদ্গুরু-সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার সঙ্গে এই কথার তাৎপর্য অভিন্ন। তিনি বললেন, 'এই কথাই বলা চলে যে, ভগবান গুরুরূপে দেখা দেন। যে প্রকৃত গুরুকে দেখেছে, সে ঈশ্বরকে দেখেছে।'
এটা গুরুবাদীদেরই কথা। সৎসঙ্গেরও কথা। গণি সাহেব ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ হলেও, একখাত বুঝেছেন। তাঁর অনুভূতি-লব্ধ মতের এই স্বতঃপ্রকাশ সত্যই আস্বাদ্য।
আর শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি তাঁর বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার যে নিদর্শন পরিব্যক্ত করে সে দিন তিনি বিদায় নিলেন, সেটি স্মরণীয়।
সকলের দিকে চেয়ে গণি সাহেব একান্ত কাকুতি করেই বললেন, দেখুন, আপনাদের কাছে আমার একটা বিনম্র প্রার্থনা আছে। 'শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখ থেকে যখন যে কথাই বেরোক না কেন, তা তৎক্ষণাৎ লিখে রাখবেন। এ জন্যে, চব্বিশ ঘন্টা তাঁর কাছে কেউ খাতা-কলম নিয়ে থাকবেন।'
'তিনি সদ্গুরু, তাই ঈশ্বরের প্রতীক। আমার বিশ্বাস তাঁর বাক্যই শাস্ত্র।'
গণিসাহেব মাঝে মাঝে ঠাকুরের কাছে আসেন- দু'দণ্ড বসেন। সেদিনের আলোচনায় তাঁর যা নেবার ছিল, তা নিলেন, কিন্তু যাবার সময়ে ধর্ম পিপাসু মানুষের জন্যে দিয়েও গেলেন অনেক কিছু।
প্রধানতঃ, অবতারবাদকেই সমর্থন করে নিজের প্রত্যয়দৃঢ় ভাষায় গণিসাহেব যে বক্তব্য সে দিন রাখলেন, তা সনাতন ধর্মেরই কথা।
মনীষিগণ বিশ্বাস করেন, সর্বপ্রথম গীতাতেই অবতারতত্ত্ব ব্যাপক এবং সুস্পষ্টভাবে প্রচারিত ও ব্যাখ্যাত হয়। গীতার জ্ঞানযোগাধ্যায়ের সপ্তম ও অষ্টম শ্লোকযুগলে সর্বশক্তিমান পরমপুরুষের এই নরদেহ-ধারণের তত্ত্ব অত্যন্ত বাস্তব ভাবে স্পষ্ট বচন-কৌশলে বুদ্ধিমান মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়। দুষ্টের বিনাশ, সাধুদের সুরক্ষা এবং তত্ত্বান্বেষী মানুষের হৃদয়ে জীবনবৃদ্ধির মূলতত্ত্ব অর্থাৎ ধর্মকে পুনঃস্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি সাধারণ মানুষের মতো দেহধারণ করে পিতার ঔরসে মাতৃগর্ভের মারফত ভূপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। মনুষ্য পরিচয়ে অবস্থিত থেকে তিনি ঈশ্বরীয় তত্ত্ব প্রচার করেন। এই তাঁর অবতারতত্ত্ব। যে পরম-পুরুষের এই নরদেহ লীলায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, তারই ঈশ্বর লাভ হয়। সে মুক্তি লাভ করে। গীতার মতে, দেহান্তে তার আর পুনর্জন্ম হয় না। 'ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জুন।' (৪/৯)
ধর্মজ্ঞ গণি সাহেব রায় দিলেন, এঁর প্রতিটি বচনই শাস্ত্র। তাই, ঠাকুরের প্রত্যেকটি বচন সংগ্রহের জন্য তাঁর এই আকুলতা।
ধার্মিক হিন্দু এবং ধার্মিক মুসলমানে কোন প্রভেদ নেই। ঠাকুরের এই বাণীর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে আমরা সেদিন হ্লাদিত হলাম।
ইংরাজি ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৭ বৃহস্পতিবার। ভারত বিভাগের ঠিক আগের দিন।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই জন্মভূমিকে মাতৃরূপে বোধ করা সংস্কার রয়েছে ভারতবাসীদের মধ্যে। সেই হিসাবে এই ভারতবিভাজন হলো মাতৃদেহের বিখণ্ডীকরণ। অঙ্গচ্ছেদনের সব ব্যবস্থাই তৈরি, আগামী কাল ছিন্নাঙ্গ জননীকে অপারেশন-থিয়েটার থেকে অচৈতন্য অবস্থায় তার বিছানায় এনে শুইয়ে দেওয়া হবে। মায়ের কোন সন্তান কাঁদছে, কোন সন্তান-দল আনন্দে বোমাবাজি ফাটাচ্ছে।
এদিন সকালে, মায়ের এক মাতৃগত সন্তান অনুকূলচন্দ্র বড়াল বাংলোর বহির্মুখের আমতলায় উপবিষ্ট। সামনেই নির্জন রোহিণী রোড পড়ে আছে বিমর্ষ অসহায় এবং নির্জীব আচ্ছন্নতায়।
কথা প্রসঙ্গে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন, 'কিছুই করা গেল না। আমরা যা করেছি, তা হলো প্রবৃত্তির সঙ্গে দরকষাকষি। তার যা ফল, তাই পেয়েছি।'
বললেন, 'এখনও একটা কাজ করে দেখতে পারো। আমাকে সলিড্ দেখে দেড় লাখ মানুষ দাও, যারা ইষ্টকে স্থান দেবে প্রবৃত্তির উপরে। এই ছিন্ন অংশটা নিয়েও তো কিছু করতে হবে। কোন রকমে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা তো করতেই হবে।'
বলিরাজার কাছে বামনদেব একটা পা রাখবায় জন্যে জায়গা চেয়েছিলেন। তোমাদের কাছে আমিও তাই চাইছি। এই মানুষগুলোকেই আমি এক পা রাখার জায়গা বলে মনে করছি। ওদের নিয়ে আমি দেখতে চাই, এই সমূহ বিপদ থেকে আবার আমরা বেরিয়ে নতুন করে বাঁচা-বাড়ার জীবনে প্রবেশ করতে পারি কিনা।
বিপদের সঙ্গে আপোস জানেন না অনুকূলচন্দ্র। আবার বেঁচে ওঠার একটা সংকল্পের স্বপ্ন নিয়েই সেদিন কাটালেন তিনি। সেদিন তাঁর দেহ থেকেও বোধ হয় ঘাম ঝরছিল-রক্তাক্ত ঘাম। ✅
10