শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 3 :-
॥ তিন ॥
ঠাকুর দেওঘরে আসার পর থেকে আনুষ্ঠানিক ভারত-বিভাজনের মধ্যবর্তী কালের মধ্যে বেশ কিছু বিদেশী তত্ত্বান্বেষীর আনাগোনা লক্ষ্য করা যায় তাঁর সান্নিধ্যে। যেমন, হাউজারম্যানের মা মাঝে মাঝেই আসতে থাকেন ছেলেকে এবং ছেলের গুরুকে দর্শন 'করতে। সব দেখে বুঝে মাও ছেলের গুরুকেই নিজের গুরুরূপে গ্রহণ করে আরও বেশি কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। ওদিকে যেমন 'যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছে ক্যাপেল, তেমনি এসে জুটেছে আউটার ব্রিজ, এঞ্জেলি মিট্টাম প্রভৃতি। আউটার ব্রিজের মতো মিট্টামও আন্তরিকভাবেই ঠাকুরের প্রতি অনুরাগী- তাই, তাঁর সঙ্গ পিপাসু। এরা প্রশ্ন করে করে তাদের সব জিজ্ঞাসার উত্তর সংগ্রহ করে নেয়। মিট্টাম একদিন প্রশ্ন করেছিল, 'আপনার কথা থেকে বুঝেছি, গুরু ঈশ্বরবোদ্ধাপুরুষ, কিন্তু নিজে তো ঈশ্বর নন। তবে ঈশ্বরকে লাভকরা যাবে কী ভাবে?'
উত্তরে ঠাকুর বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, তাই তো-গুরু হলেন ঈশ্বরদ্রষ্টা মানুষ। তিনি ঈশ্বরের বার্তাবহ, তাঁর মাধ্যমেই ঈশ্বরে পৌঁছাতে হয়। যিশুর মতো গুরু একাধারে পথ ও গন্তব্যও। তিনিই সত্য, তাই তিনিই জীবন।'
'হ্যাঁ, যিশু বলেছিলেন', মিট্টামও স্বীকার করলো, 'এ কেমন কথা যে, তোমরা আমাকে দেখছো অথচ পরমপিতাকে দেখোনি! যে আমাকে দেখে, সে আমার পিতাকেও দেখে। আমি তাঁর কাছ থেকেই এসেছি।'
'হ্যাঁ, ঐ তো আদত কথা!' সহাস্যে ঠাকুর সমর্থন করেন যিশু-বাক্যকে।
বিদেশি ভক্তদের মধ্যে এঞ্জেলি মিট্টাম ছিল অত্যন্ত জ্ঞানী এবং কৃতবিদ্য।
ভারতের বিভিন্ন মহাপুরুষ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্বন্ধেও তার পড়াশুনা ছিল। ঠাকুরকে প্রশ্ন করে করে সে অধীত সব জ্ঞানের মধ্যেকার জট খুলে নিতে চাইতো।
দেশবিভাগের অল্প পরবর্তী সময়ে একজন ইংরেজ মহিলাকেও দেখা গেল দেওঘর আশ্রমে। এর নাম মার্জারি সাইক্স্। এ মহিলাও গভীর বুদ্ধির অধিকারী। সবার মতো সাইক্স্-এরও উদ্দেশ্য হলো, সাক্ষাৎভাবে ঠাকুরের সামনে বসে নানাবিধ জটিল সামাজিক সমস্যার সমাধান সংগ্রহ করে নেওয়া। ঠাকুরের সঙ্গ করে এবং তাঁর মুখ থেকে স্নেহ, দরদ ও সহনুভূতিঝরা ভঙ্গিতে তার প্রশ্নোত্তরগুলি শুনে সাইক্স্ বলেছিল, 'আপনার কথা অপূর্ব, আপনার ব্যাখ্যা অতুলনীয়।'
দেওঘর মানে তো দেবঘর-অর্থাৎ, দেবগৃহ। কিন্তু নামার্থে দেবস্থান হলে কি হবে, দুষ্ট লোকেদেরও নজর থাকে, তারা অসাবধানতার সুযোগ নেয়। সোজা কথায় দেবস্থানেও চুরিচামারি হয়ে থাকে। ঠাকুর তাই ক্ষুদ্র সৎসঙ্গ পল্লীটায় রাত্রে পাহারা দেবার কথা বলেছেন। প্রধানতঃ রোহিণী রোড বরাবরই আশ্রমিকদের বাস। তাই, রোহিণী রোডে প্রধানতঃ নৈশপাহারার প্রতি সকলের নজর দিতে বলেছেন।
বলা বাহুল্য, হিমাইতপুর আশ্রমে থাকতেও সৎসঙ্গীরা রাত্রিকালীন প্রহরায় অভ্যস্ত ছিল। কাজেই, রাত্রে ডিউটি ভাগ করে টর্চ লাইট ও লাঠি হাতে নিয়ে টহল দেওয়া তাদের অভ্যাস আছে। এখানে এসেও ঠাকুর মাঝে মাঝে খোঁজ নেন, নৈশ পাহারার কাজ ঠিকমতো চলছে কিনা।
সবাইকে বার বার বলেন, সব কাজ নিজের গরজে করবে। মনে রাখবে, আশ্রমটা গোলামখানা নয়। এখানে কেউ কারও উপরে খবরদারি করে কাজ করতে বাধ্য করে না। এমন কি, আমিও কারও উপরে জবরদস্তি কিছু চাপিয়ে দিই না- বরং বসে বসে দেখি, কে কী করে, কিভাবে চলে।
তখন দেশ বিভাজনের কাজ হয়ে গেছে। ঠাকুর বিশেষভাবে ঋত্বিক্ সংগঠনের প্রতি নজর দিচ্ছেন। তাদের চলন-চরিত্র এবং কাজ-কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে দিচ্ছেন। একদিন বললেন, 'ঋত্বিকরা বাইরে গেলে যাজন করবে, দীক্ষা দেবে-মানুষ গড়বে আর আশ্রমে থাকার সময়ে দোকানে বসে গল্প করবে আর অলস হয়ে গোষ্ঠী-সুখ ভোগ করে দিন কাটিয়ে দেবে, তা কিন্তু নয়। ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, এখানে থাকার সময়েও তাদের অনেক কিছু করার থাকে। সর্বদাই ইষ্টকাজে ব্যস্ত না থাকলে, কখন যে কোন বৃত্তির ঘূর্ণির ভিতর গিয়ে পড়বে, তার ঠিক নেই।'
'আর একটা বড় কথা হলো, মানুষের সামর্থ্যের কিন্তু শেষ নেই।' বললেন, 'যতই শান দেবে, ততই ধার বাড়বে। কাজ করতে করতে কাজ করার বুদ্ধি ও কাজ করার অভ্যাস যেন তাকে পেয়ে বসে। এ বড় মজার জিনিস। যে ফাঁকি দেয়, সে নিজেই ফাঁকে পড়ে-জীবনযুদ্ধে হেরে যায়।'
সেই জন্যে আমি বলি, 'বেগার খাটাও ভালো। চরিত্রটা গড়ে ওঠা তো সবচেয়ে বড় লাভ।'
যে ভক্ত কাজ চেয়ে নেয় এবং তার আগাগোড়া নিজের দায়িত্বে করে, সেই ভক্তই হলো সেরা কর্মী।
একদিন ঠাকুর তামাক খেতে চেয়েছেন। তাঁর অন্যতম সদা-সেবিকা সরোজিনী জোয়ারদার তামাক সাজতে গেলেন। তামাকু-সরঞ্জামের কাছে গিয়ে দেখলেন, টিকের থালায় টিকে নেই। তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিকটবর্তী একজনকে তাড়াতাড়ি গিয়ে টিকের মজুত-ভাণ্ডার থেকে টিকে এনে দিতে বললেন।
সরোজিনীমার অসহায় অবস্থা দেখে ঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন, 'আমার ধাতটা কিন্তু আলাদা, যার উপরে যে ভার থাকবে, সে তার সবটুকু না করলে আমার ভালো লাগে না।'
প্রসঙ্গক্রমে তাঁর শ্রুতিলেখকের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি হয়তো লিখছো, একজন কাগজ এনে দেবে, অন্য একজন কলম এনে দেবে, আর একজন বা কালি ভরে দেবে-এমন রকমটা ভালো না। লিখতে গেলে যা-যা করা লাগবে, তার সবটাই তুমি করবে।'
কথা শুনে জোয়ারদার-মা নিজেই উঠে গেলেন তামাক-সাজার টিকে আনতে।
দেশত্যাগ করে এখানে এসেও সমানতালে চলেছে তাঁর মানুষ তৈরির কাজ। আবার একটা মজার ব্যাপার হলো এই যে, কারও বয়স পেকে গেছে বলে তার তৈরি হয়ে ওঠার ব্যাপারটা উপেক্ষা করেন, তা কিন্তু নয়। কারণ, যতক্ষণ দেহ ও আত্মা একসঙ্গে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তৈরি হতে হতেই চলতে থাকে। জীবন প্রবাহের মধ্যে কোন ছেদচিহ্ন নেই। ছেদ একবারই পড়ে।
ভারতভাগের পর মাত্র সপ্তাহখানেক কেটেছে। সৎসঙ্গী নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে দেওঘরে এসেছেন হিমাইতপুরের নিকটবর্তী গ্রামের এনায়েৎ বিশ্বাস এবং খবির উদ্দিন মিঞা। ঠাকুর তো দেশ থেকে চলে এলেন, এখন তিনি কেমন আছেন, কি ভাবছেন ইত্যাদি জানার আগ্রহই ছিল 'তাদের এদেশে আসার উদ্দেশ্য।
কথায় কথায় ঠাকুর তাঁদের কাছে বললেন, 'দ্যাখো, দেশবিভাগ সকলের পক্ষেই অভিশাপ-এতে হিন্দুরও ক্ষতি হলো, মুসলমানেরও ক্ষতি হলো। আমরা ভাবলাম, আমরা বুঝি পরস্পরের শত্রু। কিন্তু আসলে তো তা না। প্রত্যেক মহাপুরুষই প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সকল মানুষের প্রকৃত বন্ধু। তাঁরা সবাই একই বাণী বয়ে আনেন। আমরা এই 'আসল কথাটা ভুলে গিয়ে ধর্মের পথে না চলে আপন-আপন বৃত্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার পথে চলি। তার থেকেই যত দ্বন্দ্ব, যত বিভেদ-বুদ্ধি আর শত্রুতা-সাধনের ষড়যন্ত্র। তার যা ফল, এখন ভুগতেই হবে।'
বললেন, 'তোমরা আমাকে ভালবার্স, আমার কথা মনে রেখেছো, তাই আমাকে দেখতে এসেছো। তোমরা দেশে ভালোভাবে থেকো, আশ্রমটার দিকে লক্ষ্য রেখো-এইটুকুই আমার বলার।'
ঠাকুর তাঁদের, আদরযত্ন করলেন এবং অন্তরের শুভেচ্ছা জানালেন। আর গ্রামের সকলের উদ্দেশ্যে তাঁর শুভকামনা পাঠালেন।
এই হলেন দ্রোহহীন অনুকূলচন্দ্র। তাঁর বিদ্রোহ শুধু জীবনবৃদ্ধির বিরোধী বুদ্ধির বিরুদ্ধে।
তিনি নিজে ভারতবর্ষীয় লোকত্রাতা পরম পুরুষদের জীবনীয় জীবন-বৃত্তান্ত কতবার যে একসুতোয় গেঁথে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, তার তো ঠিক-ঠিকানাই নেই, অভারতীয় জগদ্গুরুদের জীবন-চরিতও উদাহরণ দিয়েছেন কথায় কথায়। যিশু এবং মুহাম্মদ (সঃ) এর কথাও কম বলেননি মানুষের দরবারে। সবাই যে ঈশ্বরীয় দূত, একথা বলেছেন তাঁদের প্রকৃষ্ট প্রচারকের মতোই। প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যকে একাকার করে ছাড়লেন তিনি।
আবার এযুগে যে রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে নিয়ে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল তাঁর যথার্থ মূল্যায়নের ব্যাপারে, তাঁর সম্বন্ধে ঠাকুর খোলা তলোয়ারের মতো চোখা ভাষায় ঘোষণা করলেন, রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে মহামানব-টানব বললে তাঁকে ছোট করে বলা হয়। তিনি আগাপাছতলা ভাগবত পুরুষ-নররূপী ভগবান। যে কালে লোকে তাঁর সম্বন্ধে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার জন্যে নানাবিধ বিচার-বিবেচনায় ব্যস্ত, সেই সংকোচ এবং বাগ্বিতণ্ডার ঘোলাটে মুহূর্তে হিমাইতপুরের ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ঘোষণা করলেন-রামকৃষ্ণ মানবদেহে স্বয়ং পরাৎপর পুরুষ। লোকশিক্ষার কারণে তাঁর দেহ-ধারণ।
এঁর চেয়ে সমন্বয়বাদী মানুষ আর কেউ জন্মেছেন? এর চেয়ে সমদৃষ্টির কথা ভাবা যায়?
দেশবিভাগের পর মাত্র তিন মাস, তেইশ দিন কেটেছে। আর ঠাকুরের দেওঘর-আগমনের সেদিন হলো এক বছর, তিন মাস, ছ' দিন।
সময় সকালবেলা। শ্রীশ্রীঠাকুর বড়াল বাংলোর বারান্দায় উপবিষ্ট। ইউনাইটেড প্রেসের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক বিধুভূষণ সেনগুপ্ত এসেছেন ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সৎসঙ্গের আশ্রমবাসী প্রধান ব্যক্তিরা বিধুবাবুকে সঙ্গে করে এনেছেন ঠাকুরের কাছে। বিধুবাবু নামকরা সংবাদ সংস্থার দুদে সাংবাদিক। তাঁর সাক্ষাৎকার মানেই তো সুচতুর প্রশ্ন এবং তার জবাব-সংগ্রহ। তা-বড় তা-বড় নেতাকে প্রশ্নচাতুর্যে কাবু করে ফেলে কাঙ্ক্ষিত উত্তর বের করে নেওয়ায় এঁরা সিদ্ধহস্ত। তবে বিধুবাবু রাজনৈতিক নেতার কাছে আসেননি, এসেছেন সৎসঙ্গের প্রাণপুরুষ লোকগুরু ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে-সে খেয়াল তাঁর আছে। তিনি সবিনয়ে প্রণাম নিবেদন করে প্রদত্ত আসনে বসলেন। আশেপাশেই উপবেশন করলেন তাঁর পথ-প্রদর্শক সহাগত ঋত্বিগাচার্য কৃষ্ণপ্রসন্ন, সৎসঙ্গের প্রচারসচিব রাজেন মজুমদার, প্রজ্ঞাবান্ কর্মী কিরণ মুখোপাধ্যায়, চুনীলাল রায়চৌধুরী প্রভৃতি। মজুমদার মশাই ঠাকুরের কাছে বিধুবাবুর পরিচয় প্রদান করলেন। ঠাকুর খুশিমনে প্রতিনমস্কার করে তাঁকে অভ্যর্থিত করলেন।
এবার সাংবাদিক হিসেবে বিধুবাবু তাঁর কথা আরম্ভ করলেন। বললেন, আমার অপরাধ নেবেন না, অনেকের মতে তো পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসা এক ধরণের কাপুরুষতা। বিশেষ করে আপনাদের মতো প্রজ্ঞাবান এবং সংগঠন কৌশলী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যদি দেশত্যাগী হয়ে চলে আসেন, তাহলে সাধারণ মানুষের মনোবল তো ভেঙ্গেই পড়বে।
ঠাকুর মন দিয়ে অভিযোগের কথা শুনলেন। উত্তরে দু'টি জিনিস তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন।
প্রথমতঃ বোঝাতে চাইলেন, তাঁর তেমন কোন জনবল ছিল না। আশ্রমে সামান্য সংখ্যক যে মানুষগুলি ছিল, তাদের নিয়েই তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা যে করেননি, তা নয়। সেবা দিয়েও স্থানীয় মানুষকে আপন করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু যারা সংস্কারের দিক দিয়েই বিপথগামী, তাদের আপন করা সম্ভব নয়। তাই, তিনি প্রায় ৰান্ধবহীনই ছিলেন। আর শক্তি সম্পন্ন বান্ধবশক্তি ছাড়া বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে একা আর অসহায় অবস্থায় শহীদ হবার মধ্যে তিনি কোন বীরত্বও খুঁজে পান না।
আরও বললেন, 'এই তো কদিন হলো দেশভাগ হয়েছে, এর মধ্যেই তিনি পাবনায় লোক পাঠিয়েছেন, সরেজমিনে পরিস্থিতি বুঝে আসার জন্যে। দেখা গেল, যা ছিল- তাই। বরং একদল লোক সব কিছুর দখল নিয়ে গোটা আশ্রমটাই আত্মসাৎ করতে চায়।'
'দেখুন, চেষ্টার কোন কসুর করিনি। আমার তো ওটা জন্মভূমি, আমার অন্তরের একটা স্বাভাবিক টান জন্মভূমির জন্যে আছেই। কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। আমি যা বুঝেছিলাম, তা বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতাদেরও বলেছিলাম, কিন্তু কেউ তা মেনে নিতে পারলেন না। কাজেই, আমি আদর্শের দিক দিয়ে একাই হয়ে পড়লাম। এই হলো আমার কথা।'
'আর দেখুন, আমি কিন্তু আপনার হিসেব অনুসারে শরণার্থী নই। আমি এখানে এসেছি দেশভাগের প্রায় বছর দেড়েক আগে, ডাক্তারের পরামর্শে। আশ্রমের অন্যান্য লোকজনদের সেখানে রেখেই এসেছিলাম। চিরতরে দেশত্যাগের চিন্তা থাকলে কি আসার আগে সেখানে আমার মায়ের নামে একটা ডিগ্রি কলেজ স্থাপন করে আসতাম। যে দু-চার জন নিয়ত কর্মী না হলে চলে না, তারাই শুধু সঙ্গে এসেছিল।'
'দেখুন দাদা, আমি চিরদিনই মিলনবাদী। মিলনের মধ্যে আমাদের স্বার্থ। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ বাঁচতে পারে না। সকলের সত্তা ও স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখাই আমাদের লক্ষ্য। এই কাজ করতে গেলে কোন কোন সম্প্রদায় বা কোন মানুষকে বাদ দেওয়া যায় না। এমন কি কোন দেশ, কোন দল বা কোন মতবাদকেই উপেক্ষা করা চলে না।'
বিধুবাবু এবার কথান্তরে চলে গেলেন। বললেন, 'আমাদের হিন্দু সমাজের মধ্যেও বৈষম্যই বেশি-দল বেঁধে মিলিত হয়ে চলার বুদ্ধি নেই'।
উত্তরে ঠাকুর বোঝাবার চেষ্টা করে বললেন, 'দেখুন, প্রত্যেক সত্তারই স্বস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। এ বৈশিষ্ট্য কিন্তু বৈষম্য নয়। বৈশিষ্ট্যকে নিয়েই ঐক্যের চর্চা চলে আসছে ঋষিপুরুষদের আমল থেকে। আধুনিক যুগে মানুষ এই ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যকে ভেঙ্গে চুরমার করতে গিয়ে নিজেরা এক কিম্ভুতকিমাকার জীবে পরিণত হয়েছে। বৈশিষ্ট্য-পূরণী বুদ্ধি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক বিবাহসংস্কারের মধ্যেই রয়েছে অনাগত প্রজন্মের সুকৃতি। বিবাহে বর্ণবিচার তাই একটা অবশ্য পালনীয় সামাজিক দিক।' ইত্যাদি বিশ্লেষণাত্মক কথা বলে থামলেন ঠাকুর।
কথাকে আরও অন্য দিকে নিয়ে যেতে চাইলেন বুদ্ধিমান বরিষ্ঠ সাংবাদিক।
বললেন, 'আপনি এত কিছু ভাববেন না, ওতে আপনার স্নায়ুর উপরে চাপ পড়বে, আপনার অসুস্থতা আরও বেড়ে যাবে। আপনার সুস্থ থাকার খুবই দরকার আছে'।
এই রকম শুভকামনা-বিনিময়ের পর সেদিনের সাংবাদিক-সাক্ষাৎকার সমাপ্ত হলো।
১৩৫৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের প্রায় মাঝা-মাঝি। বেশ ঠাণ্ডার আবহাওয়া। বিকেলের দিকে একটু রোদ থাকতেই ঠাকুর বড়াল বাংলোর গেটের দিকে আমতলায় এসে একখানা আরাম-চেয়ারে বসেছেন। আশ্রমবাসী কিছু ভক্ত আছেন আশপাশে।
এক ভক্ত জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনিতো যুগ-পুরুষোত্তমকে ধরে চলতে বলেন, কিন্তু পুরুষোত্তম তো সব সময়ে থাকেন না- তাঁদেরও দেহের পতন হয়ে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তো, তখন মানুষ তাঁকে ধরবে কেমন করে?'
'পুরুষোত্তমকে ধরা মানে তুমি কী বোঝ?' উত্তরে নিজেই বললেন, 'পুরুষোত্তমকে ধরা মানে তাঁকে ইষ্ট বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁরই কোন ইষ্টপ্রাণ আচারবান্ ঋত্বিকের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে চলা। এই ভাবেই যুগপুরুষোত্তমকে ধরা হয়। আর সর্বাধুনিক পুরুষোত্তমকে ধরলে পুরাতন সকল পুরুষোত্তমের নির্দেশই পূরণ করা হয়। কারণ, এঁরা একই বার্তাবাহী। তাই সর্বাধুনিক পুরুষোত্তমই মানুষের স্বাভাবিক গুরু বা ইষ্ট।'
কোন পুরুষোত্তমের যুগ বলতে কী বুঝবো? তিনি যে সালের যে তারিখে আবির্ভূত হলেন সেই সালের সেই ক্ষণ থেকে তাঁর পুনরার্বিভাবের সাল-তারিখ পর্যন্ত তাঁর যুগ। সর্বাধুনিক পুরুষোত্তমের যুগ নির্ণীত হবে ৩০শে ভাদ্র ১২৯৫ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু করে তার পরবর্তী নরদেহ ধারণের সাল-তারিখের ব্যাপ্তিকে নিয়ে।
এখন অনুকূলযুগ চলছে। অনুমান করা যায়, কয়েক হাজার বছর এই যুগই চলবে।
(শ্রীউমাপদ নাথ)
কুইকোটা (মেদিনীপুর পশ্চিম)
উল্টোরথ, ২৪শে আষাঢ়, ১৪১০
#শ্রীশ্রীঠাকুরকে_যেমন_দেখেছি
#SrisriThakurke_Jemon_Dekhechi
🪔 https://www.amritokatha.in/ 🪔 👈
Telelegram https://t.me/amritokatha
https://www.facebook.com/Amritokatha.in1?
face book

10