📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔷 অকালমৃত্যু কি করে রোধ করা যায়
[P 155-163]
৭ ই পৌষ , সােমবার , ১৩৪৮ ( ইং ২২/১২/৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর সবেমাত্র সকালে ঘুম থেকে উঠেছেন । আচমকা একটি মা এসে ঠুস হয়ে কেঁদে পড়লেন , বাবা ! আমার বুক যে জ্বলে যাচ্ছে , আমি যে আর সইতে পারছি না । বাবা ? আমি কী পাপ করেছি ? তুমি আমাকে না নিয়ে থােকাকে নিলে কেন ? ••• আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না । বুকখানা আমার ঝাঁজরা হ’য়ে গেছে । আমি কী করব বাবা ! কোথায় যাব ? কোথায় গিয়ে জ্বালা জুড়োব ? প্রৌঢ়া একটি মা ( নদীয়া থেকে আজ ভােরে এসেছেন , সঙ্গে পাড়ার একজন সৎসঙ্গী ) এইভাবে বিলাপ করছেন , আর হাউ হাউ করে কাদছেন , মাঝে - মাঝে তাসুর সানে মাথা খুঁড়তে চাইছেন , আর অন্য সবাই তা থেকে তাকে প্রতিনিবৃত্ত করতে চেষ্টা করছেন । শ্রীশ্রীঠাকুরও নির্বাক , তার চোখ দিয়ে টসটস্ ক'রে জল গড়িয়ে পড়ছে । মুখখানা বিষাদ ও করুণায় ভরা, পুত্রশােকাতুরা জননীর থেকেও তাঁর মুখশ্রী বেশী মলিন ও পাণ্ডুর হ’য়ে উঠেছে । তিনিই যেন হারিয়েছেন তার অতি প্রিয়জন কাউকে । অঝোরে ধারা বেয়ে পড়ছে তার দুটি চোখ দিয়ে । কাদতে - কাদতে তার চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছে । চোখের জল গড়িয়ে প’ড়ে গায়ের কাথা ভিজে যাচ্ছে । মা'রও ক্রন্দন ও বিলাপের বিরাম নেই । তিনি এতই অভিভূত যে শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে চাইবার অবকাশ নেই । এদিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের অবস্থাও কাহিল । তাঁর চোখ - মুখের দিকে আর চাওয়া যাচ্ছে না , একটা অব্যক্ত বেদনায় তিনি যেন মর্মান্তিক যন্ত্রণা পাচ্ছেন । বার - বার তাঁর অধর স্ফুরিত হ’য়ে উঠছে , অতি কষ্টে নিজেকে কোনভাবে চেপে আছেন । তাঁর পদ্মপলাশলোচনে যেন নিখিলের বেদনা আশ্রয় গ্রহণ করেছে । কাছে যারা আছেন তাদের কাছে এ দৃশ্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে । মাটি এইবার একবার মুখ তুলে চাইলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে । চেয়ে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন — দেখলেন , দয়াল কাঁদছেন আর পলে - পলে মর্মান্তিক বেদনায় তিনি যেন ক্ষয় হ’য়ে যাচ্ছেন । পরক্ষণেই মা'র ভাব বদলে গেল । মা বলতে লাগলেন — ‘ দয়াল ! বাবা ! তুমি অমন করে কেঁদো না । তুমি কাঁদলে আমি কোথায় গিয়ে সান্ত্বনা পাব !
শ্রীশ্রীঠাকুর কাদতে - কাদতে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন — আমি কাদব না তাে কাঁদবে কে ? তােদের সবার কান্না না ঘুচলে আমার কান্না ঘুচবে কী করে ? ( একটু থেমে পরে আবার বললেন ) —আমার দৃঢ় ধারণা অকালমৃত্যুকে নিশ্চয়ই রোধ করা যায় । রামচন্দ্রের সময় একটি ব্রাহ্মণের ছেলের অকালমৃত্যু হওয়ায় , সেই ব্রাহ্মণ এসে কৈফিয়ৎ চেয়েছিল রামচন্দ্রের কাছে , কেন তােমার রাজ্যে অকালমৃত্যু হয় ? তখন রামচন্দ্র তার অনুসন্ধানে ব্রতী হ'য়ে বিহিত ব্যবস্থা যা ’ তাই করেছিলেন , যাতে রাজ্যে অকালমৃত্যুর কারণ না ঘটে । আজ আমাদের দেশে , আরাে কত দেশে , ঘরে - ঘরে তোমার খােকার মত কত নধর কচি খােকারা অকালে মরে যাচ্ছে , অথচ এর প্রতিকার হচ্ছে না , তা কেন ? কেন আমরা এটা ঘটতে দিচ্ছি ? আমি যদি বুঝতাম যে এর উপর আমাদের কোন হাত নেই , তাহ'লে তত দুঃখ ছিল না । কিন্তু আমি জানি , এ রােধ করা যায় ।
ইতিমধ্যে কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , চুনিদা ( রায়চৌধুরী ) , বীরেনদা ( মিত্র ) , কিরণদা ( মুখােপাধ্যায় ) , শরৎদা ( হালদার ) , সতীশদা ( দাস ) , শৈলেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , যােগেশদা ( চক্রবর্তী ) , গুরুদাসদা ( বন্দ্যোপাধ্যায় ) , অমরভাই ( ঘোষ ) প্রভৃতি অনেকে এসে হাজির হলেন ।
কেষ্টদা ঐ কথার সূত্র ধরে জিজ্ঞাসা করলেন , আমরা অশু কী করতে পারি এই অকালমৃত্যু রোধের জন্য মা’র ইতিমধ্যে কান্না থেমে গেছে , তিনি গভীর মনােযােগ সহকারে শ্রীশ্রীঠাকুরের কথাগুলি যেন গিলছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখ - মুখও এখন অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থা ধারণ করেছে , বরং খানিকটা প্রেরণা - উদ্দীপ্ত । তিনি মাটিকে বললেন — অমনি ক'রে মাটিতে বসিস না বাইরে , একে তো গাড়ীতে ঠাণ্ডা লাগিছে রাত্রে । উপরে উঠে বয় । ও কালিদাসী । ওকে একটা আসন দে তাে ।
কালিদাসীমা একখানা আসন এনে দিলেন ।
মা সেই আসন পেতে বসলেন । তারপর শ্রীশ্রীঠাকুর কেষ্টদার দিকে চেয়ে মৃদু , ম্লান হাসি হেসে বললেন কী করতে হবে সে তত ঢের শুনিছেন । যা ’ শুনিছেন , তাই এখন করেন ।
কেষ্টদা — আমি অকালমৃত্যু - রােধে specific ( বিশিষ্ট ) করণীয় কী তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি problem ( সমস্যা ) -গুলি singly (একক ) দেখি না , দেখি সবগুলিই inter - connected অর্থাৎ জড়িয়ে আছে । তাই মােকথা করণীয় হিসাবে আপনাদের কাছে যা কইছি , তা যদি করেন , তাহ'লে সব অমঙ্গলই রােধ করতে পারবেন । আপনাদের প্রধান কাজ হলো দীক্ষাদান । যত মানুষকে দীক্ষিত করে তুলতে পারবেন , যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি ও সদাচারে অভ্যস্ত করে তুলতে পারবেন , জানবেন , ততগুলি মানুষকে জীবনের পথে টেনে আনা হ'লাে , মঙ্গলের পথে টেনে আনা হলো , কারণ , ইষ্ট হলেন মুর্ত্ত মঙ্গল । এই দীক্ষা আনবে আবার পারস্পরিকতা ও সংহতি । তাতে পরপর পরস্পরের বৈষয়িক উন্নতিরও সহায়ক হয়ে উঠবে । তারপর বিয়েটা খুব দেখে- শুনে দিতে হয় , সমাজে প্রতিলোম বিয়ে যেন একটাও না হয় । ছেলে যেন সব দিক দিয়ে উন্নত হয় , শ্রেয় হয় মেয়ের চাইতে । আবার , ছেলেমেয়ের মধ্যে temperamental affinity ( মানসিক সঙ্গতি ) থাকা চাই । বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলে সাক্ষাৎ সংস্রবের সুযােগ না দিয়ে ছেলের বংশ , অভ্যাস , ব্যবহার , চরিত্র , গুণপনা , স্বাস্থ্য , চেহারা , পছন্দ - অপছন্দ ইত্যাদি বিষয় তাকে জানিয়ে তার মত নিয়ে তবে বিয়ে দেওয়া ভাল । স্ত্রী যদি স্বামীকে শ্রদ্ধা করে , তার জন্য কষ্ট সয়েও নিজেকে সুখী ও সার্থক মনে করে , তাহলেই সেই বিয়ে সফল হয় । আয়ুর একটা বংশগত ধারা থাকে । কিন্তু স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে যেখানে গভীর পবিত্র প্রণয় আছে , স্ত্রী যেখানে স্বামীকে নিজের সত্তাজ্ঞানে ভালবাসে , স্বামী যেখানে স্ত্রীকে নিবিড় স্নেহের চক্ষে দেখে , সেখানে সন্তানের স্বাস্থ্য , বুদ্ধি , আয়ু ইত্যাদির উৎকর্ষ হবেই । অবশ্য , স্বামীর ইষ্টমুখী হওয়াই চাই । স্বামী যদি স্ত্রীমুখী সেখানে স্ত্রী ঐ স্বামীকে বেশীদিন শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারবে না । তাছাড়া , স্বামী - স্ত্রী উভয়ের মধ্যেই তখন প্রবৃত্তিরই প্রাধান্য দেখা যায় । এইভাবে মানুষ যদি ইষ্টকৃষ্টি ও সদাচারপরায়ণ হয় , বিয়ে যদি ঠিকমত হয় , শিক্ষা ও পরিবেশকে যদি খানিকটা সুগঠিত করে তোলা যায় , পুরুষের ও মেয়ের অবশ্যজ্ঞাতব্য যা ’ , অবশ্য করণীয় যা ’ , সেগুলিতে যদি তাদের সড়গড় ও সক্রিয় করে তোলেন , দেখবেন , দেশের লোকের স্বাস্থ্য, আয়ু , কর্মক্ষমতা কতখানি বেড়ে যাবে । আর , সুজনন ও সুযােগ্যতার জন্য চাই বর্ণাশ্রমসম্মত চলন । এগুলি সোজাসুজি বিজ্ঞানের কথা । আমাদের হাতের মধ্যের ব্যাপার ।
কেষ্টদা - আপনি এই যা ’ বললেন , এই ক'টা কথা মাথায় রেখে চলতে পারলে তাে অনেক কিছু হয়ে যায় । কিন্তু দেশের মধ্যে ব্যাপকভাবে এইটে চারাতে গেলে যে বহু কাঠখড়ি খরচ করা প্রয়ােজন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সেইজন্যই তাে আমি বার - বার আপনাদের কই কৰ্মীসংগ্রহের কথা । চরিত্রবান আচরণবান কর্মী ছাড়া হবে না । আর পুথিপত্র , বক্তৃতা , রেডিও , সিনেমা , যাত্রা , থিয়েটার , নাটক , নভেল , গল্প , শিল্পকলা , সঙ্গীত , আমােদ , উৎসব , মেলা , কথকতা , কবি , জারি , খবরের কাগজ , চিঠিপত্র , পত্রিকা , খেলাধুলো , প্রদর্শনী , শােভাযাত্রা , পােষ্টার , প্যাম্ফলেট , ছবি , মটো , বিজ্ঞাপন ইত্যাদি যতভাবে পারেন সব - কিছুর মধ্যদিয়ে মানুষকে ভগবদমুখী করে তুলতে , কর্মঠ দক্ষ করে তুলতে , সুসংহত ও সেবাপ্রাণ করে তুলতে প্রেরণা যােগান । লাগেন শালা যা থাকে কপালে । দুনিয়ায় আইছি তাে সুখ করে নিই । ( চকিতে ডান হাতখানি উর্ধে উত্তোলন করে ) — “ হায় সে কি সুখ , এ গহন ত্যজি হাতে লয়ে জয়তুরী , জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে , রাজ্য ও রাজা ভাঙ্গিতে গড়িতে , অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া হানিতে তীক্ষ্ম ছুরি’।
শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখে - মুখে প্রচণ্ড উদ্দীপনার স্থির বিজলী - দীপ্তি । অগ্নিময় উদ্দীপনায় এত শীতের মধ্যেও যেন সকলে গরম হয়ে উঠেছেন । উপস্থিত সবার চোখ - মুখ আনন্দে জ্বলছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুরকে এইবার তামাক সেজে দেওয়া হলাে । তিনি আস্তে - আস্তে তামাক খাচ্ছেন । দৃষ্টি ফ্যালফেলে — যেন অন্য কোন রাজ্যে আছেন । আঁখিযুগলে স্নেহ , প্রেম , করুণা ও প্রেরণা এক অনির্বচনীয় মাধুর্য্যের সৃষ্টি করেছে , সেই অমিয় - দৃষ্টি মেলে দয়া - বৃষ্টি করছেন সবার উপর । প্রত্যেকের -বুক কানায় - কানায় ভরে গেছে সুধাসিক্ত আনন্দ - সম্ভারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আবার মাথা দুলিয়ে - দুলিয়ে , অনুপম লীলায়িত - ভঙ্গিমায় , লীলায়িত অনিন্দ্য - কণ্ঠে প্রাণকাড়া মূর্চ্ছনা তুলে আবৃত্তি সুরু করলেন—
‘ কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব
— পেয়েছি আমার শেষ ।
তোমরা সকলে এসাে মাের পিছে ,
গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে ,
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগাে রে সকল দেশ ॥
নাহি আর ভয় , নাহি সংশয় ,
নাহি আর আগু - পিছু ।
পেয়েছি সত্য , লভিয়াছি পথ ,
সরিয়া দাড়ায় সকল জগৎ ,
নাই তার কাছে জীবন - মরণ
নাই নাই আর কিছু ॥
হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে
দৈববাণীর মতাে —
উঠিয়া দাঁড়াও আপন অলোতে ,
ওই চেয়ে দেখাে কতদূর হ'তে
তােমার কাছেতে ধরা দিবে ব’লে
আসে লোক কত শত ॥
ওই শােনাে শােনে কল্লোল - ধ্বনি
ছুটে হৃদয়ের ধারা ।
স্থির থাকো তুমি থাকো তুমি জাগি
প্রদীপের মতাে অলস তেয়াগি
এ নিশীথ - মাঝে তুমি ঘুমাইলে
ফিরিয়া যাইবে তারা ।।
কেষ্টদা , শরৎদা প্রভৃতি এক - একজনের চোখে চোখ রেখে চাপ দিয়ে - দিয়ে বলতে লাগলেন
“ স্থির থাকো তুমি , থাকো তুমি জাগি
প্রদীপের মতাে অলস তেয়াগি ,
এ নিশীথ - মাঝে তুমি ঘুমাইলে
ফিরিয়া যাইবে তারা ॥ ”
—এমন করে একটা অকুল - কঠোর সঙ্কল্পের দৃঢ়তা ফুটিয়ে তুলছেন সবার মধ্যে । তখন রােদ উঠে গেছে । চরের দিক থেকে ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে । ধীরে ধীরে লোকসংখ্যা বেড়ে চলেছে । এই আসরের একটা মাদকতা আছে । আছে একটা মৌতাত । নেশার মত পেয়ে বসে । একটুক্ষণ বসলে আর উঠতে ইচ্ছা করে না । একদিন আসলে রােজ আসতে ইচ্ছা করে । না আসলে ভাল লাগে না , মন খুতখুত করে । তাই ছােট - বড় , নারী - পুরুষ অনেকেই আসছেন , আসছেন আর প্রণাম ক'রে ব'সে যাচ্ছেন , কেউ বা দাড়িয়ে - দাড়িয়ে পুলকবিভাের প্রাণে উদগ্রীব হয়ে তাকে দেখছেন । দেখছেন দেবদেহের সুঠাম সৌন্দৰ্য্য , আর শুনছেন তার অমিয় - মধুর বাণী । দেখছেন , শুনছেন আর তাদের হৃদয় আনন্দে আকুল হয়ে উঠছে , একটা অতৃপ্ত তৃপণ তৃষা লেগে আছে তাদের চোখে । লােকেশ যিনি , প্রাণেশ যিনি , জীবজীবন যিনি তিনি যখন দেহধারণ করেন , তিনি এমনি করেই প্রতিনিয়ত প্রতিটি প্রাণে সুখ বিতরণ করেন ।
নগেনদা ( বসু ) একটু খক্ - খক্ ক'রে কাশছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কাশী হইছে , ওষুধ - টষুধ খান না ?
নগেনদা খাইছি , কমছে না । শীতকালে আমার একটু গােলমাল লেগেই থাকে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — খুব ভাল করে তেল মাখবেন । আর মধু খাবেন । বাসক ছালের রস যদি মধু দিয়ে খান , ভাল হয় । রোজ নিয়মিত খাবেন । আর পারলে খাবার পাতে মধু খাবেন । এটা বরাবর খেয়ে যাবেন । মধু খাওয়া খুব ভাল । ••••••••••• ও প্যারী ! কার্ত্তিক বােসের বই বা নাদকারণির ‘ ইণ্ডিয়ান মেটিরিয়া মেডিকা ’ এনে মধুর গুণ কী নগেনদার কাছে পড়ে শােনা তাে ।
নগেনদা — আপনার মুখে শুনলাম , সেই যথেষ্ট , আর বই আনা লাগবে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( বিস্মিত হ'য়ে ) —ও মা গাে ! সে কি কথা ? আমি কলাম , সেইজন্য আর বই দেখা লাগবে না , সে কেমন কথা ? আর বই দেখার কথাও তাে আমি কচ্ছি । যা জানবেন , তা ’ thoroughly (পুরােপুরি ) জানবেন । মধু কেন ভাল ? কো - কোন্ অবস্থায় এটা কার্যকরী , নতুন টাটকা মধুরই বা গুণ কী , পুরোন মধুরই বা গুণ কী , খেলে কোন্ মাত্রায় খাওয়া দরকার , এসব জেনে নেবেন না ? অলস আন্দাজী জ্ঞান ভাল না । অনুসন্ধিৎসা নিয়ে খুটিয়ে - খুটিয়ে জানবেন । তখন সেই জ্ঞান দিয়ে মানুষেরও উপকার করতে পারবেন । আপনি মাষ্টারমানুষ , ছেলেমেয়েদের পড়ান , আপনার মধ্যে এসব অভ্যাস খুব তুখোড় করে রাখা লাগে । মুখে - মুখে লাখ শেখান , তার কোন দাম হবে না , যদি ভাল অভ্যাসের ভিত গেড়ে দিতে না পারেন তাদের ভিতর । আর , সদভ্যাস আপনার যদি আয়ত্ত না হয় , স্বভাবগত না হয় , তবে তার ভিত গাড়তেও পারবেন না অনন্যর ভিতরে । শিক্ষকের প্রতি সাধারণতঃ ছাত্রদের কিছু - কিছু শ্রদ্ধা থাকেই , ঐ শ্রদ্ধার দরুন শিক্ষকদের চরিত্র অলক্ষিতে ছাত্রদের ভিতর চারিয়ে যায় । তাই শিক্ষকদের খুব সাবধানে চলা লাগে । শুধু ক্লাসে সাবধান হয়ে চললে চলবে না , সৰ্ব্বক্ষণ সাবধান হয়ে চলা লাগবে , হিসেব করে চলা লাগবে , ভাবা লাগবে আমি এমন - কিছু করছি কি - না , যা অনুসরণ বা অনুকরণ করে আমার কোন ছাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে । আপনি হয়তাে সাহিত্য পড়বার সময় উদারতা , দানধ্যান সম্বন্ধে খুব লম্বা - লম্বা কথা বলে এলেন । আপনার সেই কথা শুনে ছাত্র বা ছাত্রীরা হয়তাে খুব অনুপ্রাণিত হয়ে উঠলো । তার একঘণ্টা বাদে আপনাকে হয়তাে দেখা গেল , আপনি রাস্তায় দাড়ায়ে ঈষদাদার সঙ্গে একটা টিউশনির জন্য খেয়ােখেয়ি করতিছেন । আপনার অগোচরে দেখে গেল , ক্লাসে আপনার কথা যে - সম্বেগ সৃষ্টি করিছিল ছাত্রের মনে , তার উপর জল ঢেলে দিল আপনার রাস্তার ঐ আচরণ । তার শ্রদ্ধা ও সম্বেগ যা তাকে মহান করে তুলতে পারতো , তার উপর মারলেন অপিনি এক কুড়োলের কোপ , এরপর আপনার মুখে যখনই কোন ভাল কথা শুনবে , সে মনে করবে , ঐগুলি লােক ঠকানর জন্য বলতে হয় , করতে হয় না । আপনার ভণ্ডামী , আপনার মন - মুখ ও আচরণের ফারাক , তাকেও অমনতর হ'তে প্রেরণা জোগাবে । বুঝলেন তো ব্যাপার কত গুরুতর । খুব সাবধান । আর , এটা শুধু আপনাকে বলে বলছি না , ঋত্বিদের ব্যাপারে এটা ঢের বেশী সত্যি । পিতা - মাতার বেলায়ও এ - কথা খাটে । এমন মানুষ খুব কমই আছে যাকে কেউ - না - কেউ শ্রদ্ধা না করে । তাই পরিবেশের দিকে চেয়েও প্রত্যেকের সুনিয়ন্ত্রিত চলনায় চলা লাগে ।
ইতিমধ্যে প্যারীদা বই এনে বই থেকে মধুর গুণাগুণ শােনালেন ।
আগের কথার সূত্রে নগেনদা বললেন — যা ' হয়ে আছে , এই বয়সে শােধরান বড় মুশকিল । এ জীবন বোধহয় এইভাবেই যাবে , আর তো একরকম পাড়ি দিয়ে আসলাম ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( দৃপ্ত ভঙ্গীতে ) –
এক ঝাঁকিতে মােড় ফিরিয়ে
অভ্যাস ব্যবহার প্রত্যয়ের –
কি তো কেষ্টদা ?
কেষ্টদা —
আদর্শতে অবাধ চলে
বর্ধনে হ ’ অঢেল ঢের ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ঐ কথা ! এক লহমায় ভােল বদলে দিতে পারেন আপনি । ( উল্লসিত ভঙ্গীতে ) ঝেড়ে দাড়ালে আপনাকে রোখে কে ? রমণীতে নাহি সাধ , রণজয় গাও রে । ' শালাগুষ্ঠির নে কিছু বুলিছে । অকাম যা করিছি , করিছি । এইবার তাকে ঝাড়েমূলে নিকেশ করব । নিকেশ করব মানে আর সে পথে হাঁটবে না , যাতে আমার ইষ্টের সুখ - সুবিধা বা সন্তোষ না হয় । আর , জীবন পাড়ি দেবার কথা যে কচ্ছেন , জীবন পাড়ি দেওয়া অতো সোজা না । এখনও আরাে কতদিন বেঁচে থাকবেন ; -নীরােগ , দীর্ঘাযু় হয়ে বেঁচেবর্তে থাকেন সেই তাে আমি চাই । তবে মনে রাখবেন , আপনার জীবন এইখানেই শেষ হয়ে যাবে না । যা নিয়ে যাবেন , তাই নিয়েই আবার আসতি হবে। যে - রাস্তা হাঁটবার সে - রাস্তায় হাঁটতিই হবে । সময় থাকতি হাঁটে নেন , এখন সামনে পথ দেখায়ে দেবার লােক আছে , আপনি ইচ্ছুক হলি আপনার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতেও সে রাজি আছে , রােজ - রােজ এ সুযােগ মিলবি নানে , পরমপিতার মর্জিতে সুবাতাস এসেছে , এই ফাকে পাল তুলে দেন ।
এই ব'লে নগেনদার দিকে চেয়ে ফিক করে একটু হাসলেন , স্নিগ্ধ - স্মিত দৃষ্টিতে বললেন — কপা’লে আছেন কিন্তু আপনি খুব । ( মাথাটা একটু দুলিয়ে বললেন ) —হিঁ ।
নগেনদা — সব বুঝি । কিন্তু করার সম্বেগ নেই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — খােকাকে যেমন ভালবাসেন , আমাকে যদি তেমনি আপনি আপনার খােকার মত করে ভাবেন , তাহলিই হয় । পরজীবন না মানেন , খোকার জীবন তাে প্রত্যক্ষ । ওর ভিতর - দিয়ে বাচবেন । আপনার আচরণ দিয়ে ওকে , ওর পরিবেশকে যত উন্নত করে যাবেন , খােকা , খােকার ছেলেপেলের ভিতর - দিয়ে আপনিই তা উপভােগ করতে থাকবেন ।
এইবার শ্রীশ্রীঠাকুর পায়খানায় যাবেন । সবাই প্রণাম করে গাত্রোত্থান করলেন । পুত্রহারা জননী ব'সে আছেন , তার মুখের চেহারা এতক্ষণ শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা শোনার পর এখন অনেকটা স্বাভাবিক ।
শ্রীশ্রীঠাকুর অমরভাইকে ডেকে বলছেন — মাকে সঙ্গে করে গেষ্টহাউসে নিয়ে যা । দেখিস্ যেন কোন অসুবিধা না হয় । খাওয়া - থাকার যত্ন নিবি । কত পাগল আছে এখানে , কেউ যেন বিরক্ত না করে ওকে । কত ব্যথা নিয়ে এসেছে । উক্ত মা — আমি আর কোথাও যাব না বাবা । আমার খাওয়া - দাওয়া লাগবে না । আপনার মুখখানা দেখে আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হয়েছে । আমি আপনার কাছাকাছি এই দিকেই থাকি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তা’ বেশ । তুই হাত - মুখ ধুয়ে আয় । আমিও হাগেমুতে আসি । ইচ্ছে হলি এই দিকে থাকবি , আর বড়বৌয়ের ওখানে প্রসাদ পাবি ।
মা - বড়মা প্রসাদ দিলে খেতেই হবে , কিন্তু বাবা ! আমার মুখে আর দানা তুলে দিতে ইচ্ছে করে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দ্যাখ , তােকে বাঁচতে হবে আমার জন্য । না খেলে বাঁচবি কি করে ? যতদিন বেচে থাকবি , তাের সাধ্যমত ইষ্ট ও সুনীতি চারিয়ে দিবি সবার মধ্যে , তাের বুদ্ধি থাকবে , তোর আশপাশের কেউ যেন তাের মত অজ্ঞতার দরুন সন্তানের অকালমৃত্যুতে কষ্ট না পায় । মা সম্মতি জানালেন । চোখ তার ছল - ছল করে উঠলাে ।
#আলোচনা_ প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10