কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টচার্য্য :-
🔷 সংকল্প অনুযায়ী এম. এ. পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন, লাভ করলেন স্বর্ণপদক...
🔷 কৃষ্ণপ্রসন্ন ছিলেন বিজ্ঞানী নী সি. ভি. রমনের প্রিয় শিষ্য...
🔷 কৃষ্ণপ্রসন্ন ঠাকুরের শ্রীচরণে ইংরেজিতে বাণী দেওয়ার অনুরোধ করেন....। ঠাকুর সে- কথা শুনে চমকে উঠে বলেন- সে কী কথা! আমি মুখ্যু মানুষ। লেখাপড়া জানি নে। আমি কব ইংরেজি? কেষ্টদা কয় কী?...
নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোন বিষয়ে ক্রম অনুসারে লব্ধ বিশেষ জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞানকে বলে বিজ্ঞান। এই জ্ঞানের যিনি বেত্তা, তিনি হলেন বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীর দৃষ্টি তাই সর্বদাই থাকে তত্ত্বের প্রতি, কারণের প্রতি। সি. ভি. রমনের প্রিয় শিষ্য, অসাধারণ মেধাবী বিজ্ঞানী কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য তাই তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে তত্ত্ব অন্বেষণে প্রবৃত্ত হয়ে সর্বসত্তার যিনি মূল কারণস্বরূপ, তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁর অশেষ জিজ্ঞাসা, বিজ্ঞানমনস্ক সন্ধানী যাবতীয় কৌতূহল পরম সমাধানের সমাপ্তি খুঁজে পেয়েছিল শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের লোকোত্তর প্রজ্ঞার মধ্যে।
বস্তুত, কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্যকে এক অর্থে শ্রীশ্রীঠাকুরের রত্নভাণ্ডারের উজ্জ্বলতম মাণিক্য বললে অতিশয়োক্তি হয় না। বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটির জ্ঞান-গরিমা, আভিজাত্য, সুতীক্ষ্ণ মেধা ও ধীশক্তি, অপূর্ব সাংগঠনিক ক্ষমতা, বাক্নৈপুণ্য, সর্বোপরি ঠাকুরের বক্তব্য ও জীবনদর্শনের সহজ অনুধাবন-শক্তি তাঁকে এক পৃথক উচ্চতায় আসীন করেছিল। শিশুর সারল্য, স্নেহ কোমল অন্তর ছিল তাঁর মধ্যে; অপরদিকে ইষ্টার্থ পূরণে ছিলেন অনন্য, কঠোর। ঠাকুরের কোন আদেশ পালনের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ত্রুটিবিচ্যুতি অথবা সাধনভজনের ক্ষেত্রে কোনরকম অবহেলার সঙ্গে তিনি কখনও আপোষ করেননি। কারও কোন বিচ্যুতি দেখলে আলাপ আলোচনায় তার উদ্ভাবনী শক্তি বাড়িয়ে ধরিয়ে দিতেন বিচ্যুতির কারণ ও সাধনক্ষেত্রের অবহেলাকে। সহজ অথচ অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী কৃষ্ণপ্রসন্ন, ঠাকুরের প্রিয় ‘কেষ্টদা’-র বিচরণ ছিল সর্বত্র অবাধ। বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে আরম্ভ করে যতি আশ্রম, বক্তৃতামঞ্চ ইত্যাদি সর্বস্থানেই দৃঢ়চেতা মানুষটি ছিলেন সকলের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রাণ, ঠাকুর বিষয়ক প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু।
কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্যের জন্ম হয় ২৮শে পৌষ ১৩০১ ঢাকা জেলার অন্তর্গত দিগবাজার গ্রামে। পিতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন। শৈশবে মাতৃহীন কৃষ্ণপ্রসন্ন, হয়তো মাতৃস্নেহে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই, ছিলেন কিছুটা অশান্ত, খামখেয়ালী প্রকৃতির। ঈশ্বর, পরলোক, দেবতা- অপদেবতা কোন কিছুতেই আস্থা ছিল না নাস্তিক্যবাদী বিপ্রসন্তানটির। বলতে গেলে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান বিপ্র পরিবারে এক মূর্তিমান বিদ্রোহ। এসব কিছু সত্ত্বেও পিতা কালীপ্রসন্ন বলতেন, দেখিস, এই কেষ্টই একদিন এমন আস্তিক হয়ে উঠবে, এমন ভগবদবিশ্বাসী হয়ে উঠবে যে তার তুলনা মিলবে না। উত্তর জীবনে পিতার এই ভবিষ্যদ্-বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যরূপে প্রতিভাত হয়েছিল।
ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ভিতরকার স্বাভাবিক নেতৃত্ব প্রকাশিত হয়; লাইব্রেরি, ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা, থিয়েটার করা প্রভৃতি নানা গঠনমূলক কাজে নিজে ও মেতে উঠতেন, বন্ধুবান্ধবদেরও মাতিয়ে রাখতেন। পড়াশুনোর জন্য বাইরে থাকতে হত, ছুটি পড়লেই চলে আসতেন গ্রামে আর তিনি এলেই যেন উৎসব লেগে যেত। আরম্ভ হত চড়ুইভাতি, থিয়েটারের রিহার্সাল, খেলাধুলোর প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ প্রভৃতি নানা অনুষ্ঠান। আড্ডা, হৈ-চৈ, সব মিলিয়ে আনন্দের এক বিরাট বাতাবরণ। এম. এ. পরীক্ষার আড়াই মাস আগে একটি বিবাহ উপলক্ষে বরযাত্রীরূপে গিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করে বাড়ি ফিরে দেখেন পিতার রুদ্রমূর্তি।
গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার অল্প আগে পড়াশুনো না করে আমোদ-প্রমোদে যোগ দেওয়ায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পিতা যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করেন পুত্রকে। কৃষ্ণপ্রসন্ন সেই মুহূর্তে সংকল্প করেন, পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করতে হবে। তাঁকে আশৈশব মাতৃস্নেহে পালন করেন তাঁর দিদি, যাঁকে তিনি ‘দিদিমণি’ সম্বোধনে ডাকতেন। তাঁর ঐ সংকল্পটি একটি কাগজে লিখে দিদির হাতে দিয়ে বলেন-দিদিমণি, এটা রাখ,
এখন দেখবি না, আমি যখন বলব, তখন দেখবি। তারপর হিসেব করে দেখলেন, দিনে বাইশ ঘন্টা করে পড়লে প্রথম হওয়ার উপযোগী পড়া হয়। চলল সেইমত পাঠাভ্যাস। ‘দিদিমণি’-ই স্নান করিয়ে, খাইয়ে, যা প্রয়োজন যথাসাধ্য করিয়ে দিতেন তাঁর নয়নমণি ভাইটিকে। আর কৃষ্ণপ্রসন্নের কাজ ছিল নিরবচ্ছিন্ন পাঠ। সংকল্প অনুযায়ী এম. এ. পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেন, লাভ করলেন স্বর্ণপদক।
পরে দিদির কাছে রাখা কাগজ খুলে সকলকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের ইচ্ছাশক্তির প্রাবল্য।
অল্প বয়স থেকে অপরের মনের মধ্যে প্রবেশ করা এবং অন্যের মনের ভাব জানার একটা স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা ছিল তাঁর। এই ক্ষমতার অনুশীলন করতে করতে এমন অবস্থা হল যে কাউকে দেখলেই তার মনের কথা তক্ষুনি বলে দিতে পারতেন। এই অভ্যাস শেষে একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। ফলে বন্ধুবান্ধবেরা কেউ আর তাঁর কাছে ঘেঁষতে চাইত না, এড়িয়ে চলত। পরবর্তীকালে আশ্রমে এসে ঠাকুরের কাছে এই বিদ্যার কথা বলায় তিনি কৃষ্ণপ্রসন্নকে এটি করতে নিষেধ করেন। তখন থেকে এই অভ্যাস ত্যাগ করেন তিনি। অনেক বছর পর সাধনভজনের পথে অগ্রসর হয়ে যখন ঠাকুরের ভাবধারায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে অভিষিক্ত করে তুলেছেন, তখন ঠাকুর বলেছিলেন-এখন অবশ্য আরম্ভ করতে পারেন। কিন্তু ঐ স্পৃহা তখন তাঁর ভিতর থেকে পুরোপুরি দূর হয়ে গেছে।
তাঁর কৈশোরের স্বপ্ন ছিল দেশসেবা করার। কিন্তু দেশের কাজ করতে হলে শক্তি দরকার। এই শক্তি পাবেন কোথা থেকে-ভাবতেন সে কথা। কোন এক ধর্মগ্রন্থে পড়েছিলেন যে এমন শক্তি লাভ করা সম্ভব, যার মাধ্যমে কিছুই অপ্রাপ্য থাকে না। সেই শক্তি লাভের আশায় অনেক সাধুসন্ন্যাসীর কাছে গেছেন, কিন্তু পান নি কিছুই। স্থির করলেন, শ্রীঅরবিন্দের কাছে যাবেন যোগসাধনার উদ্দেশ্যে। ঠিক এমনি সময়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কিছু কথা পাঠ করে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর সান্নিধ্যে এলেন। কৃষ্ণপ্রসন্ন তাঁর এতদিনের স্বপ্নকে রূপায়িত করার পথ খুঁজে পেলেন।
মজিলপুরের অধিবাসী ধীরেন চক্রবর্তী এবং কৃষ্ণপ্রসন্ন কলকাতার অখিল মিস্ত্রি লেনে একই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। কৃষ্ণপ্রসন্নর চৌম্বক ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট ধীরেন চক্রবর্তী ছিলেন কৃষ্ণপ্রসন্নর বিশেষ অনুরাগী এবং প্রীতিভাজন। মজিলপুরে শ্রীশ্রীঠাকুরের পদার্পণে যে বিপুল ভাবতরঙ্গের আলোড়ন উপস্থিত হয়, তাতে অংশ নিয়ে ধীরেন চক্রবর্তী সৎনামে দীক্ষিত হন এবং কলকাতায় এসে সোচ্ছ্বাসে কৃষ্ণপ্রসন্নর কাছে ঠাকুরের কথা বর্ণনা করেন। কৃষ্ণপ্রসন্ন স্বভাবসুলভ পরিহাসের সুরে বলেন- তোর চেহারা দেখেই তো তোর ঠাকুরের চেহারা বুঝতে পারছি! ধীরেন চক্রবর্তী ছিলেন শ্যামবর্ণ, সাধারণ আকৃতির মানুষ। তিনি কিন্তু হাল ছাড়লেন না-ঠাকুরের বাণী সম্বলিত একখানি প্রকাশনা দিলেন কৃষ্ণপ্রসন্নকে। পরদিনই সেটি ফেরৎ পেলেন দেখলেন, বাণীগুলির তলায় বহু জায়গায় দাগ দেওয়া আছে, অর্থাৎ, গভীরভাবে পঠিত হয়েছে সেগুলি। এরপরই ধীরেন চক্রবর্তীর সঙ্গে পাবনা আশ্রমে ঠাকুর-দর্শনে গেলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন, এবং বলা যায়- “প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী”।
বিজ্ঞানের উজ্জ্বল ছাত্র কৃষ্ণপ্রসন্ন আধুনিক বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনা করে মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হন। তখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত বহু বৈজ্ঞানিক তথ্য ঠাকুর এমন সাবলীলভাবে আলোচনার মাধ্যমে উপস্থিত করেন, যা তরুণ বিজ্ঞানীর কাছে অভূতপূর্ব এবং অকল্পনীয় বলে বোধ হয়। বিজ্ঞানের যে বিষয়ে তিনি তখন গবেষণারত, তার সবটাই যেন শ্রীশ্রীঠাকুরের দৃষ্টির অন্তর্গত; অতএব এই মহাবিজ্ঞানীর কাছে তিনি যে সম্পদ পাবেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই যে তা দিতে পারবে না, তা তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন।
পুরী যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ঠাকুর তখন কলকাতার হরিতকী বাগান লেনে কিছুদিন ছিলেন; এখানেই কৃষ্ণপ্রসন্নর দীক্ষা হয়। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সংসর্গ লাভ করেন। প্রথম থেকেই ঠাকুর তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, যথা- ইলেকট্রন-বাদ, আলোকতত্ত্ব, মৃত ব্যক্তিকে পুনর্জীবন দান, বায়ুমণ্ডলীয় তড়িৎপ্রবাহের আধান ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতেন, যা তাঁকে গভীরভাবে বিস্মিত ও আলোড়িত করত। এই সময় হুগলি কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অধ্যাপক রমনের কাছে ‘Electric Properties of Flames.’ সম্বন্ধে গবেষণায় নিযুক্ত হন।
শ্রীশ্রীঠাকুর পুরী থেকে আশ্রমে ফেরার পর কৃষ্ণপ্রসন্ন আবার এলেন হিমাইতপুর। এই সময়ে বায়ুমণ্ডলীয় তড়িৎপ্রবাহের আধান বা Atmospheric electricity- কে ধরে তাকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা নিয়ে ঠাকুরের কাছে অনেক কথা শুনলেন। তিনি বিষয়টি প্রথমে ভালভাবে অনুধাবন করতে না পারায় ঠাকুর ছবি এঁকে গাণিতিক পদ্ধতিতে বিস্তারিতভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। আশ্রমে Atmospheric electricity সংক্রান্ত গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যয়সাধ্য ও কষ্টকর বলে কলকাতায় ফিরে এসে কৃষ্ণপ্রসন্ন অধ্যাপক রমনের সঙ্গে দেখা করে তাঁর অধীনে ঐ বিষয়ে পরীক্ষা করার অনুমতি প্রার্থনা করেন; কিন্তু রমন তাতে সম্মত হলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিপ্রেত গবেষণার সুযোগ না থাকায় তিনি ১৩৩০ বঙ্গাব্দে স্থায়ীভাবে আশ্রমে চলে আসেন এবং গবেষণার বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে BI-WEEKLY BENGALEE পত্রিকায় দেখেন, হাঙ্গেরীয় এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বায়ুমণ্ডল থেকে তড়িৎপ্রবাহ ধরার এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এই বিষয়ে ঠাকুরের ধারণার অভ্রান্ততা প্রমাণিত হল।
ধীরে ধীরে হিমাইতপুর আশ্রমে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ‘বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র’ নামে একটি গবেষণাগার তৈরি হল। আনানো হল বহু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, শারীরবিদ্যা ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার গবেষণার ব্যাপারে তাত্ত্বিক পরামর্শ ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বিষয়ে উপদেশ দিতেন স্বয়ং ঠাকুর, এবং প্রধান গবেষক ছিলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য; তার সহায়ক ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য ও শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়। অত দিন আগে নিতান্ত সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে তাঁরা বস্তুত এক বিজ্ঞান-বিপ্লবের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে যার প্রকৃত মূল্যায়ন, দুর্ভাগ্যক্রমে, হয়তো প্রচার বিমুখতার কারণেই হয়ে ওঠে নি।
বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্রের কর্মপ্রবাহ ছাড়াও আশ্রমের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই আত্মনিয়োগ করেন কৃষ্ণপ্রসন্ন। আশ্রমের ব্যাপ্তি ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত ধর্মজিজ্ঞাসু ও কৌতূহলীদের সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকে বিদেশীরাও। বিদেশীদের ঠাকুরের বাণী ও ভাবধারা পরিবেশনের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবধান অসুবিধা সৃষ্টি করত। অনুবাদের সাহায্যে এই অসুবিধা দূর করার চেষ্টা করা হলেও প্রত্যক্ষভাবে ঠাকুরের ভাবধারা প্রচারে তাতে কিছুটা বাধা হত। এ কারণে কৃষ্ণপ্রসন্ন ঠাকুরের শ্রীচরণে ইংরেজিতে বাণী দেওয়ার অনুরোধ করেন। ঠাকুর সে- কথা শুনে চমকে উঠে বলেন- সে কী কথা! আমি মুখ্যু মানুষ। লেখাপড়া জানি নে। আমি কব ইংরেজি? কেষ্টদা কয় কী? কিন্তু কেষ্টদা ঠাকুরকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তিনি জানতেন ঠাকুরকে ঠিকমত উদ্দীপ্ত করতে পারলে যে কোন ভাষাতেই তিনি কথা বলতে পারেন। তাই নাছোড়বান্দা হয়ে সময় সুযোগ বুঝে ক্রমাগত ঠাকুরকে বলতে থাকেন-আপনি বললেই হয়ে যাবে, ও কিছু না। তাঁর কথাগুলি মৌলিক ইংরেজি ভাষাতে পাওয়া যে আজ জগতের কাছে কতখানি প্রয়োজন তা বারবার তুলে ধরতে থাকেন বিভিন্নভাবে। ক্রমে ক্রমে ভাবসমুদ্র উদ্বেলিত হতে থাকে। কিন্তু এজন্য বাহ্যিক কোন প্রস্তুতি নিতে হয় নি ঠাকুরকে, নিত্যকার আলাপ-আলোচনা, আহার-নিদ্রা বা কাজকর্মের খোঁজখবর নেওয়া সবই করতেন স্বাভাবিকভাবে নিত্যকার নিয়মে। উপরে সব শান্ত, সব স্বাভাবিক, অথচ ভিতরে প্রস্তুত হচ্ছে এক স্বতঃউৎসারিত প্রস্রবণের ধারা। হঠাৎ একদিন শৌচালয়ে গিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর চিৎকার করে ডাকলেন, কেষ্টদা, এসে গেছে! কৃষ্ণপ্রসন্ন ছুটে এলেন। ইংরেজি ভাষা অবলম্বনে ফুটে উঠল তাঁর প্রথম বাণী:
“The booming commotion
of Existence
that rolls
in the bosom of the Beyond...”
সৃষ্টির আদিমতম অবস্থার বিবরণ। নির্ঝরের উৎস উৎসারিত হওয়ার পর বহে গেছে বাণীর স্রোতস্বিনী-জীবনের সমস্ত দিক সম্বন্ধে ইংরেজি ভাষায় বলে গেছেন বহু কথা। ক্রমে ক্রমে ইংরেজি বাণীর সংখ্যা দাঁড়াল দু’হাজার চারশো সাতষট্টিতে, পরে যা ‘The Message’ নামক গ্রন্থে নয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এই অমূল্য সম্পদ আহরণে কৃষ্ণপ্রসন্নের ভূমিকা চিরকাল মানুষ কৃষ্ণতার সঙ্গে স্মরণ করবে। এই প্রসঙ্গে ঠাকুর বলেছেন, আমি জানি না আমাকে দিয়ে কী করে ইংরেজিতে এত কথা বলালেন কেষ্টদা, এত ছড়া বলালেন, ওসব কেষ্টদার কেরদানী। আবার কখনও বলেছেন, কেষ্টদাই উসকিয়ে দিয়ে অমনতর আদায় করে নিয়েছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর দেওয়া বাণী প্রসঙ্গে বলেছেন, ওগুলি আমার কাছে যেমনভাবে এসেছে আমি তাই বলেছি। এছাড়া আর আমার কোন উপায় ছিল না। আমি বুদ্ধি করে কিছু বলিনি। আমি যদি লেখাপড়া জানতাম তবে আমার আর এ Originality থাকত না। এখন এ কথাগুলি ল্যাংটা হয়েছে। আমার কোন অধিকার এর ওপর নেই।
প্রতি বছর নববর্ষ ও শারদীয়া বিজয়া উৎসব উপলক্ষে বাণী প্রদান করেছেন ঠাকুর। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উৎসবে আশীর্বাণী দিয়েছেন। এই আশীর্বাণীগুলি সাহিত্যরসে পূর্ণ এক অনবদ্য সৃষ্টি; পরবর্তীকালে এগুলি গ্রথিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এগুলি সহজে আসত না। আদায়ের কৌশলটি বিশেষভাবে রপ্ত করে নিয়েছিলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন। যেমন- নববর্ষের আশীর্বাণীর সময়ে বৈশাখ, বিশাখা, নিদাঘ ইত্যাদি শব্দের অর্থ নিয়ে আলোচনা হত। আলোচনা চলত গ্রীষ্মের বিশেষ অবস্থা নিয়ে। কখনও বা ঋতুসংহার কাব্য থেকে গ্রীষ্ম বর্ণনা পড়ে শোনানো হত। কৃষ্ণপ্রসন্ন এগুলি ক্রমাগত করে চলতেন। একসময়ে ঝরনাধারার মত নেমে আসত মন্ত্রতুল্য শব্দরাশি শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখ থেকে। কৃষ্ণপ্রসন্নের এই উদ্দীপক গুণটির প্রশংসা করতে গিয়ে ঠাকুর বলতেন, ‘কেষ্টদা পানাতে জানে’। দুধ দুইবার আগে বাছুরকে দিয়ে গরুর বাঁটে মুখ দিয়ে চুষে চুষে চুঁ মেরে দুধ আনানো হয়, এটাকে চলতি কথায় পানানো বলে। ঠিক তেমনি কৃষ্ণপ্রসন্ন ঠাকুরকে ক্রমাগত উদ্দীপিত করে ঠিক জিনিসটি বের করে নিতে পারতেন।
কৃষ্ণপ্রসন্ন বিভিন্ন সময়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে প্রশ্নের মাধ্যমে যে-সব সমাধানী উত্তর পেয়েছিলেন, তা ‘নানাপ্রসঙ্গে’ নামে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ঠাকুর প্রদত্ত উত্তরগুলির সমর্থনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মনীষীবৃন্দের সমজাতীয় উক্তিসমূহের পাদটীকা সংযোজন করেন তিনি। প্রথম খণ্ড ন’টি অধ্যায়ে বিভক্ত। কর্ম ও ধর্মের সমন্বয়, নামধ্যানের ক্রিয়া, জন্মমৃত্যু সম্পর্কিত রহস্য, সমাজ-সংস্কার, বিবাহে নারী, স্ত্রীশিক্ষা, অনুলোম অসবর্ণ বিবাহ, মহাপুরুষ, ধর্ম, প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বিষয় এই খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ খৃষ্টাব্দে।
‘নানাপ্রসঙ্গে’-র দ্বিতীয় খণ্ডের প্রকাশ ১৯৩৯-এ। এই খণ্ডেরও অধ্যায় ন’টি। স্বাধীনতা ও রাজনীতি, পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন, সমাজ ও বিবাহ সংস্কার, শিক্ষা সংস্কার, জাতির স্বাস্থ্য সংস্কার, কৃষক ও অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয় প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে এই খণ্ডে আলোচিত হয়েছে।
উপরোক্ত গ্রন্থের তৃতীয় এবং চতুর্থ খণ্ডও ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দেই প্রকাশিত হয়। যথাক্রমে ছ’টি ও পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত ঐ দুই খণ্ড। আত্মা, জীবাত্মা, পরমাত্মা, যাগযজ্ঞ, ধ্যান, বিদ্যা, অবিদ্যা, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ, চতুরাশ্রম, আর্য্য ও আর্য্যকৃষ্টি, দারিদ্র্যব্যাধি এবং সাধনভজন সংক্রান্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্তরসমূহ বিষয়ক আলোচনা রয়েছে তৃতীয় খণ্ডে। চতুর্থ খণ্ডে সুসন্তানের আবির্ভাবের কারণসমূহ, সৎ চালক ও ইষ্ট বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের মীমাংসা সুগ্রথিত।
প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সংকলিত অপর এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘ইসলাম প্রসঙ্গে’। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে প্রথম প্রকাশিত এই গ্রন্থে প্রশ্নকর্তা কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য এবং মোহাম্মদ খলিলর রহমান, উত্তরদাতা শ্রীশ্রীঠাকুর। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় প্রকাশ যে তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বইটি পাঠে অকপটে বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িকাতার এমন সুষ্ঠু সমাধান আর কিছু হতে পারে না এবং মাত্র এই ভিত্তিতেই পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও ভ্রান্ত ধারণার নিরসন হয়ে জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র জনমণ্ডলী ভাগবত ঐক্যের অমৃত সূত্রে গ্রথিত হয়ে উঠতে পারে’। বর্তমানকালে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক অধ্যাপক হোসেনুর রহমান এবং জাস্টিস এ. এস. মাসুদ ‘ইসলাম -প্রসঙ্গে’-র ভূয়সী প্রশংসা করেন। ইসলাম ধর্মের সার্বজনীন স্বরূপ এবং অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে এই ধর্মের মৌলিক সাদৃশ্য উদ্ভাসিত হয়েছে এই গ্রন্থে। কৃষ্ণপ্রসন্ন সংকলিত বা প্রণীত অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে অনুসৃতি, চলার রীতি, যজনিকা, যাজক নীতি, যাজন সংকেত, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ও সৎসঙ্গ আন্দোলন (ইংরেজি সংস্করণসহ), সৎসঙ্গের স্বস্তি অভিযান এবং মনের পথে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কৃষ্ণপ্রসন্নের দেহাবসানের পর শ্রীশ্রীঠাকুর প্রায়ই বলতেন, ‘দেখিস, কেষ্টদার একটা জিনিসও যেন এদিক ওদিক না হয়, সব যত্ন করে রেখে দিস। কেষ্টদার লেখাগুলি সব গুছিয়ে ঠিক করে রেখে দিবি। টুকরো-টুকরো কাগজগুলোও যেন কোনটা নষ্ট না হয়-ভাল করে লক্ষ রাখবি।’ ঠাকুরের এই উক্তিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে কৃষ্ণপ্রসন্নের দেহাবসানের বহু বছর পর তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী প্রীতিপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য ১৩৯৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশ করেন ‘দিনপঞ্জী’ শীর্ষক গ্রন্থ। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত এই দিনপঞ্জীর পরিসর কাল। ধারাবাহিকতার কিছু অভাব এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু অস্পষ্টতা সত্ত্বেও এই মহামূল্য গ্রন্থটি শ্রীশ্রীঠাকুর এবং কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য সম্বন্ধে অন্যতর আলোকপাতে সমর্থ হয়েছে। এছাড়াও তাঁর আরও কিছু অপ্রকাশিত রচনা আছে, যার মূল্যায়নে ভবিষ্যৎ গবেষকরা এগিয়ে আসবেন।
কৃষ্ণপ্রসন্নের কমনীয় কান্তি, উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, আড়ম্বরহীন সহজ সপ্রতিভ আত্মপ্রকাশ-সবই ছিল দৃষ্টি আকর্ষক। ঠাকুরের কাছে সরল শিশুর মত কৌতূহলী এবং আগ্রহভরা দৃষ্টিতে একপাশে বসে থাকতেন। জিজ্ঞাসু বিদ্যার্থীর মত সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে থাকতেন গুরুর দিকে। সমস্ত দেহমনের অভিব্যক্তিতে আত্মনিবেদনের স্নিগ্ধ শান্ত রূপ। আবার ভিন্ন পরিবেশে প্রয়োজনে ব্যক্তিত্বে সুকঠিন, জ্ঞানে সমৃদ্ধ, সংকল্পে অটল, সাধনায় অনড়, আভিজাত্যে সমুন্নত, নেতৃত্বে অগ্রগামী। তিনি স্বেচ্ছায় ধরা না দিলে নাগাল পাওয়া কঠিন। তিনি বহুর মধ্যে থেকেও বহুর ঊর্ধ্বে, জনতার মধ্যে জননেতা, তপস্যায়, মনীষায়, পুরুষকারে পুরুষসিংহ।
বর্তমানে সৎসঙ্গে বক্তার অভাব নেই। কিন্তু এমন দিন গিয়েছে যখন বক্তা বলতে কেবল তিনি। আসর মাতিয়ে রাখতেন একাই। যে-কোন বিষয় সম্বন্ধে বক্তৃতার সময় গভীর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ওজস্বিনী ভাষায় যথেষ্ট পরিমিতি সহকারে ঠাকুরের অবদানের একটি সুস্পষ্ট ছবি সবার সামনে তুলে ধরার অতুলনীয় ক্ষমতা তাঁর ছিল। পরিবেশ অনুধাবন করে কী বলতে হবে, কতটুকু বলতে হবে এবং কেমন করে উপস্থাপন করলে ফলদায়ী হবে, মুহূর্তের মধ্যে বুঝে নিতেন তিনি।
একবার শ্রীরামপুর টাউনহলে সভা। আলোচ্য বিষয়-শিক্ষা। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে ছাত্রের সংখ্যাই বেশি; অধ্যাপকও আছেন কয়েকজন, এছাড়া শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও সমবেশ ঘটেছে। সভা আরম্ভ হয়েছে। কয়েকজনের বক্তৃতা হয়ে যাওয়ার পর সর্বশেষ বক্তা কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য। সভাপতি আহ্বান জানালেন সৎসঙ্গের ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্যকে।
কৃষ্ণপ্রসন্ন এসেছেন খালি গায়ে। কাঁধে শুধুমাত্র উত্তরীয়। পরনে কোমরে বাঁধা ধুতি, হাতে মোটা লাঠি, মাথার চুলগুলি ছোট করে ছাঁটা, তার মধ্যে বিরাট এক শিখা। আধুনিকতার চিহ্ন নেই, উপরন্তু ‘ঋত্বিগাচার্য্য’ উপাধিটি রীতিমত সংস্কৃত ঘেঁষা। শ্রোতমণ্ডলী তাঁকে একজন তথাকথিত টোলের পণ্ডিত বা ঐ জাতীয় কিছু একটা আঁচ করে নিয়েছে। ছাত্রমহলের মুখে বিদ্রূপাত্মক চাপা হাসির অবজ্ঞামিশ্রিত গুঞ্জন ধ্বনি উঠল। অবস্থাটা মুহূর্তে বুঝে নিলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন। এরা সব নব্যশিক্ষিতের দল। অশিষ্ট দাম্ভিকের দম্ভকে গোড়াতেই যদি চূর্ণ করা না যায়, তবে শোনবার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে না।
তিনি বক্তৃতা আরম্ভ করলেন, —‘পদার্থবিদ্যায় সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রিটি নিয়ে যখন প্রথম স্থান অধিকার করে বেরিয়ে এলাম, তখন ইউনিভার্সিটি পরিয়ে দিল সোনার মেডেল, সেটা সবাই দেখল...। অর্থাৎ শুরুতেই নিজের পরিচয়টি বুঝিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে শ্রোতাদের চাপা গুঞ্জন থেমে গিয়ে চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে বিস্ময়ের চিহ্ন। মুহূর্তের মধ্যে সভাকক্ষ নিস্তব্ধ।
তিনি বলে চললেন-কিন্তু তার সঙ্গে অদৃশ্য আর একটি মালা পরিয়ে দিল যা রইল সবার দৃষ্টির অগোচরে, সেটা হচ্ছে অহমিকার মালা। এলাম ঠাকুরের কাছে, তিনি বললেন-বা রে শিক্ষা! যত বেশি ডিগ্রিধারী তত বেশি আনএডুকেটেড। বিদ্যা বিনয় দান করে, এ হচ্ছে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার আদর্শ, আর বিদ্যা অহংকারের পুষ্টি দেয়, তা হচ্ছে আমাদের নব্য-ইউরোপীয় শিক্ষার ধারা...।
তারপর চলল অগ্নিগর্ভ ভাষণ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শিক্ষার আদর্শ নিয়ে তুলনামূলক বিচার, জীবনের প্রয়োজনে তার মূল্য নিরূপণ এবং সর্বশেষে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শিক্ষাধারার মধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশিষ্ট অবদান বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়ে শ্রোতৃমণ্ডলীকে চমৎকৃত করে দিলেন।
আর একবার জামশেদপুরে মিলনী হলে সভার আয়োজন হয়েছে। সভাপতিত্ব করবেন টাটা কোম্পানীর ওয়ার্কস্ ম্যানেজার। ওয়ার্কস ম্যানেজারের কৃপাদৃষ্টিতেই অফিসারদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। সেই ম্যানেজার যেখানে সভাপতি, বলা বাহুল্য সেই সভায় অফিসারদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদের হাবেভাবে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে সৎসঙ্গের আদর্শ জানবার চেয়ে ওয়াকস্ ম্যানেজারের দৃষ্টি আকর্ষণের আগ্রহ তাদের সমধিক।
সভা আরম্ভ হল। কয়েক জনের পর কৃষ্ণপ্রসন্ন বক্তৃতা দিতে উঠে বলতে আরম্ভ করলেন-জামশেদপুরে এসে দেখলাম এখানে এক মহাজাতির সম্মেলন হয়েছে। ভারতের প্রত্যেক প্রদেশ থেকে প্রতিনিধি এসে জড়ো হয়েছেন। বহির্ভারতের সুদক্ষ কর্মীগণেরও সমাবেশ ঘটেছে। বিরাট শহরের বুকে বহু বিচিত্র জাতির মেলা। এখানে যেমন একটা শহরকে কেন্দ্র করে এমন বিচিত্র সমাবেশ ঘটেছে, ঠিক এত বড় না হলেও এমনতরই আর একটা সমাবেশ দেখার সৌভাগ্য আমার জীবনে ঘটেছে। কোন শহর নয়, শিল্পনগরী নয়, বাংলার এক অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম হিমাইতপুর। সেখানে একজন মানুষ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র-তাঁকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের এবং বহির্ভারতের বিদ্বৎজনের এমনতরই সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু দুইয়ের মধ্যে একটা তফাৎ আছে, সেইটুকুই আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।
এখানে সবাই এসে মিলিত হয়েছেন উদরের ক্ষুধা মেটাবার জন্য আর সেখানে সবাই এসে মিলিত হয়েছে অন্তরের ক্ষুধা মেটাবার জন্য। জন্তুর আদিম চাহিদা যে ক্ষুধা সেইটুকু মেটাতে পারলে এখানে পরিতৃপ্তি আর সেই উপকরণ সংগ্রহের জন্যই এখানে প্রতিযোগিতার সংগ্রাম। আর সেখানে আদিম ক্ষুধা ছাপিয়ে মানুষের জীবন জিজ্ঞাসার সমাধানের জন্য, বিশ্বরহস্য উদ্ঘাটনের জন্য শত শত মস্তিষ্ক সঞ্চালিত।...
এমনি করে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তিনি তুলে ধরলেন আদর্শবাদের অপরিহার্যতা। ফিলসফি অব হাঙ্গারের পাশে ফিলসফি অব আইডিয়ালিজম্, তথাকথিত সাম্যবাদের বিক্ষোভের পাশে ঋষিবাদের প্রজ্ঞার দীপ্তি।
জুলিয়াস সীজারের ‘ভিনি, ভিডি, ভিসি’, অর্থাৎ এলাম, দেখলাম, জয় করলাম- তাঁর ক্ষেত্রে ছিল আক্ষরিক অর্থে সুপ্রযোজ্য। যেখানেই যেতেন, সেখানেই সবার অন্তর জয় করে আসতেন, তাঁকে বিদায় সম্বর্ধনা দিতে সবার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠত। সকলের সঙ্গে সম্ভ্রমাত্মক দূরত্ব বজায় রেখে তাদের সত্তাকে জয় করে নেওয়ার মত আচরণ ও ব্যবহার ছিল তাঁর সহজাত, ঠাকুরের চৌম্বক ব্যক্তিত্বের যাদুস্পর্শে যা বহুগুণ বর্ধিত হয়ে উঠেছিল।
অভিজাত বংশের সন্তান, যাঁর সুপণ্ডিত পিতা ছিলেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, যাঁর বাড়িতে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডাঃ নীলরতন সরকারের মত মনীষীদের সহজ আনাগোনা, যিনি প্রশান্ত মহলানবীশ ও সি. ভি. রমনের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিকের প্রিয় ছাত্র এবং সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর অতি ঘনিষ্ঠ, আবাল্য কলকাতা মহানগরীতে লালিত প্রখর বুদ্ধি, যুক্তি, মননশীলতার অধিকারী এ-হেন কৃষ্ণপ্রসন্ন বৈষয়িক দিক থেকে বিপুল সম্ভাবনাময় জীবন পিছনে ফেলে রেখে কীসের প্রেরণায় ছুটে গেলেন ক্ষুদ্র এক পল্লীর আয়াসসাধ্য জীবনে, তা বাহ্যত বিস্ময়কর বলে মনে হয়। তখন সৎসঙ্গের না ছিল প্রতিষ্ঠা, না ছিল ঐশ্বর্য বা খ্যাতি বা বস্তুগতভাবে আকর্ষণীয় কোন কিছু। আর্থিক অসচ্ছলতা, শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যবর্জিত জীবনযাপন আর শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করে একদল নরনারীর সহজ বিশ্বাস, ভক্তি, ভালবাসার উৎসার, নামধ্যান, কীর্তনের আনন্দের উচ্ছলতা-এই ছিল তখন হিমাইতপুর আশ্রমের জীবন। কিন্তু তারই মধ্যে কৃষ্ণপ্রসন্ন খুঁজে পেয়েছিলেন অস্থির জীবনজিজ্ঞাসার স্থির প্রত্যয়ী উত্তর পরম সমাধানকারী পুরুষোত্তমের চরণপ্রান্তে।
তাঁর স্বজনমণ্ডলী, অগণিত বন্ধুবান্ধব, গুণমুগ্ধ ও ঘনিষ্ঠজনের কাছে এভাবে বৈষয়িক ও পার্থিব সাফল্য ত্যাগ করে তাঁর গুরু সান্নিধ্য প্রাপ্তির ব্যাপারটি স্বভাবতই বিস্ময়কর লেগেছিল। অনেকেই এতে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হন, অনুরোধ-উপরোধ, আদেশ -নির্দেশে চেষ্টা করেন তাঁকে ফিরিয়ে নিতে, কিন্তু কোন কিছুই তাঁকে তাঁর প্রত্যয়ের বিন্দু থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। তাঁর নিষ্প্রশ্ন গুরুনিষ্ঠার এক চরম নিদর্শন রয়ে গেছে তাঁর পিতার মৃত্যুকালীন ঘটনায়। পিতা কালীপ্রসন্ন যখন অত্যন্ত গুরতর অসুস্থ, তখন কৃষ্ণপ্রসন্ন উজীরপুরে পিতার রোগশয্যাপার্শ্বে যান, কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পাবনায় প্রত্যাবর্তন করেন। মুমূর্ষু পিতা বারবার পুত্রের কথা জিজ্ঞাসা করায় বাড়ির সকলে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাঁকে বলেন যে কালীপ্রসন্নর ওষুধ আনতে বরিশাল শহরে গেছেন। ক্রমে কালীপ্রসন্নর চৈতন্য বিলুপ্ত হয় এবং তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। ইতিমধ্যে ঠাকুরের একটি চিঠি উজীরপুরে পৌঁছয় যাতে তিনি কৃষ্ণপ্রসন্নকে অবিলম্বে পাবনায় চলে যেতে বলছেন—
“ . . .দাদা! যদি আপনার পিতার নিকট আপনার অন্যান্য ভাইরা থাকেন আর আপনি সুবিধা করতে পারেন, তবে রামচন্দ্রের মতন-পিতার মৃত্যুকেও উপেক্ষা করে পিতারই জন্য-চলে আসতে চেষ্টা করুন আর তা যত শীঘ্র পারেন- এমন কী এখনই।...”
বিস্ময়ের কথা এই যে, চিঠি পাওয়ার আগেই কৃষ্ণপ্রসন্ন অন্তরে গুরুর আদেশ উপলব্ধি করে পিতার মৃত্যুসময় আসন্ন বুঝেও সেখান থেকে গুরুর কাছে যান মঙ্গলময়ের মঙ্গল অভিপ্রায় পূরণার্থে। বাহ্যত অস্বাভাবিক মনে হলেও, এবং আত্মীয়স্বজন কর্তৃক নিন্দিত হলেও, কৃষ্ণপ্রসন্ন জানতেন-তাঁর গুরুর আদেশের পিছনে আছে গূঢ় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা, যার অন্যথা করতে গেলে অনর্থ বাড়বে বই নয়। ঠাকুরের লেখা চিঠিটি পরে কৃষ্ণপ্রসন্ন-জায়া সুষমা দেবী কৃষ্ণপ্রসন্নকে দিয়েছিলেন। চিঠিটিপরে ‘তাঁর চিঠি’ গ্রন্থে সংকলিত হয়।....
কৃষ্ণপ্রসন্নর কোষ্ঠীতে আনুমানিক ঊনত্রিশ/ত্রিশ বৎসর বয়সে নিশ্চিত মৃত্যুযোগ ছিল। তিনি তখন পাবনা আশ্রমে ঠাকুরের সান্নিধ্যে চলে এসেছেন। ঐ বয়সে মরণব্যাধি টাইফয়েড-যা তখন দুরারোগ্য ছিল-রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর নিজের বাড়ি বরিশালের উজীরপুরে তাঁর পিতা এবং দিদি ঐ সময়ে কোষ্ঠীফলের কথা চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠেছেন দুর্ভাবনায়। এদিকে শ্রীশ্রীঠাকুর ও মাতা মনোমোহিনী দেবী বিনিদ্র শুশ্রূষায় তাঁকে ঘিরে রেখেও ভাবছেন-বুঝি আর শেষ রক্ষা হল না! কোন চিকিৎসাই বস্তুত তখন ছিল না, রোগীর অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে চলল। কিন্তু কীভাবে যেন অকস্মাৎ চরম অবস্থা থেকে একটু একটু করে প্রাণের দিকে ফিরে গেল গতি-ধীরে ধীরে লাভ হল পূর্ণ আরোগ্য। সর্ব গ্রহদোষভঞ্জন বৃহস্পতি অর্থাৎ গুরু কেন্দ্রে থাকাতেই অনিবার্য কোষ্ঠীফলও এভাবে নিবারণ করা সম্ভব হয়।
গম্ভীর, রাশভারি, প্রবল ব্যক্তিত্ববান মানুষটির অন্তরে ছিল রসের ফোয়ারা। একবার এক দুঃসম্পর্কিত ভ্রাতুষ্পুত্র দেওঘরে এসে তাঁর বাড়িতে ছিল কিছুদিন। একদিন সকালে তাঁর ছেলেমেয়েরা তখনও পড়তে বসেনি, একটু হৈ-হল্লা চলছে ভাইবোনে মিলে, অন্য ঘরে সেই ভাইপোটি বই নিয়ে বসে পড়েছে। তিনি ছেলেমেয়েদের বললেন-তোরা পড়তে বসিসনি এখনও, দ্যাখ্ তো, ও কেমন পড়ছে। এ কথা শুনে অত্যন্ত অনুপ্রাণিত হয়ে ভাইপো-রত্নটি একখানি গীতা কৃষ্ণপ্রসন্নর সামনে নিয়ে গিয়ে বলে-জ্যাঠামশাই, ‘আত্মা’ মানে কি? কৃষ্ণপ্রসন্ন আয়ত চক্ষু আরেকটু বিস্ফারিত করে ছেলেদের ডেকে বলেন-ওরে, কে আছিস, বাগানের মধ্যে উঁচু করে একটা দড়ি বেঁধে তার ওপর দিয়ে এটাকে হাইজাম্প দেওয়া-সাতসকালে এসেছে ‘আত্মা’-র মানে বুঝতে!
তাঁর পুত্র প্রীতিপ্রসন্নর জবানিতে একটি ছোট্ট উদ্ধৃতির মধ্যে তাঁর সরস মনের পরিচয় মেলে-“বাবার মেজাজ আমরা ধরতে পারতাম না। একদিন সকালে বকুনি দিলেন পড়াশুনো করি না বলে। পরদিন সকালে খুব বৃষ্টি পড়ছে, আমরা তাড়াতাড়ি বইপত্র নিয়ে বসে পড়েছি বাবাকে সন্তুষ্ট করতে। বাবা বললেন-আচ্ছা বেরসিক তো তোরা, এমন চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে আরা তোরা বর্বরের মত বই নিয়ে বসে আছিস? কোথায় তবলা, নিয়ে আয়, মান্তনকে (ডাঃ দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য, কৃষ্ণপ্রসন্নের অপর পুত্র প্রখ্যাত চিকিৎসক ও সুগায়ক) ডাক, গান বাজনা হোক এখন।”
শ্রীশ্রীঠাকুর বহুবার তাঁর জীবনী লেখার কথা বলতেন কৃষ্ণপ্রসন্নকে, কিন্তু ঠাকুরের জীবনী তিনি লেখেননি। না লেখার সপক্ষে তাঁর ছিল এক অপূর্ব যুক্তি, যা একমাত্র তাঁকেই মানায়। বলতেন-মহাপুরুষের জীবনী লেখা সম্ভব নয়, ঠাকুরের জীবনী লেখা যায় না। লেখা চলে কেবল কিছু ঘটনা, কিছু কথা। কিন্তু তাঁর চোখের দৃষ্টি, তাঁর বাচনবৈশিষ্ট্য, তাঁর কন্ঠস্বরের জাদু, অপরূপ দেহভঙ্গিমা কে বর্ণনা করতে পারবে? তাছাড়া প্রতিবার যখনই তাঁর সামনে যাই, মনে হয়, সম্পূর্ণ অন্যরকম, নূতন অনন্য একজন মানুষ। এঁর জীবনী লিখব কি করে? কিছু লেখা মানেই তো আরও বিপুলতর কিছু বাদ পড়ে যাওয়া!
অগাধ জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল কৃষ্ণপ্রসন্নর প্রকৃতিরই একটি অংশ। যে-কোন বিষয়ে অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে পড়াশুনো করতেন, এবং যখনই পড়তেন, আদর্শ ছাত্রের মত পড়তেন। দেওঘরে আসারও বেশ কিছু পরে ঠাকুরের নির্দেশে পাণিনি ব্যাকরণ অধ্যয়ন করতে মনস্থ করেন। একজন পাণিনি পণ্ডিতের খোঁজ পাওয়া গেল দেওঘরের কাছাকাছি কোন গ্রামে। তাঁকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে-ধূলিধূসরিত গ্রামবাসী সেই পণ্ডিত মহাশয়কে অতি যত্নে বসিয়ে একেবারে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বাধ্য ছাত্রের মত পাঠ শুরু করেন প্রৌঢ় কৃষ্ণপ্রসন্ন। আর একবার তাঁর প্রাক্তন সহপাঠী একজন গণিতের অধ্যাপক এসেছিলেন তাঁর বাড়িতে। অত্যন্ত ব্যাগ্র হয়ে তাঁকে বললেন-তুমি এসেছো, ভালই হল, ক’দিন বেশ অঙ্কের চর্চা করা যাবে, সব ভুলে গিয়েছি। ঐ অধ্যাপক যতদিন তাঁর বাড়িতে ছিলেন ততদিন রীতিমত নিয়ম করে তাঁর সঙ্গে দুরূহ গাণিতিক তত্ত্বের চর্চা চলত। জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত যেকোন আলাপ-আলোচনা ছিল তাঁর কাছে একান্ত বিনোদন।
কৃষ্ণপ্রসন্নর পুত্রগণ প্রত্যেকেই কৃতবিদ্য, সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর ব্যাপারে কখনও প্রথামাফিক শাসন-পীড়ন করেননি। পরীক্ষায় ভাল ফলের উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না, চেষ্টা করতেন তাদের আগ্রহটি গজিয়ে দিতে। নির্ভুল উচ্চারণ, ভাবগ্রাহী পাঠ, এসমস্ত বিষয়ে ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। শ্রীশ্রীঠাকুরের শিক্ষাদর্শ বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছিল তাঁর অতি নিকটস্থ যোগ্য সহচর কৃষ্ণপ্রসন্নর জীবন-চলনার মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীকালে তাঁর ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট অনেক মানুষ কৌতূহলী হয়ে পরিমাপ করতে চেয়েছে তাঁকে তাদের বিদ্যাবুদ্ধির মানদণ্ডে; কিন্তু তিনি ছিলেন সাধারণ মাপকাঠির ঊর্ধ্বে, ধরাছোঁয়ার সীমারেখার বাইরে। কেবলমাত্র ঠাকুরগত প্রাণ নিয়ে এলে পাওয়া যেত তাঁর অন্তরের সন্ধান। ঠাকুরই ছিলেন তাঁর সর্বক্ষণের ধ্যান ও ভাবনা। তিনি বলতেন, ‘ঠাকুর আমাদের জন্য কত পরিশ্রমই না করেছেন। বলতে গেলে একেবারে হাত ধরে সব কাজে অভ্যস্ত করিয়েছেন। কখনও বলে দিতেন, এখন খুব দম দিয়ে জপ ধ্যানে লেগে যান। শেষ রাত্রের দিকে আবার হয়তো হাঁক দিয়ে বলে দিচ্ছেন, উঠে পড়ুন, নাম করতে বসে যান। তখন কেবল অনুভূতির কথা, জপধ্যান, জ্যোতিদর্শন, অনাহত ধ্বনি শ্রবণ, এই সব নিয়ে আলোচনা-কত নেশায় মশগুল হয়ে থাকতাম। আশ্রম তখন গড়ার মুখে। পয়সাকড়ির খুব টানাটানি। দু’বেলা খাওয়াই জোটে না। তার মধ্যে হয়তো কোন কর্মপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছা-তার জন্য টাকার প্রয়োজন। পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়, বলে দিলেন, যান, ভিক্ষে করে সংগ্রহ করে নিয়ে আসুন। অবস্থা তখন এমনতর যে কলকাতা যাবার পাথেয়টা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য। এমন কি ভদ্রগোছের জামাকাপড় পরে যাব, তা সংগ্রহ করাটাও সমস্যা। আবার কখনও হয়তো বললেন, দেশবন্ধুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করুন। প্রস্তাব শুনে ভড়কে যাবার মত কথা। দেশবন্ধুর তখন দেশ-জোড়া নামডাক। তাঁর কাছে যাই কোন ভরসায়? কিন্তু ঠাকুর নাছোড়বান্দা। বুক তো একটু দুরু দুরু করবেই, কিন্তু তা না হলে যাজন করে স্ফূর্তি কই? নিজের বিশ্বাসের পরীক্ষা কই? এমনি করেই শ্রেষ্ঠ যাজী হওয়ার কৌশলটা মনে হয় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হাতে- কলমে শিখিয়ে দিলেন।... ঠাকুরের ইচ্ছা হল, আশ্রমের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। দিবারাত্রি একদলের পর একদল পড়িয়েই গেছি, এতটুকু বিশ্রাম ছিল না। অনেক ছেলে মেয়ে পার হয়ে গেল। ঠাকুর তখন নিজেই দেখিয়ে দিতেন কেমন করে ছাত্রদের মধ্যে Interest সৃষ্টি করতে হয়।...’
ভক্ত ও ভগবানের চিরন্তন লীলা একমাত্র তাঁরই পরিকল্পিত, তাঁর দ্বারাই নির্দিষ্ট। বহু জীবনের শুভ সংস্কার মানুষকে উপযুক্ত করে তোলে তাঁর লীলার সহকারী হিসেবে। আবার তাঁর সাহচর্যে হয় আরও ব্যাপ্তি, আরও প্রসার, যা ক্রমাগত উন্নয়নের পথে পরিচালিত করে। প্রিয়পরমের বুঝটুকু যখন মানুষের মধ্যে আসে তখন সে হয় নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত; একমাত্র তাঁর আশা-পূরণের মধ্যেই খুঁজে পায় জীবনের সার্থকতা। এই সার্থকতাই পেয়েছিলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য।
ধীরে ধীরে আশ্রমের পট পরিবর্তন হল। ঠাকুরের ইচ্ছায় সৎসঙ্গে কর্মমুখর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল, বিপুল গ্রন্থরাজির প্রণয়ন হল, গড়ে উঠল ঋত্বিক সংঘের ব্যাপক আন্দোলন। এ সবকিছুতেই ঠাকুরের সহচর ছিলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন।
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে ঋত্বিক সংঘের প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময় ঠাকুর ছয়জন ঋত্বিক, অর্ধশতাধিক প্রতিঋত্বিক এবং কয়েক শত সহপ্রতিঋত্বিককে দীক্ষাদানের অনুমতি দেন। তাঁদের সর্বাধিনায়করূপে মনোনীত করেন কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্যকে তাঁকে ভূষিত করেন ‘ঋত্বিগাচার্য্য’ উপাধিতে। ১৩৪৬ সালে দীক্ষার পদ্ধতি এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত জ্ঞাতব্য তথ্য সন্নিবেশিত করে ‘ঋত্বিক’ বই ছাপা হয় এবং আষাঢ় মাসের অধিবেশনে দীক্ষাদানের অধিকারপ্রাপ্ত প্রতিটি কর্মীকে দেওয়া হয়। ঋত্বিক সংঘের কলেবর ক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে যে বিশাল আকার ধারণ করেছে, তার পুরোধা ছিলেন ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য।
১৩৬৯ বঙ্গাব্দের ২৪শে চৈত্র আটষট্টি বছর বয়সে দেওঘরস্থ বাসভবনে এই মহাতাপসের মানবদেহের চির বিশ্রাম ঘটে। তাঁর তিরোধানের পর ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুট হলে আয়োজিত শোকসভায় বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ দেবপ্রসাদ ঘোষ স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, তাঁদের সমসময়ের এক অসাধারণ দীপ্তিমান বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলে কৃষ্ণপ্রসন্ন। হঠাৎ তাঁরা জানতে পারেন যে কৃষ্ণপ্রসন্নের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে এবং তিনি কোথাকার এক আশ্রমে গিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দেওঘর আশ্রমে গিয়ে তাঁর (দেবপ্রসাদের) এই ভ্রান্ত ধারণার নিরসন হয় এবং তিনি বুঝতে পারেন যে, অনন্ত শক্তির উৎসের কাছেই কৃষ্ণপ্রসন্ন নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন।
ইষ্টার্থ প্রতিষ্ঠায় ঋত্বিগাচার্য কৃষ্ণপ্রসন্নর নিরসল সংগ্রামের বহু ইতিহাস আজ সাধারণ লোকচক্ষুর অন্তরালে। তবু সৎসঙ্গের বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী- ভাবে মিশে আছে তাঁর অস্তিত্ব, শ্রীশ্রীঠাকুর প্রণীত গ্রন্থরাজির মধ্যে রয়ে গেছে তাঁর অচ্ছেদ্য প্রণোদনা; ঐহিক অস্তিত্বের সীমানা পেরিয়ে ইষ্টাত্ম তাঁর চির অবিনশ্বর সত্তা শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবান্দোলনের মধ্যে নিত্য বহমান।
___________________________________
#কৃষ্ণপ্রসন্ন_ভট্টচার্য্য
10