কিশোরীমোহন দাস :-
ভক্ত ও ভগবান, দুটি কথা পরস্পরসাপেক্ষ। ভগবান বা ভজমান, যিনি ভক্তের যাবতীয় অনুরাগ, ভক্তি ও ভালবাসার কেন্দ্র, তাঁকে ব্যতীত যেমন ভক্ত শব্দের তাৎপর্য নেই, তেমনই ভজনা করার কেউ না থাকলে ভগবান তাঁর ষড়ৈশ্বর্য উন্মোচনের আধার পান না। অধ্যাত্ম-সাধনার ইতিহাসে তাই ভক্ত ও ভগবান, দুই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ভগবত্তা উপলব্ধি করে তাকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করার দায়িত্ব সর্বপ্রথমে যাঁরা বহন করে ধন্য হন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন ঠাকুরের আবাল্য পরিচিত ।
কিশোরীমোহনের জন্ম হয় ১২৮৭ সালের ১৪ই চৈত্র দোল পূর্ণিমায়। পিতা কেশবলাল দাস ছিলেন বৈষ্ণব। হিমাইতপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম প্রতাপপুরে মাঝিপাড়ায় ছিল তাঁদের নিবাস। কিশোরীমোহনের প্রথাগত শিক্ষালাভ বিশেষ হয়নি, অল্প বয়সে 'কমপাউন্ডারী' বিদ্যা শিক্ষা করে নিজের বাড়িতে ডিস্পেন্সারি খোলেন। পরবর্তী কালে এ কাজে তিনি বিশেষ দক্ষতা ও সুনাম অর্জন করেন।
যৌবনে কিশোরীমোহন ও তার দুর্বিনীত অনুচরদের ক্রিয়াকলাপকে গ্রামবাসীরা সুনজরে দেখতেন না। কিশোরীমোহনের অনুচরদের মধ্যে অনেক মদ্যপ, উগ্র প্রকৃতির যুবক ছিল; তাদের অনিয়ন্ত্রিত, অশিষ্ট আচরণ গ্রামবাসীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এসব কিছু জানা সত্ত্বেও অনুকূলচন্দ্র কিশোরীমোহনের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন এবং আদর করে 'ডাক্তার' বলে ডাকতেন। গ্রামবাসীদের কাছে অনুকূলচন্দ্র ছিলেন আদর্শ, তাঁর চরিত্রমাধুর্য, সেবামাহাত্ম্য তাঁকে করে তুলেছিল সবার প্রিয়জন। সবার ভয় ছিল, এহেন চরিত্রবান যুবক কুসঙ্গে অধঃপাতে যাবে, তাই এই সঙ্গ পরিহার করতে সকলেই অনুকূলচন্দ্রকে বিশেষ উপদেশ দিতেন। কিন্তু অনুকূলচন্দ্র এই উপদেশে কান দিতেন না। পিতামাতারও যথেষ্ট ভর্ৎসনা, তিরস্কার পুত্রকে এ ব্যাপারে নিরস্ত করতে পারেনি।
আত্মসচেতন অনুকূলচন্দ্র জানতেন, কোনভাবেই কিশোরীমোহনের প্রভাবাধীন তিনি হতে পারেন না, বরং কিশোরীমোহনের চরিত্র সংশোধন করে সৎপথে আনা সম্ভব। মাতৃভক্ত অনুকূলচন্দ্র জননীদেবীকে বুঝিয়ে বলেন, "মা, তুই মোটেই ভয় করিস না। যদি কিশোরীর পাল্লা ভারী হয়, তবে আমি কিশোরীর দিকে যাব, আর আমার পাল্লা যদি ভারী হয়, তবে কিশোরীই আসবে আমার দিকে। তুই দেখ না কার পাল্লা ভারী হয়।"
কিশোরী ভাল কীর্তন করতে পারতেন। তাঁর চরিত্র সংশোধনের জন্য অনুকূলচন্দ্র এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করেন। কিশোরমোহন ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে তিনি একটি কীর্তনের দল গঠন করেন এবং প্রত্যহ কিশোরীর বাড়িতে কীর্তনের ব্যবস্থা করেন। অনুকূলচন্দ্রের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে কিশোরীমোহন অনুচরবৃন্দসহ কীর্তনে অনুরাগী হয়ে ওঠেন। সংকীর্তনের সঙ্গে সদগ্রন্থাদি পাঠ এবং সদআলোচনায় তাঁদের মধ্যে শ্রদ্ধাভক্তি, প্রেমপ্রীতির উন্মেষ হতে থাকে। যতই দিন যেতে থাকে, ততই তাঁরা আদর্শানুসরণে আপ্রাণ হয়ে ওঠেন। পঙ্কের মধ্য থেকে পঙ্কজ প্রকাশিত হয়ে উঠতে থাকে সূর্যের প্রভাবে।
কিশোরমোহনের পরিবর্তন অভাবনীয়। সর্বদাই এক ভাবোন্মাদনায় বিভোর হয়ে থাকেন। ভগবানকে লাভ করার এক দুর্বার প্রেরণা, ব্যাকুলতা তাঁকে অস্থির করে তুলেছে। সুযোগ বুঝে অনুকূলচন্দ্র কিশোরীকে তৎকালীন প্রখ্যাত সাধক ঠাকুর হরনাথের সঙ্গ করার জন্য প্রায়ই তাঁর সোনামুখী আশ্রমে পাঠাতেন। ঠাকুর হরনাথের পুণ্যপরশে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর কাছে দীক্ষাগ্রহণের আকুলতা প্রকাশ করায় ঠাকুর হরনাথ কিশোরীমোহনকে বুঝিয়ে বলেন-‘যিনি যুক্তিপরামর্শ দিয়ে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তিনিই তোমার গুরু। তিনি সদগুরু, যুগপুরুষোত্তম। তাঁর সঙ্ঘ গড়ার সময় হয়েছে। তুমি সর্ব মনপ্রাণ দিয়ে তাঁরই অনুসরণ কর, তোমার পরম মঙ্গল হবে। আমিও তো তাঁতেই আছি।’ তাঁর এই কথা কিশোরীর বিশেষ পছন্দ হল না এবং স্বভাবতই তিনি ভাবলেন যে তিনি দীক্ষাগ্রহণের অনুপযুক্ত বলেই ঠাকুর হরনাথ তাঁকে এসব কথা বলে নিরস্ত করছেন।
অনুকূলচন্দ্রের আকর্ষণ কিশোরীমোহনের কাছে খুবই জীবন্ত; তাঁর চরিত্রের দ্যুতি, উচ্চমার্গের ধ্যানধারণা, বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব, সেবাপরায়ণতা এ সবই কিশোরীর একান্তভাবে জানা। কিন্তু তাঁর থেকে বয়সে বেশ কিছুটা ছোট ছেলেবেলার এই বন্ধুটির যত গুণই থাকুক, তিনি কি সদ্গুরু হওয়ার উপযুক্ত? এই সংশয়ে কিশোরীর মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। আবার ঠাকুর হরনাথের কথাই বা অবিশ্বাস করবেন কী ভাবে! অবশেষে তাঁর মনে হল, যিনি সদ্গুরু, তিনি নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ পুরুষ, অতএব অনুকূলচন্দ্রকে পরীক্ষা করবেন তিনি। যদি তাঁর কার্যকলাপে অন্তর্যামিত্বের পরিচয় পান, তবেই তিনি তাঁকে ইষ্টরূপে গ্রহণ করবেন। এরপর চলল কিশোরীমোহনের নানাধরনের নানা পরীক্ষার পালা; তাঁকে তো নিশ্চিত হতেই হবে-বেলা বয়ে যায়, আর তো দেরি করা চলে না!
একদিন গভীর অমাবস্যার রাত্রে কিশোরীমোহন একাকী নির্জন শ্মশানে সাধনায় বসে আকুলভাবে ভগবানকে ডাকছেন—দয়াল, কোথায় তুমি, একটিবার দেখা দাও, অভাগার তাপিত প্রাণ শীতল কর। ঠিক এই সময়ে শুনতে পেলেন অনুকূলচন্দ্রের কন্ঠের ‘ডাক্তার, ডাক্তার’-এই ডাক। জনহীন শ্মশানে ভূতপ্রেত ছাড়া আর কিছু নয় ভেবে কিশোরী উচ্চৈঃস্বরে রাম নাম উচ্চারণ করতে থাকেন। আবার শুনতে পেলেন, ‘রাম নাম করছ কেন? আমি ভূত নই, আমি অনুকূল।’ এবার কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে কিশোরীমোহন বলেন-তুমি যদি অনুকূল হও তবে এমন অসময়ে এখানে এসেছ কেন? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল- তোমার জন্যই এখানে এসেছি, চল, বাড়ি চল। ইতিমধ্যে অনুকূলচন্দ্র কিশোরীমোহনের কাছে এসে তাঁর হাত ধরে বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। অনুকূলচন্দ্র চলেছেন আগে আগে, কিশোরীমোহন তাঁর পিছনে। কিশোরীমোহনের সন্দেহ তখনও যায়নি; তিনি শুনেছিলেন ভূতপ্রেতের পা মাটিতে পড়ে না, তাঁর সহযাত্রীর পা মাটিতে পড়ছে কিনা, তা বিশেষভাবে লক্ষ করতে থাকেন। অমনি সহযাত্রীটি বলে উঠলেন, ডাক্তার, পা ঠিক মাটিতে পড়ছে, আমি ভূত নই, তুমি নির্ভয়ে চল। কিশোরীমোহন অবাক বিস্ময়ে ভাবেন-তবে কি ঠাকুর হরনাথের কথাই ঠিক?
কিশোরীমোহনের সন্দেহ তবু যায় না। আরও পরীক্ষা করার বুদ্ধিতে মনে চিন্তা এল - ও যদি এখন পদ্মায় ডুব দিয়ে আসে তবে আমার মনে কোন সংশয় থাকবে না। যেমনি ভাবা অমনি অনুকূলচন্দ্র বলে উঠলেন-ডাক্তার, দাঁড়াও, জুতোয় ময়লা লেগেছে মনে হচ্ছে, পদ্মায় একটা ডুব দিয়ে আসি। গভীর রাতে মাঘ মাসের শীতে অনুকূলচন্দ্র গায়ের জামাকাপড়সুদ্ধ পদ্মায় নেমে স্নান করে এলেন এবং উভয়েই বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। কিছুটা এগোনোর পর কিশোরীমোহনের সন্দিগ্ধ মন ভাবতে লাগল-এমনও তো হতে পারে যে সত্যিই ওর পায়ে ময়লা লেগেছে আর তাই স্নান করে এল। যদি আরেকবার স্নান করে আসে তবেই পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। এর পরে অনুকূলচন্দ্র বাড়ি পৌঁছেই স্নানের ঘাটের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললেন-ডাক্তার, দেহের ময়লা ধুলেই যায়, মনের ময়লা কিন্তু সহজে দূর হয় না। তাহলে আর একবার স্নান করে আসি, কি বল? এই বলে আর একবার স্নান করে এলেন।
বিস্ময়ে অভিভূত কিশোরীমোহনের ইচ্ছা হল তাঁর চরণে লুটিয়ে পড়তে। কিন্তু পরক্ষণেই অহংবোধ মাথা চাড়া দেয়, ভাবেন—অনুকূল যদি কাল কারও কাছে বলে দেয় যে কিশোরী ভগবান বলে পা ধরেছিল, তবে যে লোকে লজ্জা দেবে। কিন্তু আবেগে ভেসে যায় অহং, অন্তর্যামী অনুকূলচন্দ্রের চরণে লুটিয়ে পড়েন কিশোরীমোহন। অনুকূলচন্দ্র হাসতে হাসতে বলেন-এই যে ডাক্তার ভগবান বলে আমার পায়ে পড়লে, কাল সকল লোককে বলে দেব। কিশোরী বুঝলেন, অনুকূল প্রকৃতই অন্তর্যামী। তখনকার মত দ্বিধাহীন হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে জিজ্ঞাসা করেন,-ঠাকুর, তুমি শ্মশানে এলে কী করে? শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেন, দেখ, সেতার বা এসরাজে অনেক তার থাকে, তার একটাতে ঝঙ্কার দিলে অন্যগুলিতেও ঝঙ্কার ওঠে। তেমনই ভাই, তোমার কান্না, তোমার আকুল আহ্বান আমার মনে বড় বাজে। আর শ্মশানে কাজ কী ভাই? যা পাবার তা তো পেয়েছ। মনে রেখো, ধ্যান করবে মনে, বনে আর কোণে।
এত পরীক্ষার পরও কিশোরীমোহন নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় অনুকূলচন্দ্র সত্যিই সর্বজ্ঞ সদ্গুরু, কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার বিরূদ্ধ চিন্তার স্রোতে দিশাহারা হয়ে পড়েন। ভাবেন-না আছে অনুকূলচন্দ্রের সাধন-ভজন, না আছে কঠোর শাস্ত্রজ্ঞান। দ্বিধাগ্রস্ত মনে আবার আসে পরীক্ষা করার চিন্তা। একদিন একজোড়া খেজুড়ের গুড়ের সন্দেশ কিনে এনে পটের পিছনে রেখে ভাবেন, অনুকূল যদি কীর্তনের পর সন্দেশ দুটি চেয়ে খায় তবে বোঝা যাবে সে প্রকৃতই অন্তর্যামী। তখন রোজই কীর্তন হয় কিশোরীর বাড়িতে, অনুকুলও অংশ নেন তাতে এবং কীর্তনের পর জল খেয়ে বাড়ি চলে যান। সেদিন কীর্তনের পর জল না খেয়েই বাড়ি চলে যান। অন্তর্যামিত্বের সাড়া না পেয়ে কিশোরীমোহন আবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অকস্মাৎ মধ্যরাত্রে অনুকূল কিশোরীর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলেন, রোজ রোজ শুধু জল খেয়ে যাই, আজ কিন্তু জোড়া সন্দেশ চাই, তখন অত লোকের সামনে চাইতে পারিনি। কিশোরী সহজভাবে বলেন, এত রাত্রে এখন সন্দেশ কোথায় পাব? উত্তরে অনুকূলচন্দ্র বলেন-আজ যে বাজার থেকে সন্দেশ এনে পটের পিছনে লুকিয়ে রেখেছ-এই বলে নিজেই পটের পিছন থেকে সন্দেশ বের করে সন্দেশসহ জল খেয়ে বাড়ি চলে যান। কিশোরীমোহন বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ভাবেন, কত পরীক্ষা করলাম, প্রমাণও পেলাম, তবু মনের অবিশ্বাস যায় না। আত্মধিক্কারে মন তাঁর ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
স্থির বিশ্বাসের দৃঢ় ভূমিতে পৌঁছতে কিন্তু কিশোরীমোহনকে আরও সংশয়ের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। একবার দুটো পাত্রে ভোগ সাজান কিশোরী; একটি ভোগ ঠাকুর হরনাথের নামে, অপরটি অনুকূলচন্দ্রের নামে নিবেদন করে মনে মনে ভাবেন, অনুকূল যদি নিজে থেকে তাঁর উদ্দেশ্যে ভোগটি গ্রহণ করেন তবে চিরদিনের মত সন্দেহের অবসান হবে এবং ঠাকুর হরনাথের কথামত তাঁকেই গুরু বলে গ্রহণ করব। ভোগ নিবেদনের বেশ কিছু পরে অনুকূলচন্দ্র তাঁর কীর্তনের সঙ্গী দুর্গানাথ সান্ন্যালকে সঙ্গে নিয়ে কিশোরীর বাড়িতে এলেন। সজ্জিত ভোগদুটি দেখে উৎফুল্ল হয়ে আহারে বসে দুটি ভোগই নিজের কাছে টেনে এনে বলেন—দুই কি আছে ডাক্তার, সবই এক। এটাও আমার, ওটাও আমার-এই বলে দুর্গানাথকে একটি ভোগ দিয়ে অপরটি নিজে গ্রহণ করেন। অনুকূলচন্দ্র যে ভোগটি গ্রহণ করেন, সেটি ছিল তাঁরই উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগ।
কিশোরীমোহনের ভাবের যেমন অন্ত নেই, তেমনই শেষ নেই পরীক্ষারও। কীর্তনের চরম অবস্থায় অনুকূলচন্দ্র তখন প্রায়শই সমাধিস্থ হয়ে পড়েন, বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থা। অনুকূলচন্দ্রের দেহে কোন অনুভূতি আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য একবার একটি জ্বলন্ত টিকে তাঁর ঊরুতে চেপে ধরেন কিশোরী। সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটি পুড়ে যায়। কিন্তু অনুকূলচন্দ্রের কোন সাড়া পাওয়া যায় না, যেমন অচৈতন্য ভাবে পড়ে ছিলেন তেমনই পড়ে রইলেন তিনি। চেতনা আসে অনেক পরে, সমাধিভঙ্গের পর। অনুশোচনায় দীর্ণ হয় কিশোরীমোহনের অন্তর। সকলের আশ্রয়স্থল অনুকূলচন্দ্র সবকিছুরই প্রশ্রয় দেন।
সীমাহীন এই প্রশ্রয়ই কিশোরীমোহনের উত্তরণের পথ মসৃণ করে। প্রেমভক্তি আর ভালবাসার পথ অবারিত হয় চিরতরে। কিশোরীমোহনের দীক্ষা হয় পুরুষোত্তম- জননী মাতা মনোমোহিনী দেবীর কাছে। একদা লোকত্রাস কিশোরীমোহন রূপান্তরিত হন লোকত্রাণ কিশোরীমোহনে, হয়ে ওঠেন অগণিত মানুষের ভালবাসা, প্রেরণা ও নির্ভরতার কেন্দ্রস্থল। তথাকথিত লেখাপড়া তেমন করেন নি, ছিল না সুগ্রথিত ভাষার বাঁধুনি, অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা অবিরামভাবে বলে যেতেন পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দিব্য জীবন-কাহিনী। আবেগাপ্লুত হয়ে শ্রোতারা শুনতেন মনোহরণ সেসব কথা। তাঁর চলাফেরা কথাবার্তায় প্রকাশ পেত স্বতঃস্ফূর্ত ঈশ্বরীয় ভাব- মুখচোখের দিব্য বিভা আকর্ষণ করত ভক্তপ্রাণ মানুষকে। গর্ব করে বলতেন, মানুষকে ভূতে ধরে, আমাকে ভগবানে ধরেছে। আমি না করেছি এমন অকাম নেই, কিন্তু ঠাকুর আমার মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কথা বলা ছাড়া উপায় নেই।
একবার কোন একটি নিষিদ্ধ কাজের প্রতি কিশোরীমোহনের খুব ঝোঁক চাপে। হয়তো কাজটি করেও ফেলতেন—কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই রাত্রে কতগুলি মৌমাছি কিশোরীমোহনের লেপের মধ্যে ঢুকে তাঁকে দংশন করে। এই দংশনে তিনি গুরুর অপরিসীম কৃপা অনুভব করে যন্ত্রণার মধ্যেও আনন্দলাভ করেন, কারণ এই ঘটনায় তাঁর মন থেকে অবৈধ চিন্তা দূর হয়ে গেল। দংশন-কাহিনী তিনি আর কারও কাছে প্রকাশ করেন নি। পরদিন সকালে ঠাকুরের কাছে কিশোরীমোহন এলে ঠাকুর বলেন, ডাক্তার, মৌমাছির কামড় কেমন? কিশোরীমোহন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলেন- কে বলেছে যে আমাকে মৌমাছি কামড়িয়েছে? তখন ঠাকুর তাঁর নিজের শরীর কিশোরীমোহনকে দেখালেন। কিশোরীমোহন দেখলেন তাঁর শরীরে যেখানে যেখানে মৌমাছি দংশন করেছিল, ঠাকুরের শরীরেও ঠিক সেই সেই স্থানে মৌমাছি দংশনের স্পষ্ট চিহ্ন বর্তমান। ভক্তের রক্ষাকল্পে ভগবানের আত্মনিগ্রহের লীলা চিরন্তন।
শীতকাল, রাত প্রায় এগারোটা। শ্রীশ্রীঠাকুর দুর্গানাথ সান্ন্যালকে বলেন, দুর্গানাথদা, আপনি এখনই গিয়ে কিশোরীকে কিছু খাওয়াতে পারেন? আজ্ঞে, আপনার আদেশ হলে পারি-এই বলে দুর্গানাথদা মহানন্দে কিশোরীমোহনের বাড়ি গেলেন। সেখানে তখন সকলে কীর্তনের পর শয্যা গ্রহণ করেছে। অগত্যা দুর্গানাথদা এক প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে স্টীমার ঘাটে গিয়ে বিশেষ চেষ্টা সত্ত্বেও ভাল খাবার কিছু না পেয়ে চিঁড়ে ও খাগড়াই মুড়কি কিনে এনে কিশোরীমোহনকে ডাকেন। কিশোরীমোহন সব শুনে খাবারের কিছুটা বাড়ির ভিতরে পাঠিয়ে অবশিষ্টাংশ নিজে খেতে আরম্ভ করে, অশ্রুসজল নয়নে বলতে থাকেন-ঠাকুরের কী কৃপা! আজ রাত্রে আমাদের কারও আহারাদি হয়নি, পরম দয়াল অন্তর্যামী জানতে পেরেছেন বলে আপনাকে দিয়ে এই খাদ্যসামগ্রী আনিয়ে দিলেন! এমন সময়ে ঠাকুরের অপর পরম ভক্ত অনন্তনাথ রায় (মহারাজ) এক ঠোঙা রসগোল্লা নিয়ে উপস্থিত হয়ে বললেন- দুর্গাদা, আপনি শুকনো চিঁড়ে দিয়েছেন, ও কি খেতে পারা যায়? এই নিন, এই রসগোল্লা খেতে দিন। সেই রসগোল্লা কিছু বাড়ির ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হল, কিছু কিশোরীমোহন পরম তৃপ্তিভরে খেলেন। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর অনন্তনাথ দুর্গানাথকে নিয়ে আশ্রম অভিমুখে রওয়ানা হলেন। অনন্তনাথকে অনুসরণ করে দুর্গানাথ এগিয়ে চলেছেন, হঠাৎ চোখের পলকে অনন্তনাথকে আর দেখতে পেলেন না। বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে দুর্গানাথ দ্রুত আশ্রমে এসে দেখলেন ঠাকুর ও অনন্তনাথ যে ঘরে থাকেন, ঘরটি ভিতর থেকে বন্ধ। ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন দুর্গানাথ; চিৎকারের শব্দে ঠাকুর ও অনন্তনাথ ঘুম ভেঙে ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসেন। দুর্গানাথ স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারেন, কিশোরীমোহনের বাড়িতে অনন্তনাথ যাননি, চতুর চূড়ামণি ঠাকুরেরই আর এক লীলাভিনয় হল তাঁর পরম ভক্তের গৃহে।
একবার কিশোরীমোহনের ঘরে কোন আর্থিক সংকুলান নেই, এমনকী ঘরে কোন খাদ্যসামগ্রীও নেই। এমতাবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুর এসে কিশোরীমোহনের কাছে মালপোয়া খেতে চান। কিশোরীমোহন হাতের আংটি বন্ধক রেখে ঠাকুরের জন্য মালপোয়া নিয়ে এলেন। ঐ দিনই ডাক্তারি ও বাকি আদায় বাবদ পঁচাত্তর টাকা উপার্জন হয়। এর কিছুদিন পরে অনুরূপ আর্থিক অনটনের মধ্যে ঠাকুর এসে এক কৌটো সিগারেট চান কিশোরীমোহনের কাছে। কিশোরী কালবিলম্ব না করে পুনরায় আংটি বন্ধক রেখে আড়াই টাকা দামের এক কৌটো সিগারেট এনে ঠাকুরকে দেন। আগের ঘটনা হেতু এবারে বৃহত্তর লাভের বাসনা তাঁর মনে গোপনে বাসা বেধেছিল। কিন্তু এবারে এরপর সাতদিনের মধ্যে তাঁর আর কোন উপার্জন হল না। উপরন্তু অত্যন্ত আর্থিক সংকটের মধ্যে জনাকয়েক অতিথি এসে হাজির হলেন। চিন্তায় ব্যাকুল কিশোরীমোহনের কাছে ঠাকুর এসে বলেন, -কী ডাক্তার, আর এক কৌটো সিগারেট আমাকে কিনে দেবে? কিশোরী উত্তর দ্যান, তুমি তো সবই জান, হাতের আংটিটি সেদিন বন্ধক রেখেছি, অতিথি এসেছেন, তাঁদেরও কোনপ্রকার সংস্থান নেই। এখন কীভাবে তোমাকে সিগারেট এনে দেব! ঠাকুর তখন বলেন-দেখ ডাক্তার, সেদিন যে আংটি বন্ধক রেখে মালপোয়া কিনে আমাকে খেতে দিয়েছিলে, সেটি নিষ্কামভাবে করেছিলে। সেজন্য সেদিন পঁচাত্তর টাকা পেয়েছিলে। তারপরে যে আংটি বন্ধক রেখে আমাকে সিগারেট কিনে দিয়েছিলে, সেটি লোভের বশবর্তী হয়ে।... তোমার এই দুর্লোভের জন্য কিছুই পাওনি। প্রতিজ্ঞা কর-এইরূপ বাসনা রেখে আর কোন কাজ করবে না। কিশোরীমোহন অনুতপ্ত হৃদয়ে তখনই সেই প্রতিজ্ঞা করলেন। ঠাকুর তখন কিশোরীর অতিথিদের সৎকারের সুব্যবস্থা করে দিলেন। কিশোরীমোহনের বাড়ির প্রাঙ্গণে সারা রাত ধরে কীর্তন হচ্ছে, ভোর হয়ে এল, কিশোরীমোহন মেতে আছেন কীর্তনে। একটু বেলা হতেই দেখা গেল এক ভদ্রলোক হাতে একটি নতুন বস্ত্র নিয়ে চিন্তাগ্রস্তভাবে কিশোরীমোহনের বাড়ির দিকে আসছেন। তিনি কীর্তন আঙিনায় উপস্থিত হলে শ্রোতারা কৌতূহলবশে তাঁর পরিচয় ও এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে কীর্তন থেমে গিয়েছে; কিশোরীমোহন কীর্তনের শেষে বেরিয়ে আসতেই ভদ্রলোক দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে-'এই সেই লোক, এই সেই লোক' বলতে বলতে নতুন বস্তুটি তাঁর পায়ে রেখে প্রণাম করতে উদ্যত হলেন। কিশোরীমোহন তাঁকে নিবৃত্ত করে শান্তভাবে বসিয়ে এহেন দান ও প্রণামের কারণ জানতে চান। ভদ্রলোক জানান, তাঁদের আদরের সন্তান ১২/১৩ বছরের মেয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ টাইফয়েড-এ ভুগছে, চিকিৎসায় কোন ফল হয় নি, রোগ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। তিনি সর্বদাই ঈশ্বরকে ডাকছেন কন্যার আরোগ্য কামনায়। গতরাত্রে স্বপ্ন দেখেন, এক জ্যোতির্ময় পুরুষ স্মিতহাস্যে তাঁকে বলছেন-'তোর বাক্সের নতুন কালোপাড়ের ধুতিটি হিমাইতপুর গ্রামের চুল-দাড়ি-গোঁফওয়ালা লোকটিকে দিয়ে প্রণাম কর, তবে তোর মেয়ে শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করবে।' ঐ স্বপ্ন দেখার পর সকালেই ভদ্রলোক কাপড় নিয়ে হিমাইতপুর গ্রামে এসে বর্ণনা অনুযায়ী কিশোরীমোহনকে দেখে প্রণামে উদ্যত হন।
সব শুনে কিশোরীমোহন সেই ব্যাক্তিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের ফটো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন যে ইনিই সেই স্বপ্নদৃষ্ট জ্যোতির্ময় পুরুষ কি না। ভদ্রলোক সেই মুহূর্তেই ঠাকুরকে স্বপ্নদৃষ্ট পুরুষরূপে চিনতে পারেন। এর পর কিশোরীমোহন তাঁকে সঙ্গে করে ধুতিটি মাথায় নিয়ে ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রণাম করলেন। ঠাকুর বললেন- ডাক্তার, কী ব্যাপার, আজ যে একেবারে সকালেই, তাতে আবার কাপড় দিয়ে প্রণাম, ভদ্রলোকটিই বা কে? এই কথা বলে তিনি মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। কিশোরীমোহন সমস্ত ঘটনা বিবৃত করার পর ঠাকুর যেন কিছুই জানেন না এমন ভাব করে বলেন, তা ভালোই তো, কাপড়টি তোমাকে দিয়েছেন, তুমিই নাও, আমাকে দিচ্ছো কেন? কিশোরীমোহন বলেন, রোগ ভাল করতে ভদ্রলোক এসেছেন, আমি তা কী করে করব? এজন্য আমি কাপড়খানা তোমাকে দিলাম। শ্রীশ্রীঠাকুর কাপড়খানি গ্রহণ করে কিশোরীমোহনকে ফেরত দিয়ে দিলেন এবং সযত্নে রাখতে বললেন। পরে ঐ মেয়েটি শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করে।
একবার ফরিদপুর থেকে চোদ্দজন অতিথি এসেছেন কিশোরীমোহনের বাড়িতে। ঘরে খাবার কিছু নেই, হাতে টাকাপয়সাও নেই। অতিথি সৎকারের চিন্তায় বিমর্ষ কিশোরীমোহন ঠাকুরের ফটোর সামনে আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা ও ধ্যানে বসেন। কিছুক্ষণ ধ্যানে বসার পরে প্রথমে দর্শন করলেন আলো-কোটিসূর্যবিনিন্দিত জ্যোতিপুঞ্জ, শ্রবণ করলেন নানা সুমধুর শব্দ। তারপর কোথায় যেন একটি বক্র ছিদ্রপথে আকাশে উঠে গেলেন-সেখানে সুমধুর বংশীধ্বনি শোনার পর তিনি বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে পড়েন। বহুলোকের চিৎকারেও তাঁর জ্ঞান ফিরে এল না; এই অবস্থায় বহুক্ষণ থাকার পর বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলো। তখনও আচ্ছন্নভাব সম্পূর্ণ কাটে নি - এমন সময় ডাকপিওন মানি অর্ডার নিয়ে এল; ঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত আচার্য সতীশচন্দ্র গোস্বামী পঁচিশ টাকা পাঠিয়েছেন। কিশোরীমোহন নিশ্চিন্ত হয়ে অতিথি সৎকারে উদ্যোগী হন। এমন সময়ে ঠাকুর এসে বলেন, কী ডাক্তার, মানি অর্ডার এলো নাকি? কিশোরীমোহন নির্বাক হয়ে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ঠাকুরের দিকে। ঠাকুর তখন সহাস্যবদনে বলেন-শোন ডাক্তার, আকুল প্রাণে ডাকলে জ্যোতিদর্শনও হয়, বাঁশীও শোনা যায়, টাকাও পাওয়া যায়। অবিশ্বাস কোরো না ডাক্তার। এই টাকা এখন খরচ কর, কিন্তু যার টাকা তাকে শীঘ্রই দিও। কিশোরীমোহন অতিথি সেবা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেন এবং পরে সে টাকা যথাসময়ে পরিশোধও করেছিলেন।
পরবর্তীকালে সে-যুগ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন, তখন বাইরের লোকজন তেমন আসেনি। কিশোরী-টিশোরীর সঙ্গে কীর্তন করতাম। পরে ধীরে ধীরে লোক এল। তখন আশ্রমে বেশ জঙ্গল ছিল। মাঝখানে মাঝখানে পরিষ্কার করে মাচা করা ছিল। সেখানে জপধ্যানাদি করা হত। অনেকে গাছতলা পরিষ্কার করে থাকতো। সেখানে লোকে কুশাসন পেতে নামধ্যান করত। বাঘের ভয় ছিল, রাত্রে বাঘের ডাক প্রায়ই শোনা যেত। তখন কষ্ট অসুবিধা অনেক ছিল। কিন্তু কষ্টের বোধ কারো ছিল না। দিন রাত আলাপ, আলোচনা, কীর্তন, নামধ্যান-এসব নিয়ে লোকে মত্ত থাকত। সে এক যুগ গেছে। এর পর অনেকদিন পর্যন্ত একটা ধরন ছিল। প্রত্যেকের ঝোঁক ছিল অপরকে সেবা দেবার। কারো সেবা নিজে নেবে না, কিন্তু অন্যকে সেবা দেবে।
নামধ্যানের সময়ে মারক শক্তির বাধাদানের ঘটনাও ঘটে কিশোরীর জীবনে। হিমাইতপুরে সেই সময়ে অনেক ভাটির গাছ ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁকা থাকতো। কিশোরীমোহন অনেক সময়ে সেখানে আসন পেতে ধ্যানে বসতেন। এই সময়ে মারক শক্তির প্রভাবে অনেক ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি উপস্থিত হয়েছে—কখনও বা দেখতেন চারদিকে অজস্র সাপ। প্রথম দিকে ভয় পেয়ে চলে আসতেন অনুকূলচন্দ্রের কাছে -অনুকূলচন্দ্র অভয় দিতেন। পরের দিকে অবশ্য এই সব উপদ্রবের উপশম হয়।
সাংসারিক জীবনের ব্যক্তিগত অসুবিধা বা বিঘ্নও কিশোরীমোহনের ঠাকুরমুখী অদম্য চলনের পথরোধ করতে পারেনি। কিশোরীমোহনের চতুর্থ পুত্রের সেসময় কঠিন অসুখ। যত দিন যায় রোগ বেড়েই চলে, প্রাণের আশা ক্রমে ক্রমে ক্ষীণতম হয়ে আসে। বাড়িসুদ্ধ সকলে শোকে মুহ্যমান। এমন সময়ে কুষ্টিয়ার দোগাছি থেকে ভক্তরা এলেন কিশোরীকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য। দোগাছিতে এসেছেন গোঁসাই (আচার্য সতীশচন্দ্র গোস্বামী), তাঁর সঙ্গে কিশোরীকেও একসঙ্গে পেতে চান ভক্তরা। ঠাকুরের উৎসব, নামগান হবে ঠাকুরের, কিশোরী না বলতে পারলেন না-চলে গেলেন দোগাছিতে। দিনের পর দিন সেখানে চলেছে নামগান, সবকিছু ভুলে মত্ত হয়ে আছেন কিশোরী। এদিকে তাঁর পুত্রের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে ঠাকুর লোক পাঠিয়ে ফিরিয়ে আনলেন তাঁকে।
পুত্রের মৃত্যুর আগেই শ্রীশ্রীঠাকুর কিশোরীমোহনের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে আসন্ন বিপর্যয় সম্বন্ধে কিশোরীমোহনকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে বলেন এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে মুমূর্ষর শয্যার চারপাশে আবর্তন করে কীর্তন করতে বলেন। কিশোরীমোহন তাই করেন। তখন রাত্রি সাড়ে নটা-ঘোর দুর্যোগে প্রকৃতি উথাল- পাথাল। তারই মধ্যে শিশুটির প্রাণবায়ু নির্গত হল। ঠাকুর শোকসন্তপ্ত পরিবার- পরিজনকে সামলানোর জন্য নিজে থাকলেন, কিশোরীমোহনকে নির্দেশ দিলেন পুত্রের মৃতদেহটি নিয়ে গিয়ে পদ্মাবক্ষে ভাসিয়ে দিতে। একটি নির্দিষ্ট বয়স না হওয়া পর্যন্ত শাস্ত্রে মৃতদেহ দাহ করার বিধি নেই- সেজন্যই অনুরূপ নির্দেশ। শিশুর গায়ে দু'- একটি সোনার অলঙ্কার ছিল, ঠাকুর সেগুলি খুলে নিতে নিষেধ করেন। অতঃপর সেই ঝড়বৃষ্টির মধ্য দিয়ে অন্ধকার রাত্রে জঙ্গলাকীর্ণ পথে কিশোরীমোহন প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের মৃতদেহ বক্ষে একাকী রওয়ানা হন পদ্মার দিকে অন্তরে দুঃসহ পুত্রশোক নিয়ে। মানসিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তার উপরে অন্ধকার; মাইলখানেক পথ পার হয়ে পদ্মায় যখন দেহটি বিসর্জন দিতে যাবেন, তখন আর টাল সামলাতে পারলেন না, নিজেও পড়ে গেলেন নদীতে। ঝড়ের পদ্মার উত্তালতা কল্পনার অতীত- মুহূর্তমধ্যে খরস্রোতে ভেসে গেলেন কিশোরীমোহন - অবিরাম ইষ্টস্মরণ ব্যতীত আর কিছুই তখন তাঁর করণীয় ছিল না। হঠাৎই একটি বাঁশজাতীয় কিছু হাতে ঠেকল, তৎক্ষণাৎ সেটি ধরে ফেলে কোনমতে পাড়ে এসে উঠলেন। কিন্তু এর মধ্যেই অনেকদূর চলে এসেছেন তিনি - গভীর জঙ্গলে আচ্ছন্ন জায়গাটি। ঝড়বৃষ্টির দাপটও অব্যাহত। অসহায়ভাবে অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে জঙ্গলের মধ্যে আছাড় খেতে খেতে চলেছেন -মনে হচ্ছে, আর বুঝি এখান থেকে বেরোনো সম্ভব নয়। আকুলভাবে ডেকে উঠলেন – ঠাকুর! সে মুহূর্তে কেউ তাঁর হাত চেপে ধরে বলে উঠলেন ডাক্তার, ভয় নেই! বিদ্যুৎ চমকালো, তার আলোয় দেখলেন - সামনেই ঠাকুর! ঠাকুর তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর সাবধানে ধরে সেই বনের ভিতর থেকে বার করে নিয়ে এলেন। কিশোরীমোহনের তখন সমস্ত দুঃখবেদনা ছাপিয়ে একটি ব্যথায়ই মন ভরে উঠেছে – আমার জন্য ঠাকুর এই দুর্যোগে এই জঙ্গলে এত কষ্ট করে এসেছেন! শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে নিয়ে গেলেন স্বীয় জননী মনোমোহিনী দেবীর কাছে; তিনি পরম সান্ত্বনায় শান্ত করলেন পুত্রশোকে অধীর কিশোরীমোহনকে।
১৩৪১ বঙ্গাব্দে অনন্তনাথ রায় বাইরে থেকে আশ্রমে ফেরেন বসন্ত রোগক্রান্ত হয়ে এবং ঐ কালব্যাধিতেই তার জীবনান্ত হয়। তারপরেই রোগ আশ্রমে দাবানলের মত ছড়িয়ে পরে এবং অন্য অনেকের মত কিশোরীমোহনও সেই ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর অবস্থা খুবই সংকটজনক হয়ে ওঠে-ডাক্তাররা প্রাণের আশা ছেড়ে দেন। শেষ অবস্থা আগতপ্রায়, জীবনের লক্ষণ ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে চলেছে, এমন অবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে ডেকে বলেন- ডাক্তার, আমাকে ছেড়ে যাও কোথায়? তোমরা সবাই চলে গেলে আমার কী উপায়? ওঠো শিগগির!
সে ডাক শুনে মুমূর্ষুপ্রায় হতচেতন কিশোরীমোহন অকস্মাৎ সদ্য ঘুম ভাঙা মানুষের মত চোখ মেলে চাইলেন। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর দেহে প্রাণের অন্যান্য লক্ষণ ফিরে এল; কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন তিনি। ভালবাসার অমোঘ শক্তিতে ঠাকুর তাঁর কর্মসাধক ভক্তকে এভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসেন।
এক্ষেত্রে অনেকেরই মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে ঠাকুর এভাবে সবাইকেই মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করতে পারেননি কেন। উত্তর একটাই-ঠাকুরকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করে যাঁরা চলতে পেরেছেন, তাঁর প্রেমশক্তি তাঁদের প্রতিই পূর্ণ কার্যকরী হতে পেরেছে। কিন্তু যে-কোন কারণেই হোক না কেন, তাঁর অভীষ্ট পথ থেকে যিনি বা যাঁরা-
সাময়িকভাবে হলেও-তিলমাত্র বিচ্যুত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে তাঁর করুণা পৌঁছনোর পথ পায়নি, ব্যর্থতার বেদনায় কেঁদে কেঁদে ফিরেছে। একতানতা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যাপার, একচুল এদিক ওদিক হলে সুর মেলে না; প্রেমতরঙ্গের প্রেরক ও গ্রাহক, দু’পক্ষই তাতে বঞ্চিত হন। অপরদিকে গ্রাহকের দিক থেকে কোনরকম বিচলনের বাধা না থাকলে পরম প্রেমময়ের অনবধি ঐশী প্রেমসুধা মঙ্গলনির্ঝর হয়ে অভিষিক্ত করে চলে তাকে অনির্বার। কিশোরীমোহনের নিষ্ঠা ছিল এমনই নিষ্প্রশ্ন, নির্বাধ।
এছাড়াও আরেকটি কথা মনে রাখা দরকার প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিণামে জীবদেহের কোন না কোন সময়ে অবসান ঘটে; তা চিরস্থায়ী নয়, নশ্বর। ইষ্টানুগ চলনের মধ্য দিয়ে দেহের অকাল নাশ হয়তো রোধ করা সম্ভব, কিন্তু এক জন্মের নির্দিষ্ট কর্মসাধন সমাপ্ত হলে, দেহটি ত্যাগ করে জন্মান্তরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেই হয়। সেই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিণামের পথ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও রুদ্ধ করেন না, কারণ তা তাঁর অভিপ্রেত নয়।
কিশোরীমোহনের আর এক বিশিষ্ট পরিচয় ছিল ‘কীর্তনের ঋষি’ রূপে। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর অধ্যাত্ম-আন্দোলনের শুরু করেছিলেন কীর্তনের মাধ্যমে এবং কিশোরীমোহন তাঁর একেবারে আদি যুগের সাথীরূপে কীর্তনের মাধ্যমে উন্নত সাধনস্তর লাভ করেন। ক্রমে এমন অবস্থা হয় যে কীর্তনরত অথবা কীর্তনে উদ্যত কিশোরীমোহনের মনে কোন চিন্তার উদয় হওয়ামাত্র তা বাস্তবে পরিণত হত। হয়তো কখনও মনে ইচ্ছা হল কীর্তন শুরু করার-দেখা গেল, তিনি আরম্ভ করার আগেই চারপাশের অন্যান্য সকলে কীর্তন শুরু করেছে। অথবা কীর্তন করতে করতে কখনও মনে হল, এইবার বন্ধ করলে হয়, তিনি চুপ করার আগেই অন্যান্য সকলে থেমে যেত।
একদিন তাঁর নিজগৃহে কীর্তন চলছে-সকলকে নিয়ে কিশোরীমোহন কীর্তনরত, তুমুল কীর্তন হচ্ছে। এমন সময় ঠাকুর সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে তাঁকে বাইরে নিয়ে এলেন, তারপর আকাশের দিকে নির্দেশ করলেন। কিশোরীমোহন দেখেন, বহুদূরব্যাপী এক আশ্চর্য আলোকবলয় আর তার মধ্যে খোলকরতালযোগে বহু ছায়ামূর্তি কীর্তনরত। ঠাকুর কাঁধ থেকে হাতখানি সরিয়ে নিতেই সে অপরূপ দৃশ্য অন্তর্হিত হল, আবার যখনই ঠাকুর কাঁধে হাত রাখলেন আবার সেই দৃশ্য। পার্থিব কীর্তনের আকর্ষণে বহু বিদেহী সত্তা কীর্তনানন্দে যুক্ত হয়েছে- বুঝলেন কিশোরীমোহন, এবং উচ্চ আধারসম্পন্ন ভক্তটিকে শ্রীশ্রীঠাকুর সে অদৃশ্যপূর্ব দৃশ্য দর্শন করালেন একান্ত প্রীতিভরে। কীর্তনের ঋষি কিশোরীমোহন একবার নামগানে বিভোর হয়ে দিগ্বিদ্গিজ্ঞানশূন্য অবস্থায় কাশীধামে বিশ্বনাথ মন্দিরে বিশ্বনাথের মাথার উপর উঠে পড়েন! তাঁর ঐ ভাবোন্মত্ত দশা দেখে হাজার পাঁচেক লোক হাত-জোড় করে দাঁড়িয়ে সেই অভিনব দৃশ্য দেখতে থাকেন। মন্দিরে চর্ম নিয়ে প্রবেশ নিষেধ বলে চর্মবাদ্য নিয়ে কীর্তনের দলকে মন্দির-প্রবেশে বাধা দিতে এসেছিল পাণ্ডারা, কিন্তু কীর্তন ও উল্লম্ফন এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে তাদের পক্ষে বাধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ভক্তি-বিশ্বাসের তীব্রতায়, আবেগের প্রাবল্যে এমন অনেক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছেন কিশোরীমোহন সেযুগে, কালের প্রবাহে যার অধিকাংশই বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন।
ঠাকুরের প্রতি তাঁর দুর্বার ভালবাসা পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। সকলেই যে পরম পিতার সন্তান, এবং সবার মধ্যেই যে তিনি বিদ্যমান, কিশোরীমোহনের অন্তর্লোকে এই বোধের উন্মেষ হয় অতি সহজে, স্বাভাবিকভাবে। সবাইকে ভাল না বেসে তাই তাঁর উপায় ছিল না। অপরের সুখদুঃখ আনন্দবেদনায় তাঁর ছিল একাত্মতার অনুভব। জীবনের চরম সত্য বলে যাঁকে জেনেছেন, যাঁকে গ্রহণ করলে সব সমস্যার সমাধানের পথ পাওয়া যায়, সেই ঠাকুরের কথাই বলে যেতেন অবিরত বিভিন্নভাবে -প্রেমের ফল্গুধারা চিরপ্রবহমান ছিল তাঁর অন্তরে। মানুষকে তাই তাঁর প্রিয়পরম ঠাকুরের সঙ্গে যুক্ত করার মধ্যেই ছিল তাঁর চরম তৃপ্তি।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথা প্রসঙ্গে একবার বলেন, “আমি ছিলাম একা, কেউ চিনত না, জানত না। তবে আমিও ভালবাসতাম লোককে, লোকেও ভালবাসত আমাকে। কিশোরীকে পেলাম। তাকে লোকে পয়লা নম্বর গুণ্ডা বলে জানত। কিন্তু আমি দেখলাম ওর একটু ক্ষুধা আছে। ওকে গান বেঁধে দিতাম, ঠাকুর হরনাথের কথা বলতাম, খুব ভক্তি হল তাঁর প্রতি। সেই ভক্তি ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে উঠল আমাকে নিয়ে, ও আমাকেই চেপে ধরল।” অন্য এক প্রসঙ্গে বলেন- “কিশোরীর Co-ordination ও materialisation বেশী ছিল। টানও ছিল তেমনি তুখোর। ওই বাজখাঁই গলায় কিশোরী যখন হরিবোল হরিবোল বলে গেয়ে উঠত, তখন সে যাই হোক, he was a king.”
ঠাকুরের আদর্শ প্রচার, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, সৎ দীক্ষা দান, লোকসংগ্রহ, লোকসেবা - এসবই ছিল কিশোরীমোহনের অস্তিত্বের অচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর মধ্যে ছিল এক দুরন্ত প্রাণশক্তি, শ্রীশ্রীঠাকুরের অসামান্য সান্নিধ্যে যা নিয়ন্ত্রিত হয় পরিপার্শ্বপ্লাবী কল্যাণকর্মে। তাঁর তাণ্ডব কীর্তনের প্রেমের স্রোতে অসংখ্য তৃষিত নরনারী পেয়েছিলেন তৃষার শান্তি। হিমাইতপুর ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকতেন না-ঠাকুরের স্বাচ্ছন্দ্যবিধান এবং আশ্রমের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে ছিল তাঁর অপরিসীম দৃষ্টি।
১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষের সময় কিশোরীমোহনের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ও প্রয়াসে হিমাইতপুরের পার্শ্ববর্তী অন্তত পঞ্চাশটি গ্রামের একটি লোককেও অনাহারে প্রাণ হারাতে হয়নি। সূর্যোদয়ের আগে থেকেই শুরু হত ভিক্ষা ও দান গ্রহণ এবং তার পরিসমাপ্তি ঘটতে ঘটতে মধ্যরাত্রি পেরিয়ে যেত। বুভুক্ষু নরনারীর একজনও অভুক্ত থাকলে তিনি সেদিন অন্নগ্রহণ করতেন না।
কিশোরীমোহনকে ‘ভগবানে পাওয়া’ ব্যাপারটি যে কত গভীর, তাঁর সমগ্র সত্তা যে কীভাবে ঠাকুরময় হয়ে গিয়েছিল, অতি ক্ষুদ্র একটি ঘটনায় তার দৃষ্টান্ত মেলে। দুর্ভিক্ষ- পীড়িত গ্রামবাসীদের অনাহার-নিবারণে বিভিন্ন জায়গা থেকে চাল সংগ্রহের কাজে বেরিয়ে একদিন প্রবল দুর্যোগে পড়েছেন; সারাদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় চলেছেন ঠাকুরের আদেশ অনুযায়ী চাল সংগ্রহে। একজন তাঁকে বলেন-একবারে ভিজে গেলেন যে দাদা, একটা ছাতা নিয়ে বেরোলেন না কেন? কিশোরীমোহন অত্যন্ত সহজভাবে উত্তর দ্যান-তা কী করে নেব, ঠাকুর তো ছাতা নেওয়ার কথা বলেননি। ইষ্ট নির্দেশ বহির্ভূত একটি পদক্ষেপও না ফেলা তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল এমনই স্বাভাবিক। এই বিভীষিকাময় মহামারীর সঙ্গে যুদ্ধ করে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে সামলে নিলেও নিজের শরীরকে সামাল দিতে পারলেন না তিনি। কঠোর শারীরিক শ্রমে ভেঙে পড়ল স্বাস্থ্য, অসুস্থ হয়ে পড়লেন কিশোরীমোহন। ধীরে ধীরে নিভে আসতে লাগল তাঁর জীবনদীপ। ১৩৫১, ১৯শে বৈশাখ তেষট্টি বৎসর বয়সে শ্রীশ্রীঠাকুরের অতি আদরের ‘ডাক্তার’, কীর্তনের ঋষি, মহাপ্রাণ ভক্ত কিশোরীমোহনের জীবনাবসান ঘটে। পরিশেষে তাঁর শ্রাদ্ধতর্পণ উপলক্ষ্যে শ্রীশ্রীঠাকুরের মর্মস্পর্শী অভিভাষণখানি উল্লেখ করা হচ্ছে:
সাধু ঋদ্ধি তাপস !
ভক্তবীর কিশোরীমোহন আজ আর নাই। ইষ্টানুগ সেবা-সম্বর্দ্ধনী হোম বেদীর কল্যাণযজ্ঞানলে তার ঐহিক শরীর আহুতি দিয়া নিজেকে জ্যোতিষ্মান অমরার অমর স্পর্শে সার্থক করে তুলেছে। আমার আবাল্য সহচর যৌবনের জ্যোতিঃ প্রৌঢ়ের পরম বান্ধব-তার যা কিছুকে সম্বর্দ্ধিত করে যথাযোগ্য লোকে চলিয়া গিয়াছে। আজ আর সে নাই। আমি একা, সম্মুখে তার শ্রাদ্ধবাসর, আমাদের প্রাণঢালা অর্ঘ্য নিয়ে তাকে অভিনন্দিত করার দিন সম্মুখেই। ভক্তবীর, সেবাভিক্ষু, কর্মসন্ন্যাসী তার আত্মাকে আমাদের প্রাণকাড়া সশ্রদ্ধ সামর্থ্য দিয়ে ধন্য হতে কেউ কি কুণ্ঠিত হব? তার সেবাকে স্মরণ করে প্রাণঢালা কৃতজ্ঞতায় তার স্মৃতিকে পূজা করতে কোন কুন্ঠ। আমাদিগকে নিরোধ করতে পারে? কৃতজ্ঞতা আমাদিগকে দীপ্ত করে তুলুক। আরও দেখতে হবে আমাদিগকে তার পরিবারবর্গের কেউ যেন কখনও অন্নবস্ত্রের অনটনে বিমর্ষ না হয়ে ওঠে। ধৃতি, ঋদ্ধি ও প্রজ্ঞা বুকের প্রাণকাড়া ভালবাসা নিয়ে ভক্ত কিশোরীমোহনের জয়গান করুক।
২৫শে বৈশাখ তোমাদেরই দীন
সন ১৩৫১ “আমি”
‘ভক্তবীর, সেবাভিক্ষু, কর্মসন্ন্যাসী’-স্বয়ং শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত এই অভিধাত্রয়ের মধ্য দিয়েই তাঁর আবাল্য সহচর, যৌবনের জ্যোতি, প্রৌঢ়ের পরম বান্ধব কিশোরীমোহনের পরিচয় শাশ্বত হয়ে থাকবে।
___________________________
#ভক্তবলয়,#শ্রীশ্রীঠাকুরের_দিব্য_লীলা🪔 https://www.amritokatha.in/ 🪔 👈Telelegram https://t.me/amritokathahttps://www.facebook.com/Amritokatha.in1
10