🔷 আমাকে ঈশ্বর ভাবে আপনাকে হীন , তার প্রেমে কভু আমি না হই অধীন ...
🔷 Libido ( সুরত ) -টা কী ?
🔷 সাধুসঙ্গ বলতে কী বােঝায় ?
২৭ শে কার্তিক , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ১২/১১/১৯৪১ )
স্নিগ্ধ - শান্ত , উজ্জ্বল হেমন্তের প্রভাত । একটু - একটু ; শীতের ভাব পড়েছে ইদানীং , বেশ রােদ উঠেছে — রোদটি বেশ মিষ্টি লাগছে । বেলা প্রায় গোটা নয়েক , শ্রীশ্রীঠাকুর তাসুতে প্রসন্নচিত্তে বসে আছেন । কাছে যারা আছেন , সস্নেহে তাদের সাথে আলাপ - সালাপ করছেন , খোঁজ - খবর নিচ্ছেন । একজনের বাড়ীতে ম্যালেরিয়া - জ্বরের সংবাদ শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যস্ত - সমস্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ প্যারীদাকে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন । বললেন — ভাল করে দেখেশুনে দরকার হ'লে ইনজেকশন দিয়ে দিও , টাকার দরকার হলে আমাকে বলো , আর চারিদিকে যেমন ম্যালেরিয়া হচ্ছে তাতে বেশ কিছু ভাল কুইনাইন ও এ্যাটেব্রিন জোগাড় করা দরকার , এখন ঘুরে আস , দেখি কী করা যায় ।
যারা উপস্থিত ছিলেন , শ্রীশ্রীঠাকুর তাদের প্রত্যেককে পইপই করে বলে দিলেন ঠিকমতো মশারি টানাতে , মশারি ভাল করে গুজে দিতে যা’তে মশা ঢুকতে না পারে , মশারি ফেলার সময় সাবধানে ফেলতে , সপ্তাহে এক - আধটা কুইনাইন খেতে আর বাড়ীর আশপাশ পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং আর সকলকে দিয়েও এটা করাবার ব্যবস্থা করতে । এরপর প্রফুল্ল জিজ্ঞাসা করলাে – কর্মহীন সচ্চিন্তা নরক কেন ? সচ্চিন্তা টুকুও তাে লাভ ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - নরক মানে কী তা জানিস তো ?
প্রফুল্ল ‘ বৃদ্ধিতে যা ’ হানি আনে , টেনে নেয় তা নরক পানে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — হ , ওতে সচ্চিন্তার একটা বিলাস পেয়ে বসে যা জীবনের কোন কাজে লাগে না , আর তাই - ই নরক । প্রফুল্ল — ঠিক যেন মাথায় ঢুকছে না , নরক কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর- Habit- এ set করেনি ( অভ্যাসে আয়ত্ত হয়নি । তাই অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে । ব্যাপারটা হয় কি , যে - সরষেকে দিয়ে ভূত ছাড়াব সেই সরষেকে যেন ভূতে পায় । যে - সচ্চিন্তা মানুষকে কল্যাণকর্মে নিযুক্ত করে , তাই তার কাছে একটা pose ( ভাওতা ) হয়ে দাড়ায় , বাইরে সাধুতার ভান ধরে মিষ্টি - মিষ্টি ভাল কথা কয় — ভিতরে থাকে active ( সক্রিয় ) দুষ্টবুদ্ধি , সেই purpose- এ ( মতলবে ) ওটা utilise ( ব্যবহার করে), একটা cheat ( জোচ্চোর ) হ'য়ে ওঠে । এমন মানুষ দেখিসনি ?
প্রফুল্ল — তাহ'লে এটা তাে একটা বিকৃতি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - হ , রীতিমতো বিকৃতি ।
২৮ শে কার্তিক , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৩/১১/১৯৪১)
শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে তসুতে বিছানায় ব'সে , ঈষদা - দা ( বিশ্বাস ) , বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) , ইন্দুদার ( বসু ) দিকে চেয়ে বলছেন — ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার দিকে interest ( অনুরাগ ) আসলে দুইজন দেখা হ'লেই কথা উঠবে — কেমন করে consolidation ( সংহতি ) আনা যায় , কোথায় কী করা যায় ইত্যাদি । কোন বৃত্তিই তখন prominent ( প্রধান ) হ'য়ে উঠতে পারে না । আপনি যদি বােঝেন , কোন জায়গায় sexually inclined ( যৌন অনিতি ) হ'লে আপনার ছেলেটা শুকিয়ে যাবে তখন আপনি যেমন কিছুতেই সেখানে সায় দিতে পারেন না , এও তেমনি হয় । এমন নয় যে প্রবৃত্তিটা নেই , ওটা পুরোমাত্রায় থাকে , কিন্তু আপনি তার অধীন নন – বরং অপিনার principle ও purpose ( আদর্শ ও উদ্দেশ্য ) fulfil ( পরিপূরণ ) করার জন্য নানাভাবে কাজে লাগান তাকে ।
প্রফুল্লকে কয়েকটা ছড়া পড়তে বললেন । পড়ার সঙ্গে - সঙ্গে সেই প্রসঙ্গে কথা চলতে লাগল — অনেকে হয়তাে বলে , আমি ধৰ্ম্ম , কৃষ্টি ওসব কিছু বুঝি না , আমি বুঝি people in general- এর interest ( জনস্বার্থ ) , এই সব লােক এমনিভাবে suffer ( কষ্টভােগ ) করছে ইত্যাদি বলে উদারতার ভান দেখিয়ে লােক - বাগানর চেষ্টা করে । এরা ভারি dangerous ( সাংঘাতিক ) —নানা কায়দায় ইষ্টস্বার্থ হনন করে । আবার , একদল হয়তাে কেষ্ট - ঠাকুরের কথা উঠতে বলবে , ‘তিনি অযোনিসম্ভব ’ , তিনি সব পারেন , আমরা দীন - হীন জীব , আমাদের কিছু করবার শক্তি কোথায় ? ভগবান আমাদের দিয়ে করিয়ে নেন না — তাই হয় না । অথচ ভক্ত বলে পরিচয় দেয় । এমনি করে মানুষের কোমর ভেঙ্গে দেয় , মানুষের normal evolution ( স্বাভাবিক উৎকর্ষ ) -এর পথ এইভাবে যারা ঘায়েল করে , তাদের চেয়ে গুণ্ডা - বদমায়েস ঢের ভাল । এরা সমাজের যে সর্বনাশ করে তার তুলনা নেই । চৈতন্যচরিতামৃতে তাই আছে — ‘ আমাকে ঈশ্বর ভাবে আপনাকে হীন , তার প্রেমে কভু আমি না হই অধীন ।
বিমলদা - তবে দাস্য - ভাবটা কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর দাস্য কথাটা এসেছে দাস্ ধাতু থেকে , আর দাস্ - ধাতু মানে দান । একজনকে তোমার সবকিছু দিলে অথচ তার রং তোমার মধ্যে কি একটুও ফুটবে না ? তোমার ছাত্র তােমাকে খুব ভালবাসে , গাড়ু - গামছা এগিয়ে দেয় অথচ পড়াশুনা করে না , একি হয় ? তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবে — তার মূল অর্থাৎ টান অন্যস্থানে , তা না করে ওখানেই যদি মার সুরু করে দাও — কোন কাজ হবে না । ছেলেপেলে যে বিড়ি - তামাক খাওয়া শেখে , তাও বিশেষ এক অবস্থায় প'ড়ে । Sex - topics- এর ( যৌন - আলােচনার আড্ডায় প'ড়ে ঐ ঘােরে প্রায়শঃই এ - সব হয় । Cinema ( সিনেমা) দেখার নেশাও অনেক সময় ঐ থেকে আসে ।
ইলুদা - অতাে ছোট বয়সে কী বোঝে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — বােঝে না মানে ! ওর উপর দাঁড়িয়েই যে জন্ম । দুই বছরের শিশু হয়তাে শুয়ে আছে , মা - বাবা চুমু খাচ্ছে , ছেলে মিটমিট করে চেয়ে দেখছে , ওর কাম হ'য়ে গেল ওখানে । তাই ছেলেপেলে বড় হ'তে - না - হ'তেই নিজেদের আলাদা থাকা লাগে । ওদের libido ( সুরত ) -কে right channel direct ( ঠিক পথে পরিচালিত ) করা লাগে । টর্চলাইটে যদি পাঁচ রকম কাচ থাকে , তবে ভেতরের একই light ( অলো ) যেকাচের ভিতর - দিয়ে pass ( চালিত ) করাবে সেই রং দেখাবে । Libido ( সুরত ) -ও ওই রকম । যে রং - এ রাঙ্গান যায় , সেই রঙ্গ - এ রঙ্গীন হয়ে ওঠে । দরদভরা বুকের টান হলাে আদত জিনিস — যার উপর তা থাকবে , মানুষ তেমনি হবে । দামাল ছেলে শিবাজী রামদাসকে পেয়ে হয়ে ওঠে emperor ( সম্রাট )।
বিমলদা- Libido ( সুরত ) -টা কী ? শ্রীশ্রীঠাকুর — যে cohesive force- এর ( সংযােজনী শক্তির ) দরুন sperm ও ovum ( শুক্র ও ডিম ) fertilised ( মিলিত ) হ'য়ে zygote form( জীবনকোষ গঠন ) করে cell - division ( কোষ - বিভাজন ) হ'তে - হ'তে মানুষ হয়ে ওঠে তার underlying magnetic current অন্তনিহিত চৌম্বক তরঙ্গ ) -ই হ'লাে libido— একে বলা যায় tendency towards unification ( মিলনের ঝোক ) , এটা অভ্যাস , ব্যবহার , ঝোকের ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে , আর এই libido চায় integration ( যােগ ) ।
হিটলার , মুসােলিনী , অশোক ইত্যাদির কথা উঠলাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন অশােকের মতো কেউ নয় । বুদ্ধদেবের প্রতি ভক্তি তাকে অতাে বড় করে তুলেছে । একজন প্রশ্ন করলেন — বুদ্ধদেবকে জীবিত অবস্থায় তিনি তো পাননি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — উপগুপ্তের ভিতর দিয়েই তিনি বুদ্ধদেবকে বোধ করেছেন ।
যেমন , রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সময় কেষ্ট ঠাকুরকে বুঝতে গেলে রামকৃষ্ণ - ঠাকুরের ভিতর দিয়ে ছাড়া বোঝার উপায় নাই ।
ইন্দুদা — অনেকে তো শুধু বিবেকানন্দকে মানে , রামকৃষ্ণদেবকে মানে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সে বিবেকানন্দকেও মানে না , সে মানে নিজের প্রবৃত্তিকে ; নিজের কোন প্রবৃত্তির support- এ ( সমর্থনে ) বিবেকানন্দ utilise ( ব্যবহার ) করে ।
★ ★ ★
প্রফুল্ল সাধুসঙ্গে নাকি সব হয় ? সাধুসঙ্গ বলতে কী বােঝায় ? শ্রীশ্রীঠাকুর — প্রথম কথা , সাধু মানে practical man ( ব্যবহারিক - বোধ সিদ্ধ - মানুষ ) আর সঙ্গ আসছে সন্জ - ধাতু থেকে , সন্জধাতুর মানে আসক্ত হওয়া । সাধুতে আসক্ত হতে গেলে যা ’ - যা করতে হয় তা - তা করাই সাধুসঙ্গ করা । তুমি আমার কাছে বসে কথা শুনতে ভালবাস , অথচ পঞ্চাশটা টাকা চাইলে বা পাঁচ হাজার মানুষ আনতে বললে সে - কাজ ভাল লাগে না — তা কিন্তু সাধুসঙ্গ নয় , বরং তখন ঐ কাজ করাই সঙ্গ করা ।
এক দাদা আর - একজনের বিরুদ্ধে অভিযােগ জানিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট বলছিলেন— Reference ( পূর্ব্বাপর) । না জেনে মাঝখান থেকে একটা কথা টেনে নিয়ে অমুক খুব fanaticism ( নিষ্ঠার গোঁড়ামি ) দেখান , ইত্যাদি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সবার মধ্যে ঘুলি ( গাঁট ) আছে — বিশেষ - বিশেষ সংঘাতে এক এক ভাবে জেগে ওঠে , আত্মপ্রকাশ করে — ভেতরের ঘুলি আবার এইভাবে কাটে । দ্বন্দ্ব বাধে , বিচার আসে , কেউ হয়তো ছিটকে যেতে চায় , কিন্তু টান থাকলে ফিরে আসতেই হয় , আস্তে - আস্তে adjust ( সামঞ্জস্য ) করে নেয়।
ধূর্জটিদা - শোনা নেই , বােঝা নেই , কথায় - কথায় কেবল আছে — ঠাকুরের নিন্দা করেছে — মাথা নেব , জুতিয়ে দেব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সে তাে আলাদা কথা , ঠাকুরের একটা চুল নড়লে সত্যি সত্যিই যদি অতোখানি হতো তবে তাে একটা বিরাট শক্তির অভ্যুদয় হয়ে যেত , তার তাে একটা অন্য দিক আছে ।
10