*Page no & topic
🔳 ধর্মঘট সম্বন্ধে-৪৭
🔳 মালিক-শ্রমিক সম্বন্ধে-৪৭
🔳 শারীরিক পুষ্টির জন্য উত্তম খাদ্য-৫১
🔳 সময়ের মর্য্যাদা-৫১
🔳 পঞ্চামৃত টনিকের থেকে বেশী কার্যকরী-৫২
🔳 শুভ-অনুশীলন-মূলক স্ফূর্ত্তির প্রবর্ত্তন করতে হয় -৫২
🔳 শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৫২
[p 46-51]
২১ শে পৌষ , সােমবার , ১৩৪৮ ( ইং ৫।১।৪২ )
প্রভাত - সৰ্য্যের দিকে মুখ ক'রে ব'সে আছেন শ্রীশ্রীঠাকুর , শাস্ত - সৌম্য ধ্যান গম্ভীর মু্র্ত্তি । চোখ চেয়েই যেন ধ্যান করছেন । কোন্ , অতলে তলিয়ে গেছে তাঁর মন । তবু , সহজ , সচেতন , সক্রিয় , সদানন্দ , পরিবেশের কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়াচ্ছে না , একেই কী বলে সহজ সমাধি চৈতন্য - সমাধি ? পূূর্ণ সমাহিতি ও পূর্ণ জাগ্রতির শুভ - সমন্বয়ই কি বর্তমানের যুগধর্ম ? আর , তাই - ই কি তিনি দেখাচ্ছেন নিজ জীবনে ? সেইজন্যই কি তাঁকে পেয়ে মানুষের এত আনন্দ , আরাম , এত আশ্বাস ? নইলে , তাঁর সান্নিধ্যলাভের জন্য কেন এই দুর্নিবার অনির্ব্বাণ ক্ষুধা মানুষের ?
হন্তদন্ত হ’য়ে ছুটে এসেছেন একটি যুবক । ছুটে এসেছেন কলকাতা থেকে । একটা কারখানায় কাজ করেন তিনি । এসে তাসুর সামনে প্রণাম করলেন তিনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর চকিতে পাশ ফিরে উত্তরাস্য হ'য়ে ব'সে সুমধুর কন্ঠে বললন কী রে , কী খবর ? অমন উসকো - খুসকো দেখাচ্ছে কেন তোকে ? ভাল আছিস তাে ?
যুবক আমরা কারখানার শ্রমিকরা আজ চার দিন হ’লো ঘর্ম্মঘাট করেছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কেন রে ?
যুবক কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবী - দাওয়ার দিকে কানই দেয় না , তাই ধর্মঘট করেছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এতে লাভ কী তােদের ?
যুবক - কারখানার লােকসান হ'লে কর্ত্তারা তখন আমাদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - কারখানার যদি লােকসান হয় , তা'তে তোদের লাভ কোথায় ? আর , তােদের বাদ দিয়ে একেবারে নতুন লােক যদি তারা নেয় , তখন তোরা করবি কী ? দেশে কি বেকার লােকের অভাব আছে যে তােমরা ছাড়া লোক জুটবে না ?
যুবক — অন্য লােক যারা ওখানে কাজ নিতে যাবে , আমরা তাদের শাসাব , ভয় দেখাব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এ তাে ভাল বুদ্ধি দেখছি ! হাগবও না , পথও ছেড়ে দেব না । মালিকের কী দোষগুণ তা নিয়ে আমি আলােচনা করছি না এবং সে যে নির্ভুল এ কথাও আমি বলি না । কিন্তু আমার মনে কয়েকটা প্রশ্ন জাগছে ।
যুবক - বলুন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ঐ কারখানার শ্রমিক হওয়ার জন্য মালিক কি তােমাদের বাধ্য করেছিল ?
যুবকতা —তা' করবে কেন ?
আমরাই কাজ খুঁজছিলাম , কাজ পেয়ে ওখানে ঢুকেছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - মালিকের সঙ্গে মাইনে ইত্যাদির যে সৰ্ত্ত ছিল , যে সর্ত্তে তোমরা ঢুকেছিলে , সে সর্ত্ত কি মালিক পুরণ করছে না ?
যুবক - তা ’ যে করছে না , তা নয় । কিন্তু যুদ্ধের বাজারে কোম্পানী লাল হ'য়ে যাচ্ছে , কিন্তু আমাদের মাগগী ভাতা ইত্যাদি যা ' দেওয়ার তা ' দিচ্ছে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - তাহ'লে তােমরা যেটা চাচ্ছ সেটা তাে দয়া । দাবী - দাবী বলছ কেন?
যুবক –দয়া কিসের ?
আমরা খেটে - পিটে মাল তৈরী করি ব'লে তো মালিকের এত ফুটানি ।
শ্রীঠাকুর ঊরুর উপর কোলবালিসটি রেখে তার উপর ভর দিয়ে ঝুকে ব'সে হাত নেড়ে বলতে লাগলেন --- আমি তাে বলি , মালিক যে তার কারখানায় তোমাদের কাজ দিয়েছে , সেইটেই দয়া । পরের কারখানায় না খেটে পেটের ভাত রোজগারের মুরােদ যদি তোমাদের থাকতাে , তাহ'লে তােমরা সেখানে ঢুকতে যেতে না। সে দয়া ক'রে তোমাদের কাজ দিয়েছে , তা'তেই তােমাদের যাহোক ক'রে পেট চলছে । পেট চলার ব্যবস্থা যে ক'রে দিয়েছে , এখন তার মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গতে না পারলে হবে কেন ?
যুবক – পেট চলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলছেন , কিন্তু সে তাে তার নিজের গরজে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — নিজের গরজেই হােক , আর যাই হোক , সে তােমাদের দ্বারস্থ হয়নি পরিশ্রম কিনবার জন্য , তােমরা তার দ্বারস্থ হয়েছিলে পরিশ্রম বেচবার জন্য । সে তোমাদের পরিশ্রম কিনে তােমাদের বাঁচার পথ ক'রে দিয়েছে ।
যুবক — তা'হলে কি আপনি বলতে চান , শ্রমিক ব'লে আমাদের মানুষের মতো বাঁচবার অধিকার নেই ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তােমার যােগ্যতা - অনুযায়ী বাঁচবার অধিকার তোমার আছে বৈ কি ? তােমার যোগ্যতা যদি থাকে ৫ পয়সার , অথচ ৫ টাকার যােগ্যতা যার আছে , তার সঙ্গে তাল ঠুকে যদি চলতে চাও , তাহ'লে চুরি , ডাকাতি বা জুলুম ক'রে তা করতে হবে । চুরি , ডাকাতি বা জুলুমকে যদি তুমি গালভরা দার্শনিক ব্যাখ্যা দাও , তাহ'লেই তার স্বরূপ বদলে যায় না ।
যুবক — এখন এই যােগ্যতার মাপকাঠি কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - মানুষের বাঁচা - বাড়ার উপযােগী পােষণ - দানের ক্ষমতা যার যেমন , তার যোগ্যতাও তেমন ।
যুবক - সেদিক দিয়ে আমার তাে মনে হয় , মালিকদের থেকে আমাদের যােগ্যতা ঢের বেশী । আমরা অন্ততঃ শারীরিক পরিশ্রম করতে পারি , তাদের কোন ক্ষমতাই নেই , কেবল পারেন বিলাসিতা করতে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- কারখানাটা চালু করতে ও চালু রাখতে যতটুকু যােগ্যতা দরকার , তা ' তাদের আছেই । অতোখানি যােগ্যতা থাকলে তােমরাও শ্রমিক না হয়ে এক - একজন মালিক হয়ে দাঁড়াতে ।
যুবক - পয়সার জোর থাকলে মানুষ সব পারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - যােগ্যতার জোর না থাকলে পয়সার জোর আসে কী করে ? অবশ্য , ফাঁকি দিয়ে যে কেউ - কেউ টাকার মালিক না হয় , তা নয় । কিন্তু সে টাকাও তারা টিকিয়ে রাখতে পারে না , বা ক্রমবর্দ্ধমান ক'রে তুলতে পারে না , যদি যোগ্যতা না থাকে ।
যুবক বাবার টাকায় যারা বাহাদুরী করে তাদের যােগ্যতাটা কোথায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - কৃতী পিতার সন্তান হওয়াটাই একটা যােগ্যতা । এর পিছনেও জমান্তরীণ কর্ম্মফল লাগে , যােগ্যতা লাগে । আবার , সন্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার যোগ্যতার খানিকটা পেয়েই থাকে , অবশ্য যদি বিবাহে কোন গােলমাল না ঘটে থাকে । কিন্তু জন্মগতভাবে যে যাই পাক না কেন , সে যদি অনুশীলন না করে , তাহ’লে তার ক্ষমতা বাড়ে না ।
যুবক- তাহ'লে কি ধর্ম্মঘট আপনি পছন্দ করেন না ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - তােমার উপর যদি কেউ ধর্মঘট করে , তাহ'লে তুমি পছন্দ কর কিনা ?
যুবক — কথাটা বুঝতে পারছি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ধর , তােমার স্ত্রী তােমাকে রান্না ক'রে দেয় , তুমি তার কোন চাহিদা পূরণ করতে না পারার দরুণ যদি সে ধর্মঘট করে , অর্থাৎ রান্না করা বন্ধ করে দেয় , তাহ'লে তােমার কেমন লাগে ?
যুবক- আমার আয় - উপর্জ্জনের প্রতি লক্ষ্য না রেখে সে যদি কোন আব্দার ধরে , তাহলে আমি তা’ পুরণ করব কেমন ক'রে ? তেমন অবস্থায় আমি যদি তার চাহিদা পূরণ করতে না পারি , তাহ'লে তাে আমার দোষ নয় , বরং সেটা তারই দোষ । তার উপর আবার যদি রান্না বন্ধ করে দেয় , সেটা তাে আরাে দোষ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর – ধর , টাকা - পয়সা সংক্রান্ত কোন চাহিদা যদি তার না থাকে , সে যদি তােমার কাছ থেকে মাত্র ভাল ব্যবহারটুকু চায় , আর , তাই যদি না পায় , এবং তার জন্য যদি রান্না বন্ধ করে দেয় , তাহ'লে কেমন হয় ?
যুবক – ওতে তাে মেজাজ আরাে খারাপ হয়ে যাবে , ভাল ব্যবহার যতটুকু পেত , তাও পাবে না । কিন্তু মালিকের ক্ষেত্রে তাে অন্য কথা , আমাদের খাটিয়ে সে অজস্র পাচ্ছে , তার থেকে সামান্য কিছু দিলেই তাে আমরা খুশি , তার তা ’ দেওয়া তো কঠিন কিছু নয় , নিজের কোন ক্ষতি না করেই দিতে পারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তুমি তাে নিজের কোন ক্ষতি না করেই তােমার স্ত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পার ।
যুবক - সব সময় কি মন - মেজাজ ঠিক থাকে নাকি ? এক সংসারে চলতে গেলে কোন - কোন সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক - আধটা খারাপ ব্যবহার হয়ে যায় , আর তার জন্য রান্না বন্ধ ক'রে দেবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - মালিক - শ্রমিকের বেলায় ব্যাপারটা এইভাবে ভাব না কেন ? মালিক হয়তাে অনেকখানি সুযােগ - সুবিধা তােমাদের দিয়েছে , কোন সময় হয়তো পারেনি এবং সেটা হয়তাে তার আর্থিক অসামর্থ্যের দরুন নয় , মানসিক অসঙ্গতির দরন । ধরলাম , তাই যদি হয় , তবে তার প্রতিকার কী ধৰ্মঘট ? তোমার মানসিক অসঙ্গতি - প্ৰসূত দুর্ব্ব্যহারের দরুন , তােমার স্ত্রী যদি তােমার প্রতি তার কত্তব্য না করে , সেখানে তাে তুমি আরাে চটে যাও , আর এক্ষেত্রে কী তােমাদের এই বেদরদী রকমে মালিকের মনটা হঠাৎ খুব প্রসন্ন হয়ে উঠবে ? আর , ধর্মঘট যদি কর , তাহলে নিজেদের কর্ম্মশক্তিকেই তো নষ্ট করতে থাকবে , তাতে লাভ কী ? আমি বলি টাকার উপর লোভ না করে মানুষের উপর লােভ কর । মালিককে ভালবাস , মালিকের ভাল যাতে হয় তাই কর । সঙ্কীর্ণ স্বার্থ বুদ্ধির দরুন , শ্রমিক যদি মালিকের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ ব'লে মনে করতে না পারে এবং মালিক যদি শ্রমিকের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ করে নিতে না পারে , তবে সেটা উভয়ের পক্ষেই দোষণীয় । যাতে পরস্পর পরস্পরের প্রতি স্বার্থান্বিত হয়ে ওঠে , প্রত্যেকের মধ্যে সেই মানসিকতা যাতে গজায় , তেমনতর যাজন চালাও । সৎসঙ্গী হিসাবে তােমার কাজ হ'লাে সেই সামঞ্জস্যবিধান ।
যুবক — আমার কথা কে শুনবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - তোমার যদি কোন হীন স্বার্থবুব্ধি না থাকে , সহকর্মী এবং মালিক সকলের প্রতি শুভেচ্ছা নিয়ে তুমি যদি চেষ্টা কর , ঠিক পারবে । ইষ্টস্বার্থ ও ইটপ্রতিষ্ঠার বুদ্ধি যদি থাকে , তবে পারবে না এমন কাজ নেই । শ্রমিক হােক , মালিক হােক , প্রজা হােক , রাজা হােক , তখনই তারা ভুল করে , যখনই তারা ইষ্টনীতি থেকে বিচ্যুত হয় । তােমাদের কাজ হলাে মানুষকে এই বিচ্যুতির সুযােগ না দেওয়া । এ বাদ দিয়ে দলবিশেষকে যতই ক্ষ্যাপাও না কেন , তা'তে সমস্যার সমাধান হবে না । শুনেছি , কোন - কোন শ্রমিকনেতা ধৰ্ম্মঘট বাধিয়ে বেশ দু'পয়সা করে নেয় ।
যুবক — তাহ'লে কী ধৰ্ম্মঘট কখনই করা উচিত নয় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর -- শ্রমিকরা যদি কখনও ধর্মঘট করে বা ধর্মঘট করবার ভয় দেখায় , তবে তা নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের জন্য করবে না , করবে বহুর স্বার্থের জন্য । মালিক হয়তাে বহ , টাকা লাভ করেছে একবার , সবরকম খরচ খরচা , ইনকাম - ট্যাক্স ইত্যাদি বাদ দিয়েও তার বহু , আছে , তাকে হয়তাে ধরলাে জনসাধারণের জীবিকা , শিক্ষা বা স্বাস্থ্যোন্নতিমূলক স্থায়ী কোন ব্যবস্থা ক'রে দিতে । সুবিধা ও সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও অর্থগৃধাতার দরুন মালিক যদি তা করতে অস্বীকার করে এবং তেমন ক্ষেত্রে শ্রমিকরা সঘবদ্ধ হয়ে যদি বলে , ‘ আমরা নিজেদের জন্য কিছুই চাই না , আমরা কষ্টেসষ্টে যেভাবে চলছি সেই ভাবে চলব , কিন্তু সাধারণের সুবিধার জন্য আপনার এটা করতেই হবে , তা যদি দয়া ক'রে না করেন , তাহলে আপনার কর্মপ্রতিষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধির জন্য আগের মতো আশুরিক সহযোগিতা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না । ' তাহ'লে সেটা দোষের কিছু হয় না । এমন - কি কল্যাণবুদ্ধি নিয়ে , অমনতর ক্ষেত্রে মালিককে সৎকাজে , সদ্ব্যয়ে বাধ্য করার জন্য যদি বাস্তবে ধর্মঘটও করে , তা'ও দোষণীয় নয় । তবে যে - কোন ক্ষেত্রে ধৰ্মঘট যত না ক'রে পারা যায় , ততই ধর্মঘট যদি করতে হয় , তবে তা ' আধশের নিরােধ এবং ধৰ্ম্ম ও কুটির প্রতিষ্ঠার জন্য । দেশের বৈশ্য শক্তি তো তাও ব্রাহ্মণ্য - শক্তিকে মান্য করে না , বরং দায়ে পড়ে রাজশক্তি ও শূদ্রশক্তিকে ( শ্রমশক্তি ) খাতির করে চলে , অন্তত৩ঃ এই শূুদ্র শক্তিও ও যদি বৈশ্যশক্তিকে ধর্ম ও কৃষ্টিপোষোনার্থে দানে প্রবুদ্ধ করে তোলে , সেও একটা মস্ত লাভ। এতে সবারই কল্যাণ হবে । নইলে , বৈশ্যশক্তি ও শূদ্রশক্তির যদি বিত্ত বাড়ে অথচ চিওরে দৈন্য না ঘোচে , তাহলে এ বিত্ত তার অনর্থই ঘটাবে , কদৰ্য্য গ্লানিরই সষ্টি করে তুলবে । তােমাদের এই আন্দোলনকে যত বাড়িয়ে তুলতে পারবে , ততই মানুষের চিত্ত - সম্পদ ও চরিত্র সল্পদ বেড়ে যাবার সম্ভাবনা ।
[P 51-54]
বেলা এখন সাড়ে আটটা । আশ্রম - প্রাঙ্গণ রােদে ছেয়ে গেছে । এখানে ওখানে এক - এক দল মিলে শীতের সকালে মিষ্ট রৌদ্র উপভােগ করছে । ডিসপেন্সারী , ফিলানথ্রপি অফিস , তরকারীর বাজার , কলতলা সর্বত্রই এখন কর্মতৎপরতা । শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছেও অনেকে জমায়েৎ হয়েছেন । এই দিব্য পরিবেশের মাধুর্য্যটুকু সব হৃদয় দিয়ে আহরণ করছেন । বকুল , বাবলা , বনঝাউ ও সােনালের ডালে - ডালে পাখীগুলি নেচে - নেচে খেলা করছে , আনন্দে কলরব করছে । গরু - ছাগলগুলিও স্বছন্দ মনে চরে বেড়াচ্ছে মাঠে । কয়েকটা কুকুর রোদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে । উদ্ধের্ব নিৰ্ম্মল , নীল আকাশ , চারিদিকে যেন শান্তি - সমীরণ বইছে । সকলেই তাঁর সঙ্গসুখ - উপভােগে রত । তনুমনপ্রাণ ডুবিয়ে দিয়েছে তাঁর সান্নিধ্যপূত এই সুধাস্রোতে । পরিতৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার রসঘন ছন্দে লীলায়িত তাঁর দেবদেহ , অঙ্গে - প্রত্যঙ্গে অমিয় - লাবণ্যের ললিত উল্লাস , তাই যতই দেখছে ততই বুক ভ'রে উঠছে অনিৰ্ব্বচনীয় আনন্দে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর পাশ ফিরে ব'সে জিজ্ঞাসা করলেন -- আজ কত তারিখ রে ?
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য্য ) -আজ ৫ ই জানুয়ারী ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - একটা বছর পিছনে ফেলে এসে আবার নতুন বছরে পা দিলাম , তা'ও পাঁচ দিন হয়ে গেল । এইভাবে দেখতে - দেখতে ৩৬৫ দিন কেটে যাবে । এই বছর হয়ে যাবে পুরােণ বছর , আবার নতুন বছর সুরু হবে । কালের পরিক্রমা কাউকে খাতির করে না । বুদ্ধিমান সেই যে এই সময়কে বিফলে যেতে না দেয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার বললেন -- রােদে যেয়ে বসি , কী বলিস ?
সকলে বললেন -- হ্যাঁ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বেরিয়ে বেশী দূর অরি গেল না , শ্রীশ্রীমায়ের কুটিরের পাশে একটা চেয়ারে বসলেন । গাডু় - গামছা ইত্যাদি ওখানে নিয়ে আসা হলাে ।
শ্রীশদা ( রায়চৌধুরী ) . শরীরের পুষ্টির জন্য কোন খাদ্য আপনি সব চাইতে ভাল মনে করেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর --- আমার মনে হয় , হবিষ্যান্নের মতো পুষ্টিকর খাদ্য কমই আছে । ওতে আতপ চাল , কাচকলা , ডালবাটা , তিলবাটা , ঘি , দুধ , কলা ইত্যাদি যে - সব জিনিস খাওয়া হয় , আমার মনে হয় , তাতে আর বিশেষ কোন deficiency ( খাকতি) থাকে না , তবে টাটকা শাক - সব্জী ও ফলও কিছু - কিছু খাওয়া ভাল , অবশ্য ব্রত হিসাবে হবিষ্য যখন করা হয় তখন নয় । এ - সব বলছি উচ্চাঙ্গের কথা । আমার মনে হয় , মানুষ কঠোর পরিশ্রম যদি করে , নাম যদি ঠিকমতো করে , মানসিক শান্তি যদি থাকে , তবে স্রেফ ডাল - ভাত খেয়ে হজম করতে পারলে তা থেকেই যথেষ্ট পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারে । আর , মানুষ যে দামী - দামী টনিক ইত্যাদি খায় , আমার মনে হয় , পঞ্চামৃত ( দধি , দুগ্ধ , ঘৃত , মধু , চিনির মিশ্রণ ) খেয়ে যদি হজম করতে পারে , তা'তে অনেক টনিকের থেকে বেশী কাজ দেয় । জিনিসগুলি যদি খাঁটি হয় , তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই হজম হবারই কথা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর শৈলমাকে দেখে হেসে - হেসে মাথা দুলিয়ে - দুলিয়ে বলছেন বুককুলু ! বুককুলু !
শৈলমা একগাল হেসে ফেললেন । আহ্লাদে ডগমগ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তুই নৌকাবাইচ দেখিছিস ?
শৈলমা — অল্প - সল্প ।
শ্রীশদা প্রভৃতি তখন গল্প করতে লাগলেন , পূৰ্ব্ব বঙ্গে নৌকাবাইচ উপলক্ষে কত আমােদ - আনন্দ হয় , সমস্ত লােক কত মেতে ওঠে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — শুভ - অনুশীলনমূলক স্ফূর্তির প্রবর্তনা যত করা যায় , ততই ভাল । এতে মানুষের instinct ( সহজাত সংস্কার ) -গুলি nurture ( পােষণ ) পায় ।............ নষ্টচন্দ্রার দিন যে চুরি করে , এ প্রথাও আমার ভাল ব'লে মনে হয় । গৃহস্থ সজাগ রয়েছে , তা সত্ত্বেও তার দৃষ্টি এড়িয়ে তার বাড়ীর বাতাবী , শসা , নারকেল , কলা কি আর পাঁচটা জিনিস নিয়ে আসা কম চাতুর্য্যের কথা নয় । ধর , তুমি হয়তাে যুদ্ধে গেছ , সেখানে শত্রু - শিবিরে ঢুকে সুকৌশলে তােমার কতকগুলি কাজ বাগিয়ে নিতে হবে । ঘরােয়াভাবে এইগুলি যদি তুমি পার , ওগুলি পারাও তােমার কঠিন হবে না । জীবনের এমনি আছে একটা সহজ চলা আর একটা আছে বিপদ , আপদ , দুর্দ্দশা , দৈবদুর্ব্বিপাক , শত্রুতা , যড়যন্ত্র , দাঙ্গা - হাঙ্গামা , যুদ্ধবিগ্রহ , মহামারী , দুর্ভিক্ষ , রাষ্ট্রবিপ্লব , প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি chiergency ( জরুরী অবস্থা ) -র মধ্যে চলা । কার যে কখন কোন অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে তার কিছুই ঠিক নেই । সেইজন্য প্রস্তুত থাকা লাগে সব অবস্থার জন্য , যা'তে আকস্মিক কোন দুরবস্থার মধ্যে প'ড়ে আমরা নিশ্চিহ্ন হ'য়ে না যাই । যে - শিক্ষা আমাদের শুধু , সুময় ও সুখের জন্য প্রস্তুত করে , অথচ দুঃসময় ও দুঃখের জন্য প্রস্তুত করে না , সে - শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয় । শিক্ষা প্রস্তুত ক'রে তুলবে আমাদের সমগ্র বাস্তবতার জন্য , সেই বাস্তবতা কোন ধরাবান্ধা পথে চলে না , তার মধ্যে থাকে অনেক বৈচিত্র্য , অনেক জটিলতা , অনেক ভালমন্দ সম্ভাবনা । তার সবখানির জন্য তৈরী হতে হয় ।............ আমার পড়াশুনাের জীবনে আমি যে কঠোর দুঃখ - দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি , তা আমাকে অনেকখানি ঠিক করে দিয়ে গেছে । অতোখানি চরম অবস্থার মধ্যে না পড়লে মানুষের কষ্ট আজ যেমন ক'রে বুঝতে পারি , তা বোধ হয় পারতাম না । আমার নাম অনুকুল বটে , কিন্তু জীবনের প্রায় প্রতি পদক্ষেপে আমাকে প্রতিকূলতার পাহাড় কেটে এগােতে হয়েছে । আমার জীবনের একমাত্র নেশা ছিল মাকে খুশি করা । আমার বুদ্ধি - বিবেচনা - শক্তিমতাে বরাবর সেই চেষ্টা করেছি । আমার লােভ ছিল , মা’র কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার , তাঁর আদর পাবার । কিন্তু মা ছিলেন আমার প্রতি বড় কড়া , তাঁর শাসন ও ভৎর্সনা পেয়েছি অজস্র , তাঁর সােহাগের জন্য ক্ষুধা থাকলেও তেমন পাইনি তা ' । তাহ’লে কী হবে ? মা ছাড়া যে আমার অচল । মা যতই অসন্তুষ্ট হউন , রুষ্ট হউন , কেবল এফাঁক করতাম , কেমন করে মাকে তুষ্ট করব । ঐ ছিল আমার ধান্ধা । প্রতিকূল অবস্থায় হাল ছেড়ে দেবার বুদ্ধি আমার কোনকালে হয় না । তখন আমার গোঁ চেতে যায় , কেমন করে সেটাকে আয়ত্তে আনব । ছেলেবেলায় পাড়ার সকলেই ছিল আমার অভিভাবক । খামকা কতােজনে কান চেপে ধ'রে দুটো চড় দিয়ে ছেড়ে দিত । সেখানে দোষ হয়তাে আমার কিছুই নেই । অন্য কারওঁ দোষের কথা যে ক’ব , তা'ও আমার কখনও মন চাইত না । অনেকে আজেবাজে কথা মা'র কাছে এসে লাগাত । মাও চালাতেন একচোট । এইরকম যতই ঘটুক , আমি কখনও হতাশ হতাম না , নিরাশ হতাম না । ভাবতাম , আমি আমাকে এমন করে তৈরী করব , এমনভাবে চলব , যা'তে এর অবকাশ না ঘটে । স্কুলে মাষ্টারদের কাছে মারও কম খাইনি । একবার এক আর এক দুই হয় কী ক'রে এই কথা জিজ্ঞাসা করে তাে প্রাণ যায় আর কি ? মাষ্টার মশায় ভাবলেন — আমি তাঁকে ঠকাবার জন্য না - বােঝার ভান করছি , কিন্তু আমি যে বুঝতিছি না সেটা কেমন ক'রে বােঝাব । আমার কাছে সমস্যা দাঁড়ালাে , কোন দুটো জিনিস তাে একরকম দেখি না । এমন অবস্থায় এক আর এক দুটো এক হ'লাে , এ বরং বলা যায় , কিন্তু দুই হ'লাে এ - কথা বলি কী করে ? আমার কথা কে শোনে ? মারের পর মার । দোয়াড়ে মার । কলকাতায় পড়ার সময় দিনের পর দিন কলের জল খেয়ে , ফুটপাথে শুয়ে কতদিন কেটে গেছে । ছুটিতে বাড়ী এসে যে দুদিন থাকব , ভালমন্দ খাব , তারও উপায় ছিল না । পাড়ার লােকে বলতো , বউয়ের টানে আসে , বেশী দিন বাড়ী থাকলে পড়াশুনা নষ্ট হয়ে যাবে । মা - ও ব্যস্ত হয়ে পড়তেন । ফিরে যেতাম কলকাতায় । ডাক্তারী যখন সুর করলাম , স্থানীয় ডাক্তাররা প্রাণপণ শত্রুতা করছে । বিধিমতাে চিকিৎসা ক'রে রােগ সারলেও তারা বলতাে — আমি তুক ক'রে রােগ সারিয়েছি । বসন্ত চৌধুরী প্রভৃতি ফাঁক পেলেই মানুষের সামনে অপমান করে ছেড়ে দিতেন । তাদের ঐ অপমান আমি গায় মাখতাম না । যে আমার বিরুদ্ধে যতই বলুক , কারও বিরুদ্ধে কিছু বলবার মতাে আমার কখনও মন হতাে না । কারও বিরুদ্ধে বলব কী ? কোন রােগী হাতে নিলে তাকে ভাল করবার জন্য প্রাণ ছটফট করতাে , সেই ধান্ধাতেই আমি অস্থির । বার - বার রােগীর বাড়ী গেলে , পাছে রােগীর বাড়ীর লোক কিছু মনে করে , সেইজন্য রােগীর বাড়ীর কাছ দিয়ে ঘুরতাম , ভাবতাম - একবার ডাকলে আর একবার যেয়ে রােগীর অবস্থাটা দেখে আসি , তাকে আর একবার সাহস - ভরসা দিয়ে আসি । টাকার জন্য আমি কোন দিন ডাক্তারি করিনি , কিন্তু টাকা আসতাে খুব । অবস্থা খারাপ দেখলে তার কাছ থেকে টাকা নিতাম না , বরং ওষুধ - পথ্যের জন্য গাঁটের থেকে টাকা খরচ করতাম । এ করতাম নিজের স্বস্তিরই গরজে । পরে এমন হ'লাে , যারা আমার নিন্দা করতাে , মানুষ তাদের তাড়া করতাে । আশ্রমের গােড়ার আমল থেকে এ পর্যন্ত বাধা কম পাইনি । শক্তি - মন্দির তাে ঐ তালেই আছে । তবে এ - গলিতে আমার তত মন খারাপ হয় না , যত মন খারাপ হয় আপনাদের বেচাল দেখলে । তামি আদেখলে মতাে আছি , চিরদিন আমি ভালবাসার কাঙ্গাল । ভালবাসার নামে যেখানে দেখি ব্যবসাদারী , কাপট্য , সেখানে আমার মন খিচড়ে যায় । সত্যিকার ভালবাসা যেখানে সেখানেই থাকে প্রিয়ের মননামতাে চলন , চিন্তা , ব্যবহার , আত্মনিয়ন্ত্রণ । আপনারা অনেকেই আমার জন্য ঢের করেন , কিন্তু নিজেদের প্রবৃত্তির গায় হাত দেন না । আমার জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ও প্রবৃত্তিকে কতখানি অতিক্রম করতে পারেন , সেইটে হ'লাে ভালবাসার মাপকাঠি । কিন্তু অনেকেরই দেখি অহঙ্কার , অভিমান বা স্বার্থে এতটুকু চোট লাগলে পীরিত চটে যাওয়ার মতো হয় । তাই , আমার হিসেব করে আপনাদের তােয়াজ ক'রে চলতে হয় । এতে কি সখু হয় ? না , আপনাদেরই কল্যাণ হয় এতে ? তবে আমি বেহায়া , নাছোড়বান্দা । যে যাই করুক , তার ভাল না করতে পারলে আমার নিস্তার নেই । এতে আমার নিজের উপর দিয়ে অনেকখানি চোট যায় । তবে আমার শান্তি ও সান্ত্বনা এইটুকু যে , আপনাদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ ভালবাসার টানে সত্যিই adjusted ( নিয়ন্ত্রিত ) হ'য়ে উঠছে । সেই মানুষগুলিকে দেখবেন — তারা পরিবেশের সঙ্গেও শুভ সঙ্গতি নিয়ে চলে- অন্যায়ের সঙ্গে আপােষ - রফা না ক'রেও । যারা একটু পথে দাঁড়ায় , তারা সবারই সত্তাপােষণী হয়ে ওঠে , দরকচা - মরা যেগুলি সেগুলি কেবল বেগ দিয়ে মারে ।
10