🎗️ প্রায়শ্চিত্ত মনে কী ?
🎗️ পাপ মানে কী ?
🎗️ নারীর স্বাধীনতা ও শিক্ষা...
🎗️ 'লজ্জা' মানে..?
🎗️ নারী অসতী হয় কেন?
🎗️পুরুষ দ্বিতীয়া স্ত্রী-গ্রহণে তো অসৎ হয় শোনা যায় না!-কেন?
🎗️ পতিত' বলতে কী বুঝায়?
২১শে এপ্রিল, ১৯৩৪
[P 93-100]
প্রশ্ন। নারীর একবার কোনোরকমে অনিচ্ছাকৃত পদস্খলন হইলেও তাহাকে বর্জন করার জন্য সমস্ত সমাজ যেন বদ্ধপরিকর হ'য়ে ওঠে-তার ফলে সেই নারীর সর্বনাশের পথই তো মুক্ত হয়! এইরূপ নারীর সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করলে ঠিক হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর। অনিচ্ছাকৃত পদস্খলনও যেখানে, বুঝিতে হইবে সেখানে self-preservation-এর (আত্মসংরক্ষণের) sufficient intelligence-এর (যথেষ্ট ধীশক্তির) অভাব। এমনতর-স্থলে তাহাকে বর্জন না করিয়া, আশ্রয় দিয়া যাহাতে সে নিজেকে রক্ষা করিবার বা অন্যকে রক্ষা করিবার উপযুক্ত সামর্থ্য লাভ করে, তাহার ব্যবস্থা করাই উচিত। -শাস্ত্রে প্রায়শ্চিত্তের বিধি দিয়া গ্রহণের উপদেশ করা আছে *। কিন্তু যাহারা মোটেই পদস্খলন করে না, তাহাদের চাইতে less esteemed (কম আদরণীয়) হওয়া স্বাভাবিক। 'প্রায়শ্চিত্ত' মানে বোঝেন তো? প্রায়শ্চিত্ত বলিতে আমি বুঝি-অনুতপ্ত হইয়া কেমন-করিয়া ইহা হইল, চিন্তা দ্বারা তাহা ধার্য্য করিয়া তাহার নিরাকরণ-প্রতিষ্ঠা।
প্রশ্ন। ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। প্রায়শ্চিত্ত বলিতে প্রায়শঃ কতকগুলি বাহ্যিক অনুষ্ঠানই তো দেখা যায়! ইহার প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। 'পাপ' মানে যে-আচরণ বা চিন্তায় মন ও শরীরকে অবসন্ন বা রুগ্ন করিয়া জীবন ও বৃদ্ধিকে খিন্ন করে। আর, এই পাপের উদ্ভব অজানা হইতে; কারণ, কেহই জীবন ও বৃদ্ধি হইতে বঞ্চিত হইতে চায় না-ইহাই প্রকৃতি। তাহা
_____________________________
* "বন্দিগ্রাহেণ যা ভুক্তা হত্বা বদ্ধা বলাদ্ভয়াৎ।
কৃত্বা সান্তপনং কৃচ্ছ্রং শুধ্যেৎ পরাশরোহব্রবীৎ ।।”
-পরাশর-স্মৃতি, ১০/২৫
অর্থাৎ, বন্দী করিয়া লইয়া গিয়া কিংবা হত্যার ভয় দেখাইয়া, বন্ধন করিয়া কিংবা বলপ্রয়োগ করিয়া বা অন্য কোন প্রকার ভয় দেখাইয়া যদি কেহ নারী উপভোগ করে, তাহা হইলে পরাশর বলিয়াছে কৃষ্ণ সান্তপন প্রায়শ্চিত্ত করিলেই সে নারী শুদ্ধি লাভ করিবে।
হইলেই প্রায়শ্চিত্ত সে-অজ্ঞানকে দূর করিয়া শরীর ও মনের শুশ্রুষা করিয়া মানুষকে সুস্থ করিয়া তোলে-তাই প্রায়শ্চিত্তের বিধি। প্রায়শ্চিত্ত মানে-চিত্তে গমন করা *, অর্থাৎ, কেমন-করিয়া সে-দোষ চিত্তে ঢুকিয়াছে, চিন্তা করিয়া বাহির করিয়া তাহার নিরাকরণ করা। তাই, বিধি আছে-প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইলে মন্ত্রজপ ও অনুতাপ, আহারের সংশোধন-যেমন চান্দ্রায়ণ (ক্রমে কমাইয়া ক্রমে বৃদ্ধি) ইত্যাদি, ঔষধ প্রয়োগ- যেমন বিল্বমূল, শঙ্খপুষ্পী, ব্রাহ্মী, কুশজল, গোমূত্র, পঞ্চামৃতপান ইত্যাদি।
আর, এই প্রায়শ্চিত্ত যাহাতে সম্যভাবে মস্তিষ্কে আশ্রয়লাভ করে তাহার জন্য বাহ্যিক ব্যবস্থা। আমরা যদি কোনপ্রকার ইচ্ছা করি, আর তাহা যদি পারিপার্শ্বিক হইতে infused (সঞ্চারিত) না হয় তবে সে-ইচ্ছা আমাদের চরিত্র ও কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করিতে পারে না। তাই বোধহয়, প্রায়শ্চিত্তে-অন্ততঃ অনেকের জন্য-বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের বিধি-ব্যবস্থা আছে।
প্রশ্ন। উচ্চশিক্ষা দিতে গেলেই নারীকে কতকটা স্বাধীনতা তো দিতেই হবে, আবার স্বাধীনতা দিতে গেলেও তো বিপদের সম্ভাবনা! এর উপায় কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। নারীর নারীত্বকে কেন্দ্র করিয়াই তাহাদের স্বাধীনতা ও শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে।
নারীর তো উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন বটেই! কারণ, পুরুষকে তাহার সর্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে হয়। তাহা-ছাড়া, তাহাদের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত-তাহারা যেন সর্বতোভাবে তাহাদের service (সেবা) দ্বারা সংসারের সকলের প্রহর্ষণ, পুষ্টি, উদ্বর্দ্ধন ইত্যাদি করিতে পারে†।
___________________________
* প্রায়শ্চিত্ত-অর্থাৎ চিত্তে গমন করা। প্র-অয়-ধাতু (গমন) হইতে প্রায়ঃ।
শাস্ত্রে অনেক রকম প্রায়শ্চিত্তের বিধান আছে।
† "All such knowledge should be given her as may enable her to understand, and even to aid the work of men....I believe, then, that a girl's education should be nearly, in its course and material of study, the same as a boy's; but quite differently directed. A woman in any rank of life ought to know whatever her husband is likely to know, but to know it in a different way. His command of it should be fundamental and progressive; hers, general and accomplished for daily and helpful use.
প্রশ্ন। দেশে নারীর উচ্চশিক্ষা বলিতে যা' চলিতেছে, আপনি কি এইরূপ উচ্চশিক্ষার পক্ষপাতী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। শিক্ষা পুরুষ ও নারীর সমানভাবেই চলা উচিত-বৈশিষ্ট্য হইবে তাহাদের উভয়ের বৈশিষ্ট্যে। যদি শিক্ষা এমনতর হয় যাহাতে নারীর বৈশিষ্ট্যকে ব্যাহত করে, তবে তাহা সর্ব্বতোভাবে পরিত্যাজ্য, কারণ, ইহাতে অস্বাভাবিকতা আসে, আর এই অস্বাভাবিকতা হইতে উচ্ছৃঙ্খলতা জন্মে,-আর তাহা হইতে জাতি ও সমাজের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষাক্ত হইয়া ওঠে।
প্রশ্ন। ভারতে তো অবরোধ-প্রথা ছিল না! অবরোধ-প্রথার প্রবর্তন হইল কেমন-করিয়া? ইহার উদ্দেশ্য বা কী ছিল? আর তাহার পরিণামই বা কী হইল?
শ্রীশ্রীঠাকুর। অবরোধ অস্বাভাবিক, তেমনি, স্বেচ্ছাচারিণী হইয়া পুরুষের সহিত অবাধ মিশ্রণও ভয়াবহ ও দোষাবহ; কারণ, তাহাতে
_______________________________
Speaking broadly, a man ought to know any language or science he learns thoroughly, while a woman ought to know the same language or science only in so far as may enable her to sympathise in her husband's pleasures, and in those of his best friends. -Ruskin
অর্থাৎ, নারীকে এমন শিক্ষা দিতে হইবে যাহাতে পুরুষের কার্য্য বুঝিতে এমন-কি তাহাকে সাহায্য করিতে পারে। সুতরাং আমার বিবেচনায় নারীর শিক্ষা পঠনীয় বিষয়ে পুরুষের সমানই হওয়া বিধেয়, কিন্তু নারীর শিক্ষা হইবে বিভিন্ন প্রকৃতির। স্বামী যাহা-কিছু জানে, স্ত্রীরও তা' সবই জানা উচিত কিন্তু পৃথক রকমে... যাহাতে স্বামীর সুখ ও কর্মে সহানুভূতি করিতে সক্ষম হইতে পারে। -রাসকিন
* "The more absolutely the woman is segregated to sex-functions only, cut off from all economic use and made wholly dependent on the sex-relations....the more pathological does her motherhood become. The over development of sex caused (in this way) reacts unfavourably on her essential duties. She is too female for the perfect motherhood."
'Women and Economics'-Mrs. Stetson
অবরোধ যত কঠিন হয়, নারীর বর্হিজগৎ হইতে বিচ্ছেদ তত গভীর হয়-ফলে, নারীর দ্বারা কোন অর্থনৈতিক প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না-কেবলমাত্র যৌন ব্যবহারই মুখর হইয়া ওঠে, সুতরাং নারীর মাতৃশক্তি তত রুগ্ন হয়-যৌনবৃত্তির অত্যধিক পুষ্টি হওয়ার দরুণ তার প্রতিক্রিয়া তাহার সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য-সাধনের পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ হইয়া দাঁড়ায়। সে এত বেশী নারী হইয়া ওঠে যে পূর্ণ মাতৃত্ব তাহার আসিতেই পারে না।
atachment (আসক্তি) বিক্ষিপ্ত হইয়া ওঠে, বহু পুরুষে কামচিন্তা জাগিয়া উঠিতে পারে, স্থৈর্য্যহানি হয়, এবং তাহার ফলে দুষ্ট, দুর্ব্বল ও জড় প্রকৃতি (nature) জন্মগ্রহণ করে, আর তাহা জাতি ও সমাজের প্রভূত অকল্যাণকর। যখন সমাজে উক্ত ভয়াবহ দোষের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়াছিল, তখনই অবরোধ-প্রথার সৃষ্টি হইয়াছিল-অভিপ্রায় ছিল জাতি ও সমাজকে ক্রম-মরণের হাত হইতে রক্ষা করা।
প্রশ্ন। নারীর কিরূপ শিক্ষার বন্দোবস্ত হইলে অবরোধের প্রয়োজনই থাকে না?
শ্রীশ্রীঠাকুর। মেয়েদের শিক্ষার ভিতর-দিয়া এমন সংস্কার জন্মাইতে হয় যাহাতে জাতি, বর্ণ, বংশ, বিদ্যা ইত্যাদি বিবেচনা না করিয়া কাহাকেও পতিত্বে বরণ না করে, -আর, অন্যায্য ও অবাধ পুরুষ-সংমিশ্রণকে ঘৃণার চক্ষে দেখে। শ্রেষ্ঠকে কেমন-করিয়া কি-ভাবে বরণ করিতে হয়, শ্রেষ্ঠকে কি-করিয়া চিনিতে হয়, শ্রেষ্ঠের প্রতি সহজ admiration (শ্রদ্ধা) ইত্যাদি বিশেষভাবে স্ত্রীশিক্ষার অঙ্গীভূত করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন। লজ্জা নাকি নারীর শোভা-তা'র মানে কী? লজ্জা তো সঙ্কোচেরই নামান্তর মাত্র! অথচ লজ্জা যেন নারীর প্রকৃতিগত! লজ্জা কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। 'লজ্জা' মানে সঙ্কোচ কিনা জানি না। আমার মনে হয়, এমনতর একটা mood (ভাব) যা'তে নাকি passive (গ্রহণমুখী) অথচ honourable-এ inclined (সম্মানিত ব্যক্তির নিকট আনত) করিয়া তোলে, যা'র ফলে মানুষ তা'র প্রতি actively attentive হয়, অর্থাৎ, তৎপরতার সঙ্গে অবহিত হয়; তাই, লজ্জায় আছে regard (শ্রদ্ধা), submissiveness (আনতি)- অথচ serious (গম্ভীর)। লজ্জা, যাকে লজ্জা করে, indirectly, unconsciously (পরোক্ষভাবে, অজ্ঞাতসারে) তা'র সর্বাঙ্গ ও হাবভাব দিয়ে ব'লে দেয়-তুমি মহান, তুমি আশ্রয়, তুমি বল। তাহ'লেই যে mood (ভাব) মানুষের ভিতরে অমনতর একটা ভাবের সৃষ্টি করে, তা'র ফলে-যা' হ'তে সে লজ্জিত হয়-সে indirectly encouraged হয় (পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত হয়), active হয় (তৎপর হয়), এবং তাকে সম্মান করার, স্নেহ করার, সাহায্য করার প্রবৃত্তি unconsciously (স্বতঃই) জাগিয়া ওঠে। তবেই লজ্জা যদি এই হয়, এ তো শ্রেষ্ঠ অলঙ্কারই,-আর, এ পুরুষের পক্ষেও! নারী naturally passive (স্বভাবতঃ গ্রহণমুখী)-তাই, তাদের লজ্জাও প্রকৃতিগত হওয়া উচিত। আর, অন্যায় বা অপকর্ম হ'তে যে অবস্থা হয় তাকে লজ্জা বলতে ইচ্ছা করে না, বরং সঙ্কোচ বললে মন্দ হয় না।
প্রশ্ন। নারী অসতী হয় কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর। স্ত্রীর বৃত্তিগুলি যখনই পুরুষের বৃত্তির পরিপোষিকা, পরিবর্দ্ধিকা হইয়া সুখী না হয়, তখনই সে জীবনের ভিতর একটা অস্বচ্ছন্দতা ও যন্ত্রণা বোধ করে। আর, এই যন্ত্রণাকে যে-নারী যখনই নিরাকরণ না করিয়া চিন্তা দ্বারা আরো পুষ্ট করিয়া তোলে তখনই তাহা সেই স্ত্রীর মনকে তৃপ্তির পথে চালিত করে। অতএব সে তখন-যেখানে তাহার সার্থকতা লাভ করিবে বিবেচনা করে-সেখানে inclined হইয়া বা ঝুঁকিয়া পড়ে *।
প্রশ্ন। পুরুষ এক-স্ত্রী থাকা-সত্ত্বে দ্বিতীয়া স্ত্রীর সহিত মিলিত হইতে চায় কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর। সাধারণতঃ পুরুষের কোন স্ত্রীর সহিত মিলিত হওয়ার চিন্তাই অবমাননা-সূচক-তার ইচ্ছাগুলিকে আদর্শের দিকে নিয়ন্ত্রিত করাই সার্থকতার
______________________________
* "Love is what gives intrinsic value to a marriage...... It is one of the supreme things which make human life worth preserving.
"Nothing is so destructive of instinctive liking as thwarted purposes and unsatisfied needs; and nothing facilitates co-operation......so much as companion, instinctive liking.
"Large numbers of men and women are condemmed to the society of an utterly uncongenial, with all the embittering consciousness...In these circumstances, happier relations with others are sought."
'Principle of Social Reconstructions'-Russell
ভালবাসা বিবাহে আসল জিনিস, ইহাই মানুষের জীবনকে বাঁচিবার যোগ্য করিয়া রাখে। উভয়ের সহজ অনুরাগ আর-কিছুতেই তেমন নষ্ট হয় না, যেমন হয় উদ্দেশ্য ব্যাহত হইলে আর আকাঙ্ক্ষা অতৃপ্ত হইলে।
অনেক লোকই জীবনের পক্ষে প্রতিকূল সঙ্গীর সহবাসে থাকিতে বাধ্য হয়-তার ফলে, কত-না যন্ত্রণাগ্রস্ত হইয়া জীবন কাটাইতে হয়। এই রকম অবস্থায়ই মানুষ-যাহার সঙ্গে এর চেয়ে বেশী সুখ পাইবে বলিয়া মনে করে-তাহার দিকে ধাবিত হয়। ---রাসেল
পথ। এমনতর অবস্থায় সে যদি বহু স্ত্রী দ্বারা বরিত হয়, তাহাতে কিছু আসে-যায় না। তাহা না হইলে স্ত্রীরও যে-কারণে অন্য পুরুষে আসক্তি হয়, পুরুষেরও পুরুষযোগ্য রকমে অন্য স্ত্রীতে আসক্তি জন্মে।
প্রশ্ন। নারী পুরুষান্তর-গ্রহণে অসতী হয়, পুরুষ দ্বিতীয়া স্ত্রী-গ্রহণে তো অসৎ হয় শোনা যায় না!-কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর। পুরুষ যদি আদর্শত্যাগী হয় তবে সে অসৎ হয়; আর, স্ত্রীর তাহার পুরুষকে আদর্শে উন্নীত করাই সার্থকতা। সে আদর্শকে পাইতে চায়, দেখিতে চায়-তাহার পুরুষের ভিতর-দিয়া। তাহা-হইলেই স্ত্রীর মুখ্য কেন্দ্র স্বামী বা পুরুষ, তাহা হইতে বিচ্যুতি তার অসতীত্ব।
প্রশ্ন। 'স্ত্রী আদর্শকে দেখিতে চায় স্বামীর ভিতর দিয়া'-এর মানে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। অর্থাৎ, সে দেখতে চায় তার আদর্শের will ও wishes (ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিগুলি) তার স্বামী দ্বারা fulfilled (সার্থক) হচ্ছে কি-না-আর সেই আদর্শে অনুরঞ্জিত করাই স্ত্রীর সহধর্মিণীত্বের সার্থকতা।
প্রশ্ন। 'পতিত' বলতে কী বুঝায়?
শ্রীশ্রীঠাকুর। পতিত সেই-যাহার আদর্শ হইতে বিচ্যুতি ঘটিয়াছে, অর্থাৎ detached from the Unit or Ideal.
প্রশ্ন। তাহ'লে তো পুরুষ ও নারী উভয়েই পতিত হ'তে পারে! তবে আমাদের দেশে বর্তমানে শুধু নারীই পতিতা হয় কেন? পতিত পুরুষের কথা তো আজকাল শোনাই যায় না?
শ্রীশ্রীঠাকুর। তাহ'লে বোধ হয় বর্তমানে পুরুষের আদর্শের বোধই কম-তাই তা'র প্রশ্ন নাই; অতএব অসৎ বা পতিত হওয়ার প্রশ্নও নাই। আর, প্রত্যেক পুরুষ দাবী করে সে স্বামী, স্ত্রীরাও জানে আমার স্বামী আছে, তাই তা' হ'তে বিচ্যুতি ঘটলেই পতিত হ'য়ে পড়ে।
প্রশ্ন। পতিতা হইলে তাহাদের উদ্ধারের উপায় কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। যাহারা পতিতা, তাহাদের আসক্তির বিশ্রামের স্থান নাই-অতএব বিক্ষিপ্ত। আর, আসক্তি যাহাদের বিক্ষিপ্ত, তাহারা দুর্ব্বল-অকল্যাণকারিণী-মৃত্যুর নিমন্ত্রণকারিণী। তাই, তাহাদের দোষ যেখানে supported হয় (সমর্থিত হয়), সেখান হইতে তাহাদের দূরে থাকা উচিত। আর, যাহারা মানুষকে ভালবাসিয়া-যে-দোষে পতিত করিয়াছে তাহা পরিহারের সাহায্য করে এবং যাহাদের সংসর্গে বিক্ষিপ্ত আসক্তি কেন্দ্রীভূত হয়, তাহাদের সঙ্গ ও সেবাই ইহার প্রধান ঔষধ।
প্রশ্ন। নিজেদের ভিতর উন্নয়নের চেষ্টা না জাগলে সমাজে এমন কোনপ্রকার ব্যবস্থা হ'তে পারে কি-না যা'তে তাদের উৎকর্ষ আসতে পারে? না, তাদের বর্জনই শ্রেয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর। সমাজের উচিত এমন পারিপার্শ্বিকের সৃষ্টি করা যাহাতে সৎ, সুখ ও শান্তির আবহাওয়া তাহাদের শরীর ও মনকে সুস্থ করিয়া তোলে। মানুষের সৎ হওয়ার প্রবৃত্তি সহজ, জীবন তাহাকে জলাঞ্জলি দিতে পারে না। মানুষ তখনই অসুস্থ হইয়া পড়ে, যখনই পারিপার্শ্বিক তাহাকে সাহায্য করে না বরং বাধ্য করে তাহার জীবনের সঙ্কোচ আনিতে;-তখন সে আশু জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আবেগে ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে পরিহার করিতে বাধ্য হয়।
প্রশ্ন। এদেশে আজকাল পতিতা বা বেশ্যার সংখ্যা-বৃদ্ধি লইয়া কেহ-কেহ আলোচনা করিতেছেন-এ সংখ্যা-বৃদ্ধির কারণ কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। কারণ-সামাজিক বিধি-ব্যবস্থা। অশাস্ত্রীয় অমঙ্গলকর লৌকিক বিধি-নিষেধ যে-সমাজের নিয়ন্তা, সেখানেই এই সমস্ত দোষের পর্য্যাপ্তি ঘটিয়া থাকে।
প্রশ্ন। আজ সমাজে ইহাদের কোনো স্থান নাই। আর্য্যসমাজে কি চিরদিনই ইহাদের কোনো স্থান ছিল না?
শ্রীশ্রীঠাকুর। ধর্ম-বিশেষতঃ আর্য্যধৰ্ম্ম চিরদিনই পালনশীল! Progress বা উন্নয়ন হইতে এক পা স্খলিত হইলেও তার স্থান নির্দ্ধারণ করাই আছে। পতনের পথকে রুদ্ধ করা এবং progress-এর (উন্নয়নের) পথকে মুক্ত করা শাস্ত্রীয় বিধির চিরদিনই লক্ষ্য; পতিতকে উন্নতির দিকে টানিতে সব-শাস্ত্রই সিদ্ধহস্ত।
প্রশ্ন। নির্বাসন-রূপ কঠোর সামাজিক শাসন পতনের পথকে বিপৎসঙ্কুল করিবার জন্যই নহে কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। নির্বাসন সেখানেই applied (প্রযুক্ত) হয়েছে যেখানে যার সংসর্গে একটা অস্বাস্থ্যকর অত্যাচার-অবসাদ-মৃত্যু ইত্যাদি দ্বারা মানুষ contaminated হ'তে পারে (আক্রান্ত হ'তে পারে), যে contamination-এ (স্পর্শদোষে) curative law (আরোগ্যকারী বিধি) কম আছে।
প্রশ্ন। পতিতাদের সমাজে স্থান কিরূপ হইতে পারে? ইহাদের কী কাজে লাগানো যাইতে পারে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। যেমন-যেমন মানুষ যেমন-যেমন কাজের উপযুক্ত তেমন-তেমন স্থলে নিয়োজিত করা যাইতে পারে; এবং সেই নিয়োজিত কর্ম্মের উৎকর্ষতায় তাহাদের উন্নতির গতিকে রাখিতে হইবে অবাধ-আর, lovingly এবং lucidly (প্রেমের সঙ্গে ও জ্বজ্জ্বল্ ক'রে) আদর্শ বা ইষ্টকে infuse (সঞ্চারিত) করিতে হইবে তাহাদের অন্তরে, -অবশ্য নিয়োজিত করিতে হইবে শাসন এবং সংরক্ষণ-বিধি দ্বারা তাহাদের further deterioration-কে (অধিকতর অবনয়নকে) যতদূর সম্ভব restricted করিয়া (রুদ্ধ করিয়া)। তাহা-হইলেই ইহাদের দ্বারা কুফল হইতে সুফলের প্রাবল্য বেশী হইতে পারে।
10