সুবোধচন্দ্র সেন :-
[ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নবীন বয়সেই যাঁরা তাঁকে জীবনকেন্দ্ররূপে গ্রহণ করে তাঁর চতুষ্পার্শ্বে নিজ জীবন আবর্তিত করেছেন এবং সারা জীবন ধ’রে নিজের প্রাপ্তি অন্য অনেকের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন, ডাঃ সুবোধ সেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সৌভাগ্যবশত তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী বন্দনা দাশগুপ্তের সৌজন্যে তাঁর রচিত পিতৃস্মৃতি-আলেখ্য পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে সুবোধ সেনের ব্যক্তিত্ব, কর্মময় জীবন এবং আদর্শের প্রতি নিঃশর্ত সমর্পণের ছবি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে - তার সঙ্গে রয়েছে সেই সময়ের ইতিহাসের ঝলক। শ্রীমতী বন্দনার অনাড়ম্বর, নির্ভার অথচ গভীর মনস্বিতায় উজ্জ্বল মৃদু স্বগতোক্তি-প্রতিম স্মৃতিচারণাটি কিছু সংক্ষেপ ও সামান্য সম্পাদনা ক’রে এখানে যুক্ত হল। ]
ইতিহাস দুরকমের হয়-এক, বহিরঙ্গের ইতিহাস, ঐতিহাসিকরা যা লিপিবদ্ধ ক’রে বিতর্কের ঝড় তোলেন। আর এক হল অন্তরালের অন্তরঙ্গ ইতিহাস- প্রত্যক্ষদর্শীর ধমনীর মধ্য দিয়ে যে ইতিহাসের অণু-পরমাণু প্রবাহিত হয়। এই অন্তরঙ্গের ইতিহাস খুব ব্যক্তিগত মনে হলেও এটাই সত্য। রাজা-রাজড়ার যুদ্ধের বিবরণ, কার অশ্বপালে কত অশ্ব, হাতিশালে কত হাতি, কোন যুদ্ধে কার কত লাভ হয়েছিল, কার বা ক্ষতি-এই হিসাবে পণ্ডিত মহলের সংখ্যাতাত্ত্বিক আনন্দ হয়তো লাভ হতে পারে, কিন্তু অন্তরঙ্গের ইতিহাস, যা নিভৃত ঘরের কোণে তিল তিল ক’রে গড়ে ওঠে, তার কোন চমক থাকে না, থাকে সত্যের শক্তি।
আমার বাবা সুবোধ সেন সম্বন্ধে আমি তেমনই একটা কিছু লিখতে বসেছি। বাবার জীবনে কোন নাটকীয় চমক ছিল না-ছিল জিজ্ঞাসা আর নিষ্ঠা। এই শান্ত আড়ম্বরহীন জীবনধারার মধ্যে সত্যিকারের প্রাণের যে স্বাদ আছে, তারই সামান্যাংশ আমি ফুটিয়ে তুলতে চাই। যেসব ঘটনা বিবৃত করব, তার অনেকটাই আমার পঁচিশ / ছাব্বিশ বছর বয়সের মধ্যে। তাই নির্দিষ্ট সময়ের পথে না চলে আমি ঐ সময়ের ওঠানামার মধ্যে বাবাকে কেমনভাবে পেয়েছি আর বাবা আমাদের কী দিতে চেয়েছেন -তার খোঁজেই এই লেখা।
বাবা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৮ সালের ২৬শে জুন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১৯১৪ সালে। এই সময় দেশের রাজনৈতিক পটভূমি খুব অস্থির ছিল। ব্রিটিশ শাসনের দমননীতিতে ক্রুদ্ধ যুবসমাজের একাংশ সন্ত্রাসবাদের পথ অবলম্বন করেছিল। কোন কোন রাজনৈতিক দল দেশোদ্ধারের উৎসাহে দূরদর্শিতার বিচার ও প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপকে স্বীকার না করে তাৎক্ষণিক স্বার্থসিদ্ধির কোন দ্রুত এবং চমকপ্রদ পদ্ধতিতে বীর হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাৎক্ষণিক স্বার্থসিদ্ধি কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির মনে তুষ্টি আনতে পারে না। এক খণ্ডস্বার্থ থেকে আর এক খণ্ডস্বার্থে ঘুরতে ঘুরতে যে পথভ্রান্তির সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়, সেকথা যাঁরা মননশীল তাঁদের বোধে ধরা পড়ে।
বাবা ম্যাট্রিক পাশ করার পরে ১৯১৪ সালে কলকাতায় এসে তখনকার রাজনৈতিক দলগুলো-বিপ্লবী ও অসহযোগী-সকলের সঙ্গেই মিশেছিলেন। আধ্যাত্মিক জীবনে কিছু জানবার জন্য তাঁর আগ্রহ ছিল, আবার বাস্তব জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি সুন্দর হোক, এটা তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল। ১৯৫৪ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তাঁর কাছ থেকে তাঁর জীবনের ঘটনাপঞ্জীর একটি নোট নিয়েছিলাম- সেটাতে ধরা পড়েছে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের চঞ্চলতা। সেই নোটটি বর্ণনা করছি।
“বাবা ফার্স্ট ক্লাসে পড়বার সময় আগ্রা সৎসঙ্গে দীক্ষা নেন। ১৯২০-তে নাগপুর কনফারেন্সের সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দিয়ে ভলানটিয়ার হন। ১৯২১-এ প্রবর্ত্তক সংঘে যোগ দেন। ১৯২২-এর অক্টোবরে হিমাইতপুর সৎসঙ্গে দীক্ষা নেন। নরেন ব্যানার্জি নামে কোন বন্ধু তাঁকে এ পথে আসতে উৎসাহিত করেছিল। তখন বাবা মেডিক্যাল কলেজের ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র। ১৯২৩-এ পরীক্ষায় কৃতকার্য হননি (নন-কোঅপারেশন মুভমেন্ট?)। ১৯২৪-এ ডাক্তারি পাশ করেন। ১৯২৫-এ D.P.H. পাশ করেন। ১৯২৬-এ দশ মাস বহরমপুর থাকেন-তারপর পুরুলিয়া যান। এই সময় তাঁর বিবাহ হয়। ১৯৩০ এ যশোর আসেন। যশোরে আসার পর প্রচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন ছয়/সাত বছর পর্যন্ত। ১৯৩৭-এ ঋত্বিক সম্মেলনের প্রবর্তন হওয়াতে প্রচারকার্যে খুব সুবিধা হয়। ১৯৪১-এ যশোর উৎসব। ১৯৪২-এ মিলিটারি থেকে আমাদের বাড়ি নিয়ে নেওয়াতে আমরা পাবনায় চলে আসি। ১৯৪২-১৯৫৪ তো জানা ইতিহাস।”
১৯৫৪ সালে নেওয়া এই ছোট্ট নোটটুকুর মধ্যে কিন্তু বাবা যে নন-কোঅপারেটিভ মুভমেন্ট-এ যোগ দিয়েছিলেন, সেকথা কোথাও লেখা নেই। সে গল্প আমি কোন সময় ঠাকুমার কাছে শুনেছিলাম। নোট নেওয়ার সময় যদি খেয়াল থাকত তাহলে হয়তো বাবার কাছে ঐ সময়ের কথা কিছু শুনে নিতাম। বাবা কেন উল্লেখ করেননি; হয়তো ঐ আন্দোলনের পুরো ব্যাপারটাই ওঁর কাছে জীবনবিরুদ্ধ মনে হয়েছিল, আত্মঘাতী মনে হয়েছিল। ঐ আন্দোলন সম্বন্ধে মনে কোন নরম জায়গা থাকলে আমাকে বলতেন বলে মনে হয়।
সৎসঙ্গে আসার পর থেকে, ঠাকুরের কাছে সর্বপরিপূরক আশ্রয়ের সন্ধান পেয়ে বাবা আর কোথাও ছোটাছুটি করেননি। তিনি নিজের স্বভাবকে রক্ষা করার কথা চিন্তা করেছিলেন। তাঁর একান্ত সহানুভূতিসম্পন্ন বিদ্যোৎসাহী সাহায্যকারী নিরহঙ্কার মাধুর্যমণ্ডিত স্বভাবকে তিনি কোন বিরুদ্ধ ভাবধারায় পঙ্কিল হতে দেননি-এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন।
ডাক্তারি পড়া শেষ করে স্বাধীনভাবে ডাক্তরি করার ঝুঁকি না নিয়ে চাকুরিজীবনের নিশ্চয়তা গ্রহণ করেছিলেন পারিবারিক কারণে। ডাক্তারি পড়ার তৃতীয় বর্ষে পিতৃবিয়োগের পরে তিন ভাই, তিন বোন এবং মা, সকলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ওঁকে মনে মনে প্রস্তুত হতে হয়েছিল। আমার কাকা-পিসিমারা বরিশালে থেকেই পড়াশুনা করেছেন। ছুটির সময় আর পড়াশুনো শেষ হলে ওঁরা যশোরে আসতেন, কিম্বা যেখানেই মা বাবা থাকতেন, নির্দ্বিধায় সেখানেই কাকারাও থাকতেন। একথা উল্লেখ করলাম এজন্য যে যখন দেশভাগের পরে অনেক কষ্ট করে মামাবাড়ির দুখানা ঘরের মধ্যে থাকা হচ্ছিল তখনও কাকারা দাদার শ্বশুরবাড়িতে এসে ক’দিন থেকে যেতে অসুবিধা বোধ করেননি। আমার মায়ের সঙ্গে কাকাদের খুব ঘনিষ্ঠ মধুর সম্পর্ক ছিল- বাবার সঙ্গে ছিল সম্ভ্রমসূচক দূরত্বপূর্ণ অন্তরের সম্বন্ধ।
যদিও বাবা ১৯২২ খৃষ্টাব্দে দীক্ষা নিয়েছিলেন, তবুও সম্পূর্ণভাবে ঠাকুরের কাছে নিজেকে নিবেদন করার মত মানসিক গঠন আসতে আরও বছর সাতেক লেগেছিল। ১৯২৯-এ মায়ের কাছে লেখা এক চিঠি থেকে তাঁর তখনকার মনের অবস্থা জানতে পারি। একটু উদ্ধৃতি রাখছি-
“...... কত কথাই তো এতদিন মাথায় গজ গজ করত-স্বরাজ দেশোদ্ধার কত কী! এবার পাবনা গিয়ে অনেক ভাল ফল হয়েছে। ওসবে যেন মন সাড়া দেয় না। ঠাকুর বলেছেন-স্বরাজ বললে স্বরাজ হয় না, স্বরাজ করলে স্বরাজ হয়।
.... বাস্তবিক এখানে যে বিপুল কর্মপ্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। দু-তিন শত লোক... এখানেই দিনরাত খাটছে। খাওয়া একবেলা।... এতগুলি লোক যে একবেলা খেয়ে পরিশ্রম করছে, কীসের জোরে? মুখে হাসি লেগেই আছে। তাছাড়া কেউ যে কষ্টে আছে- একথা কেউ মনেই ভাবে না। অনুভব করা দূরের কথা। আমার মনে হয় এদের activity- র মূল হচ্ছে ঠাকুরের প্রতি ভালবাসা। ভালবাসার লোকের জন্য যে পরিশ্রম-তাতে আনন্দ ছাড়া কিছু নেই। সকলেই কি পারে? না-তা পারে না-তাই যারা স্বার্থ খোঁজে-তারা কিছুদিন পরেই আশ্রম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এইসব লোকেরাই আশ্রমের কুৎসা প্রচার ক’রে তাকে মসীলিপ্ত করতে চাইছে। ... যাক্, ঠাকুর বলেছেন যে, যার life unit ঠিক হয়েছে-ও যার activity আছে- তার আর কোন ভয় নেই।... আশ্রমের কাজের জন্য worker আরও চাই... আমাকে কিন্তু বললেন না আসতে। তাঁর কথায় মনে হল আমি যে কাজে আছি সেই কাজে থাকাই তাঁর অভিমত। ঠাকুর এককথায় বলে দিয়েছেন biology সম্বন্ধে research করতে হবে। ডাক্তারি শাস্ত্রটা তো প্রায় ভুলেই গেছি। আবার তা পড়তে হবে প্রথম থেকে- উপায় নাই... কিন্তু কী করে কাজ আরম্ভ করি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।... এখানে (পুরুলিয়ায়) লোকের সঙ্গে আমি মিশতে পারি না। কী করে মিশবো? একটা common basis থাকে তবে তো মেশা যায়? কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি যে এই তো আমার স্থান। আমি যা বলি, যা ভাবি, যা চাই-এই তো এখানে ঠিক তাই আছে।”
এই সময় বাবার life unit ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এই সময় বাবা জীবনের কেন্দ্রীভূত আকর্ষণ কোথায় আছে বুঝেছিলেন, গ্রহণ করেছিলেন,-এবং সেই কেন্দ্র পুরুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁরই উদ্দেশ্যে সমস্ত দিক adjust ক’রে সমস্ত কর্মপ্রণালী পরিচালিত করেছিলেন। বাবার ভাললাগার যে অভিব্যক্তি এই লেখাতে ফুটে উঠেছে-তা তখনকার দিনের আশ্রমবাসীদের অনেকের কাছেই পরিস্ফুট ছিল। গোপাল জ্যাঠামশাই-অর্থাৎ সৎসঙ্গের প্রথম যুগের সম্পাদক এবং ঋত্বিগাচার্য-সচিব শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়-এর মাসতুত ভাই হরেরাম চক্রবর্তীর বাড়িতে গিয়েছিলাম আশ্রমের কথা, পুরোনো দিনের কথা শুনব বলে। প্রথম কিছুক্ষণ উনি শুধু বাবার কথাই বললেন। ওঁর ভাষায়, “ঠাকুরকে গ্রহণ করলে কীভাবে তাঁকে জীবনে বহন করতে হয়, সুবোধদাকে দেখে সেটা বোঝা যায়।... গোপালদা, তোমার বাবা, ওঁরা ঠাকুরের বড় কাছের লোক ছিলেন। সুবোধদা যখন আসতেন আমরা ছুটে গিয়ে ঠাকুরের কাছে বসতাম। কত গল্প হত। ঠাকুর ভীষণ উৎফুল্ল হতেন, আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম। ঠাকুর গ্রহণ করা যে কী জিনিষ সুবোধদাকে দেখলে বোঝা যেত।...”
ঠাকুরের কাজ জীবনের অনেক বিভাগের মধ্যে একটু অংশ নয়, সবখানি জুড়েই তাঁর কাজ, বাবার অন্তরে এই বোধ পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে ১৯২৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময় লেগেছিল-এ কথা স্পষ্ট। এরপরে বাবা পুরুলিয়া থেকে যশোর চলে আসেন ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে। ঐ সময় থেকে তাঁর ইষ্টার্থপরতার সুবর্ণ যুগের শুরু বলা যায়। প্রায় সবসময়ই যজন ও যাজনকার্যে ব্যাপৃত থাকতেন তিনি। বাবা ভীষণ দৃঢ় কিন্তু মিষ্টিভাষী ছিলেন- তাঁর কাছে এসে কেউ কখনও আহত হয়নি। এই সময় ঋত্বিক সংঘের সংগঠন হয়। যশোরে আমাদের চৌরাস্তার মোড়ের ভাড়াবাড়ির কাছে ঋত্বিক সংঘের লোকেদের রাত্রিবাসের জন্য একটা ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া আমাদের বাড়িতেই হত। আমার মনে আছে, এঁদের সঙ্গে বাবার দীর্ঘ আলোচনা হত। প্রতিটি বিষয়ে নিজেদের ধারণা পরিষ্কার আছে কি না-এটা পরিস্ফুট করার জন্য দুটো দল ক’রে আলোচনাগুলো চলত। দু’পক্ষের ভাগেই কিছু কিছু জোরদার বক্তব্য রাখার মত লোক থাকত। এই দুটি পক্ষ নিজেদের মতামত স্থাপনা করার জন্য তীব্র এবং তীক্ষ্ণ যুক্তি প্রয়োগ করতেন। মা বলতেন, “এসব মতামত বিনিময়ের জন্য আমার টেবিলটা যে কত কিলঘুষি খেয়েছে। ওর যদি প্রাণ থাকত তবে ও নিশ্চয়ই আমার কাছে তার দুঃখ জানাত।” এই আলোচনাচক্র যেমন বুনিয়াদী ছিল, তেমনই মনোগ্রাহী। বৈঠকখানা ঘরে লোক ধরত না। সন্ধেবেলা এই ছিল নিত্যকার ব্যাপার। আর সকালে সবাই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তেন। মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগেই সমস্যাগুলোকে গুচ্ছ গুচ্ছ ক’রে নির্ধারিত করা যায়; এবং এই প্রত্যেক গুচ্ছের সমস্যার সমাধান ঠাকুরের কাছ থেকে আমরা কেমন ক’রে পাচ্ছি এবং চিরায়ত ভারতীয় ভাবধারার সঙ্গে তা কীভাবে অঙ্গীভূত-গীতার শ্লোকের মাধ্যমে সেগুলিকে সুপ্রতিষ্ঠিত ক’রে, বহির্মুখী এবং বিভ্রান্ত চিন্তাধারাকে সুকেন্দ্রিক ক’রে তোলার প্রয়াস এই আলোচনাচক্রের মাধ্যমে করা হত। কোন একজন মানুষকেও ঠাকুরের কথা বোঝাতে পারলে এঁরা সবাই মিলে দিগ্বিজয়ের আনন্দ অনুভব করতেন। সেই উচ্ছ্বাসভরা মুখগুলি মনে আছে।
বাবা মাকে নিজের ব্রতপালনের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন। মা ব্রাহ্মঘেঁষা পরিবারের মেয়ে ছিলেন। নিরাকার ঈশ্বর সাকার দেহধারী পুরুষোত্তম গুরুরূপে মানুষের সামনে সত্যিই থাকতে পারেন, একথা মানবার জন্য অনেক আলোচনা, বিচার-বিবেচনা, প্রত্যক্ষদর্শন এবং বাবার প্রতি একান্ত ভালবাসার ফলে মা বিয়ের দশ বছর পরে দীক্ষা নেন। আমার মা জ্যোতির্ময়ী দেবী-জুঁই-মা নামে যিনি অধিক পরিচিত-ছিলেন দার্জিলিং কনভেন্টে পড়া ব্যাক্তিত্বময়ী, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন, এবং সর্বার্থে সুদক্ষ; কিন্তু বাবার উগ্রতাবিহীন এবং আদর্শে-সমর্পিত দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে তিনি সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করেছিলেন।
যশোর জেলায় ঠাকুরের ভাবাদর্শের আন্দোলন-সংগঠনে বাবা ডিস্ট্রিক্ট-ইন-চার্জ হন। ডিস্ট্রিক্ট হেলথ্ অফিসার হিসাবে যশোরের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ট্যুর করতেন, তার সঙ্গে বাবা প্রচার-অভিযানের কাজ যোগ করে নিয়েছিলেন। যেখানে যেতেন সারাদিন অফিসের যা করণীয় করতেন; সন্ধেবেলায় যেসমস্ত লোকজন আসতেন, তাঁদের কাছে ঠাকুরের কথা বলতেন। কখনও কখনও অধিবেশন আগে থেকেই ঠিক করা থাকত। আমাদের বাড়িতে যশোর জেলার একটা বড় ম্যাপ টাঙানো থাকত। সেই ম্যাপ ধ’রে পর পর গ্রাম কিংবা সাব-ডিভিশনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হত। এভাবে যশোর জেলার প্রত্যেক সাবডিভিশনের সঙ্গে বাবার ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। প্রত্যেক গ্রামে যে দীক্ষাপত্র তৈরী হয়ে আসত, সেই দীক্ষাপত্রের অর্ধাংশ কেন্দ্রে, অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে জমা থাকত। একটা খাতা তৈরী করা হয়েছিল, যাতে গ্রাম হিসাবে নাম তালিকাভুক্ত করা হত। আমার তখন স্কুল ছিল না। রাসবিহারীদা নামে একজন একাজগুলো করতেন। তাঁর সঙ্গে বসে বসে আঁকাবাঁকা অক্ষরে কাঁচা হাতে আমিও একাজ অনেক করেছি।
সৎসঙ্গের অধিবেশনগুলিতে প্রচুর লোকসমাগম হত। মাঝরাত্রেও একনৌকা মানুষ এসে উপস্থিত হতেন। তাঁদের আহার-শয়নের ব্যবস্থা করার দায়িত্বে ছিলেন মা। প্রফুল্লকুমার দাস সঙ্কলিত ঠাকুরের কথোপকথন-গ্রন্থ ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’-তে এর একটু উল্লেখ আছে। ঠাকুর বাবাকে বলছেন, “শুনেছি তোমার বাড়িতে ছোটখাটো আনন্দবাজার লেগেই থাকে... কিন্তু আরও দ্রুতগতিতে কাজ চাই।” যে দুর্দিনের আশংকায় ঠাকুর সবাইকে এত তাড়া দিতেন, তা যে কতটা ভয়ঙ্কর, তা কেউ বুঝতে পারেনি তখন। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের দূরত্ব থেকে সেই সময়কে যখন দেখতে পাই তখন কাজগুলির গুরুত্ব স্পষ্ট হয়।
১৯৪১-এ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ যশোর উৎসব পালিত হয় মূলত বাবার ঐকান্তিকতায়। ১৯৩০ থেকে আরম্ভ ক’রে ১৯৪১-এ উৎসব পর্যন্ত একভাবে কাজ ক’রে বাবা যশোর জেলায় কাজের একটা শক্ত জমি তৈরি করেছিলেন। যশোর- উৎসব সার্থক হয়েছিল গ্রাম বাংলার সমর্থনে। উৎসবে প্রতিদিন পাঁচ হাজার লোক আনন্দবাজারে (সাধারণ ভোজনালয়) প্রসাদ পেয়েছে। আমাদের বাড়ির পিছনে একবিঘা জমির উপর খাবার জায়গা করা হয়েছিল। যত চাল-ডাল-তরিতরকারি, সবই মানুষের দানের। গরুর গাড়ি বোঝাই খাদ্যশস্যের আমদানির যে-মিছিল দেখা যেত, তা দেখতে মানুষ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়ত। প্রফুল্লদা (দাস)-র কাছে শুনেছি অখণ্ড বাংলার প্রতিটি মিউনিসিপ্যালিটিতে আমন্ত্রণপত্র গিয়েছিল এবং প্রতিটি জেলার মানুষ উৎসবে যোগ দিয়েছিল। উৎসবের সময় যশোরে অনেক বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। বাড়িগুলি গ্রাম অথবা জেলা হিসাবে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল যাতে যাঁরা এসেছিলেন কেউ নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে না করেন। অতবড় উৎসবে গিয়ে কেউ ভীষণ কষ্ট পেয়ে এসেছিলেন, এখনও পর্যন্ত আমি এমন কথা কারও মুখে শুনিনি। পঞ্চানন বিশ্বাস বলে একজন ছিলেন, ছোট ছোট টিনের প্লেটে ঠাকুরের অনেক বাণী লিখতেন। সুসজ্জিত প্যান্ডেলে কাপড়ে মোড়া বাঁশের খুঁটিতে সেই বাণীগুলি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উৎসবের আগের তিন মাস বাড়িতে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর জন পর্যন্ত সর্বক্ষণের কর্মী নিত্যই থাকতেন। কারণ যে অনুষ্ঠানসূচী তৈরি করা হয়েছিল, যেসমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, প্যাণ্ডেল তৈরি করার যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তার জন্য কিছু লোককে অনবরত কলকাতা-যশোর ক’রে বেড়াতে হত। যশোরের মিউনিসিপ্যালিটি থেকে বাবা খুব সাহায্য পেয়েছিলেন। যে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল-তার জন্য জায়গায় জায়গায় লাইন দিয়ে খাটা পায়খানা ক’রে দেওয়া হয়েছিল, ঘন্টায় ঘন্টায় সেগুলি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা ছিল।
যশোর উৎসব সাত দিনের জন্য পরিকল্পিত ছিল-কিন্তু সম্ভবত এমন সুসংহত জনশক্তির অভ্যুদয়ে ঈর্ষাতুর কোন শক্তির প্ররোচনায় উৎসবের শেষদিনের অনুষ্ঠান চক্রান্ত ক’রে পণ্ডক’রে দেওয়া হয়। ছ’দিন, ছ’রাত্রি বাবা প্যাণ্ডেল থেকে নড়েননি, ইতিমধ্যে গণ্ডগোল বাঁধতে উদ্যোগী যুবকদের ডেকে বাবা তাদের ক্ষোভ এবং জিজ্ঞাসার প্রশমন করেছিলেন। কিন্তু ষষ্ঠ দিনের রাত্রে কেউ বাবাকে জোর ক’রে একটু বিশ্রামের জন্য পাঠিয়েছিলেন এবং সেই অবসরে কিছু গোলমাল হয়। শেষের ঐ খুঁতটুকু সত্ত্বেও মনে হয়-যশোর উৎসব একটা সার্থক প্রচেষ্টা। একক প্রচেষ্টা তো নয়। উৎসব করার আগে উৎসবের উদ্দেশ্য বর্ণনা ক’রে একটি লেখা তৈরি ক’রে যশোরের যত বিদ্বজ্জন ছিলেন -ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, উকিল, শিক্ষক কিংবা বনেদী বংশীয় অভিজাত ব্যক্তি, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী, মিউনিসিপ্যালিটির কর্মকর্তা- সকলের কাছেই উপস্থিত হয়েছিলেন আমার বাবা। তাঁরা সানন্দে এই উৎসবের আহ্বায়ক হিসাবে নিজেদের নাম সই করেন। বাবা সবার কাছে গিয়েছিলেন; রাস্তার ভিখারি এসে ‘মহোৎসবে আমি কিছু দিতে চাই’ বলে তার ভিক্ষার ঝুলি উজাড় করে দিয়েছিল- বাবা সাদরে প্রত্যেকের দান গ্রহণ করেছেন।
এই উৎসবের কথা বিশদভাবে বললাম এজন্য যে এর পরেই পঞ্চাশের মন্বন্তরের বীভৎস ঘটনা ঘটে। দুর্ভিক্ষটা কৃত্রিম ছিল। প্রত্যেক গ্রাম থেকে অজস্র মূল্য দিয়ে চাল-ডাল-আলু নিঃশেষে কিনে নিয়ে নৌকা বোঝাই করে গ্রামবাসীদের চোখের সামনে সেসমস্ত খাদ্যশস্য জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিলিটারিদের জন্য বাজার থেকে দ্রুত খাদ্য সরিয়ে নিয়ে গুদামজাত করাও চলছিল অবাধে। যে সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন, এক আদর্শে চলার উন্মাদনা পরাধীন জাতিকে আবার স্বনির্ভর করে, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতায় গ্রথিত ক’রে, এক ক’রে তুলতে চাইছিল, স্বভাবতই শাসক ইংরেজের তা ভাল লাগেনি। বিব্রত করার চেষ্টায় তাই ফাঁক ছিল না। তখন মহাযুদ্ধের তাড়নায় ইংরেজ হয়রান। সৎসঙ্গের এতবড় সংহতির পিছনে কোন বিপ্লবী শক্তি লুকিয়ে নেইতো? এই সন্ধান তারা ভালভাবেই করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন কুষ্টিয়ার বিশ্বগুরু উৎসব এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যশোর উৎসব- দুটোর পরেই আশ্রমে গুপ্তচর পাঠানো হয়েছিল। যশোর উৎসবের পরে একটি ইংরেজ যুবক। হঠাৎ করেই আশ্রমে এসে থাকতে শুরু করে। আমার দুই মাস্টারমশাই ধূর্জটিকৃষ্ণ নিয়োগী এবং নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে তার খুব আলাপ হয় নিরীহ জিজ্ঞাসু হিসাবে, যেন ঠাকুরের কথা জানতে আগ্রহী এক অনিসন্ধিৎসু সত্যসন্ধানী। মাস ছয়েক থেকে চলে যাওয়ার পরে জানা যায় সে ছিল গুপ্তচর। একথা জেনে আমার শিক্ষকদ্বয় খুবই আঘাত পেয়েছিলেন।
এই ঘটনা পঞ্চাশের মন্বন্তরের পরের। যখন মন্বন্তরের সময় এবং পরেও আশ্রমের এবং ঠাকুরের লোকেদের সেবাকর্মে কোন ব্যাঘাত ঘটল না, বরং আরও তীব্রভাবে চলতে লাগল, যখন গুপ্তচর এসেও কোন ছিদ্র বার করতে পারল না, কোন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের লেশমাত্র দেখতে পেল না, তারপরেই মুসলিম লীগের উস্কানি শুরু হল।
যশোর উৎসবের মাস ছয়েকের মধ্যেই যশোর মিলিটারি বেস হিসাবে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আমেরিকান সৈন্য শহর ভরিয়ে ফেলেছিল। তাদের থাকার জন্য শহরের লোকেদের বাড়ি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বাবার অফিস- ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বিরাট বিল্ডিং, একই সঙ্গে আমাদের বাড়িও নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পারিবারিক এবং আর্থিক দিক দিয়ে বাবাকে যাতে খুব বিব্রত থাকতে হয়, তার জন্য সবরকম ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছিল। সরকারি কর্মে অবহেলার অজুহাতে বাবাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। আসলে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে তখন বাবাকে তাদের প্রচারের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়েছিল। তখন যশোরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এম. এন. খান-তিনি ভয়ানক গোঁড়া ছিলেন। প্রফুল্লদা (দাস)-র মুখে শুনেছি, উনি সরকারকে নোট পাঠিয়ে ছিলেন যে সৎসঙ্গকে যদি বাড়তে দেওয়া হয়, তবে লীগের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। এ কথা কীভাবে জানা গেল-আমার এ প্রশ্নের উত্তরে প্রফুল্লদা বলেন-‘সব অফিসেই তো ঠাকুরের লোক ছিল, তাই জানতে পারা গিয়েছিল।’ আসলে বাবা যখন সেখানে উৎসবের জন্য অথবা ঠাকুরের কথা বলার জন্য প্রচারে বেরোতেন-বিশেষ করে উৎসবের আগে-তখন বাবার সঙ্গে একজন মৌলবী থাকতেন। যেহেতু যশোরের গ্রামগঞ্জ মুসলমানপ্রধান, ঠাকুরের সাম্প্রদায়িক বিভেদশূন্য জীবনধর্মী কথা যা পূর্ববর্তী পুরুষোত্তমের বাণীর সঙ্গে এক সুরে বাঁধা, তা নির্দ্বিধায় সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বলার তখন সুযোগ হয়েছিল। লীগের পক্ষ থেকে যে বিদ্বেষের ফোয়ারা ছিটিয়ে বিভেদের বীজ রোপন করার কথা ভাবা হচ্ছিল, তার উত্তর দেওয়ার এবং প্রতিবিধান করার শক্তি সৎসঙ্গের এবং মুখপাত্র হিসাবে বাবার আছে, এ কথা তারা অনুমান করেছিল। অতএব বাবাকে কর্মক্ষেত্র থেকে সরানো তাদের প্রধান করণীয় হয়ে উঠল। ইষ্টপ্রাণ ক্ষিতিনাথ জ্যাঠামশাই (ঘোষ) ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনীয়ার। তিনি বোর্ডের বেশির ভাগ মেম্বারদের কাছ থেকে বাবার প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাবার সমর্থনে জনমত সংগ্রহ করেছিলেন। যে মিটিং-এ এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা ছিল, সেই মিটিং-এর আগেই বাবা তাঁর প্রতি প্রতিটি অভিযোগের উত্তর দিয়ে এবং উত্তরগুলি গ্রহণীয় মনে করলে তিনি ইস্তফা দিচ্ছেন, এই মর্মে একটি চিঠি কাউকে না জানিয়ে চীফ সেক্রেটারির কাছে দিয়ে আসেন। সেই চিঠি সানন্দে গৃহীত হয়েছিল। কারণ, বাবা তাঁর কর্মক্ষেত্রে না থাকুন, এভাবে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতে না পারুন, এটাই কাম্য ছিল। আমরা তখন পাবনায় ছিলাম। মা যত চিঠি লিখতেন, যত উৎসাহ দিতেন, ঠাকুরের কাছে জিজ্ঞাসা করে যত কথা লিখতেন, অফিস থেকে সে চিঠিগুলি চেপে দেওয়া হত। সাত/আট মাস বাবা কোন চিঠি পাননি। ইস্তফা দেওয়ার ব্যাপারে ঠাকুরের সমর্থন ছিল না, তবু সেটা ঘটে গেল; ক্ষতিটা হল প্রচারকার্যের, অসৎনিরোধের। এভাবে পরিস্থিতির প্রভাবে বাবার জীবনের একটা পর্বান্তর ঘটে গেল।
১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বরে ঠাকুর দেওঘর চলে আসেন। আগের থেকে কেউ বুঝতে পারেনি। ঠাকুরের শরীর ভাল যাচ্ছিল না- ডাক্তার হাওয়া বদলের পরামর্শ দ্যান। সুশীল জ্যাঠামশাই, অর্থাৎ ঠাকুরের অন্যতম অগ্রগণ্য মনস্বী পার্ষদ সুশীলচন্দ্র বসুকে ঠাকুর দেওঘরে বাড়ি ঠিক করতে পাঠালেন। যে বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে গেছেন, সেই বাড়িটিই ঠিক করে সুশীল জ্যাঠামশাই হিমাইতপুরে খবর দিলেন। ঠাকুরের দেওঘরে আসা খুব আকস্মিক হয়েছিল; তিনি যে চিরদিনের মত হিমাইতপুর ছেড়ে যাচ্ছেন, একথা কেউ বোঝেনি। তার দু/তিন বছর আগে থেকেই মুসলিম লীগের কাজকর্ম প্রচণ্ড গতিতে চলছিল। লোভের প্ররোচনা, বিদ্বেষের ঘৃণার উস্কানি প্রাণভরা ভালবাসা আর সেবার ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছিল। সে সেবা কেমন ছিল? আশ্রমের দু/তিনটে গ্রাম এবং তারও আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়ানক দিনগুলোতেও কেউ না খেয়ে মরেনি। ঠাকুরের নির্দেশমত ভোরবেলায় উঠে কিশোরী দাদু (ঠাকুরের প্রথম দুই ভক্তের অন্যতম কিশোরীমোহন দাস, অনন্য সেবাকর্মী) ধামা মাথায় নিয়ে কয়েকজন সঙ্গীসাথী নিয়ে দরজায় দরজায় এসে মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে যেতেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিক্ষা। সেই চাল এবং অন্যান্য জিনিস তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হত যাদের নিজেদের আসার উপায় ছিল না। অন্যরা আশ্রম প্রাঙ্গণে এসে কিশোরী দাদুর ডিসপেন্সারি থেকে খাবার, ওষুধ সব নিয়ে যেত। গ্রামেগঞ্জে কলকাতার রাস্তাঘাটে যখন শুধুই হাহাকার, আমরা তখন বসবাস করতাম পারস্পরিকতায়, আনন্দময় পরিশ্রমের জোয়ারে ভাসা, আনন্দময় পুরুষোত্তমের করুণায়। ঐ সময় আশ্রমের আশেপাশের একটি লোকও অনাহারে মরেনি। ডকুমেন্টেশনের প্রশ্ন উঠলে বলা যায় যে অন্ধকারের যে ছবি দেখানো হয়েছে, তা হয়তো সত্য; কিন্তু পাশাপাশি মানুষের লক্ষ, চিন্তা, চেষ্টা অন্যরকম হলে বিপর্যয়ের মুখেও জীবন যে অন্যরকম হয়, সে-সত্যও তো ছিল। পরবর্তী ঐতিহাসিক খুব সামান্য রকমে হলেও মন্বন্তরের আগ্রাসন থেকে কিছু গ্রামের এই অসামান্য উত্তরণের উল্লেখ না ক’রে পারেননি, যদিও সে গ্রামগুলি যে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম- পরিমণ্ডলের, সে-কথা উল্লেখ করার বদান্যতা তাঁর ছিল না। সেসময় বাংলায় এমন একটা লোক ছিল না যার কোন না কোন আত্মীয়স্বজন ঠাকুরের কাছে পৌঁছয়নি। এত প্রাণচঞ্চল, কর্মমুখর, ভালবাসাময় পরিবেশ ছিল যে সেসময় তীব্র রটনা ছিল-ঠাকুর সম্মোহনবিদ্যা জানেন। আশ্রমে এলেই তাঁর সম্মোহনী স্পর্শে মানুষ বদ্ধ হয়ে যায়।
নানারকম গুজবে যারা মত্ত হয়ে থাকত, সাক্ষাৎ তদন্ত করার মত মানসিক শক্তি তাদের ছিল না। কিশোরী-দাদুর এই যে সেবাকর্ম তার মূল গ্রহীতাই ছিল স্থানীয় মুসলমান সমাজ। বিভেদকামীর প্ররোচনায় তারা ভুলে গিয়েছিল যে ঠাকুর তাদের হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন, অসুখে ওষুধ দিয়েছেন, ঘর বাঁধার ছাউনি, পরনের কাপড় অকাতরে বিলিয়ে তাদের রক্ষা করেছেন। তারা প্রয়োজনের কথা এসে বললে ঠাকুর নিজে ভিক্ষে ক’রে তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের ঠিক আগেই যশোর উৎসবে সৎসঙ্গের সাংগঠনিক শক্তির প্রকাশ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে তার মূল্যবান ভূমিকা লীগ কর্মকর্তাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল; তাই ঠাকুরের প্রাণঢালা ভালবাসা ও সেবার অবদান হীন স্বার্থপ্রণোদিত অভিযানের কাছে বহুলাংশে মূল্যহীন হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাবনার স্থানীয় মুসলমান সমাজের এক বৃহৎ অংশ ঠাকুরের প্রতি অনুরাগে ও ভালবাসায় নিনড় ছিলেন-একথা উল্লেখ না করলে সত্যের অপলাপ করা হয়। এই প্রচণ্ড গতিবেগসম্পন্ন কর্মমুখর জীবনযাত্রা আকস্মিকভাবে চতুর্দিক থেকে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় আঘাতটা বাবার শরীরের উপর পড়েছিল। বাবা সে অবস্থা অতিক্রম করে প্র্যাকটিস শুরু করলেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যশোরের বাড়ি ফিরে পেয়ে আমরা পাবনা থেকে ফিরে এলাম। বাবা নতুন করে প্র্যাকটিসে মন দিলেন; প্র্যাকটিস উপলক্ষ্যেই গ্রামেগঞ্জে যেতে হত-সেসময় ঠাকুরের কাজও করতেন। এই সময়কার বাবার একটি ঘটনা উল্লেখের লোভ সামলাতে পারছি না। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই রাতারাতি অনেকগুলো ব্যাঙ্ক গজিয়ে উঠেছিল, কারণ যুদ্ধের খাতিরে কিছু লোকের হাতে বেশ কাঁচা পয়সা এসেছিল। তাছাড়া বাড়িঘরের জন্যও ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু টাকা পাওয়া গিয়েছিল। এরকমই একটি ব্যাঙ্ক হঠাৎ ফেল করল। সেই ব্যাঙ্কে অনেকের টাকা ছিল; বাবারও ছিল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে মারবে বলে শহরসুদ্ধ লোক ক্ষেপে উঠল। স্টেশনে, বাজারে, ডাকবাংলোয় সব জায়গায় তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল জিঘাংসায় উন্মাদ জনতা-বেচারির তখন প্রাণ বাঁচানোই মুস্কিল হয়ে দাঁড়াল। ঘটনাক্রমে প্রবোধ-কাকাবাবু (প্রবোধচন্দ্র মিত্র, সৎসঙ্গের মুখপত্র ‘আলোচনা’-র প্রথম সম্পাদক, দক্ষ ইষ্টকর্মী)-র সঙ্গে ভদ্রলোকের কোন সূত্রে পরিচয় হয়, কাকাবাবু তাঁকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাবা তাঁকে আশ্রয় দেন। রটে যায় যে ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে আছেন। আমাদের বাড়ি ঘেরাও হয়ে যায়। কিন্তু সীমানার বাইরে থেকে। সীমানার বাইরের আমগাছগুলোতেও ছেলের দল চ’ড়ে বসেছিল। ভদ্রলোক বোধহয় বাবার কম্পাউন্ডারকে টাকা দিয়ে চুপি চুপি পাঠিয়েছিলেন টেলিগ্রাম করতে-কিন্তু লোকেরা ধরতে পেরে তাকে লাঞ্ছিত করে। সন্ধেবেলা ভদ্রলোক মুখ ঢেকে একবার পালানোর চেষ্টা করতে গেলে ধরা পড়ে যান। হঠাৎ চেঁচামেচি গোলমাল শুনে বাবা ছুটে গিয়ে দেখেন-রাস্তায় ভদ্রলোক আক্রান্ত। বাবা এগিয়ে এসে ওঁর কাঁধে হাত রেখে বলেন-ইনি আমার আশ্রিত। ছেলেরা বলে-আপনার আশ্রয়ে থাকুন, পালাবার চেষ্টা যেন না করেন। এই অবরোধ দু’দিন ছিল, কিন্তু আমাদের গেটের মধ্যে কেউ একটি পা-ও রাখেনি। মিটমাটের জন্য শহরের গণ্যমান্য লোকেরা যেদিন এসেছিলেন, সেদিন একটা জরুরি কলে বাবাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। বাবা বেরোনোর আগে কর্তাব্যক্তিদের বলেন-জরুরি কলে আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে; ইনি আমার অতিথি, আমার আতিথ্যের ভার আপনাদের উপর দিয়ে গেলাম-ত্রুটি না হয়, দেখবেন। তাঁরা বাবাকে ভরসা দিয়েছিলেন এবং ভরসার মর্যাদা রেখেছিলেন। সেই ভদ্রলোককে তাঁরা চলে যেতে দিয়েছিলেন এ কথা ব’লে-একমাত্র ডাক্তারবাবুর অতিথি বলে আপনার প্রাণটা বাঁচল।
এই সময়ের আর একটা গল্প বলি। বাবার মাসতুত ভাই রবিকাকা ব্যবসা উপলক্ষে যশোরে এসে একটা হোটেলে উঠেছিলেন। সেখানে বাবার সম্বন্ধে খোঁজ করেছিলেন দেখা করতে আসবেন বলে। সেখানে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বললেন-সে কী, আপনি তাঁর ভাই আর হোটেলে ভাত খাচ্ছেন? উনি তো অতিথি না খাইয়ে নিজে খান না, এমনই অতিথিবৎসল। স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কেউ যদি কোন উপলক্ষে একটু থাকার জায়গা খুঁজত-সবাই বাবার নাম বলে দিত।
ঠাকুরের কাজ আবার শুরু করেছিলেন বাবা; বাড়িতে দু’একটা অধিবেশন হল। কিন্তু তারপরেই বাড়ি ছাড়তে হল। দেশভাগ। স্বাধীনতা ঘোষণার পরদিন অথবা চার/পাঁচ দিনের মধ্যে আমাদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ এসেছিল-সাত দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে। প্রাথমিকভাবে বর্ডার পেরিয়ে একটি বাড়িতে ওঠা হল এবং পরে দেওঘরে গিয়ে বাবা-মা ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করায় ঠাকুরের নির্দেশে কলকাতা চলে আসা হল। কলকাতায় এসে আমাদের মামাবাড়িতে দুখানা ঘরের মধ্যে থাকতে হয়েছে। ঠাকুমা, আমি, আমার বড় ভাই শঙ্কর এবং ওর বন্ধু পরমেশ-আমরা মজঃফরপুরে বাবার ছোটকাকার কাছে গেলাম।
এই দেশভাগের ধাক্কায় বহু বড় বড় বনেদি পরিবার ভেসে গেছে। কিন্তু বেঁচে গেছে সেসব পরিবার যাদের মধ্যে শ্রদ্ধার বীজ দৃঢ় ছিল। নিদেপক্ষে মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করতে হয়, এটুকু শিক্ষা যেসব ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিল, তারা হারিয়ে যায়নি। একদিন তখন আমি মজঃফরপুরে বি. এ. পড়ছি, কথায় কথায় সেজ- কাকাকে বলেছিলাম-সত্যি, কত লোকের কত বিপর্যয় হয়ে গেল এই পার্টিশন হয়ে, সে তুলনায় আমরা তো বেশ ভাগ্যবান! পার্টিশনের দুঃখ আমাদের স্পর্শ করতে পারেনি। একথা শুনে সেজকাকা আমাকে খুব জোরে বকেছিলেন-কিছু হয়নি মানেটা কী? সকলের যা হয়েছে-তোমাদের তার চেয়ে বেশি ছাড়া কমটা কী হল? তবে লোকেদের যা থাকে না, তোমাদের সেটা ছিল, ভরসা ছিল। তোমাদের সবসময় একটা নিশ্চিন্ত বিশ্বাস ছিল-ঠাকুর আছেন, একটা কিছু ব্যবস্থা হবে যাতে অন্তত ধ্বংস হয়ে যেতে হবে না। এই বিশ্বাস আর নির্ভরতাই তোমাদের মুষড়ে পড়তে দেয়নি। আর মুষড়ে না পড়লে মানুষ কিছু একটা করে ফেলতে পারে।
বাবা অনেক ঘুরে, অনেক বিচার ক’রে, অনেক দেখে ঠাকুরকে পেয়েছিলেন- গ্রহণ করেছিলেন সবখানি দিয়ে। খানিকটা সংসারের জন্য, খানিকটা সন্তানের জন্য, খানিকটা অর্থের জন্য, প্রতিপত্তির জন্য রেখে ঝড়তি-পড়তি ঠাকুরের জন্য থাকুক -বিপদের সময় নাম ক’রে ডাকাডাকি করলে বিপদমুক্ত হওয়া যায়, তাই মাদুলি- কবচের মত ব্যবহার হোক, এজন্য তিনি ঠাকুরকে গ্রহণ করেননি। তিনি নিজের প্রাণের টানে ঠাকুরকে গ্রহণ করেছিলেন এবং বহন করেছিলেন-মনন করেছিলেন এবং ধ্যান করেছিলেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যদি কিছু গিয়ে পৌঁছে থাকে তাহলে সেটা সেই নামীর স্পর্শ পাওয়া নামের বৈভব। ঠাকুরের একটা ছড়া আছে-
ভর দুনিয়ায় যেই যা করুক
ঠিক জানিস তুই থোক্
সব করারই পিছে আছে
প্রিয় উপভোগ।
বাবা ঠাকুরকে প্রিয় বলে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর আনন্দকে লক্ষ ক’রে নিজের সব কিছু নিয়োজিত করেছিলেন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যদি কিছু গিয়ে পৌঁছে থাকে তা হল সেই নিবেদিত প্রাণের বৈভব!
কলকাতায় মামাবাড়ি থেকে পার্কসার্কাসে বাড়িভাড়া নিয়ে চলে এসেছিলেন বাবা। কলকাতায় এসে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন, পশারও জমে উঠেছিল, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার দরুণ বাবাকে মা আর প্র্যাকটিস করতে দেননি। এরপরে বাবা বাড়িতেই থাকতেন। খুব নাম করতেন। ঘরে বসে কিছু লাইফ ইনস্যুরেন্সের কাজ করতেন। আমার দিদি এবং আমি দুজনেই স্কুলে পড়ানোর কাজে যোগ দিই। সেটা ১৯৪৯। বছরের শেষ দিকে আমার বড় ভাই শঙ্করের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে সিলেকশন হল এবং পরের বছরের শুরুতেই দেরাদুন চলে গেল। আমাদের দুই বোনেরই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল এবং একরাত্রে বিয়ে হয়ে গেল। ছোটভাই পুলককে নিয়ে মা-বাবা থাকলেন। ঐ বছর পুজো উৎসবে বাবা দেওঘর যাওয়ার পরে ঠাকুর দেওঘরেই গিয়ে থাকতে বললেন-বাবা ১৯৫১ সালে দেওঘরে চলে গেলেন। ছেলেদের লেখাপড়া, মেয়েদের বিয়ে নিয়ে গৃহস্থকে কত পরিকল্পনা কত হিসাব কত সঞ্চয়-জল্পনা-কল্পনা করতে হয়, ব্যতিব্যস্ত হতে হয়। কিন্তু বাবার ক্ষেত্রে ব্যাপারগুলি এত সহজে সংঘটিত হয়েছে যে তাকে লৌকিক হয়েও অলৌকিক ঘটনা মনে হয়।
বাবা-মা পুলককে নিয়ে দেওঘর চলে আসার পরে ওখানকার পরিবেশে বাবা কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। সেসময় দেওঘরে বাবার সহকর্মী বন্ধু, চেনাজানা পরিবার সকলে বাড়িঘর রুজি-রোজগারের পন্থা সব কিছু ফেলে যে- যেখানে যেমনভাবে পারেন এসে আশ্রয় নিয়েছেন। জীবনযাত্রা তখন কঠিন ছিল। সব পরিবারেই মা বাবাদের খাওয়াপড়ার যোগাড় করতে কায়িক অথবা মানসিকভাবে এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হত যে তাঁরা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো ইত্যাদির কথা চিন্তা করতে পারতেন না। বাবা পুরানদহের লক্ষ্মীকুটিরে ছিলেন। বাড়ির সামনে একটা বড় মাঠের মত ছিল। প্রাচীর ঘেরা বাড়িটায় অনেক ফলগাছ-ফুলগাছ ছিল -তার উপর স্বাভাবতই ছেলেদের আক্রমণ ছিল-মালীর তাড়নাও ছিল। বাবা ঘরের ইজিচেয়ারে বসে এসব দেখতেন। এসমস্ত ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর কী হবে, সেবিষয়ে বাবার চিন্তার অন্ত ছিল না। ওরা ঘুরে বেড়ায় কেন? আমার কাছে পাঠিয়ে দিও-এরকম কয়েকজনকে বলতেই মস্ত বড় দল তৈরি হয়ে গেল। পুলক বছর দেড়েকের মধ্যে বেলুড়ে পড়তে চলে গেল। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা মা বাবার আশেপাশেই ঘুরে বেড়াত। তাদের ইংরেজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, ছোটদের অক্ষর পরিচয়, যোগ-বিয়োগ- সবই ভাগে ভাগে চলতে থাকত। একটা ছোট্ট ছেলের কথা মনে আছে-একদম ভোরবেলায় স্লেট বুকে করে চলে আসত। মা সকালের নিত্যকর্মের ফাঁকে ফাঁকে তাকে মুখে মুখে পড়াতেন। বেশ মেধাবী ছিল ছেলেটি। পরপর ছ’সাতটা সংখ্যা বলে গেলেও তার যোগফল বলতে পারত। অত শীতে হাত-পা ঢাকা জামা ছিল না তার-মা খদ্দরের জামা আর পাজামা তৈরি করে দিয়েছিলেন নিজে, চটি কিনে দিয়েছিলেন। দু’তিনটি মেয়ে মা আর বাবার কাছে পড়ে স্কুল ফাইনাল দিয়েছিল। আমরা যখন যেতাম তখন আমাদের ভাগেও ছাত্রছাত্রী থাকত। দিদির তো পড়ানোর অভ্যাস ছিলই, আমিও না-ভুলে-যাওয়া পাঠগুলো পরিবেশন করতে ভালই বাসতাম। বাবা বলতেন, তুমি যতক্ষণ সমাজের মধ্যে আছ, কী-কী ভাবে তুমি সমাজকে সাহায্য করতে পার, তা তোমাকে খুঁজে বার করতে হবে। তুমি যদি পরিবেশকে উন্নত করতে চেষ্টা না কর, সেই অবনত পরিবেশ তোমাকে নামাতে চাইবে। মনে রেখো, এটা প্রাণের দায়।
বাবা দেওঘরে ছিলেন ১৯৫৯ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তারপর আমাদের ছেড়ে চলে যান। এই নয়/দশ বছর বাবার কাছে ছুটে ছুটে যাওয়ার আকর্ষণ আমাদের সবার কাছেই দুর্বার ছিল। তখনও তো ঠাকুরকে বুঝিনি-বাবাকেই জানতাম। আমার দীক্ষাদাতা ঋত্বিকও ছিলেন বাবা-ই। ১৯৫৪ সালে বাবার কাছে অনেক দিন ছিলাম। বিকেল বেলায় পাঁচিল ঘেরা লক্ষ্মীকুটিরের ভিতরের মাঠের পাশে বাঁধানো রাস্তার উপর বাবা চেয়ার নিয়ে বসতেন-আমি রাস্তায় ঘুরতাম। কোন কোনদিন অনেক কথা হত। ঐ বছরের ১লা এপ্রিলের ডায়েরি থেকে তুলে আলাপচারীর একটু নমুনা দিচ্ছি। কেমন করে বাইরের জগতে চলতে হয় সে-প্রসঙ্গে বলেছিলেন- “কথা বলবার সময়-বিশেষ করে কোন আলোচনার সময় বিশেষ নজর রাখতে হয় যাতে অবান্তর আর অপ্রয়োজনীয় কথা কিছু না আসে। সত্যি কথা হলেও তা বলতে নেই যদি মঙ্গলপ্রসূ না হয়। সত্যি কথা হলেও তা বিশেষ করে বলতে হয় না, যদি সে কথায় বিরোধের কোন সম্ভাবনা থাকে। কারণ সত্য এককভাবে কখনও সত্য নয়-সত্য, শিব এবং সুন্দর, এই trio যেখানে একাঙ্গীভূত নয়, সেখানে সত্যকে শুধু দন্ত ছাড়া আর কিছুই আখ্যা দেওয়া যায় না। সত্যের পিছনে চাই মঙ্গলকে-শিবকে; আর শিবই সুন্দর। যদি শিবকে বাদ দাও তবে যতই শক্তির অর্চনা কর, দক্ষযজ্ঞের মতই পণ্ড হয়ে যাবে।
আসল কথা, আত্মরতি চাই-self-contentment বলে যাকে; শিব আত্মরতিতে বিভোর, তাই শিব ভোলানাথ সর্বংসহ নীলকণ্ঠ আশুতোষ।”
আমি বললাম-ভাবলে পরে জিনিষটা বেশ অনুভব করা যায়-কিন্তু self- contented থাকা কি সহজ? থাকতে দেবে না পারিপার্শ্বিক। সংঘাতে সমালোচনায় পাগল করে দেবে। Contentment কে মনে করে জড়ত্ব, অসাড়তা। মনে করে লোকটা inert, inactive, আরও কত কী! মনটা বিষিয়ে উঠতে চায়, তিক্ততায় ভরে ওঠে। বাবা বললেন-আঘাত তো আসবেই। বাইরের সকলে আঘাত হানতেই তো জানে, প্রেমিক তো নয় দুনিয়ার সবাই। ভোলা মহেশ সেই আঘাতেই নীলকণ্ঠ। Overcome করতে হবে সে অবস্থাকে শুধু সহ্য করে। নইলে আত্মরতি থাকবে না। স্বয়ং তৃপ্ত থাকার পথে ঐটুকু সাধনা। লোকে ভুল বোঝে বুঝুক কী আসে যায় তাতে! নিজের মত করে ভেবে নাও সব কিছু। যারা নিন্দা করছে, তারাও তোমারই একটা ভাবের অভিব্যক্তি, যারা তোমার বিরুদ্ধে সমালোচনা করছে-তারাও তোমারই বিকল্প। নিজের সত্তার সাথে মিলিয়ে নাও সব কিছুকে, তৃপ্তি তোমাকে ছাড়বে না।’...
দিনটা বিশেষভাবে আমার মনে আছে এজন্য যে বাবার সঙ্গে এরকম আলাপচারীর সুযোগ আর হয়নি। এই বছরই কালীপূজার পরের দিন বাবার প্রথম স্ট্রোক হয়; পক্ষাঘাত হলেও খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিয়েছিলেন। তারপরেও ছাত্রদের পড়াতেন। কিন্তু বছর তিনেকের মাথায় আবার যে স্ট্রোক হয়, সেই পক্ষাঘাত আর নিরাময় হয়নি, বাক্রোধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও শেষের দিকে মায়ের অক্লান্ত চেষ্টায় কথা বলতে পারতেন একটু একটু। যাওয়ার কিছুদিন আগে মাকে বলেন- আমার খুব আনন্দ, আমার খুব আনন্দ। বেদনাক্লিষ্ট মুখে যে আনন্দের প্রকাশ, বাবার একটা ছবিতে তা পরিস্ফুট আছে। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ১৯৫৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর। ভয়ানক একলা বোধ করেছি। তারপর ভেবেছি-খুঁজে দেখব বাবা আমাদের কী সম্পদ দিয়ে গেছেন। সে এক অন্য গল্প। অন্য কালে অন্য সমাজচিন্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অন্য পরিবেশের ভিতর দিয়ে, নিজের অনুভূতি দিয়ে কেমন করে জেনেছিলাম-বাবা আমাদের জন্য যে পরমৈশ্বর্য রেখে গেছেন তা হল শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রয়। এমন সম্পদ আর হয় না। কিন্তু এ যে সম্পদ, তা যদি নিজের অনুভূতির কাছে ধরা না পড়ে, তবে তা শুধু শেখানো বুলি। আবার নিজের অনুভবকে হস্তান্তরও করা যায় না। বাবার সারা জীবনের চেষ্টা আমার প্রচেষ্টাকে জাগ্রত করতে পারে, অভিমুখী করে তুলতে পারে-কিন্তু করার ভাগ আমার আলাদাই থাকবে। ঠাকুর বলেছেন- ধর, কর, হও। অথবা-কর, হও, পাও। ধরার জায়গাটা বাবা ধরিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু আমার স্থানকালপাত্র পৃথক বলে যদি ধরার জায়গায় সংশয়দীর্ণ মনোভাব পোষণ করি, তবে করা আসবে না, হওয়া হবে না। “প্রাপ্য বরান্ নিবোধত” শ্রুতির এই বাণী বাবা তাঁর জীবনচর্যার মাধ্যমে রেখে গেছেন আমাদের জন্য এবং সেটাই একমাত্র। বাবাকে প্রণাম। আমার ঋত্বিককে প্রণাম। আমার প্রাণপ্রিয় দয়াল ঠাকুরকে প্রণাম ।
বন্দে পুরুষোত্তমম্।
_________________________________________
#সুবোধচন্দ্র_সেন
10