দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ :-
ঊনবিংশ শতকের বাংলার আকাশ যাঁদের দীপ্তিতে দীপ্যমান হয়ে ছিল, চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যদের একজন। তাঁর পারিবারিক প্রেক্ষাপট, সুবৃহৎ কর্মজীবন, রাজনৈতিক মতবাদের স্বাতন্ত্র্য ও দার্ঢ্য, অনবধি দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি তাঁর অস্তিত্বের সর্বব্যাপী মহাপ্রাণতা-এ সবই তাঁকে এক অনন্য বিশিষ্টতা প্রদান করেছে। ঢাকা জেলার তেলিরবাগের আদি নিবাসী, কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নি ভুবনমোহন দাশ ও নিস্তারিণী দেবীর দ্বিতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠ পুত্র চিত্তরঞ্জনের জন্ম হয় কলকাতায়, ৫ই নভেম্বর, ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে। ভবানীপুরের লণ্ডন মিশনারি স্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু। ১৮৯০-এ প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ড যান এবং ১৮৯৩-এ মাত্র তেইশ বছরে ব্যারিস্টার হয়ে স্বদেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে পিতা ভুবনমোহন বন্ধুর জামিন হতে গিয়ে দেউলিয়া হন। কিন্তু আর্থিক দৈন্য ও দুরবস্থায় অবদমিত হওয়ার মানুষ চিত্তরঞ্জন ছিলেন না। সাত বছরের মধ্যে ১৯১৩-তে পিতৃঋণ পরিশোধ করে তিনি দেউলিয়া নাম খণ্ডন করেন। চিত্তরঞ্জনের প্রভূত উপার্জন, বৈভব, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, প্রতিপত্তি এবং দানশীলতা তাঁর সমসময়েই নানা কিংবদন্তীর জন্ম দেয়। এর পাশাপাশিই সমান্তরালভাবে ছিল তাঁর স্বদেশচেতনা ও রাজনীতিভাবনা। প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র থাকাকালীনই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবর্তিত সুডেন্টস্ ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর চমকপ্রদ আইন ব্যবসার সাফল্যের মধ্যে একটি বিরাট অংশ জুড়ে আছে নানা রাজনৈতিক মামলায় অংশগ্রহণ, যার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার (১৯০৮) আসামী অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ প্রমুখের পক্ষ সমর্থন ও গরিমাময় সাফল্য। জাতীয় কংগ্রেসে সক্রিয় যোগদান করে অল্পকালের মধ্যেই চিত্তরঞ্জন প্রথম সারির নেতারূপে গণ্য হন এবং গাঁধীজির অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বানে বিপুল আয়ের ব্যারিস্টারি পেশা ত্যাগ করে দেশসেবায় সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় তিনি ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ব্যারিস্টার- রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। স্বয়ং ভারত সরকার প্রখ্যাত মিউনিশনস্ বোর্ড-ঘটিত মামলায় প্রচলিত নজির উপেক্ষা করে ব্রিটিশ অ্যাডভোকেট জেনারেল অপেক্ষা অধিক পারিশ্রমিক দিতে স্বীকৃত হয়ে তাঁকে সরকারি কৌঁসুলি নিযুক্ত করেন। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে আইন ব্যবসা পরিত্যাগ করায় তিনি এ কাজও পরিত্যাগ করেন। তাঁর অসামান্য ত্যাগের ফলে সারা দেশ উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে ও তাঁকে ‘দেশবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। নিজের ও পরিবারবর্গের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ত্যাগ করে সন্ন্যাসীসুলভ অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা বেছে নেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন।
এই অসাধারণ সাফল্য ও কর্মময় মহাপ্রাণ মানুষটির অন্তরের অন্তস্থলে ছিল আর এক গূঢ় বুভুক্ষা, তৃষ্ণা, যার পরিচয় সাধারণ্যে সর্বদা উন্মোচিত হয়নি। এক
অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা, আত্মানুসন্ধান তাঁর মধ্যে ছিল সহজাত। তাঁর পিতা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় তাঁকেও ব্রাহ্ম পরিমণ্ডলীর মধ্যে বড় হতে হয়েছিল-কিন্তু সনাতন হিন্দুধর্মের প্রতিই ছিল চিত্তরঞ্জনের সুগভীর প্রত্যয়। তাঁর ভাগিনেয়ী সুগায়িকা সুলেখিকা সাধিকা সাহানা দেবীর ভাষায় “... মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একটি সত্যকারের হিন্দু। হিন্দুধর্মের যেটি প্রাণ সেইটি তিনি বুঝেছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন, তাই তার ডালপালাকে আশ্রয় না করে একেবারে মূলকেই আশ্রয় করেছিলেন। প্রকাশ্যে যখন নিজেকে হিন্দু বলতে আরম্ভ করেন তখন ব্রাহ্মসমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ একজন তাঁকে এসে বলেন- ‘তুমি তাহলে তোমার পিতার ধর্ম রাখলে না!’ উত্তরে মামাবাবু তাঁকে বলেন, ‘পিতার ধর্ম রাখাই যদি পুত্রের ধর্ম হয় তবে আমার পিতা কখনও তাঁর পিতার ধর্ম পরিত্যাগ করতেন না।...’
অবসরবিহীন সদা ব্যস্ত জীবনধারার মধ্যেও তাঁর অন্তরের কী এক আকুলতা তাঁকে বারেবারে উদ্বেল করে তুলেছে। শ্রীঅরবিন্দের কাছে যোগসাধনার অভিপ্রায় ছিল তাঁর, কিন্তু ‘রাজনীতি ও যোগসাধনা দুটো একসঙ্গে করা সম্ভব নয়’-বলে শ্রীঅরবিন্দ তাঁকে নিরস্ত করেন।
অবশেষে ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি, ৫৪ বছর বয়সে চিত্তরঞ্জনের জীবনে এক লগ্ন আসে, যা হয়তো পূর্বনির্দিষ্ট ছিল। ১৯২৪-এর এপ্রিল মাসে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, ছত্রিশ বছরের যুবা, কলকাতায় মানিকতলা স্ট্রীটের একটি ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ঐ সময়ে পাবনা সৎসঙ্গে বায়ুচালিত তড়িৎযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়েছিল। সেই সূত্রে ঋত্বিগাচার্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য, যতীন রায় এবং সুশীলচন্দ্র বসু দেশবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। দেশবন্ধুর জীবনীকার হেমেন দাশগুপ্ত তাঁদের দেশবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পাবনা সংসঙ্গ থেকে আগত শুনে তিনি সাগ্রহে জানান যে ঠাকুরের কথা তিনি বিপ্লবী বারীন ঘোষের কাছে শুনেছেন এবং ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি বিশেষ আগ্রহী। বারীন ঘোষ দ্বীপান্তর থেকে ফিরে পাবনা আশ্রমে ঠাকুরের সাহচর্যে কিছুদিন কাটিয়ে অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং কলকাতায় ফিরে দেশবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় ‘পাবনা সৎসঙ্গীর মধুচক্র’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।
সিরাজগঞ্জে কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান করতে যান চিত্তরঞ্জন; ঠাকুরের নির্দেশে তাঁর সঙ্গে সুশীলচন্দ্র বসুও সিরাজগঞ্জ যান এবং অবকাশমত ঠাকুরের সম্বন্ধে নানা আলাপ আলোচনা করেন। সিরাজগঞ্জ অধিবেশন থেকে ফেরার দিন দশেক পরে একদিন সন্ধ্যায় দেশবন্ধু মানিকতলার বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এলেন। তখন সেখানে চলছিল তুমুল কীর্তন। গাড়িবারান্দার ছাদে মাদুরে বসেছিলেন ঠাকুর- দেশবন্ধুকে দেখেই অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গীতে সৌহার্দ্যের সঙ্গে “আসেন দাদা, বসেন” -বলে মাদুরে বসালেন। বহু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হতে থাকে- অসহযোগ আন্দোলন, স্বরাজ, চরকা, খদ্দর ইত্যাদি। মহাত্মা গাঁধী সম্বন্ধেও কথা উঠল। দেশবন্ধু বললেন-চরকা ও খদ্দরে দেশের খানিকটা উপকার হলেও তাতেই যে দেশোদ্ধার হবে তা তাঁর বিশ্বাস হয় না। প্রসঙ্গত বলা যায়, গাঁধীজির সঙ্গে মতান্তরের দরুন তিনি ১৯২২-এ কংগ্রেস ত্যাগ করে ‘স্বরাজ দল’ গঠন করেন, যা তাঁর এবং মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অত্যল্প সময়ের মধ্যে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দলরূপে পরিগণিত হয়।
ঠাকুরের সঙ্গ পেয়ে চিত্তরঞ্জনের যেন মনের অর্গল খুলে গেল। প্রথম দিনেই তিনি তাঁর জন্মজন্মান্তরের পরম আশ্রয়কে চিনে নিয়ে তাঁর পায়ে নিজেকে সমর্পণ করলেন। দেশবন্ধুর দীক্ষাগ্রহণ পর্ব বিষয়ে সুশীলচন্দ্র বসু প্রণীত ‘মানসতীর্থ পরিক্রমা’ থেকে নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক:
“শ্রীশ্রীঠাকুর বলতে লাগলেন,-দাশদা, শুধু খদ্দরে কী হবে বলুন দেখি? আর জেলে গেলেই বা কী হবে? ইংরাজকে কি এমনই শক্তিহীন মনে করেন যে, এতেই তারা ভয় পেয়ে ভারত ছেড়ে পালিয়ে যাবে? আর যা করলে (মানুষ) জেলে যায়, তা করলে জেলেই যায়; আর জেলে গেলে যা হয়, তাই-ই হয়, স্বাস্থ্য যায়, শক্তিক্ষয় হয়, মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়।
দেশবন্ধু প্রশ্ন করলেন-তবে কী করব?
-দেশটাকে যদি স্বাধীনই করতে চান, তবে... কোথায় দেশবাসীর দুঃখ, জনসাধারণের কোথায় অভাব, অন্তরের দরদ দিয়ে বুঝে, তা দূর করবার জন্য তীব্রভাবে কাজে লাগেন; আর এর ফলে যখন দেশবাসীরা আপনাদের সেবাকে ইংরেজের সেবার চাইতে বেশী বলে প্রাণে-প্রাণে বুঝবে, তখন ‘স্বরাজ’ ‘স্বরাজ’ বলে চীৎকার না করলেও স্বরাজ আপনিই এসে যাবে।
-কিন্তু যা-ই করতে যাই, তাতেই তো ইংরেজরা বাধা দেয়।
-এমন জায়গায়, এমন platform-এ দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়, যাতে কারো সঙ্গে কোনও বিরোধ না বাধে। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী যখন এদেশে আসে, তখন ইংরেজরা এল ব্যবসার সাথে তাদের কৃষ্টি নিয়ে। ব্যবসা দিয়ে যেমন তারা দেশবাসীর চাহিদা মেটাতে লাগল, সেই সঙ্গে নানাভাবে তাদের culture-কেও establish করতে লাগল। পাদ্রীরা বসিয়ে দিল স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি। সে-সব দিয়ে ক্রমশ তারা দেশবাসীর মন জয় করে নিল।
আপনারাও যদি শুধু বক্তৃতা না দিয়ে, ইংরেজকে গালি না দিয়ে, দেশের কোথায় ব্যথা তা অনুভব করেন, দেশের সেবায় লেগে যান, তবেই না আপনারা দেশটাকে জয় করতে পারবেন।... আমি বুঝি সেবা, - মানুষের সবরকম অভাব দূর করা। একে যদি politics বলেন, তবে এই-ই আমার politics।
একথায় উদ্দীপ্ত হয়ে দেশবন্ধু বলে উঠলেন-কী করব তাহলে বলে দিন। আমারও আর এ রাজনীতি ভাল লাগে না, কিন্তু এমন জড়িয়ে গেছি যে কিছুতেই যেন আর বেরুতে পারছি না। এমন একজন উপযুক্ত লোকও খুঁজে পাই না, যার হাতে সব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি।
-সে কি? এত বড় দেশটায় আপনার সাহায্যকারী একটা লোকও খুঁজে পাচ্ছেন না; এও কি একটা কথা?
-তাই তো দেখছি। কাজের ভার দিলে কেউই ঠিকমত পারে না। আবার যার ভাল করি, সে-ই হয়ে ওঠে নিন্দুক, বিশ্বাসঘাতক।
-দেখুন তবে; আপনিই বলছেন, সারা দেশে মানুষের মত মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না। অথচ একা আপনি তো আর স্বরাজ আনতে পারবেন না; সাহায্যকারী না পেলে, কাজ করবেনই বা কাদের নিয়ে?
আরো দেখুন, দেশের এতবড় একটা অভাব আপনারা বুঝতে পাচ্ছেন, অথচ সেদিকে না তাকিয়ে, তাড়াহুড়ো করে আপনারা স্বরাজও আনতে চাইছেন। তাতেই তো বোঝা যাচ্ছে যে স্বরাজ আপনারা চান না। তা যদি চাইতেন, তবে আমার মনে হয়-আগে মানুষ তৈরী করতেন। তা না করে আপনারা শুধু ইংরেজের দোষই দেখছেন। ওদের দোষ দেখতে দেখতে, ওদের কী গুণে যে আমরা ওদের অধীন হয়ে আছি, তা আর নজরেই পড়ছে না!
দেশে মানুষ পাবেন কী করে দাশদা, দেশের সমাজটা যে একদম পচে গেছে। ঘরে-ঘরে অশান্তি, দাম্পত্য-কলহ আর শিশু মৃত্যু। আজকাল বিবাহ ঠিকমত হচ্ছে না, তাই ভাল ছেলে জন্মাবে কী করে? সমাজটাকে যদি এখনও সংস্কার করতে পারেন তবে অসম্ভব নয় যে কুড়ি-পচিশ বৎসরের মধ্যে এমন সব যুবক পাবেন যারা দেশের সত্যকার কর্মীর অভাব দূর করতে পারবে।
দেশবন্ধু মন্ত্রমুগ্ধের মত শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখনিঃসৃত বাণী শুনতে লাগলেন। দেশের সমাজ ও অর্থনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে এমন সব কথা হতে লাগল, যা দেশবন্ধুর মত আমাদেরও অন্তরকে স্পর্শ করল। দেশবন্ধু শেষে বললেন-রাজনীতির কাজে আমি আর মন-প্রাণ দিয়ে লাগতে পারছি না। সমাজ-সেবাই যেন আমার মন চায়। আর এমন করে গোলমাল বাড়িয়ে স্বরাজ পাওয়া যাবে না, তাও বুঝি। তবু এই মরা দেশটাকে একটা হুজুগে মাতিয়ে রাখতে চাইছি, আর কেমন করে নিজেই যেন সেই হুজুগের ঘূর্ণিপাকটাতে পড়ে গেছি।
শেষে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-দেখুন দাশদা, যিনি সবটা দেখতে পান, এমন একজন ঋষি বা Seer পিছনে না থাকলে কোন কাজ হয় না। অর্জুনের শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন, রামদাস ছিলেন বলে শিবাজী মহারাষ্ট্র জাতি গড়ে তুলেছিলেন, আর চাণক্য ছিলেন বলেই চন্দ্রগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত হতে পেরেছিল। আবার রাণা প্রতাপ অত শক্তিশালী হয়েও তেমন কিছুই গড়ে তুলতে পারল না, শুধু তার পিছনে অমন কেউ ছিল না বলেই। দেশবন্ধু তখন বালকের মত বললেন-তবে কী করতে হবে আমায় বলে দিন।
-‘নাম’, খুব ‘নাম’ করতে হয় দাদা!
-‘নাম’ তো কত করেছি; কই কিছুই তো হল না।
-কেমন করে করব, বলে দিন।
-শুনে নিতে হয়, কী করে করতে হয়; আর তাই অনবরত করতে হয়।
-মা’র কাছে শুনে নিন, মা জানেন।
জননী মনমোহিনী তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি আসতেই দেশবন্ধু উঠে গিয়ে তাঁর কাছে বসলেন। দীক্ষাগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করতেই, একটু ভেবে মা বললেন-দেখ তোমরা বড়লোক; বড়লোকদের আমার মোটেই বিশ্বাস হয় না, তারা ভগবানকে অনুগ্রহ করে। অদূরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখিয়ে বললেন-ও বালক, ওর কি বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে? ওর কথায় অনেকে লাফিয়ে ওঠে, শেষে থাকতে পারে না। দীক্ষা এখন থাক, আগে মন ঠিক কর গিয়ে।
মা’র কথা শুনে দেশবন্ধু আগেবভরে বললেন-মা! আপনার দয়া যে পাব না, তা আমি জানি! আমার মত পাপীর উপর দয়া কেমন করে হবে? জগন্নাথের মন্দিরে কত লোক যায়, আমি অভিমানে সে মন্দিরে কখনো ঢুকিনি। জগন্নাথ সবাইকে দয়া করেন দেখতে পাই, শুধু আমাকেই করেন না।
দেশবন্ধুর কাতরতায় মায়ের মন ভিজে গেল। মা বললেন-দেখ, কতলোককেই তো দেখলাম; তারা ধরে থাকতে পারে না, কিছুদিন বাদেই ছেড়ে দেয়, আর শেষে বলে-ওতে কিছু হয় না। তারপর কত কী নিন্দা করে বেড়ায়!... তুমি চিত্তরঞ্জন! দেশজোড়া তোমার নাম, কত লোক তোমায় মানে, কত বড়লোক তুমি! আর বড়লোক যখন আমাদের মত লোকের কাছে আসে, তখন কৃতার্থ করতেই আসে। তাই বলি, কৃতার্থ করতে যদি এসে থাক, তবে ‘নাম’ নিয়ে আর কাজ নেই। অন্যান্য বড়লোকদের মত তুমিও কিছুদিন বাদে সব ছেড়ে দেবে।
দেশবন্ধু মায়ের কথা শুনে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন-মা, চিত্তর অনেক দোষ থাকতে পারে, কিন্তু তার পরম শত্রুও কখনো একথা বলবে না যে, সে যেখানে-সেখানে গিয়ে মাথা নত করে। আর এটাও সকলে জানে, চিত্ত একবার যেখানে মাথা নত করে, সেখান থেকে আর সে মাথা কখনও ওঠায় না। আমি মা কৃতার্থ করতে আসিনি, কৃতার্থ হতেই এসেছি। আপনি আমায় দীক্ষা দিন।
দেশবন্ধুর কথায় মায়ের হৃদয় গলে গেল। ছাদের উপর, উন্মুক্ত আকাশের তলে মা দেশবন্ধুকে দীক্ষা দিলেন ও কত কথা বললেন। দীক্ষা গ্রহণান্তে তিনি মা ও শ্রীশ্রীঠাকুরের পদধূলি নিয়ে নেমে গিয়ে মোটরে উঠলেন। ১৯২৪ সালের ১৪ই জুন শনিবার সন্ধ্যায় দেশবন্ধু দীক্ষা গ্রহণ করেন।”
দেশবন্ধুর এই দীক্ষাগ্রহণ রাজনৈতিক মহলে, বিশেষত তাঁর নিজের স্বরাজ দলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তা তাঁকে কোনভাবে বিচলিত করতে পারেনি। অনেকেরই অভিমত ছিল যে যে-কোন ভাবেই হোক দেশবন্ধুকে ঠাকুরের সংস্পর্শে আর যেতে দেওয়া হবে না। এরকম কয়েকজন হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি বলেন- তোমরা এরূপ চেষ্টা থেকে বিরত হও। আমি জানি, শ্রীশ্রীঠাকুর-সম্বন্ধে, he has got a very strong sentiment। তোমরা কর্তার কাছে (দেশবন্ধুকে তাঁরা ‘কর্তা’ বলতেন) শ্রীশ্রীঠাকুরের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেই তিনি তোমাদের প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হবেন।
অনেকের ধারণা-দেশবন্ধুর ঠাকুরের কাছে দীক্ষা গ্রহণের ঘটনাটি কল্পিত। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর ‘দেশবন্ধু স্মৃতি’ (১ম সংস্করণ) এবং সাহানা দেবীর ‘স্মৃতির খেয়া’ গ্রন্থ পাঠ করলে এই ভ্রান্তির নিরসন সম্ভব। দীক্ষা গ্রহণের তিনদিন পরে তিনি আবার মানিকতলায় ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন-ঐ সময় পল্লী সংস্কার নিয়ে তিনি বিশেষ ভাবিত ছিলেন। গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্প ও ছোট ছোট ব্যাঙ্ক স্থাপন করে গ্রামজীবনে কীভাবে সমৃদ্ধি ও নবজীবন আনয়ন করা সম্ভব-এ সমস্ত গ্রাম-সংগঠনের বিষয়ে ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিস্তৃত আলাপ আলোচনা হল। যাওয়ার সময় দেশবন্ধু জানালেন যে স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি তাঁর FORWARD পত্রিকায় গ্রামসংগঠন সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রকাশ করবেন। কয়েকদিন পরেই ঐ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।
সেবার ঠাকুরের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় দেশবন্ধু ঠাকুরকে বলেন- দেশের কাজে এমন জড়িয়ে পড়েছি যে যখন খুশি আশ্রমে গিয়ে আপনার সঙ্গ-সুখ লাভ করব, তারও উপায় নেই। আপনার কর্মীদের মধ্যে এমন যদি কেউ থাকেন যিনি আমার বাড়ি গিয়ে মাঝে মাঝে থাকতে পারেন, তবে তাঁর সঙ্গে আলাপাদি করে আপনার বিভিন্ন বিষয়ে মতবাদগুলি সব জানতে পারি। ঠাকুর উত্তরে বলেছিলেন, আচ্ছা, চিন্তা করে দেখব আপনার বাড়িতে কাউকে পাঠাতে পারি কিনা। পরবর্তীকালে ঠাকুর সুশীলচন্দ্র বসুকে দেশবন্ধুর বাড়িতে পাঠান। তাঁকে পেয়ে দেশবন্ধু মহাখুশি। দোতলার যে ঘরে তিনি থাকতেন, তারই পাশের ঘরে সুশীলচন্দ্রের থাকার ব্যবস্থা করেন।
আশ্রম বিষয়ক নানা আলাপ আলোচনায় একবার সুশীলচন্দ্র দেশবন্ধুকে বায়ুচালিত তড়িত্যন্ত্রের সম্বন্ধে বলেন। দেশবন্ধু হেসে বলেন-আমিও ফকির হলাম, আর আপনারাও আমার কাছে এলেন। আগেকার সময় হলে আমি একাই এটার ভার নিতে পারতাম। নিঃস্ব হয়েও তিনি এই কাজে দু’হাজার টাকা দিয়েছিলেন। একটি অংশীদারি কেমিক্যাল ওয়ার্কস্ ছিল দেশবন্ধুর যেটি পরে উঠে যায়। তার কতগুলি আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি এবং একটি সূক্ষ্ম কেমিক্যাল ব্যালেন্স তিনি বিশ্ববিজ্ঞানাগারের জন্য দেন। এমন কী তাঁর নিজের ব্যবহারের রেমিংটন টাইপ মেশিনও আশ্রমের কাজের জন্য দান করেন।
কলকাতা করপোরেশনের মেয়র থাকাকালীন একবার দেশবন্ধু সুশীলচন্দ্রকে বলেন-দেখুন, বালিগঞ্জ লেকের ধারে পঞ্চাশ বিঘা জমি আমার Control-এ আছে, সেটা আমি আপনাদের আশ্রমের জন্য দিতে পারি। ঠাকুরকে বলে আপনারা যদি এখানে আশ্রম স্থাপন করেন, তাহলে দেশের জনসাধারণ ও বড় বড় লোক আপনাদের কাজকর্ম প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাবেন। তাঁদের সাহায্য ও সহানুভূতি পেয়ে আশ্রম সহজে সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে আর আশ্রম স্থাপনের উদ্দেশ্যও সফল হবে শীঘ্রই।
সুশীলচন্দ্র কলকাতা থেকে আশ্রমে ফিরে দেশবন্ধুর প্রস্তাব ঠাকুরের কাছে নিবেদন করেন। সব শুনে ঠাকুর বলেন-দাশদা ও আপনার অনুমান ঠিকই, আশ্রম ওখানে হলে তা শীঘ্রই বড় হয়ে উঠবে। কিন্তু আমি কী ভাবছি জানেন? একটা অজ পাড়াগাঁ, যেখানে কোন কিছুরই সুবিধা নেই, বরং পদে পদে বাধাবিঘ্ন অনেক, এরকম একটা জায়গায় থেকে, আপনারা যদি নিজেদের আশ্রম গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে কোন কিছুই আপনাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই কলকাতার সুবিধার চাইতে এখানে হিমাইতপুরে থেকেই আশ্রমের কাজ চালিয়ে যাওয়া আমি পছন্দ করি।
সুশীলচন্দ্র বলেন যে আশ্রম স্থাপন না করলেও, দেশবন্ধুর ইচ্ছানুযায়ী জমিটা নিয়ে রেখে দেওয়া যায়, ভবিষ্যতে বিক্রয় করলে বেশ কিছু অর্থাগম হতে পারে তাতে। ঠাকুর দৃঢ়ভাবে জানান-সেখানে আশ্রম স্থাপনের যখন কোন সংকল্পই আপাতত নেই, তখন জমি নেব কেন?
সকল আসক্তির অতীত শ্রীশ্রীঠাকুরের নিস্পৃহতায় এভাবেই দেশবন্ধু-প্রস্তাবিত জমি গ্রহণ পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
দেশবন্ধুর বাড়িতে থাকাকালীন সুশীলচন্দ্রের বহু দেশবরেণ্য নেতাকে সামনে থেকে দেখার ও তাঁদের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়। এঁদের মধ্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের পিতা জানকীনাথ বসু ও মাতা প্রভাবতী দেবী সৎনামে দীক্ষিত ছিলেন। সুভাষচন্দ্রও ছিলেন ঠাকুরের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। একাধিকবার তিনি আশ্রমে যান এবং ঠাকুরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন। শেষবারের মতন যখন ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তারপর ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য ও সুশীলচন্দ্রকে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- “শ্রীশ্রীঠাকুর আপনাদের যে-পথে পরিচালিত করছেন, সেটাই সর্বকালের সর্বমানবের পথ, এতে কোন সন্দেহ নেই। বৈদেশিক শাসন থেকে ভারত যখন মুক্তি লাভ করবে, তখন তাকে এই পথই অনুসরণ করতে হবে।” সুভাষচন্দ্রের ঐতিহাসিক অন্তর্ধানের পূর্বে এলগিন রোডের যে বাড়িতে তিনি অন্তরীণ ছিলেন, সেই বাড়িতে তাঁর শয়নকক্ষের দেওয়ালে ঠাকুরের একখানি বৃহৎ আলোকচিত্র বহুদিন পর্যন্ত টাঙানো ছিল, পরে কোন অজ্ঞাত কারণে সেটি সরিয়ে দেওয়া হয়।
একবার সুশীলচন্দ্র দেশবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন যে প্রথম দর্শনেই তিনি ঠাকুরকে কীভাবে গুরুরূপে বরণ করেন? তা কি নেহাৎ সাময়িক ভাবোচ্ছ্বাসে? দেশবন্ধু প্রত্যুত্তরে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন-না, তা নয়; আমি ভাবের ঘোরে তাঁকে গ্রহণ করি নি। প্রথম দর্শনেই যা আমাকে মুগ্ধ করল তা হচ্ছে তাঁর wonderful child-like simplicity (আশ্চর্য বালকসুলভ সরলতা)।... পূর্ণজ্ঞান না হলে এরূপ সারল্য সম্ভব নয়। তারপর আমি যে সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন। was beset with innumerable difficulties, which, inspite of the knowledge and experience I had, I could not solve (আমি এত অসংখ্য বাধাবিঘ্নতে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম যে আমার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়েও তার কোন সমাধান পাইনি)। আমার জীবনের সেই সব অসুবিধা ও বাধা-বিঘ্নের কথা যখন তাঁর কাছে বললাম তখন তিনি মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে, সামান্য কটা কথায় আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। তখনই আমি বুঝলাম-ইনি কেবল শিশুর মত সরলই নন, অসাধারণ জ্ঞানীও বটেন। তাই তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ না করে আর কোন উপায়ই রইল না।
দীক্ষা গ্রহণের কিছুদিন পরে চিত্তরঞ্জন পুত্র চিররঞ্জন ও পুত্রবধূ সুজাতা দেবীকে সৎমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে পাবনায় সৎসঙ্গ আশ্রমে পাঠিয়ে দেন-তাঁরা সুদীর্ঘ দিন সেখানে ছিলেন। দেশবন্ধু দীক্ষা নেওয়ার পর থেকেই নিয়মিত নামধ্যান করতেন এবং যেখানেই যেতেন সবার কাছে ঠাকুরের কথা বলতেন। পরবর্তীকালে সুশীলচন্দ্র বম্বে বিধানসভার স্বরাজ দলের সদস্য ডঃ জয়াকর এবং মথুরায় এ. আই. সি. সি. সদস্য হাকিম ব্রজলাল বর্মন-এর কাছে দেশবন্ধুর দীক্ষাগুরুর প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধার কথা শুনেছেন। দেশবন্ধুর অনুরোধেই গাঁধীজি পাবনা সৎসঙ্গ পরিদর্শনে আসেন।
১৯২৪-এর ডিসেম্বরে নিজের বাড়িটি পর্যন্ত দেশের সেবায় দান করে চিত্তরঞ্জন বন্ধু পল্টু করের বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে সপরিবারে উঠে যান। ইতিমধ্যে অমানুষিক পরিশ্রমে তাঁর শরীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। তা সত্ত্বেও কর্মধারার কোন বিরতি ছিল না। ১৯২৫-এর ২রা মে ফরিদপুর কংগ্রেসে যোগদান করেন। ফরিদপুর থেকে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য দার্জিলিং যাওয়া ঠিক হয়। দেশবন্ধু ফরিদপুর আসছেন শুনে ঠাকুর ফরিদপুর থেকে পাবনা আসার জন্য অনুরোধ করে তাঁকে একটি মধুর, আন্তরিক চিঠি পাঠান। ১১ই মে স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে চিত্তরঞ্জন কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে পাবনা আশ্রমে আসেন। তার আগে থেকেই চিররঞ্জন সেখানে সপরিবারে বাস করছিলেন।
পদ্মাতীরে একটি ছোট বাংলোতে দেশবন্ধুর থাকবার ব্যবস্থা হয়। বাংলোর সামনে বাঁধানো বেদীতে বসে গভীর রাত পর্যন্ত ঠাকুরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সাধনা, শিক্ষা, দর্শন, সমাজ, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি বহু বিষয়ে আলোচনা চলত। দার্জিলিং থেকে ফিরে কী কী কাজে হাত দেবেন, ঠাকুরের সঙ্গে সেসবও পরামর্শ করলেন।
আশ্রমে দিন দুই থাকার পরেই দেশবন্ধু অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুরোধেই তিনি আরও কিছুদিন থেকেও যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিবার-পরিজনের আগ্রহাতিশয্যে দার্জিলিং চলে যেতে বাধ্য হন। বিদায়কালে ব্যথাতুর কন্ঠে ঠাকুর বললেন-যেতে দেওয়ার ইচ্ছা আমার মোটেই ছিল না, কিন্তু কী করব, উপায় নেই। দেশবন্ধুর অনুরোধে তাঁর পি. এ. হিসেবে সবসময় কাছে থাকার জন্য আশ্রমকর্মী মনোহরচন্দ্র বসুকে ঠাকুর সঙ্গে দিলেন; ইনি মহাপ্রয়াণের সময় পর্যন্ত দেশবন্ধুর পাশে ছিলেন। আশ্রম থেকে যাওয়ার সময় মোটরে ঈশ্বরদি যাওয়ার পথে দেশবন্ধু সুশীলচন্দ্রকে বলেন-আমার জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য, যা এতদিন আবছার মত ছিল, শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গ পেয়ে তা স্ফুটতর হয়ে উঠেছে আমার কাছে। আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই যে, কী করে একজনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাধারা, এরকম আর একজনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিলে যেতে পারে। দুটো শরীর আলাদা, কিন্তু মনের এ রকম অপূর্ব মিল কী করে সম্ভব হয়-তা বুঝি না।
১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই জুন, মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে দার্জিলিং-এ মহাপ্রাণ দেশবন্ধুর মহাপ্রয়াণ ঘটে। সমগ্র দেশ শোকে উদ্বেল হয়ে ওঠে তাঁর অকাল প্রয়াণে। কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে যায় তাঁর জীবনের অন্তিম পর্বের ইষ্ট-আকূতি। মৃত্যুশয্যা পার্শ্বে উপবিষ্ট মনোহরচন্দ্র বসু জানিয়েছেন, ‘ভোম্বল (চিররঞ্জনের ডাকনাম)! আমি পাবনা যাব’-এই কথা কটি বলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রোগশয্যায় দেশবন্ধুর ইষ্ট চিন্তা ও ধ্যানই মুখ্য ছিল। মৃত্যুর ঠিক আগের দিন ‘FORWARD’ পত্রিকার সম্পাদক প্রফুল্ল চক্রবর্তীর সঙ্গে আলোচনা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলে দেশবন্ধু বললেন- এখন এসো প্রফুল্ল, আমি একটু ‘নাম’ করব। ঐদিন হেমেন দাশগুপ্ত দার্জিলিং থেকে কলকাতা ফেরার সময় তাঁর কাছে বিদায় নিতে গেলে তিনি বলেন-তুমি পাবনা হয়ে যেতে পারবে?
কলকাতায় দেশবন্ধুর শ্রাদ্ধবাসরে শ্রীশ্রীঠাকুরের পুষ্পশোভিত প্রতিকৃতি রাখা হয়েছিল। জননী মনমোহিনী তাঁর শবযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন। চিত্তরঞ্জনের প্রয়াণের বেশ কিছুদিন পরে একবার কলকাতায় তাঁর পত্নী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে সুশীলচন্দ্র বসুর সাক্ষাৎ হয়। সেসময় বাসন্তী দেবী সুশীলচন্দ্রকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান যে, তাঁর স্বামী মৃত্যুশয্যায় তাঁকে বলে যান শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে-কিন্তু নানা কারণে স্বামীর মৃত্যুশয্যার সে অনুরোধ তাঁর পক্ষে রাখা সম্ভব হয়নি। বাসন্তী দেবীর এই উক্তির মাধ্যমে বোঝা যায়, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চিত্তরঞ্জনের অন্তরে ঠাকুরের জন্য কী তীব্র আকুলতা ব্যাপ্ত হয়ে ছিল।
দেশবন্ধু পাবনা থেকে দার্জিলিং-এ যাওয়ার পরে ঐ সময়ে দার্জিলিং-এ যাঁরা দেশবন্ধুকে দেখেছেন, তাঁরাই তাঁর চরিত্রে শ্রীশ্রীঠাকুরের সুগভীর প্রভাব অনুভব করে অভিভূত হয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী দেশবন্ধুরই অনুরোধে পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রম পরিদর্শনে যান দেশবন্ধু আশ্রম থেকে দার্জিলিং চলে যাওয়ার অল্প কিছুদিন পরে। আশ্রম পরিদর্শনের কিছুদিন পরে মহাত্মাজি দাজিলিং গিয়ে দেশবন্ধুর সান্নিধ্যে কয়েকদিন কাটান। তাঁদের মধ্যে এই সময়কার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় ঠাকুরের সাহচর্যে দেশবন্ধুর স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন ফুটে ওঠে। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রিকায় মহাত্মা গাঁধীর লেখায় বিষয়টি পরিস্ফুট হয়। গুজরাটি সাপ্তাহিক ‘নবজীবন’-এ গাঁধীজি লেখেন- ‘শেষ চার মাসে দেশবন্ধুর চরিত্রে অতি অদ্ভুত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। তাঁর বদ-মেজাজের পরিচয় আগে অনেকেই পেয়েছেন, কিন্তু ফরিদপুরে তাঁর নম্রতার যে পরিচয় পেলাম, তা যেন তার পর থেকে বেড়েই চলল।... দার্জিলিং এসে দেখলাম তার পূর্ণ পরিণতি। এই পাঁচ দিনের স্মৃতিচারণে আমার কোন ক্লান্তি নেই। সেসময়ে তাঁর প্রতি কথায় ও কাজে যেন ভালবাসা উচ্ছে পড়ত। তাঁর আশাবাদও এসময়ে অতিশয় তীব্র ছিল।... বলেছিলেন-যতদূর সম্ভব, মানুষের হৃদয় জয় করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ঐ একই পত্রিকায় গাঁধীজি আরও লিখেছেন- ‘দার্জিলিং-এ তাঁর কাছে যখন যাই তখন তিনি বাড়িতে মাছ মাংস ঢুকতে দিতেন না। তিনি আমাকে বার কয়েকই বলেছিলেন, “পারলে আর কখনও মাছ মাংস খাব না। আমার খেতে ভাল লাগে না আর তাতে আধ্যাত্মিক বিকাশের বাধাও ঘটে। আমার গুরুদেব বিশেষভাবে বলেছেন -আমি এখন যে সাধনার পথ ধরেছি তাতে আমার পক্ষে আমিষ বর্জন করাই বিধেয়।”
দেশবন্ধুর জীবনের শেষ পর্বের এই অভূতপূর্ব অধ্যাত্ম চেতনার দিকটা তাঁর অন্যতম জীবনীকার মণি বাগচি অনবদ্য ভাষায় বর্ণনা করেছেন, “স্টেপ এসাইড্-এর ঘরটিতে রোগ শয্যায়শায়িত দেশবন্ধুর শেষের দিনগুলি যখন এক নিবিড় নীরবতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল, তখন আমরা অনুমান করতে পারি তাঁর আরাধ্য দেবতা বরাভয় নিয়ে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাঁর জীবনের এই ত্যাগ দ্বারা দেশবন্ধু তাঁর হৃদয়ের সমস্ত আবেগকে রূপান্তরিত করেছিলেন একটি আধ্যাত্মিক শক্তিতে, আর রাজনীতির সঙ্কীর্ণ ধ্যান-ধারণাকে অতিক্রম করে তিনি স্পর্শ করেছিলেন ভারত আত্মার যথার্থ তন্ত্রীটিকে... এখানেই তাঁর জীবনের প্রকৃত সার্থকতা।”
পরবর্তীকালে কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুর দেশবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, “দাশদাকে ছেড়ে দিতে আমার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। দাশদা যখন গাড়িতে উঠলেন, তখন মনে হচ্ছিল তাঁকে হাত ধরে টেনে নামাই। এমন sincerity ও সত্যের প্রতি টান আর কোথাও দেখিনি। একদিন গভীর রাত্রে দাশদা এই বাঁধের উপর একা দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘মা, তোকে স্বাধীন দেখতে পাব না?’ আমি পিছনে ছিলাম, দাশদা তা জানতে পারেননি। আমি তাঁর কথার উপর চেঁচিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই পাব, তবে কাজ অনেক বাকি।’
আমার এই মেঠো পাড়াগেঁয়ে কথা সবাই বোঝে না। আমি অশিক্ষিত লোক, ঠিক ঠিক সবটা বুঝিয়ে বলতে পারি কি না জানি না। কিন্তু দাশদাকে যা বলতাম, আকার ইঙ্গিতেই তিনি সব বুঝে নিতেন ও তেমনভাবে চলার চেষ্টা করতেন। বলতে কি, দাশদা কয়েকদিনের মধ্যে আমার ভাষার a, b, c, d, যেন মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। আমি যা বলতে যা বুঝি, তিনি তা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। তিনি যেন শিশুর মত আমার কথাগুলি গিলতেন।”
সবদিক থেকেই সবার চেয়ে অনেক বড় মাপের এই মানুষটির ইষ্টনিষ্টার গভীরতাও ছিল তাঁরই পক্ষে মানানসই। তাই বাহ্যত অল্প কালের পরিসরের মধ্যেই তাঁর ইষ্টের সঙ্গে একাত্মতার অভীপ্সা এমন তীব্রতা লাভ করেছিল যে দেহাতীত হয়ে তিনি চিরলগ্ন হয়েছেন তাঁর পরম ঈপ্সিতে, সকল বিচ্ছেদের শেষে হয়েছে চিরমিলন।
_____________________
# দেশবন্ধু_চিত্তরঞ্জন_দাশ
10