ব্রজগোপাল দত্তরায় :-
মানবসভ্যতার ইতিহাস এক অর্থে মহামানবের জীবনেতিহাস। জন্ম-মৃত্যুর দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী পরিসর জুড়ে প্রতিটি মানুষের জীবনায়ন; কিন্তু বেশির ভাগ জীবনের ব্যক্তিক তথা পারিবারিক সীমানার বাইরে কোন তাৎপর্য নেই; বৃহত্তর পরিবেশে তার অস্তিত্বের বিশেষ অবদান থাকে না। তাদের জীবন-কথা তাই প্রায়শই একটি অপরটির পুনরাবৃত্তি, এবং ইতিহাসের উপাদান হিসাবে গুরুত্বহীন। মুষ্টিমেয় কিছু অস্তিত্ব তার ব্যতিক্রম। সামগ্রিক পরিপার্শ্বের কল্যাণমুখী বিনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে যে-সমস্ত মহাপ্রাণের আবির্ভাব ঘটে, তাঁদের জীবন এবং জীবনী বিবর্তনের দিশারী। তাই মহাপুরুষের জীবনী-রচনা দাবি করে বিশিষ্ট দক্ষতা, অসাধারণ পর্যবেক্ষণ, ধীশক্তি, পরিশ্রম-সামর্থ্য এবং সর্বোপরি গভীর অনুধ্যান। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র এসেছিলেন পরিবেশ-পরিপ্লাবী, বৈচিত্র্যের রহস্যে ভরা, অলোকসামান্য এক জীবন নিয়ে, আপাত দৃষ্টিতে যার মধ্যে তথাকথিত নাটকীয় উপাদান তেমন কিছু নেই। তাঁর জীবন সহস্রতলযুক্ত হীরকের মত, যার প্রতিটি তল থেকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার আলোক বিচ্ছুরিত হয়। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দিক প্রদর্শক আলোকবর্তিকাস্বরূপ এ হেন জীবনের ইতিহাস রচনার জন্য মহামানব-জীবনীকারের উপরোক্ত গুণাবলি ছাড়াও আরও কিছু প্রয়োজন-তা হল সম্পূর্ণ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ও অহংশূন্যতা। শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনীকার ভক্তপ্রবর ব্রজগোপাল দত্তরায়ের মধ্যে দুর্লভ ঐ গুণরাজির সমাবেশ ঘটেছিল।
অধুনা বাংলাদেশস্থিত ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বনগ্রামের জগৎচন্দ্র দত্তরায় ও বসন্তময়ী দেবীর পুত্র ব্রজগোপাল ১২৯৯ বঙ্গাব্দের ৭ই চৈত্র জন্মগ্রহণ করেন। অতি শৈশবে মাতৃহারা হন, কৈশোরে ঘটে পিতৃবিয়োগ। গৌরবময় ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয় ময়মনসিংহ শহরে ও পরে কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় এম. এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। স্নাতকোত্তর পাঠ্যজীবনে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ মনীষিবৃন্দের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলার জজকোর্টে ব্যবহারজীবীরূপে কর্মজীবন শুরু করে অতি অল্প সময়ে বিশেষ খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
কর্মজীবনের সাফল্য, গতানুগতিক সংসারযাত্রা নির্বাহ, কোন কিছুই পূর্ণতা এনে দিতে পারে না ব্রজগোপালের অন্তরে; কী এক বিরাট শূন্যতা চারিদিকে-কী যেন না পাওয়ার বেদনায় চঞ্চল হয়ে ওঠে মন। বাড়িতে পূর্বপুরুষের প্রতিষ্ঠিত শালগ্রাম শিলার নিত্যপূজা হত, তাতে বিশেষ অনুরাগী ছিলেন তিনি। পূজার্চনায় আনন্দ পেলেও পূর্ণতা পান না; অন্তরের সহজাত ভক্তিভাব আরও কিছুর সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে থাকে। অনন্ত যিনি, তাঁর স্বরূপ জানার আকাঙ্ক্ষায় উদ্গ্রীব হয় মন।
দীক্ষা নিয়ে নামজপপরায়ণ হয়ে চললে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে বোধ হয়। দীক্ষা কোথায় নেবেন-এ কথাও মনে হয়। সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে সাধনভজনে নির্ভুলভাবে পরিচালিত করতে পারেন কেবলমাত্র সদ্গুরু। কিন্তু সদ্গুরু সন্ধানের জন্য অপেক্ষা করার মত ধৈর্য তাঁর তখন ছিল না-কালবলিম্ব না করে দীক্ষা নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এই উদ্দেশ্যে কুলপুরোহিতের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারেন যে, যে-কোন সংক্রান্তির দিন দীক্ষা নেওয়া চলে। তখন শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে শুভ কর্মের সিদ্ধান্ত নিয়ে পুরোহিত মহাশয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বনগ্রাম থেকে কর্মক্ষেত্র ময়মনসিংহ ফিরে আসেন।
আবার কর্মজীবনের শুরু। কয়েক দিন পর বার লাইব্রেরিতে এসে টেবিলের উপর হাতে লেখা একটি কাগজ পড়ে থাকতে দেখে অন্যমনস্কভাবে সেটি দলা পাকিয়ে ফেলে দেন। ঘন্টা দুই পরে কোর্টের কাজ সেরে এসে ঐ ফেলে দেওয়া কাগজটি তুলে পড়ে দেখেন যে সেটি একটি ধর্মসভার বিজ্ঞপ্তি-স্থানীয় দুর্গাবাড়িতে হওয়ার কথা ধর্মসভাটির। জিজ্ঞাসু, পিপাসু মন; যথাসময়ে বন্ধু উমেশচন্দ্র সেনকে নিয়ে সেখানে হাজির হন। সভায় ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্ত্তী ধর্ম সম্বন্ধে এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। বক্তা কর্তৃক নিম্নোক্ত শাস্ত্রীয় রচনাটির উল্লেখ ব্রজগোপালকে ভাবিয়ে তোলে:
উত্তমো ব্রহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবস্তু মধ্যমঃ।
স্তুতির্জপোহধমোভাবো বাহ্যপূজাধমাধমঃ।।
তাঁর মনে কৌতূহল হয়-স্তুতিজপ, বাহ্যপূজার অতিরিক্ত প্রকৃত সদ্গুরুর সন্ধান কি বক্তা পেয়েছেন? সভাশেষে জানতে পারেন বক্তা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মন্ত্রশিষ্য। তিনি পাবনা হিমাইতপুর আশ্রম থেকে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে এসেছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত; তিনিও ঠাকুরের একজন বিশিষ্ট শিষ্য। তাঁর সঙ্গে ঠাকুর ও দীক্ষাগ্রহণ বিষয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা হয়। সদ্গুরু বলতে এঁরা ঠাকুরকে বোঝেন। সদ্গুরুর বিভিন্ন লক্ষণ ও গুণাবলি সম্বন্ধে ব্রজগোপালকে অবহিত করে তাঁরা তাঁকে দীক্ষাগ্রহণের অনুরোধ জানান।
সদ্গুরু তীব্র আকাঙ্ক্ষা তো ছিলই, তাই এঁদের সংসর্গে মন স্বভাবতই চঞ্চল ও অধীর হয়ে ওঠে। ভাবেন, তিনি যদি সদ্গুরু হয়ে থাকেন, তবে এ সুযোগ কোনমতেই হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। যুগযুগান্তের সঞ্চিত আকুলতা যদি কূল খুঁজে পায়, তবেই জীবন হবে সার্থক, সব চাওয়া বিলীন হবে অনন্তে। ঠাকুরের ভক্তদের কাছে ঠাকুরের গ্রন্থাবলি বিষয়ে জানতে চান ব্রজগোপাল। তাঁরা তাঁকে ‘সত্যানুসরণ’ নামে একটি ছোট পুস্তিকা এবং ‘অমিয় বাণী’ ও ‘পুণ্যপুঁথি’ নামে দুটি গ্রন্থ দেন। সত্যানুসরণ শ্রীশ্রীঠাকুরের স্বহস্তে লিখিত প্রথম প্রকাশিক পুস্তক। ছোট ছোট কথায় চলমান জগতের দিক্ নির্ণয় পন্থা সহজভাবে বিধৃত। অমিয়বাণী শাস্ত্র, দর্শন, সাধনতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে কথোপকথনমূলক গ্রন্থ। মহাভাবসমাধি অবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুর-উক্ত বাণীর সঞ্চয়ন পুণ্যপুঁথি।
বইগুলি অভিনিবেশ সহ পাঠ করতে শুরু করেন তিনি। ‘সত্যানুসরণ’ পুস্তিকার
প্রথম বাণীটি তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে- ‘সর্ব্বপ্রথম আমাদের দুর্ব্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। সাহসী হ’তে হবে, বীর হতে হবে। পাপের জ্বলন্ত প্রতিমূর্ত্তি ঐ দুর্ব্বলতা। তাড়াও, যত শীঘ্র পার, ঐ রক্তশোষণকারী অবসাদ-উৎপাদক Vampire- কে।...’ সমস্ত পুস্তিকাটি এক নিঃশ্বাসে পড়া হয়ে যায়, মনে আসে গভীর বিস্ময়। এত সহজভাবে গূঢ় তত্ত্বের অবতারণা, সাবলীল সমাধান, দৈনন্দিন জীবনে চলার এমন সুষ্ঠু এবং সহজ উপায় নির্দেশ এর আগে কোথাও পাননি তিনি। ‘অমিয় বাণী’- র মনোজ্ঞ আলোচনাভঙ্গী তাঁর বিশ্বাসকে জাগ্রত করে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ‘পুণ্যপুঁথি’-র সর্বত্র ছড়িয়ে আছে প্রবক্তার সুগভীর আশ্বাসভরা দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রজ্ঞা: ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ, অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচ’; ‘তোদের আত্মাতেই আমি জেগে উঠব। সকলকে বল, ভয় নাই, চিন্তা নাই...
অভীরভীরভীঃ’; ‘ছুটে আয়, আমি তোদের শান্তি দিব, আমি তোদের স্থান দিব, আমি নরকে স্বর্গরাজ্য স্থাপিত করে দিব।’; ‘আমি পরম কারণ। অনন্ত কোটি দেবতা, ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, ব্রহ্মজ্যোতি, শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গজ্যোতি, সেই পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণের সভা-আমিই সব,’; এ সমস্ত বাণী পাঠের পর শ্রীশ্রীঠাকুরের স্বরূপ ব্রজগোপালের অন্তর্লোকে স্বতই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে-এতদিনের জমে থাকা দুর্ভেদ্য অন্ধকার, সংকোচ, অবসাদ দূর হয়ে যায়, আশা, উৎসাহ, প্রেরণায় দীপ্ত হয়ে ওঠে সত্তা, প্রশ্নশূন্য, নিশ্চিন্ততার আশ্রয় পান তিনি।
সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান-আর বিলম্ব সয় না। ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ২৮শে শ্রাবণ তিনি সস্ত্রীক ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর মাধ্যমে সৎনাম গ্রহণ করে পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে গুরুরূপে বরণ করেন।
জীবন দেবতার সন্ধান পেয়েছেন, আনন্দে উপছে যায় অন্তরের পাত্রখানি। সব- সময়েই একটা তরতরে, নির্ভাবনা, উৎফুল্ল ভাব, জীবনীশক্তিতে ভরপুর। এখনও তাঁকে দর্শন করা হয়নি, মন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এই সময়ে পুরুষোত্তম জননী মাতা মনোমোহিনী দেবী ময়মনসিংহ শহরে এলেন। খবর পেয়ে সস্ত্রীক ব্রজগোপাল মাতৃ-সন্দর্শনে আসেন। মা খুব খুশি হন তাঁদের দেখে; তাঁর আন্তরিক, মধুর ব্যবহারে তাঁরাও অপার আনন্দ লাভ করেন। মাতৃদেবীর কাছে আশ্রমিক জীবনযাপনের অভিপ্রায় জানালে স্নেহকোমল কন্ঠে মা বলেন, ‘তোদের কোলে কচি শিশু, ও আর একটু বড় হোক, আর কিছু দিন পরে বরং যাবি। ওখানে যে খুব দুঃখকষ্ট সহ্য করে থাকতে হয়। কয়েক দিন পরে আমি আশ্রমে যাচ্ছি, ওখানে গিয়ে অনুকূলের কাছে তোদের কথা বলব।’
এদিকে ঠাকুর-দর্শনের বিলম্ব অস্থির করে তোলে ব্রজগোপালকে। গুরুপদে বরণ করে যাঁর পায়ে জীবন সঁপেছেন, তাঁকে সাক্ষাৎ ভাবে না পাওয়া পর্যন্ত তৃপ্ত হয় না মন; শুধু ভাবজগতে বিচরণ নয়, চাই প্রেমসমুদ্রে প্রত্যক্ষ অবগাহন। অবশেষে একদিন একাই আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ১৩৩০, ১০ই পৌষ। বড়দিনের ছুটি তখন। শ্রীশ্রীঠাকুরের পাদপীঠতলে পুরো ছুটিটাই কেটে গেল যেন চোখের নিমেষে। তাঁর দিব্য সান্নিধ্যের অবর্ণনীয় আনন্দসুধায়, নানাধরনের আলাপ আলোচনার রত্ন আহরণে অসীম তৃপ্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠল মন। ছুটি ফুরিয়ে এল, বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু বিদায়ের বেদনা অসহ্য বোধ হয়, দেহমন বিষাদে অবসন্ন হয়ে যায়। ব্রজগোপাল দত্তরায়ের নিজের ভাষায়:
“... তাঁহার আসনের সন্নিকটেই দাঁড়াইয়া আছি। দেখিলাম, আমার প্রতি তাঁহার দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ। মমতা জড়ানো সে করুণ চাহনি আমাকে পাগল করিয়া তুলিল। মনে হইল, বিস্ফারিত লোচনের সেই অকম্পিত স্নেহসিক্ত দিব্য দৃষ্টিপাতে তিনি আমার বিগত লক্ষ লক্ষ জীবন, আমার বর্তমান, ভবিষ্যৎ জীবন সকলই নিরীক্ষণ করিতেছেন, আমার সমগ্র সত্তাকে সুরলোকের সুধাধারায় অভিস্নাত করিয়া দিতেছেন। তাঁহার দরদভরা সজল আঁখিতারা আমাকে যেন অব্যক্ত ভাষায় এই কথাই বারংবার সুস্পষ্টরূপে জানাইয়া দিতেছে, তিনি আমার জন্মজন্মান্তরের চিরসাথী, তিনি আমার চিরবন্ধু, তিনি আমার প্রিয়পরম-সারা দুনিয়ায় তিনিই আমার একমাত্র আপনার জন। স্বর্গীয় বিভামণ্ডিত ঠাকুরের সেই ভাবগম্ভীর প্রশান্ত বদনমণ্ডলের প্রতি অপলক নেত্রে চাহিয়া রহিয়াছি, এমন সময় কী এক অলৌকিক আনন্দের উচ্ছল আবেগে অভিভূত হইয়া আমি যেন আত্মহারা হইয়া পড়িলাম, পুলক-স্পন্দনে আমার সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, চক্ষুযুগল অশ্রুভারাক্রান্ত হইল, রোরুদ্যমান অবস্থায় সংজ্ঞাহারা হইয়া আমি ভূতলে পড়িয়া গেলাম। পূজ্যপাদ মহারাজ অনন্তনাথ রায় আমার নিকটেই দাঁড়াইয়া ছিলেন, তিনি আমাকে বুকে তুলিয়া লইলেন। তাঁহার সস্নেহ শুশ্রূষায় বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়া আমি কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইলাম। ঠাকুর তখন ছলছল নয়নে বাষ্পজড়িত অস্ফুট কন্ঠে, ‘এবার যান, আবার চলে আসবেন’-
কোনমতে শুধু এই কথা কয়টি বলিয়া সেবারের মত বিদায় দিলেন।”
বড়দিনের ছুটির শেষে কর্মস্থলে ফিরে আদালতে কর্মে যোগদান করেছেন ব্রজগোপাল। কিন্তু কাজে আর মন বসছে না, সর্বক্ষণের চিন্তা কবে আবার আশ্রমে গিয়ে ঠাকুরের চরণতলে স্থায়িভাবে বাস করবেন। অবশেষে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে হাতের সমস্ত মামলা বন্ধু উকিল উমেশচন্দ্র সেনকে অর্পণ করেন এবং বিষয় সম্পত্তি সহোদর ভাইদের বুঝিয়ে দেন। এক মাসের মধ্যে অত্যাবশ্যক কাজ যথাসম্ভব সমাধান করে ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসের শেষদিকে স্ত্রী ও শিশুপুত্রসহ পাবনার হিমাইতপুর পল্লীর ঠাকুর বাড়িতে চলে আসেন। তখন থেকেই দয়াল ঠাকুরের শ্রীচরণতলে তাঁকে কেন্দ্র করে জীবনীকার ব্রজগোপাল দত্তরায়ের জীবন আবর্তিত হতে লাগল।
অল্প বয়সে ব্রজগোপালের ইসলাম ও খৃষ্ট ধর্মের প্রতি অনুরাগের অভাব ছিল। কিন্তু ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে মহম্মদ ও যীশু প্রচারিত ধর্মমতের সারবত্তা অনুভব করেন তিনি। ঠাকুরের সাহচর্য ও শিক্ষাই জগতের সমস্ত মহাপুরুষগণের প্রতি শ্রদ্ধাবনত করে তুলেছিল তাঁকে। পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ, পরম দয়াল মহম্মদ, মহাপ্রাণ যীশু, প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ-সকলেরই দীন সেবক রূপে নিজেকে অনুভব করেন তিনি। ঠাকুরকে দেখে উপলব্ধি করেছেন-পূর্ব পূর্ব আচার্যগণের জীবনের মহামঙ্গলব্রত সম্যকভাবে উদযাপনের উদ্দেশ্যেই শ্রীশ্রীঠাকুরের আগমন।
মানুষের জীবনের কর্তব্য সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা তিনি পেয়েছেন। জীবন চলনার সঙ্গে রাষ্ট্র, শিক্ষা, সমাজ, বিজ্ঞান, শিল্প, ধর্ম প্রভৃতি কীভাবে পরস্পর সম্পৃক্ত, সে- সম্বন্ধে দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়েছে। ঠাকুরের কাছে প্রাণায়াম, ষ্টচক্রভেদ প্রভৃতির আলোচনা থেকে আরম্ভ করে ওঙ্কার পর্যন্ত সকল স্তরের এবং ওঙ্কার পরবর্তী ‘সত্য লোক, অলখ লোক, অগম লোক, অনামী লোক’ ইত্যাদি বিভিন্ন ধামের প্রত্যক্ষীভূত অনুভূতিরাজির অপূর্ব অনবদ্য বিবরণ শোনার পরম সৌভাগ্য হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। মন সর্বদাই উচ্চ ভাবভূমিতে বিচরণ করে ব্রজগোপালের। সর্বজীবে প্রেম ও একাত্মবোধ এখন তাঁর অস্তিত্বের সমার্থক। তিনি বুঝেছেন সাধনার মাধ্যমে মনের মধ্যকার সুপ্ত ধারণাগুলি জাগিয়ে তোলা সম্ভব। তীব্র নামধ্যানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরের সংস্কারগুলি জেগে ওঠে। তখন বোঝা যায় নিজের স্বরূপ।
সেই সময়টি ছিল আশ্রম গঠনের আদিপর্ব। আশ্রম বলতে কয়েকটা কুটির মাত্র আর জনাকয়েক স্থায়ী আশ্রমিক। তখনও গড়ে ওঠেনি বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র, শিল্প কেন্দ্র, তড়িৎ ভবন, কলা ভবন, চিকিৎসালয়, মুদ্রণালয়, গ্রন্থশালা, নাট্যশালা, সাধন মন্দির, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। ঠাকুরের প্রেরণায় এবং কর্মীবৃন্দের নিরলস প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে নানা কর্মপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রম বিশাল কর্মকেন্দ্রে পর্যবসিত হল। কর্ম ও ধর্মের এক নতুন প্রকাশ ঘটল, যা সম্পূর্ণ অভিনব ও অভূতপূর্ব।
আশ্রমের এই সাংগঠনিক পর্বে তিনি আশ্রমের গঠন ও পরিচালনার নানা বিষয়ে এবং দেশদেশান্তরে ঠাকুরের ভাবধারা ও কর্মপরিকল্পনার প্রচারে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। পূর্ব প্রত্যন্তের বার্মা থেকে পশ্চিম প্রান্তের মুম্বই পর্যন্ত যাজন পরিক্রমায় প্রায় সর্বত্র ঘুরেছেন। সৎসঙ্গ প্রতিষ্ঠানের প্রথম কার্যনির্বাহী সমিতির তিনি ছিলেন সহ-সম্পাদক। ঠাকুরের নির্দেশে হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রমে তপোবন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ করেন দীর্ঘকাল। পরবর্তীকালে দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমের তপোবন বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন বহু বছর। সৎসঙ্গে ঋত্বিক আন্দোলন প্রবর্তিত হলে তিনি ঠাকুরের কাছ থেকে প্রতিঋত্বিকের পবিত্র দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
বিপুল ও বিচিত্র কর্মপ্রবাহে নিরন্তর নিযুক্ত থেকেও তারই মধ্যে ব্রজগোপাল রচনা করে চলেছেন শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনীগ্রন্থ তথা সৎসঙ্গের কর্মধারার ইতিহাস। অপরিসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে সংগ্রহ করেছেন অমূল্য তথ্যাদি যা চিরকাল অমিয় পথের সন্ধান দেবে। ভবিষ্যতের গবেষকরা এই গ্রন্থটি থেকে শত শত গ্রন্থ রচনার উপাদান পাবেন। এই প্রামাণ্য সুবৃহৎ জীবনী গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে। পরবর্তীকালে এই গ্রন্থের আরও দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। “শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র” নামক এই অমূল্য জীবনী বর্তমানে তিন খণ্ডে প্রকাশিত। এছাড়া, ঠাকুরেরই নির্দেশে পুরুষোত্তম জননী মাতা মনোমোহিনী দেবীরও জীবনী রচনা করেন তিনি। “পুরুষোত্তম জননী শ্রীশ্রীমনোমোহিনী” নামক এই গ্রন্থটিকেও ইতিহাসের ধারক গ্রন্থ বলা চলে। সে-যুগের বহু বিষয় এখানে বিশদভাবে বিবৃত আছে। এই দুটি অসাধারণ জীবনী গ্রন্থ ছাড়াও ‘শ্রী অনুকূলচন্দ্র’, ‘বাণীশতক’ এবং ‘আর্যবাদ ও জীবন বেদ’ নামে তাঁর তিনটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অপ্রকাশিত রচনা এখনও কিছু রয়েছে। তবে তাঁর “শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র” প্রন্থটির তাৎপর্য এবং গুরুত্ব নিঃসন্দেহে সর্বাধিক।
৫ই অগ্রহায়ণ, ১৩৫২। শ্রীশ্রীঠাকুর নাট্যমণ্ডপে ভক্তমণ্ডলী পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। সুশীলচন্দ্র বসু, যতীন দাস, কাশীশ্বর রায়চৌধুরী, গোপেন রায়, অপূর্ব মুখোপাধ্যায়, উপেন বসু, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, কালু আইচ, সুরেন দাস, প্রেসের মোহিনীদা, তারাপদ রায়, তারক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি অনেকেই আছেন। বিভিন্ন আলাপ আলোচনার পর ব্রজগোপাল দত্তরায় রচিত “শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র” গ্রন্থ প্রসঙ্গে কথা উঠলে ঠাকুর বলেন-ব্রজগোপালদা তার সাধ্যমত চেষ্টা করেছে। চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ওতে যা material আছে, তা পরবর্তীদের কাজে লাগবে। সেই হিসাবে এর সার্থকতা আছে। আমার জীবনী-আমার কোন আগ্রহ নেই, কিন্তু আমার mission সম্বন্ধে আগ্রহ অশেষ। সেই mission চারাতে জীবনীর প্রয়োজন আছে। তা যত যথাযথ-সমন্বয়ী ও বাস্তব তাৎপর্য-সমন্বিত হয়, ততই ভাল। ভাল জীবনী থাকলে আমার কথাগুলিও লোকের বুঝতে সুবিধা হবে। কারণ, আমি এমন কথা কইনি বা কই না, যা আমার বাস্তব অনুভব বা অভিজ্ঞতার মধ্যে নেই। আমি তো আর পণ্ডিত না, করা কুড়িয়েই আমার যা কিছু পাওয়া ও কওয়া।
ঠাকুরের ইচ্ছাপূরণই ছিল ব্রজগোপালের জীবনের লক্ষ্য। অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে কোন বাধাই তাঁকে বিরত করতে পারেনি। ঠাকুরের আনন্দে, খুশিতে তৃপ্তিতে ভরে উঠত মন। তাঁর কোন আদেশ বা নির্দেশের ব্যাখ্যা বা বিচার করতে যাননি কোনদিন -তিনি দয়া করে আদেশ করেছেন, সেটাই বড় কথা, পরম সৌভাগ্য ভক্তের কাছে। ভক্ত ও ভগবানের চিরন্তন এই সম্পর্ক প্রেম-ভক্তি-ভালবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ব্যাপ্তির মধ্যেই যে আনন্দ তা তাঁরা বুঝেছেন ঠাকুর-গ্রহণে এবং সমস্ত সত্তা দিয়ে তাঁকে বহন করে।
১৯২৪ খৃষ্টাব্দে ব্রজগোপাল স্থায়িভাবে শ্রীশ্রীঠাকুরের আশ্রয়ে আশ্রমে চলে আসার পর থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত তাঁর অক্লান্ত ইষ্টকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড সুবিদিত। কিন্তু ১৯৩৯-১৯৫৩, এই চৌদ্দ বছর ব্রজগোপালের জীবনেতিহাসে এক আশ্চর্য অধ্যায়- যা অধিকাংশ মানুষেরই অগোচরে থেকে গেছে।
১৯৩৯-এ তাঁর পুত্র রজতবরণ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে একদিন একান্তে ডেকে বললেন- ব্রজগোপালদা! ছেলেকে মানুষ করা বাবার প্রধান কর্তব্য। রজতকে নিয়ে আপনি আশ্রম ছেড়ে চলে যান-ওর পড়াশুনোর ব্যবস্থা করুন। আমি ওকে কত ভালবাসি তা আপনি জানেন। আমি খরচা দিয়ে ওর পড়াশুনোর ব্যবস্থা করতে পারি, সে সামর্থ্য আমার আছে। কিন্তু এক পয়সাও আমি দেব না; আমি চাই, আপনারা বাপ-ব্যাটায় ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে উঠে দাঁড়ান। রজতের পড়া শেষ হলে, ওর কাজকর্মের ব্যবস্থা হলে একটা বাড়ি করুন, ওর বিয়ে দিন, তারপর আবার আমার কাছে আসবেন।
শুরু হল নিষ্প্রশ্ন ভক্তের কঠোর পরীক্ষা। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে এলেন আশ্রম থেকে-কোথায় থাকবেন, কী করবেন, কিছুই স্থির নেই। সুপ্রতিষ্ঠিত যে- সংসার আত্মীয়-পরিজনকে সমর্পণ করে চলে এসেছিলেন, সেখানে ফিরতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে ভৎসনা, বিদ্রুপ ও লাঞ্ছনা প্রাপ্তি হল ব্রজগোপালের, সহায়তা কিংবা আশ্রয়ের ঘরে শূন্য! একান্ত নিকট আত্মীয়বর্গের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিচয় প্রতিভাত হল তাঁর কাছে। কিন্তু যে গভীর বন্ধনে তিনি চিরবন্ধনে বাঁধা পড়েছেন সেই নিত্যমুক্ত পুরুষোত্তমের সঙ্গে, সে বাঁধন কোন কিছুতেই এতটুকুও শিথিল হল না- বরং ক্রমবর্ধনার পথে চলল তা। বিচলিত না হয়ে যথাসাধ্য প্রচেষ্টায় বিস্তর বিঘ্নের মধ্য দিয়ে পুত্রের শিক্ষার ব্যবস্থা ও সংসার প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে নিরলসভাবে করে চললেন তথ্যসংগ্রহ। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র-সংক্রান্ত যথাসম্ভব তথ্য যে- কোন উৎস থেকে সংগ্রহ করে চয়ন করে চললেন তিনি। দয়ালেরই অলক্ষ্য কৃপায় টালমাটাল সংসার-তরণী ভেসে চলে; কখনও অযাচিতভাবে পেয়ে যান শিক্ষকতার কর্ম, কখনও বা গৃহশিক্ষকতার কাজ-দিনান্তে যেখানে একমুঠো চিড়ে আর গুড় জোটে, মাসান্তে দশটি টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল ছায়ায় তখন পৃথিবীর আকাশ অন্ধকার; ভারতে-বিশেষত বাংলার বুকে হতমান ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা আদায়ের জন্য আন্দোলনের অস্থির অভিঘাত। বিশ্বযুদ্ধজনিত সংকটে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রাণশক্তি নিষ্পেষিত। এমনই এক অশান্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিপ্রেক্ষিতে যখন সুস্থিত প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত পরিবারসমূহই বিপর্যস্ত, পরাভূত-তখন একটি পরিবার সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে কীভাবে ইষ্টার্থপূরণের লক্ষ্যে অবিচলিত থেকেছে, এ রহস্য সাধারণ বোধের অগম্য। কোন বিপর্যয়, সমস্যা বা অসুবিধার বিবরণ কোন অবস্থাতেই শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানিয়ে তাঁকে বিব্রত করেননি ব্রজগোপাল। তিনি আশ্রম ছেড়ে যেতে বলেছেন, যা করতে বলেছেন, যেভাবেই হোক তা নিষ্পন্ন করতে হবে, এই ছিল ভক্তপ্রবরের মনোভাব।
১৯৪৪-এ একবার একজন সুপ্রতিষ্ঠিত স্বচ্ছল ব্যক্তি ব্রজগোপাল-তনয় সুমেধাবী ছাত্র রজতবরণের অধ্যয়নের আর্থিক দায়িত্বভার গ্রহণে আগ্রহী হন- তবে তাঁর আগ্রহ নিঃশর্ত ছিল না। বর্ণ, বংশ সবদিকেই মিল রয়েছে, তিনি রজতবরণকে জামাতারূপে পেতে চাইলেন। তাঁর কন্যাটিও রূপেগুণে বরণীয়া। ব্রজগোপাল সব শুনে বললেন-আমার গুরুর সম্মতি পেলে বিয়ে হবে, নাহলে নয়। সেই ভদ্রলোক ভাবলেন - পাত্রপক্ষের যখন আপত্তি নেই, তখন এ সম্বন্ধ একরকম স্থির। নিয়মরক্ষার্থে গুরুদেবকে একবার জানিয়ে দিলেই হবে। তিনি “ঠিক আছে, আপনি আপনার গুরুর সম্মতি নিয়ে আসুন” এ কথা বলে বিয়ের প্রায় যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেললেন।
ব্রজগোপাল ঐ একবারই শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশ অমান্য করে হিমাইতপুরে তাঁর কাছে গেলেন। ঠাকুর বসেছিলেন মাতৃমন্দিরের সামনে। কতদিন পরে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করলেন অন্তরতম পরমপ্রিয়কে-মন পূর্ণ হয়ে উঠল আনন্দে। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে প্রণাম করলেন ঠাকুরকে। শ্রদ্ধেয় শরৎ হালদার, ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য প্রমুখ অন্তরঙ্গ পার্ষদবর্গ ছিলেন সেখানে। ব্রজগোপালকে দেখে ঠাকুর বলে উঠলেন -ব্রজগোপালদা তো এবার ছেলের বিয়ের কথা বলবেন! ব্রজগোপাল স্মিতমুখে চুপ করে রইলেন। অন্য সকলে চলে গেলে একান্তে ঠাকুরকে সব নিবেদন করে বললেন-ঠাকুর, মেয়েটির ফটোও নিয়ে এসেছি সঙ্গে, আপনাকে দেখাব? ঠাকুর শুধু বললেন-না, না, দেখাবেন না, দেখলে যদি আবার পছন্দ হয়ে যায়!
ব্রজগোপাল বুঝলেন-এ বিয়ে দয়ালের অভিপ্রেত নয়। তিনি চলে এলেন। আবার অনিশ্চয়তার দাঁড় বেয়ে চলল অকূল যাত্রা। কিন্তু শত বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়েও দৃঢ় নিষ্ঠা ও আন্তরিক বিশ্বাসের বলে ক্রমে ক্রমে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য পূর্ণ হতে লাগল। রজতবরণ বি.এ. অনার্স ও এম. এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে কলেজে অধ্যাপনায় বৃত হলেন কায়ক্লেশে বারাসতে একটি বাড়িও হল। এর মধ্যে কেটে গেছে শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের মত চোদ্দটি বছর। ১৯৫৩ সালের প্রথমদিকে আবার দেওঘরে ফিরে এলেন ব্রজগোপাল-ইতিমধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুরেরই নির্দেশিত সুলক্ষণা সুযোগ্যা পাত্রীর সঙ্গে পুত্রের বিবাহও দিয়েছেন। তিনি ফিরে আসার পরে ঠাকুরের আনন্দ যেন আর ধরে না-খুব আহ্লাদ করে দুখানি ঘরের একটি বাড়িতে তাঁকে থাকতে দেন, বলেন-একটা ঘরে আপনি সস্ত্রীক থাকবেন, আর যখন ব্যাটা আসবে বৌ নিয়ে, তখন তারা আর একটা ঘরে থাকবে। সরকারি কলেজে অধ্যাপনার জন্য রজতবরণকে তখন নানা জায়গায় বদলি হতে হত।
আশ্রম ছেড়ে যাওয়া এবং পুনরায় ফিরে আসার মধ্যকার সংগ্রামসংকুল চৌদ্দ বছরের গূঢ় রহস্য কিন্তু ব্রজগোপাল কখনও কারও কাছে প্রকাশ করেননি-এমনকী, নিজের পরিবারেও না। ইষ্টভ্রাতা অনেকেরই ধারণা ছিল, ব্রজগোপাল পুত্রের পড়াশুনোর জন্য আশ্রম এবং ঠাকুরকে ত্যাগ করে গেছেন; এ বিষয়ে নানা ভ্রান্তিমূলক গুঞ্জনও কানে এসেছে তাঁর, কিন্তু কখনও কাউকে কোন কথা বলেননি। ঘটনাচক্রে তাঁর পুত্রবধূ ব্যাপারটি সম্বন্ধে অবহিত হন।
১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাস। পুজো উৎসব উপলক্ষে ব্রজগোপালের পুত্রবধূ
আশ্রমে এসেছেন। একদিন সন্ধ্যার পর শ্রীশ্রীঠাকুর বসে আছেন-শ্রদ্ধেয় শরৎ হালদার, দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহ অনেকে উপস্থিত আছেন। নানা আলাপ- আলোচনা চলছে। একটু দূরে আরও কয়েকজনের সঙ্গে ব্রজগোপালের পুত্রবধূও বসে আছেন, শুনছেন অমিয় আলোচনার ধারা। ‘যোগ্যতা’ শব্দটির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা শুরু হল। ঠাকুর দেবীপ্রসাদকে অভিধান নিয়ে আসতে বললেন। দেবীপ্রসাদ অভিধান নিয়ে এলেন। হঠাৎ ঠাকুর বললেন- যোগ্যতা কাকে বলে জানেন? এই যেমন ব্রজগোপালদা। আমি তাকে বললাম আশ্রম ছেড়ে গিয়ে ছেলের পড়াশুনোর ব্যবস্থা করতে, ছেলের চাকরি হলে একটি বাড়ি করতে, ছেলের বিয়ে দিতে, তারপর আবার আমার কাছে ফিরে আসতে। ব্রজগোপালদা তা-ই করল। একেই বলে যোগ্যতা। ঠাকুরের এই কথায় অনেকেরই বহুদিন যাবৎ লালিত একটি ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটল। ব্রজগোপালের তরুণী পুত্রবধূর মনও বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় এবং গৌরবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
মানুষের পূর্বসঞ্চিত বহু প্রারব্ধ সদ্গুরু লাভের ফলে দ্রুত ক্ষয় হয়-তাই অনেক সময় দেখা যায় দীক্ষাগ্রহণ করা এবং তন্নিষ্ঠ চলনে চলার পরেও নানা দুর্বিপাক • দেখা দেয়। কিন্তু যে-কোন অবস্থার মধ্যে তাঁতে আস্থা অনড় থাকলে সে দুর্গতির অবসানও হয়। আবার নানা-দুঃখকষ্টের মধ্যে ফেলে দয়াল-ভয়াল-পরমলীলাময় বাজিয়ে নিতে চান ভক্তটিকে, দেখতে চান, কতখানি দুরবস্থার মধ্যেও তাঁর প্রতি ভালবাসা অটুট থাকে।
১৯৩৬-৩৭ নাগাদ একবার ব্রজগোপালের পরিবারে নেমে আসে রোগরূপী মহাবিপদের বিপর্যয়। ব্রজগোপাল নিজে অর্শের রোগী ছিলেন; সে-সময়ে সে-রোগ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, তার সঙ্গে দেখা দেয় সারা গায়ে ছোট ছোট স্ফোটক- একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। সহধর্মিণী প্রিয়লতা আক্রান্ত হন ‘বেরিবেরি’ রোগে, একই সঙ্গে পুত্র রজতবরণের হয় প্লুরিসি। সে এক অবর্ণনীয় দুর্দশা। তিনজনই শয্যাগত, কে কার সেবা করে-কে বা করে পথ্য প্রস্তুত, আর চিকিৎসাই বা হবে কোন উপায়ে! ব্রজগোপাল কোন অবস্থাতেই নিজের দুরবস্থা ঠাকুরের গোচরে এনে তাঁকে বিমর্ষ করে তুলতে চান না। কিন্তু অবস্থা যখন সীমানায় গিয়ে ঠেকেছে, তখন প্রিয়লতা কোনমতে শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ঠাকুরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ঠাকুরও যেন কিছুতেই ধরা দেবেন না-একবারও তাঁর প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছেন না, চোখে চোখ পড়তে গেলেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন। তারপর হঠাৎই উঠে পড়ে হনহন করে চলতে শুরু করলেন। প্রিয়লতাও তখন মরীয়া হয়ে কোনরকমে তাঁর সামনে গিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়ালেন এবং সংক্ষেপে সমগ্র অবস্থা বর্ণনা করলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রিয়লতাকে ঘরে যেতে বলে অল্প সময়ের মধ্যে আশ্রমস্থ চিকিৎসক সবাইকে নিয়ে একেবারে সদলে এলেন ব্রজগোপালের ঘরে। জঙ্গল-পরিবেষ্টিত একটি উত্তরমুখী অপরিসর ঘরে থাকতেন ব্রজগোপাল। অচিরেই সেখান থেকে তাঁদের স্থানান্তরিত করে জোর কদমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন ঠাকুর। কিন্তু এরই মধ্যে একদিন ব্রজগোপাল-ঘরণী প্রিয়লতাকে দেখে গিয়ে চিকিৎসক প্যারীমোহন নন্দী ঠাকুরকে জানালেন- শেষ অবস্থা, বোধহয় রাত কাটবে না। শোনামাত্র ঠাকুর ছুটে এলেন রোগিণীর কাছে, নিজে ওষুধ দিলেন এবং যেখানে যত চিকিৎসক জানা আছে, সবার কাছে লোক পাঠিয়ে, টেলিগ্রাম করে সম্ভাব্য যতরকম চিকিৎসা হতে পারে, তার ব্যবস্থা করলেন। চব্বিশ ঘন্টা স্নানাহার ইত্যাদিও করেননি শ্রীশ্রীঠাকুর- সম্পূর্ণভাবে নিযুক্ত থেকেছেন প্রিয়লতার চিকিৎসার ব্যাপারে। অবশেষে ধীরে ধীরে সংকট কাটল-রুদ্রের প্রসন্ন মুখের দাক্ষিণ্যে পুনর্জীবন লাভ হল প্রিয়লতার। দীর্ঘ রোগভোগের পর একে একে সকলেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ঠাকুর বলেন, বড় খারাপ যোগ ছিল তখন; প্রথমে যেত ব্রজগোপালদা, তারপর রজত তারপর রজতের মা। পরমপিতার দয়ায় রক্ষা হয়েছে।
সংসারজীবন ত্যাগ করে আশ্রমিক জীবনে প্রবেশ করার অর্থই ছিল তখন স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য ও কৃষ্ণসাধনের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়া। তবু সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, সন্ততির নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের আশ্বাস হেলায় ত্যাগ করে, রুষ্ট আত্মীয়-পরিজনদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কোন্ ঐশ্বর্যের টানে ভক্তদল ছুটে এসেছেন মানবদেহধারী এক আশ্চর্য পুরুষের পদপ্রান্তে, তা “যার খেলা হয়, সে জানে।” এমন সময় গেছে, যখন বস্ত্রাভাবে ঘরের বাইরে বেরোনোর উপায় ছিল না ব্রজগোপাল ও তাঁর পরিবারের। অর্ধাহারের পর অনাহারও গেছে বহুদিন। তারপর হঠাৎই একদিন সকালে প্রসাদী-পিসিমা (শ্রীশ্রীঠাকুরের ভগ্নী পূজনীয়া গুরুপ্রসাদী দেবী) অনেক জামাকাপড় খাবারদাবার নিয়ে এসে হাজির-ঠাকুর পাঠিয়েছেন। এও পরীক্ষারই অঙ্গ। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, অর্থাৎ অন্নবস্ত্রের চরম অভাবেও ইষ্টানুরাগে অবিচলিত থাকার পরে পরীক্ষক পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন।
নিবন্ধারম্ভে ব্রজগোপালের শিক্ষাজীবন প্রসঙ্গে বাংলায় এম. এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভের উল্লেখ আছে। বিষয়টি আরও বিশদ বিবরণের দাবি রাখে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন ব্রজগোপাল। তিনি অঙ্ক নিয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ যখন প্রায় সমাপ্ত করেছেন, এম. এ. পরীক্ষার বাকি আর ছ’মাস, তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ তাঁকে ডেকে বলেন বাংলায় এম. এ. পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে। বাংলা-ভাষা ও সাহিত্যে সে-বছরই প্রথম এম. এ. পরীক্ষা চালু হতে চলেছে আশুতোষেরই একান্ত আগ্রহে। ইংরেজির অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেনকেও আশুতোষ বাংলায় এম. এ. পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে বলেন। উপাচার্যের ইচ্ছানুযায়ী ছ’মাসের প্রস্তুতিতেই পরীক্ষায় বসেন ব্রজগোপাল এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাংলার এম. এ. উত্তীর্ণদের অন্যতম হওয়ার দুর্লভ ঐতিহাসিক সৌভাগ্যের অধিকারী হন। অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন, দ্বিতীয় স্থান ব্রজগোপাল দত্তরায়।
আশ্রমে চলে আসার পরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য আহ্বান জানান। উত্তরে তিনি জানান যে, যে-ঐশ্বর্যের সন্ধান তিনি পেয়েছেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পদে আসীন হয়েই তার তুল্য আর কিছু পাওয়া সম্ভব নয়; তাই তিনি সসম্মানে এবং সবিনয়ে স্যার আশুতোষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরে আশুতোষ তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরূপে নিয়োগ করে আশ্রমেই পরীক্ষার খাতা পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরীক্ষকতার যৎকিঞ্চিৎ দক্ষিণায় তাঁর পরিবার-প্রতিপালনে কিছু সহায়তা হত।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ব্যক্তিত্ব ছিল সর্বাংশে নিখুঁত। যে-কোন জিনিষই পরিপাটি পরিচ্ছন্ন না হলে তাঁর ভাল লাগত না। হিসাবপত্রের ব্যাপারেও তিনি নির্ভুল ও যথাযথ হওয়া পছন্দ করতেন। তাঁর প্রবর্তিত ফিলানথ্রপি অফিস তাঁর নিখুঁত নিপুণতার একটি দৃষ্টান্ত। ঠাকুরের নিকটস্থ নিত্য পার্ষদ যাঁরা, তাঁদের অনেকের মধ্যেই তাঁর এই সুনিপুণ কর্মকৌশল সঞ্চারিত হয়েছিল। ঠাকুর চাইতেনও তাই। ব্রজগোপালের হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি ঠাকুর খুব পছন্দ করতেন; বলতেন, ব্রজগোপালদার মত করে হিসাব রাখতে হয়। ব্রজগোপাল ফিলানথ্রপি থেকে কোন অ্যালাওয়েন্স নিতেন না। উল্লেখ করা যায়, পরিস্থিতির চাপে অ্যালাওয়েন্স প্রথা অনুমোদন করলেও ফিলানথ্রপি থেকে অ্যালাওয়েন্স নেওয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের অভিপ্রেত ছিল না। মানুষ-সম্পদের ওপর নির্ভর করেই ঋত্বিক, যাজন ও সমস্ত আশ্রমকর্মী চলুন, এ-ই ছিল তাঁর একান্ত আকাঙ্ক্ষা। ব্রজগোপাল তাঁর এই ইচ্ছার মর্যাদা রক্ষা করে চলেছিলেন। খরচ বাবদ যে যা নিত ফিলানথ্রপি থেকে, সবই লেখা থাকত। একবার হিসাব পরীক্ষায় দেখা গেল-তিন মাসে খরচের জন্য ব্রজগোপাল নিয়েছেন দু’টাকা। তাই দেখে ঠাকুরের সে কী হাসি! জনে জনে ডেকে হেসে বলেন-তিন মাসে ব্রজগোপালদার খরচ লেগেছে দু’টাকা! আর একবার যাজনকার্যোপলক্ষে যাওয়ার সময় ব্রজগোপাল ফিলানথ্রপি থেকে কিছু অর্থ নিয়েছিলেন; হিসাব করে দেখলেন, সে অর্থ থেকে পাঁচ টাকা ফেরত আসবে। সচরাচর অনেকেই উদ্বৃত্ত অর্থ ফেরতদিতেন না। কিন্তু ব্রজগোপালের সেই উদ্বৃত্ত অর্থ খরচ হয়ে যাওয়ায় ছেলের সাইকেল বিক্রি করে তার থেকে পাঁচ টাকা নিয়ে ফিলানথ্রপিতে জমা দেন। অনেকেই তাঁকে এ কাজে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন- কিন্তু তিনি ইষ্টার্থপূরণে যা করণীয় বলে বোধ করতেন, তা থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করা যেত না।
দয়ালের নানা রসরহস্যেরও কোন শেষ ছিল না। আশ্রমে থাকা মানেই নিরবচ্ছিন্ন বৈষয়িক অভাবে থাকা-এ ছিল স্বতঃসিদ্ধ। ব্রজগোপাল যাজন-পরিক্রমায় ঘুরে বেড়াতেন, আশ্রমে তাঁর সহধর্মিণী প্রিয়লতা শিশুপুত্রটিকে নিয়ে কোনক্রমে দিন কাটাতেন। তবে মনে ছিল অফুরন্ত আনন্দের, উৎসাহের জোয়ার। শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করে প্রণাম করে এলেন হয়তো, পরমুহূর্তেই মনে হত-অনেকক্ষণ তাঁকে দেখিনি, যাই, একবার দেখে আসি। এ অভিজ্ঞতা ছিল আশ্রমস্থ প্রায় সকলেরই। একবার ব্রজগোপালকে কেউ কিছু সম্মানী অর্থ দিয়েছেন-তা থেকে পনের টাকা তিনি মানি অর্ডার করে পাঠিয়েছেন প্রিয়লতাকে। টাকাটা পেয়ে প্রিয়লতা খুবই খুশি হলেন-ছেলেটার গায়ের কোন গরম জামা নেই, শীত আসছে, একটা কিছু কেনা যাবে। আরও কত কী হিসেব হয়ে গেল টাকা হাতে পাওয়া মাত্রই। একটু পরে ঠাকুর- দর্শনে যেতেই ঠাকুর রহস্যভরে হেসে বলেন-মারে! আমায় দশটা টাকা দিতে পারবি? আছে? ব্যাস, হয়ে গেল সব হিসেবনিকেশ, সানন্দে তাঁর চরণে দিয়ে এলেন সেই পনের টাকা থেকে দশ টাকা।
আশ্রমে স্থায়িভাবে এসে বাস করতে শুরু করার পর শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশে তপোবন বিদ্যালয়ের দায়িত্ব থেকে শুরু করে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাপৃত ছিলেন ব্রজগোপাল। তার মধ্যে প্রেসের অধ্যক্ষের কাজটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রমে নানা অভাবনীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে ক্ষীরোদা স্মৃতি প্রেস অন্যতম। তখনকার পক্ষে আধুনিক সমস্ত পদ্ধতিই ছিল প্রেসটিতে। এই প্রেসের কর্ণধার ছিলেন শ্রদ্ধেয় ইষ্টভ্রাতা সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বর্ষীয়ান এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় সুরেশচন্দ্র প্রেসটিকে অন্তরের পূর্ণ মমতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। বয়োবৃদ্ধিজনিত কারণে তিনি প্রেসের দায়িত্বভার পালনে ক্রমে অসমর্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর অতিপ্রিয় প্রেস-এর দায়িত্ব যে-কোন ব্যক্তিকে দিতে রাজি ছিলেন না। শ্রীশ্রীঠাকুরকে সুরেশচন্দ্র বলেন-ব্রজগোপাল যদি দায়িত্ব নিতে রাজি থাকে, তবে ওর হাতে আমি প্রেস-এর চাবি দিতে পারি। ঠাকুরও সানন্দে সম্মতি জানান এ প্রস্তাবে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন ব্রজগোপাল। পরবর্তীকালে কলকাতায় বিবেকানন্দ রোডের নিকটবর্তী ঘোষ লেন-এ একটি সৎসঙ্গের শাখা স্থাপিত হয়। সেখানে একটি প্রেসও হয়; ‘বিবর্দ্ধন’ পত্রিকা ছাপানো এবং অন্যান্য অনেকভাবে এই প্রেস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কলকাতার এই প্রেস হওয়ার পর সুদক্ষ পরিচালনার জন্য হিমাইতপুর থেকে ব্রজগোপালকে শ্রীশ্রীঠাকুর কলকাতায় প্রেরণ করেন এবং এখানেও তাঁর কর্মকুশলতার স্বাক্ষর চিহ্নিত হয়।
একবার হিমাইতপুর থেকে যাজনোপলক্ষে কলকাতা এসেছেন ব্রজগোপাল। দাড়ি কাটতে গিয়ে ক্ষুরের আঘাতে গালে একটি ক্ষত হয়ে সেটি দূষিত হয়ে ওঠে। সেই ক্ষতদূষণ উপশমে তাঁর কোমরে পেনিসিলিন ইন্জেক্শন্ দেওয়া হয়-কিন্তু ইন্জেকশন্ট ঠিকমত দেওয়া হয়নি। ইন্জেকশনের জায়গাটি ফুলে পেকে আরও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় হিমাইতপুর ফেরেন ব্রজগোপাল। আশ্রমে দুই চিকিৎসক নিজেদের বিচার অনুযায়ী সেই ক্ষতস্থানটিতে অস্ত্রোপচার করেন অবশ না করে। ক্ষতটি ছিল কাঁচা এবং অপারেশনের অযোগ্য। তার ওপর অবশ না করে অস্ত্রাঘাত করায় তীব্র যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েন ব্রজগোপাল। তারপরে জানতে পারেন-এই অস্ত্রোপচারে ঠাকুরের ইচ্ছা ছিল না, জোর করে তাঁর সম্মতি আদায় করা হয়েছে। শোনামাত্র তিনি একটি ট্রলি আনতে বলেন। আশ্রমের অভ্যন্তরে অসুস্থ ব্যক্তির গমনাগমনের জন্য ট্রলির ব্যবস্থা ছিল। ট্রলি আনা হলে তাতে করে সরাসরি ঠাকুরের কাছে গিয়ে হাজির হন, সঙ্গে প্রিয়লতাও ছিলেন। ঠাকুরের পাশে তাঁর জননী মাতা মনোমোহিনী দেবীও ছিলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন ব্রজগোপাল-ঠাকুর, তোমার নাকি এ অপারেশনের ইচ্ছা ছিল না, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ কাজ হল কেন? লক্ষণীয় যে অন্য সময় তিনি ঠাকুরকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, ঠাকুরও তাঁকে তাই করতেন। কিন্তু সেসময় আবেগে মথিত হয়ে তিনি ঠাকুরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেন। আবার বলেন- তোমার ইচ্ছায় যদি এ অপারেশন হত, তাতে আমার যত যন্ত্রণাই হোক, আমার কিছু মনে হত না; কিন্তু তোমার ইচ্ছা নেই, তেমন কাজ আমার ওপরে কেন করা হল? বল?
ঠাকুর ঈষৎ অপ্রতিভ হয়ে বলেন-আমি তো ভোটে চলি-বেশির ভাগের যা মত-
ঠাকুরের কথা শেষ করতে না দিয়ে আবার গর্জে ওঠেন তিনি-কীসের ভোট? তোমার ইচ্ছাই ভোট, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবার ভোট কী? তোমার যাতে মত নেই, সে কাজ কেন হল?
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রিয়লতাকে বললেন ব্রজগোপালকে ঘরে নিয়ে যেতে। পরে মাকে বলেন-দেখলি মা, এমন করে কইল যে পরমপিতার আসন টলে গেল!
এর পরে শ্রীশ্রীঠাকুর নিজেই চিকিৎসার ভার নিলেন। তাঁর প্রেসক্রিশন্ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগে সেই ক্ষত পরিপক্ক হল এবং তারপর অপারেশন করায় সম্পূর্ণ নির্মূল হল।
ব্রজগোপালকে ঠাকুর একদিন বলেন-ব্রজগোপালদা, আমি যা বলব, আপনি তাই করতে পারবেন।
—আজ্ঞে হ্যাঁ!
—কোন দ্বিধা করবেন না তো?
—আজ্ঞে না।
—যদি বলি, আমার সামনে বস্ত্রত্যাগ করুন, পারবেন তো?
—নিশ্চয়ই পারব।
শুধু বলা নয়, ঠাকুরের নির্দেশে তাই করেছিলেন তিনি। আত্মসর্পণ, আত্মনিবেদনের চুড়ান্ত রূপ ছিলেন ব্রজগোপাল। ঠাকুরের সম্মুখে যখন বসে থাকতেন, যেন সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে তাঁর সান্নিধ্যসুধা উপভোগ করতেন নিঃশেষে-কোন প্রশ্ন, কোন সংশয় বা দ্বিধা জাগত না অন্তরে। ঠাকুরকে বলেছিলেন তিনি-আমি আপনার সম্বন্ধে প্রশ্নশূন্য।
বার্মায় প্রচারকার্যে গেছেন ব্রজগোপাল। রেঙ্গুনের স্টীমার ধরবেন এক জায়গা থেকে স্টীমারঘাটে পৌঁছে দেখেন স্টীমার ছাড়ার উপক্রম হচ্ছে। দ্রুতগতিতে টিকিট কাউন্টারে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখেন ভাড়ার চেয়ে পাঁচ টাকা কম পড়ছে। এদিকে স্টীমারের ভোঁ বেজে উঠল। ঐ স্টীমারে যেতে না পারলে খুবই অসুবিধায় পড়তে হবে; ইষ্টনাম ব্যতীত আর কিছুই স্মরণে আসছে না সেই সংকটের মুহূর্তে। কাউন্টারে যে ভদ্রলোক টিকিট দিচ্ছিলেন, তাঁর কী মনে হল কে জানে, তিনিই পাঁচটি টাকা দিয়ে ভাড়ার অঙ্ক পূরণ করে দিয়ে টিকিট দিলেন ব্রজগোপলকে।
পাবনা থেকে কলকাতা যেতে তখন ঈশ্বরদি পর্যন্ত বাসে গিয়ে ঈশ্বরদি থেকে ট্রেন ধরতে হত। একবার একটি জরুরি কাজে কলকাতা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন ব্রজগোপাল ঠাকুরেরই নির্দেশে; সঙ্গে যাবেন ইষ্টভ্রাতা বাসুদেব গোস্বামী- ‘লাটিমদা’ নামে যিনি সমধিক পরিচিত। দুটি বাস ছাড়ে সকালের দিকে ঈশ্বরদির উদ্দেশ্যে; প্রথমটি ধরতে পারলে তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে মনে করে সকাল সকাল রওয়ানা হয়েছেন দুজনে ব্রজগোপাল খানিক এগিয়ে গেছেন, বাসুদেব আসছেন একটু পরেই। হঠাৎ বাসুদেবকে ডাকলেন ঠাকুর। ডেকে আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন অনেক গল্প করতে শুরু করলেন। এদিকে ব্রজগোপাল অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছেন বাসুদেব না এসে পৌঁছনোতে। বাসুদেবও ভেতরে ভেতরে উসখুস করছেন-কিন্তু ঠাকুর কথা বলছেন, সেখান থেকে তো চলে আসা যায় না। ঠাকুরেরও গল্প যেন আর ফুরোয় না-এটা, ওটা, সেটা অপ্রয়োজনীয় হাজার কথা বলে চলেছেন। অবশেষে যখন বিদায় দিলেন তখন অনেকখানি সময় পেরিয়ে গেছে। ব্রজগোপাল বাসুদেবকে দেখে উত্তেজিত হয়ে দেরির কারণ জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে ঠাকুরই আটকে রেখেছিলেন এতক্ষণ। দুজনে দ্রুত বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখেন আগের বাসটি ছেড়ে গেছে। কী আর করা যাবে-পরের বাসেই রওয়ানা হলেন। ঈশ্বরদি স্টেশনে যেতে বাসটিকে লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে যেতে হত; লেভেল ক্রসিংয়ের বেশ খানিকটা আগেই বাস দাঁড়িয়ে পড়ল, আর যাবে না, কারণ আগের বাসটি লেভেল ক্রসিং-এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়েছে, বহু লোক হতাহত। দুজনেই মুহূর্তের মধ্যে অনুভব করলেন, চতুরচুড়ামণি কীভাবে রক্ষা করেছেন তাঁদের! কিছুটা হেঁটে স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা পৌঁছন তাঁরা।
এদিকে আশ্রমে খবর পৌঁছে গেছে দুর্ঘটনার, এবং সকলেই ভাবছেন। যে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটিতেই ব্রজগোপাল ও বাসুদেব ছিলেন। মাতা মনোমোহিনী নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকেন-পরমপিতা! আমি কী পাপ করেছি যে আমার এমন ক্ষতি হল? সমগ্র আশ্রমের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠল। ব্রজগোপাল-জায়া প্রিয়লতা একবার ছুটে যাচ্ছেন ঠাকুরের কাছে, আর একবার নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়ছেন। শিশু রজতের তখনও বোধ জন্মায়নি তত-সে নির্বিকারভাবে বাড়ির কাজের মেয়েটিকে ডেকে বলছে, জানো আবেদের মা, আমার বাবা না মরে গেছে! আবেদের মা ধমক দিয়ে বলে-চুপ কর, অমন অলক্ষুণে কথা কয় না! ঠাকুর বসে আছেন গম্ভীর মুখে-কিন্তু তাঁকে দেখে বিশেষ বিচলিত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।
কলকাতা পৌঁছেই ব্রজগোপালদের মনে হয়-এই দুর্ঘটনা নিয়ে আশ্রমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। তাঁরা তৎক্ষণাৎ নিরাপদ পৌঁছে সংবাদ জানিয়ে টেলিগ্রাম করে দেন। টেলিগ্রাম আসাতে আশ্রমের ওপর থেকে আশঙ্কার জগদ্দল ভার অপসারিত হল।
সাধন-ভজন ও কর্মপ্রবাহের মধ্যে দেখতে দেখতে পেরিয়ে এসেছেন জীবনের সত্তরটি বছর। দেশ ভাগ হয়েছে, ঠাকুর চলে এসেছেন দেওঘরে দেশ ভাগের ঠিক এক বছর আগে। ব্রজগোপাল সহ অন্যান্য ভক্তরাও তখন দেওঘরেই আছেন। হঠাৎ একদিন ঠাকুর প্রখ্যাত পণ্ডিত গিরিশচন্দ্র কাব্যতীর্থকে ডেকে ব্রজগোপলের কোষ্ঠী দেখতে বলেন। পণ্ডিত মহাশয় কোষ্ঠী বিচার করে ঠাকুরকে জানান, তিয়াত্তর বছর বয়সে একটা খুব বড় ফাঁড়া আছে। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করেন, তারপর? পণ্ডিত মহাশয় জানান যে গুরুর কৃপায় ঐ ফাঁড়া কেটে গেলেও সাতাত্তরে নিশ্চিত মৃত্যুযোগ। ঠাকুর সব শুনলেন, কিছু বললেন না। আরও সাত বছর অতিক্রান্ত হল। ব্রজগোপল নির্বিঘ্নে তিয়াত্তর পার করে সাতাত্তরে উপনীত হলেন। সাভাত্তর পূর্ণ হতে তখন আর মাস তিনেক বাকি। ঠিক এমন সময় ঠাকুরের আদেশ হল মায়ের জীবনী লেখার জন্য। মায়ের অর্থাৎ মাতা মনোমোহিনী দেবীর জীবনী।
১৯৬৮ খৃষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর প্রাতে নিত্যদিনের মত জীবনীকার গিয়েছেন ঠাকুর দর্শনে। ঠাকুর তখন বেশ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন। ঐ দিনই ঠাকুর তাঁকে মায়ের জীবনী লেখার কথা বলে জিজ্ঞাসা করেন-‘মনে থাকবে তো?’ ঠাকুর কী বললেন ভালভাবে তা না বুঝেই তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ঠাকুরের কাছে অন্য প্রসঙ্গ ওঠায় ঠাকুর কী বললেন তা আর জেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এক অস্বস্তির মধ্যে সময় কাটতে লাগল ঠাকুরের আদেশ ঠিকমত না বোঝার জন্য। বিকেলে আবার এলেন ঠাকুর বাড়ি, কিন্তু ঠাকুরের শরীর সেসময় বেশি অসুস্থ থাকায় কথা বলায় সুযোগ হল না।
পরদিন ২রা ডিসেম্বর সকালে ঠাকুর প্রণামে এলেন, ঠাকুর তখন পার্লারের ভিতরে ছোট ঘরটিতে ছিলেন অর্ধশায়িত অবস্থায়। খুবই ক্লান্ত ও অবসন্ন দেখাচ্ছে তাঁকে; ঐ অবস্থায় আর কিছু জিজ্ঞাসা না করা শ্রেয় মনে করে প্রণাম করে চলে এলেন তিনি। ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার অল্প সময় পরে আমেরিকান ইষ্টভ্রাতা হাউজারম্যান এসে জানালেন যে ঠাকুর তাঁকে ডাকছেন। তিনি তাড়াতাড়ি ঠাকুরের কাছে গিয়ে উপস্থিত হতেই ঠাকুর উচ্চ স্বরে আকুল হয়ে মাতা মনোমোহিনী দেবীর জীবনীর কথা বলেন। তাঁর আকুলতায় লেখক অভিভূত হয়ে পড়েন। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলেন, আপনার জীবনী গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তো আমি শ্রীশ্রীমা-র জীবনের সবই যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি। একথা শোনার পর ঠাকুর অবুঝ শিশুর মত বারবার মায়ের জীবনীর উল্লেখ করতে থাকেন। ব্রজগোপাল বুঝলেন, ঠাকুর মায়ের পৃথক পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার কথাই বলছেন। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করেন-ঠাকুর, শ্রীশ্রীমার সম্বন্ধে একখানি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জীবনীগ্রন্থ রচনাই কি আপনার ইচ্ছা? এই কথায় ঠাকুর স্বস্তি বোধ করেন এবং বারবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। ব্রজগোপাল বলেন-ঠাকুর, আশীর্বাদ করুন, আপনার দয়ায় নিশ্চয়ই আপনার ইচ্ছা পূরণ করে উঠতে পারব। এ কার্য সাধনে আমার প্রাণপাত পরিশ্রমের এক বিন্দুও ত্রুটি হতে দেব না। সেখানে উপস্থিত ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র পূজনীয় প্রচেতারঞ্জন ঠাকুরকে বলেন-বাবা, তুমি শান্ত হও, মাস্টারমশাই যখন ভার নিয়েছেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। ঠাকুরের অন্যতম বাণীলেখক দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ঠাকুরকে বলেন, ব্রজগোপালদা যখন এই কাজ হাতে নিয়েছেন, নিতান্ত সুষ্ঠুরূপেই তিনি তা সমাপ্ত করবেন, আমরাও তাঁকে সাহায্য করব। আপনি সুস্থির হোন। এর পরে ধীরে ধীরে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রকৃতিস্থ হলেন।
একে একে সবাই চলে গেলে ব্রজগোপাল পুনরায় ঠাকুরের কাছে নিবেদন করেন -ঠাকুর, আশীর্বাদ করুন, অগৌণেই যেন আপনার ইচ্ছা পূরণ করে উঠতে পারি। ঠাকুর তাঁর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন। তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন।
সেদিন থেকেই মায়ের জীবনী লেখার কাজ শুরু হল। সমস্ত দুপুর এবং গভীর রাত পর্যন্ত লেখা চলল। পরদিন অর্থাৎ ৩রা ডিসেম্বর বেলা একটা পর্যন্ত একটানা কাজ হল। দুপুরে প্রচেতারঞ্জন এলেন ঠাকুরের কাছে যেতে বলার জন্য। ঐ দিন সন্ধ্যায় ঠাকুরের কাছে গেলে তিনি মৃদুকণ্ঠে ধীরে ধীরে বলেন-সকলের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যত সত্বর পারেন কাজটা সেরে ফেলুন। আর, মা’র ব্যাপারে তো আপনার বেশ ভালই জানা আছে। তাঁর আদেশ, উপদেশ ও আশিস লাভে ধন্য ও কৃতার্থ হয়ে খুশি মনে ফিরলেন ব্রজগোপাল।
এরপর ঠাকুরের সঙ্গে যখনই তাঁর দেখা হয়েছে, ঠাকুর স্মিতকণ্ঠে শুধু বলতেন,
—কেমন, চলছে তো? জোর চালিয়ে যান।
জীবনী রচনার কাজ অনেকখানি এগিয়েছে-বেশ কিছুদিন হল এ কাজে ব্যস্ত থাকায় ঠাকুরের কাছে বিস্তারিত জানানো হয়নি অগ্রগতির কথা। ২৬শে জানুয়ারি সকালে ঠাকুর তখন পার্লার সংলগ্ন ছোট ঘরটিতে বিশ্রাম করছেন। ব্রজগোপাল গেলেন ঠাকুর-প্রণামে। সেখানে তখন আর কেউ না থাকায় তিনি ঠাকুরের খুব কাছে গিয়ে বসেন। ঠাকুরের চোখেমুখে এক সুগভীর প্রশান্তি, মুখে মৃদু হাসি, সানন্দে সাগ্রহে জীবনীকারকে অভ্যর্থনা করেন ঠাকুর। অপরিসীম আত্মতৃপ্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন তিনি, আনন্দে বিভোর চিত্তে নিবেদন করলেন-ঠাকুর, আপনার দয়ায় শ্রীশ্রীমার জীবনীর কাজ ইতিমধ্যে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। দশটি অধ্যায়ে গ্রন্থখানি সম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। পাঁচটি অধ্যায়ের পাণ্ডুলিপি রচনার কাজ একরকম সারা হয়েছে। অপর অধ্যায়গুলির উপাদানও যথেষ্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রন্থে ষোলখানা ছবি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ছবির ব্লকগুলিও সব যোগাড় করা হয়েছে, সেগুলি ছাপানোর জন্য কলকাতার প্রেসে পাঠিয়ে দিয়েছি। এগুলির প্রুফও শীঘ্রই পাওয়ার আশা করছি। গ্রন্থমুদ্রণের ব্যাপারেও চেষ্টা চলছে।... ঠাকুর স্মিত হাস্যে প্রীতিপ্রফুল্ল দৃষ্টিতে বলতে থাকেন-খুব ভালো! খুব ভালো! জীবনীকার করজোড়ে ঠাকুরের চরণে নিবেদন করেন, ঠাকুর, আশীর্বাদ করুন, এইবার গ্রন্থখানার মুদ্রণ সত্বর সমাধা করে আপনার শ্রীকরে অর্পণ করে আমার জন্ম ও জীবন যেন সার্থক করতে পারি।
গ্রন্থরচনার কাজ তিনি সম্পূর্ণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঠাকুরের শ্রীহস্তে অর্পণ করা সম্ভব হয়নি; ঐ দিনই শেষ রাত্রে শ্রীশ্রীঠাকুরের মর্ত্যলীলার অবসান ঘটে।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে সেই অনুপম মাতৃজীবনীসুধার কিয়দংশ মাত্র উদ্ধৃত করা যেতে পারে, যার মধ্য দিয়ে লেখকের তন্নিষ্ঠা এবং জননীদেবীর আলোকসামান্য ব্যাক্তিত্বের দ্যুতির স্ফুরণ কিছুটা উপলব্ধি করা সম্ভব।
“দেশবন্ধুর অনুরোধে মহাত্মাজী বঙ্গদেশ ভ্রমণ-কালে একবার শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শনে সৎসঙ্গ-আশ্রমে আগমন করেন।...
মহাত্মাজী প্রাতঃকালে আশ্রমে শুভাগমন করিলে খদ্দর পরিহিত আশ্রমিকগণ শ্রীশ্রীজননীদেবীকে পুরোভাগে রাখিয়া সচন্দন পুষ্পমাল্যাদি অর্ঘ্য উপচারে তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে অভিনন্দিত করেন। জননীদেবী ও মহাত্মাজীর পরস্পরের কুশল প্রশ্নাদি বিনিময়ের পর জননীদেবী আপন বাহুবন্ধনে মহাত্মাজীর গলা ধরিয়া তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া ধীরপদে আশ্রম বাটিকার সর্বত্র ঘুরিয়া কুটীরশিল্পাগার, বিজ্ঞানকেন্দ্র, তপোবন বিদ্যালয়, কারখানা, ছাপাখানা, তড়িদ্ভবন, ভৈষজ্যালয়, কলাভবন প্রভৃতি কর্মকেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করান। জননীদেবী হিন্দী ভাষায় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রত্যেকটির আদর্শ, উদ্দ্যেশ্য ও কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে মহাত্মাজীকে ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া বলেন। জননীদেবীর কথায় মহাত্মাজী শ্রীশ্রীঠাকুরের জনকল্যাণকর অপূর্ব ভাবরাজি এবং বিচিত্র কর্মধারার বিশদ পরিচয় পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের অজস্র প্রশংসা করেন। আশ্রমপরিদর্শনে বাহির হইয়া মহাত্মাজীর সঙ্গে পথ চলিতে চলিতে জননীদেবী মাতৃসুলভ আদর ও সোহাগের সুরে একবার তাঁহাকে কথাপ্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন,-“মহাত্মাজী, পরমপিতার আশীর্বাদে তুমি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বটে, তবে তুমি কিন্তু আমারই ছেলে।” জননীদেবীর ঈদৃশ অনাবিল অপূর্ব সন্তানবাৎসল্যের স্নেহল স্পর্শে মহাত্মাজী আহ্লাদে আটাখানা হইয়া স্মিতমুখে গদগদ কন্ঠে কহিলেন, - “হ্যাঁ, মা, সত্যিই তাই, আমি তো আপনার ছেলেই।” বহুক্ষণ ধরিয়া সৎসঙ্গের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও অন্যান্য নানা বিষয়ে জননীদেবীর সহিত কথাবার্তায় মহাত্মাজী তাঁহার হৃদ্য আলাপন, মধুর আচরণ এবং পরমাত্মীয়তুল্য প্রাণখোলা মেলামেশায়, সর্বোপরি তাঁহার অপূর্ব মাতৃত্ব ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্ট পরিচয় লাভে এমনই মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, ইহা তাঁহার অন্তরে চিরদিনের মত একটি গভীর রেখাপাত করিয়াছিল। মহাত্মাজী অতঃপর যখনই যেখানে যাইতেন, জাতীয় উন্নতিসাধনে জনসেবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নেতৃবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাকালে সৎসঙ্গের উন্নত আদর্শ ও বিচিত্র কর্মধারার কথা সানন্দে উল্লেখ করিতেন এবং তৎসঙ্গে সৎসঙ্গ-জননী মনোমোহিনী দেবীর ভূয়সী প্রশংসা করিয়া বলিতেন, “I have never seen a masterly woman of such wonderful personality in my life”-অর্থাৎ, “এমন অদ্ভুতব্যক্তিত্বসম্পন্না সুদক্ষা নারী আমি জীবনে আর দেখি নাই।”
বহুকাল পূর্বের কথা। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবধারা-প্রচারকার্যে আমি একবার পশ্চিম ভারতে গিয়াছিলাম। তৎকালে আমেদাবাদে অবস্থানকালে মহাত্মাজীর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আমি তাঁহার সুপ্রসিদ্ধ ‘সবরমতী’ আশ্রমে যাই। আমি ‘পাবনা সৎসঙ্গ’ হইতে গিয়াছি শুনিবামাত্রই তিনি আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তিনি তখন চড়কায় সূতাকাটায় রত ছিলেন। তাঁহার সমীপে উপস্থিত হওয়া মাত্র তিনি উল্লসিত কন্ঠে অধীর আগ্রহে জননীদেবী ও শ্রীশ্রীঠাকুরের সর্বাঙ্গীণ কুশলসংবাদ জানিতে চাইলেন। প্রায় এক ঘন্টাকাল তাঁহার সঙ্গে আমার সৎসঙ্গ আশ্রম সম্বন্ধে নানা বিষয় আলোচনা হইল। গভীর মনোযোগের সহিত তিনি আমার সকল কথা শুনিলেন এবং বিশেষ কৌতূহলী হইয়া নানা প্রশ্ন করিয়া আশ্রমের আরব্ধ কার্যাবলীর খুঁটিনাটি কত কথা জানিতে চাইলেন। তাঁহার সহিত কথাবার্তায় ইহা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়া অত্যন্ত বিস্মিত ও আনন্দিত হইয়াছি যে, সৎসঙ্গ-আশ্রমের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য তিনি অন্তরে কী গভীর আগ্রহ এবং জননীদেবী ও শ্রীশ্রীঠাকুর সম্বন্ধে কী উচ্চধারণা ও প্রগাঢ় শ্রদ্ধাই না। পোষণ করেন।”
“পুরুষোত্তম জননী শ্রীশ্রীমনোমোহিনী” নামক গ্রন্থটি বহু পরে ১৯৮৬-র অক্টোবর মাসে ব্রজগোপলের উত্তরাধিকারীগণ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। মুদ্রণ এবং প্রকাশনা না দেখে যেতে পারলেও গ্রন্থসমাপ্তির মহাতৃপ্তিতে তিনি উচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন। বস্তুত, এই বইখানি রচনার জন্যই যেন তাঁর আয়ু অবশিষ্ট ছিল। ঠাকুরের ঐহিক লীলানিবৃত্তির পর ব্রজগোপল বারাসতে পুত্রের কাছে অবস্থান করে মায়ের জীবনীর বাকি অংশ রচনার কাজ সমাধা করেন। ঠাকুরের আদেশ পাওয়ার পর এই গ্রন্থ রচনার কাজে তিনি প্রায় তিন বছর ব্যাপৃত ছিলেন, এবং রচনাকার্য সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই ২৯শে পৌষ, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দে তাঁর ইহজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। মৃত্যুশয্যায় তাঁর শেষ কথা ছিল-“I have kept my word, I have kept my word”! প্রিয়তমকে দেওয়া কথা-মাতৃজীবনী রচনার কথা, তিনি যে রাখতে পেরেছিলেন, এই বিপুল সৌভাগ্যে আপ্লুত হয়ে জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করেন ব্রজগোপল, সূক্ষ্ম সত্তায় বিলগ্ন হন পরমপ্রিয় পুরুষোত্তমের চরণপ্রান্তে।
ব্রজগোপাল দত্তরায়ের মুখ্য পরিচয় জীবনীকাররূপে পৃথক মর্যাদা পেলেও নিরলস সুদক্ষ কর্মী, সংগঠক, প্রচারক এবং কৃতী শিক্ষকরূপেও সৎসঙ্গের ইতিহাসে তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকবেন বিশেষভাবে। মৃদুভাষী, শান্ত অথচ দৃঢ় মানুষটি ‘মাস্টারমশাই’ অভিধায় সমধিক পরিচিত ছিলেন। তবে তাঁর শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ পরিচয়-তিনি পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নিষ্প্রশ্ন, নিঃশর্ত, আজ্ঞাবাহী, নিরভিমান ইষ্টসর্বস্ব পরম ভক্ত, এবং এই পরিচয়ই কালের সীমানা অতিক্রম করে অক্ষয় হয়ে থাকবে, প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করবে শ্রীশ্রীঠাকুর-অনুগামী আগামী প্রজন্মকে।
____________________________________
#ব্রজগোপাল_দত্তরায়
10