কবি হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
🔶 ঠাকুরের কাছে আসবেন বলে সেদিন আরও বেশি করে নেশা করে এসেছেন, ঠাকুর তাকে ঘৃণা করেন কিনা, পরীক্ষার উদ্দেশ্যে.....
প্রেমের অমৃত ছোঁয়ায় সুরাপাত্র কখনও কখনও সুধাপাত্রে পরিবর্তিত হয়- সুরামাতাল হয়ে ওঠে সুরের মাতাল, ভালবাসার নেশায় টলোমলো, মদিরার তীব্র আকর্ষণ তুচ্ছ করে গীতি-কুসুমে পূজার নৈবেদ্য সাজাতে শুরু করে তার প্রিয়পরম প্রেমের দেবতার উদ্দেশ্যে। হয়তো এর প্রস্তুতি জন্ম-জন্মান্তরের-চিরবন্ধনে আবদ্ধ ভক্ত ও ভগবান; তাই বাহ্যত বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেও তাঁর অমোঘ টানে কাছে আসতে বাধ্য হয় অভিমানী ভক্ত। মানুষটি চেয়েছিলেন আশ্রয়, পেলেন সব পাওয়ার সেরা পাওয়া-এক অবাধ প্রশ্রয়। সমস্ত দোষগুণ নিয়ে, এমনকি মদ্যপানের সংসারনিন্দিত নেশাসুদ্ধ, পরম প্রশ্রয়ে সঁপে দিলেন নিজেকে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাঁর ধ্বনিত হল:
হে মোর জীবনসাথি, চির প্রেমময়,
বিশ্বে শুধু তুমি মোরে দিয়েছ প্রশ্রয়
তাই তুমি সকলের বড়;...
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অনিঃশেষ প্রেমের প্রশ্রয়ে সুরার অন্ধকার থেকে সুরের আলোকে উত্তীর্ণ কথক কবি ভক্ত মানুষটি হলেন হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
বরিশালের বিপ্রসন্তান হেমচন্দ্রের প্রথাগত শিক্ষালাভের তেমন সুযোগ হয়নি, কিন্তু অসাধারণ প্রতিভা ও সহজাত কাব্য ও কথকতার ক্ষমতার অধিকারী হেমচন্দ্র বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে তৎকালীন বঙ্গসমাজে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। প্রভূত প্রতিভা-সম্পদ সত্ত্বেও সুশৃঙ্খলতার অভাবে এবং স্বভাবগত ঔদাসীন্যের কারণে তাঁর বিপুল সৃষ্টির অধিকাংশই বিলুপ্ত এবং সাধারণ্যে আজ কবি হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক সম্পূর্ণ বিস্মৃত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইতিহাসের ধূসর পাতা উলটিয়ে সে সময়ে ফিরে গেলে অনুভব করা যায় যে কী আশ্চর্য ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য ছিল তাঁর মধ্যে। বরিশালের অপর খ্যাতনামা কবি মুকুন্দ দাস-চারণকবি রূপে যিনি পরবর্তীকালে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন-ছিলেন হেমকবির নিত্যসঙ্গী। মুকুন্দদাসের গাওয়া বহু গানের রচয়িতা ছিলেন হেমকবি, যদিও এ তথ্য প্রায় সকলেরই অজানা। মুকুন্দদাসের জীবনী-গবেষক অধ্যাপক ডঃ জয়গুরু গোস্বামী ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’ গ্রন্থে চারণকবির জীবনে কবি হেমচন্দ্রের প্রভাব সুনিপুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। উক্ত গ্রন্থ থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে হেমকবির প্রতিভার বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যেতে পারে।
“... মুকুন্দদাসকে যিনি গান সরবরাহ করিয়াছিলেন, যিনি যাত্রার পালা রচনা করিয়া দিয়াছিলেন, তাঁহার নাম-কবি হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ভাওয়ালের কবি গোবিন্দদাসের সঙ্গে তাঁহার তুলনা হইতে পারে। বুঝি বা গোবিন্দদাস অপেক্ষাও বিয়োগান্ত মহিমায় ভাস্বর তিনি। এমন নেশা ছিল না, যাহাতে তিনি আসক্ত না ছিলেন। এমন রাগ-রাগিনী ছিল না, যাহাকে তিনি তাঁহার কণ্ঠের শাসনে না রাখিয়াছিলেন। নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের মত সহজ ছিল তাঁহার গান রচনা এবং কথকতা।... অদ্যপিও বরিশালের ঐতিহ্যবাহী মানুষের কানে বাজে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের বাড়ীতে ও জগদীশবাবুর আশ্রমে হেমকবির কথকতা।
প্রাচীন চারণগণ নিজেরাই ছিলেন রচয়িতা, উহা সামন্তযুগের কাহিনী। ইংরাজ আমলের চারণ মুকুন্দদাস তাঁহার কবিত্বশক্তির প্রেরণালাভ করিয়াছিলেন হেমকবির নিঃস্বার্থ সাহচর্যের নিকটে। দুই শক্তি একই হইয়া গিয়াছিল। কেহ কেহ বলেন, হেমকবি না থাকিলে মুকুন্দদাস হইত না; আবার কেহ কেহ বলেন, মুকুন্দদাস না থাকিলে হেমকবিকে কেহই চিনিত না, পূর্ণতা এই দুইটিকে লইয়াই। তুলসী পাতা ছোট হইলেও যেমন মহাত্ম্যে ছোটবড় হয় না, তেমনি ছিলেন- হেমকবি আর মুকুন্দদাস।...
হেমকবির প্রতিভা ধনী ছিল, কিন্তু তাহাতে “সুগৃহিণী” ভাব ছিল না। মুকুন্দদাস এই “সুগৃহিণী”র কার্য করিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পরশমণির স্পর্শে হেমকবি সঞ্জীবিত হইয়াছিলেন। কলিকাতার ঠাকুরবাড়ীতে কিছুদিনের জন্য তাঁহার অধিষ্ঠানও হইয়াছিল। তাহার পর “আতিথ্যের উপহার” লাভ করিয়াছিলেন “বীরবল” ছদ্মনামধারী প্রমথ চৌধুরীর বাড়ীতে।... মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত নৈষ্ঠিক নীতিবাদী হইলেও হেমকবির কবিত্বকে তিনি বিনাশ হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। হেমকবির কবিতা ও গীতরচনার ধারাল ইস্পাত খণ্ডকে তিনি মুকুন্দদাসের গান গাহিয়া অভিনয় করা ও আসর মাতাইবার ক্ষমতার সঙ্গে যোজনা করিয়া দিয়াছিলেন। ইহা যেন কুঠারের ফলার সঙ্গে “আছাড়ি’ লাগাইয়া দেওয়া।
মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত নিজে লেখনীচর্চা করিতেন।... বরিশালের বি. এম. কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় শ্রীসুধাংশুকুমার রায়চৌধুরী মহাশয় বলেন- “প্রতিযোগিতার কথা শুনিয়াছি, অশ্বিনীকুমার দত্তের এবং হেমকবির মধ্যে-কে কত অল্প সময়ে কবিতা লিখিতে বা গান বাঁধিতে পারেন। ফলাফলে দেখা যাইত হেমকবির নিকটে অশ্বিনী দত্তের মহানুভব পরাজয়।” এই প্রসঙ্গে সুধাংশুবাবু একটি দিনের ঘটনার উল্লেখ করিয়া বলেন-“সেদিন হেমকবির লেখনীতে বেদান্ত আসিয়া ভর করিয়াছিল। ফলে তখন একটি আধ্যাত্মিকতত্ত্বপূর্ণ গানের সৃষ্টি হইল, যাহা আজও হেমকবিকে বাঁচাইয়া রাখিবে।” গানটি নিম্নরূপ:-
“কেবা কার করে আরাধন
যেন, আপনি পাতিয়া কান
শোনো আপনার গান
আপনা আপনি আলাপন।
কারে ডাকো বারে বারে, কে দিবে সাড়া
আপনারে নাহি চেনো, আপনি-হারা
মুঠোর ভিতরে রাখি
মোহপাশে মুদি আঁখি
আঁধারে নিভায়ে বাতি, খোঁজা হারাধন।
কেবা তুমি, কেবা আঁখি
সব আমি হই,
আমাতেই আমি তুমি, ভিন্ কেহ নই
হয় শুধু তুমি থাকো
নয় শুধু আমায় রাখো
উভয়ের হ’তে নাহি পারে একাসন।”
এই রচনার নিকটে অশ্বিনীকুমারের রচনাকে হার স্বীকার করিতে হইয়াছিল। “দত্ত কারো ভৃত্য নহে”, কিন্তু, হেমকবির নিকটে অশ্বিনীকুমার যেন বলিতে চাহেন, “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে।” উভয়ের সম্পর্কটা দৃষ্টি- উন্মোচক। লোকনেতা, সারা বাঙ্গা দেশের শ্রেষ্ঠ পুরুষদের অন্যতম বনাম অখ্যাত অজ্ঞাত মদ্যপ এক স্বভাবকবি। জয় হইতেছে শেষোক্তের।....
Emerson বলিয়াছেন, “Man is only half himself; the other half is his expression” হেমকবি সেই ‘other half’ কে উদ্ঘাটন করিতে সমর্থ জানিয়া ‘the man that is half himself’ তাঁহার নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়াছিলেন। মুকুন্দদাসের ‘other half’ এই হেমকবি। হেমকবিকে বাদ দিলে মুকুন্দ দাস অর্ধেক হইয়া থাকিতে পারেন না- ‘a man taken by half is never taken right....
হেমকবি ও মুকুন্দদাস কেহই উচ্চ সংস্কৃতিবান্ নহেন; শিক্ষিতও নহেন। স্কুল- কলেজের বিদ্যায় উভয়েই বঞ্চিত। মুকুন্দদাসের উদ্ভব নিম্নকূলে; হেমকবির ব্রাহ্মণকূলে হইলেও কর্ম ছিল নিম্নকূলে। তদানীন্তন নৈতিকতার মাপকাঠি দিয়া মাপিলে উভয়েরই লজ্জা নিবারণ কঠিন হইয়া পড়ে। তথাপি উভয়ে মিলিয়া বাঙালীকে মাতাইয়া রাখিয়া ছিলেন-দেবদেবীর ভক্তিতে নহে, এক নূতনতর কর্মবোধে নহে,-দেশাত্মবোধে সম্মানবোধে ইংরাজ বিরোধিতায়।”
ঐ গ্রন্থেরই অন্যত্র ডঃ গোস্বামী গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে হেমকবিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তদানীন্তন বঙ্গাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রমণ্ডলী-এমনকী সূর্যস্বরূপ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে “ আর এই গণজাগরণের গান গাহিবার জন্য এই দেশের মাটিতে আবির্ভূত হইলেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, স্বাধীনতার অগ্রদূত গোবিন্দ দাস, রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, সত্য-শিব সুন্দরের পূজারী কবি রবীন্দ্রনাথ, ছন্দের কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বরিশালের জন্মদাতা অশ্বিনীকুমার, কবি ও কথক হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং চারণকবি মুকুন্দ দাস”।
এ হেন প্রতিভাধর হেমচন্দ্রের গুণমুগ্ধের তালিকায় ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, জাস্টিস আশুতোষ চৌধুরীর মত মানুষও। অর্থোপার্জনও ছিল রীতিমত উল্লেখযোগ্য, ঘন্টায় ত্রিশ টাকা নিতেন কথকতায়। কিন্তু সবই নিঃশেষ হয়ে যেতে মদ ও আনুষঙ্গিক কুসংসর্গে। তাঁকে সমূহ বিনাশের হাত থেকে উদ্ধার করার আশায় মুকুন্দদাসই তাঁকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে প্রেরণ করেন।
ঠাকুর সেসময় কলকাতার হরিতকী বাগান লেনের একটি বাড়িতে এসে ছিলেন। সারাদিন আলাপ-আলোচনা, নামকীর্তনে বাড়িটি ভরপুর হয়ে থাকতো। কলকাতার ভক্তমণ্ডলী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসতেন বিভিন্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে, ঠাকুর নিরন্তর দিয়ে যেতেন সকলের সব প্রশ্নের সমাধানী উত্তর। সে-সব উত্তর ছিল অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক, মানুষ তৃপ্ত হয়ে ফিরে যেত উত্তর পেয়ে, কিন্তু পরদিনই এসে উপস্থিত হত কী এক অদ্ভুত আকর্ষণে। ঠাকুর যখন কথা বলতেন, তাঁর সমস্ত দেহে যেন তার অভিব্যক্তি ফুটে উঠত, ভাবের এক সাবলীল অপরূপ প্রকাশ ঘটতো, ভাষায় যা অবর্ণনীয়।
একদিন বিকেলে এমনই এক আসরে এলেন কবি হেমচন্দ্র মদ্যপ অবস্থায়। ঠাকুরের কাছে আসবেন বলে সেদিন আরও বেশি করে নেশা করে এসেছেন, ঠাকুর তাকে ঘৃণা করেন কিনা, পরীক্ষার উদ্দেশ্যে। কবি ঘরে ঢুকতেই ঠাকুর তাঁর সুপরিচিত মধুর ভঙ্গিতে ‘আসুন দাদা’ সম্বোধনে সস্নেহে আলিঙ্গন করেন। বেসামাল কবির ভারে ঠাকুর বসে পড়েন এবং হেমচন্দ্রের মাথাটি নিজের উরুতে রাখেন। এই অবস্থায় কবি অনর্গল বকে যেতে লাগলেন আর ঠাকুর মৃদু হাসি ভরা মুখে স্থির দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর হেম কবি ঠাকুরের দিকে চেয়ে বললেন, ঠাকুর, এইমাত্র আমি মদ খেয়ে এলাম।
-সে তো মুখের গন্ধেই টের পাচ্ছি।
-কই, মদ খেয়েছি বলে তো আপনি আমায় ঘৃণা করছেন না!
-আমার বাঁ হাতে যদি ঘা হয়, তবে আমার ডান হাত তাকে কেটে ফেলে দেবে, না সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলবে?
-ঠাকুর, এমন কথা তো কারো কাছে আগে শুনিনি। সেদিন আরও নানা কথা হল কবির ঠাকুরের সঙ্গে; সস্নেহে ঠাকুর বলে গেলেন নানা কথা। লক্ষ্য যাঁর সমাধান, সমস্যা তাঁর কাছে দুর্লঙ্ঘ্য নয় কখনও; সাধারণ দৃষ্টিতে যা অন্যায়, গর্হিত অপরাধ, তাঁর চোখে তা সংশোধনীয় সাময়িক বিচ্যুতি। মাতৃস্নেহে সহ্য করেছেন তিনি অবাধ্য সন্তানের উপদ্রব, যাতে তার রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।
কিছুদিন পর ১৩৩১ বঙ্গাব্দের শেষ দিকে হেমকবি পাবনা আশ্রমে এলেন। ঠাকুরের কাছে গিয়ে বলেন,- আপনার কাছে কিছুদিন থাকব বলে এলাম।
শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যে বলেন-ভালই হল, এই ক’টা দিন তাহলে বেশ স্ফূর্তিতে কাটানো যাবে।
তোরো বছর বয়স থেকে কবির মদের নেশা। বিকেল হলেই নেশা চেপে বসে। কিন্তু আশ্রমে মদ পাওয়ার উপায় নেই। তাই প্রত্যহ পাবনা শহরে গিয়ে নেশা করতে হয়। শহরের অনেকেই আশ্রমকে ভাল চোখে দেখত না, তার উপর আশ্রমেরই একজনকে প্রকাশ্যে রোজ মদ খেতে দেখে বিরূপ সমালোচনা বৃদ্ধি পায়। আশ্রমকর্মী সুশীলচন্দ্র বসু ঠাকুরের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন। ঠাকুর হেম কবিকে ডেকে বলেন-আপনি তো আমার কাছেই এসেছেন, আমারই তো অতিথি আপনি?
-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
-তাহলে আপনার যা কিছু দরকার আমার কাছেই বলবেন, আমিই সব কিছু আপনাকে দেব।
-সবই আপনি দেবেন? ধরুন, আমার যদি মদ দরকার হয়?
-হ্যাঁ, তাও দেব।
-তাহলে তো খুব সুবিধাই হয়, আমার আর কষ্ট করে তিন মাইল হেঁটে পাবনা যেতে হয় না।
পরদিন বিকেলে হেমচন্দ্র ঠাকুরের কাছে এসে বলেন, ঠাকুর আমার নেশার সময় হয়েছে, এক্ষুনি মদ চাই।
ঠাকুর সেকথা শুনে হেমচন্দ্রের মদ্যপানের ব্যবস্থা করে দিলেন, কবি স্বচ্ছন্দে তা পান করলেন। এভাবে পরপর কয়েকদিন ঠাকুরের ব্যবস্থাপনায় মদ নিয়ে পান করার পর একদিন বিকেলে ঠাকুরের কাছে এসে বলেন-ঠাকুর, মনে করেছিলাম আপনি অত্যন্ত সহজ সরল লোক, এখন দেখছি আপনি অতি বড় খল, অতি বড় কুটিল।
ঠাকুর হেসে জিজ্ঞাসা করলেন- কেন কী হল?
-আপনার কাছ থেকে মদ নিয়ে খেতে হবে, এমন বন্ধনে আমায় ফেললেন কেন?
-দেখুন, আপনিও বিপ্রসন্তান, আমিও তাই। আমি কথা দিয়েছি, আপনিও কথা দিয়েছেন; আমি আমার কথা রক্ষা করে চলেছি আর আপনিই বা তা করবেন না কেন?
-ঐটাই তো মুস্কিলের কথা, আপনিই চালাকি করে আমাকে এই ফাঁদে ফেলেছেন। সকলে আপনার কাছে এসে আপনার মধুর সঙ্গ পেয়ে ও অমৃতোপম উপদেশ শুনে তাদের জীবন চলনা শুধরে নেয়, আর আমি কিনা আপনারই কাছ থেকে মদ নিয়ে খাচ্ছি! কাল থেকে আমার মনে ভয়ানক দ্বন্দ্ব হচ্ছে -আপনার কাছ থেকে মদ নিয়ে খাওয়া আর কিছুতেই চলবে না। এর থেকে যদি আমার আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাও ভাল।
বললেন বটে, কিন্তু আশ্রম ছেড়ে যাওয়া তাঁর আর হল না, ঐ ‘অতি বড় কুটিল’ মানুষটির ভালবাসার ফাঁদে পড়ে তীব্র অনুতাপের দহনে আবাল্য সঙ্গী বদ নেশাকেই ছাড়তে বাধ্য হলেন কবি। সকল নেশার সেরা নেশার সন্ধান পেয়ে গাইলেন:
“........ বিগত জনম কত সঞ্চিত কামনা,
কত কথা সুখ দুঃখ কত না বেদনা,
তোমারই মাঝারে ফুটেছে আহারে!
তোমারেই বারে-বারে চেয়েছিনু আমি।...”
ঠাকুরের সরল চাতুর্যের পূর্ণ পরিচয় পেতে তখনও কবির বাকি ছিল আরও। একদিন বিকেলে ঠাকুরের কাছে এসে বসেছেন, অন্যান্য অনেকেই উপস্থিত আছেন। নানা কথাবার্তা আলাপ আলোচনা চলছে। হঠাৎ ঠাকুর হেমচন্দ্রের কাঁধে হাত দিয়ে বলেন-চলুন, একটু ঘুরে আসি। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে এগোতে লাগলেন; ঠাকুর মাতৃমন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন, বললেন-এবারে একটু ভেতরে গিয়ে বসলে হয়। একতলার একটি ঘরে প্রবেশ করে বসলেন উভয়েই। একটুক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে শ্রীশ্রীঠাকুর হেমচন্দ্রের জীবনের একটি গভীর গোপন ঘটনা হঠাৎ উল্লেখ করেন। কবি তো অবাক! এ কথা ঠাকুর জানলেন কীভাবে! তিনি নিজে ছাড়া একথা আর কারও জানা নেই। কিন্তু ঐ একটিতেই শেষ নয়-পরপর এ ধরনের সকলের অজ্ঞাত কবির জীবনের গুপ্ত ব্যাপার ঠাকুর বলে চলেন-যেন ছবির মত দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে। হেমচন্দ্র নতজানু হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন-সমস্ত দেহখানি কাঁপছে থরথর করে। একসময় ঠাকুর নীরব হলেন; কান্নায় ভেঙে পড়ে চরণে লুটিয়ে পড়লেন কবি, ঠাকুর তুলে নিলেন বুকে, ঘুচে গেল সমস্ত অন্তরাল, নিঃসীম শান্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠল অশান্ত কবির অন্তস্থল। তাঁর এই আত্মসমর্পণের নন্দিত প্রাপ্তি ফুটে উঠেছে তাঁর গানের মধ্য দিয়ে-
“.... হে নব পরিচিত, হে চিরপুরাতন,
দরশনে আজি তব সার্থক এ নয়ন।
এ জীবন ফুটি উঠি, স্তুতি হয়ে পড়ে লুটি
শুধু তব শ্রীচরণ-পরশনকামী।...”
দীক্ষা নিলেন কবি হেমচন্দ্র এবং সপরিবারে আশ্রমে এসে স্থায়িভাবে বসবাস আরম্ভ করলেন। ছিপছিপে গড়ন, ফরসা রঙ, ছোটখাটো চেহারা কবির। একবার উৎসবের সময় ঠাকুর বসে আছেন মাতৃমন্দিরে, ভক্তমণ্ডলী পরিবেষ্টিত হয়ে। কবি এসেছেন ঠাকুরের কাছে।
কিন্তু ভিড় ঠেলে এগোতে পারছেন না। বিফল মনোরথ হয়ে মনোবেদনা নিয়ে ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে। ঠিক তখনই ঠাকুর এসে উপস্থিত হলেন কবির দরজায়, বললেন, আসুন হেমদা, বেড়িয়ে আসি। আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন হেমচন্দ্র, গাইতে আরম্ভ করলেন তাৎক্ষণিক রচিত গান:
এই তো এই তো তব দরশন মানস-নয়ন রঞ্জন
এই তো করিনু চরণে প্রণতি জয় জগজন-বন্দন!
এই তো করিছ নয়নপাত
এই তো আমার হৃদয়নাথ
সার্থক আজি জীবন মম সফল সকল ভুবন।...
ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক চিরন্তন, যখনই তিনি আসেন, তখনই আসতে হয় তাঁর ভক্তকেও-একই আবর্তে নিত্য আবর্তিত। ঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বলেছেন, একবার ছাপ মারা হয়ে গেলে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। এ সম্পর্ক জন্মজন্মান্তরের।
ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার আগে একবার কুমিল্লার এক সাধুর কাছে গিয়েছেন কবি। তখন তিনি বাংলার সুপরিচিত কথক। সাহিত্যিক মহলেও যথেষ্ট খ্যাতি তাঁর। সাধুজির সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর তিনি কবির কাছে কথকতা শুনতে চান। কবি বলেন, ভগবানের নামগান করতে আমার ভালই লাগে, কিন্তু আমি যে মদ খাই। কথকতার আসরে বসার আগে আমার মদ চাই, নইলে ভাব আসবে না। এসব জেনেও আমার কথকতা যদি শুনতে চান, তবে শোনাব। এই অকপটতা ও সরলতা ছিল তাঁর স্বভাবজাত, যা পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে এসে ব্যাপ্তি ও গভীরতা লাভ করে। তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন ঠাকুরের ভালবাসার কাছে - চেতনসত্তা জাগ্রত হয়েছিল তাঁর ঠাকুরের অমিয় স্পর্শে।
কবি ঠাকুরের মধ্যে দেখেছিলেন অনন্ত রসের উৎস এক আশ্চর্য মজার মানুষকে যিনি সীমার মাঝেও অসীম, রূপের মাঝেও অপরূপ। তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে লেখনীর মাধ্যমে:
এসেছে মজার মানুষ
মানুষের সাথে তাঁহার মেলে না,
(তাঁর) চলা-বলা-হাসি-খেলা
যে দেখে আর ভোলে না।...
কখনও বা কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে:
“.... সবাই মিলে করব পূজা আয় রে তোরা আয়!
নামগুলি সব কুসুম হয়ে পড়বে তাঁহার পায়।
ধোওয়াব চরণ তাঁহার নয়নের জলে
সুরের মালা গেঁথে তাঁহার পরাব গলে...”
হেমচন্দ্র রচিত তাৎক্ষণিক গানের সংখ্যা প্রচুর, তার অধিকাংশই আজ বিলুপ্তির পথে। সৎসঙ্গ পাবলিশিং হাউস কর্তৃক প্রকাশিত ‘মুরলী’ পুস্তিকাতে ৮৩টি গীতি সংরক্ষিত হয়েছে। উচ্চ ভাব ও স্বচ্ছন্দ ভাষায় রচিত এই গানগুলি একসময় সৎসঙ্গীদের ঘরে ঘরে বহুল প্রচারিত ছিল। সমবেত কীর্তনে এসমস্ত গানের প্রচলন এখনও অত্যন্ত প্রয়োজন।
মহারাজ অনন্তনাথ রায়ের উক্তিতে হেম কবি ও তাঁর গানের কিছুটা পরিচয়
পাওয়া যায়। মহারাজের ভাষায়- “শ্রীশ্রীঠাকুরকে উৎসর্গীকৃত হেম কবির সেই গান এখন আমার তন্ত্রীতে বেজে ওঠে। তাকে লক্ষ্য করেই যেন গাইতে ইচ্ছা হয়- কোথায় পাব এমন মানুষ, কোথায় পাব এমন প্রাণ। তার প্রাণভরা প্রত্যেকটি গানই এমনতরই-এমনি করে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে বিধ্বস্ত বিব্রত ব্যাকুল হৃদয়তন্ত্রীতে,- অন্তত আমার তো এমনই মনে হয়। যে প্রাণ যাতে বিসর্জন পেয়ে তৃপ্ত, আমার মনে হয়, সেই ভাবমাখা উদাত্ত ও স্বরিত সুর সবার প্রাণের তুষ্টি ও শান্তির একটা আবহাওয়া অন্তত ক্ষণিকের তরেও-সৃষ্টি করে সার্থকতা ও তৃপ্তি এনে দেবে।”
একবার অধ্যাপক পঞ্চানন সরকার কবিকে জিজ্ঞাসা করেন,- “ঠাকুরের আশ্রয়ে কেমন আছেন?
-আশ্রয় আবার কী? প্রশ্রয় বলুন।
-সে কী, প্রশ্রয় কী বলছেন! সে তো একটা নোংরা জিনিস; তাই কি পেলেন আপনি এই বিশ্ববিশ্রুত আশ্রমে?
-বলি ঠিকই। হেম কবি ভুল কমই কয়-সে কি আপনার অজানা, পঞ্চাননবাবু? মানুষ আশ্রয় চায় না। চারযুগে কস্মিনকালেও মানুষ চায়নি তা। মানুষ চায় প্রশ্রয় যা পেলে তার অন্তরাত্মা বর্তে যায়। অথচ এই দুনিয়ায় কেউ সে বস্তুটি দিতে চায় না- দিতে জানে না-দিতে পারে না। যদিও নিজে নিজে প্রত্যেকেই ঐ কোন্ আকাশের চাঁদটাকেই ঐ পরশমণিটাকেই খুঁজে মরছে-নিশিদিন শয়নে-স্বপনে- জাগরণে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার পঞ্চাননবাবু। মানুষ বড় হতে চায়, বড় বলে গণ্য হতে চায়, অথচ আশেপাশে কারও দুর্বলতার গন্ধ পেলে তার টুটি টিপে ধরে। সহ্য করবে না, নিজে বুক পেতে দুর্বলের অত্যাচার সইবে না।...
—কথা তো মন্দ বলছেন না মনে হচ্ছে। তবে কি আশ্রয় কেউ চায় না বলতে চান হেমদা?
—না, চায় না। কেউ না জানলেও কবি হেমচন্দ্র জানে। আশ্রয়ের কাঙালপনা জীবের নেই। থাকবে কী করে? আশ্রয়ের আকালই বা কবে হল জীবের? যেমনই হোক, যাই হোক, সে কোন না কোন আশ্রয় নিয়েই চলে। পারে তো কোন বড় লোকের গোলাম হয়-যদি ঐ গোলামিটা নেহাৎ গায়ে না বেঁধে। নতুবা, নিদেন বৃত্তির আশ্রয় তো তার রয়েছে অঢেল-অপর্যাপ্ত।
......সেদিন রাতে-কী কারণে-হয়তো কারণ নেই। মনের তলে যে ব্যথাটা চাপা আছে বাইরের অভিজ্ঞানে তা জেগে উঠল। ছুটে গেলাম তাঁর কাছে। চাই সান্ত্বনা, চাই প্রবোধ। কত জন এমন করে বসে আছে তাঁর কাছে আমারই মত। দূরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। কথা বলতে বলতে এক ঝলকে এক পলকে আমার দিকে চাইলেন, ঘরে ফিরে এলাম।
সে চাউনি বলে দিল, যা ভেবেছ এ কিন্তু তা নয়। আগে দেখেছ একরকম, সে
দেখা নিয়ে দেখেছ-তাই দেখা হয়নি।
আমার চোখের দেখা কি তাঁর চক্ষুভাণ্ডারে জমা আছে নাকি? চোখ দিয়েই তা কেড়ে নিতে হবে। কিন্তু চোখ তো পারে না। চোখ অনেক দেখে তাই তাঁকে দেখে না।
তাই তো, চোখে এখনও দেখা ফোটেনি। এত বড় জগৎটা, কত কিছু নিয়ে কাজ- কারবার করছি, কিন্তু কিছুই তো দেখা হল না।”
উপরে উল্লিখিত পঞ্চানন সরকার ও হেমচন্দ্রের এই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ব্যথাহারী দরদী দয়ালের প্রতি মরমী কবির তীব্র আকর্ষণ ও গভীর অনুরাগ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত কথা, অপূর্ব অনুভূতি “চোখ অনেক দেখে, তাই তাঁকে দেখে না”! চেতনার প্রত্যন্ত প্রদেশ হতে উৎসারিত যে ব্যথা, দেখেও যে না দেখার বেদনা- তারই শাব্দিক প্রকাশ যেন। দেখা শুধু চোখে নয়, সমগ্র সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করা, তাঁতেই ভরপুর হয়ে থাকা। বেদান্তের সার বাক্য ‘জগৎ ব্রহ্ম’ এই উপলব্ধিরই স্থায়িত্ব লাভ।
ছোটখাটো চেহারা আর বৃহৎ অন্তঃকরণের অধিকারী এই মানুষটিকে নিয়ে ঠাকুরের কত আশা ভরসা। প্রেরণা দিয়ে তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছেন ‘কর্মদেবী’, ‘সঙ্ঘমিত্রা’ প্রভৃতি নাটক। পুরুষ চরিত্র বর্জিত নাটক ‘কর্মদেবী’ মাতা মনোমোহিনী দেবীর পরিকল্পনায় উৎসবের সময় মঞ্চস্থ হয়। আশ্রমের মেয়েদের প্রথম প্রয়াস এটি, তাই তাদের উৎসাহ দেওয়া, কলাকৌশল শিক্ষা দেওয়া থেকে আরম্ভ করে নৃত্যগীতাদি সব কিছুর শিক্ষা ও পরিচালনার ষোল আনা দায়িত্বই বহন করেন হেমচন্দ্র।
পরের বছর মঞ্চস্থ হল ‘সঙ্ঘমিত্রা’। অনভ্যস্ত, একান্ত ঘরোয়া মেয়েদের দিয়ে অত্যন্ত মঞ্চসফল এই নাট্যপরিবেশনার পিছনেও রয়েছে হেমচন্দ্রের সুদক্ষ নৈপুণ্য ও নিরলস পরিশ্রম। এমনি করে বছরের পর বছর চলল নিত্য নতুন পালা।
নাটক রচনার পর হেমচন্দ্র নিজে অভিনয় করে প্রথমে দেখাতেন ঠাকুরকে সেখানে উপস্থিত থাকতেন পুরুষোত্তমজননী মাতা মনোমোহিনী দেবী, সুশীলচন্দ্র বসু, ব্রজগোপাল দত্তরায়, কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য, রত্নেশ্বর দাশশর্মা, পঞ্চানন সরকার প্রমুখ। রচনার মধ্যে কোথাও মনস্তাত্ত্বিক অসৌকর্য বা ভ্রান্তি থাকলে ঠাকুর স্বয়ং তা নিয়ে আলোচনা করতেন, আর হেমচন্দ্র মহানন্দে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে পুনরায় ঠাকুরের সামনে তুলে ধরতেন। একাধারে মানুষটি ছিলেন কবি, নাট্যকার, শিক্ষক, গায়ক, বাদক, নর্তক, অভিনেতা, পরিচালক, সর্বোপরি এক গভীর মনোযোগী ছাত্র।
কবি নিত্য সঙ্গ করেন ঠাকুরের, তাঁর কবিমনের সরস ভাবভূমিতে লীলাময়ের লীলা ক্ষণে ক্ষণে নতুন নতুন রঙে আভাসিত হয়, আর নিত্যনতুন অভিব্যক্তি লিপিবদ্ধ করে রাখেন বিভিন্ন ভাবে, কখনও কবিতায়, গীতিতে, কখনও বা নাটকে অথবা প্রবন্ধের মাধ্যমে।
অধ্যাপক পঞ্চানন সরকার একবার জিজ্ঞাসা করেন, এতসব লিখে যে মজুত
করে চলেছেন, এসব ছাপা হয়ে বেরুবে কবে?
—ছাপা হয় হবে, না হবে, নেই। কী তোয়াক্কা রাখি আমি তার? ও ভাবনা আমার নয়। আমি লিখছি রাত্তির জেগে, খেয়ে না খেয়ে, ভিক্ষে করে টেমির কেরোসিন যোগাড় করে, কিন্তু কেন জানেন?
—কেন বলুন তো?
—না করে উপায় নেই বলে। এটাই এ রাজ্যের সব সত্যের উপরের সত্য, সব
রসের সেরা রস। প্রজাপতি ব্রহ্মা এই বিরাট সৃষ্টি রচনা করে কী আনন্দ পেয়েছিলেন জানি না; কিন্তু আমার এ অফুরন্ত সৃষ্টির রসও যে অফুরন্ত, এটা জোর করেই বলতে পারি-সেখানে ব্রহ্মা ও বুঝি বা হার মেনে যান!
আক্ষেপের বিষয় এই বিপুল স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির অধিকাংশই কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে।
হেমচন্দ্র নিজের গোত্র বলতেন না, কেউ তাঁর গোত্র পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে শ্রীশ্রীঠাকুরের গোত্রের উল্লেখ করতেন। কারণ হিসাবে বলতেন, যে-গোত্রের বড়াই আমাকে ঊর্ধ্ব-সম্বেগী করে উন্নতির পথে অবাধ করে তোলে নি, বরং উৎসন্নের পথেই বেপরোয়া চলিত করেছে, জ্ঞান হওয়া থেকে শুরু করে এ অবধি, এ হেন গোত্রের নাম আর এ মুখে না-ই বা নিলাম। তাছাড়া, দীক্ষা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ তো এক নব জন্ম আমার। সেই মহা ভয়ঙ্কর অতীতটা থাকে থাক মাথা গুঁজে, আমার এই বর্তমান সব কিছুর পিছনে, কিন্তু তার জেরটা আজ আর টানতে যাব কোন্ দুঃখে!
একবার ভরদুপুরে একদল দর্শনার্থী আসেন হিমাইতপুর আশ্রমে। শ্রীশ্রীঠাকুর তখন দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামে। দর্শনার্থীর দল হেমকবিকে দেখতে পেয়ে বলেন-দাদা, আপনাদের ঠাকুর দেখতে এলাম। হেমকবি বলেন-আমরা না হয় তাঁকে ঠাকুর বলি, ভগবান, মহাপুরুষ বলি, আপনারা সেসব না বলুন, অন্তপক্ষে একজন ভদ্রলোক বলে তো মানেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই।
—তাহলে বলুন তো, এমন ভরদুপুরে বিশ্রামের সময় কি কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করা যায়? তিনি বিশ্রামের পর উঠুন, তখন দেখা হবে।
এরপর তাঁর অসাধারণ কথার যাদুজালে মুগ্ধ করে তাঁদের আটকে রাখেন তিনি বেশ কয়েক ঘন্টা। যখন বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে, তখন তাঁদের মধ্যে একজন বলেন-ঠাকুর কী এখনও ঘুমোচ্ছেন?
—আগে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিন আমায়, তারপর বলছি।
সিগারেটের প্যাকেট আসার পর মৌজ করে একটি সিগারেট ধরিয়ে হেমচন্দ্র বলেন-কী জানেন দাদা, ঠাকুর উঠেছেন অনেক্ষণ আগেই। তা এতক্ষণ আপনাদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, আপনাদের পক্ষে (নিজের বুকে হাত ঠেকিয়ে) এই ঠাকুরই যথেষ্ট।
এরপর অবশ্য হাসতে হাসতে তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ঠাকুর দর্শন ও প্রণাম করান।
রসরাজ হেমচন্দ্রের দৈহিক অসুস্থতাতেও অন্তরের সরসতার ঘাটতি হয়নি। ওষুধ খেতে চাইতেন না মোটেই; ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য অসুস্থ কবিকে জিজ্ঞাসা করেন-ওষুধ খাচ্ছেন তো ঠিকমত?
তৎক্ষণাৎ উত্তর দ্যান কবি-ভেবে দেখলাম, ওষুধ খাওয়ায় যত কষ্ট, বেঁচে থাকায় তত সুখ নেই। ওষুধ আর খাই না তাই।
তাঁর শরীর তখন অত্যন্ত অসুস্থ, অপটু। সুধা-মা (পরবর্তীকালে কৃষ্ণপ্রসন্ন-জায়া) পড়তে যেতেন কবির কাছে। পড়া শেষ হলে হেমকবি অসুস্থ শরীরে লণ্ঠন হাতে এগোতে আসতেন সুধা-মাকে, আপত্তি করলেও শুনতেন না। শারীরিক অসুস্থতার জন্য যখন ঠাকুরের কাছে গিয়ে স্বরচিত গান শোনাতে পারতেন না, তখন সুকণ্ঠী সুধা- মাকে সদ্য রচিত গান শিখিয়ে পাঠাতেন ঠাকুরকে শুনিয়ে আসতে। এমনি করেই অব্যাহত ছিল তাঁর নিত্য নিবেদন।
কবি বলতেন, জন্মজন্মান্তরের মহাপুণ্য, তাই সব কিছু নিয়ে চলতে চলতে শেষে তাঁরই পদপ্রান্তে এসে পড়েছি আমরা। লোকে তাই তো বলে, কোন কিছুর শেষ না দেখে সব ধারণাই আহাম্মকি। যেমন করে যা হোক করে আসি না কেন, শেষ পর্যন্ত অমৃতভাণ্ডে চুমুক দিয়ে ফেলতে পারলে আর কথা কী!
অমৃতভাণ্ড পান করে কবি যে অমৃতলোকে বিচরণ করতেন, তার সন্ধান মেলে তাঁর গানের মধ্যে। আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে তাঁর রচনার প্রায় সবই আজ হারিয়ে গেছে, তবু যা আছে, তা আজও মানুষের মধ্যে ভক্তিভাবের সঞ্চার করে, উদ্দীপ্ত করে মনকে। বিশিষ্ট আশ্রমিক ও শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্যতম পার্ষদ ব্রজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কবির একান্ত সুহৃদ। হেমচন্দ্রের সংগীতের প্রেরণার উৎস চিত্রণে তাঁর জবানীতে বর্ণিত নিম্নোক্ত ঘটনাটি বিবৃত হল:
“একদিন গভীর রাতে হেমকবি এসে হাজির আমার কাছে।... হেমকবির কন্ঠস্বর ব্রজেনদা, ও ব্রজেনদা! একটা গীত রচনা করেছি। সুরও দিয়েছি। চলুন না, বাঁধের ধারে বসে গানটা গাওয়া যাক।
.....আমরা দুই বন্ধু চললাম বাঁধের ধারে। আকাশে পাতলা মেঘের আস্তরণ- আধখানা ভাঙা চাঁদ অতি কষ্টে কিছু আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাঁধের উপর বসলাম। পিছনে নিস্তব্ধ আশ্রম। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পদ্মার জলরাশি। দূরে দূরে “গহনার নৌকো” থেকে নক্ষত্রের মত ক্ষীণ আলোর দীপ্তি দেখা যাচ্ছে। গৈরিক জলধারা ঢেউ তুলে বাঁধের গায়ে কলতান সৃষ্টি করে পশ্চিমের দিকে বয়ে চলেছে। দুই বন্ধু পা-দুটো নামিয়ে দিতেই শীতল জলস্রোত আমাদের পা ধুইয়ে বয়ে চলল। কবি গান ধরলেন -একটি কলি গাইতেই আমি গানটি গলায় তুলে নিলাম। আমাদের উদাত্ত কন্ঠস্বর পদ্মার ঢেউয়ের উপর ভেঙে পড়ল। দ্বৈত কণ্ঠের মূর্ছনা পদ্মার বাতাস বয়ে নিয়ে চলল অসীমের পথে-
তুমি কি রহিবে সাথে?
যবে, এ আবাস ছাড়ি বাহিরিব আমি
মরণ-আঁধার রাতে।
যবে, ব্যর্থ-বাসনা-প্রহত-চিত্ত দারুণ আর্তনাদে
নিরাধার মহা ভয়াল শূন্যে লুটাইবে অবসাদে;
তুমি কি তখন বাহু পসারিয়া
লইবে আমারে বক্ষে তুলিয়া
ফুটাইবে আলো হাসির কিরণে
উজ্জ্বল আঁখিপাতে...
... বেশ কিছুক্ষণ আপন ভোলা কন্ঠে গান চলার পর আমাদের খেয়াল হল ঠাকুর কাঁধ দুটি স্পর্শ করে পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা চমকে পিছনে ফিরলাম-গান থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর হেসে ফেললেন, বললেন-‘একটা correction করবের হবিনি (একটা জায়গা শুধরে নিতে হবে)। “তুমি কি” হবে না, “তুমি যে” হবে। “তুমি যে রহিবে সাথে “, “ তুমি যে তখন বাহু পসারিয়া”। আমি তো বারবার বলেছি-আমি থাকবো, থাকবো, থাকবো।”
১৩৪০ সালে স্বল্পায়ু কবির প্রতিভাদীপ্ত জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হয়। কিন্তু পার্থিব জীবনাবসানে সত্তার নাশ হয় না, শাশ্বত এই সত্য কবি হেমচন্দ্র সম্বন্ধেও বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তাঁর ‘ব্যর্থ-বাসনা-প্রহত চিত্ত’ ‘মরণ আঁধার রাতে বাহির’ হওয়ার বহু পূর্বেই শ্রীশ্রীঠাকুরের অমিয় সঙ্গের প্রসাদে সংহত, একাগ্র ও স্থির হয়ে গিয়েছিল। অতএব কবি বর্ণিত নিরাধার মহা ভয়াল শূন্যে একাকী অবসাদে তাঁকে থাকতে হয়নি। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন-মৃত্যুর সময় মানুষ যে চিন্তা নিয়ে চলে যায়, সেই চিন্তা ও চিৎকণায় আত্মা আবদ্ধ হয়ে থাকে। যার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত থাকা যায়, সেই অনুরাগ আর সব ভাবকে control করে, সেই অনুরাগের সঙ্গে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জড়িত ভাব নিয়েই মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। সুতরাং শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি সুগভীর অনুরাগে পূর্ণ চিত্ত কবি হেমচন্দ্র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে অতিক্রম করে আনন্দের অমৃতলোকে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
_______________________________________
# কবি_হেমচন্দ্র_মুখোপাধ্যায়



10