বঙ্কিমচন্দ্র রায় :-
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের খুব কাছের মানুষ যাঁরা ছিলেন, তাঁর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা সুষ্ঠুভাবে বাহিত হত যাঁদের তৎপরতায়, তাঁরা সম্ভবত অতিনৈকট্যের কারণেই, প্রদীপের নিম্নস্থ অংশের মত, কিছুটা যেন সকলের অগোচরে, নীরবে থেকে গেছেন। তাঁরা ঠাকুরের নিত্যমুহূর্তের সুবিধা-অসুবিধা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের সঙ্গে নিজেদের এমনভাবে একীভূত করে নিয়েছিলেন যে যেন তাঁদের পৃথক অস্তিত্ব আর দৃশ্যমান ছিল না, ঠাকুরের নিয়ত-পরিপার্শ্বেরই অংশ হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। এ- কথাটির তাৎপর্য বিশেষভাবে অনুধাবন করা যায় ঠাকুরের অন্যতম নিত্য-সহকারী বঙ্কিমচন্দ্র রায়ের জীবনরেখা অনুসরণ করলে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সাবডিভিশনের অধীনস্থ বল্লভদি গ্রামের এক বিপ্র পরিবারে ১৯০২ খৃষ্টাব্দের আগস্ট মাসে
বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম-পিতার নাম বরদাকান্তি রায়। গ্রামের মাইনর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পরে, মাতুলালয় কার্তিকপুরের হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন করেন বঙ্কিমচন্দ্র। একান্ত অল্প বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে একটি বহির্জগৎ-মুখী প্রাণচাঞ্চল্য ছিল, ছিল কিছুটা অস্থিরতা। পারিবারিক বন্ধনের সীমার মধ্যে ছটফটিয়ে উঠত প্রাণ তাঁর, বাইরের বিরাট পৃথিবী যেন হাতছানি দিত নিয়ত। মাত্র পনের বছরের কিশোর বঙ্কিম প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে সেন্ট জন অ্যাম্বুলেন্স-এর ‘মিলিটারি কোর’-এ যোগ দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে চলে যান সুদূর মেসোপটেমিয়ায়, বাবা-মা এবং অন্যান্য গুরুজনদের আপত্তিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়েই। জীবনের বাস্তব পৃষ্ঠা থেকে লাভ করেন অভিজ্ঞতার মূল্যবান শিক্ষা। ফিরে এসে পরে কোচবিহার থেকে আই. এস সি. এবং কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বি. এস সি. পাস করেন।
১৯২২-এর শেষদিকে বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীশ্রীঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন। ঐ সময়ে
১/১সি, হরিতকী বাগান লেন-এ ঠাকুরের অনুগামী বেশ কিছু তরুণ ও যুবকের আবাস ছিল। ঠাকুরের মাসতুত ভাই সতীশ চক্রবর্তী এবং অন্যান্য আরও কয়েকজনের সঙ্গে বঙ্কিমও তখন ঐ বাড়িতে থাকতেন। বঙ্গবাসী কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক নীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির সভাপতিত্বে ‘বিদ্যার্থী সংঘ’ স্থাপিত হয় ঐ বাড়িতে ১৯২২ খৃষ্টাব্দেই। সচিব হন আইনজীবী অমূল্য ভট্টাচার্য্য এবং সহকারী বনবিহারী ঘোষ। এই সংঘের সভায় ঠাকুরের ভাবধারা ও জীবনদর্শন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হত-সভ্য বেশির ভাগই কলেজ পড়ুয়ার দল, যাদের মধ্যে অ্যানার্কিস্ট দলের উৎসাহী সদস্যও ছিল বেশ কিছু। ডাঃ সুবোধ সেনও বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই সংঘের, পরে তিনি সেক্রেটারিও হন। শ্রীশ্রীঠাকুর কলকাতায় এলে তখন ঐ হরিতকী বাগানের বাড়িটিতে উঠতেন বঙ্কিম নিজে বিদ্যার্থী সংঘের সভ্য ছিলেন না। তবে অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল সংঘের মধ্যে, তাই তাদের সঙ্গে সঙ্গে সংঘের মিটিং-এ যোগ দিতেন। স্বামী প্রজ্ঞানন্দের আখড়ার সঙ্গে তখন বিশেষ ছিল ঘনিষ্ঠতা বঙ্কিমের। ঐ বছর কালীপুজোর আগের দিন রাত্রে মিনার্ভা থিয়েটার হলে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে অন্যান্যদের সঙ্গে বঙ্কিমও যান। আগুন নিভিয়ে ভিজে কাপড়ে ফিরছিলেন-সে অবস্থায় ঠাকুরের সঙ্গে দেখা, ঠাকুর এসে উঠেছেন ঐ বাড়িতে। বঙ্কিমকে দেখামাত্র বলে উঠলেন তিনি- ‘অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া হানিতে তীক্ষ্ণ ছুরি’। বঙ্কিমের মনে হল তাঁরই মনের কথাটি বললেন ঠাকুর। বাহ্যত বঙ্কিম বরাবর কিছুটা উচ্ছ্বাসহীন; এবং কারোর প্রতি হঠাৎ করে আকৃষ্ট হওয়ার মত প্রকৃতি তাঁর নয়। কিন্তু ঐ সুন্দর অথচ বলিষ্ঠ মানুষটির সঙ্গ কেন যেন বড় কাম্য মনে হতে লাগল বঙ্কিমের, সবসময়ই তাঁর কাছে কাছে ফিরতে লাগলেন, কিছুটা যেন নেশার মত লাগে। ঠাকুর পুরী গেলেন, উঠলেন হরনাথ লজ-এ, সেখানেও বঙ্কিম সঙ্গী; একান্ত ব্যক্তিগত কাজে সহায়তা করতে লাগলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাঁর উপরে কেউ কিছু আরোপ করে দিতে পারত না বাইরে থেকে, নিজে যেমনটি বুঝতেন, চলতেন তেমনই। কলকাতা ও পুরীতে ঠাকুরের সান্নিধ্য তাঁর আপাত-কঠোর আবরণের অন্তঃস্থলে হয়তো কোন আলোড়ন তুলেছিল, যার স্বরূপ নিজেও সেদিন বোঝেননি, কিন্তু তারই সাক্ষ্য ছিল তাঁর পরবর্তী জীবন জুড়ে।
বি. এস সি. পাস করার পরে সরকারি চাকুরি কিংবা ব্যবসা, কিছু একটা করতে হবে-এরকম অভিপ্রায় নিয়ে কলকাতায় হরিতকী বাগানের বাড়িতে থাকতে লাগলেন বঙ্কিম। ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে সৎসঙ্গ আশ্রমে তপোবন বিদ্যালয়ের জন্য টাকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভক্তপ্রবর সুশীলচন্দ্র বসু শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে প্রস্তাব দিলেন কলকাতার তৎকালীন বিখ্যাত নাট্য সংস্থা মনোমোহন থিয়েটারের মালিক মনোমোহন পাঁড়ের কাছে ‘বেনিফিট নাইট’-এর আবেদন করার। অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের থিয়েটারের এক রাত্রির উপার্জন তপোবন-বিদ্যালয়ের সাহায্যকল্পে দান করবেন- এই ছিল সুশীলচন্দ্রের অভিপ্রায়। প্রস্তাব শুনে ঠাকুর বলে উঠলেন-বাঃ, খুব ভাল কথা। মনোমোহন থিয়েটারকে এখানে (অর্থাৎ হিমাইতপুরে) নিয়ে এলে আরও ভাল হয়।
এ-কথায় সুশীলচন্দ্র বিস্মিত হয়ে বলেন যে অত বড় থিয়েটারের দল গ্রামে আসতে রাজি হবে কি না সন্দেহ-বিশেষত রাজি হলেও খরচ এত বেশি পড়বে যে লাভ বিশেষ কিছু হবে না। কিন্তু ঠাকুরের এবং তাঁর অনুগামীদের অভিধানে ‘অসম্ভব’ অথবা ‘না’ শব্দ তো ছিল না-তাঁর ইচ্ছায় সুশীলচন্দ্র অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। মনোমোহন থিয়েটারকে দলীয় বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রী সহ হিমাইতপুরে সৎসঙ্গে আনলেন এবং যাবতীয় ব্যবস্থাও হল। কলকাতা থেকে মনোমোহন থিয়েটার হিমাইতপুরে নিয়ে যাওয়ার সময় সুশীলচন্দ্র তরুণ বঙ্কিমকে সহযোগী হিসেবে সঙ্গে। যেতে বললেন। বঙ্কিম “সাত দিনের জন্য যাব” এই শর্তে সঙ্গে গেলেন।
বঙ্কিমদের পরিবারের যজমান ছিলেন তৎকালীন পোষ্টমাষ্টার জেনারেল সুরেন্দ্রবিনোদ সিংহ। তিনি বঙ্কিমের জন্য পোস্টাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট-এর পদে চাকুরির ব্যবস্থা করেন, ২৮শে নভেম্বর ঐ চাকুরির ইন্টারভিউ ছিল। আর সুশীলচন্দ্রের সঙ্গে তিনি হিমাইতপুর যাত্রা করেন ১৮ই নভেম্বর; সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সাত দিনের মধ্যে কলকাতা ফিরে আসার গরজ ছিল। কিন্তু তার পরবর্তী ঘটনা কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সে-প্রসঙ্গে সুশীলচন্দ্র বসুর অনবদ্য স্মৃতিকথা ‘মানসতীর্থ পরিক্রমা’ থেকে সামান্য অংশ উল্লেখ একান্ত প্রাসঙ্গিক: “... তখন বঙ্কিমকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রমে এলাম। সেই দিন ছিল ১৯২৩ সালের ১৮ই নভেম্বর। তার সে সাত দিন আজও পূর্ণ হয়নি; নিয়ত কর্মী হিসাবে সেই থেকে সে শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবায় নিয়োজিত। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সঙ্গেই হয়তো তার সেই সাত দিনের মেয়াদ পূর্ণ হবে।...” ঋষি-প্রতিম কর্মযোগী সুশীলচন্দ্রের এই অনুমান অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রতিপন্ন হয়েছিল।
মনোমোহন থিয়েটারের অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত অস্থায়ী প্রদর্শনী-স্থলের গেটে গেটকীপারের দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্কিম; ভারী কড়া গেটকীপার, টিকিট ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেন নি-এমনকী ঠাকুরকেও আটকেছিলেন টিকিট পরীক্ষার জন্য।
থিয়েটার শেষে দল ফিরে গেল কলকাতায়, কিন্তু বঙ্কিমের আর ফেরা হল না। তাঁর চিরকালের ঘর-পালানো বাউন্ডুলে মন এক আশ্চর্য মুক্তিময় বন্ধনে ধরা দিল স্বেচ্ছায়, থেকে গেলেন ঠাকুরের প্রেম-প্রাঙ্গণে। তপোবন বিদ্যালয়ের প্রথম দিককার শিক্ষকমণ্ডলীর অন্যতম ছিলেন বঙ্কিম রায়। বেশ ঘোর গাত্রবর্ণ, রোমশ দেহ, ঘন ভ্রু, তীক্ষ্ণ চোখ এবং বাহ্যত নিরাবেগ ঈষৎ রুক্ষ ভাবভঙ্গী- ছাত্রদের ভীত হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। কিন্তু তাঁর অন্তরের শুদ্ধতা এবং ইষ্টাবেগ ছোটদের সহজ বোধে সম্ভবত প্রতিফলিত হত, তিনি তাদের কাছে বিশেষ প্রিয় ছিলেন। ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ আত্মজ পূজ্যপাদ বড়দা তাঁকে ‘মাষ্টারমশাই’ সম্বোধন করতেন।
সে-সময় তপোবনে শিক্ষা হত হাতে-কলমে। আশ্রমে আবাদি জমি জ্যামিতিক খোপে কাটা থাকত-একেক দল ছাত্র একেক অংশ চাষ করে ফসল ফলিয়ে নিজেরাই আশ্রমের বাজারে বিক্রি করত। লাভক্ষতির হিসাব, কোন ফসল ভাল না হলে তার কারণ কী, সবই ছেলেদের বুঝতে হত। এরকম বাস্তবভিত্তিক ব্যবহারিক শিক্ষাপদ্ধতিই ঠাকুরের মনোমত ছিল। তৎকালীন অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রও ছিলেন এই অভিনব শিক্ষাব্যবস্থার শরিক।
শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশে যাজনকাজেও পরিক্রমা করেছেন বিভিন্ন অঞ্চল। যশোরের খ্যাতনামা ইষ্টকর্মী ডাঃ সুবোধ সেনের সঙ্গে যাজন সংক্রান্ত পরিক্রমায় গেছেন বহু স্থানে। যশোরে সুবোধ সেনের বাড়ি সৎসঙ্গ আন্দোলনের একটি বিশিষ্ট কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল; সেখানে রাত্রিবেলায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত আলোচনা অথবা বিতর্কের আসর বসত। ডাঃ সুবোধ সেনের সুযোগ্যা কন্যা শ্রীমতী বন্দনা দাশগুপ্তের ভাষায় “রাত্রিবেলায় প্রায় দুটো/আড়াইটে পর্যন্ত একটা আলোচনা অথবা বিতর্কের আসর বসত। বাবা থাকতেন-বঙ্কিম-কাকাবাবু থাকতেন-আরো যাঁরা কর্মী বা ঋত্বিক থাকতেন, তাঁরাও উপস্থিত হতেন। দুটো পক্ষ হত। বঙ্কিম-কাকাবাবু বিপক্ষ দলের মুখপাত্র হতেন। নিজেদের ধারণা পরিস্ফুট করার জন্য অনেক কূট প্রশ্নের অবতারণা করতেন। যাঁরা পক্ষের লোক হতেন-তাঁদের উত্তর দিতে হত। বিচারের আসরে বিজ্ঞান, সমাজ, স্বাস্থ্য, রাষ্ট্র, শাস্ত্র কোন বিষয়ই বাদ পড়ত না। ঠাকুরের কাজ করার জন্য তাঁরা নিজেদের তৈরী করেছিলেন যুদ্ধের প্রস্তুতিতে সৈনিকদলের মত।”
এই সৈনিকদলের নিজেদের বুঝটি এতখানি পাকা হত বলেই এঁরা অপরকে বোঝাতে পারতেন গভীর প্রত্যয়ে। হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামে এক রাশভারী পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন-তাঁর সামনে কেউ এগোতে সাহস করত না। কিন্তু সুবোধ সেন ও বঙ্কিম রায় তাঁকে ঠাকুরের কথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের যাজনে উদ্বুদ্ধ হয়ে হেমচন্দ্র দীক্ষা তো গ্রহণ করেনই, ক্রমে আশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ওঠেন। তাঁর পুত্র শ্রীদেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় শ্রীশ্রীঠাকুরের কথোপকথন ও বাণীর অনুলিখন, সম্পাদনা এবং ইষ্টকেন্দ্রিক নানা সাহিত্যকৃতির জন্য সৎসঙ্গ সমাজে বিশেষ সম্মান ও সমাদরের অধিকারী।
বঙ্কিমের আশ্রমে চলে আসা তাঁর পরিবারের কাছে স্বাভাবিকভাবেই কাম্য ছিল না। তাঁর পিতা বহুবার লোক-মারফত এবং চিঠিপত্রের মাধ্যমে ছেলেকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পিতার মৃত্যুর পরে তাঁর মা পরিবারস্থ অন্য সবাইকে নিয়ে একটি নৌকা করে এসে উপস্থিত হন আশ্রমে। সৎসঙ্গ আশ্রম এবং তার প্রাণ- পুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুরকে দর্শন করে তাঁদের মনের বিভ্রম দূর হয়। ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না পেরে মা নিজেই রয়ে গেলেন আশ্রমে ঠাকুরের আশ্রয়ে পরিবারসহ।
সৎসঙ্গ কেমিক্যাল ওয়ার্কস্-এর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারেও অন্যান্যদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বঙ্কিম। এ প্রসঙ্গে ঠাকুরের একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখ্য: “... কেমিক্যাল ইত্যাদি যে করলাম, আমার কি কিছু ছিল? এর বাড়ির হাঁড়ি ওর বাড়ির ড্যাগ নিয়ে বাগানের গাছ-গাছড়া দিয়ে কাজ শুরু করলাম। আর ছিল বঙ্কিম। সে efficient-ও খুব ছিল। সি. আর. দাশ বলেছেন-অমন পাঁচটা মানুষ পেলে হত।...”
১৯৪০-এর আগস্ট মাসে তৎকালীন সৎসঙ্গ সেক্রেটারি শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যুর সময় বঙ্কিম কার্যোপলক্ষে পাবনার বাইরে ছিলেন। ঐ দুর্ঘটনার পরে শ্রীশ্রীঠাকুর টেলিগ্রাম করে বঙ্কিমকে ডেকে পাঠান এবং সেক্রেটারির কার্যভার তাঁকে গ্রহণ করতে বলেন। ঠাকুরের নির্দেশে বেশ কিছুদিন তিনি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ঐ গুরু দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও তত্ত্বাবধানের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সেসময়কার মানুষের স্মৃতি থেকে। ডাঃ সুবোধ সেনের কন্যা শ্রীমতী বন্দনা দাশগুপ্তের স্মৃতি অনুসরণ করে তখনকার একটি খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়—
“আমাদের পাবনার বাড়ির সামনে দিয়ে একটা রাস্তা সোজা আশ্রমের দিকে চলে গিয়েছিল। আর সামনে ডান দিক দিয়ে একটা রাস্তা ছিল সোজা পদ্মার চর পর্যন্ত। সেখানে পদ্মা সরু খালের মত ছিল। তার উপর দিয়ে একটা বাঁশের সাঁকো ছিল নড়বড়ে মত। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে বড় চর-আর তার ওপাশে বড় পদ্মা। ঐ চর ধরে হাঁটলে আশ্রমের সামনের চরে পৌঁছনো যায়। কিন্তু আমরা ওখান দিয়ে যেতাম না। খুব নিরাপদ ছিল না। আশেপাশের মানুষজনেরা ভরসা করার মত ছিল না। আমরা সামনের সোজা রাস্তা দিয়েই আশ্রমে যেতাম।”
“একদিন ছোটপিসির সঙ্গে পরামর্শ হল-আজ চরের উপর দিয়ে আশ্রমে যাব। আমরা সেই দিক দিয়ে সেই নড়বড়ে সাঁকো পার হয়ে চরের উপর দিয়ে যাচ্ছি। খুব অস্বস্তি আছে। গা ছমছম করছে। পিসি বললেন- দ্যাখ, দূরের থেকে ঐ ছেলেগুলো অনেকক্ষণ আমাদের ফলো করছে। ওরা ছোট চরের রাস্তায় ছিল। চরগুলো ঢেউ খেলানো-ওদের সব সময় দেখা যাচ্ছিল না। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। নির্জন চরের রাস্তায় আমরা তাড়াতাড়ি আশ্রমে পৌঁছবার চেষ্টা করছিলাম। আশ্রমের বাঁধের সিঁড়ির উপর দেখি বঙ্কিম-কাকাবাবু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
-“এরকমভাবে-এসময়-এ রাস্তায় আসা হল কেন?”
আমরা বললাম-“তুমি জানতে নাকি যে আমরা এদিক দিয়ে আসছি?”
—“তোমাদের পাহারা দিয়ে আনবার জন্য ছেলেদের পাঠাল কে?”
–“ওরা তোমার পাঠানো ছেলেরা ছিল? আমরা ত ভাবলাম-“
–“এরকম আর কোরো না।”
কম কথার মানুষ বঙ্কিমচন্দ্রের এরকমই ছিল রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাপনা। পরবর্তীকালে তিনি হয়ে ওঠেন ঠাকুরের নিত্যমুহূর্তের সঙ্গী-তাঁর নিয়ত প্রয়োজনের অনুক্ষণের যোগানদার। ঠাকুরের অঙ্গন ছিল সকলের জন্য অবারিত। কিন্তু তাঁর মানুষী দেহটির তো কিছু সীমা ছিল, আহার-বিশ্রাম ও একান্ত ব্যক্তিগত কর্মের জন্য কিছু সময়ের আবশ্যকতা ছিল। কিন্তু উন্মুখ ভক্তকূলের বোধে তা ধরা দিত না। ঠাকুর যেহেতু 'ঠাকুর', সেহেতু যে-কোন সময়ই তাঁকে দর্শন করার অথবা তাঁর কাছে হৃদয়ের প্রার্থনা নিবেদনের দাবি নিয়ে অবিরাম জনস্রোত ধাবিত হত সর্বদা।
তখন প্রয়োজন অনুসারে সে-স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করার কঠিন এবং অপ্রিয় কাজ বঙ্কিম স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ঠাকুরের স্বস্তিবিধানের জন্য। তাঁর আপাত-রুক্ষ শক্তপোক্ত চেহারা, রোমশ দেহ, ঝাঁকড়া ভুরুর তলায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তাঁর পাহারাদারির কাজের সহায়ক হয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর প্রতি ছোটদের মনোভাব কিন্তু নিছক ভয়ের ছিল না। এক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শৈশবের স্মৃতিচারণায় জানা যায়, বাবার সঙ্গে দেওঘরে গিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শন ও প্রণামের পরে ঠাকুরের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় বালকটি মুখে হাত দেয়। বঙ্কিম ছিলেন বেশ কিছু দূরে, হঠাৎ করে দ্রুতবেগে কাছে এসে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটু দূরে কলের পাশে হাত ধুইয়ে আবার সযত্নে তাকে তার বাবার পাশে দাঁড় করিয়ে দেন। প্রথমে কিছুটা হতচকিত হলেও ছেলেটি বুঝে যায় যে মুখে হাত দিলেই হাত ধুয়ে ফেলতে হয়। এভাবে সদাচারের প্রথম পাঠের একটি বিষয় তার মনে গেঁথে দেন বঙ্কিম তাঁর তীক্ষ্ণ নজরদারি দিয়ে। তাঁর হাঁকডাক, গম্ভীর মূর্তি সত্ত্বেও কোনও প্রয়োজন হলেই ছোটরা কিন্তু তাঁর দরবারেই গিয়ে হাজির হত। কারণ তারা জানত যে তাদের প্রয়োজন সঙ্গত হলে তা পূরণ করবেন ঐ কড়া মানুষটিই। আবার কোন বিচলন দেখলে তার প্রতিবিধানে যথাযোগ্য সাজা দিতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
বঙ্কিমচন্দ্রের দিবারাত্রির প্রতিক্ষণ ছিল ঠাকুরের দৈনিক চলনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ থেকে শুরু করে রাত্রে শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত ঠাকুরের যাবতীয় কৃত্যের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে যুক্ত ছিলেন বঙ্কিম। এমনকী, রাত্রে ঘুমোতেনও ঠাকুরেরই ঘরে। ঠাকুরের ঘুম খুব সহজে আসত না-হাতের অতি মৃদু কম্পন সৃষ্টি করে তাঁর শরীরটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কাঁপাতে থাকলে ধীরে ধীরে ঘুম আসত। এই কম্পনবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বঙ্কিম। ঠাকুরের এতটুকু স্পর্শ লাভ করা ভক্তমণ্ডলীর কাছে চির আকাঙ্ক্ষার বিষয় ছিল। বঙ্কিম ছিলেন সে দিব্যদেহ নিত্যস্পর্শের বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী।
হিমাইতপুর আশ্রমে বঙ্কিম যখন আসেন, তখন আশ্রম গঠনের প্রাথমিক পর্যায় চলছে। তৎকালীন একটি সরস ঘটনার উল্লেখ করেছেন ভক্ত লেখক শ্রীসঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'পূর্ণের প্রাঙ্গণে' শীর্ষক রচনায়, যার মধ্য দিয়ে আশ্রমের তখনকার সহজ অনাড়ম্বর আন্তরিকতা এবং বঙ্কিমের একান্ত আত্মপর-ভেদ-বোধ-হীনতা, দুই-ই ফুটে উঠেছে। তাঁর ভাষায়: "তখন আশ্রম গঠনের কাজ চলছে। দ্বি-প্রহরে পরম পূজনীয়া বড়-মা (শ্রীশ্রীঠাকুর জায়া) তাঁর চওড়া পাড় শাড়ী ধুয়ে-কেচে দড়িতে মেলে দিয়েছেন শুকোবার জন্য। বিকালে শাড়ী দুখানা তুলতে এসে দেখেন, একখানা শাড়ী চুরি হয়ে গেছে। হৈ হৈ কাণ্ড-বড়-মার শাড়ী কে চুরি করল! খোঁজ চলতে লাগল। একটু বেলা পড়লে একজন আবিষ্কার করল-ছাতিম গাছের নীচে চাদর পেতে বঙ্কিমদা বড়-মার শাড়ী পরে শুয়ে আছেন।
–ও বঙ্কিমদা! উঠুন! করেছেন কী?
–কী হয়েছে? এত হাঁকডাঁক কেন?
–বঙ্কিমদা আড়মোড়া ভাঙছেন।
–বড়-মার শাড়ী পরে আছেন কেন? খুব হৈ চৈ হচ্ছে।
–হৈ চৈ কেন? আর একটা শাড়ী তো ছিল। বড়-মা সেটা পরুন গিয়ে।
বঙ্কিমদার কাছে কত সহজ সমাধান! মায়ের দুটো শাড়ী ছিল-তার একটা পরে সত্যিই তো তিনি কোন ভুল করেননি। এখানেই ছিল আশ্রমের বৈশিষ্ট্য।...”
ঠাকুরের এতটুকু সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে তিনি ছিলেন একমুখী, আপোষহীন। দেওঘরে আশ্রমে প্রথমটিকে একটি গোল তাসুর ঘর ছিল-তার পুবদিকে ছিল একটি ছাউনি। ঠাকুর ঐ তাসুর ঘর থেকে এসে মাঝে মাঝে ছাউনিতে বসতেন। তাসুর ঘরের কাছে ছিল এক বেল গাছ-ছোট ছোট বেল হত তাতে। গাছটির একটি শিকড় মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঠে ছিল। ঠাকুর একদিন একপাশে অন্যতম সহচর ডাঃ প্যারীমোহন নন্দী ও অপরপাশে বঙ্কিম-সহ তাসুর ঘর থেকে বেরিয়ে ছাউনিতে যাচ্ছিলেন, পথে ঐ উঠে থাকা বেলগাছের শিকড়ে বেশ জোরে হোঁচট খেয়ে ঠাকুরের পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল, বেশ আঘাত লাগল পায়ে। যাহোক, নিজেই সামলে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্কিম কোথাও চলে গেলেন। ঠাকুর একটু পরেই ভারী ব্যস্ত হয়ে খোঁজ নিতে লাগলেন বারবার-বঙ্কিম কোথায়? অবশেষে বঙ্কিমকে ডেকে নিয়ে আসা হলে ঠাকুর প্রশ্ন করলেন- কোথায় ছিলি? প্রথমে উত্তর এড়িয়ে যেতে চাইলেন বঙ্কিম-কিন্তু ঠাকুরের উদ্বিগ্ন কাতরতা দেখে শেষে জানালেন যে তিনি লোক সঙ্গে নিয়ে ঐ শিকড়টি কেটে ফেলার ব্যবস্থা করছিলেন। ঠাকুর এই ঘটনার আশঙ্কাতেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, বেদনার্ত মুখে আকুলভাবে বঙ্কিমকে বললেন-তোমার হাত যদি কাটা যায় তবে কেমন লাগে, লক্ষ্মী? দোষ তো গাছের নয়, দোষ আমার। আমারই দেখে চলা উচিত ছিল।
ঠাকুরের সর্বাত্মবোধের এমন প্রত্যক্ষ পরিচয়ে স্তব্ধ, অভিভূত হয়ে গেলেন বঙ্কিম। এমন করে তাঁর সঙ্গে নিত্যমুহূর্তে জড়িত থেকে তন্ময় হয়ে উঠেছিলেন বঙ্কিম।
তাঁর মা, ভাই, বোন ইত্যাদি পরিবারের পরিজন আশ্রমে ঠাকুরের আশ্রয়ছায়ায় ছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে ঠাকুরের সঙ্গ ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন না। অকৃতদার মানুষটি আক্ষরিকভাবে ঠাকুর-সর্বস্ব ছিলেন। তাঁর ইষ্টভৃতির ধরনও ছিল বিচিত্র। একটি ঝুড়িতে করে প্রতিদিন সকালে তরিতরকারি, আলু, ইত্যাদি বড়মার রান্নাঘরে দিয়ে আসতেন-আমরণ এভাবেই ইষ্টভৃতি পালন করেছেন তিনি।
১৯৬৯-এর জানুয়ারি মাসে ঠাকুরের দেহাবসানের পরে বঙ্কিম শিশুর মত আকুল হয়ে কাঁদতেন, অঝোরে জল পড়ত তাঁর দু’চোখ বেয়ে, এ দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন তখন অনেকেই। তাঁর বাহ্যিক কঠোরতার অন্তরে যে কতখানি নিবেদিত কোমল প্রাণ ছিল, তা প্রকাশিত হয়েছিল তখন। ১৯৭৬-এর ২৬শে এপ্রিল পার্থিব বিরহের পালা সাঙ্গ করে পরমপ্রিয়-সঙ্গে চিরমিলনে যাত্রা করেন বঙ্কিমচন্দ্র।
________________________________________
#বঙ্কিমচন্দ্র_রায়
10