🔶 জীবনের উন্নতি কেমন করে হবে...
🔶 প্রফুল্ল — মানুষ ইষ্টপ্রাণ হ'লেই কি তার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় ?
২২ শে অগ্রহায়ণ , রবিবার , ১৩৪৮ ( ইং ৭/১১/১৯৪১ )
যথাসময়ে তপোবনের শিক্ষকবৃন্দ এবং অন্যান্য দাদাদের নিয়ে বাঁধের ধারে তাসুতে শ্রীশ্রীঠাকুর - সান্নিধ্যে প্রাতঃকালীন বৈঠক বসলো
জীবনের উন্নতি কেমন করে হবে , সেই কথা বলতে গিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — প্রথম জিনিস হলো উৎসমুখতা । উৎসমুখতা এনে দেওয়াই শিক্ষার মূলকথা । বাপ , মা , গুরুর প্রতি উদগ্র টান থাকলে , তার বেচালে পা পড়তে পারে না , সে কখনও প্রবৃত্তির দাস হয় না । ভুল - ভ্রান্তি তার জীবনে কমই হয় । ‘ ভ্রান্তি এলাে সেই , উৎসবমুখ চলনবলন বসলো পেয়ে যেই । যে উৎসবিমুখ হয় না , তার ভুল আসবে কোত্থেকে ? সমস্ত star ( তারা ) Polar Star- এর (ধ্রুবতারার ) দিকে মুখ করে ঘুরছে , তাই কক্ষচ্যুত হয় না । সব জায়গায় ঐ এক কথা । এই ধৃতি , স্থিতি ও গতি অব্যাহত থাকে যা - দিয়ে , তাকেই বলে ধর্ম । তাই , ধর্ম প্রত্যেককে বলে , তুমি সুকেন্দ্রিক হও , যে - টানে বিধৃত থেকে তুমি সুস্থ থাক , সুস্থ থাক , তুমি তুমি থাক , ছিন্নভিন্ন হয়ে না যাও , সেই টানে নিবদ্ধ রাখ নিজেকে , আর তােমার পরিবেশকেও সেই টানে - টানে রাখ । ' মানুষের পক্ষে এই কেন্দ্র হলেন যুগ - পুরুষোত্তম , তিনি প্রত্যেককেই পরিপূরণ করেন স্ব - স্ব বৈশিষ্ট্যানুপাতিক । তার টানে আবদ্ধ থাকলে মানুষের আর কোন ভাবনা নেই । তাকে যদি কেউ না পায় , পিতামাতা ইত্যাদি স্বভাব - গুরু যারা , সুকেন্দ্রিক অনুরাগমুখর শ্রেষ্ঠ যারা , তাদের প্রতিও যদি টান থাকে , তাহ'লেও মানুষের অনেকখানি বাঁচোয়া । টান মানেই আপােষণী , আপূরণী টান । নইলে যে যত বড় হােমরা - চোমরাই হাে’ক না কেন , সে বৃত্তিস্বারূপ্য লাভ করবেই । ছােট ছেলে লাল দেখলে লালই যেন হ'য়ে যায় মা’র প্রতি টান থাকবার দরুন , তখন মা'র কথা মনে পড়ে , আর মা'র থেকে ওটা যে আলাদা , contrast- এ ( বৈপরীত্যে ) সে - বোধ মাথায় গজায় , নইলে লালকে লাল ব'লে বোধই করতে পারতাে না । ছােট - বড় যে যেমনই হােক — নিজের একটা দাড়া না থাকলে , বস্তুুবোধই আমাদের গজায় না , প্রত্যেকটি জিনিসের সংস্পর্শে আমাদের প্রবৃত্তি যেমন উত্তেজিত হয় , তাই দিয়ে আমরা পরিচালিত হ'তে থাকি । আমরা ভাবি “ আমরা খুব বুঝছি , জানছি , করছি ; কিন্তু সবটাই যে প্রবৃত্তির ক্রীতদাসত্ব করা হচ্ছে সে বুঝটা আর ফোটে না । আর , এতে করে প্রকৃত বোধ ও উপভোগ হ'তে আমরা অনেক দূরে সরে যাই । ধর , লোভের ঠেলায় রসগোল্লা কাছে আসলেই জিহ্বা যদি রসগোল্লা হয়ে যায় , তখন আর রসগােল্লাকে বোধ বা উপভােগ করবে কে ? কোনকিছু জানতে গেলে , বােধ করতে গেলে , উপভােগ করতে গেলে , তার থেকে interested aloofness ( অন্তরাসী দুরত্ব ) দরকার হয় । বৃত্তি যদি স্ব - এর অধীন থাকে তবেই তা সম্ভব , আর স্ব বজায় থাকে superior- এ ( শ্রেষ্ঠের) প্রতি active attachment- এ ( সক্রিয় অনুরাগে ) । বৃত্তি দিয়েই তাে দুনিয়া উপভােগ , কিন্তু বৃত্তিতেই যদি আমাদের সত্তা merge ক'রে ( ডুবে ) যায় , তবে কে কাকে উপভোগ করবে ?
তাই জীবনই অচল হয়ে ওঠে , সবই নিরর্থক হয় — যদি উৎসের প্রতি হাড়ভাঙ্গা টান না থাকে । এইজন্যই সব ব্যাপারে ইষ্টনিষ্ঠা , গুরুভক্তির কথা আমি অতাে করে বলি । কারণ , জানি - ও - ছাড়া কিছুতেই কিছু হবার নয় , ও বাদ দিয়ে জীবনীয় কিছুর সূত্রপাত হয় না , তাতে বড় জোর অনেক চেষ্টায় একটা অশ্বডিম্ব প্রসব করা যেতে পারে মাত্র ।
মানদা - মা একটা কফি বাইরে রেখে এসে ভিতরে বসেছেন । ইতিমধ্যে একটা গরু এসে তা খেয়ে গেল । পরে সবার খেয়াল হ'লো । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন গরুতে কফি খেয়েছে সে কিছু না । কিন্তু তােমরা কেউ সজাগ না , হুশিয়ার না , চোখ - কান - বোধ যেন আচ্ছন্ন ।
ধূর্জটিদা ( নিয়ােগী ) পূৰ্ব্বকথার সূত্র ধরে বললেন — তাহলে তাে ইষ্টানুসরণ বাদ দিয়ে কোন সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — হ্যা , তা ঠিকই তাে । সমাধানের ব্যাপারে সমাধা , সমাধি দুই - ই লাগে । অর্থাৎ , এর জন্য চাই যথাযথ নিষ্পন্নত ও সম্যক ধারণা । কোনকিছু সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করতে গেলে এবং তা বিহিতভাবে নিষ্পন্ন করতে গেলে যে বৃত্তিসাপ্যে নিমজ্জিত থেকে তা হবার নয় , সে - কথা তাে এতক্ষণ ধরে বললাম । সমাধি - সম্বন্ধে অনেকের কিন্তু কিম্ভুতকিমাকার ধারণা আছে । সমাধি কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থা নয় । ঘুমে থাকে অজ্ঞানতা , আর সমাধিতে থাকে একটা full knowledge ( পূর্ণ জ্ঞান ) , সমাধি হ'লো keener conscious ( তীব্রতর - চেতন) -অবস্থা । সমাধির মধ্যে করা , ভাবা , জানা , বোধ - করা , হওয়া — সবটাই আছে , সমাধিতে বৈধানিক বিন্যাসেরই পরিবর্তন ঘটে যায় ।
প্রফুল্ল — মানুষ ইষ্টপ্রাণ হ'লেই কি তার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়?
কত ইষ্টপ্রাণ ব্যক্তিও অভাবে কষ্ট পায় , আবার কত ইষ্টহীন ব্যক্তিও তো সচ্ছলতা উপভোগ করে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষ ইষ্টপ্রাণ হলে তার চলন - চরিত্র সুনিয়ন্ত্রিত হয় , তার বুদ্ধিবৃত্তি , দক্ষতা , যােগ্যতা , সেবাবুদ্ধি , কর্মক্ষমতা পুষ্ট হয়ে ওঠে । এতে - ক’রৈ সে লােকের প্রয়ােজনপূরণী স্বভাবসম্পন্ন হয়ে ওঠে , তাতে তার অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হওয়াই তো উচিত । তা ছাড়া , মানুষই মানুষের সব চাইতে বড় সম্পদ , সে দিক দিয়ে যাজনমুখর , সেবাপ্রাণ , ইষ্টানুরাগী যে , যার চলনা সুসমঞ্জস , ব্যবহার হৃদ্য ও মনোজ্ঞ , তার লােক - সম্পদ তো বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক । তার দরিদ্র থাকার তাে কারণ খুজে পাওয়া যায় না । কারণ , অর্থনৈতিক উন্নতির বুনিয়াদ যে দক্ষতা , যগ্যতা , ক্ষিপ্রতা , চরিত্র , নিরলস - সেবাবুদ্ধি , সুসঙ্গত - চলন— তার কোনটারই অভাব থাকে না তাতে । অবশ্য , তারা হয়তো প্রয়ােজনাতিরিক্ত consume ( ব্যবহার ) নাও করতে পারে । তবে অর্থের প্রতি তার লোভ না থাকায় , অর্থকরী প্রয়াসের দিকে বেশী নজর না দিয়ে সে হয়তাে এমন কোন কল্যাণকর গবেষণা বা অনুশীলনের দিকে ঝোক দিল , যার ফল নগদানগদি পাবার নয় , অথচ সেটা কিনা ভবিষ্যতে একদিন হয়তাে পরিবেশ শুদ্ধ তাকে প্রভূত সমৃদ্ধ করে তুলবে । এমনও হয়তো হতে পারে যে , তার ফল সে নিজের জীবনে পেল না ; উপকৃত হোল ভবিষ্যৎবংশধরগণ । এ অবস্থায় তাকে কি বলতে হবে যে সে অর্থনৈতিক - জীবনে অকৃতকার্য হলাে ? বিপুল সৃষ্টির , বৃহৎ সংগঠনের দায় দায়িত্ব যারা বহন করে , অনেক দুঃখের আগুনে পােড় খেয়ে , অনেকের জন্য প্রায়শ্চিত্ত ক'রে , অনেকের অক্ষমতার বালাই বহন করে তাদিগকে এগুতে হয় । তাদের পুরাে গতি ও পরিণতিটা লক্ষ্য না - ক'রে মাঝখানকার কোন - একটা অবস্থাকে দেখে একটা রায় দেওয়া সবসময় বুদ্ধিমানের কাজ নয় । আজ আমাদের ঋত্বিদের যাদের হয়তাে দেখছ — কত অর্থনৈতিক কৃচ্ছতা , তাদের নিরলস সেবার ফলে হয়তো দেখবে একদিন সমগ্র জাতি কতখানি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে — সবদিক দিয়ে । এদের এই আপাত - কৃচ্ছতা দেখে কি বলবে যে এরা কিছুই পেল না , কিছুই পারল না , কিছুই করল না ? ব্যক্তিগতভাবে দুই - চার জনের সম্বন্ধে সে - কথা খাটলেও এদের বেশীর ভাগের সম্বন্ধে সে - কথা খাটে না । আমি বলব , একটা গোটা মরণােন্মুখ জাতিকে বাচাবার জন্য , মানুষ করবার জন্য , এদের প্রত্যেকে যদি লাখো কষ্ট - দারিদ্র্য বরণ করে নেয় , সেই - ই তাদের পরম ঐশ্বৰ্য্য । আর , এরা যদি মানুষের পিছনে seriously ( গুরুতরভাবে ) খাটে , তবে এদের দুঃখ ঘুচতেও দেরী লাগবে না — এরা তা ’ চাক বা না চাক । মানুষের ঐশ্বর্যের এক কণাই তাদের অঢেল ক’রে দেবে । যদি শুধু মুখে - মুখে ইষ্টপ্রাণ হয় , অথচ বাস্তবে তেমন না হয় , তাহলেও যে সে অর্থনৈতিক - জীবনে কৃতী হবে , এ - কথা বলতে পারি না । আবার , চোরা কারবার করে বা ফাকিবাজির ভিতর দিয়ে কেউ যদি বেশ দু’পয়সা কামায় , তাহলেই যে সে খুব একটা যােগ্য হয়ে উঠলাে , এ - কথাও আমি ক’বার চাই না । আমার কথা হলো , মানুষের ইষ্টপ্রাণতার সঙ্গে জড়িত আছে তার সুনিয়ন্ত্রিত যােগ্যতা , এবং এর সঙ্গে জড়িত আছে তার অর্থনৈতিক অবস্থা ।
#Alochona_prosonge_part_1
#আলোচনা_প্রসঙ্গেপ্রথম_খণ্ড
#ষষ্ঠ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1
10