✧ অভাব, অভিযোগ, দুঃখকষ্ট
✧ বৃত্তিমাফিক সেবা করার ফলে উভয়েরই সর্বনাশ
✧ কি - ক'রে বুঝব ইনি গুরু হবার উপযুক্ত কিনা..
✧ ইষ্টপ্রাণতা তিন রকমের..
✧ উপনয়ন - সম্পর্কে...
২ রা কার্তিক , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৬ ( ইং ১৯/১০/১৯৩৯ )
উপনয়ন - সম্পর্কে বললেন —
উপনয়ন মানে উপনীত হওয়া , গুরুগৃহে উপনীত হ'য়ে উপনয়ন গ্রহণ করতে হত । উপনয়ন হলো আমাদের পূর্বপুরুষের স্বীকৃতি । উপনয়ন গ্রহণ না - করলে , আমাদের ঋষি - মহাপুরুষদের সঙ্গে যে কোন সম্পর্ক ছিল তাই যেন বোঝা যায় না । মুসলমান কর্মচারীরা বেশ নামাজ পড়বার জন্য ছুটি নেয় , কিন্তু আমাদের হিন্দুদের সন্ধ্যা করবার জন্য ছুটির ব্যবস্থা নেই — এ তাে আমাদের দোষ , এক ভাই যদি সন্ধ্যার জন্য ছুটি চায় আর একজন বলবেন , আমি কাজ করব । কী যে আমাদের অধঃপতন ! আমরা এক হতেই পারি না । আর , ভগবান আমার সামনে জুটিয়ে দেনও দৃষ্টান্ত । একবার নারায়ণগঞ্জ থেকে আসছি , ওখানে একটি মুসলমান মেয়েছেলের গায়ের ওড়না না বােরখা একটা কনেষ্টবলের গায় লেগেছিল — আর সেই কনেষ্টবলটাকে কি মার । কুড়ি - পঁচিশজনে মিলে তাকে একেবারে ফুটবল করে ফেলল । মেরে পিষে দিল । তখনও পুরােপুরি ইংরেজী আমল , এখনকার মতো একজনও দেশের লােক মন্ত্রী হয়নি । ওই দেখলাম — আর সকালে গােয়ালন্দে steamer ( ষ্টীমার ) থেকে নামার সময় দেখি , এক সাব - ডিপুটি তার বৌ নিয়ে আসছে , এমন সময় কে একজন তার বুক চেপে ধরেছে , আর সকলে বলছে — বৌকে যেমন মেম সাজিয়ে নিয়ে বেড়াও , করবে না , বেশ করেছে । আমি ভাবতে লাগলাম —কেউ যদি অন্যায়ই করে থাকে , তার কি ক্ষমা নেই ! তাকে কি এমন ক'রে অপদস্থ করতে হয় ! আমি ভদ্রলােকের পিছনে - পিছনে গেলাম । একটু তফাতে এসে ভদ্রলোক স্ত্রীকে বকতে লাগলেন — তুমি অত লােকের মধ্যে চেঁচালে কেন ? চেচালে কেন ? এই তাে আমাদের অবস্থা ।
আর - একবার দেখেছিলাম পোড়াদহ ষ্টেশনে — একটি মেয়ে পায়খানায় গেছে —একটা পুরুষ সেইদিকে ঢুকল — এবং সে সরতে - সরতে এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে যেখানে পুরুষটির সুবিধা হয় , পরে তাড়া দিতে লোকটি মাঠের মধ্যে দৌড় দিল । লােকটি চলে যাবার আধঘণ্টা পর পর্যন্ত মেয়েটি কাপতে লাগল । কিন্তু তারপর ঐদিনই ব্যাণ্ডেলে দেখলাম — কাছ দিয়ে কাপড় - পরা একটি মেয়েমানুষ —বোধ হয় মারাঠী হবে । একটা পুরুষকে পায়ের জুতাে খুলে চটপট - চটাপট মার — পুরুষটা ছুটে পালাল , কেউ কোন কারণ বুঝতে পারল না । মুখ ধোবার সময় মেয়েটির গায় জল লাগিয়েছিল — এই বােধহয় অপরাধ । এই মারাঠা জাতটাও একসময় আমাদের মতাে ছিল , কিন্তু শিবাজী এসে এদের গ'ড়ে দিয়ে গেলেন ।
সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — একরকম মানুষ আছে , তাদের হয়তো কোন মেয়েকে খুব ভাল লাগল — কিন্তু approach করবার ( এগােবার ) সাহস নেই , ভয় পায় — অথচ মনে - মনে তার জন্য অভাব বােধ করে , টানটা ছাড়তে পারে না — আর তার অভাব মেটাতে চায় আর - একজনকে দিয়ে — যাকে ভালবাসে না , যা সে পছন্দ করে না , দেখাচ্ছে , তাই যেন খুব ভালবাসে । তাদের সবই এমনি উল্টো , সেখান থেকে ঘা খেল , গেল অন্যত্র । কাউকে হয়তো মা - বোন ব'লে ভালবাসতে আরম্ভ করলাে , খুব মিশে পড়লো , কিন্তু তলে - তলে রইলাে শয়তানি — এইরকম এদের libido ( সুরত ) পৈতের মতো জড়া পাকিয়ে যায় , distorted ( বিকৃত ) হ'য়ে পড়ে । এরা সব - কিছু বােঝে উল্টো , কেউ হয়তাে তাকে বলল — ওখান থেকে লাফ দিও না — সে সােজাভাবে কথাটা কিছুতেই নিতে পারবে না , ভেবে নেবে তাবে বুঝি অপমান করা হচ্ছে । একটা জিনিস তার হয়তাে খুব ভাল লেগেছে —তখন সে দেখাবে তা যেন সে পছন্দ করে না— vigorously oppose- ই ( জোরের সঙ্গে প্রতিবাদই ) করতে থাকবে । এরকম যাদের হয় , তাদের শােধরান মুশকিল । এরা gentlemanly pose ( ভালমানুষী চাল ) নিয়ে চলে , খুব mild ( নম্র ) -মোলায়েম কায়দাকরণ করে চলে — অথচ insincerity- তে ( কপটতায় ) ভরা — এদের সারা বড় কষ্টকর । আর - একরকম আছে damaged ( বিধ্বস্ত , যেমন বিল্বমঙ্গল — এরা হয়তাে কারো জন্য একেবারে উন্মাদ হয়ে ওঠে —কোনদিকেই খেয়াল রাখে না— debauched life lead ( ব্যভিচারী জীবন যাপন ) করে — কিন্তু একটা নৌকার মধ্যে একটা ফুটো হ'লে সেই ফুটো - জায়গায় একটা গোজা দিয়ে দিলে যেমন যে নৌকা সেই নৌকা — আগে যেমন পাঁচশাে মণ মাল বইতে পারত , তেমনি পারে — এদেরও সেইরকম , ওই ফুটোটা যদি একটিবার ঠিক করে দেওয়া যায় , Superior Beloved- এ ( প্রেষ্ঠে ) attached ( অনুরক্ত ) হয় , তবে normal ( সহজ ) মানুষ হয়ে দাড়ায় — তাই damaged ( বিধ্বস্ত সুরত ) অনেক ভাল ।
একটা মানুষ যখন বলে — সংসার নিয়ে পেরে উঠছি না — অভাব - অভিযােগ , দুঃখকষ্ট , ছেলেপেলে অবাধ্য ইত্যাদি , তখন বুঝতে হবে , তার কোন obsession ( অভিভূতি ) আছে , সেইজন্যই সব নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না । একেই বলে মায়া - মায়া আমাদের পরিমাপিত করে তােলে , জীবন সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে নিয়ে যায় , এ হলাে বৃত্তির খেলা — বৃত্তাকার তাই বলে বৃত্তি , বৃত্তির মধ্যে মানুষ যখন থাকে তখন চলার পথ পায় না । প্রকৃতপক্ষে জরা - মৃত্যু ছাড়া আর কোন দুঃখ নেই — অন্য যা - কিছু জীবনে আসে — তা ’ অামাদের বলে — আমাদের গ্রহণ কর , আমাদের দিয়ে তুমি পুষ্টি সংগ্রহ কর । সব - কিছু আসে আমাদের serve ( সেবা ) করতে , আমাদের principle ( আদর্শ ) থাকলে ওরাই খােরাক হ'য়ে দাড়ায় — যাই আসুক না কেন , আমরা ঘাবড়াই না , ওদের জীবন - বৃদ্ধির কাজে নিয়োগ করতে পারি ।
এক দাদা পরোপকার ও দেশসেবার কথা তুললেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ভালমন্দ যাই করি না কেন , principle ( আদর্শ ) না থাকলে কিছু integrated ( সংহত ) হয় না । সি , আর , দাস যখন leader ( নেতা ) হ'য়ে গেলেন , একজন বিশিষ্ট নেতার তখন মনে - মনে ক্ষোভ হয়েছিল , তিনি আমার কাছে এসে বলেছিলেন — দেশ আমাকে চাইলো না , দেশের জন্য আমি আমি বললাম — তা তো হবেই । আপনি তাে কাউকে fulfil ( পরিপূরণ ) করার জন্য এ - সব করেননি । প্রথমে উনি কথাটা বুঝতে পারেননি , এত করলাম । পরে মৃত্যুর আগে বুঝেছিলেন । আমরা যদি কারও উপকার করতে যাই এবং কোন প্রত্যাশা রাখি — তখনই সে rigid ( কঠোর ) হ'য়ে ওঠে — ভাবে , ওঃ , তুমি তিন পয়সা দিচ্ছ — পাঁচ পয়সা পাবার লােভে , সে - সব চালাকী খাটছে না । আত্মস্বার্থ - আত্মিপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করলে অমন না হয়ে পারে না , কিন্তু ইষ্টস্বার্থ - ইষ্টপ্রতিষ্ঠার জন্য করলে অনন্য তােমার ইষ্টের প্রতি ও সেই সঙ্গে - সঙ্গে তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠে । তুমি হয়তাে বললে - ভাই ! তোমাকে যা পারলাম দিলাম , তােমার কাছ থেকে আমি এ আর ফিরে চাইনে ; ভাই , আমার দশাও এইরকম ছিল তার দয়ায় আমি এখন সব বুঝেছি — সার্থক হয়েছি । এতে মানুষ automatically grateful ( স্বতঃই কৃতজ্ঞ ) হয় । কোন মানুষ এতেও যদি ভাল না হয় তবে বহুদিন ধরে ইষ্টানুগ সেবা ও অনুধাবন করলে ঠিক হয়ে যায় — যদি কিনা জন্মগত ব্যত্যয় না থাকে । প্রকৃতির নিয়মই এইরকম । তুমি হয়তো তোমার স্ত্রীর ডালে ফোড়ন দিয়ে দিচ্ছ , তরকারী কুটছ , ছেলেমেয়ে রাখছ — অথচ তােমার পুরুষত্ব নেই , তোমার স্ত্রী তখন তোমাকে পেয়ে বসবে , তােমার উপর দৌরাত্ম্য করবে , তােমার জন্য এতটুকু ভাববে না , তােমার কথা শুনবে না । কিন্তু তুমি যদি বল — তােমার মতো কত মেয়ে আছে , তুমি যদি আমার মা - বাবার সেবা না কর , তুমি আমার কেউ নও । দেখবে তােমার স্ত্রী আপনা - থেকেই ঠিক পথে চলবে । মানুষকে বৃত্তিমাফিক সেবা করার ফলে উভয়েরই সর্বনাশ হয় , কিন্তু শ্রেয় কাউকে fulfil ( পরিপূরণ ) করার জন্য যদি সেবা করা যায় , সকলেই মঙ্গলের অধিকারী হয় ।
যতীনদা — একজন দেখে কি - ক'রে বুঝব যে ইনি আমার গুরু হবার উপযুক্ত কিনা ?
বিশ্বাস আসবে কী - ক'রে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — দেখা মাত্রই কি বােঝা যায় ? কেউ - কেউ পারে । তবে সঙ্গ করলে বোঝা যায় । সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে শ্রদ্ধা , শ্রদ্ধয়া দৃষ্টিশুদ্ধতা , দৃষ্টিশুদ্ধোহ বিশ্বাসঃ , বিশ্বাস নির্বিচারতা , নির্বিচারাৎ ভবেৎ প্রেম , প্রেম্নশ্চাত্মসর্মপণম । সঙ্গ করলে শ্রদ্ধা আসে , শ্রদ্ধার ফলে দোষদর্শন দূর হয়ে যায় । ভালটাকে মন্দ বলে দেখার প্রবৃত্তি থাকে না , আর মন্দ বলে কিছু দেখতেও পাই না । তারপরে আসে বিশ্বাস , বিশ্বাস আসলে আমরা প্রশ্নশূন্য হয়ে দাঁড়াই ! তৃপ্তিতে আমাদের মন ভরে যায় , এতে জন্মে প্রেম , ভালবাসা , টান । আর , প্রেম আত্মসমর্পণে পরিণত হয় — প্রিয় ছাড়া আমরা আর কিছু জানি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হরেনদাকে ( ভদ্র ) ডেকে একজন রােগীর জন্য আটটা কমলা আনতে দিলেন । ইষ্টপ্রাণতা - প্রসঙ্গে কথা উঠলাে , বললেন — ইষ্টপ্রাণতা তিন রকমের সবচেয়ে gtai passion - pervading attachment ( বৃত্তি - ভেদী , অনুরাগ ) যে - বৃত্তি আমার ইষ্টকে fulfil ( পরিপূরণ ) করে না , তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই আর , যা কোন - না - কোন ভাবে ইষ্টকে fulfil ( পরিপুরণ ) করে , সে সম্বন্ধে আমার কোন প্রশ্ন নেই — করবই । আর - এক রকম- passion compro mising প্রবৃত্তির সঙ্গে আপোষকারী ) । আমার complex ( প্রবৃত্তি ) -এর সঙ্গে যতটুকু খাপ খায় , ইষ্টকে ততটুকু follow ( অনুসরণ ) করি — অর নিকৃষ্ট হচ্ছে passionate ( প্রবৃত্তিমুখী ) —এখানে ইষ্টকে আমার বৃত্তির fulfilment . এর পূরণের জন্য utilise ( ব্যবহার) করি - ঠাকুর ! আমি তােমায় কত ভক্তি করি , ডাকি , দিনরাত কাঁদি , ঠাকুর , ঐ মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়েটা যদি ঘটিয়ে দাও , তাহলে তুমি প্রকৃত ঠাকুর , তবে তোমার ভােগ দেব , ইত্যাদি ।
এরপর কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , ভোলানাথদা ( সরকার ) প্রভৃতি এসে পড়লেন । আজ সারাদিন শ্রীশ্রীঠাকুর কেষ্টদার কথা বারবার জিজ্ঞাসা করছেন , কেষ্টদা আসতেই কি স্ফূর্তি। বললেন — আমি ভাবছিলাম , আপনি হারিয়ে গেছেন । নাকি ?
কেষ্টদা ও উপস্থিত সকলেই হেসে ফেললেন । শ্রীশ্রীঠাকুরও সঙ্গে - সঙ্গে হাসতে লাগলেন । ভােলানাথদা পায়ের ব্যথার কথা জানালেন । শ্রীশ্রীঠাকুর আনন্দ - আবেগে বলতে লাগলেন — আপনি ঐ ন্যাঙড়া পা নিয়ে যা ’ ক'রে এসেছেন -সে তো একটা অমানুষী কাণ্ড , আমি তো ভাবতেই পারি না । শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখে এইরকম প্রাণ - মাতান কথা শুনলে দুনিয়ার দুঃখকষ্ট সব ভুলে যেতে হয় — যারা শােনে , যারা দেখে তাকে , তারাই শুধু বোধ করতে পারে এর মর্ম — শিরায় - শিরায় আনন্দের ঢেউ খেলে যায় । বিশ্বগ্রাসী ব্যগ্রতা নিয়ে নিখিলের রন্ধ্রে - রন্ধ্রে তাকে প্রতিষ্ঠা করার উন্মাদ - আকাঙ্ক্ষা তাদের উদ্বেল করে তোলে ।
#Alochona_prosonge_part_1
#আলোচনা_প্রসঙ্গেপ্রথম_খণ্ড
#ষষ্ঠ সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
https://www.facebook.com/Amritokathaa
10