* চতুর্ব্বর্ণ কে সৃষ্টি করেছে ? (চাতুর্ব্বর্ণং ময়া সৃষ্টং) কখন থেকে শুরু হয় ?
* ঠাকুরের ইচ্ছা হলে সব করতে পারে, কিন্তু কেনো করে না ?
২১ শে অগ্রহায়ণ , শনিবার , ১৩৪৮ ( ইং ৬/১২/১৯৪১ )
লুব্ধ মধু যেমন মধুচক্রকে ঘিরে ভিড় জমায় , ইষ্টব্ৰতী তাপস - মণ্ডলী উষা - সমাগমে তেমনি ক'রেই এসে হাজির হয়েছেন তারই কাছে । আজ হিমায়েতপুরের পূণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে যে - দৃশ্য আমরা দেখছি — এমনতর দৃশ্য মানুষ বড় বেশী দেখেনি , দেখেছিল একদিন দক্ষিণেশ্বরের দেবদেউলে , দেখেছিল একদিন নদীয়ার পথে - পথে , দেখেছিল একদিন আরবের মরু - প্রান্তরে , দেখেছিল একদিন জেরুজালেমের জলপাইবনে , দেখেছিল একদিন সারনাথের স্তুপপাদমূলে , দেখেছিল একদিন মথুরা - বৃন্দাবন - দ্বারকায় , দেখেছিল একদিন অযােধ্যার রাজপুরীতে । এইতো অমৃতময়ের অমৃতসঞ্চারের পর্ব , যে অমৃতপ্রবাহ গুটিকয়েক ব্যষ্টির ভিতর - দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যায় সারা বিশ্বে , আনে নূতন প্লাবন —এক নবীন ভাববিপ্লব , স্তরে স্তরে পলি রেখে যায় — যার উপর দাড়িয়ে সমৃদ্ধ তর ফসল ফলতে সুরু করে মানব - জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ।
শরৎদা জিজ্ঞাসা করলেন - চাতুর্ব্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ ' - এর মানে কী । এটা কি গােড়া থেকেই আছে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — হ্যা । ভিতরে যেমন instinct ( সহজাত সংস্কার বা গুণ ) কৰ্ম্মও তদনুযায়ী হয় । দুনিয়ার দুটো জিনিস ঠিক অবিকল বা একরকম দেখতে পাবেন না , প্রত্যেকটি যা - কিছুর একটা বিশিষ্টতা আছে — তা যেমন রূপে তেমনি গুণে । একই বাপ - মায়ের পাচটি সন্তান পাঁচরকম হয় । কারণ , উপগতির সময় নারী পুরুষকে যখন যেমন প্রেরণা দেয় , পুরুষের ভিতরকার তেমনতর জিনিসই তখন বেরোয় । স্ব - অয়ন - সূত বৃত্ত্যভিধ্যান তপস্যায় গতি ও অস্তি অধিজাত হয়েছে । সেখানে স্ব হচ্ছে যেন পুরুষ , sperm ( বীজ ) , বৃত্তি যেন প্রকৃতি , ovum ( ডিম্বকোষ ) , আর অভিধান হলো cohesive affinity (যােগাবেগ ) । প্রকৃতির বিভিন্ন প্রেরণায় একই পুরুষের ভিতর থেকে বিভিন্ন গুণের সৃষ্টি হলাে । যত রকমের গুণই থাক না কেন , তার grand division (প্রধান বিভাগ ) ঐ চার বর্ণের মধ্যেই রয়েছে । শুধু মানুষের জন্যই নয় , জীব - জগতের সব স্তরেই চাতুৰ্বর্ণ রয়েছে , সৃষ্টির সঙ্গে - সঙ্গেই বর্ণ ঢুকে গেছে । প্রথম থেকেই তা ’ insti nct ( সহজাত সংস্কার ) হিসাবে থাকে , environment (পারিপার্শ্বিক ) -এর মধ্যে তা প্রকাশিত হয় , generation after generation (বংশপরম্পরায় ) সেই ধারা চলে ।
শরৎদা — বর্ণ যদি প্রধানতঃ গুণগত ব্যাপার , তাহ'লে hereditary varna (বংশানুক্রমিক বর্ণ ) মানবার প্রয়ােজন কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাহলে তাে বেশ বুঝেছেন দেখছি ! গুণটা আসছে কোথেকে?
সেও তাে ঐ জন্মসূত্র থেকে । আপনার জৈবী বিধানকে বাদ দিয়ে আপনার কোন গুণ বা কর্মক্ষমতা নেই । হাওয়ার উপর কিছু দাড়ায় না । গুণ ও কর্মক্ষমতা শরীর , স্নাযু় , কোষ chromosome ( ক্রমজম ) , gene ( জেনি ) ইত্যাদিকে আশ্রয় করেই অবস্থান করে । সেগুলি বংশানুক্রমিকতার সূত্র বেয়েই তাে নেমে আসে , যাকে বলে immortal necklace of germ - cells ( বীজ কোষের অবিনশ্বর মালা ) ।
শরৎদা — বর্ণধৰ্ম্ম ঠিকভাবে পালন করতে গেলে তো মানুষ বর্ণোচিত কৰ্ম্ম ছাড়া অন্য কাজ করতে পারবে না । কিন্তু কোন মানুষের অন্য বর্ণের কম্মে যদি বিশেষ প্রতিভা থাকে এবং তা যদি সে করতে না পারে , তাহলে তাে সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষ জীবিকার জন্য বর্ণোচিত কৰ্ম্ম ছাড়া করতে পারবে না এক অপদ্ধর্ম ছাড়া । তা ছাড়া , কোন কৰ্ম্মানুশীলনে মানুষের কোন বাধা নেই । বর্ণাতীত কর্মে যার বিশেষ প্রতিভা থাকে , বর্ণোচিত কর্মেও সে অপটু হয় না । সেই কৰ্ম দিয়ে জীবিকা আহরণ করে বাদবাকী সময় সে তার প্রতিভার স্ফুরণ এবং তদনুযায়ী লোকসেবায় ব্যয় করতে পারে । তার বিনিময়ে সে কিছু চাইবে না , কিন্তু তার সেবায় প্রীত হয়ে স্বতঃস্বেচ্ছ আগ্রহে প্ৰীতি - অবদান - স্বরূপ কেউ যদি তাকে কিছু দেয় , তা গ্রহণ করতে তার কোন বাধা নেই । কিংবা রাষ্ট্রের তরফ থেকেও যদি তাকে কোন পুরস্কার দেয় , তাও সে গ্রহণ করতে পারে । প্রত্যেকে যদি বর্ণোচিত কর্মনিরত থাকে , কেউ কারও বৃত্তিহরণ না করে , তাহলে বেকার - সমস্যা জিনিসটাই আসতে পারে না । অযথা প্রতিযােগিতা জিনিসটাও বন্ধ হয়ে যায় । পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় । বংশপরম্পরায় একই কৰ্ম্ম করার ফলে প্রত্যেকের দক্ষতা ও যোগ্যতাও বেড়ে যায় । প্রত্যেকে স্ব - স্ব কর্ম করায় সর্বতােমুখী সুষম উৎপাদন ও সেবা - পরিবেষণের একটা স্বাভাবিক ব্যবস্থা স্বতঃই গজিয়ে ওঠে । কোন বর্ণের বিশিষ্ট সেবার অভাবে , তারা এবং অন্যান্য বর্ণ অপুষ্ট থাকে না । সামাজিক শৃঙ্খলা অব্যাহত ভাবেই এগিয়ে চলে । তাই আমাদের বাপ , বড় বাপ , ঋষি , মহাপুরুষরা যে বিধান করে গেছেন , তা একটু তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করবেন । অদূরদর্শিতা ও হীনত্ববুদ্ধি থেকে দুনিয়ার অনেক আন্দোলনই হয়েছে , কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান কিছু হয়নি , সব ব্যাপার মানুষের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং বার বার বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছে । এর প্রতিকার আছে সুঙ্গত ব্যক্তিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানকে আশ্রয় করার মধ্যে । এই বিজ্ঞানের নামই বর্ণাশ্রম , এবং আমাদের ঋষি - মহাপুরুষরাই এই প্রাকৃতিক বেদবিজ্ঞানের দ্রষ্ঠা , আবিষ্কর্ত্তা প্রতিষ্ঠাতা ।
সাধনা - সম্পর্কে কথায় শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন
— অমরা অগ্নির উপাসনা , বরুণের উপাসনা , milky way ( ছায়াপথ ) -এর উপাসনা — যত উপাসনাই করি না কেন , তা আমাদের কাছে যত বিরাট বা সূক্ষ্ম হোক না কেন , একটা মজা দেখবেন , আমরা কিন্তু তা হতে চাই না , cause (কারণ ) আমরা জানতে চাইলেও causal plane- এ ( কারণভূমিতে ) আমরা রূপান্তরিত হতে চাই না । আমরা চাই with this body and consciousness ( এই শরীর এবং চেতনা নিয়ে ) সবটার উপর আধিপত্য করতে , সবটাকে উপভােগ করতে , ঈশত্ব লাভ করতে । তাই , আমাদের মতো মানুষ হয়েও যিনি তা পেরেছেন , তাকে আমরা খুজি ভগবান লাভের আকাঙ্খার মূলে রয়েছে এই । একটা দেহী - মানুষ না থাকলে , তার প্রতি টান না জন্মালে , এতে কোন রস থাকে না । তাকে যখন জীবনে মুখ্য ক'রে ধরি তখন তার প্রীতির জন্য , তার তৃপ্তির জন্য অসাধ্য সাধন করতে পারি আমরা , তাতে আমাদের কষ্টের বােধ থাকে না , আরাে - আরাের পথে অতন্দ্র প্রয়াসে এগিয়ে চলি । এই সাধনার ভিতর - দিয়ে নূতন - নূতন acquisition (অঞ্জন বা অধিগমন ) হয় , এমনি করেই হয় আমাদের evolution ( বিবৰ্ত্তন ) বা becoming ( বিবর্দ্ধন ) । আবার , ঐ বাঞ্ছিতই হলেন elixir of acquisition (অধিগমনের অমৃত ) । আধিপত্য আসলেও তা নিজে নিজে উপভােগ করা যায় না , তাকে উপভােগ করিয়ে উপভােগ করতে হয় , control ( আধিপত্য ) করতে চাই , সেও তারই জন্য , নচেৎ অহংকারে বদ্ধ হয়ে যাই , further acquisition (আরােতর অধিগমন ) -ও হয় না , উপভােগও থাকে না । এমনি করে ইষ্টহারা সাধনার মধ্যদিয়ে মানুষ একটা দানব , পাগল বা দুশমনও হয়ে উঠতে পারে । কারণ তখন সাধনার ভিতর - দিয়ে সে যদি কোন শক্তি লাভ করে , তা সে নিজেরই খুশি , খেয়াল বা প্রবৃত্তিমাফিকই ব্যবহার করবে । সাধনা মানে acquisitive effort ( অধিগমনী প্রয়াস ) , যে - কোন দিকেই মানুষ সাধনা করুক , যেমনতর বিদ্যা , শক্তি বা যােগ্যতা সে অহরণ করুক , তার পিছনে যদি ইষ্টানুরাগ না থাকে , তা'তে কিন্তু ঐ একই ফল দাড়াবে । তাই , জীবনের আদিতে , মধ্যে ও অন্তে — সর্বাবস্থায় যে জিনিসটি দরকার , তা ঐ ইষ্টপ্রাণতা ।
প্রশ্ন করা হলাে — ইষ্ট নাই অথচ সংযত , ব্যক্তিত্ববান , বুদ্ধিমান , পরোপকারী , কৃতী লােকও তাে অনেক দেখা যায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাদের দেখবে অন্ততঃ মা - বাবা বা শ্রেয় গুরুজনের প্রতি টান আছেই । অনেকের আবার জন্মগত সম্পদ ও প্রকৃতি ভাল থাকে , তাই ইষ্ট ধরা না থাকলেও তার দরুন চলনার মধ্যে অনেকখানি goodness ( সদগুণ ) থাকে । কিন্তু সেটা হচ্ছে machanical goodness ( যান্ত্রিক সদগুণ) যা কিনা সৰ্ব্বতঃসঙ্গতি নিয়ে কাউতে সার্থক হয়ে ওঠে না । ফলে দাড়ায় একটা sterile uneven goodness ( বন্ধ্যা , অসমঞ্জস , সদগুণ ) —যা ’ প্রেরণা - প্রদীপ্ত করে কোন জীবনকে উৎক্ৰমণশীল করে তুলতে পারে না । কারণ , শ্রেয়কেন্দ্রিক না হওয়ার দরুন তাদের meaningful adjustment ( সার্থক বিন্যাস ) হয় না , তাদের কোন করার সঙ্গে কোন করার সঙ্গতি থাকে না । আর , শ্রেয় মানেই শ্রেষ্ঠপুরুষ । কিন্তু দৈবী প্রকৃতিসম্পন্ন যারা , তারা উপযুক্ত ইষ্টকে গ্রহণ না করলেও স্বতঃই শ্রদ্ধা বান থাকে এবং ইষ্টের সন্ধান পেলে তাকে গ্রহণ করতে তাদের কোন অসুবিধা হয় না । আবার কিন্তু হীনবুদ্ধি , ঈর্ষা বা আক্রোশ থেকে মানুষ যদি খানিকটা কৃতিত্ব অর্জন করে , কিংবা প্রতিষ্ঠার লোভে পরােপকার বা মােলায়েম বাহ্যিক চাল নিয়ে চলে , তাদের দৈন্য অর্থাৎ ভিতরের অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্য প্রতিপদেই ধরা পড়তে থাকে , তাদের শেষ পর্যন্ত শেষরক্ষা হয় না , মাঝপথেই এলিয়ে পড়ে তারা । প্রকৃতি বড় কঠোর পরীক্ষক , দুনিয়ার বুকে দীর্ঘদিন কারও ফাকি দিয়ে চলবার জো নেই । আবার , হীনত্ববুদ্ধি যাদের বেশী , তারা সদগুরু পেলেও , তাকে গ্রহণ করতে পারে না । আত্মসমর্পণের কথায় তাদের সমস্ত সত্তাটা যেন থেতলে ওঠে ।
এরপর গণতান্ত্রিক বিধান - সম্বন্ধে কথা উঠলো । শ্রীশ্রীঠাকুর তাতে বললেন —আমাদের এই body- র ( শরীরের) দিকে চেয়ে দেখুন , প্রত্যেকটা organ ( শরীর - যন্ত্র ) প্রত্যেকটা organ- কে ( শরীর - যন্ত্রকে ) help করছে , কোন organ- এ ( শরীর - যন্ত্রে ) deficiency ( খাকতি ) হ'লেও , অন্য organ ( শরীর - যন্ত্র ) -গুলি লেগে যাচ্ছে তা ’ make up ( পরিপূরণ ) করতে , প্রত্যেকের থাকা অন্য সবগুলির উপর নির্ভর করছে , আর , brain ( মস্তিস্ক) -টা যেন whole ( সমগ্র ) , তাই তাকে বলে উত্তমাঙ্গ , সব organ ( শরীর - যন্ত্র ) -গুলি separately ( পৃথকভাবে ) ও jointly ( সমবেতভাবে ) constantly ( সৰ্ব্বক্ষণ ) brain ( মস্তিষ্ক ) -কে nourish ( পুষ্ট ) করতে চেষ্টা করছে , brain ( মস্তিষ্ক ) করছে গুরুর কাজ , brain ( মস্তিষ্ক ) দিচ্ছে impulse : ( প্রেরণা ) , সবাইকে guide ( পরিচালনা করছে । সত্যিকার সঙ্ঘ , সমাজ বা রাষ্ট্র গড়তে গেলেও এমনতর দরকার । এ - ছাড়া কোন system ( বিধান ) গড়ে ওঠে না , ধসে যায় । তাই বুঝন , ' vox populi vox dei ' ( জনগণের কথা ভগবানের কথা ) না ‘ vox expletori vox dei ' ( পূরক - পুরুষের কথাই ভগবানের কথা ) । Sufferings- এর ( দুঃখের ) ক্রন্দন একটা atmosphere ( আবহাওয়া ) সৃষ্টি করে , একটা good pair- এর ( সু - দম্পতির ) brain ( মস্তিষ্ক ) -কে সেই আকুলতা ঠেসে ধরে , সেখানে পরিত্রাতার soul ( আত্মা ) নেমে আসে , একটা zygote (জীবনকোষ) cord ( নাড়ী ) placenta ( ফুল ) -এর মধ্যে শুয়ে - শুয়ে বাড়ে , নারায়ণ যেন ক্ষীরোদ - সমুদ্রে শুয়ে আছেন , লক্ষ্মী তার পদসেবা অর্থাৎ চলনসেবা করছেন । পরে একদিন জন্ম হয় - জেগে ওঠেন তিনি মানুষের মধ্যে । জন্মের থেকেই তার বিরাটত্বের tinglings ( ঝঙ্কার ) টের পাওয়া যায় । সকলের দুঃখ , বেদনা বক্ষে ধারণ করে তারই নিরাকরণী প্রতিভা ও প্রচেষ্টা - প্রদীপ্ত হয়ে যিনি আসেন — এমনতর মানুষই মানুষজাতির প্রাণ ও মস্তিষ্কস্বরূপ — তা ব্যষ্টিগতভাবে ও সমষ্টিগতভাবে । তাই সঙ্ঘ সমাজ বা রাষ্ট্র যদি তাকে কেন্দ্র করে সংগঠিত করে তােল— প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যকে পােষণ দিয়ে , প্রত্যেককে প্রত্যেকের সহায়ক করে পারস্পরিকতায় ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত প্রচেষ্টার ভিতর - দিয়ে ঐ জীয়ন্ত কেন্দ্রকেই পরিপূরিত করে পরিপুষ্ট করে , তাহলেই মানুষের দুঃখ ঘুচে যায় । আর , ভেবে দেখ — এমনতর বিধান তােমরা চাও কিনা , প্রত্যেকটা মানুষই চায় কিনা । এই আমাদের শ্বাশ্বত অৰ্য - বিধান । একে যে - তন্ত্রই বল না কেন , তাতে কোন আপত্তি নেই , তবে দরকার এই জিনিসটা ।
অনির্বচনীয় অক্ষয় সুধাস্বাদে ভরা তার জীবন । তার সান্নিধ্যে এসে মানুষ যতটুকুই যা কুড়িয়ে নেয় সে অতি সামান্য , তবু এর মধ্যে একটা নেশা আছে নিজের হারান সত্তাটাকে কুড়িয়ে পাবার নেশা । সেই নেশায় মানুষ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে , জানার পর আরো জানে , করার উপর আবার করে , এমনি করে সে নিজেকে সত্যি করে উপলব্ধি করে চলে , “ পরম সত্য , শিব , সুন্দর জীবনের সঙ্গে প্ৰীতি - নিবদ্ধ হ'য়ে ।
প্রফুল্ল — আপনি কি গােড়া থেকেই বুঝতেন যে আপনি জগতের কল্যাণের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সে - সব কি জানি ! ছােট থেকেই মানুষকে ভালবাসতাম কারও দুঃখ দেখতে পারতাম না । কাউকে দুর্দশাগ্রস্ত দেখলে মনে হ'ত , আমি নিজেই ঐ অবস্থায় পড়ে গেছি , এবং তার একটা বিহিত না করা পর্যন্ত স্থির থাকতে পারতাম না । বিদ্যে বুদ্ধি , টাকাপয়সা , লোকবল — কোন সম্বলই আমার ছিল না , কিন্তু একমাত্র ভালবাসার সম্বলকে বুকে ক'রে আমি দুঃসাহসিকের মতো চলেছি — কোন কাজকেই অসম্ভব বলে মনে করিনি । মানুষের যাতে ভাল হয় , তা না করে আমার উপায় ছিল না । সেখানে পারব কিনা এমনতর প্রশ্ন বা সন্দেহের অবকাশ আমার কোনদিন ছিল না । আমারই সত্তার আত্মরক্ষার আকুতি যেন আমাকে হন্যে করে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সকলের আত্মরক্ষার জন্য । আমার এই অসহায় অবস্থা দেখে পরমপিতা বােধহয় দয়া করে সবকিছুর অন্তর্নিহিত সত্যবস্তুকে আমার চোখে - আঙ্গুল দিয়ে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন । তাই আমি লেখাপড়া না জানলেও — ব্যষ্টি ও সমষ্টিজীবনের সবদিককার সবরকম মঙ্গল কীভাবে হবে , সে - সম্বন্ধে আমার বুঝতে কিছু বাকী নেই — পরমপিতার , দয়ার দান হিসাবেই আমি এটা বুঝতে পেরেছি । আমি সাহিত্য , বিজ্ঞান , শাস্ত্র , তত্ত্ব , ইতিহাস কিছুই জানি না , কিন্তু যা ’ আমি নিজে চোখে দেখেছি , সেই দর্শনে — আমার বোধ যতটুকু ধরতে পারে তা'তে — কিছুই বাদ পড়েছে বলে মনে হয় না । আমি যা - কিছু বলি , ওর ভিত্তির উপর দাড়িয়েই বলি । তাই , আমার বলা - সম্বন্ধে আমার কোন সংশয় নেই । কিন্তু আমার সব চাইতে কষ্ট হয় , যখন দেখি , তোমরা আমার সব কথা শুনেও যেমনভাবে খাটা দরকার , তা খাট না , একটা তাত্ত্বিক আমেজ নিয়ে স্বচ্ছন্দে দিন কাটিয়ে দাও । এ - কথা ঠিক জেনাে , আমি নিস্ক্ৰিয় আলাপ - আলোচনা পছন্দ করি না । তোমাদের ফিঙ্গে হয়ে লাগার পর বাংলার ; ভারতের তথা সমগ্র জগতের অনেককিছু দুঃখ - কষ্টের সমাধান নির্ভর করছে । যা ’ বলছি , সেভাবে তীব্র বেগে এগিয়ে যদি না চল , সারাদেশে এটা যদি ছড়িয়ে না দাও তাড়াতাড়ি , মানুষগুলিকে ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগতভাবে যদি সুগঠিত ও সংগঠিত করে না তােল ; তবে অদূরভবিষ্যতে তোমরা এতবড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে ; যার ভয়াবহতা এই অবস্থায় তােমরা কল্পনাও করতে পার না । আমার কী কষ্ট তা তােমরা বুঝতে পার না , তাহলে এমন ক'রে যার - যার পিছ টান নিয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারতে না । আমি বলি ! তােমাদের পিছটানের প্রতিই যদি সুবিচার করতে চাও , তাহলেই ওগুলির প্রতি নির্মম হ'য়ে আমি যা ’ বলি তা - ই কর
‘ মযি় সৰ্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংন্যসাধ্যাত্মচেতসা ।
নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ॥’
কথাগুলি বলতে - বলতে আগ্রহ ও আবেগের আতিশয্যে শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখ - মুখ জ্বলজ্বল করতে লাগলাে , কণ্ঠস্বরের তড়িৎ - মূর্চ্ছনা সকলের অন্তরে এক তীব্র জ্বালা সৃষ্টি করে তুললাে — তিনি আপনমনে কিছু - সময় পদ্মাচরের দূর আকাশের দিকে উদাসদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন , কারও মুখে একটিও কথা নেই , একটা দিব্য গাম্ভীৰ্য্য থমথম করতে লাগলাে । হরিপদদা ( সাহা ) নিঃশব্দে তামাক সেজে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর হাতে নলটা ধরে মুখে দিয়ে টানতে লাগলেন । তিনি যে তামাক খাচ্ছেন তা যেন তিনি নিজেই ঠিক পাচ্ছেন না , দৃষ্টি তখনাে তার কোন সুদূরের কোন গভীরে , —দেশ - কাল - পাত্রকে অতিক্রম করে — অনন্তের মহাসায়রে । চুপচাপ ব'সে আছন — পূর্ব্বদক্ষিণাস্য হয়ে , এমন সময় জানালা দিয়ে একফালি রােদ এসে পড়লো বিছানায় ও গায়ে । শীতের সকালে ঐ রোদটুকুকে পরমাত্মীয়ের মতো মনে হতে লাগলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর নিজেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ব্যথিত কণ্ঠে বললেন — সব জেনে শুনেও যে প্রতিকার করতে পারছি না , এর চাইতে দুঃখ আর কী আছে ? ( তিনি যেন সৰ্বসাধারণের কী এক ভীষণ বিপদকে প্রত্যক্ষ করে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন ।
শরৎদা — আপনি দুঃখ করছেন কেন ? —আপনার ইচ্ছা হলে সবই হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি বিশ্বাস করি , আমি যেমন - যেমন ইচ্ছা করি ঠিক তেমনি তেমনিই হতে পারে , অবশ্য আপনারা যদি আমার ইচ্ছাটাকে আপনাদের ইচ্ছা করে নেন । আমার ইচ্ছামতাে কাজ করবেন , আর তার মধ্যে আপনাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাগুলি , স্বার্থ , প্রয়োজন , প্রবৃত্তি ও খেয়ালগুলি স্বতন্ত্রভাবে সাবল চালাতে থাকবে , তাতে কিন্তু হবে না । আপনাদের ভিতর যা - কিছু আছে তার প্রত্যেকটি আলাহিদাভাবে এবং সবগুলি সামগ্রিকভাবে আমার ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতিশীল হয়ে ওঠা চাই । তোমার রক্তের একটা কণা , শরীরের একটা cell ( কোষ ) বা ইচ্ছার একটা আঁশও যদি থাকে , যা আমার ইচ্ছার পরিপূরণে সক্রিয়ভাবে আগ্রহশীল হয়ে ওঠেনি , তাই - ই একদিন মস্ত বড় বাধার সৃষ্টি করে তুলতে পারে । এই বাধার অপসারণ হয়ে গেছে যার মধ্যে , তার অসাধ্য কাণ্ড নেই । এমনতর যে , সে নিরহঙ্কার হয়ে যন্ত্রস্বরূপ কাজ করে যেতে পারে , পরমপিতা তাকে নিত্য শক্তির যোগান দেন । সে ভাবে না — ‘ আমি পারব কিনা , সে জানে যে তার না করলেই নয় , তাই করেই চলে এবং পারেও । আবার , তার ঐ আকুলতা বহুলোককে ভিড়িয়ে তােলে । সে নিজে যা পারে না , অন্যের সাহায্যে তা করে । ••••••••• তাই , আপনার মাঝখানে ফাক বা ফাঁকি নিয়ে চলবেন না , তাহলে নিজেরাও ঠকবেন , আমাকেও ঠকাবেন । আপনাদের ঠকাটাই আমার ঠকা , তা ছাড়া আমার নিজের ঠকা - জেতা বলে আর কিছু নেই । এবার আপনারা সবভাবে জিতে ওঠেন দেখতে চাই , আপনারা আমার সঙ্গে সহযােগিতা করে সেই সুযােগটুকু আমায় দিন — এই আমার ভিক্ষা আপনাদের কাছে ।
তার চোখমুখ , চাউনি , কথাবার্তা — সবটার ভিতর - দিয়ে যেন করুণা ক্ষরিত হচ্ছে । হঠাৎ ফিরে বসলেন , তিনি ফিরে ব'সে প্রত্যেকের সর্বাঙ্গে স্নেহদৃষ্টি বুলিয়ে দিতে লাগলেন । মুহূর্তে শান্তি — গভীর শান্তিতে অগাধ হয়ে উঠলো সকলে । —এ এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত — ‘অবাঙ্ মনসগােচরম ’ -- ‘ বোঝে প্রাণ বোঝে যার ।
Alochona prosonge part 1
আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথম খণ্ড
ষষ্ঠ সংস্করণ
https://amritokathaa.blogspot.com/
10