🔳 চাণক্যের মাতৃভক্তি-৫৯
🔳 ইন্দ্রিয়শক্তি বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা-৫৭
🔳 শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৫৪
🔳 ইষ্টের আদেশ অমান্য করলে তিনি দুঃখ পান কেন-৫৬
🔳 ডাক্তারের কর্ত্তব্য-৫৬
🔳 সেবায় ফাঁকিবুদ্ধি থাকলে-৫৬
🔳 ইষ্টের দায়িত্ব-উদ্যাপনে নিজের লাভ-৫৮
🔳 ভক্তি-৫৮
🔳 কর্মীদের অপারগতার কারণ-বিশ্লেষণ-৫৯
🔳 ক্যাসাবিয়াঙ্কার পিতৃভক্তি-৫৯
[P 54-59]
২২ শে পৌষ , মঙ্গলবার , ১৩৪৮ ( ইং ৬ /১/৪২ )
শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আনন্দের হাট বসেছে । দুপুরে ঘুম থেকে ওঠার পর তিনি মাতৃ - মন্দিরের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় এসে বসেছেন । তক্তপােষের চারিদিকে ঘিরে বসেছেন । আনন্দময়ের সান্নিধ্যে সকলেই আনন্দিত , আর ভক্তগণের উপস্থিতিতে শ্রীশ্রীঠাকুরও মহাপ্রীত । নিজের থেকেই বলছেন - আপনারা সব আছেন এখানে , বেশ আছি , যখন মনে হয় আপনাদের অনেকের যাবার সময় হলাে , তখন বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে ওঠে । এও বুঝি , কাজের জন্য আপনাদের তাে বাইরে যাওয়া লাগবেই , কিন্তু কেন জানি মন মানে না । এ আমার কেমন স্বভাব বলেন তাে ?
সকলেই চুপ ক'রে শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখের দিকে চেয়ে আছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আবার বলছেন — আমি নিজেকে যেন কারও থেকে আলাদা করে ভাবতে পারি না । মনে হয় , আমি যেমন আমার মধ্যে আছি , তেমনি সবার মধ্যে আছি , সবই যেন আমি , সবই যেন আমার , এই যে বন্ধন তা থেকে মুক্তি পেতেও মন চায় না । শুধু , ভাবি , সকলকে কেমন করে সুস্থ রাখা যায় , সুখী করা যায় , উন্নতিপরায়ণ ক'রে তােলা যায় । এই স্বার্থের ধান্ধায় দিনরাত উদ্ব্যস্ত হয়ে চলি । পরকালের কথাও যে একটু ভাবব তারও আমার অবকাশ নেই ।
কুমারখালির - মা — সব কালের মালিক যিনি , তাঁর আর পরকালের ভাবনা ভাবতে হবে কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন — ইহকালের ভাবনা ঠিকমতাে ভাবলে পরকালের ভাবনা কারও ভাবা লাগে না । যতটুকু কাল আমরা হাতে পাই , ততটুকু যদি তাঁর সেবায় লাগাতে পারি , তাহ'লেই তাে কাম ফর্সা । তাঁর সেবা কিন্তু পারিপার্শ্বিককে বাদ দিয়ে নয় । প্রত্যেকের বাঁচা - বাড়ার সাহায্য যতটা করতে পারবে — নিজে ইষ্টনিষ্ঠ থেকে ও তাকে ইষ্টনিষ্ঠ ক'রে — ততই জানবে তাঁর সেবা করা হলাে । সেই সেবায় তিনি তুষ্ট হন । নচেৎ তাঁর পটে ফল - বিল্বপত্র যতই দেও না কেন , কিংবা পুণ্যলােভে বা আত্মপ্রতিষ্ঠার লােভে ইষ্টের গাডু় গামছা যতই বও না কেন , তাতে কিন্তু তাঁর সন্তোষ উৎপাদন হবে না । আমি দেখেছি , আমাকে সেবা করবার জন্য অনেক সময় কাড়াকাড়ি প'ড়ে যায় । একজনকে বললাম পিকদানীটা ধরতে , সে আসার আগে আর তিনজন হয়তাে এগিয়ে আসল । সেটা আমার পছন্দসই কিনা , তাও তারা ভেবে দেখে না । আবার , তাদের কাউকে যখন সত্যিই প্রয়ােজন তখন হয়তাে তাদের টিকিটিও দেখা যাবে না । তারা তখন নিজের ধান্ধায় ব্যস্ত । ফলকথা , আমার সেবা যে তারা করতে চায় , তা নয় । এক - একজন এক - এক খেয়াল নিয়ে অবসর - বিনােদন করে। ও তাদের একটা খেয়াল বিশেষ । আমার সুখ - সুবিধা লক্ষ্য নয় । লক্ষ্য , নিজেদের খেয়াল চরিতার্থ করা । জান যে তােমরা সকলের খোঁজ - খবর নিলে , সেবা - যত্ন করলে আমি খুশি হই , কিন্তু আমার কাছে এসে হয়তাে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাক , অথচ পাশের বাড়ীর একটা রােগীর খবর নেবার অবকাশ হয় না তােমাদের । এ - সবগুলি আমি লক্ষ্য ক'রে দেখি , কিছুই আমার চোখ এড়ায় না । আবার অনেকে আছে , সেবার অছিলায় প্রবত্তির ঘোরে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায় , কিন্তু আমার এদিক দিয়ে মাড়ায় না । এক - এক জনের এক - এক ব্যাধি । মােটপর , বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখি -- আমি যা চাই বা কই , সেটা ছাড়া আর সব পারে , আর সেটা করলেও তার মধ্যে নিজের প্রবত্তি ও খেয়ালের এমন কতকগুলি খাদ মিশিয়ে রাখে যে , তার মধ্যদিয়ে চরিত্রের গলদ বাড়ে বই কমে না , ফলে দক্ষতা ও কৃতকাৰ্য্যতার মুখ তারা দেখতে পায় না । পরে আবার দোষ দেয় — ঠাকুরের কথামতাে তাে এই ক'রে দেখলাম , তাতে তাে এই হলাে । আমি ভাবি–ঠাকুরের দোষ না হয় দিলি , কিন্তু তাতে তাের কী হ'লাে ? তাই মানুষের ভিতরে ফাঁকি - বুদ্ধি থাকলে , তাদের সঙ্গে পারা মুশকিল । তবে কর্মঠ স্বভাব যাদের , করার পথে তাদের স্বেচ্ছা ও অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি যাই হােক না কেন , তাদের সংশােধনের সম্ভাবনা বেশী থাকে , অবশ্য যদি ঐ সঙ্গে নাম , ধ্যান ও আত্মবিশ্লেষণের অভ্যাসটা বজায় থাকে । যারা অলস , নিজেরা কিছু করে না , অথচ যারা করে , ক্রমাগত তাদের বিরুদ্ধে সমালােচনা করে বেড়ায় , তাদের জঞ্জাল ক্রমে - ক্রমে ভারী হ'তে থাকে । তাদের নিজেদের দোষ যা , তা ’ আবার গুণিত হয় দোষদর্শনের ভিতর দিয়ে । তারা কর্মক্ষেত্রে নামলে অন্ততঃ টের পায়, তাদের মধ্যে গলদ কতখানি । তাই গীতায় আছে — সহজং কৰ্ম্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ , সর্ব্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ।” ( হে কুন্তীপুত্র ! দোষযুক্ত হ'লেও সহজাত কৰ্ম্ম ত্যাগ করা উচিত নয় । কারণ , অগ্নি যেমন ধূমে আচ্ছন্ন হয় , তেমনি সকল কর্মই দোষযুক্ত হয় । )
আশু ( ভট্টাচাৰ্য্য ) —আমাদের প্রকৃতি দেখে আপনার রাগ হয় না ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - রাগ ক'রে যাব কোথায় ? ছাওয়ালের বাবা তাে হােসনি , তাহ'লি কিছুটা বুঝতিস । তবে দুঃখ হয় , আপসােস হয় । আমার কথা শোনে না ব'লে যে দুঃখ হয় , তা নয় , আমার কথা না শুনে দুঃখ পাবে বলে দুঃখ হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্যারীদাকে বললেন- আমার নাড়ীটা দেখ তাে !
প্যারীদা ঘড়ি ধ'রে দেখে বললেন- Pulse rate ( নাড়ীর গতি ) একটু বেড়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কত ?
প্যারীদা -- আপনার normal ( স্বাভাবিক ) যা ' , তা ' থেকে ৫|৭ বেশী ।
শ্রীশ্রীঠাকুর- এইটুকু বাড়লো কেন ?
প্যারীদা ও কিছু না । মাঝে মাঝে এইরকম variation ( পার্থক্য ) হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এটা ডাক্তারের কথা হলাে না । ডাক্তার প্রত্যেকটার কারণ খুজে বের করতে চেষ্টা করবে , তবেই সে ভাল করে চিকিৎসা করতে পারবে । আন্দাজে ঢিল মারা অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার ।
প্যারীদা আপনার কাছে যদিও এই কথা বলছি কিন্তু আমি সবটারই কারণ অনুসন্ধান করে থাকি এবং সেইভাবে ওযুধ দিই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাহ'লিই ভাল । আমি তোমাকে যত কথা কইছি , সব যদি মনে রেখে কাজে লাগাও , তাহ'লি দেখবা , রােগী আরাম করা কত সহজ হবে । ............ এ সম্বন্ধে যখন যা ' কই , টুকে রেখাে ও মাঝে - মাঝে সেগুলি প'ড়ো । দাসীর কথা বাসি হ’লি কামে লাগে ( হাস্য ) । উপস্থিত অনেকেই হেসে ফেললেন ।
একটা গন্ধ পেয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর নাক টেনে অশুর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন— বলতাে কিসের গন্ধ ?
আশুভাই উঠে খোঁজ করতে যাচ্ছিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — উঠতি পারবি না । এই জায়গায় বসে ক ' ।
আশুভাই নাক টানতে লাগলেন , কিন্তু সঠিক ঠাওর করতে না পেরে বললেন - বুঝতে পারছি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আরাে কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন ।
কেউ - কেউ বললেন কোন গন্ধই তাে পাচ্ছি না ।
কেউ যখন পারলেন না , শ্রীশ্রীঠাকুর তখন বললেন — পায়রার গু - র গন্ধ ব'লে মনে হচ্ছে । ছাদের উপর যেয়ে দেখ , তো পায়রার গু জমেছে নাকি ।
তখন কয়েকজনে একসঙ্গে উপরে যেয়ে দেখে এসে বললেন - ওখানে পায়রার গু কিছু জমেছে বটে , কিন্তু একেবারে কাছাকাছি যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাে গন্ধ পাইনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - চোখ , কান , নাক , ত্বক , জিহা সবগুলিরই অনুভব - শক্তি বাড়িয়ে তুলতে হয় । তখন দরদর্শন , দরশ্রবণ , দুর থেকে ঘ্রাণ পাওয়া ইত্যাদি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে । এর মধ্যে অলৌকিকত্বের কোন বালাই নেই । ইন্দ্রিয়ের বােধশক্তিই বেড়ে যায় । তাকেই মানুষে কয় অতীন্দ্রিয় । নামধ্যান বেশী ক'রে করলে , আর প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের সক্ষম বােধশক্তি বাড়াতে চেষ্টা করলে এগুলি সহজেই হয় । দৃষ্টি প্রসারিত করে দূরের একটা জিনিস ভাল করে দেখতে হয়তাে চেষ্টা করলে । দেখে যা ' মনে হলাে আবার কাছে গিয়ে হয়তাে মিলিয়ে দেখলে । আবার হয়তাে আরাে দুরের একটা জিনিস দেখলে , সেটা ঐভাবে মিলিয়ে দেখলে । শ্রবণ , ঘ্রাণ ইত্যাদি সম্বন্ধেও ঐভাবে চেষ্টা করতে থাকলে । দেখা , শােনা , শোকা একসঙ্গে কত দুরের কতখানি পার , তারও অনুশীলন করতে হয় । এইভাবে অনুশীলন করতে - করতে দেখবে একেবারে তুখােড় হ'য়ে উঠবে । আমার মনে হয় , চোখ বুজে শুধু , গায়ের চামড়া স্পর্শ করে সহজেই বলা যায় , লােকটা কে । প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয়ের বােধশক্তি যা'তে বাড়ে , সেই ধরণের নানাপ্রকার খেলাধুলাে বের করতে হয় , আর তাই ছেলেপেলেদের মধ্যে চারিয়ে দিতে হয় । বােধ হওয়া চাই সূক্ষ হ'তে সূক্ষ্মতর , ক্ষিপ্র হ'তে ক্ষিপ্রতর , সমগ্রহতে হ'তে সমগ্রতর , আবার বােধ - অনুপাতিক ঐ বিশেষ স্থলে বিহিত করণীয় যা ' , সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত ও বাস্তব - করণও হওয়া চাই ত্বরিত ও সম্যক । এইসব নিজেরা করতে হয় , মানুষকে দিয়ে করাতে হয় । মানুষকে কঠিন অবস্থার ধ্যে ফেলে দিতে হয় । সেই অবস্থায় সে কী করে , কেমন করে , তা ' দেখতেহয় । নিজের প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের শক্তিকে প্রসারিত করার অভ্যাস যার থাকে , তার অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাব্যতাকে বিকশিত করে তােলার একটা ঝোঁকও হয় , উদ্ভাবনী বুদ্ধিও তার বেড়ে যায় । কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে কিভাবে কী করতে হবে , তাও তার মাথায় খেলে যায় । আমি ইচ্ছা করেই সেইজন্য এক - এক জনের উপর এক - একটা চাপিয়ে দিই । কাউকে হয়তাে একটা কিছু , জোগাড় করতে বললাম , সেই জিনিসটার দরকার আমার যতটা থাক বা না থাক , তা জোগাড় করতে গিয়ে যে - সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে হবে তাকে , তার মধ্য দিয়ে তার অনেকখানি বাস্তব শিক্ষা হবে , সেইটেই আমার লাভ । আমি বলি বা না বলি , ক্রমাগত যে আমার জন্য স্বতঃস্বেচ্ছভাবে , স্ফূর্ত্তির বিলাস হিসাবে কঠিন হতে কঠিনতর দায়িত্ব গ্রহণ ক'রে উদযাপন করে , সে বেড়েই ওঠে । দুনিয়ায় সেই বুদ্ধিমান যে ইষ্টার্থপূরণী ব্রত হিসাবে নিজের উপর সর্ব্বদা কঠোর চাপ চাপিয়ে রাখে , এর ফলে হয় কি , হাউস ক'রেই সে এত ভার বইতে অভ্যস্ত হয়ে থাকে যে , অতি বিরাট প্রয়োজনের ভারও তার কাছে ভার ব'লে মালুম হয় না । অক্লান্ত পরিশ্রমের উপর থেকেও তার মনে হয় যেন মহা আরামে আছে । মহাপ্রলয়েও টিকে থাকবার মতাে শক্তি অর্জ্জন করে তারা । তাদের আশ্রয়ে আবার কতাে মানুষ বেচে যায় । ধর্ম্ম মানে যদি হয় বাঁচা - বাড়া , তবে ধর্ম্মানুশীলনের ব্যাপারে এ - সবের প্রয়ােজন আছে ।
বেলা তখন আন্দাজ চারটে । আশ্রমের উপর দিয়ে গ্রামের লােক কেউ - কেউ কাশীপুরের হাটে যাচ্ছে । ঝাঁকায় ক'রে লাউ , বেগুন , মূলাে , লঙ্কা ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছে বিক্রী করতে । ঝাঁকার এক পাশে , আছে দড়িবাধা তেলের শিশি । আনাজপত্র বিক্রী করে তেল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আসবে । মাঠের মধ্যে এখনও বেশ রােদ আছে , তবে রােদের তেজ কমে আসছে । গাছের ছায়া দীর্ঘায়িত হ'য়ে পূব দিকে হেলে পড়েছে । মাঝে - মাঝে একটা দমকা হাওয়া এসে বেণুবন দুলিয়ে দিয়ে একটা গভীর সন - সন শব্দের সৃষ্টি করছে । অশথের শাখায় - শাখায় কাপন লেগে ঝর - ঝর ক'রে ঝ'রে পড়ছে জীর্ণ পত্রদল । আশ্রমের সামনের বনঝাউ গাছগুলিতে ব'সে কয়েকটি পাখী ডাকছে , তাদের সুরে বেলা শেষের তান । কেমন যেন উদাস , করুণ আবহাওয়া চারিদিকে । তায় আবার শীতের দিন । মন ঘরে ফিরে যেতে চায় , যেতে চায় প্রিয়জনের কাছে , যেতে চায় সেখানে যেখানে আছে তার চিরন্তন স্নেহের আশ্রয় । সকলে তাই শ্রীশ্রীঠাকুরকে ঘিরে আরাে নিবিড় হ'য়ে বসে । ক্লান্ত অপরাছে প্রিয়তমের মধুর সান্নিধ্য মধুরতর মনে হয় ভক্তজনের কাছে । এখান থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না কারও । কেবল দুটি নয়ন ভ'রে সাধ মিটিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে তাকে , আর শুনতে ইচ্ছা করে তার সর্ব্বদুঃখহরা অমৃত - স্নিগ্ধ বাণী ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আবার শুরু করেন -- ভক্তির মতাে জিনিস আর হ'তে নেই। শক্তি বল , জ্ঞান বল — সব আসে ও থেকে । শ্রেয়কে আশ্রয় করে যে আন্তরিক টান তাকেই বলে ভক্তি । সন্তানের পিতৃভক্তি , মাতৃভক্তি , স্ত্রীর স্বামীভক্তি , শিষ্যের গুরুভক্তি — এর কোনটাই ফেলনা জিনিস নয় । ভক্তির কোঠায় যে একবার পা দিয়েছে , সেই ত'রে যাওয়ার পথে উঠেছে । রামচন্দ্র স্বয়ং ভগবান । তিনি তাঁর সারাটা জীবন দিয়ে দেখালেন — পিতৃভক্তি কাকে বলে । ক্যাসাবিয়াঙ্কার পিতৃভক্তির কথা আজও মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে । কেউ - কেউ হয়তাে ভাববে , ঐভাবে আত্মবিসর্জন দেওয়া তার বােকামী । কিন্তু যে অক্ষরে - অক্ষরে পিতৃ - আদেশ পালনের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে মরতে পারে , নিজের প্রাণটাকে পৰ্য্যন্ত । তুচ্ছ করতে পারে , তার ভিতরে কতখানি নিষ্ঠার জোর তা একবার ভেবে দেখতে হবে তাে । ঐখানেই তার মহত্ত্ব । অতখানি একাগ্র নিষ্ঠায় মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে । তারপর যারাই বড় হয় , তাদের মধ্যেই দেখা যায় মাতৃভক্তি । চাণক্যের কথা শুনেছি , এক জ্যোতিষী এসে নাকি তার সম্বন্ধে তার মাকে বলেছিল যে , তার ছেলে রাজা হবে , কারণ , তার সামনের দাঁত দুটো উচু ও বড় । ওটা যেমন সুলক্ষণ তেমনি আবার দুলক্ষণও , কারণ , আমনতর দাঁত থাকলে , সে - ছেলে মায়ের দুঃখের কারণ হয় , সে মাতৃভক্ত হতে পারে না । এইকথা শুনে বালক মূহর্ত্তে মনস্থির করে ফেলল , ভাবল - দাঁত দুটো থাকলে যদি রাজা হ'তে হয় , আর রাজা হ'লে যদি মাকে ভুলতে হয় , মায়ের কষ্টের কারণ হতে হয় , মাতৃভত্তি থেকে চ্যুত হ'তে হয় , তবে কাজ নেই সে রাজত্ব দিয়ে ও রাজলক্ষণবাহী দাঁত দিয়ে । এই ভেবে মা বাধা দিতে না দিতেই চোখের নিমেষে একটা নাড়া দিয়ে নিজের কাঁচা দাঁত দুটো ভেঙ্গে ফেলল - দর - দর ক'রে রক্ত পড়তে লাগল । মা তো হতভম্ব । এ হেন ছেলে , যে মায়ের খুশির জন্য হাসিমুখে যে - কোন কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে পারে , ভাগ্যলক্ষী সুপ্রসন্ন হ'য়ে তারই গলায় পরিয়ে দেন জয় , যশ , প্রভুত্ব ও ঐশ্বর্য্যের মালা । বাঞ্ছিতের সুখকামনায় আত্মসুখ কামনাকে বর্জন করতে পারে যে , প্রকৃতিই সেই শূন্যতাকে ভ'রে দেন পূর্ণতায় ।
10