শ্রী শ্রী ঠাকুরের কথা শুনে শুনে যিনি আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন সেই প্রফুল্লকুমার দাস
মহাপুরুষের জীবৎকালে তাঁর আদর্শ জীবনধারার দৃষ্টান্ত এবং সান্নিধ্য, উপদেশ ও নির্দেশ সমসাময়িক জনমণ্ডলীকে উদ্বুদ্ধ এবং যথাযথভাবে পরিচালিত করে। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে যখন তাঁর প্রত্যক্ষ সঙ্গলাভের সুযোগের অবসান ঘটে, তখন মানুষের জন্য থেকে যায় তৎকথিত বাণীর অনির্বাণ দীপমালা, যার আলোকে পথ দেখে চলা যায়। পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সর্বতো জীবনমুখী বাস্তবানুগ আধ্যাত্মিক দর্শন নিহিত রয়েছে তৎকথিত বিপুল সংখ্যক গ্রন্থরাজির মধ্যে, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পথপ্রদর্শকরূপে। তাঁর বাণীসমূহকে সংকলন ও গ্রন্থন করে যাঁরা সকলের জন্য পরিবেশনের উপযোগী করে তুলেছেন তাঁরা নিঃসন্দেহে মানবজাতির মহামিত্র, পরম সৌভাগ্যবান এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ কৃপাধন্য। এই বিরল সৌভাগ্য ও বিশিষ্ট দক্ষতার অধিকারীদের অন্যতম প্রধান প্রফুল্লকুমার দাস, সৎসঙ্গ জগতে যিনি ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’-র সংকলকরূপে চিরবরেণ্য হয়ে থাকবেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথিত গ্রন্থগুলিকে প্রাথমিকভাবে দু-ভাগে বিভক্ত করা চলে-এক, ওঁৎ-প্রদত্ত বাণীচয়ন; দুই, প্রশ্নোত্তর বা কথোপকথনমূলক। ঠাকুর বিভিন্ন বিষয়ে বাণী বা ছড়ার মাধ্যমে তাঁর যে-সমস্ত বক্তব্য সরাসরি উপস্থাপিত করেছেন, সেগুলির সংকলনকে বাণীগ্রন্থ বলা চলে। অপরপক্ষে বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য জিজ্ঞাসু ও জীবন-পিপাসু মানুষ তাঁর কাছে এসে তাদের নিজ নিজ প্রশ্ন ও সমস্যার সমাধান পেয়েছে, ঠাকুরের সঙ্গে তাদের আলাপ আলোচনার তাৎক্ষণিক অনুলিখনের সম্পাদিত প্রকাশনগুলি দ্বিতীয় প্রকারভুক্ত। এই দ্বিতীয় প্রকারের গ্রন্থসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত, উপযোগী, প্রাঞ্জল ও মনোগ্রাহী গ্রন্থটির উল্লেখ করতে গেলে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করা যায় ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’ শীর্ষক গ্রন্থটির নাম, এ পর্যন্ত যার বাইশ খণ্ড অবধি প্রকাশিত হয়েছে, আরও বেশ কিছু খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। এই মহাগ্রন্থের সংকলক বেদ- পরিবেশক প্রফুল্লকুমার দাস। তবে শুধুমাত্র ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’-ই নয়, ঠাকুরের অধিকাংশ বাণীর অনুলিখন বা গ্রন্থনের গুরু দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি আদৃত হবেন শ্রীশ্রীঠাকুরের অধিকাংশ বাণী ও আলোচনা- সমূহের সংগ্রাহক বা অনুলেখকরূপে। বিশ্বচেতনায় ঠাকুরের বাণীসমগ্র যত বেশি দ্যুতিত হবে, সেই দ্যোতনায় প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকবেন নিষ্ঠায় চির অতন্দ্র তাপসশ্রেষ্ঠ প্রফুল্লকুমার দাস।
খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার অন্তর্গত গোটাপাড়া গ্রামে ১৯১৩ সালের ৩রা এপ্রিল এক ধর্মপ্রাণ বংশে প্রসন্নকুমার দাস ও মানদাসুন্দরী দেবীর পুত্র প্রফুল্ল জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্পবয়স থেকেই ধর্মানুশীলনের অভ্যাস ছিল তাঁর এবং এ বিষয়ে প্রেরণার উৎস ছিলেন মা মানদা দেবী। বরাবর প্রথম স্থানাধিকারী কৃতী ছাত্ররূপে শিক্ষকদের বিশেষ স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। ১৯৩০ বঙ্গাব্দে আইন-অমান্য আন্দেলনে যোগদান করেন এবং বাগেরহাট সাবডিভিশনে কংগ্রেসের কার্য পারিচালনার দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়। এরই সঙ্গে সঙ্গে চলে তীব্র অধ্যাত্ম-অনুসন্ধান। শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ-শিষ্য মণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তের পুত্র অধ্যাপক গৌরগোবিন্দ গুপ্ত এবং শ্রীশচন্দ্র সান্যালের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন তিনি এবং ১৯৩০ সালেই রামকৃষ্ণ মিশনের দ্বিতীয় মঠাধ্যক্ষ স্বামী শিবানন্দ (মহাপুরুষ মহারাজ)-র কাছে বেলুড় মঠে দীক্ষাগ্রহণ করেন।
১৯৩১ সালে প্রফুল্ল পাবনা হিমাইতপুর আশ্রমে প্রথম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র- দর্শনে আসেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি এবং উপভোগ করার আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে বারবার নিয়ে আসে সৎসঙ্গ আশ্রমে এবং ভাবিত করে তোলে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সম্বন্ধে। তাঁর নিজের ভাষায়: “... আমার মন সর্বদা কাঁদত তাঁকে (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে) রক্তমাংসসংকুল নরদেহে পাবার জন্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই জীবনেই আমি তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে পাব। বুকভরা আশা নিয়ে ব্যাকুল হয়ে নিত্যই আমি কাঁদতাম ও নাম করতাম। সেই ব্যাকুলতা ও কান্নাই আমাকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের রাতুল চরণপ্রান্তে উপনীত করে। ১৯৩১ খৃষ্টাব্দের জুন মাস থেকে ১৯৩৮ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে সাত বৎসর ধরে আমার মনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে নানা প্রশ্ন ও দ্বন্দ্বের প্রবল ঘূর্ণিব্যাত্যা। জীবনজিজ্ঞাসা ও ঈশ্বরপিপাসা যে মানুষকে যুগপৎ কী বিষামৃত আস্বাদনের অনির্বচনীয় দুরন্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে টেনে নিয়ে চলে, তা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। সৌভাগ্যবশতঃ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সান্নিধ্যে এসে তাঁর মধ্যে আমি পূর্বতন প্রত্যেক মহাপুরুষকে, বিশেষত শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণদেবকে অনুভব ও উপভোগ করতে পেরেছি, তাই অনন্ত কোটি বর্ষব্যাপী সুপ্রলম্বিত বিবর্তনের কঠোর মধুর বিচিত্র বর্ণাঢ্য লীলার নিগূঢ় সূত্র ও তাৎপর্যটুকু উপলব্ধি করবার সুযোগ আমার ঘটেছে।”
শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণপ্রান্তে তাঁর উপনীত হওয়ার হৃদয়গ্রাহী কাহিনীটি অতি আকর্ষণীয় শৈলীতে তিনি উপস্থাপিত করেছেন “স্মৃতি-তীর্থে” গ্রন্থের ‘পূর্বতনের নবকলেবর’ শীর্ষক আখ্যানে। আখ্যানটি সংক্ষেপে বিবৃত করা হল।
ভগবান রামকৃষ্ণদেবকে প্রত্যক্ষভাবে পাওয়ার আকুলতা এবং বাস্তব জগৎ ও জীবনকে ধর্মের ভিত্তিতে সর্বাঙ্গীণভাবে গড়ে তোলার সমস্যা প্রফুল্লকুমারকে উদ্বেল করে তুলত। এমন সময় সৎসঙ্গের কিছু কিছু গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে-বিশেষত ‘নানাপ্রসঙ্গে’-র প্রথম খণ্ড পাঠে তাঁর মনে হয়েছিল যে একটা সূত্রের উপর দাঁড়িয়ে বাস্তব জীবনের নানা সমস্যা সমাধানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বইটিতে আছে, এবং কথাগুলি যিনি বলেছেন, তিনি উপলব্ধিবান পুরুষ। এর পরে যোগেন্দ্রনাথ হালদার ও শরৎচন্দ্র হালদারের কাছ থেকে অন্যান্য বই এনে পড়তে পড়তে তিনি ক্রমশই আরও বেশি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। ‘ভাববাণী’ (পুণ্যপুঁথি গ্রন্থ) পড়ে তাঁর মনে হয়েছিল ঈশ্বর ঠাকুরের মুখে স্বরূপ ব্যক্ত করেছেন।
১৯৩১ সালে শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শন করে যাওয়ার পরে প্রফুল্ল প্রায়শ স্বপ্ন দেখতেন শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের মূর্তি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মূর্তিতে উদ্ভিন্ন হয়ে উঠছে। এই স্বপ্ন দর্শনে তাঁর মনে দ্বন্দ্ব এবং বেদনার সৃষ্টি হত-মনে হত, তাঁর প্রিয়তম থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন।
১৯৩৫-এ আবার পাবনা আশ্রমে গিয়ে ঠাকুরকে দেখে তাঁর অত্যন্ত আপনজন বলে মনে হয়, ভাল লাগে সৎসঙ্গীদের খোলামেলা চলন। মনে হয়-সবার সঙ্গেই ঠাকুরের গভীরতম প্রাণের যোগ, সুখে, দুঃখে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তিনি যেন সবার সঙ্গে এক হয়ে আছেন, সহজ মানুষটি, অথচ সবার ঊর্ধ্বে, সবের ঊর্ধ্বে তিনি। মানুষকে সুকেন্দ্রিক করে তোলা, কর্মঠ ও যোগ্য করে তোলা, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুখী করে তোলা, এই যেন তাঁর নেশা ও পেশা, কোন ক্লান্তি নেই এতে তাঁর। মায়ের প্রতি তাঁর আকুল টান, শিশুর মত সরলতা, সর্বগুণের সমন্বয়, নিরাসক্ত চলন, এ-সবই প্রফুল্লর মনকে অশেষভাবে মুগ্ধ করে তোলে। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে উঠে ভাবতেন-এত ভাললাগা ভাল না, তিনি যে শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে নিবেদিত।
একদিন নিভৃতে ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে তিনি ঠাকুরকে বলেন- রামকৃষ্ণদেবকে আমার খুব ভাল লাগে, তিনি কি আবার কোথাও এসেছেন? এবং এলেও, সে কোথায়?
ঠাকুর উত্তরে বলেন, খোঁজ, খোঁজ, খুঁজতি থাক, খুঁজতি খুঁজতি মিলে যাবিনি, কোথার থেকে ডুব মেরে কোথায় এসে ওঠেন, তার কি ঠিক আছে?
-তিনি এসেছেন কি না, এবং যদি এসে থাকেন কোথায় এসেছেন-যদি জানেন সোজা কথায় বলুন।
-আমি তো সোজাই কই, তুই বুঝবি ব্যাঁকা, তা আমি ঠেকাব কী করে?
-দৈনন্দিন জীবনে বহু বাস্তব সমস্যা ও প্রশ্নের উদয় হয়, তার সমাধান পাব কী করে?
-‘চলার সাথী’ বইখানা বগলে করে রাখবি, আর যখন কোন সমস্যার উদয় হয়, বলবি, ‘ঠাকুর আমাকে বলে দাও’, এই বলে বইখানা খুলবি, দেখবি ওর মধ্যেই সমাধান পেয়ে যাবি।
এই কথা শুনে ঠাকুরের ভক্ত মণীন্দ্রনাথ সেন একখানি ‘চলার সাথী’ গ্রন্থ প্রফুল্লকে উপহার দেন। ঐ বই নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। ঠাকুরের কথামত বইখানি কাছে রাখতেন এবং বিশেষ কোন সমস্যা-পীড়িত হয়ে বইটি খুললেই দেখতে পেতেন, বিশিষ্ট যে সমস্যাটির সমাধান খুঁজছেন, তারই সমাধান সেই পাতায় লেখা আছে। বারবার এরকম হওয়ায় ঠাকুরের প্রতি তাঁর মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। প্রায়ই তখন তিনি ঠাকুরের স্বপ্ন দেখতেন।
কিছুদিন পর আবার ঠাকুরের কাছে আসেন প্রফুল্ল। একদিন সকালে ঠাকুরের কাছে বসে থাকাকালীন তাঁর মনে হয়-শ্রীশ্রীঠাকুর নিজ মুখেই যদি তাঁর স্বরূপ ব্যক্ত করেন, তা হলে নিঃসংশয় হওয়া যায়। এমন সময় ঠাকুর-জননী মাতা মনোমোহিনী দেবী সেখানে উপস্থিত হলেন। ঠাকুর হাসতে হাসতে মাকে বললেন- ‘মা, ভৃগুতে কয়, আমি নাকি আর জন্মে রামকৃষ্ণ ছিলাম; তা মা! এত সাধনভজন করলাম, এ-জন্মে আমার একখানা ঘরও তো হল না!’ মা উদাসীনভাবে বললেন, ‘তোমার ভালোটা তো ফলতে দেখলাম না, খারাপটাই ফলে।’ প্রফুল্ল অত্যন্ত চমৎকৃত হয়ে ভাবলেন-ঠাকুর নিজমুখেই তো বলছেন, তিনি গত জন্মে রামকৃষ্ণদেব ছিলেন। পরক্ষণেই মনে হল-অনেক সাধক এভাবে মনের ভাব বুঝে কথা বলতে পারেন, ওসব কিছু নয়। কিন্তু তবু তাঁর মনের চঞ্চলতা গেল না। শ্রীশ্রীঠাকুর কিন্তু তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সম্বন্ধে আরও অনুপ্রাণিত করে তুললেন এবং ফলত ঠাকুরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা গভীরতর হতে লাগল। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল-ইনিই ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব। ঐ চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে রামকৃষ্ণদেবের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চিন্তায় তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত-ভাবতেন-ঠাকুরের কাছে আর এগোবেন না। কিন্তু কী এক অমোঘ আকর্ষণে আবার তাঁর কাছে গিয়ে উপস্থিত হতেন। এই মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংকটের কথা অবশেষে সংক্ষেপে সংযতভাবে ঠাকুরের কাছেই খুলে বললেন প্রফুল্ল। ঠাকুর বললেন-‘তা কেন? তুই তোর ঠাকুর নিয়ে থাকবি। তাঁর স্বার্থ-প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবি, আর খুব যাজন করবি। এই ভাবে চলতে থাক-তুই তোরটা ছাড়বি কেন? তবে একান্তই যদি কোথাও কাতকুত হয়ে পড়িস সে অন্য কথা।’ ঠাকুরের এই কথায় প্রফুল্লর মন শান্ত হল।
এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণ-শতবার্ষিকীর আয়োজন চলছে। প্রফুল্ল সুডেন্টস্ রামকৃষ্ণ সেন্টেনারির অন্যতম সংগঠক হিসাবে এম. এ. ক্লাসের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রদের মধ্যে বিশেষভাবে যাজন করে ছাত্রসমাজকে মাতিয়ে তুললেন। তবে ‘চলার সাথী’ বইটি সবসময়ই তাঁর কাছে থাকতো, এবং প্রতিনিয়তই ঠাকুরের কথা মনে পড়ে প্রেরণা লাভ করতেন।
১৯৩৯ সালে শ্রীশ্রীঠাকুর কলকাতায় এসে বেশ কিছুদিন সুকিয়া স্ট্রীটে ছিলেন। তখন প্রফুল্ল মাঝে মাঝে ঠাকুরের কাছে যেতেন। একদিন কথা বলতে বলতে ঠাকুর আদর করে তাঁর চিবুক স্পর্শ করাতে তাঁর সারা শরীরে আনন্দের তড়িৎ খেলে যায়। এরপর তাঁর মন অত্যন্ত অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। ধ্যান হয়ে ওঠে সহজসাধ্য, অভূতপূর্ব আনন্দে এবং স্থৈর্যে, প্রশান্তিতে মন যেন ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ করত। পরিপার্শ্বস্থ সবকিছুকে, সমস্ত মানুষকে অতি সুন্দর ও প্রিয় বলে বোধ হত। তিনি বুঝলেন-এ আনন্দানুভূতি ঠাকুরেরই দান।
১৯৩৭ সালে তাঁর এম. এ. পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। কিন্তু শরীর ভাল না থাকায় পরীক্ষা না দিয়ে তিনি লালমণিহাটে তাঁর কাকা নেপালচন্দ্র দাসের কাছে চলে যান। সেখানে সাপ্তাহিক ‘সৎসঙ্গী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘নানাপ্রসঙ্গে’, ‘কথাপ্রসঙ্গে’ ইত্যাদি গভীর অভিনিবেশে পাঠ করেন প্রফুল্ল; বাইবেল, গীতা, শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণী প্রভৃতি তুলনামূলকভাবে পড়েন তিনি। এক বছর এভাবে গভীর অধ্যয়ন, নামধ্যান ও চিন্তার ফলে তাঁর কাছে অকাট্যভাবে প্রতিভাত হল যে পূর্ববর্তী অবতার মহাপুরুষদের বাণীর সঙ্গে ঠাকুরের ভাবধারার কোন বিরোধ তো নেই-ই, বরং আছে যুগোপযোগী পরিপূরণ এবং সর্বাঙ্গীণভাবে সেগুলিকে বাস্তবায়িত করার সুস্পষ্ট, সুসম্পূর্ণ কার্যক্রম।
১৯৩৮-এর জুলাই মাসে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পরীক্ষায় বসেন প্রফুল্ল। শেষ দিনের পরীক্ষায় ‘বর্তমান ভারতের পরস্পর বিরোধী আদর্শনিচয়’-এই বিষয়ের উপর রচনা লিখতে বসে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে-এরকম বহুবিধ আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গীর শেষে প্রকৃত সমাধান কোথায়? লেখা থামিয়ে দু’চার মিনিট নাম করার পর ঠাকুরের সর্বসঙ্গতিসম্পন্ন জীবনবাদের মূল তত্ত্বটি তাঁর চোখের সামনে যেন মূর্তি নিয়ে ধরা দিল এবং তিনি সেই তত্ত্ব সুন্দরভাবে পরিবেশন করলেন। ছাত্রজীবনের শেষ পরীক্ষা দিয়ে তিনি যখন হল থেকে বেরোচ্ছেন জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে পদক্ষেপ করার জন্য, তখন তাঁর চোখের সামনে একটি মাত্র মুখ জ্বলজ্বল করে ভাসছিল-সে মুখ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের। তাঁর অন্তর্লোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল একটি সত্য- পৃথিবীকে পরিপূর্ণ সত্তা ফিরে পেতে হলে ঐ অকিঞ্চন ব্রাহ্মণ সন্তানের পায়ের তলায় বসেই পেতে হবে।
কৃতিত্বের সঙ্গে এম. এ. পাশ করেন প্রফুল্ল। ইতিমধ্যে স্বপ্নে ও ধ্যনে শ্রীশ্রীঠাকুরের মূর্তিদর্শন তাঁর জীবনে যেন নিত্যকার স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে তাঁর মনে আর দ্বন্দ্ব হয় না-যেন একরকমের সমর্পণ করেই বসে আছেন নিজেকে-মনে হয়, দুই-ই এক, এক-ই দুই। বর্তমানের পদতলে প্রত্যক্ষের বেদীমূলে আত্মসমর্পণে তাঁর আর আপত্তি নেই, আবার উগ্র ব্যাকুলতাও তেমন অনুভব করেন না।
কিন্তু পাগল করে তোলাই যাঁর কাজ, তিনি কি সহজে নিস্তার দেবেন? সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের বাড়িতে শুয়ে আছেন প্রফুল্ল, বুকে যেন কার স্পর্শ টের পেলেন, তাঁর বুকে মুখ লুকিয়ে শুয়ে কে? জীবন্ত স্পর্শ-চেনা মানুষ। কিন্তু পাবনার মানুষটি এখানে এলেন কী করে? এ তাহলে স্বপ্ন। রাতের সুখস্বপ্নের শেষে সকালে তাঁকে দেখবার জন্য মন ব্যথায় টনটন করে। রাস্তায় বেরিয়ে কলেজ স্ট্রীট ধরে হাঁটছেন-পাশে হেঁটে চলেছেন কে? পাশ ফিরে চেয়ে আর দেখা যায় না তাঁকে। মনের ভ্রম! আবার চলতে শুরু করেন-আবারও মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন তিনি, ফিরে চেয়ে আর দেখতে পাওয়া যায় না। দু’দিন, তিনদিন-রাত্রিদিন একই ভাবে কাটে। স্থির করলেন প্রফুল্ল-এবার পাবনায় গিয়ে সব বলতে হবে তাঁকে। পাথেয়র অসুবিধা ছিল- অযাচিতভাবে বন্ধু সুপ্রকাশ চ্যাটার্জির কাছ থেকে পেয়ে গেলেন টাকা।
রাত্রে পৌঁছলেন পাবনা। সে-রাত্রে আর ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হল না। পরদিন সকালে তাঁর কাছে যেতেই দূর থেকে দেখেই সোল্লাসে বলে উঠলেন,-কি রে কখন আলি? প্রফুল্ল গত রাত্রে এসেছেন জানিয়ে প্রণাম করে দাঁড়ানোর পর ঠাকুর বললেন -এম. এ. পাশ করিছিস শুনলাম, এখন করবি কী? প্রফুল্ল বলেন-আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ ব্যক্তিগত কথা আছে। কলের পাশে খড়ের ঘরের বারান্দায় মোড়ায় বসে ছিলেন ঠাকুর; প্রফুল্লর কথা শুনে সেখান থেকে উঠে গিয়ে মাতৃমন্দিরের উত্তরে বকুল গাছতলায় দাঁড়িয়ে স্মিতমুখে বলেন-কী বলবি বল। আবেগাপ্লুত প্রফুল্ল ধরা গলায় বলেন-সর্বক্ষণ আমার মনে হয়, আপনিই আমার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব। আমি জানি আপনি আমাকে mislead (বিপথে পরিচালিত) করবেন না। আপনি সত্যি করে বলুন-এ বোধ আমার ঠিক কিনা, না, আমি ভুল পথে চলেছি। শ্রীশ্রীঠাকুর মুখে কোন জবাব দিলেন না-প্রসন্ন মুখে একটুখানি হেসে স্নেহবিহ্বল দৃষ্টিতে অপাঙ্গে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ যেন বলে দিতে লাগলো-তোর বোধ ঠিক, তোর বোধ ঠিক, আর দেরি করিস না। প্রফুল্লের মনে মুহূর্তেই এক নিশ্চয়াত্মক প্রত্যয় জন্ম নিল যে ইনিই তাঁর ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব। ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন,- আমি তো দীক্ষা নিয়েছি ওখানে, আমার কি আর দীক্ষার প্রয়োজন আছে?
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-নেওয়া ভাল। নিত্য নামধ্যানের সময় আগেরটা আগে করিস-পরে এটা করিস।
১৯৩৮ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভাট্টাচার্য্যের মাধ্যমে সৎনামে দীক্ষা গ্রহণ করেন প্রফুল্ল। দীক্ষা নিয়ে আশ্রম থেকে ফেরার আগেই ঠিক হল যে তিনি কিছুদিন পরেই আশ্রমে চলে আসবেন। ১৯৩৯ সালের ৭ই মে স্থায়িভাবে আশ্রমে চলে এলেন তিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে প্রত্যক্ষ প্রাপ্তির আকুল আকাঙ্ক্ষা তাঁর পূর্ণ হল। তাঁর নিজের ভাষায় উদ্ধৃতিটি এখানে প্রাসঙ্গিক-“একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর মোড়ার উপর বসেছিলেন -অল্প সময়ের জন্য আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম, শ্রীরামকৃষ্ণদেব সামনে বসে আছেন- অবিকল সেই চেহারা। এ আমার ব্যক্তিগত অনুভব, আমি এর উপর কোন জোর দিতে চাই না, তবে আমার জীবনে এর মূল্য আছে, আর আমার বিশ্বাস এই যে পূর্বতন যে- কোন অবতার মহাপুরুষকেই তাঁতে প্রত্যক্ষ করা যায় ভাবতঃ, তত্ত্বতঃ, স্থূলতঃ। তাঁর স্বচ্ছ, সহজ, সরল দৈনন্দিন জীবনচলনার প্রতিটি ছন্দ মনের কাছে নিয়ে আসে ঈশৈকলক্ষ্য অপরূপ আনন্দলোকের আভাস এবং প্রতিনিয়তই তা মানুষের কাছে প্রকট করে তোলে ভাগবত জীবনের রসধন লীলামাধুর্য-যা কিনা মানুষ যুগে যুগে উপভোগ করেছে সচ্চিদানন্দঘন নরবিগ্রহের নিকট-সান্নিধ্যে।... তিনি স্নেহময়, প্রেমময়, জ্ঞানময়, আনন্দময়। আবার এমন শক্তিমান পুরুষ তিনি, যে যে-ই তাঁর প্রতি উন্মুখ হয়, সে-ই তাঁর দয়ায় এক নবীন আনন্দচেতনায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে।
১৯৩৯ সালের জুন মাসে তখন প্রাজাপত্য করছি ও নানাপ্রসঙ্গে চার ভাগের বিষয় সূচী, অধ্যায় সূচী ইত্যাদি তৈরী করছি-তখন একদিন সকালে শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা পড়তে পড়তে ও ভাবতে ভাবতে এমন একটা বিশ্বপ্লাবী আনন্দ ও সার্থকতার অনুভূতি জেগেছিল যে, তখন মনে হয়েছিল যে, শুধু সেইটুকু আনন্দের মূল্যস্বরূপ যদি কোটি কোটি জীবন দুঃখ ভোগ করা লাগে তাও সে দুঃখ দুঃখই নয়। তাঁকে নিয়ে চললে তাঁর দয়ায় মাঝে মাঝেই এমনতর আনন্দের আস্বাদন লাভ করা যায়, তাই দুঃখ, কষ্ট, বিপদ, আপদ, দোষ, দুর্বলতা, সব সত্ত্বেও জীবনটা পরম উপভোগ্য মনে হয়।...”
১৯৩৯ সালের মে মাসে আশ্রমে চলে আসার পর আশ্রম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন প্রফুল্লকুমার দাস। ১৯৪০ সালের ১লা জানুয়ারী প্রতিঋত্বিকের পূত পাঞ্জা পান। তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা, মননশীলতা এবং জ্ঞানসন্ধিৎসার জন্য ঠাকুর তাঁকে ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্নের একান্ত সচিবের কার্যভার ন্যস্ত করেন এবং ঋত্বিগাচার্য্যও স্নেহ, শাসন ও যথোপযুক্ত তত্ত্বাবধানে তাঁর দক্ষতা ও নৈপুণ্য আরও বৃদ্ধি করে ইষ্টকার্যে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীকালে ঠাকুরের কথোপকথন ও বাণী অনুলিখনের কাজে প্রফুল্লর সহায়ক হিসাবে দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রেবতীমোহন বিশ্বাস, নিখিল ঘোষ, মণিলাল চক্রবর্ত্তী, আতপেন্দ্র রায়চৌধুরী, সুনীল করণ প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
১৯৪২-১৯৪৪, এই তিন বছর অবিভক্ত বাংলার গ্রামগঞ্জ শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঠাকুরের ভাবাদর্শ প্রচার ও প্রসারের জন্য ট্যুরিং ব্যাচের নেতৃত্ব দেন প্রফুল্লকুমার। ১৯৪৬ সালে মনোমোহিনী ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এণ্ড টেকনোলজির অধ্যক্ষ পদে বৃত হন। দেওঘরে আসার পর ১৯৫৪ থেকে ১৯৭০ সৎসঙ্গের মুখপত্র ‘আলোচনা’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ঠাকুরের নির্দেশে কিছুকাল তপোবন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। কিন্তু এই শ্রুতিধর তাঁর মুখ্য যে কীর্তির জন্য সৎসঙ্গ তথা বিশ্বে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তা হল শ্রীশ্রীঠাকুর- সমীপে আগত অবিরাম জনস্রোতের সঙ্গে ঠাকুরের দৈনন্দিন অথচ অমূল্য কথোপকথন, আলাপ-আলোচনার তাৎক্ষণিক অনুলিখন, এবং পরবর্তী সুসম্পাদনা।
প্রফুল্লকুমার দাস যে-সময়ে আশ্রমে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন, সে-সময়টিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণী-প্রকাশের যুগ বলা চলে। অনন্ত ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া তাঁর অমূল্য বাণীনিচয় সেসময় উৎসারিত হয়ে চলেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে; ঋত্বিগাচার্য্যের উপযুক্ত সহকারীরূপে প্রফুল্ল সেই অমিয় সম্পদ আহরণে ও সুগ্রথনে তৎপর হলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের নিত্যসঙ্গী যিনি, ঠাকুরের অমিয় সঙ্গ ও করুণায় আকীর্ণ তাঁর জীবনের অঙ্গন। সেই অলোক-সুধার কয়েকটি কণিকা বর্ণিত হল।
দয়ালের লীলামধুর সান্নিধ্যের প্রতিটি মুহূর্তই তাঁর ভক্তের জীবনের পরম সম্পদ, প্রতিক্ষণেই যেন তাঁর এক একটি অভিনব পরিচয় ফুটে ওঠে। এই নিত্য মাধুর্যের সীমা নেই, ভক্তের অস্তিত্বকে ভরিয়ে তোলে তা অনাস্বাদিত আনন্দের রসে। ১৯৪০-এর জুন মাসে ঠাকুর কলকাতা থেকে আশ্রমে প্রত্যাবর্তন করছিলেন আমনুরা প্যাসেঞ্জারে।
একটি থার্ড ক্লাস কামরায় সদলবলে ফিরছেন তিনি, দলের মধ্যে প্রফুল্লও আছেন। ঠাকুরের সামনাসামনি উল্টোদিকের বেঞ্চে বসেছিলেন প্রফুল্ল। রাত একটার পর ঠাকুর তামাক খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রফুল্ল তামাক সেজে তাঁর হাতে নল ধরিয়ে দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ঠাকুর তামাক খাওয়া শেষ করে তাঁর হাঁটুতে ডান হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে নলটি ধরতে ইঙ্গিত করেন। ঠাকুর হাঁটু স্পর্শ করায় প্রফুল্ল চমকে উঠে নল ধরতে গিয়ে ঘুমের ঘোরে কলকে ধরে ফেলেন এবং গরম কলকে হাতে রাখতে না পারায় হাত থেকে পড়ে গিয়ে জ্বলন্ত টিকেগুলি ছড়িয়ে পড়ে। পাছে ঠাকুরের কাপড়ে আগুন ধরে যায় এই ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অপরাধীর মত তিনি পোড়া টিকেগুলি গোছাতে লাগলেন। দেখলেন কলকে নীচে পড়ায় ঠাকুরের গায়ে লাগেনি। তবু তিনি কিছুটা বিপর্যস্ত ও বেদনাহত হয়ে করুণমুখে নীরবে দয়লের ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন। এর পরের মধুর বর্ণনা তাঁর ভাষাতেই করা শ্রেয়: “আনন্দ-উত্তাল ভঙ্গীতে স্নেহকরুণ নয়নে দয়ালের তখন সে কী দমকে দমকে হাসি, সমস্ত দেহ তাঁর হাসির হিল্লোলে থরে থরে দুলছে, বিমূঢ় ভাব যে আমার পক্ষে কত অশোভন তা যেন তাঁর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গীতে ফুটে উঠছে। এই রকম একটা মজাদার ব্যাপার ঘটায় জীবনের একঘেয়েমি ঘুচে গিয়ে যেন একটা অভিনব আনন্দের খোরাক জুটেছে বৈচিত্র্যহীন ট্রেন যাত্রায় এবং ঠাকুর যেন তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন এবং আমাকেও যেন তা উপভোগ করতে আহ্বান জানাচ্ছেন। এটা যেন কোন ভুল নয়, যেন একটা মজার খেলা, যা না ঘটলে এই অভিনব আনন্দটা মাঠে মারা যেত, ভ্রমণটা স্মরণীয় হত না। ঠাকুরের নীরব অভিব্যক্তি ও অভিনয়ে আমার কাছে তাঁর ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি তখন খুশি হয়ে উঠলাম। এই ঘটনার পর সে রাতের মত আমার চোখের ঘুম চলে গেল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাই-ই যেন চাইছিলেন, কত মোহন ভঙ্গিমায় শ্রীশ্রীঠাকুর যে সে-রাত্রে আমার চোখে চোখ রেখে হেসেছিলেন তা আজও মনে পড়ে। বাকি রাত ছিলাম আমি তাঁর রাত্রি জাগরণের সাথী। তিনি যে কতভাবে এই প্রাণে প্রবেশ করেন তার রোম্যান্টিক কাহিনীর কি কোন শেষ আছে? গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মত ছড়িয়ে পড়ে”।
অবিরাম আত্মসংশোধনে উৎসুক প্রফুল্ল একবার কাতরভাবে ঠাকুরকে বলেন- চেষ্টা সত্ত্বেও কতকগুলি দোষত্রুটি এড়াতে পারছি না। এমন অবস্থায় তাহলে কি পরজীবনে আপনার সান্নিধ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ব? আজ এত অহেতুক করুণা উপভোগ করছি, পরজীবনে কি শ্রীচরণতলে ঠাঁই পাব না?
ঠাকুর জিজ্ঞাসা করেন-কলকাতার গঙ্গা দেখেছিস?
-আজ্ঞে হ্যাঁ!
-তার উপর কী থাকে?
-অনেক ময়লামাটি, আবর্জনা, মড়া, ফুল, বেলপাতা, ভালমন্দ কত কী!
-কিন্তু সাগরমুখী স্রোতটা গঙ্গার যদি ঠিক থাকে, তবে সব কিছু নিয়েই ঐ গঙ্গা সাগরে পৌঁছে যায়। তোমার যদি ইষ্টমুখী গতিটা ঠিক থাকে, তবে সব কিছু নিয়েই ইষ্টের কাছে পৌঁছে যাবে। ভাবনার কিছু নেই। ভালমন্দ নিয়েই তাঁর দিকে এগিয়ে চল। অবশ্য মন্দকে প্রশ্রয় দিও না। ইষ্টে টান বাড়াও। তাঁকে নিয়ে মেতে থাক।
এমন করেই পরম ত্রাতা শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর ভক্তের আকুল প্রাণকে অভয়বাণীতে আশ্বস্ত করেন।
ঠাকুর তাঁর একান্ত অনুরক্ত ভক্তদের মাঝে মাঝে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন। এও তাঁর রহস্যমধুর লীলার অঙ্গ। একসময় তিনি চেয়েছিলেন যে প্রফুল্ল সর্বদা তাঁর কাছে থাকেন। কিন্তু সঙ্ঘের কর্তাব্যক্তিদের তখন ইচ্ছা ছিল সংগঠনকর্মের জন্য সারা ভারতে তাঁকে ঘুরতে পাঠাবেন। তাঁরা ঠাকুরের কাছে সেই প্রস্তাব করায় তিনি বললেন-সে তো খুব ভাল। পাঠাবেন।
পরে প্রফুল্লকে বললেন- তোকে বাইরে পাঠাতে চাইছে এরা। আমি মত দেব। তুই কিন্তু যাবি না। আমি তোর নিন্দা করব, ওরাও তোকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা করবে। সকলেই তোকে ভুল বুঝবে। তা সত্ত্বেও কিন্তু তুই আমার কাছে থেকে বাণী ও কথোপকথন লিখবি, চিঠিপত্রের উত্তর দিবি। আমার ফাইফরমাস খাটবি। এইসব পরীক্ষায় যদি উত্তীর্ণ হতে পারিস, তোরও লাভ, আমারও লাভ।...
ঠাকুর আরও বলেন-... তাঁকে পেতে গেলে সব ছাড়তে হয়। সুতোর এতটুকু ফেঁসো থাকলে সূচের মধ্যে ঢুকতে পারে না। তোকে আমি যতি করিনি। কিন্তু তুই খাঁটি যতি হোস, আমি তাই চাই। সাজা যতি নয়, বাস্তবে যতি। কিছু যতি না হলে আমার কাজ হবে না। আমি তোমার মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই।... আমার কথাগুলি মনে রেখো। এবং আমার কথাগুলি পৃথিবীর লোকে যাতে জানতে পারে, সময়মত তার ব্যবস্থা করে যেও।...
শরীর অসুস্থ বলে প্রফুল্ল তাঁর নিজের কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করেন। উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন-শরীর রুগ্ন হলেও তোমার মাথাটা সাফ আছে। তাই তোমাকে দিয়ে দেওঘরে এসে অবধি এতগুলি বইয়ের ভূমিকা লিখিয়েছি। ভূমিকার focussing ঠিক না থাকলে ঐ রন্ধ্র দিয়ে পরে অনেক গলদ ঢুকে যায়। তাই সেবার তুমি রোগশয্যায় কলকাতায় থাকা সত্ত্বেও লোক দিয়ে ছড়ার ফর্মা তোমার কাছে পাঠিয়েছিলাম ভূমিকা লিখিয়ে আনার জন্য। আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল, পরমপিতার কাজে তোমাকে ব্যাপৃত করে তোমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলার। আমি এক ঢিলে অনেক পাখি মারি। ছলে-বলে-কৌশলে তোমাদের ভাল করাটাই আমার লক্ষ্য। আমার স্বার্থই যে তোমরা।
জগৎস্বার্থী জগৎপিতার স্বার্থ এবং স্বার্থ পূরণের যন্ত্র-দুই রূপেই জন্ম সার্থক হয়েছে পূর্ণসমর্পিত প্রাণ প্রফুল্লর।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রথম থেকেই তাঁর কর্মসাধক প্রফুল্লকে ঘষে-মেজে তৈরি করেছেন। প্রফুল্ল আশ্রমে চলে আসার অল্পদিন পরেই ঠাকুর তাঁকে ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য সংকলিত প্রশ্নোত্তর-মূলক সারবান গ্রন্থ ‘নানাপ্রসঙ্গে’ চার খণ্ডের বিষয়সূচী ও অধ্যায়সূচী প্রণয়নের নির্দেশ দেন। তিনিও ঠাকুরের নির্দেশানুযায়ী কাজটি করে ঠাকুরকে দেখিয়ে ঠিক করে নেন। এর পরে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রফুল্লকে বলেন ঐটি একবার আশ্রমিক সুপণ্ডিত পঞ্চানন সরকারকে দেখিয়ে নিতে, এবং তাঁকে যে ইতিমধ্যেই দেখানো হয়েছে সে-কথা জানাতে বারণ করেন। প্রফুল্ল নির্দেশানুযায়ী পঞ্চানন সরকারকে দেখানোর পরে তিনি আবার কিছুটা পরিবর্তনের নির্দেশ দেন। ঠাকুরকে প্রফুল্ল সে-কথা জানালে ঠাকুর ঐ পরিবর্তিত রূপেই আর একবার কাজটি করার কথা বলেন। প্রফুল্ল তা-ই করেন। এর পরে ঠাকুর নির্দেশ দিলেন আগের প্রস্তুত সূচী এবং পঞ্চানন-নির্দেশিত পরিবর্তিত সূচী-দুটিই সঙ্গে নিয়ে পঞ্চানন-সহ প্রফুল্লকে তাঁর কাছে আসতে এবং পরিবর্তিত সূচীটি আগে তাঁর সামনে পড়ে শোনাতে। তদনুযায়ী প্রফুল্ল পঞ্চানন-সহ ঠাকুর সমীপে গিয়ে পঞ্চানন-নির্দেশিত সূচীটি ঠাকুরকে পড়ে শোনালেন। শুনে ঠাকুর খুব প্রশংসা করলেন। এরপরে প্রফুল্লকৃত আগের সূচীটি পড়ে শোনাতে বললেন। সেটিও পড়া হল। পড়ার পরে শ্রীশ্রীঠাকুর পঞ্চানন- নির্দেশিত সূচীটির অজস্র প্রশংসা করে শেষে বলেন-ওটার সঙ্গে এর তুলনা হয় না। তবে আমার মত গোলা লোকের পক্ষে এটা (অর্থাৎ প্রফুল্ল-কৃত সূচী) বুঝতেই সুবিধে।
একথা শুনে পঞ্চানন প্রসন্ন চিত্তে আগের সূচীটিই প্রেসে দিতে বললেন। পরে প্রফুল্ল ঠাকুরের কাছে অকারণে দ্বিতীয় সূচীটি প্রস্তুত করার সময় ও শ্রম নষ্টের কারণ জানতে চাইলে ঠাকুর জানান যে এভাবে পঞ্চাননকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিলে তাঁর মধ্যে একটু ভুল-বোঝার ভাব দেখা দিত এবং তাতে তাঁর ক্ষতি হত। এরপরে কোমল গম্ভীর স্বরে ঠাকুর বলেন-পরস্পর পরস্পরকে নিয়ে চলতে শেখা লাগে। মানুষ গড়ে তোলাই আমার মুখ্য কাজ। তোমার যদি সহ্য-ধৈর্য-অধ্যবসায় না বাড়ে, সব রকম মানুষকে নিয়ে চলতে না শেখ তাহলে আমার কাজ ঠিকভাবে করতে পারবে না।
মানুষের প্রবৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে তাকে একটা গোটা মানুষ করে তোলাই আমার স্বার্থ। তোমরা কতকগুলি মানুষ যদি ইষ্টকে ভালবেসে বৃত্তি-প্রবৃত্তির উপর আধিপত্য লাভ করতে পার, অখণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পার এবং তোমাদের মধ্যে যদি সহযোগিতা ও সংহতি থাকে, তোমরাই পারবে সারা ভারতের ও সারা জগতের সব সমস্যার সমাধান করতে।... ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠা ছাড়া যাদের অন্য কোন ধান্দা থাকবে না, তারাই পারবে পরমপিতার বিশ্বমঙ্গল যজ্ঞের হোতা হতে।... তুমি একলা যদি পুরোপুরি আমার হতে পার, তাহলে দেখতে পাবে, কী অঘটন ঘটে যাবে দুনিয়ায়।
শ্রীশ্রীঠাকুরের নিরবচ্ছিন্ন সংশোধনী দৃষ্টিস্নাত প্রফুল্ল একটু একটু করে নিজেকে বিবর্তিত করার অসীম সৌভাগ্যে কৃতার্থ হয়েছেন। একদিন সন্ধ্যায় ঠাকুর ছড়া দিচ্ছেন, প্রফুল্ল প্যাডের কাগজে লিখে নিচ্ছেন। একটি কাগজের তিন/চার লাইন লেখা হতে না হতেই প্রফুল্ল কাগজটি ছিঁড়ে রাখার উদ্যোগ করছিলেন। তা দেখে ঠাকুর জানতে চাইলেন যে কেন প্রফুল্ল ওরকম করছেন। প্রফুল্ল উত্তরে জানালেন, যাতে অসুবিধা না হয় তাই আগে থাকতেই তিনি ছিঁড়ে রাখছেন। ঠাকুর বলেন যে অত আগে থেকে কাগজ ছিঁড়ে রাখার প্রবণতার মধ্য দিয়ে প্রফুল্লর সমগ্র জীবন ও চরিত্র বোঝা যায়, বোঝা যায় যে ভবিষ্যতের জন্য সর্বদাই প্রফুল্লর মনে একটা উদ্বেগ ও দুর্ভাবনা লেগে থাকে, যা ক্ষতিকর। প্রফুল্ল স্বীকার করেন যে কথাটি অত্যন্ত সত্য এবং এজন্য তিনি খুব কষ্ট পান। ঠাকুর পরম আশ্বাসে বলেন-সমস্ত মনপ্রাণ পরমপিতার চিন্তায় ও সেবায় এমনভাবে ডুবিয়ে রাখতে হয়, যাতে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ মনে ঠাঁই না পায়। করণীয় করে যেতে হয় আর পরমপিতার উপর বিশ্বাস ও নির্ভরতা নিয়ে চলতে হয়। আত্মমসর্পণ ছাড়া মনে প্রশান্তি, স্থৈর্য ও সাম্যভাব আসে না। শিশু যেমন মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে আনন্দে থাকে, ইষ্টসর্বস্ব হয়ে ঐভাবে কর্মঠ চলনে চলতে হয়। এতে ভক্তি, মুক্তি, যোগ, সবই সিদ্ধ হয়। এই দেহেই অমরার অমৃত উপভোগ করা যায় এন্তার।
শ্রীশ্রীঠাকুরের এই প্রত্যয়পূর্ণ কথায় প্রফুল্ল দৃষ্টি এক নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল এবং ভবিষ্যতের জন্য দুর্ভাবনার অভ্যাস ক্রমে তিনি পরিহারে সক্ষম হলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের সুগভীর দরদ সর্বদাই প্রফুল্লকে বেষ্টন করে থাকত। ১৯৪০-এর প্রথম দিকে ঠাকুর “আর্য্য ভারতবর্ষ” শীর্ষক গানখানি রচনা করেন। একদিন ‘নিভৃত- নিবাস’ নামে হিমাইতপুর আশ্রমস্থ একটি ঘরে বসে ঠাকুর গানটি বলে চলেন এবং কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য তার শ্রুতিলিখন নিতে থাকেন। সামনে প্রফুল্ল উপস্থিত ছিলেন। ঐসময় ওখানে একাধিক লোক থাকা প্রয়োজন নেই মনে করে কৃষ্ণপ্রসন্ন ইশারায় প্রফুল্লকে বাইরে যেতে বলেন। প্রফুল্ল বাইরে এসে অপেক্ষা করতে থাকেন। গানটি লেখা শেষ হলে কৃষ্ণপ্রসন্ন বাইরে বেরিয়ে আসার পরে প্রফুল্ল সেটি দেখতে চান। কৃষ্ণপ্রসন্ন তখন বলেন-তোমাকে পাঠিয়ে আমি তো বেকুব! তোমাকে চলে আসতে বলায় তোমার যদি মন খারাপ হয়ে থাকে, এই ভেবে ঠাকুর বিমর্ষ এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। আমি লিখছি, কাছে এমন কেউ নেই যাকে দিয়ে তোমাকে ডেকে পাঠাই। আমারও ভাল লাগছিল না।
এ কথা শুনে পরম দরদীর অফুরন্ত স্নেহের স্পর্শে প্রফুল্লর অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
অসৎ নিরোধ বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর অনুগামীবৃন্দকে সর্বদা তৎপর ও সতর্ক থাকতে বলতেন। ১৯৬৬ সালে এক বর্ষা-সন্ধ্যায় ঠাকুর দেওঘর আশ্রমের পার্লার নামাঙ্কিত ঘরে নিজের বিছানায় বসে এই বিষয়ক আলোচনা করছিলেন; বিশিষ্ট ভক্ত সুশীলচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র হালদার প্রমুখ অন্যান্য কয়েকজনের সঙ্গে প্রফুল্লও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কথায় কথায় প্রফুল্ল জানতে চান যে সঙ্ঘের কর্তাস্থানীয় কোন ব্যক্তি যদি ইষ্টস্বার্থ-প্রতিষ্ঠা এবং ইষ্টনীতির পরিপন্থী চলনে চলেন, সেখানে কী করণীয়। ঠাকুর উত্তরে জানান-অন্যত্র ঘোঁট না পাকিয়ে তাকেই তা বলা উচিত। উচিত কথা বললে মার খেতে হতে পারে-প্রফুল্লর এই উক্তিতে শ্রীশ্রীঠাকুর দৃঢ়ভাবে বলেন-মারলে মার খাবি, তবু ভদ্রভাবে যা বলার বলবি। ন্যাকার মত বলবি -আপনি হয়ত ঠিকই করছেন, কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গতি খুঁজে পাচ্ছি না।
স্বার্থবুদ্ধি বা ভয়বশত যদি তুমি কোন শক্তিমান লোকের অসৎ চলনের প্রশ্রয় দাও, তবে জেনে রেখো-তুমি তার, তোমার নিজের, সমাজের এবং ইষ্টের সঙ্গে শত্রুতা সাধন করছ এবং তার সমুচিত শাস্তি থেকে কিছুতেই রেহাই পাবে না। অসৎ-নিরোধী পরাক্রমের অভাবে দেশে দিন-দিন পাপীরাই প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠছে। তবে পাপকে ঘৃণা করলেও পাপীকে ঘৃণা করতে নেই। অসৎ-নিরোধের ব্যাপারে মনোবল যেমন থাকা চাই, তেমনই চাই সংযম, শুভবুদ্ধি, কুশলকৌশলী বাক্য ও ব্যবহার।
এমনভাবে প্রতিনিয়ত শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রফুল্ল নিজেকে সর্বদিক থেকে সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত করে তুলতে পেরেছিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের নিয়ত-সান্নিধ্য তাঁকে কতখানি যোগ্য এবং সর্বমান্য করে তুলেছিল নিম্নোক্ত ঘটনায় তার পরিচয় মেলে।
প্রফুল্লর মত কৃতী ছাত্র একান্ত তরুণ বয়সে সব ছেড়ে ঠাকুরের কাছে আশ্রমে চলে আসায় তাঁর নিকটজন কেউ কেউ স্বভাবতই ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ হন। তাঁর দাদা অমূল্যকুমার দাসও প্রাথমিকভাবে আশ্রমের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু ১৯৪১-এর শেষদিক থেকে অমূল্য বেশ কয়েকবার আশ্রমে যাতায়াত করেন। ১৯৪২-এর শেষদিকে তিনি অনুজ প্রফুল্লর কাছে এসে ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে তিনি সস্ত্রীক দীক্ষা নেবেন-প্রফুল্ল যেন ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করে আসেন যে কোন ঋত্বিকের কাছে তাঁরা দীক্ষা নেবেন। প্রফুল্ল এসে ঠাকুরকে সেকথা জিজ্ঞাসা করাতে ঠাকুর তাঁকেই তাঁর দাদা-বৌদিকে দীক্ষা দিতে বলেন। এ কথায় প্রফুল্ল আশঙ্কা হয় যে এতে হয়তো তাঁর দাদার দীক্ষা নেওয়ার সংকল্প ভগ্ন হবে। তাই তিনি ঠাকুরের নিত্যসেবকসেবিকাদের অন্যতম, শ্রদ্ধেয় ভক্ত রাধারমণ জোয়ারদারের স্ত্রী সরোজিনী-মায়ের মাধ্যমে তাঁর আশঙ্কার কথা ঠাকুরের কাছে নিবেদন করেন। সরোজিনী-মা ঠাকুরকে তা জানালেন, কিন্তু ঠাকুর তাতে গুরুত্ব না দিয়ে আবার প্রফুল্লকেই নির্দেশ দিলেন দাদা-বৌদিকে দীক্ষা দিয়ে দিতে। প্রফুল্ল কিছুটা বিব্রতভাবে দাদাকে সেকথা জানাতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন-ঠাকুর যে অন্তর্যামী, তা আমি আর একবার বুঝলাম। আমাদের ইচ্ছা ছিল-দীক্ষা নিলে তোর কাছ থেকেই নেব। ঠাকুর আমাদের মনের কথা জেনেই এই নির্দেশ দিয়েছেন।তখন প্রফুল্ল আনন্দিত চিত্তে তাঁদের দীক্ষা দিলেন। এই প্রসঙ্গে ঐ দীক্ষাপর্বের. অল্প কিছুদিন পরে শ্রীশ্রীঠাকুর মন্তব্য করেন- “... দীক্ষা নিয়ে এসে ওর (প্রফুল্লর) দাদা কয়-‘ঠাকুর, আপনি অন্তর্যামী। আমার বড় ইচ্ছে ছিল, দীক্ষা যদি নিই তো প্রফুল্ল কাছ থেকেই নেব।’ শুনে একটা আত্মপ্রসাদ হল যে প্রফুল্ল আমার কাছে পড়ে থেকে দাদার মনে এতখানি দাগ কাটতে পেরেছে।” (আঃ প্রঃ ২২/১০/১৯৪২)।
১৯৪৬ সালে পাবনায় সমাজবাদী কর্মীদের সম্মেলনে সভাপতিরূপে আসেন ডাঃ রামমনোহর লোহিয়া। সেসময় লোহিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় প্রফুল্লকুমার দাসের। ডাঃ লোহিয়া প্রফুল্লকে ভারতের সর্বত্র সমাজবাদ প্রচারের জন্য অনুরোধ জানালে তিনি জানান-তিনি আর্য ভারতীয় সমাজবাদের পূজারী এবং সংক্ষেপে আদর্শবাদ, সমাজবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আর্য ভারতীয় সমাজবাদের জগতকল্যাণকামী দৃষ্টিভঙ্গী বিবৃত করেন। তিনি বলেন-জগতের সমস্ত মহাপুরুষগণ একই আদর্শের পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত; পরিবেশ বলতে বোঝায় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বাদ দিয়ে মানুষের বিকাশ ও কল্যাণ হতে পারে না। ইষ্টকৃষ্টি, সমাজ, চতুবর্ণ, চতুরাশ্রম সবকিছুর সমন্বয়েই সামগ্রিক মঙ্গল সম্ভব।
ইংরেজিতে এই সংক্ষিপ্ত আলাপের পর ডাঃ লোহিয়া বলেন- তোমার দৃষ্টি আমার দৃষ্টির তুলনায় অনেক গভীর ও ব্যাপক। তবে এইটুকু বুঝি যে তুমি ধর্মপ্রাণ লোক হলেও শুধু নিজের মুক্তি নিয়েই ব্যস্ত নও, তুমি সবার কল্যাণ চাও। এমনতর ধার্মিক যারা, তাদের আমি শ্রদ্ধা করি। তুমি তোমার পথে চলো। আমি আমার পথে চলি। আমাদের উভয়ের ধারায়ই লোকের কল্যাণ হবে এই বিশ্বাস আমি রাখি।
পরে একজন স্থানীয় যুবনেতাকে লোহিয়া বলেন- অধ্যাপক দাস ধর্মপ্রতিষ্ঠানের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও যে এতখানি উদার ও ব্যাপক হবেন তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। উক্ত যুবনেতাটি বলেন-উনি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সেবক এবং তাঁর প্রধান কথা হচ্ছে ধর্ম মানে সপরিবেশ বাঁচা বাড়া। উনি ওঁর গুরুর কথাই বলেছেন।
একথা শুনে ডাঃ লোহিয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন।
একবার সাংসদ অনন্ত শায়নম্ আয়েঙ্গার আশ্রমে এসেছেন। তাঁর একান্ত ইচ্ছা, ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনার গোপনীয়তা যেন দোভাষী বজায় রাখেন। ঠাকুর বললেন, আমার প্রফুল্ল আছে, ও থাকলে চিন্তার কারণ নেই। প্রায় ঘন্টাখানেক আলোচনায় দোভাষীর কাজ করলেন প্রফুল্ল। অনন্ত শায়নম্ পরে তাঁকে বলেছিলেন- ভারত সরকারের আই. সি. এস.-দের মধ্যে কিন্তু তোমাদের মতো committed লোক কমই। তোমার মত একজন সাথী পেলে আমার খুব আনন্দ হতো। তোমার কথা আমার মনে থাকবে। তোমাদের প্রত্যয় আমাকে মুগ্ধ করেছে।
আর একবার উৎসবের সময় হোম মিনিস্টার বি. এন. দাতার এসে বক্তৃতা দিতে গিয়ে শুনলেন যে বঙ্গভাষী শ্রোতৃমণ্ডলীর অধিকাংশই ইংরেজি বোঝেন না। তিনি তখন ঠাকুরকে বললেন-আপনি আমাকে এমন একজন লোক দিন, যে আমি একটা করে sentence ইংরেজিতে বলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা করে বলবে। আমি ত্রিশ মিনিট বলব, সেও ত্রিশ মিনিট বলবে। ডায়াসে পাশাপাশি মাইক থাকবে।
প্রফুল্ল সেখানে উপস্থিত ছিলেন, ঠাকুর বললেন- প্রফুল্ল ইচ্ছা করলে পারে। তিনি বললেন-তা নয়, আপনার যদি দয়া হয় তাহলে পারি। ঠাকুর বললেন-ভাল করে কবি। দাতার সাহবের কথায় অডিয়েন্সকে পাগল করে দিবি। ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে দাতার সাহেবের।
মিটিং-এর মঞ্চে দাতারের এবং প্রফুল্লর মাইক পাশাপাশি রাখা হল। দাতার বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনর্গল বলে যেতে লাগলেন। বক্তৃতার শেষে সমবেত ত্রিশ হাজার শ্রোতার হাততালি আর থামে না। বক্তৃতার পর ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য ঠাকুরের সামনে এসে প্রফুল্লকে জিজ্ঞাসা করলেন-তুমি দাতারের ইংরাজি বক্তৃতার কপিটা আগে পড়ে নিয়েছিলেন? উত্তরে প্রফুল্ল ‘না’ বলাতে কৃষ্ণপ্রসন্ন বলেন- তাহলে ওঁর বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে অমন করে সক্রিয় ইষ্টনিষ্ঠা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা সংযোজন করলে কি করে? মনে হচ্ছিল গুরুগতপ্রাণ কোন ভক্তের বক্তৃতার তর্জমা হচ্ছে। তোমার অনুবাদ যারা শুনেছে তারা উপকৃত হয়েছে।
প্রফুল্ল বলেন-ঠাকুরের দয়ায় এবং আপনার আশীর্বাদে হয়েছে। আমি কিছু ভেবে বলিনি। ঠাকুর ললিতমধুর ভঙ্গীতে বললেন-মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্। যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্।।
প্রফুল্ল আপ্লুত হৃদয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন।
তাঁর জীবনে নামের সক্রিয়তা বাস্তবভাবে বহুবার অনুভূত হয়েছে। একবার ১৯৪২-এর জুন মাসে ঠাকুরের নির্দেশিত কাজে সাঁওতাল পরগণার বাকুদি গিয়ে রাতে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হন প্রফুল্ল। প্রবল জ্বরের ঘোরে ঠাকুরের নাম করে কাঁদতে লাগলেন তিনি; হঠাৎ ঠাকুরের কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন-উঠে বসে নাম কর, জ্বর ছেড়ে যাবে।
তিন ঘন্টা দুর্দান্ত বেগে নাম করার পর ভোরবেলা জ্বর ছেড়ে গিয়ে দারুণ খিদে পেল তাঁর। ঠাকুরকে বললেন মনে মনে-এই বিদেশ বিভুঁইয়ে একমাত্র তোমার দয়া ছাড়া প্রাণঘাতী ক্ষুধার হাত থেকে ত্রাণ পাব না। কিছুক্ষণ পরেই সেখানকার ইষ্টভ্রাতা রোহিণী রায় তাঁকে সাদরে নিজের বাড়ি চা খাওয়ার জন্য নিয়ে গিয়ে তাঁর যথোপযুক্ত আহার্যের ব্যবস্থা করেন।
গভীর নামধ্যানের ফলে দেহের অসারতার বোধ এবং মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব হয়। একবার বিছানায় শুয়ে গভীরভাবে নাম করতে করতে প্রফুল্লর হঠাৎ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। প্রাণটা যেন দেহ থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু তাঁর বিন্দুমাত্র ভয় হল না, বরং এক অপূর্ব মুক্তি ও ব্যাপ্তির স্বাদ অনুভব করলেন তিনি। দূরদূরান্ত ঘুরতে লাগলেন। দেহটার প্রতি দারুণ বিতৃষ্ণা অনুভব করলেন। কিন্তু বেশ কয়েক ঘন্টা পরে হঠাৎ কেমন করে আবার দেহের মধ্যে তাঁর প্রবেশ ঘটল। এই ঘটনার ফলে দেহাতীত সত্তার সত্যতা সম্বন্ধে তাঁর মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নেয়।
একবার পূজ্যপাদ বড়দার (শ্রীশ্রীঠাকুরের জ্যেষ্ঠ তনয়) সঙ্গে শিলচর যান প্রফুল্লকুমার। সেখানে অন্নদা দেব নামে একজন জ্যোতিষীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। অন্নদা দেব নিজ কৌতূহলে প্রফুল্লর একটি জন্মকুণ্ডলী তৈরী করেন। জন্মকুণ্ডলী বিচার করে জ্যোতিষী বলেন-কী আশ্চর্য, আপনার এক দুর্লভ যোগ রয়েছে-এই জন্মই আপনার শেষ জন্ম! কর্মফল ভোগ করার জন্য আপনাকে আর জন্মগ্রহণ করতে হবে না। একথা বলে তিনি পাঁচটি টাকা দিয়ে প্রণাম করেন ক্ষণজন্মা প্রফুল্লকুমার দাসকে। প্রফুল্ল বিব্রতভাবে বলেন-আমারই তো আপনাকে দেওয়া উচিত কিছু...। উত্তরে অন্নদা দেব বলেন-না, না। আমি বহু মানুষের ঠিকুজি-কোষ্ঠী নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, অনেক সৎসঙ্গীরও কোষ্ঠী দেখেছি, কিন্তু এরকম যোগ আমার চোখে পড়েনি। আমি জানতাম যে শেষ জন্মের যোগ বলে একটা যোগ রয়েছে, কিন্তু এতদিন পর্যন্ত আর কারও কোষ্ঠীতে সে যোগ না পেয়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে ঐ যোগ কারও হয় না। এই প্রথম আপনার কোষ্ঠীফলে আমি এই যোগ দেখলাম।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রফুল্লকুমার দাস রচিত ‘স্মৃতি-তীর্থে’ গ্রন্থে এবং তৎসংকলিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’-র বহু স্থানে মুক্তির জন্য তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা পরিলক্ষিত হয়। হয়তো এই মুমুক্ষুত্ব তাঁর কোষ্ঠীফলেরই প্রতিফলন।
অন্তর্যামী ও সর্বব্যাপী ঠাকুরের করুণায় অবগাহন করে ধন্য হয়েছে তাঁর জীবন। হয়তো কোন বিষয়ে কখনও তাঁর মনে সংশয় দেখা দিত; তখনই হয়তো দেখলেন যে ঠাকুর এমন বাণী বা কথোপকথন শুরু করলেন যাতে ঐ দ্বন্দ্বের নিরসন হয়। দূরে বসে আর্তভাবে ডাকলে ঠাকুর টের পেতেন। ১৯৬১ সালে একদিন প্রফুল্ল অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় বসে ঠাকুরকে আকুলভাবে ডাকছেন ও বারবার তাঁর ছবির সামনে মাথা খুঁড়ছেন-মনে হচ্ছে, দয়াল যেন কাছেই আছেন। ঠিক সেই সময় ঠাকুর দেওঘরে সর্বসমক্ষে বললেন-প্রফুল্ল এইমাত্র আমাকে প্রণাম করে গেল।
প্রফুল্লকুমার দাসের জীবনবৃত্তান্ত ঠাকুরের বাণী ও কথোপকথনের ভাণ্ডারীরূপে সবচেয়ে সার্থকভাবে বর্ণনা করা চলে। ‘সাহিত্যকৃতি’ শীর্ষক আলোচনায় এ বিষয়ে বিস্তৃত কথনের প্রয়াস করা হল।
সাহিত্যকৃতিঃ -
আলোচনা প্রসঙ্গেঃ শ্রীশ্রীঠাকুরের আশ্চর্য মানুষ-পিপাসা এবং চুম্বক ব্যক্তিত্বের টানে বিভিন্ন মতের ও বিচিত্র চরিত্রের অসংখ্য মানুষ এসেছেন দীর্ঘদিন ধরে- তাঁদের মধ্যে অতি সাধারণ দেহাতী গ্রাম্য মানুষ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, লেখক, কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সবাই রয়েছেন। প্রত্যেকের সঙ্গে ঠাকুর তার প্রয়োজনানুসারী কথা বলেছেন, অভিনব সমাধান দিয়েছেন প্রতিটি সমস্যার। এই দৈনন্দিন অথচ সারগর্ভ কথোপকথন ১৯৩৯-এর ১৫ই জুন থেকে প্রফুল্ল তাৎক্ষণিক অনুলিখনের মাধ্যমে সংকলন করে চলেন এবং ১৯৫৮ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে চলে এই অনুলিখন-পর্ব। এই সংকলন সমগ্রই, পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, ‘আলোচনা- প্রসঙ্গে’ নামে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’ নামে বাইশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে, আরও বেশ কয়েকটি খণ্ড এখনও প্রকাশিতব্য।
অনন্যমনা শ্রুতিধর প্রফুল্লকুমারের এই শ্রুতিলিখন ডায়েরি শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানার এবং বোঝার পক্ষে অপরিহার্য এক মাধ্যম যা আগামী প্রজন্মের কাছে পরম বিস্ময়কর উপাদান রূপে প্রতিভাত হবে।
এই কথোপকথন গ্রন্থগুলির সংকলন-নৈপুণ্য সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুরের স্মরণীয় উক্তি (৯ই জানুয়ারী, ১৯৫০): “প্রফুল্লর বইগুলি তাড়াতাড়ি ছেপে ফেলা দরকার। Conversation (কথোপকথন) গুলি wonderdul (অপূর্ব) জিনিষ হয়েছে। এত সহজ, এত সুন্দর, আমার সামনে যখন পড়ে, আমিই মুগ্ধ হয়ে যাই।” অন্য এক প্রসঙ্গে আর একদিন (৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০) ঠাকুর বলেন-“প্রফুল্ল আলোচনা প্রসঙ্গে তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেললে ভাল হয়। জিনিষগুলি একেবারে supernatural (অতিপ্রকৃত)। ওর কানটাও তেমনি। ভগবান সেইভাবেই সৃষ্টি করে পাঠিয়েছেন এই কাজ করবে বলে। যে-কলমটায় কথাগুলি লিখছে, বাণীগুলি লিখছে তাকে কওয়া যায় পুণ্যলেখনী। এটা রেখে দেওয়া লাগে।”
এছাড়াও, ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’ মহাগ্রন্থ এবং তার সঙ্কলক প্রফুল্লকুমার দাস সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর বহুবার বহু উক্তি করেছেন, যেগুলির মাধ্যমে এ বিষয়ে ঠাকুরের নিজের করা মূল্যায়নের আভাস পাওয়া যায়। ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’ এবং ‘দীপরক্ষী’ (দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সঙ্কলিত) গ্রন্থ থেকে এমনই কিছু অংশ নিম্নে প্রদত্ত হল, যা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
“প্রফুল্লর দিকে চেয়ে (ঠাকুর) কৃত্রিম বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন-ঐ আর একজন! খাতা-কলম বাগায়েই আছে। আবোল-তাবোল যা কব লিখে ফেলবে। আমি কখন কি কই, তার ঠিক নেই। যত সব পাগলের কাণ্ড।
কেষ্টদা (কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য) জোরদার সমর্থনের সুরে বললেন-আপনার রোজকার কথাবার্তা লিপিবদ্ধ না করে আমরা যে অপরাধ করেছি, ও তার প্রায়শ্চিত্ত করছে।
চতুর-চুড়ামণি এবার কৌতুকজনক ভঙ্গিমায় মাথায় হাত দিয়ে বললেন-ও হরি! আপনিও ঐ চ্যাংড়ার হয়ে ওকালতি শুরু করে দিলেন! বল মা তারা দাঁড়াই কোথা!” (আঃ প্রঃ, ১৭/৮/১৯৮৪)
“কথা প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন- প্রফুল্ল যে নোটগুলি নিচ্ছে, যদি তা ঠিকমত unfold (প্রকাশ) করতে পারে, বিরাট কাম হতে পারে। অবশ্য চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, চিন্তা অনুযায়ী কাজ চাই।” (আঃ প্রঃ, ১৮/৮/১৯৪৮)
“একটু পরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-আমি আস্তে বললে প্রফুল্ল বুঝতে পারে না কেন? কিন্তু ভগবান ওর কানটা দিয়েছেন এমন, ওর কিন্তু শোনাই উচিত। আর অনেক সময় যখন কেউ ধরতে পারে না, ও ধরে। ও জন্মেছেই যেন এই কাজের জন্য আমার কথাগুলি ধরবার জন্য শ্রুতি নিয়ে।” (আঃ প্রঃ, ৫/১০/১৯৪৮)
“শ্রীশ্রীঠাকুর ঈষৎ হেসে বললেন- প্রফুল্লকে বলা যায় নারায়ণী কেরাণী। মানুষ কেমন করে কীভাবে বাঁচতে পারে, সে সবই তো লিখে রাখে। যা লেখে সব becoming (বৃদ্ধি)-এর জন্য।” (আঃ প্রঃ, ৩১/১০/১৯৪৮)
“শ্রীশ্রীঠাকুর যতি-আশ্রমের জন্য নির্মীয়মান টিনের ঘরের নিচে বসে বাণী দিচ্ছিলেন। পরম পূজনীয় বড়দাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রসঙ্গত বললেন-প্রফুল্লর কান ঠিক হয়ে এসেছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ওর কানটাই অন্যরকম। জন্মই এই কাজের জন্য। Blessed birth (পবিত্র জন্ম)। গণেশের মত লিখছেই। True disciple (প্রকৃত শিষ্য)-এর মত discipline (শৃঙ্খলা)-ও খুব। ধমক দিলে আবার চৈতক ঘোড়ার মত alert (সজাগ) হয়ে ওঠে।” (আঃ প্রঃ, ২৫/১১/১৯৪৮)
“প্রফুল্লকে লিখতে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-ওর জন্মই এইজন্য। ওর কান দুটো দেখেছেন? ও যা করেছে, মানুষ পরে বুঝবে-এ জিনিষের দাম কী। কত কথা, কত আলোচনা হয়ে গেছে, এতদিন বরাবর যদি লেখা হত, একটা লাইব্রেরী হয়ে যেত।” (আঃ প্রঃ, ৬/৬/১৯৪৯)
“বই ছাপা সম্বন্ধে কথা ওঠায় শ্রীশ্রীঠাকুর প্রফুল্লকে বললেন-আমার বাণীর বইগুলি বের হবার আগে তোর বইগুলি (আলোচনা-প্রসঙ্গে) বের হওয়া দরকার। যখন আমার সামনে পড়িস তখন মনে ভাবি-আমার কথাগুলি কি এত সুন্দর! আমার যদি এমন হয়, তাহলে বাইরের লোকের কতখানি হয় তা তো বুঝতেই পার। আর, শুনিও তো সবার কাছে। যা কয় তাতে তো মনে হয় singularly effective, beautiful and wonderful (অসাধারণ কার্যকরী, সুন্দর এবং বিস্ময়কর)। কোথাও ডাকে আলোচনা (সৎসঙ্গের মুখপত্র) গেলে সবাই নাকি দল ধরে পড়তে শুরু করে দেয়। একজন পড়ে আর দশজনে শোনে। যেন ভাগবতের আসর।” (আঃ প্রঃ, ৩/২/১৯৫০)
“শ্রীশ্রীঠাকুর ... conversation (কথোপকথন)-এর নোট যে প্রফুল্ল লিখছে তার পিছনে ওর খাটুনি আছে খুব। জিনিষগুলি অপূর্ব। এত সহজ ও সুন্দর যে, কারও বুঝতে কষ্ট হয় না। ঐগুলি ভাল edit (সম্পাদনা) করে বেরোলে খুব কাজ হবে।” (আঃ প্রঃ, ১৫/১২/১৯৫০)
“শ্রীশ্রীঠাকুর প্রফুল্লকে লক্ষ করে বললেন-ওর কান দেখে মনে হয়, ওর জন্মই হয়েছিল এ কাজের জন্য। ভবিষ্যতে মানুষ হয়তো ব্যাস-ট্যাস কবে।” (আঃ প্রঃ,২৮/৫/১৯৫১)।
“শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ প্রফুল্লর খাতার বাক্সটা এখানে (দুমকায়) নিয়ে আসবার কথা বলতে গিয়ে বললেন--একটা সাম্রাজ্যের চেয়ে ওর দাম বেশী।” (আঃ প্রঃ, ২৭/৮/১৯৫২)
“শ্রীশ্রীঠাকুর চুণীদাকে (রায়চৌধুরী) ডেকে পাঠালেন; চুণীদা আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর আবদারের সুরে বললেন-আর এক ব্যাপারে তো ঠেকে গেছি। প্রফুল্লর ঐ কলম কেষ্টদা দিয়েছিল। কলম খুব দামী কলম, কিন্তু লিখতে পারছে না। হয় ওটা ভাল করে এনে দেবে, আর যদি ভাল না হলো, আর একটা কলম এনে দেবে ভাল দেখে। বোঝো তো, আমার চলন আর প্রফুল্লর কলম।” (আঃ প্রঃ, ১৯/৩/১৯৫৪)
“শ্রীশ্রীঠাকুর-... প্রফুল্ল একেবারে চুর হয়ে গেছে। কোন মহাপুরুষ ও তা আমি জানি না। কিন্তু যা ও পেয়ে গেল, আর কত হাজার পর এতখানি কেউ পাবে জানি না।” (আঃ প্রঃ, ১/৯/১৯৫৪)
“শ্রীশ্রীঠাকুর প্রফুল্লকে আজ গুরুদায়িত্ব দেন। প্রফুল্লও সেটা সানন্দে গ্রহণ করে। দয়াল বারবার সন্তোষ প্রকাশ করে বলছেন-প্রফুল্ল আজ আমাকে যে relief (স্বস্তি) দেছে, সে আর কবার না। শুনেছি মায়েদের ছেলেপুলে হলে ঘুমোয়ে পড়ে। এত আরাম পায় যে অসাড়ে ঘুমোয়ে পড়ে। প্রফুল্লর কথা দেওয়ার পর থেকে আমার যেন তেমন লাগছে। আর আমার মনে হয় ও কৌশল যা শিখেছে এতদিনে, তা খাটিয়ে successful (কৃতকার্য) হয়ে যাবে।” (আঃ প্রঃ, ৫/৯/১৯৫৪)
“শ্রীশ্রীঠাকুর-প্রফুল্লর হাতটা দেখ তো (আকুদাকে)।
আকুদা হাত দেখে বললেন-সাহিত্যের যে দার্শনিক দিক সেইটে নিয়ে অনুশীলন করলে ভাল হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ও যে কাণ্ড করিছে! Conversation (কথোপকথন) গুলি এমনভাবে লিখেছে যে তাতে যেন ছবি ফুটে উঠেছে। রামকৃষ্ণ-কথামৃতের থেকেও বোধহয় ভাল হবে।” (আঃ প্রঃ, ১৭/১০/১৯৫৪)
“শ্রীশ্রীঠাকুর... বইগুলি ভাল করে পড়ে ফেলাও। ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’-র মধ্যে সব আছে। ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’ লিখে প্রফুল্ল ভালই করেছিল। ওতে commoner (সাধারণ লোক)-দের সাথে কথাবার্তা আছে। যদিও সব লেখা হয়নি, কিন্তু যা লিখেছে তা-ই খুব। বাইরের লোক কয় দাসমশাই। এবার দাসকে দেখার জন্য যে কত লোক খোঁজ করেছে তার ঠিক নেই।” (দীপরক্ষী, ১৭/১২/১৯৫৮)
“শরৎদা বললেন-প্রফুল্ল চিঠি লিখেছে, কোলকাতায় গিয়ে ওর শরীর ভাল আছে। শ্রীশ্রীঠাকুর-তা তো হল। কিন্তু এদিকে ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’ লেখার কাজে বাধা পড়ে যাচ্ছে। ওগুলির মধ্যে আমার সব কিছু কওয়া আছে। একেবারে Prima facie
(প্রথম দৃষ্ট বিষয়ের)-র মতন।... প্রফুল্লর লেখার কতগুলি সুন্দর ধারা আছে।” (দীপরক্ষী, ৫/৮/১৯৫৯)
“শ্রীশ্রীঠাকুর-দ্যাখ, ঐ ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’-র কাজ যা আছে তাড়াতাড়ি করে শেষ কর। এ কথা আমি কই কেন? কারণ, কাল যে আমার কী অবস্থা হবে তা তো আমি জানিনে।
প্রফুল্লদা-শরীরের জন্য একটু অসুবিধা হয়। শরীর ভাল থাকলে আমি ঠিক পেরে যাব।
শ্রীশ্রীঠাকুর-দেখ, পার না যে তার একটা কারণ হল স্বাস্থ্য। সেইজন্য পাবনা আমল থেকেই যখন ওগুলি নিতে, তখন তখনই যদি সব গুছিয়ে ঠিক করে রাখতে তাহলে ভাল হত। তোমার পরিবেশনের ক্ষমতাও আছে। ধর, আগে সন্দেশ দিলে, তারপর একটু বোঁদে দিলে, কি আগেই বোঁদে দিলে। এরকম করে দেবার ক্ষমতা তোমার আছে। আর এইভাবে দিতে পারলে এগুলি মানুষের মাথায় সহজভাবে ঢোকে। এ দিয়ে যা হচ্ছে তা ঐ নানা-প্রসঙ্গে বা কথা-প্রসঙ্গে দিয়ে হবনানে। ওগুলো আর এক ধরনের জিনিষ। এই পরিবেশনের ক্ষমতা সকলের থাকে না। ‘ডিশ’ সাজানো ক্ষমতার দরকার।...” (দীপরক্ষী, ৯/৮/১৯৫৯)
আলোচনা-প্রসঙ্গে এবং দীপরক্ষী ছাড়াও প্রফুল্ল দাস বিরচিত অপর গ্রন্থ ‘স্মৃতি-তীর্থে’ গ্রন্থে আলোচনা-প্রসঙ্গের পাণ্ডুলিপি সম্বন্ধে ঠাকুরের উক্তিটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রফুল্লকে বলেন-আমি বলি, আমার সামনে বসে লিখিস। এগুলির মধ্যে আমার নিঃশ্বাস থাকছে। এসব ঠিকমত রাখা লাগে। এই খাতাগুলির মধ্যে এমন impulse (সাড়া) থাকছে যে, এগুলি দর্শন করে হয়তো শত শত বৎসর পরে বহুলোক উদ্ধার পেয়ে যাবে।
ঐ গ্রন্থেই উল্লেখিত অপর একটি ঘটনাও স্মরণীয়। ঠাকুরের লেখা নিয়ে দিবারাত্র ব্যাপৃত থাকার দরুন প্রফুল্ল নামধ্যানের অবকাশ পৃথকভাবে তেমন পেতেন না, অথচ রাত্রিতে ঘুমের সময় তাঁর মন এক অপূর্ব আনন্দে নিমজ্জিত থাকত। ঠাকুরের কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন-যা নিয়ে সব সময় থাকিস, তা হ’লো বেদ না কি যেন কয়, তাই। তার দরুন পরমপিতার দয়ায় এসব হয়।
আলোচনা-প্রসঙ্গে-র কয়েকটি খণ্ডের অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই পুস্তকের যে-সমস্ত পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়েছে, কয়েকটি পত্রিকা থেকে তার কিয়দংশ এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই মন্তব্যগুলির মধ্যে সংকলনের বিষয়বস্তু এবং সংকলক সম্বন্ধে সাধারণভাবে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।
আনন্দবাজার পত্রিকা: “অধ্যাত্মবিজ্ঞানের সঙ্গে জড় বিজ্ঞানকে blend করার একটা প্রয়াস শ্রীশ্রীঠাকুরের কথাবার্তায় পরিস্ফুট।... এই পুস্তক প্রণয়নে সংকলয়িতা
তাঁহার কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করিয়াছেন।”
সাপ্তাহিক দেশঃ “আশ্রমের আবাসিক শিষ্য শ্রীপ্রফুল্লকুমার দাস দিন প্রতিদিনের ডায়েরি রেখেছেন এবং ঠাকুরের অলোচনা, ব্যাখ্যানা ও মন্তব্যের শ্রুতিধর ভাণ্ডারী হিসাবে সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করে সংগ্রহ করেছেন।”
যুগান্তর: “ঠাকুরের উপদেশগুলি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং সংকলয়িতার কৃতিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভা, তাঁর সংগঠনশক্তি এবং সর্ববিষয়ে বৈজ্ঞানিকোচিত দৃষ্টিভঙ্গীও পরিস্ফুট হয়েছে।”
দৈনিক বসুমতীঃ “এর মধ্যে যে মহামূল্য সম্পদ নিহিত আছে তার পরিমাপ করা দুরূহ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।... অত্যন্ত সহজ, যুক্তিসংগত ও অকাট্য ঠাকুরের এ উপদেশবাণী সমূহ যেমন হৃদয়স্পর্শী, তেমনই সহজবোধ্য। সংকলনকারী দাস মহাশয়ের কৃতিত্বও এ ক্ষেত্রে স্বীকার করিতেই হয়।”
Hindustan Standard: “Prafulla Kumar Das has done good job to compile the talks which Thakur Anukulchandra often gave to his disciples.”
অখণ্ড জীবন-দর্শন: প্রফুল্লকুমার দাস প্রণীত ২৬৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রীশ্রীঠাকুরের তিরোধানের চার বছর পর ১৯৭৩-এ। ১৯৬৪ সালের শেষভাগে ঠাকুর সৎসঙ্গের সামগ্রিক ভাবধারা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনার কথা বলেন। তার অব্যবহিত পরেই প্রফুল্ল এই গ্রন্থ রচনার কাজে হাত দেন। ধর্ম, কৃষ্টি, দীক্ষা, সাধনা, সৃজনতত্ত্ব, যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, বিবাহ, পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সদাচার, অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্র, বিজ্ঞান, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি ছাব্বিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এগ্রন্থ এককথায় ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র-দর্শনের অখণ্ড চিত্রায়ন।
An Integral Philosophy of life:: ৩২০ পৃষ্ঠার ইংরেজি এই গ্রন্থে ঠাকুরের সর্বতো জীবনমুখী ও সর্বপূরক দর্শন ও ভাবধারার সুসংহত রূপায়ন ঘটেছে। প্রকৃত ধর্মের ভিত্তিতে কেমন করে দিব্যভাবাপন্ন ঐক্যবদ্ধ এক অখণ্ড মানবজাতি গড়ে উঠতে পারে-তারই অমিয় সংকেত রয়েছে গ্রন্থটিতে। বিশেষতঃ অবাংলাভাষীদের পক্ষে এই গ্রন্থ ঠাকুরের ভাবধারা আস্বাদনের অনন্য মাধ্যম।
উপরোক্ত গ্রন্থ দুটি সম্বন্ধে বিশিষ্ট পত্রপত্রিকার মতামত :-
যুগান্তরঃ “লেখকের ভাষা সুন্দর, বিশ্লেষণ হৃদয়গ্রহী। পাঠকগণ গ্রন্থটির সর্বত্র একটি প্রত্যয়নিষ্ঠ মনের সন্ধান পাবেন।”
দৈনিক বসুমতী: “গ্রন্থকারের বিদ্যাবত্তা ও প্রগাঢ় ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞানের বিভাব যেমন বিধৃত হয়েছে এই গ্রন্থের মধ্যে, তেমনি অপরদিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশমত রচিত এই গ্রন্থ ‘সৎসঙ্গ’-র ভাবধারার প্রাঞ্জল পরিচয় বহন করে এনেছে।”
অমৃতঃ “গ্রন্থটির বড় গুণ এর ভাষা এবং দুরূহ তত্ত্ব ও দর্শনচিন্তাকে সহজ করে সাধারণ মানুষের জন্য বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা। গ্রন্থ ও গ্রন্থের লেখক অভিনন্দনযোগ্য। বস্তুত গ্রন্থটি সর্বস্তরের মানুষের সংগ্রহযোগ্য।”
Amrita Bazar Patrika: “The work is an attempt to present in a synthetic way the all embracing ideology of the Preceptor.”
The Holy Book: বাহাত্তর দিনের মহাভাবাবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখনিঃসৃত
বাণীগ্রন্থের নাম পুণ্যপুঁথি। ঠাকুরের অন্তরের গভীরতম ইচ্ছা ছিল, পুণ্যপুঁথির ইংরেজি অনুবাদ হোক। ঠাকুরের ইহলীলাবসানের পর প্রফুল্লকুমার নিজ দায়িত্বে সেই অনুবাদকার্য সম্পন্ন করেছেন এবং সেই অনুবাদ সৎসঙ্গের ইংরেজি মুখপত্র Ligate -এ প্রকাশিত হয়েছে।
যতি-অভিধর্মের ইংরেজি অনুবাদ: ঠাকুর-প্রদত্ত শ্রমণ ও যতি জীবনে পালনীয় নীতিসমূহ যথা আত্মসমর্পণ, স্বাধ্যায়, তপস্যা, আত্মবিশ্লেষণ, লোকচরিত্র নির্ণয় ইত্যাদি বিষয়ের উপর ৮৭টি গদ্যস্তবকের বাণী সংকলনের নাম যতি-অভিধর্ম। এই গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের দুরূহ কার্যটি প্রফুল্লকুমার দাস সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেছেন। এখনও তা কোথাও প্রকাশিত হয় নি।
স্মৃতি-তীর্থে: ক্ষণজন্মা ঋষিসদৃশ মানুষটি ঊনআশি বৎসরে অপটু শরীরে দয়াল ঠাকুরের ভাবধারা যথাযথভাবে পরিবেশনের জন্য তাঁর অনুপম সান্নিধ্যের স্মৃতি-কাহিনী ‘স্মৃতি-তীর্থে’ গ্রন্থ ভক্ত-পিপাসুদের উপহার দিয়ে নন্দিত হয়েছেন। ১৫১টি শিরোনামের অধীনে ১৫০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির বিষয়বৈচিত্র্য ঠাকুরের স্মরণোজ্জ্বল কথামালিকার সমাহারে অত্যন্ত আকর্ষক। ১৯৯১ খৃষ্ঠাব্দে পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হলেও এর অধিকাংশ শিরোনাম ‘বিবেক-বিতান’ থেকে প্রকাশিত ‘সপ্তাচ্চি’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বইটির সবকটি অনুচ্ছেদ হয়তো সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ‘স্মৃতি-তীর্থে’ পরিক্রমা প্রেমের, ভালবাসার, জ্ঞানমিশ্রা ভক্তির অভিজ্ঞতার, সাধনজগতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যবোধের, বাস্তবে চলার নির্ভুল সংকেতের, সর্বোপরি পরম দয়ালের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির পরশের অভিজ্ঞতা।
A Pilgrimage to Memory: ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থটি ‘স্মৃতি-তীর্থে’-র অনুবাদ। দয়াল ঠাকুরের অনুপম সান্নিধ্যের স্মৃতিমণিকার এই চয়নটি বঙ্গভাষী নন এমন ভক্ত ও আগ্রহী জনগোষ্ঠীর কাছে অতি আদরণীয়।
অন্যান্য: এতদ্ব্যতীত প্রফুল্লকুমার দাস রচিত অন্যান্য কয়েকটি ঠাকুর বিষয়ক পুস্তিকা উল্লেখযোগ্য। যেমন-আলাপনী ১ম ও ২য় খণ্ড, ঐ এলোরে দুয়ারে, Meaningful Education, In Quest and All in One, বৃদ্ধি কি ও কোনপথে এবং শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়-কৃত Nature’s Dharma গ্রন্থের ‘প্রাকৃত ধর্ম’ নামক অনুবাদ।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ঠাকুরের ভাবধারা অবলম্বনে তাঁর জ্ঞানগর্ভ রচনাসমূহ প্রকাশিত হয়েছে। এইসব পত্রপত্রিকার মধ্যে ঋত্বিক, আলোচনা, ধৃতিদীপা, সপ্তর্চি, Ligate, Becoming ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখ্য। এছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকা এবং দৈনিক বসুমতীতেও তাঁর কিছু মূল্যবান রচনা প্রকাশিত হয়েছে। Ritvik Manual-এর তৎকৃত অনুবাদ ‘ঋত্বিকসাথী’ একসময়ে প্রতিটি পাঞ্জাধারী কর্মীর নিত্য পাঠ্য ছিল।
বাণী সংকলন: শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত বাংলা গদ্যবাণীর সংখ্যা ১০,৩৯২; সাত খণ্ডে প্রকাশিত ছড়ার সংখ্যা ৮,৮২৯ এবং নয় খণ্ডে প্রকাশিত ইংরেজি বাণীর সংখ্যা ২,৪৬৭। এই বিপুল বাণীসমূহের অধিকাংশের সংগ্রাহক ও সংকলক ঠাকুরের অশেষ কৃপাধন্য চিরপ্রসন্ন প্রফুল্লকুমার দাস। উপরন্তু, শ্রীশ্রীঠাকুর প্রণীত গ্রন্থরাজির বিপুলসংখ্যক গ্রন্থের তাৎপর্য-প্রকাশক গভীর মননশীল মূল্যবান ভূমিকাও তিনি প্রণয়ন করেন।
দূরদর্শন অনুষ্ঠান: শ্রীশ্রীঠাকুরের ১০২তম আবির্ভাবতিথি উপলক্ষে ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯ ভারত সরকারের কলকাতা দূরদর্শন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রচারিত “পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র” শীর্ষক তথ্যচিত্রে প্রফুল্লকুমার দাসের মূল্যবান বক্তব্য বহু দর্শকের কাছে মনোগ্রাহী হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে দূরদর্শন কর্তৃপক্ষ দেওঘরে গিয়ে এই বক্তব্য রেকর্ডিং করেন এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্প্রচার করেন।
তিনি বর্তমানে বেশ কিছুকাল যাবৎ দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমে ঠাকুরের মধ্যম পুত্র প্রয়াত বিবেকরঞ্জন চক্রবর্তীর বাসভবন ‘বিবেক-বিতান’-এ আছেন। ঠাকুরের পৌত্র পূজনীয় বিদ্যুৎরঞ্জন চক্রবর্ত্তী এবং বিবেক-বিকতানের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ ও প্রফুল্লকুমারের পুত্র মুক্তেন্দু দাসের সদাজাগ্রত দৃষ্টি এই শ্রুতিধরের নিয়ত স্বস্তি বিধান করে চলেছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মানবীয়, জীবনীয় আদর্শবাদ অবিকৃতভাবে পরিবেশন- কারী অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটি কোন বস্তুজাগতিক সমৃদ্ধি পাননি, পেয়েছেন অসংখ্য মানুষের সশ্রদ্ধ ভালবাসা, অনুভব করেছেন প্রেমমূর্তি ঠাকুরের অপরোক্ষ প্রেমানুভব। ধর্মীয় সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর কর্মনিচয় অভূতপূর্বরূপে পরিগণিত হবে। তিনি যেন দেবদেউলের সেই অনির্বাণ প্রদীপখানি যার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দেবতার প্রসন্ন মুখচ্ছবি ভক্তজনের অন্তরলোকে। পরম দয়ালের কাছে প্রার্থনা, তিনি সুস্থ দেহে আমাদের মধ্যে আরও বহুকাল থেকে বিকীর্ণ করে চলুন দেব-উদ্ভাসক অমিয় আলোকধারা।
________________________________
10