প্যারীমোহন নন্দী
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অলোকসম্ভব ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে বহু প্রতিভাবান সামাজিক সাফল্যে উজ্জ্বল মানুষ এসে উপস্থিত হয়েছেন তাঁর কাছে এবং তাঁর চরণাশ্রয় লাভ করে ধন্য হয়েছেন। অনুপ্রাণিত উদ্বুদ্ধ সেসব মানুষ নিজেদের পরমপ্রাপ্তির বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন জনে জনান্তরে স্বতঃ প্রণোদনায়; তাঁদের নানা বর্ণোজ্জ্বল কীর্তিকলাপ রোমাঞ্চকর কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। তাঁদের অসাধারণ বিশ্বাসদীপ্ত চলনের দ্যুতিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে সংশয়ের অন্ধকারে আচ্ছন্ন অগণিত প্রাণ। এঁদের কীর্তিকাহিনী নানাভাবে পল্লবিত হয়ে অনেক জায়গায় প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু যেসব সর্বত্যাগী মানুষ অহোরাত্র শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে থেকে তাঁর যাবতীয় স্বস্তিবিধানের জন্য তৎপর থেকেছেন, প্রতিনিয়ত তাঁর আদেশ-নির্দেশ পালনের মাধ্যমে তাঁর এবং তাঁর একান্ত নিকটস্থ পরিপার্শ্বের সেবায় নিযুক্ত থেকেছেন, তাঁদের অনাড়ম্বর দৈনন্দিন চমকবিহীন জীবনযাত্রায় তেমন কোন নাটকীয় উপাদান নেই, যা সাধারণ্যে প্রচার লাভ করতে পারে। অথচ এঁদের নিরন্তর সতর্ক দৃষ্টি এবং সেবা-ই শ্রীশ্রীঠাকুরের নিত্যদিনের জীবনচলনাকে স্বস্তিদান করেছে। ডাক্তার প্যারীমোহন নন্দী এমনই একজন অপরিহার্য নিত্যসেবক।
অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের এক সম্ভ্রান্ত বারুজীবী পরিবারে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ১৫ই ফাল্গুন (১৯০১ খৃষ্টাব্দ) প্যারীমোহনের জন্ম। পিতা প্রসন্নকুমার নন্দী ছিলেন সফল ব্যবসায়ী। প্রসন্নকুমার ও স্বর্ণময়ীর তিন পুত্রের মধ্যে প্যারীমোহন কনিষ্ঠ, কিশোরীমোহন এবং কৃষ্ণমোহন যথাক্রমে জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম।
প্রসন্নকুমারের ব্যবসা কলকাতাতেও বিস্তৃত ছিল। কলকাতায় তাঁদের যে ব্যবসাস্থল ছিল, সেখানে থেকে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কিশোরীমোহন পড়াশুনো করতেন। তাঁদের পরিবারের মধ্যে একটি সুতীব্র ধর্মপিপাসার বাতাবরণ ছিল। কিশোরীমোহন বাগবাজারে রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্বোধন কেন্দ্রে নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। মিশনের সন্ন্যাসীমণ্ডলীর অনেকের সঙ্গেই তাঁদের পরিবারের বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, এবং অনেকেই তাঁদের বাড়ি যাওয়া আসা করতেন। সমগ্র পরিবারটিই ক্রমে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এবং রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরাগী হয়ে ওঠেন। হয়তো মিশন থেকে দীক্ষা গ্রহণের ইচ্ছাও ছিল তাঁদের, তবে ঘটনাচক্রে তখনও পর্যন্ত দীক্ষা গ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি।
প্যারীমোহন কৃতিত্বের সঙ্গে বিদ্যালয় জীবনে সমাপ্ত করার পর ঢাকার সুবিখ্যাত মিডফোর্ড মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে যান। সেখানে তাঁর
পরিচয় হয় সুবোধ দাস নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে। নানা বিষয়ে দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গ আলাপ-আলোচনা হত। প্যারীমোহনের অন্তরেও ছিল প্রবল অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা। শ্রীরামকৃষ্ণদেব-সদৃশ কোন আধ্যাত্মিক পরমপুরুষের সন্ধানে তাঁর চিত্ত ব্যাকুল হত। সুবোধ তাঁর আকুলতা লক্ষ করে তাঁকে জানান এক মহামানবের কথা এবং দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন যে তাঁর কাছে গেলে প্যারীমোহনের সমস্ত জিজ্ঞাসার অবসান ঘটবে। প্যারীমোহন একথা শুনে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন তাঁর দর্শনলাভের আকাঙ্ক্ষায়। মেডিক্যাল ফাইনাল পরীক্ষা তখন আগতপ্রায়। স্থির হলো, পরীক্ষা দিয়েই চলে যাবেন পাবনার হিমাইতপুরে, সুবোধের ‘ঠাকুর’-দর্শনে। বাড়িতে চিঠি দিয়ে প্যারীমোহন জানালেন যে পরীক্ষা শেষ হলে হিমাইতপুরে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র-দর্শনে যাবেন, সেহেতু বাড়ি যেতে কয়েকদিন দেরি হবে।
উনিশশো বিশের দশকের মধ্যভাগ-আনুমানিক ১৯২৪ কিংবা ১৯২৫ খৃষ্টাব্দ। তরুণ প্যারীমোহন পৌঁছলেন হিমাইতপুরে। সেখানে পৌঁছনোর পর তাঁর অনুভূতিটি হল-যেন কত যুগের পর নিজের জায়গায় এসে পৌঁছলেন। আশ্রমে তখন অবিশ্বাস্য বিপুল কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠার যুগ; অর্থ এবং পরিকাঠামোর সর্ববিধ অভাব সত্ত্বেও নিষ্ঠা, ভালবাসা এবং উদ্দীপনার শক্তিতে আশ্রমে তখন বহু অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে। আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে রীতিমত কায়ক্লেশে দিন চলে আশ্রমিকবৃন্দের -কিন্তু উৎসাহের প্রাবল্যে সে ক্লেশও আনন্দময় সকলের কাছে। প্যারীমোহনের নবীন প্রাণ সে আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভরে উঠল। আশ্রমের অধিবাসী সকলের অন্তরঙ্গ আপ্যায়ন, ঠাকুর-জননী মাতা মনোমোহিনী দেবীর দৃঢ় ব্যক্তিত্বপূর্ণ কোমল স্নেহ, আশ্রমের আশ্চর্য কর্মোদ্দীপনা, সবকিছুই তাঁকে মুগ্ধ, অভিভূত করে তুলল। সর্বোপরি আশ্রমের প্রাণ-কেন্দ্র ঠাকুরের ভালবাসার অমৃত-স্পর্শে ঘটে গেল যেন জন্মান্তর! আশ্রম ছেড়ে, ঠাকুরকে ছেড়ে আর কোথাও যাওয়ার কথা তাঁর আর মনেই এল না। ওদিকে পিতা প্রসন্নকুমার তাঁর মেধাবী কনিষ্ঠ পুত্রের বিলেতযাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ করে রেখেছেন, সেখান থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রের উচ্চতর পাঠ সমাপ্ত করে পুত্র প্রথিতযশা চিকিৎসকরূপে দেশবাসীর সেবা করবে-এই ছিল তাঁর অভিপ্রায়। হিমাইতপুর আশ্রম এবং ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সম্বন্ধে তখন নানাবিধ জনশ্রুতি ছিল- তাতে খ্যাতির চেয়ে অপবাদই ছিল বেশি। একটি বিশেষ প্রচলিত জনরব ছিল- অনুকূলচন্দ্র এবং তাঁর জননী সম্মোহনবিদ্যায় পারদর্শী, আশ্রমে কেউ গিয়ে পড়লেই তাকে সম্মোহিত করে স্থায়িভাবে বেঁধে ফেলেন আশ্রমের সঙ্গে। প্যারীমোহনের হিমাইতপুরে দীর্ঘদিন অবস্থিতি তাঁর পরিজনদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠল। অবশেষে পিতা প্রসন্নকুমার জ্যেষ্ঠ পুত্র কিশোরীমোহনকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
আশ্রমে যাওয়ার পরে সেখানকার সবকিছু সাক্ষাৎভাবে দেখে-শুনে-বুঝে, ঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁরা বহুশ্রুত সম্মোহন-বিদ্যার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারলেন। বুঝলেন, সম্মোহনী শক্তির মূল স্বরূপ হল সীমাহীন ভালবাসা। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তাঁর সান্নিধ্যে আগত যে-কোন মানুষকে এমন ভালবাসতে পারেন, তেমন বুঝি মানুষ নিজেকেও ভালবাসতে পারে না। সুতরাং যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, তার পক্ষে ঐ আশ্চর্য ভালবাসার অমৃত আস্বাদন একবার লাভ করার পরে আর তা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। অতঃপর প্যারীমোহন তো বটেই, তাঁর পিতা প্রসন্নকুমার এবং অগ্রজ কিশোরীমোহনও মহারাজ অনন্তনাথ রায়ের মাধ্যমে সৎনামে দীক্ষা গ্রহণ করে তৃপ্ত হলেন।
প্রসন্নকুমারের কাছে শ্রীশ্রীঠাকুর প্যারীমোহনকে ইংল্যাণ্ডে পাঠানোর অভিপ্রায়ের কথা জেনে বলেন-ওকে বিলেত পাঠানোর আপনার যে উদ্দেশ্য, অর্থাৎ চিকিৎসা- বিদ্যায় অধিকতর পারদর্শিতা লাভ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক মানুষের স্বস্তিবিধান, সে উদ্দেশ্য যদি এখানে এই আশ্রমেই সিদ্ধ হয়, তাহলে আপনার ওকে এখানে রাখতে আপত্তি নেই তো? প্রসন্নকুমার জানান যে সেরকম হলে তাঁর কোন আপত্তি নেই। ঠাকুর তখন ভারী মধুর কোমল ভঙ্গিমায় আবদার করে তাঁর কাছে প্যারীমোহনকে চেয়ে নেন। প্রসন্নকুমার কনিষ্ঠ পুত্রকে শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণে সমর্পণ করে ফিরে যান।
প্যারীমোহনের শুরু হল অন্য জীবন-এক অনন্য জীবন। নামধ্যান- সাধনভজনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে তেমনই অধীত চিকিৎসাবিদ্যার বাস্তব প্রয়োগ হতে থাকে ঠাকুরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। ঠাকুর- পরিবারের এবং আশ্রমিকবৃন্দের চিকিৎসা তো করতেনই, আশেপাশের গ্রামেগঞ্জেও অসুস্থ আতুর মানুষের বলভরসা হয়ে ওঠেন ডাক্তার প্যারীমোহন। ঠাকুরের সাহচর্যে ও সদাসতর্ক নির্দেশনায় তাঁর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্তর্দৃষ্টি প্রস্ফুটিত হতে থাকে। চিকিৎসা পদ্ধতির বৈচিত্র্য, বিস্তার এবং গভীরতা-সবদিকেই শ্রীশ্রীঠাকুরের বোধিসম্পন্ন নির্দেশনায় ও পরামর্শে তাঁর দক্ষতা ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে।
দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ, সুপুরুষ প্যারীমোহন বিশেষ যে বাকপটু ছিলেন, তা নয়। খুব সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন সেবা ও কর্মের মূর্ত প্রতীক। প্রতি মুহূর্তে ঠাকুরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং ঠাকুরের নির্দেশ অনুযায়ী চিকিৎসা এবং অন্যান্য নানাবিধ কর্মসম্পাদনের মধ্য দিয়ে তাঁর ইষ্টায়িত চরিত্র ফুটে বেরোত। ঠাকুরও কখনও শাসনে কখনও আদরে তাঁর এই নিত্য সহচরটিকে বৃহত্তর মঙ্গলের দিকে পরিচালিত করতেন।
১৯৪১-এর এক শীতের সকাল। শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তবৃন্দ-বেষ্টিত হয়ে বসে ছিলেন। সে সময় প্যারীমোহন উপস্থিত হয়ে কথায় কথায় বলেন যে এক টাইফয়েড রোগীকে অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে ঠাকুর-প্রদত্ত ফর্মুলায় প্রস্তুত ‘এ্যাজামঞ্জিট’ দিয়ে খুব উপকার পাওয়া গেছে। শুনে ঠাকুর সন্তোষ প্রকাশ করলেন। এ প্রসঙ্গে সুচিকিৎসা বিষয়ে প্যারীমোহনকে ঠাকুর মূল্যবান উপদেশ দিয়ে বলেন যে ভাল চিকিৎসক হতে গেলে রোগ এবং রোগীর বিষয়ে সম্যক বিশ্লেষণ প্রয়োজন; case-note বা চিকিৎসার বিবরণ নিজের মত করে লিখে রেখে মাঝে মাঝে সেগুলি পড়া, তা নিয়ে ভাবা এবং আরও ভাল ফল কীভাবে পাওয়া যেতে পারে তার উপায় চিন্তা করা দরকার। ঠাকুর আরও বলেন-বিভিন্ন শ্রেণীর অসুখের বিবরণ বিভিন্ন অধ্যায়ে বিন্যস্ত করে লিখে রাখলে দরকারমত খুঁজে পেতে সুবিধা হয়। লিখে না রাখলে সব কথা মনে থাকে না। নতুন কিছু পড়লে তার মধ্যকার প্রয়োজনীয় অংশও লিখে রাখতে হয়। এছাড়া সহকর্মীদের পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে একজন অপরজনের কাছে অনেক কিছু শিখতে পারে।
প্যারীমোহন বলেন-শেখবার বুদ্ধি তো বড় কারও দেখি না, প্রত্যেকেই এক এক জন মাতব্বর। বললেও শুনতে চায় না, হীনম্মন্যতায় ভরা।
ঠাকুর কিন্তু এ কথার উত্তরে প্যারীমোহনের নিজের দায়িত্বই স্মরণ করিয়ে বলেন যে প্যারীমোহনের ভিতরে ছাত্রত্বের বোধ জাগরূক থাকা প্রয়োজন। তাহলে শ্রদ্ধা ও আগ্রহভরে অপরের কথা শুনে তার মধ্য থেকে গ্রহণীয় যা তা গ্রহণ করে তার বিহিত প্রয়োগে সুফল পাওয়া সম্ভব। এবং এভাবে কোন সুফল পেলে যে- ব্যক্তির কথা শুনে উপকার হয়েছে, সকলের কাছে তার উন্মুক্ত ভাবে প্রশংসা করলে তার মধ্যে কোন হীনম্মন্যতা যদি থেকেও থাকে, তা দূর হয়, এবং সে-ও তখন ছাত্রভাবে প্যারীমোহনের কাছ থেকে শুনতে বা শিখতে পারে। কিন্তু আগে নিজেকে নমনীয় করতে হয়, নিজে অনমনীয় হলে অপরকে নমনীয় করা যায় না।
প্যারীমোহন বলেন যে অনেকে ভুল পরামর্শ দিয়েও তাদের পরামর্শ গ্রহণ না করলে অহংবশত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। ঠাকুর মাধুর্য-মণ্ডিত ধীর গম্ভীর ভঙ্গীতে বলেন- ভুল বলে যেটা বোঝ, সেটা গ্রহণ করতে যাবে কেন? কিন্তু সেখানে সরাসরি বিরোধিতা না করে, তোমার positive experience যেটা কারণসহ সেইটে মিষ্টি করে বলবে, with all respect to the person। ন্যায়সঙ্গত কথাও যদি তুমি অকারণ রূঢ় ও রাগতভাবে বল, তা মানুষ শুনতে চাইবে না। আবার নিজের মেজাজ ঠিক রেখে, অন্যের মেজাজের প্রতি লক্ষ রেখে খেলিয়ে-খেলিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে তুমি কিন্তু অনেক কথা বসিয়ে দিতে পার তার মাথায়। নিজের উপর নিজের লাগাম যদি ঠিক না থাকে, তাহলে আর কাউকে কিন্তু তোমার পথে আনতে পারবে না। তোমার পথে মানে কল্যাণের পথে, সত্যের পথে, সত্তা-সম্বর্দ্ধনার পথে, অভ্রান্তির পথে, বিজ্ঞানের পথে; আর, সে-পথ সবারই পথ। আমাদের অহং-এর খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মানুষ যেন আমাদের অনুসৃত সত্যপথ হতে বঞ্চিত না হয়। ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’। মানুষের জানা যদি বিহিত বিনয়-সমন্বিত না হয়, তবে সে-জানা দিয়ে সে অন্যকে উদ্বুদ্ধ ও উচ্চেতিত করে তুলতে পারে না। বিনয় মানে বিশেষভাবে নিয়ে যাওয়া। তুমি তোমার পরিবেশকে তোমার জানার রাজ্যে যদি নিয়ে যেতে চাও, তবে প্রতিটি বিশেষকে বিশেষভাবে অনুধাবন করে বিশিষ্ট পথে ঘটিয়ে তুলতে হবে তা। বিদ্যা আছে, অথচ বিনয় অর্থাৎ বিনয়ন কৌশল নেই, তার মানে সে-বিদ্যা আয়ত্ত হয়নি- তোমার। এই বিনয় মানে কিন্তু একটা নির্জীব নরম ভাব নয়। যেখানে, যখন, যে-ক্ষেত্রে, যার সঙ্গে যেমনতর ব্যবহার করলে তুমি তাকে তোমার আদর্শ ও উদ্দেশ্যানুগ পন্থায় আনতে পারবে, তেমনতর আচরণটাই বিনয়। তাই বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ নানাক্ষেত্রে নানারকম হতে পারে। তবে তার সঙ্গে থাকা চাই দরদ ও শ্রদ্ধা। তা কিন্তু সাধারণত মানুষের মনকে স্পর্শ করেই।
প্যারীমোহন জানতে চান-বিনয়ের expression নানারকম হতে পারে, সে কেমন?
শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যে বলেন-আমার নিজের কথাই বলি। সে ভারি মজার কাণ্ড হয়েছিল। তখন আমি ডাক্তারি করি। একবার এক রোগীর বাড়ি থেকে ক’দিন খবরও দেয় না, ওষুধও নিয়ে যায় না। অথচ বলবৎ রোগী। আমি ভেবে-ভেবে সারা। নিজে যে যাব, সে ফুরসতও নেই। ওরাও আসে না। উৎকণ্ঠায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। শেষটা তিন দিন পরে রোগীর বাড়ি থেকে ওষুধ নিতে এলো। লোকটাকে দেখে প্রথমে রোগীর খবর নিলাম, তারপর রেগে আমি এইসান গালাগালি শুরু করে দিলাম, সে আর কথা কবে কী? আমাকে তিনদিন ধরে এতখানি দুশ্চিন্তায় ভুগিয়েছে, আমিও মনের ঝাল মিটিয়ে বকলাম। যা মনে এলো, বললাম। সে-বলার মধ্যে উদ্দেশ্য ছিল তাদেরই মঙ্গল। আমার বকা খেয়ে সে বলে, ‘বাবু! আপনি আর একটু গালান। আমার ঘাট হইছে বাবু, আর এমন করব না। তবে গালমন্দ যে এত মিঠে লাগে আমার জানা ছিল না, আপনি আর একটু গালান। আপনার মুখে কথাগুলি কত ভাল শোনালো, আর কেউ আমাকে এমন কথা ক’লি তার ঘাড়ডা আমি ছিঁড়ে ফেলতাম না এতক্ষণ! কিন্তু আপনি কেমন সুন্দর করে কলেন।’ তখন আমার মনে হলো পরমপিতা তাহলে আমাকে গালাগালি দিতে শিখিয়েছেন বটে। এখানে গালাগালিই কিন্তু তাকে ঈপ্সিত বোধে উপনীত করে দিয়েছে। তাই এটা বিনয়বহির্ভূত নয়। তবে এ বড় কঠিন ব্যাপার। পট করে যদি নকল করতে যাও, কেউ ঘাড়টাই ছিঁড়ে ফেলতে পারে। তবে এইটুকু লক্ষ রাখবে, যদি কোথাও তিক্ত কথাও বলা প্রয়োজন হয়, তা বলবে যথাসম্ভব হৃদ্য করে। চটে আত্মহারা হয়েছ কি আর মাত্রা ঠিক রাখতে পারবে না, তখন আর মানুষকে পথে আনতে পারবে না। তোমার ক্রোধের সংস্পর্শে তারও ক্রোধের উদ্দীপন হবে। মনের যে-দরজা খোলা থাকলে মানুষ ভাল কথা মাথায় নিতে পারে, সে-দরজায় তখন কপাট পড়ে যাবে। তখন তুমি লাখ ভাল কথা কও, তা তার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। সে ভাববে, তুমি তাকে খাটো করবার জন্য সব কথা বলছ। তাই, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে খুব হুঁশিয়ার।
প্যারীমোহন ঈষৎ চিন্তিতভাবে বলেন-অতো হিসাব করতে গেলে তো কাজ করাই মুশকিল।
ঠাকুর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসে বলেন-ঐখানেই তো বাহাদুরি প্যারীচরণ! ঐখানেই তো বাহাদুরি! ‘প্যারীমোহন’ নামটি আদর করে ঠাকুর ‘প্যারীচরণ’ করে নিলেন। এরপরে গুরুত্ব সহকারে একটু গম্ভীর স্বরে বললেন-কার্যক্ষেত্রে সংঘাতের মধ্যে পড়ে কার কতখানি মাথা ঠিক থাকে, সেইটেই তো চরিত্রের পরখ। আর, কাজের কোন মানে হয় না, সে-কাজের সঙ্গে যদি আত্মনিয়ন্ত্রণবুদ্ধি না থাকে। সে কাজ তখন ভিতরে-বাইরে জঞ্জাল সৃষ্টি করে। নিরখ-পরখ ঠিক রেখে কাজ কোরো, দেখবে, সে-কাজে নিজেও শান্তি পাবে, অন্যকেও শান্তি দিতে পারবে। একদিনেই মানুষ নির্ভুল হয়ে যায় না, তবে ভুল সংশোধনের দিকে লক্ষ থাকলে আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে আসে। ইষ্টপ্রীতিকে লক্ষ করে কাজ করলে প্রত্যেকটা কাজ হয় তাঁর আরতি-বিশেষ। সেখানে অহমিকা বা প্রবৃত্তি বেশি মাথাতোলা দিতে পারে না। তাই দ্বন্দ্ব, বিরোধ, বিরক্তি, দম্ভ, বিদ্বেষ স্বতঃই প্রশমিত হয়। মানুষ কঠোর, ক্ষিপ্র, অনন্তকর্মা হয়েও হয় নিরভিমান ও নির্বিরোধ। তাই বলে সে অন্যায়ের সঙ্গে কিন্তু আপোষ করে না, দৃপ্ত বিনয়ে প্রতিরোধ করে সেখানে। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে থাকে এমন একটা ঔজ্জ্বল্য যা মানুষের অন্তরের জটিল অন্ধকারকে আলোকিত করে তোলে। তেমনি হলে তুমি যা খুশি তাই করতে পার। তখন তোমাকে দেখে লোকে বলবে- যাদুকরের ছেলের মত প্যারী কত রঙ্গ জানে!
শেষ পংক্তিটি মাথা দুলিয়ে গানের মত সুর করে গাইলেন ঠাকুর। তারপর হেসে লঘু স্বরে বললেন-অনেক বকাইছ, এইবার ভাল করে এক কলকে তামাক খাওয়াও।
প্যারীমোহন দ্রুত তামাক সেজে দিলেন। অন্তর তাঁর ভরে গেল ঠাকুরের প্রীতিপ্রসন্ন সংশোধনী কথায়, মনে এল অনন্য আত্মবিশ্বাস।
আর এক বার একজন রোগীর চিকিৎসা সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর প্যারীমোহনকে বলেন-যে-সব complication আসেনি, অথচ আসতে পারে, সেগুলির পথ আগে থাকতে বন্ধ করে দিতে হয়। তাছাড়া রোগীর system টাও মোটামুটি বোঝা দরকার, যাতে একটা কষ্ট কমাতে গিয়ে আর একটা কষ্ট না বাড়ে। চারিদিকে নজর রেখে এমনভাবে treatment করতে হয়, যাতে সর্বাঙ্গীণ সুস্থতা ও স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। একদিক সামাল দিতে আর একদিক বেসামাল হয়ে গেল, সেটা সামলানো হল তো অন্যদিকে বেতাল হল, এভাবে একটার পর একটা ওষুধ চলতে লাগল, এ কিন্তু ভাল চিকিৎসকের লক্ষণ নয়। তাছাড়া অস্বাভাবিক জলদিবাজি বা ঢিলেমি, কোনটাই ভাল নয়। রোগকে কাবু করা ও ভিতরের শক্তি উজ্জীবিত করে তোলা-দু’দিকেই নজর দিতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবহার এমন দরদী ও উদ্দীপনী হওয়া চাই যাতে রোগীর অন্তর্নিহিত curative urge flare up করে ওঠে।
এভাবে ঠাকুর প্যারীমোহনকে সবদিকে দক্ষ আদর্শ চিকিৎসকরূপে গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
দেওঘরে আসার কিছুকাল পরে ১৯৪৮-এর প্রথমদিকে প্যারীমোহন একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশ কিছুদিন রোগভোগের পর কোনমতে উত্থানশক্তি লাভ করামাত্র গাড়ি করে ঠাকুর-দর্শনে আসেন। অসুস্থ থাকার জন্য ঠাকুরের কাছে আসতে পারেননি এতদিন, অসুস্থতার যন্ত্রণার চেয়েও সে-যন্ত্রণাই যেন তাঁর বেশি। কোনক্রমে গাড়ি থেকে নেমে ঠাকুরের সামনে পৌঁছতেই ঠাকুর সোল্লাসে বলে উঠলেন-তুই আলি?
প্যারীমোহন অতি কষ্টে প্রণাম করলেন। স্নেহে ও মমতায় ঠাকুরের মুখখানি আর্দ্র হয়ে উঠল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা সবিস্তারে খোঁজ নিতে লাগলেন। কথায় কথায় প্যারীমোহন জানালেন যে কানে ভাল শুনতে পাচ্ছেন না, শ্রবণশক্তি নষ্ট না হয়ে যায়!
ঠাকুর উদ্দীপ্তভাবে বলেন-তোর অতখানি vital urge and energy, তাই ঠিক আছিস। তোর মত অমন strong brain কজনের আছে? সোজা কথা? তোর কান যাবে কী করে? ঐ অবস্থায় তুই নাম করেছিস!... তোর মত কজন পারে? পরমপিতার দয়ায় তুই সেরে উঠলি বলে। আর তোর কত কাজ, তোর কি পড়ে থাকলে চলে? তাড়াতাড়ি ঠেলে ওঠ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের বচন-শক্তিতে প্যারীমোহন তৎক্ষণাৎ যেন অনেকখানি উজ্জীবিত ও সুস্থ হয়ে উঠলেন। তাঁর চেহারা বদলে গেল। ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁকে প্যারীমোহন বললেন-আমার খুব অবনতি হয়েছে, নইলে ঠাকুরের কথা কখনও বিস্মরণ হবার মত হয়? মাঝে কিছুই যেন আমার মাথায় ছিল না। সবই যেন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
তা শুনে ঠাকুর সবিস্ময়ে বলেন-বলিস কী? শুনিস পরে-কী অসম্ভব কাণ্ড তুই করেছিস।...
ঠাকুরের মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল কিছুদিন ধরে; প্যারীমোহন জানতে চাইলেন, ঠাকুরের মাথাধরা কেমন আছে। ঠাকুর জানালেন- আছে, তুই ভাল হ। প্যারীমোহন বলেন-আমি ভাল হলে তো আপনার মাথাধরা কমবে না। ঠাকুর জবাব দেন- তুই ভাল হলে আমাকে ভাল করে দেখতে পারবি। ঠাকুরের অমন অন্তরঙ্গ আকুলতা এবং উদ্দীপনায় প্যারীমোহনের প্রাণশক্তি বহুলাংশে সঞ্জীবিত হয়ে উঠল।
১৯৫০-এর এক গ্রীষ্মের সকালে ঠাকুর দেওঘরে যতি-আশ্রমের বারান্দায় বসে কয়েকটি বাণী প্রদান করছিলেন। সম্মুখে বিশিষ্ট ভক্তবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। প্যারীমোহন সেখানে এসে ঠাকুরকে প্রণাম করে দাঁড়ালেন। ঠাকুর তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। প্যারীমোহন জানান যে কলকাতায় তিনি কতগুলি ওষুধের কথা লিখেছিলেন-সেগুলি ঠিক লেখা সত্ত্বেও তারা জানিয়েছে যে ভুল লেখার জন্য তারা ওষুধ পাঠাতে পারেনি। এভাবে তাঁর প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ঠাকুর মিষ্টি করে বলেন-মানুষ না পেরে দোষ দেয় ভগবানকে। তুই চটিস কেন? তোর ওপর দোষ দিয়ে ওরা বাঁচতে চায়।
এ কথা শুনে প্যারীমোহনের ক্ষোভ অনেকখানি প্রশমিত হয়। প্রসন্নভাবে বলেন -আমিও তো দোষ থেকে বাঁচতে চাই, কিন্তু যেখানে দোষ দেখি না, সেখানে দোষ শোধরাব কী ভাবে? তা সত্ত্বে অন্যে দোষ দিলে তাকেই বা বোঝাব কী ভাবে?
ঠাকুর আরও মধুর স্বরে বলেন, তোর তা দিয়ে কাজ কী? তুই ভগবানের কোলে থাক।
এমন আদর-মাখানো কথায় প্যারীমোহনের সব বিরক্তি, ক্ষোভ দূর হয়, হাসিভরা মুখে সেখান থেকে বিদায় নেন।
ঠাকুরের পরিপার্শ্বস্থ অনেকে নানা প্রশ্নের মাধ্যমে নিজেদের বুঝটা পাকা করে নিতেন। ১৯৪৯-এর এক হেমন্তের বিকেলে শ্রীশ্রীঠাকুর দেওঘরে বড়াল-বাংলোর বারান্দায় তক্তাপোষে বসে ছিলেন-সামনে উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য, শরৎচন্দ্র হালদার, সুরেন বিশ্বাস, প্রফুল্লকুমার দাস প্রমুখ আরও কয়েক জনসহ প্যারীমোহনও। কোন্ কাজ মানুষ বাহবার প্রলোভনে করে এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল। শরৎচন্দ্র হালদার কথাপ্রসঙ্গে বলেন যে বাহবার প্রলোভন তাঁদেরও আছে। ঠাকুর তখন বলেন যে যতজনে বাহবা দিক, তাঁর অর্থাৎ ইষ্টের তৃপ্তিজনিত বাহবা পেতে ভাল লাগা ভাল।
শরৎচন্দ্র বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়ার উদ্দেশ্যে জানতে চান যে এমনিতে হয়তো কারও জন্য কিছু তিনি করেন না, কিন্তু ঠাকুরের কাছে বাহবা পাওয়ার লোভে তাঁকে দেখিয়ে লোকের জন্য যদি করেন, সেটা কেমন হয়?
ঐরকম চলনের মধ্যে ইষ্টকেন্দ্রিকতার অভাব এবং প্রবৃত্তির তাড়না থাকে বলে শ্রীশ্রীঠাকুর অভিমত প্রকাশ করেন। এর পরে প্যারীমোহন বলেন-সুরেনদা (বিশ্বাস) আমার কাছে পাঁচটা টাকা চাইলেন, তাঁকে দিলাম না। আপনি তাঁর জন্য যখন চাইলেন, তখন দিলাম, এতে দোষ কী?
ঠাকুর নিষ্ঠাবান শিক্ষকের মত আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে বলেন-তার মানে আমি তোমার মধ্যে জীবন্ত নই। আমি তোমার প্রবৃত্তি-পূরণের ইন্ধন। আমি কষ্ট করে তোমাকে বলব, তবে তুমি দেবে। আমার উপর টান থাকলে, তুমি সুরেন যখন প্রয়োজনপীড়িত হয়ে চাইল, সামর্থ্য থাকলে তখন তাকে না দিয়ে পারতে না। এই বোধের থেকেই সুরেনকে দিতে যে তার সত্তারূপে পরমসত্তাও বিদ্যমান। ঠাকুরকে ভালবাসা মানেই নিজের ও সবার সত্তাকে ভালবাসা ও পুষ্ট করা। যা-কিছু করবে, করবে আমার প্রীত্যর্থে। আমাকে বা লোককে দেখিয়ে করবার বুদ্ধি যদি হয়, তবে বুঝতে হবে আমাকে তুমি ভালবাসনি। আমার সম্বন্ধে কোন বোধ বা দরদ তোমার গজায়নি। তাই, আমার চলনও তোমার চরিত্রে ফুটে উঠছে কম। যে পরমপিতাকে ভালবাসে, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসও অজ্ঞাতসারে সবার কল্যাণ করে। কারণ, পরমপিতা চান প্রত্যেকের সাত্বত কল্যাণ। যখন মানুষের জন্য এইরকম বোধ ও সেবা জাগে, তখন সত্যিকার আত্মপ্রসাদ জিনিসটা আসে; আমার ঠাকুর যেন তখন আমার ভিতরে জেগে থাকেন-আমার বিকশিত হৃৎপদ্মে-শান্তিতে, সুখে, হর্ষে। আমার স্বতোৎসারিত ইষ্টপ্রাণ সেবা নন্দিত করে তাঁকে নিত্যনিয়ত। তৃপ্তি পাই আমরা, তৃপ্তি পায় পরিবেশ। তখন জীবনটা যেন আনন্দে ফুটে ওঠে। এতে আত্মপ্রসাদ হয়, কিন্তু সেবার অহং আসে না। শক্তি আসে, সংহতি আসে, আসে সম্বর্ধনা। ছোট স্বার্থ ছুটে গেলে পরে দেখবে, এক ঝাঁকিতে কত যোজন পেরিয়ে যাবে।
এরপর আরও কিছু কথাবার্তা হওয়ার পরে প্যারীমোহন পরিষ্কারভাবে জানতে চান-প্রত্যেক আমার ঠাকুরের প্রতিমূর্তি ভেবেই তো সেবা করা উচিত।
স্নিগ্ধ স্বরে ঠাকুর উত্তর দেন-গোড়ায় ঐ কথা ভাবা সবার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত নাও হতে পারে। ওটা পরে স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে ইষ্টানুরাগের সার্থক পরিণতি হিসাবে। ভাবতে হয় আমার ভিতরে ঠাকুর আছেন, তাঁর traits আছে, তিনি জীবন্ত আছেন। এই মানুষটি প্রয়োজনপীড়িত, এর জন্যে না করলে অন্তরের ঠাকুর আমার উপোসী থাকবেন। আবার, এভাবেও হয়-আমার ঠাকুর প্রত্যেকের কষ্টে ব্যথিত হন, প্রত্যেকের সেবা করেন, আমি যদি এর জন্য না করি, ঠাকুরের কষ্ট বাড়বে। তাই এর জন্য করাই আমার একান্ত কর্তব্য। তার ভিতর দিয়ে শিবজ্ঞানে জীব সেবা সত্যিকার হয়ে উঠবে। অর্থাৎ সম্বোধি নিয়ে জেগে উঠবে।
এভাবে নানাদিক থেকে প্রশ্ন করে প্যারীমোহন পরম দ্রষ্টা শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছ থেকে জীবন-চলনার দিক্ নির্দেশ লাভ করেতেন।
আর একবার ঠাকুর-সন্নিধানে অন্যান্য ভক্তদের সঙ্গে প্যারীমোহন উপস্থিত ছিলেন। ভক্তবর প্রফুল্লকুমার দাসের সদ্গুরুর লক্ষণ বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর বলেন যে সদ্গুরুর প্রধান লক্ষণ-তিনি তাঁর গুরুতে সর্বতোভাবে সংন্যস্ত হবেনই। তাঁর করা, বলা এবং ভাবার মধ্যে ফারাক থাকে না। তিনি পূর্বতনদের প্রতি নিত্যপ্রণত এবং প্রতি-প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যশালী। অলৌকিকতার আশ্রয় গ্রহণ না করে তিনি মানুষকে সহজ পথে এমনভাবে পরিচালনা করেন যাতে তাদের চারিত্রিক বিকাশ ঘটে। মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী করে তোলার দিকেই থাকে তাঁর সবচেয়ে বেশি ঝোঁক।
প্যারীমোহন জানতে চান যে কারও ভিতরে ঐসব লক্ষণ আছে কি না, তা বাইরে থেকে কীভাবে বোঝা সম্ভব।
ঠাকুর সহাস্য মুখে বলেন-নজর করলেই বোঝা যায়। সদ্গুরুর অহংটা হয় অত্যন্ত পাতলা। অপরকে সওয়া-বওয়ার শক্তি তাঁর থাকে অসীম। নিজের গুণগান করার অভ্যাস তাঁর খুবই কম থাকে। অপরকে বড় করাই তাঁর সুখ। আত্ম-প্রতিষ্ঠার বালাই তাঁর থাকে না। আদর্শ প্রতিষ্ঠাই তাঁর একমাত্র ধান্দা।
এরপরে ললিত ভঙ্গিমায় গানের সুরে বলেন-তাঁর আছে অনেক নিশানা- নয়নে তাঁর যায় যে চেনা। তাঁর character হয় abnormally normal। তাঁরা যেন প্রকৃতির শিশু। তাঁদের মধুর ব্যক্তিত্ব মানুষকে স্বতঃই মোহিত করে।
ঠাকুরের ভাবে, ভঙ্গিতে, কথায় এমন প্রীতি, লালিত্য এবং গভীরতা ঝংকৃত হয়ে উঠল যে সমগ্র পরিবেশে তা সঞ্চারিত হয়ে গেল। উপস্থিত অন্যান্য সকলের সঙ্গে প্যারীমোহনের সত্তাও আবিষ্ট হয়ে উঠল অপরূপ ভাবতরঙ্গে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি বিষয় ছিল প্যারীমোহনের তত্ত্বাবধানে। তাঁর তামাক সেজে দেওয়া, সুপুরি এগিয়ে দেওয়া, জামাকাপড় গোছ করে রাখা, নখ কাটা, বিহিত সেবার মাধ্যমে তাঁর ঘুম আসতে সাহায্য করা-সব কিছুই ছিল প্যারীমোহনের নিত্য কর্ম। সম্ভবত অতিমাত্রায় সক্রিয় এবং সূক্ষ্ম চেতনার দরুন ঠাকুরের ঘুম খুব সহজে আসত না। প্যারীমোহন কখনও পায়ে হাত বুলিয়ে, কখনও খুব মৃদুভাবে শরীরটি ঝাঁকিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়াতেন। এক রাতে এভাবে অনেক চেষ্টাতেও ঘুম আসছে না। প্যারীমোহন ঘুম না আসার কারণ জানতে চাইলে ঠাকুর বলেন-পাঁচশ বছর পরে কাকে কোথায় রাখব তাই ভাবছি। সচরাচর অন্য কারও সামনে তিনি এরকম কথা বলতেন না-প্যারীমোহনকে যোগ্য আধার অনুধাবন করেই এমন অন্তরঙ্গ গূঢ় উক্তি তাঁর কাছে করেন।
সদ্দীক্ষা ও ইষ্টে যথাযথ অনুরাগের মাধ্যমে কীভাবে মানুষকে উজ্জীবিত করে উপযুক্ত করে তোলা যায়, সে-বিষয়ে ঠাকুর সমস্ত জীবন ধরে বহুবার বহুভাবে বলেছেন। একদিন এরকম আলোচনা চলাকালীন প্যারীমোহন বলেন যে পরিস্থিতি অনেক সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করে দিতে চায়। ঠাকুর প্রত্যুত্তরে দৃঢ়ভাবে বলেন- পরিস্থিতি তোমাকে তার মত করতে চেষ্টা করবে। তোমার বৈশিষ্ট্য হল তাকে তোমার সহায়ক করে নেওয়া। দম্ভ, ঘৃণা, অহমিকা, দ্বেষ, লজ্জা, ক্রোধ এসে চেষ্টা করবে তোমাকে আত্মসাৎ করতে। তোমার কাজ হল তাদের ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠাপন্ন করে তোলা। আর সেই হল তোমার পুরুষকার। প্রতি মুহূর্তে সজাগ হয়ে এইভাবে চলাকেই বলে ধর্মাচরণ। তাই ধর্মাচরণের মূল হল ইষ্টানুগ আত্মনিয়ন্ত্রণ।
শ্রীশ্রীঠাকুর চাইতেন, তাঁর মানুষ যারা তাদের কর্মপটুতা এবং তৎপরতা হয়ে উঠুক সমীহীন। তাদের অসীম ক্ষমতাধর দেখতে পেতে চাইতেন তিনি। ঠাকুরের নিয়ত সেবা এবং পরিপার্শ্বস্থ সকলের চিকিৎসা নিয়ে প্যারীমোহন সম্পূর্ণ ব্যাপৃত থাকতেন। তা সত্ত্বেও ঠাকুর যখনই যে কাজের কথা বলতেন, বিনা বাক্যব্যয়ে তা সম্পন্ন করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু একবার ঠাকুর-প্রদত্ত একটি কাজ সম্পন্ন করে উঠতে পারেননি। ঠাকুর তাঁকে দেখে আগ্রহের সঙ্গে উজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করেন-কী রে! কাম হাসিল করেছিস তো? প্যারীমোহন বিব্রত হয়ে অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে জানালেন-এখনও সময় পেয়ে উঠিনি।
ঠাকুরের মুখখানি একথা শুনে বিষণ্ণ হয়ে উঠল, বললেন-আমার মনটা খারাপ করে দিলি। আমি তো জানি তোর সময়ের অভাব। তৎসত্ত্বেও যে আর একটা responsibility দিয়েছি, তার উদ্দেশ্য তোর efficiency ও power of quick execution যাতে বেড়ে যায়। তোরা ক্রমাগত বেড়ে চলেছিস, এইটে দেখতে পেলেই আমার খুব satisfaction হয়। সুবিধা-সুযোগের মধ্যে অনেকে অনেক কাজ করতে পারে। আমার দেখতে ইচ্ছে করে অসুবধিা সত্ত্বেও কে কত স্থিরমস্তিষ্কে তৎপরতার সঙ্গে কাজ উদ্ধার করতে পারে। আমার নিজের চরিত্রটাও ঐ রকম। বাধাবিঘ্ন বা অসুবিধাকে আমি কোনদিন ডরাইনি। তাছাড়া, পাঁচ মিনিটে যা পারি, তা আড়াই মিনিটে করা যায় কিনা দেখতাম। নিজেকে চাপের মধ্যে ফেলতে ভাল লাগত। সেইটেই যেন আমার আরাম। এখন শরীরটা অপটু হওয়ায় আগের মত পারি না।
ঠাকুরের বেদনা-বিমর্ষ মুখ দেখে এবং তাঁর কথাগুলি শুনে প্যারীমোহন মনে মনে নিজেকে আরও ক্ষিপ্রতর করে তোলার সঙ্কল্প গ্রহণ করেন।
কেউ অসুস্থ হলে ঠাকুর অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। বারবার লোক পাঠিয়ে খবর নিতেন রোগী কেমন আছে। প্যারীমোহন চিকিৎসা করতেন, তাই তাঁকে ডেকে বলতেন -তাড়াতাড়ি সারাতে পারছিস না কেন? প্যারীমোহন জবাব দিতেন- আমি তো সাধ্যমত চেষ্টা করছি, প্রত্যেকের কর্মফলও তো আছে। আমি কী করব?
ঠাকুর জোরের সঙ্গে বলতেন-মানুষের কর্মফল যদি কাটাতে না পারিস তাহলে কী হল? ঠাকুরের উদ্বেগ এবং ব্যস্ততা দেখে সে-উদ্বেগের নিরসনের জন্য প্যারীমোহন আপ্রাণ চেষ্টা করতেন যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে সুস্থ করে তুলতে। এর ফলে তাঁর মনঃসংযোগ আরও বেশি হত এবং সাফল্যও লাভ হত অধিকতর।
স্বল্পভাষী সেবক-প্রবর প্যারীমোহন ঠাকুরের নির্দেশ ছাড়া নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন কাজে হাত দিতেন না; এমন কী, নিজের বা পরিবারের কোন প্রয়োজন হলেও ঠাকুর নিজে থেকে না বললে অন্যত্র কোথাও যেতেন না। ১৯৬৯-এর জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে ঠাকুর প্যারীমোহনকে একদিন সকালে ডেকে পাঠালেন। প্যারীমোহনের স্ত্রী সেসময় অসুস্থ ছিলেন। ঠাকুর তাঁকে বললেন-বৌমার শরীর ভাল না, তুই বৌমাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখা। ঠাকুরের শরীরও বেশ কিছুদিন যাবতই অসুস্থ ছিল, যদিও সেসময়ে শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল। তাই ঠাকুর বলা সত্ত্বেও প্যারীমোহনের ঠাকুরকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। তবু তাঁর নির্দেশ পালনের জন্য স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা গেলেন। অকস্মাৎ ২৭শে জানুয়ারির ভোরে পেলেন মহাপ্রলয়ংকর সেই ভীষণ সংবাদ-শ্রীশ্রীঠাকুর ইহলীলা সম্বরণ করেছেন। দ্রুত ছুটে এলেন দেওঘরে, তবে তার আগেই সে ঐশী তনু মহাগ্নিতে বিলীন হয়ে গেছে। সমগ্র সৎসঙ্গ জগতের সঙ্গে প্যারীমোহনও মূহ্যমান হয়ে বিপুল শোকসাগরে নিমগ্ন হলেন। কিন্তু তার মধ্যেও অনুভব করলেন- পরম দয়াল অশেষ করুণায়ই তাঁকে শেষ মুহূর্তে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে যেভাবে বিশেষ কোন উপসর্গ ছাড়াই ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ঘটে, চিকিৎসক প্যারীমোহনের উপস্থিতিতে সেরকম ঘটলে চিকিৎসার ত্রুটির দায়ে হয়তো সকলের চোখে তিনি চির-অপরাধী হয়ে থাকতেন। এমন কী, তিনি নিজেও হয়তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন না।
এর পরে আরও নয় বছর ছিলেন প্যারীমোহন। পরম প্রেমময়ের স্মৃতিবিজড়িত পরিমণ্ডলে দেওঘরেই তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত হয় ঠাকুর-পরিবারের এবং আশ্রমিক ও অনাশ্রমিক বহু মানুষের চিকিৎসাকর্মের মধ্য দিয়ে। ঠাকুর তাঁকে তাঁর পিতার কাছ থেকে যে-প্রতিশ্রুতি দান করে চেয়ে নিয়েছিলেন, জীবনের শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠাভরে তা-ই রূপায়িত করে গেছেন প্যারীমোহন। ১৯৭৮-এর ১২ই এপ্রিল অল্প রোগভোগের পরে দেওঘরে তাঁর ঐহিক জীবনের অবসান হয়-প্রিয়পরমের চরণে চির-আশ্রয় লাভ করেন তাঁর নিত্য সেবক।
_____________________________________



10