🔷 ঠাকুরের প্রতি কেমন টান থাকা দরকার
🔷 আদর্শ ছারা অন্যকিছু প্রধান হ'লে কিছুই ক'রে ওঠা যায় না..
🔷 স্বস্ত্যয়নীর পাচটি principle ( নীতি )
২৩ শে আষাঢ় , সােমবার , ১৩৪৮ ( ইং ৭/৭/১৯৪১)
শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে বাঁধের ধারে তাসুতে । ধীরেনদা ( চক্রবর্তী ) শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে বসে আছেন । তার সান্নিধ্যে একটা গভীর স্বস্তি ও তৃপ্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে তার মুখে । শ্রীশ্রীঠাকুর কয়েকটা ছড়া পড়তে বললেন । একটা ছড়া পড়ার পর বুঝিয়ে বললেন — মন খারাপ হলে চিন্তার কোন কারণ নাই , মন যেদিকেই থাক , কর - বলা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে - সঙ্গে মনের অবস্থা বদলে যেতে বাধ্য , এক - নিমিষেই করা যায় , এটা আমাদের হাতের মধ্যে । তারপর আর একটা ছড়া পড়া হলো ---
‘ কাম - আবেশে স্ত্রী - পুরুষে
যেমন করে উপভােগ ,
ইষ্টকাজে বাস্তবতায়
তেমনি হ'লে তবেই যোগ "।
পড়ার পর শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — ইষ্টের কাজ করতে গিয়ে যদি কষ্ট বােধ হয় , বুঝতে হবে কোন passion ( প্রবৃত্তি ) unwilling ( অনিচ্ছুক ) আছে , uninterested ( অনন্বিত ) আছে — প্রকৃত যোগ হয়নি ; আর সত্যই কামের নেশার মতো লাগে , কমিচক্ষু গজায় । ইঞ্জিনটা , একটা বিশিষ্ট স্থানের একটা গাছ — চারিদিকের সব যেন লােলুপ দৃষ্টিতে উপভােগ করতাম । মা যাওয়ার সঙ্গে - সঙ্গে সব যেন ঝম করে নিভে গেল । আগে কত ভাল লাগতো , এখন সব আনন্দের মধ্যেও মা’র ব্যথা ভুলতে পারি না । জীবনে এক বৈষ্ণবী দেখেছি , আর দেখেছি এক সাধু , অমনটা আর দেখলাম না । বৈষ্ণবী ‘ সে ’ ‘ সে ’ বলতো , আমাকে অত্যন্ত আদর করতাে , মাঝে - মাঝে ভাবাবেশ হতো , যাত্রা - থিয়েটারের কায়দা নয় , একেবারে সহজ , সুন্দর , স্বাভাবিক । ভক্তি , বিরহ , ব্যাকুলতার একটা অনুপম অভিব্যক্তি দেখেছি তার মধ্যে । ' সে মুখে কাউকে কোন উপদেশ দিত , কিন্তু তার চলাটাই ছিল উপদেশ । লোকসমক্ষে প্রকাশ্যে সে গল্পচ্ছলে এমন করে আত্মবিশ্লেষণ করতাে যে তার থেকে অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করা যেতো । সে যখন কাদতো , একশাে লোক সঙ্গে - সঙ্গে কাদতাে , সে হাসতো , সঙ্গে - সঙ্গে সবাই হাসতো , সে ছুটলে সবাই পিছু - পিছু ছুটতাে , হয়তাে একটা গাছের কাছে গিয়ে লুকোচুরি খেলতাে , যাঁকে সে খুজছে যেন তাকে দেখতে পেয়েছে , চোখে - মুখে কেমন একটা চকিত অগ্রহ - আবেগ । কোন দিন আমার খাবার আগে খেতে বসলে জানতে পেলেই খাওয়া ফেলে উঠে যেত । সাধু আমাকে না খাইয়ে নিজে কিছু খেত না , কাউকে কিছু খেতে দিত না । মানুষ পয়সা দিলে প্রয়ােজন - মাফিক দুই - এক পয়সা নিত আর সব ফেলে রেখে যেত , ছেলেপেলেরা কুড়িয়ে নিয়ে যেত । যাবার দিন এমন চাউনি চেয়ে গেল যে , আমার বুকখানা যেন ভিজিয়ে দিয়ে গেল , বলল — বাচ্চা ! আবার দেখা হবে ।
২৫ শে কার্তিক , সােমবার , ১৩৪৮ ( ইং ১০/১১/১৯৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর পদ্মার বাঁধের পাড়ে মোড়ায় বসে আছেন । বেলা আন্দাজ নটা । কাছে অনেকে দাড়িয়ে আছেন ।
প্রফুল্ল — শুনছি , আপনি বাইরে চলে যাবেন , সবাই তো চিন্তিত ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যেতে পারি , এখন বঙ্কিম ( রায় ) সব ঠিক করে দিলে হয় ।
প্রফুল্ল — আপনার কি এস্থান ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — চারিদিকের মানুষ যে - রকম তা দেখে - শুনে মনে হয় , অন্যত্র চ'লে যাই , নচেৎ এমনি ইচ্ছা করে না ।
প্রফুল্ল — আপনি যেখানেই যাবেন সেইখানেই তাে মানুষের ভিড় জমবে , মানুষ ছেড়ে আপনি যাবেন কোথায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তবু মনে হয় , সাঁওতালরা বােধহয় আর একটু , normal ( সহজ ) , তাদের মধ্যে থাকব । বাংলার যে অবস্থা তাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করা দরকার । তিনশাে whole - time worker ( নিয়তকর্মী ) ও চারটে touring batch ( ভ্রাম্যমাণ দল ) যদি খুব খাটে বহুদিন ধরে , তবে integrated ( যুক্ত ) হ'তে পারে , consolidation ( সংহতি ) তাে পরের কথা ।
বৈকালে শ্রীশ্রীঠাকুর বেড়াতে বেরুলেন । সঙ্গে কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) প্রভৃতি । শ্রীশ্রীঠাকুর বলতে লাগলেন — আশ্রমের চেহারা এমন করে ফেলা লাগে , যাতে মানুষ charmed ( মুগ্ধ ) হয়ে যায় সব দেখেশুনে , কাত না হয়ে উপায় থাকে না । আর আপনারা পারবেনও , আপনাদের করা আছে কিনা অনেকখানি । বিমলদা — আমাদের way- তেই ( রকমেই ) সব পারি , কিন্তু অনন্যর way- তে ( রকমে ) যেতে হ'লেই মুশকিল । শ্রীশ্রীঠাকুর — হ্যা , আপনাদের way- তেই ( রকমেই ) হবে তবে with every solution of all other ways ( অন্যান্য সব রকমগুলি সমাধানের সাথে ) , সেই solution ( সমাধান) দিতে গিয়েই আপনাদের সৎসঙ্গ - আন্দোলনের সৃষ্টি — তাই ওটা আপনাদের জন্মগত অধিকার । চোর হোক , বদমায়েস হােক , লুচ্চা হােক , জোচ্চোর হােক , কিছুতেই আটকায় না যদি কিনা সব দিয়ে আমার interest ( স্বার্থ ) fulfil ( পরিপূরণ ) করে — একমাত্র fascination ( আকর্ষণ ) হ'য়ে উঠি আমি । তখন আপনার - আমার মধ্যে barrier ( অন্তরাল ) বলে কিছু থাকবে না , আমি এখানে , আপনি দিল্লীতে থাকলেও যে - কথা কবেন , সে অমা কথা , যদিও language ( ভাষা ) আলাদা হ'তে পারে । ব্যাপার তাে এতটুকু শাস্ত্রে-টাস্ত্রে যেখানে যা ’ কয়েছে , দুনিয়ায় যেখানে মানুষ বড় হয়েছে , ফেনান যত কথাই থাক , সবটুকু চুইয়ে তো ঐ স্বস্ত্যয়নীর পাচটি principle ( নীতি ) । অর্থাৎ ( ১ ) শ্রীবিগ্রহের মন্দির ভেবে শরীরটাকে সুস্থ ও সহনপট করে তুলতে হবে । ( ২ ) সচ্চিন্তাগুলিকে বিহিত - ক্রমে কাজে মুর্ত্ত করে তুলতে হবে । (৩)প্রবৃত্তির ঝোকগুলিকে ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার দিকে মোড় ফিরিয়ে দিতে হবে । ( ৪ ) পাড়াপড়শীর বাচা - বাড়াকে নিজেরই স্বার্থজ্ঞানে যাজন - সেবায় তাকে পৃষ্ট করে তুলতে হবে । ( ৫ ) নিজের অর্জনপটুতা বাড়িয়ে নিত্য যথাশক্তি ইষ্টার্ঘ্য নিবেদন করে চলতে হবে । এ সম্বন্ধে অন্যান্য করণীয় তো আপনাদের জানাই আছে । মনুতেও আছে— “ ইদং স্বস্ত্যয়নং ' বলে । গীতায় আছে— “ মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মৃদযাজী মাং নমস্কুরু মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়ােহসি মে । নীতি - ক’টি অভ্যাসে গেঁথে ফেলতে পারলে তখন আর পায় কে ? পদ্মপাদের মতাে পায় - পায় পদ্ম ফুঠতে থাকবে — দেখে - দেখে ছেলেপিলে শিখবে ।
কথায় - কথায় বললেন — এক - একটা মানুষকে সমর্থ করে তােলার জন্য কত খাটা লাগে । একজনকে খেতে দেওয়াই যথেষ্ট নয় , ধৰ্মদান শ্রেষ্ঠ দান ; তাকে এমন ক'রে তুলতে হবে যাতে সে নিজে খেতে পায় , সঙ্গে - সঙ্গে আর দশজনকে খাওয়াতে পারে । হয়তো তাকে ২ টাকা দিলে — সে তাই দিয়ে কপি কিনে বাজারে বিক্রি করল , বিক্রির পরই সবটা নিয়ে তােমাকে দিল , বার আনা লাভ হ'লাে , তুমি চার আনা তার থেকে রেখে দিলে , সে সংসারের জন্য বাকী লভ্যাংশ খরচ করলো - এইভাবে কয়েকদিনে আর ২ টাকা জমলো , ৪ টাকা দিয়ে ব্যবসা চললো — এমনিভাবে বাড়তে লাগল । কয়েক দিনের পর ১ টাকা দিয়ে একদিন হয়তো ছেড়ে দিয়ে দেখতে হয় — সে ফিরিয়ে আনে কিনা । তখন বোঝা যায় , মানুষটা কেমন । সাধারণতঃ পিছনে - পিছনে থাকা দরকার । যদি ফাকি দেয়— তার পেট তো আছে , ক্ষিদে তাে আছে , ওরই তাড়ায় অভাবে প'ড়ে পরে একদিন হাজির হবেই , তখন সমঝে দিতে হয় , বুঝিয়ে দিতে হয় — ক'রে পাওয়াটা কত সহজ ও স্বাভাবিক , সে যা করেছে তার চাইতে সুবিধাজনক । পাইয়ে দিয়ে পাওয়ার পথ ধরিয়ে দিতে হয় । না করলে বােঝে না , এতেও যাদের না হয় , তাদের বুঝতে হবে , জন্মগত ন্যূনতা আছে । অনেক মানুষ হয়তাে বরবাদ যাবে ।
রাস্তায় যাদের সঙ্গে দেখা হ'লাে , শ্রীশ্রীঠাকুর তাদের কাছ থেকে নানা খবর - বার্ত্তা নিলেন ।
কথা বলতে - বলতে কাশীপুরের রাস্তায় হাটতে লাগলেন ।
প্রফুল্ল — অন্ততঃ পেট চালাবার জন্যই তাে মানুষকে কতকগুলি নীতি মেনে চলতে হয় , কিন্তু কত মানুষ তো আজীবন ধাপাবাজি করে কাটায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — পারিপাশ্বিকই তাকে শিক্ষা দেয় , ফাকি দেবার পথও রুদ্ধ হ'তে ভিতরে weakness- এর ( দুর্ব্বলতার ) দরুন ভয় থাকে ।
আমার ইচ্ছা ছিল , তপােবনে practical ( হাতে - কলমে ) কাজের উপর দাড়িয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে । হয়তো কৃষি করলাে , সেই সম্পর্কিত যা ’ - যা ’ থাকে , লাগল । শিখলো , theory ( পরিকল্পনা ) বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে নিয়ে যাবে , একটার সঙ্গে আর - একটার সম্পর্ক দেখাবে , তবে ঐ practice ( হাতে - কলমে শিক্ষা ) -এর উপর দাড়িয়েই এগুতে হবে । আরম্ভও হয়েছিল সেইভাবে — আর যতটুকু হয়েছিল , ততটুকু বাস্তব ।
প্রফুল্ল — কিন্তু disappear করলাে ( নষ্ট হয়ে গেল ) কেন ? শ্রীশ্রীঠাকুর — হাতকে পুষ্ট থাকতে হলে মুখ দিয়ে খেতে হয় , মুখে খাবার তােলা বন্ধ করে যদি হাতে শুধু তেল মাখা যায় , হাত কিন্তু তাতে ঠিক থাকে না । একটা শরীর থেকে vital current off ( জীবনীশক্তি অপসৃত ) হ'লেই তাকে বলে মৃতদেহ — দেহ আছে কিন্তু জীবন নেই । Ideal ( আদর্শ ) হ'লেন সেই life ( জীবন ) যার উপর দাঁড়িয়ে থাকে সব , তিনি ছাড়া অন্যকিছু prominent ( প্রধান ) হ'লে কিছুই ক'রে ওঠা যায় না । তাছাড়া , আমাদের এখানে করণে ওয়ালা যে - সব মানুষ , তারা মতলববাজ লোকের চাপে ousted ( উচ্ছেদ ) হ'তে তাতেও কম ক্ষতি হয়নি ।
প্রফুল্ল — যে ousted হলো , তারই তাে disqualification ( অযােগ্যতা ) । শ্রীশ্রীঠাকুর — তবু তাে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখেছে— body cell ( দেহকোষ ) আর bacteria ( বীজাণু ) হয়ে যায়নি ।
প্রফুল্ল— India- র ( ভারতের ) অন্যান্য province ( প্রদেশ ) -এর চাইতে বাংলার degeneration ( অবনতি ) কি সব চেয়ে বেশী হয়েছে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — বাংলায় আছি তাই বাংলারটা আমরা দেখছি — আর degenera tion ( অবনতি ) মানে , এর disintegrated ( বিচ্ছিন্ন ) , এদের ideal or principle ( আদর্শ ও নীতি ) বলে কিছু নেই , ego ( অহং ) -ই সব । Integra tion ও consolidation ( আদর্শনিষ্ঠা ও সংহতি ) আনতে পারলেই হয় , আর সবই তাে আছে ।
অন্যান্য কথা উঠল । কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — নিজে আচরণ না করে ছেলেপেলেদের উপদেশ দেবার মতাে দুর্বুদ্ধি আর নেই । মা হয়তো ছেলের সামনে বাপকে অসম্মানসূচক কথা বলছে , বাপ মাকে মারছে - সেখানে ছেলে যে খারাপ হবেই , সে - সম্বন্ধে সন্দেহ নেই । বাপ ছেলেকে বলছে সত্য কথা বলতে , নিজে স্ত্রীর কাছে মিথ্যা কথা বলছে , ছেলে এটা adjust ( বিনায়ন ) করতে পারে না , মাথায় একটা fissure ( ফাটল ) -এর মতো হয় । তুমি কেমন মানুষ বোঝা যাবে , তোমার ছেলেপেলে দেখে । Defect ও merit ( দোষ ও গুণ ) সব পাবে । Sexual intercourse ( যৌন - মিলন ) হয়তো করতে চাও কিন্তুঅনিয়ন্ত্রিতভাবে হ'লে তার risk ( বিপদ ) কতখানি তা কি চিন্তা কর ? তােমার সন্তান হয়তাে like a street dog ( রাস্তার কুকুরের মতাে ) ঘুরবে । ও কিন্তু তুমিই , তুমি কি চাও তােমার ঐ পরিণতি ? নিজে আচরণসিদ্ধ হওয়া ছাড়া মানুষকে ভাল করবার পথ নেই — শাশুড়ী যদি বউকে মানুষ করতে চায় , তারও করে দেখাতে হবে । মা হওয়ার আগে কোন মেয়ে যদি স্বামী , শ্বশুর - শাশুড়ী , দেবর , ননদ , জা ইত্যাদির চোখ - মুখ দেখে প্রয়ােজন অনুধাবন করে তদনুপাতিক কথাবার্তা , সেবা - ব্যবহার প্রয়ােগ করে , তবেই আস্তে - আস্তে তার এমন intuition develop ( স্বতঃবােধ বৃদ্ধি করবে যাতে সে ছােট শিশুর nurture ( পােষণ ) যখন যেমন প্রয়োজন দিতে পারবে । আঁচ করতে - করতে intuition ( সহজ জ্ঞান ) grow করে ( জন্মায় ) । তখন একটা লােক দেখলেই হয়তাে তুমি বুঝলে , সে অকাম করে এসেছে । তখন তাকে কোন কথা কোন সময় কেমনভাবে বললে কী effect ( ফল ) হবে এবং সে effect ( ফল ) কত সময় থাকবে , সব বোঝা যায় ।
10