page no & topic 🔲 পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য ছাত্রের প্রতি-৬২
🔲 কর্মে সাফল্যলাভের তুক-৬৩
🔲 শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৬৩
🔲 শ্রীশ্রীঠাকুরের সোহাগ-৬৩
🔲 কৌশল-৬৫
🔲 দীক্ষাদানে বিচার্য্য-৬৬
🔲 কর্মে প্রেরণা-দান-৬৮
🔲 চতুর চলন-৬৮
🔲 শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৬৮
🔲 কর্মীদের প্রতি-৬৯
🔲 দরিদ্র-নারায়ণ কথাটি ঠিক নয়-৬৯
[P 62-70]
২৩ শে পৌষ , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ৭/১/৪২ )
তপােবনের একটি ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করেছে ব'লে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসে কাঁদছে । শ্রীশ্রীঠাকুর তখন অশ্রিম - প্রাঙ্গণে বাবলাতলায় একটি হাতল ওয়ালা বেঞ্চে পূর্ব্বাস্য হ’য়ে বসা । বেলা আন্দাজ আটটা , রােদ উঠেছে বেশ , শ্রীশ্রীঠাকুর রােদের মধ্যে পা - দুখানি রেখেছেন , বেঞ্চের হাতলে হেলান দিয়ে সুখকর ভঙ্গীতে ব'সে আছেন । কিছু , ধান ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে , কতকগুলি পায়রা সেগুলি খুঁটে - খুঁটে খাচ্ছে । শ্রীশ্রীঠাকুর পায়রাগুলির দিকে চেয়ে আছেন সস্নেহ - সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে , চেয়ে চেয়ে দেখছেন পায়রাগুলির ধান খাওয়া । পায়রা গুলির সুখে তিনিও যেন কত সুখী । ছেলেটির কান্নায় শ্রীশ্রীঠাকুর চকিত ভঙ্গীতে চাইলেন তার দিকে , চেয়ে স্নেহ - বিগলিত কণ্ঠে বললেন -- কি হইছে সােনা ? কি হইছে ? কাঁদো কেন ?
ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলল আমি পরীক্ষার পরে বাড়ী চ’লে গিয়েছিলাম , এসে শুনলাম আমি প্রােমোশন পাইনি । ভাবছি , বাবা - মাকে কি করে এই কথা জানাব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেনও , এই কথা ! এই জন্য তুই কাঁদছিস ! দূর পাগল ! পরীক্ষায় ফেল করিছিস , তাতে কী হইছে ? এবার এমন ক'রে পড় যাতে খুব ভালভাবে পাশ করতে পারিস । মনে - মনে এমন সঙ্কল্প করা লাগে যে জীবনে আর কখনও ফেল করব না । আর , শুধু ; নিজে না করা , সহপাঠী বা পরিচিত কাউকেও ফেল হতে দিবি না । কোথায় কোথায় , কিসে কিসে গলদ আছে , সেগুলি বের করা লাগে , বের করে খেটে শুধরে ফেলতে হয় । নিজের গলদগুলি সেরে ফেলতে পারলে , অন্যকেও তখন তাের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করতে পারবি , প্রবুদ্ধ করে তুলতে পারবি । শুধু পড়াশুনার ব্যাপারে নয় , সব ব্যাপারেই জীবনে জয়ী হওয়া চাই । যদি কখনও কোন ভালকাজে অকৃতকার্য্য হােস বা দুঃখ পাস , তা'তে কিন্তু দমবি না , রোখের সঙ্গে লেগে যাবি । বাধাকে বাধ্য করে তার উপরে উঠে জয়ী হওয়া চাই । আমার ঐ স্বভাব আছে , তাই দেখিস না কিছুতেই ডরাই না । বাধাকে বাধ্য করা , না - কে হাঁ করা , অসম্ভবকে সম্ভব করা — এ - যেন আমার একটা নেশা বিশেষ । তা'তে কোন কষ্টের জ্ঞান থাকে না আমার , একটা শুয়ােরে গোঁ যেন পেয়ে বসে । কাজ হাসিল না ক'রে যেন আমার রেহাই নেই । অনেকদিন আগের কথা , একদিন গরমের সময় দুপুর বেলা হঠাৎ খেয়াল হলাে , এই গরমের মধ্যেই আগুনের মতাে বালির উপর দিয়ে হেটে কুষ্টিয়া যাব । মনে হওয়া মাত্র বেরিয়ে পড়লাম । সে কি কাঠফাটা রােদ , বালি তেতে যেন একেবারে জলন্ত কয়লা হ'য়ে আছে । একটু দূর হেটে মনে হলাে এর মধ্যে যেয়ে কাজ নেই । পরক্ষণেই মনে হলাে — এত শীঘ্র আমি সঙ্কল্পচ্যুত হব , তা কিছুতেই হ'তে দেব না , মনে যখন করেছি যাব , যেতেই হবে আমাকে । তখন সেই অবস্থায় ৯ মাইল পথ পাড়ি দিলাম এইভাবে । যেতে - যেতে পায়ের তলায় ফোস্কা প'ড়ে গ'লে গ'লে ঘা হ'য়ে গেল , কিন্তু তবু দমলাম না , তখন রােখ আমার এতই প্রবল যে কষ্ট সম্বন্ধে হুশ নেই । কুষ্টিয়া পৌছে তখন খেয়াল হ'লে পায়ের কী অবস্থা হয়েছে । ওদিন কেটে গেল , পরদিন দুপুরবেলা আবার মনে হলাে , দেখি পায়ের এই অবস্থা নিয়ে আবার পাবনা পর্যন্ত হেটে যেতে পারি কিনা । কষ্টের কথা ভেবে মন শিউরে উঠলাে , তৎক্ষণাৎ মনে হলাে , ভয় বা দুৰ্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না । পারব না , যখন মনে হচ্ছে , তখন তাকে অতিক্রম ক'রে পারাই লাগবে । ভেবে কি ব'সে থাকার জো আছে ? ভেবেছি কি করতেই হবে । বেরিয়ে পড়লাম পায়ের ঐ দগদগে ঘা নিয়ে , এসে পৌছলাম এখানে । কোন ভাল ব্যাপারে হ'টে যাওয়াটা আমার কাছে বড় তাপমানজনক মনে হয় । ও আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারি না ।..... তােরা আমার বাচ্চা , তােদেরও আমি এমনতর দেখতে চাই । তাই বলি , রুখে দাঁড়া , ফেল যেন ফেল মেরে যায় তোর কাছে , কোন ব্যাপারে ফেলকে আর এগুতে দিবি না তাের ত্রিসীমানার কাছে , শুধু তুই নয় , দেখবি কেউ যেন কোন সৎকাজে ফেল না পড়ে । নিজে কৃতকার্য্য । হবি , সবাইকে চেতিয়ে তুলে কৃতকাৰ্য্যতায় পৌছে দিবি । কী বলিস , এ খেলায় মজা আছে না ?
ছেলেটি তখন স্ফূর্ত্তিতে ফলছে , হাসি - হাসি মুখে বাপ - আপনার কথা শুনে , মনে হচ্ছে আমি সব পারব । আমি আজ থেকে লাগলাম ।
শ্রীঠাকুর উলসিত হ'লে সাবাস বেটা ! এরেই তো কয় পুরুষ - ছাওয়াল । তবে যা ’ করিস , শরীরটা ঠিক রেখে করবি । মনে রাখিস , আমার জন্য তােকে জীবনে বড় হওয়া লাগবে , কৃতী হওয়া লাগবে , আর তাতে তাের বাপ - মায়েরও মুখ উজ্জ্বল হবে । ছেলেটি আনন্দবিধুর সাশ্রুনয়নে শীতের মাটিতে আভূমিলণ্ঠিত হয়ে প্রণাম করে চলে গেল , তার অশ্রুধারা পুরুষােত্তম - পদচুম্বিত আশ্রম - ভূমির উপর অম্লান মাধুর্য্যে জেগে রইলাে তার শুভসঙ্কল্পের — নবজন্মের ভাস্বর স্বাক্ষর বহন ক’রে ।
একটু পরে খেপুদা ( চক্রবর্ত্তী ) , কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) ও বঙ্কিমদা ( রায় ) আসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — আপনাদের একসঙ্গে দেখলে আমার গােপালের কথা মনে পড়ে । গােপাল ছিল হাতের লাঠির মতাে । কাছে থাকলে বল পাওয়া যেত ।
কেষ্টদা — আপনার প্রত্যেকটি কাজে গােপালের উৎসাহ ছিল অসাধারণ । নিজে যেমন উৎসাহী ছিল , অন্যের মধ্যে আবার তেমনি উৎসাহ সঞ্চারিত ক'রে দিতে পারত । কনফারেন্সের রিপাের্টগুলি পড়তাে , ঐ সব dry facts and figures ( নীরস তথ্য ও সংখ্যা ) -এর ভিতর দিয়ে কেমন একটা glowing hopeful picture ( উজ্জল আশাপ্রদ চিত্র ) ফুটিয়ে তুলতাে ।
বঙ্কিমদী - কথা বলতে হয় কেমন ক'রে , সে art ( কলা ) ও জানতাে ।
_শ্রীশ্রীঠাকুর খেপুদা , কেষ্টদার দিকে চেয়ে — বঙ্কিম ঐ দিক দিয়ে একটু খাটো , তা'ছাড়া ওর জুড়ি নেই । অফিস নিয়ে লাগিছে তো তার পিছনে লাগেই আছে । আবার , খােয়া ভাঙতে দেন বা ঘর দুরমুজ করতে দেন , কোনটাতেই পিছপাও হবে না । ( হাসতে - হাসতে ) তবে নতুন লােক ওর কথা শুনলি ঘাবড়ে যায় । একদিন আমাকে তাে একজন বলেই বসলাে — উনি আমার উপর চ'টে গেলেন কেন ? আমি যত ভাল কথা বলি , উনি তত চটেন , এ কেমন লােক ? আমি তখন বলি উনি খুব ভাল লােক , উনি খুব ভাল কথাই বলছেন । ওর ভাল কথা বলারও ধরণ ঐ রকম । আপনি বুঝতে পারেননি । লােকটার সঙ্গে মিশে দেখবেন । ভদ্রলােক তখন আমতা - আমতা করতে করতে বলল -ও তাই বুঝি ? উনি আমার সঙ্গে ভাল কথা বলছিলেন !
এই ব'লে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাণ খুলে হাসতে লাগলেন । বঙ্কিমদা শুদ্ধ সকলেই সে হাসিতে যােগ দিলেন ।
একটু পরে শ্রীশ্রীঠাকুর গম্ভীরভাবে বললেন - মানুষেরই যে বড় অভাব ।
কেষ্টদা বড়খোকা , মণি এরা অসাধারণ মানুষ । ওরা একটু sliy ( লাজুক প্রকৃতির ) , নইলে মানুষ - পরিচালনা করার ক্ষমতা ওদের খুব আছে । মাথাও খুব ভালো , বুঝগুলি এমন সহজ ।
খেপুদা- বড়খােকা ( exceptionally intelligent ( অসাধারণ বুদ্ধিমান ) ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওরা এখনও চ্যাংড়া মানুষ , তারপর বড়খােকার শরীরও ভাল না, ওর বুদ্ধি আছে , দরদও আছে , আবার কর্মশক্তিও কম নয় , তবে বড়বৌয়ের মতাে একটু রাশভারী । মানুষ প্রথমে ঠাওর পায় না , যত মেশে তত দেখে , অন্তরে মধুভরা । ওর শরীরটার জন্য বড় ভাবনা হয় ! ......... মণিরও লােক একগাট্টা করে নিয়ে চলার ক্ষমতা আছে । ‘ তারা যাবার পর থিয়েটার , গান বাজনা জিইয়ে রাখিছে কিন্তু ও - ই । ওর নিজের যেমন নেশা আছে , আবার কতকগুলিকে তৈয়েরীও করিছে বেশ । অনুশীলন করে খুব , ঐ নিয়ে লাগেই আছে । রীতিমতাে একটা atmosphere ( আবহাওয়া ) create ( সষ্টি ) ক'রে ফেলিছে । পাঁচজনের সঙ্গে হৃদ্য সহযােগিতায় একটা কাজও যে নিখুতভাবে করতে পারে — দিনের পর দিন ঝড়ঝাপটা - বাদল অগ্রাহ্য করে ক্রমাগতি বজায় রেখে , তার মধ্যে অনেকখানি সম্ভাব্যতাই কল্পনা করা যায় ।............ পাগলুটারও আমার উপর খুব নেশা আছে । এরা সব সুস্থ সুদীর্ঘ জীবন পায় , তাহ'লে অনেক কিছু করতে পারবে ।
সরােজিনীমা তামাক সেজে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে কেদার দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন — আপনি ডলাই - মলাই ক'রে প্রফুল্ল ( দাস ) , চুনী ( রায়চৌধুরী ) , বীরেনকে ( মিত্র ) যেমন পোক্ত করে দেছেন , কিরণ ( মুখােপাধ্যায় ) , মনােরঞ্জন ( বন্দ্যোপাধ্যায় ) ওদেরও তেমনি ক'রে দেন । আপনার কতকগুলি hand ( সহকারী ) না থাকলে , একলা সব দিক সামাল দেওয়া মুশকিল হবে ।.......... শরৎদার মতাে আরও কয়েকজন হাউড় তােলার জন্য বক্তৃতারও দরকার আছে । অবশ্য বক্তৃতার effect ( ফল ) যদি utilise ( সদ্ব্যবহার ) না করা যায় , তাহলে তা'তে কাজ হয় না । Public meeting ( জনসভা ) -এর আগে যাজন লাগে , পরে যাজন লাগে , এমন কি meeting ( সভা ) -এর সময়ও যাজন লাগে ।
কেদা --- Metting ( সভা ) -এর সময় যাজন কী রকম ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - ধরেন , একজায়গায় একটা Metting ( সভা ) হ'চ্ছে audience ( শ্রোতৃবন্দ ) -এর ভিতরে intcrspersc করে ( ইতস্ততঃ - ছড়িয়ে ) কতকগুলি গুণগ্রাহী । আপনজন রেখে দেবেন । তারা বক্তার বক্তৃতার সময় মাঝে - মাঝে এমনতর suggestive remark ( সঙ্কেতপর্ণ মন্তব্য) করবে যা'তে আশে পাশের সবার supporting tendency ( সমর্থনী মনােভাব ) হয় । কেউ যদি বক্তৃতার সময় উল্টো মন্তব্য করে বা বিরুপ ভঙ্গী দেখায় , তা'ও তারা tactfully (counteract) করবে - আশ - পাশের লোককে সমর্থনমুখী ক'রে । এতে বক্তৃতা শেষ হবার সঙ্গে - সঙ্গে সমগ্র জনতা ( ৩ য় -- ৫ )charged ( উদ্বুদ্ধ ) হয়ে যাবে । যারা wrong suggestion ( ভ্রান্ত সঙ্কেত ) দিয়ে মানুষকে সৎপথ হ'তে দূরে রাখতে চায় , তারা audicnce ( শ্রোতৃবন্দ ) -কে infect ( দুষিত ) করবার সুযোেগ পাবে কম । বক্তৃতার সময় লক্ষ্য করা লাগে , audience ( শ্রোতৃবন্দ ) -এর ভিতর ' কার চোখমুখ কেমন glow করে ( দীপ্ত হয়ে ওঠে ) । আগ্রহশীল যারা , তাদের চোখমুখের চেহারা দেখলেই বােঝা যায় । আপনাদের কথা শুনলে তাদের এমনভাব হবে যে , তারা যেন কী পাওয়া পেয়েছে । তাদের mark ( লক্ষ্য ) করে রাখতে হয় । পরে তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যাজনে উদ্বুদ্ধ ক'রে দীক্ষিত করে তুলতে হয় । দীক্ষার ব্যাপারে দীক্ষাদাতার চাইতে দীক্ষাগ্রহণকারীর আগ্রহ বেশী হওয়া চাই । সেই আগ্রহ সৃষ্টি করাই যাজনের প্রধান লক্ষ্য । তুমি দীক্ষা নাও , এ - কথা বলতে নেই , তা'তে বরং মানুষের নিজের আগ্রহ কমে যায় । অবশ্য ধরাবাঁধা কোন রাস্তা নেই । ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থা আছে । শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুর বলেছেন উত্তম বৈদ্যের কথা । উত্তম বৈদ্য দরকার হলে রােগীর বুকে হাঁটু দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দেয় । আসল কথা যাজক , অধ্বর্য্যু বা ঋত্বিকের কোন দৈন্যবােধ থাকবে না , মানুষের মঙ্গলের জন্য , ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার জন্য সে যেখানে যেমন শােভন ও সুষ্ঠ বিবেচনা করে , তাই করে যাবে ।
Public meeting ( জনসভা ) করা সম্পর্কে আমার আরাে একটা কথা মনে হয় । স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে প্রধান যারা তাদের এমনভাবে যাজনে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হয় যে তারা নিজেরাই যেন স্বতঃ - দায়িত্বে সভা আহ্বান করেন , এবং আপনাদের অনুরােধ করেন বলবার জন্য । তাঁরা উদ্যোক্তা হয়ে যদি সভা আহান করেন এবং লোককে আমন্ত্রণ করেন , আপনারা যদি অনুরুদ্ধ ও আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে যান -- তার একটা মৰ্যাদা হয় অন্যরকম । আর , কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে কম । তেমন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হ'লেও ঐ প্রধানরাই তার প্রতিবিধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । সেটা আপনাদের প্রতি অনুরাগবশতঃ না হ'লেও , নিজেদের মর্যাদা অক্ষুণ রাখার তাগিদে ক'রে থাকেন তারা । যে - ভাবেই করুন , আপনাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই ।...... (কেষ্টদাকে লক্ষ্য ক'রে ) বরিশাল থেকে ফিরে এসে আপনারা পিরােজপুরের মিটিংয়ের গল্প করছিলেন , আমার বড় ভাল লাগিছিল । ঐভাবে মিটিং করা আমার খুব পছন্দ হয় । গল্পটা আবার করেন তো ।
কেষটদা প্রফুল্ল সবটুকু জানে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ক ’ দেখি , শুনি ।
প্রফুল্ল “ কেষ্টদা রইলেন বরিশাল । আমি ও বীরেনদা ( মিত্র) কয়েকদিন আগে গেলাম পিরোজপুর । আমরা পিরোজপুর যেয়ে বিশ্বেশ্বরদার ( দাস ) বাড়ীতে উঠলাম । তখন বিশ্বেশ্বরদা , জনার্দ্দনদা ( বসু ) , প্রভৃতির সঙ্গে কথাবার্তা বলে স্থানীয় নামকরা লােকের একটা list ( তালিকা ) ক’রে নিলাম । কংগ্রেস , হিন্দুমহাসভা , মুলিম লিগ , বার এসোসিয়েসান , মেডিক্যাল এসােসিয়ে সান , স্থানীয় ক্লাব ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান - ইত্যাদি সকল ব্যাপারেরই কৰ্মকৰ্ত্তাদের সাথে বীরেনদা ও আমি দেখা - সাক্ষাৎ ও আলাপ - আলােচনা চালাতে লাগলাম । কয়েকদিন পর কেষ্টদার ওখানে যাবার সম্ভাবনা আছে সে কথাও তাঁদের বললাম । কেষ্টদা গেলে তাঁর কাছ থেকে যে আপনার ও সৎসঙ্গের সম্বন্ধে বিশদ পরিচয় লাভের সুযোগ জুটবে , তাদের সে কথাও জানালাম । কেষ্টদার বাবার ওখানে খুব নামডাক , কেষ্টদার কথাও অনেকে জানেন । সবাই কেষ্টদাকে পিরােজপুরে আনবার জন্য খুব আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন । আমরাও বললাম , সুবিধা পেলেই তিনি আসবেন । সব কথা কেষ্টদাকে লিখে জানাতে থাকলাম । পরে উনি জানালেন কবে যাবেন । স্থানীয় যুবকবৃন্দকে আমরা সে - খবর জানালাম । তারা তখন হুলার হাট ষ্টীমার - ষ্টেশন থেকে কেষ্টদাকে বিপুল সম্বর্ধনা সহকারে পিরােজপুরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন । নিজেরা বাস রিজভি করে ক্লাবের ব্যাণ্ড , ফুলের মালা ইত্যাদি নিয়ে গেলেন । পরে স্থানীয় বিশিষ্টরা নিজেদের স্বাক্ষরে মিটিংয়ের এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করলেন । রবিবার দিন বেলা তিনটের সময় স্থানীয় এক বিরাট মণ্ডপে মিটিং হলাে সমস্ত সহর , ভেঙ্গে পড়লাে সে মিটিং - এ । সভায় মাইক ছিল না বটে , কিন্তু কেষ্টদা এমন উদাত্ত কণ্ঠে বললেন যে কারও শুনতে কোন অসুবিধা হলো না । কেষ্টদার বলাও সেদিন খুব মর্মস্পর্শী হয়েছিল । মিটিংয়ের পর সুরু হয়ে গেল ব্যক্তিগত যাজনের পালা । দলে - দলে লােক আসতে লাগলাে বিশ্বেশ্বরদার , বাড়ী । ভাের থেকে রাত একটা পর্যন্ত যাজনে বাড়ীখানা সরগরম হয়ে থাকতাে । পদস্থ হাকিমরাও আসতেন কেষ্টদার সঙ্গে আলাপ - আলোচনা করতে । প্রমথবাবু ব'লে একজন গেজেটেড অফিসার কেষ্টদার সঙ্গে দেখা করতে এসে এতই রস পেয়ে গেলেন যে উঠি - উঠি করেও পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে উঠতে পারলেন না । জরুরী কাজকর্ম ফেলে আলাপ - আলােচনা করতে লাগলেন । তার প্রশ্নগুলিও ছিল খুব intelligent ( বুদ্ধিদীপ্ত ) । সকলেই কেষ্টদার সেদিনকার যাজন খুব উপভোগ করেছিলাম । ঐ কটা দিন সময় কোথা দিয়ে যে কেটেছে তা ঠিক পাইনি । ভাল - ভাল দীক্ষাও বেশ কিছু ; হ'লাে । আমরা যেদিন চলে আসি , সেদিন পিরোজপুরের দীক্ষিত - অদীক্ষিত অনেকই চোখের জল ফেলেছিলেন । ওখান থেকে আমরা গ্রীনবােটে বেরিয়ে পিরোজপুর মহকুমার বহু , বর্ধিষ্ণু গ্রামে যাই । সে - সব জায়গায়ও ঐভাবে মিটিং ও যাযন চলতো । কেটদার সঙ্গে ঐ এক মাস ঘুরে আমি খুব উপকৃত হয়েছি , কোন প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিতে হয় , তা' শুনে - শুনে টুকে রেখেছি ।
কেষ্টদা খগোদারও ( তপাদার ) খুব Student like attitude ( ছাত্রোচিত মনােভাব ) , লেখাপড়া তাে তেমন জানে না , যাজনের মধ্যে ইংরেজী কথা যার যা’ শুনতাে তা আবার বাংলা অক্ষরে পেন্সিল দিয়ে নােট বইতে টুকে রাখতো , sentence- কে- sentence ( পুরােপুরাে বাক্য ) —জায়গায় - জায়গায় হুবহু , লিখে রাখিছে , কোথাও কোথাও অবশ্য ভুল আছে । নােট বইটা একদিন আমার হাত পড়তে দেখলাম । প্রথমে ভাষাটা বুঝতে পারছিলাম না , পরে বুঝলাম , ইংরেজী ভাষা বাংলা অক্ষরে লেখা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর শুনে হাসতে লাগলেন । পরে বললেন — এ একটা শুভ নমুনা । দেখেন অনুসন্ধিৎসা , জ্ঞানস্পৃহা সাধারণের মধ্যে কতখানি বেড়ে গেছে । হাওয়া যা বওয়ায়ে দিছেন আপনারা , তাতে মানুষের ভাল না হয়ে আর যায় না । এখন কিছু লােক জোগাড় করেন আর speed ( বেগ ) -টা বাড়ায়ে দেন , আর সবসময় লক্ষ্য রাখবেন সংহতি যা'তে অটুট থাকে । নিজেদের মধ্যে এতখানি understanding ( বুঝ ) থাকা চাই যে , কেউ যেন এর মধ্যে দাঁত বসাতে না পারে । বাংলার মাটিতে সংহতি গড়ে তোলাটা বড় কঠিন কাজ । একজনের শ্রীবৃদ্ধি বা প্রাধান্য দেখলে আর পাঁচজনের অকারণ চোখ টাটায় । মানুষের inferiority ( হীনম্মন্যতা ) আছে , take it for granted ( এটা ধ'রেই নেবেন ) , আর তাই ধরে নিয়ে মানুষের inferiority ( হীনম্মন্যতা ) যা'তে excited (উত্তেজিত ) না হয় সেইভাবে চলবেন ।
কেষ্টদা — তার মানে তো খােশামদে চলনা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ইষ্টার্থ বিসর্জন দিয়ে যদি আপনি শুধু মানুষকে খুশি করার তালে থাকেন , তাকে বলা যায় খােশামুদে চলনা । অমনতর খােশামদে চলনায় কোন কাজ হয় ব'লে আমার মনে হয় না । আর একটা আছে ইষ্টে fanatic ( গোঁড়া ) থেকে , ইষ্টার্থে যেখানে যেমন চলা লাগে , তেমনি চলা । একে বলে কৌশলী চলন , চতুর চলন । এমনতর চলতে জানে যে , তাকেই কয় ধুরন্ধর । যেমন ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ , চাণক্য । কৌটিল্যসিদ্ধ সরল চলনই শ্রেয় । তা যেখানে মানুষ পারে না , তার মানে তার কোন obsession ( অভিভূতি ) আছে । ইষ্টার্থ তার কাছে বড় নয় , ইষ্টার্থে নিজের গোঁ সে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় । যার ঐ টেক ভাঙ্গেনি , ধৰ্ম্ম তার কাছ থেকে বহু দূরে ।
খেপুদা - আমার একটা কথা মনে হয় দাদা । নানা জায়গায় যদি constructive activity ( গঠনমূলক কর্ম ) ও সেবাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি start (চালু) করা না যায় , তাহলে সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর- দ্যাখ খ্যাপা ! মানুষের হাততালি পাওয়া বা বাহবা পাওয়ার লােভ আমার কোনদিনই নেই । গালমন্দেরও আমি বড় একটা পরােয়া করি না । আমি ভাবি কাজের কাজ যদি কিছু না হ'লাে , তবে কী করব আমি মানুষের সুখ্যাতি দিয়ে ? আর , মানুষের সত্যিকার ভাল করতে গিয়ে প্রথমটা যদি দুর্নামের ভাগী হতে হয় , তাহলেই বা আমার ক্ষতি কী ? আমি যে জানি খ্যাপা , মানুষের দুঃখ কোথায় , আর সেই দুঃখের নিরাকরণ যা’তে হয় , তাই - ই তো করে যাচ্ছি । এ আমার কাছে সখের ব্যাপার নয় , প্রাণের দায় । এর চাইতে বড় constructive activity ( গঠনমূলক কর্ম ) আর কী আছে , আমি জানি না । মানুষগুলি একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে গেছে , সংযম কাকে কয় , আত্মনিয়ন্ত্রণ কাকে কয় , তা জানে না । তাতে জীবনসংগ্রামে পদে - পদে হ'টে , যাচ্ছে । তারই অনুশীলনের জন্য কই দীক্ষার কথা , যজন , যাজন , ইষ্টভৃতির কথা । আবার , এক আদর্শের পতাকাতলে যত লােক দীক্ষার মাধ্যমে সমবেত হবে , ততই তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিকতা গজিয়ে উঠবে । এমনি করেই বিচ্ছিন্ন মানুষগুলি দানা বেধে উঠবে । প্রত্যেকের জন্য ভাববে প্রত্যেকে , প্রত্যেকের জন্য করবে প্রত্যেকে । এই প্রাণটুকু , এই দরদটুকু যদি তোমরা প্রাণে প্রাণে ফুটিয়ে দিতে পার — নিজেদের আচরণ দিয়ে , তাহ'লে আর relief centre (সাহায্যকেন্দ্র ) খুলতে হবে না । তখন relief - centre ( সাহায্য কেন্দ্র ) হবে প্রত্যেকটা মানুষ । অবশ্য , দৈবদুৰ্বিপাকে বন্যা , দুর্ভিক্ষ , মহামারী ইত্যাদি সময়ে তােমরা যদি অন্নবস্তু , ওষুধপত্র , অর্থ সংগ্রহ করে বিতরণ কর , তা'তে আমার কোন আপত্তি নেই । কিন্তু ঐটেকেই মুখ্য করে তুলে না । তোমাদের মুখ্য কাজ হলাে ধৰ্মদান । দরিদ্র - নারায়ণ কথাটা দেশে প্রচলিত আছে , ও - কথা আমার ভাল লাগে না , কারণ , নারায়ণ স্বতঃই যড়ৈশ্বর্য্যশালী । নারায়ণই যদি কও , সে - নারায়ণকে দরিদ্র থাকতে দেবে কেন ? প্রত্যেকটি নারায়ণের যােগ্যতা যা'তে বাড়ে তাই কর । আর , তার জন্য প্রথম পরিবেষণ করতে হবে ধৰ্ম্ম , ইষ্ট , কৃষ্টি । ধর্ম , ইষ্ট , কৃষ্টি যত বেশী মানুষের জীবনের মধ্যে , আচরণের মধ্যে বুনে দিয়ে যেতে পারবে - নিজেদের জীবন দিয়ে ; আচরণ দিয়ে , ততই দেখবে তারা শিক্ষা , স্বাস্থ্য , কৃষি , শিল্প , বাণিজ্য , সামাজিক অনুষ্ঠানাদি ধৰ্ম , ইষ্ট , কৃষ্টির ছাঁচে ফেলে নিজেরাই গ'ড়ে তুলতে লাগবে । উন্নতির zigotc ( প্রাণকেন্দ্র ) -টা সৃষ্টি ক'রে দাও , আর তাকে পােষণ দাও , শুকিয়ে মরতে দিও না , তাহলে দেখবে , তা ' পূর্ণাঙ্গ অবয়ব নিয়ে সময়ে আত্ম প্রকাশ করবে । তােমার - আমার ব্যস্তবাগীশ হ'য়ে আলাদা করে তার অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ , শিরা - উপশিরা রচনায় ব্যাপত থাকার প্রয়োজন হবে না । যেখানে যেমন প্রয়ােজন , স্বভাববশে আপনিই cvolve করবে ( উদ্ভিন্ন হয়ে উঠবে ) । তাই কই , তেসরা চাষ আগে দিতে যেও না । এখন দোয়াড়ে দীক্ষা দিয়ে যাও , মানুষগুলিকে যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি ও সদাচারে অভ্যস্ত করে তোল , এদের পরপরের মধ্যে আদান - প্রদান , সেবা - বিনিময় যা'তে বেড়ে চলে তার ব্যবস্থা কর , বিয়ে - থাওয়াগুলি যা'তে ঠিকমতাে হয় , সেদিকে লক্ষ্য রাখ , আর এই কাজের জন্য উপযুক্ত কর্মী সংগ্রহ কর । কখন কী করা লাগবে , সব আমার মাথায় আছে । যা ’ কই তা কাঁটায় - কাঁটায় ক'রে যাও । ব্যস্ত হ'য়াে না ।
প্যারীদা আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর স্নেহস্বরে বললেন — পা'টায় ঝি - ঝিঁ ধরিছে , একটু টানে দাও লক্ষী !
প্যারীদা আগ্রহসহকারে এগিয়ে আসলেন ।



10