শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 7
॥ সাত ॥
বর্ণাশ্রম সম্পর্কে কথা উঠেছে। ঠাকুর বললেন, শিক্ষিত সমাজের মধ্য থেকেই একদল লোক বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। হরিজন-সম্প্রদায়ের দেব-মন্দিরে প্রবেশের অধিকার নিয়ে বেজায় সোরগোল তুলেছে তারা। শুধু তাই নয়, উচ্চবর্ণকর্তৃক তাদের হাতের-প্রস্তুত অন্ন-ব্যঞ্জন-গ্রহণের একটা সামাজিক আন্দোলনও গড়ে উঠছে দিকে দিকে। ধারণাটা হচ্ছে, তাদের হাতের অন্ন ভোজন করলেই তাদের সমাধিকার নাকি স্বীকৃত হবে এবং তারা উচ্চবর্ণের লোকের সমস্তরে উঠে আসবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুষ্টিয়া শহরেও এই সামাজিক গণ্ডিভাঙ্গার আন্দোলন চালু হয়েছিল। একবার আয়োজন হলো, শহরের মধ্যস্থলে বিখ্যাত গোপীনাথ-অঙ্গনে হরিজন সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা মন্দিরে সমবেত হবে এবং তাদের প্রস্তুত অন্নব্যঞ্জনাদি উচ্চবর্ণের নামীদামী ভব্য ব্যক্তিরা পঙ্ক্তিবদ্ধ হয়ে বসে তা ভোজন 'করবেন। আমার পিতাও এই আয়োজনের একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং আমাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যগণ সবাই শ্রীগোপীনাথের নাটমন্দিরে পঙ্ক্তিবদ্ধ হয়ে বসে হরিজন সম্প্রদায় কর্তৃক পরিবেশিত সেই অন্নব্যঞ্জন গ্রহণ করি।
জাতপাত ভাঙার এই আন্দোলন-সম্পর্কে ঠাকুর বললেন, আন্দোলনটা হরিজনদের মন্দিরে ঢোকানো বা তাদের হাতের অন্নজলগ্রহণের ব্যাপার না হয়ে তাদের সদাচারী ও সমুন্নত করে তোলার জন্য হওয়া উচিত ছিল। আরও বললেন, আমি তো জানি, সদাচারী শূদ্রের মন্দিরে প্রবেশে কোন বাধা থাকতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, সমাজে শূদ্রেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। তারা এই চলমান সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। তারা মোটেই ফেলনা নয়। আমার ভয় প্রতিলোমজদের নিয়ে। প্রতিলোমজ যে বর্ণসাংকর্যেই হোক, সে সমাজের, জাতির এবং রাষ্ট্রের ভয়াবহ শত্রু। একজন প্রতিলোমজ যে কী ভাবে ব্যাপক সর্বনাশ করতে পারে, তা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে।
তিনি আরও বললেন, আর্যদের বর্ণাশ্রম ভিত্তিক সমাজে কেউ বেকার থাকতো না। সকলেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যানুযায়ী কর্মে রত থেকে জীবিকার্জন করতো। কেউ কারও জীবিকা হরণ করতো না। সে সুযোগই ছিল না। বর্ণগুলির মধ্যে ছিল পারস্পরিক সহযোগিতা এবং আন্তরিক সৌহার্দ্য। আর এই প্রীতি-পরিবেশে সমগ্র সমাজ তথা জাতিটাকে ধরে রাখতো একজন ব্রহ্মদর্শী ঋষির প্রতি অনুগত্য। তিনিই জাতির গুরু বলে স্বীকৃত হতেন। আর সমাজের যাতে পতন না হয়, সেই উদ্দেশ্যে প্রতিলোম বিবাহকে ঘটতে দেওয়াই হতো না- প্রতিলোম বিবাহের সম্ভাবনাই প্রতিরোধ করা হতো। বলা চলে, সেই রকম বিধ্বংসী চিন্তাধারাই কারও মগজে আসতো না। বরং অনুলোমক্রমে অসবর্ণ বিবাহ ঘটিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবেই মনুষ্য সমাজের আভ্যন্তরীণ উন্নতি ঘটানো হতো, সমাজক্ষেত্রে এই রকম কড়া বিধান মানুষের মস্তিষ্কে গ্রথিত হয়েই থাকতো। তাই, সমাজ ছিল অত নিটোল এবং ক্রমোন্নতিশীল।
আজ হয়েছে তার, উলটো। আজকাল বড়কে ছোট করে সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। ছোটকে তার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী বড় করে তোলার মধ্যেই যে সাম্যের বীজ লুকিয়ে আছে, সেটা আর কেউ বুঝতে চায় না। অনুলোমক্রমে অসবর্ণ-বিবাহের মাধ্যমেই যে মনুষ্যজাতির স্তরোন্নয়ন ঘটে এসেছে প্রত্যেকটি ঋষিযুগে, সে-চিন্তাই মাথা থেকে মুছে যেতে বসেছে। আজকের শ্লোগান হয়েছে, কোদাল মেরে সব সমান করো-কেউ বড় হয়ো না, ঘাসের উচ্চতায় বেঁচে থেকে সবাই সমান হয়ে যাও।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষপ্রান্ত। শীত তখন প্রায় অবসান হতে চলেছে। প্রকৃতিতে আভাসিত হচ্ছে একটা পালাবদলের আয়োজন। এমনি এক সকালে ঠাকুর বড়াল বাংলোর আমতলায় বসে আছেন একখানা ইজি চেয়ারে। চতুর্দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রকৃতি রাজ্যের সাজবদল নিরীক্ষণ করছেন। অন্য কিছু ভক্তের সঙ্গে পাঞ্জাবের বেয়াস সৎসঙ্গ থেকে আগত এক সৎসঙ্গীও আছেন। তাঁর পদবী ভাণ্ডারী। আগত ভাণ্ডারী মশাইকে ঠাকুর সম্মান দিয়ে কাছে একটি বেঞ্চিতে বসিয়েছেন। কথাপ্রসঙ্গে বেয়াসের ভাণ্ডারী মশাই বললেন, তাঁর গুরুদেবের শরীর ভালো নেই। কিন্তু অসুবিধার কথা হচ্ছে, তিনি ওষুধপত্র খেতে চান না। ওষুধ খাওয়ার কথা বললে বলেন, পরমপিতার দয়ায় সেরে যাবে-যা-কিছু ঘটে তাঁর ইচ্ছাতেই ঘটে।
ঠাকুর বললেন, তা তো বটেই। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না। তবে, সবকিছুই ঘটে আমাদের কর্মের ফল হিসেবে। আমরা ভালো কাজ করে ভালো ফল পাই, মন্দ কাজ করে মন্দ ফল পাই। এই নিয়ম ধরেই ভালো-মন্দ আসে আমাদের জীবনে। যারা তাঁর পথ ধরে যতখানি অগ্রসর হয়, তারা ততখানি তাঁর আশীর্বাদ পাওয়ার অধিকারী হয়। আসলে, তিনি সবার পক্ষেই একরকম। যে তাঁর আশীর্বাদ যতটা কুড়িয়ে নিতে পারে, সে ততটাই মঙ্গলের অধিকারী হয়। নিজের দিক থেকে তিনি ভালো লোকের পক্ষেও যা, খারাপ লোকের পক্ষেও তা'ই। তাঁর বিচারে কোন পক্ষপাত নেই। তাঁর কাছ থেকে বিধান সংগ্রহ করো, সেই মতো কর্ম করো এবং তদনুপাতিক ফল লাভ করে ধন্য হও। তিনি আমাদের ভালোবাসা দিয়েই চলেছেন-সমানভাবে, সকলের ক্ষেত্রেই। আমরা যত গভীর ভাবে তাঁকে ভালোবাসবো, তত তাঁর কথামতো চলতে পারবো এবং তার সুফলপ্রাপ্ত হয়ে জীবন ধন্য করতে পারবো। এইটাই হচ্ছে সাফল্যের মরকোচ অর্থাৎ চাবিকাঠি।
কথাপ্রসঙ্গে আরও বললেন, দুর্ভাগ্যক্রমে দেশতো ভাগ হয়ে গেল। যা ক্ষতি হবার তা তো হয়েই গেল। বহু ছিন্নমূল পরিবার এখন এদিকে এসে বেঁচেবর্তে থাকতে চায়। তাদের সকলের দিকে আমাদের লক্ষ্য থাকা চাই। সকলে মিলেমিশে যাতে আবার একটা সহমর্মিতাপূর্ণ সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারে, সেদিকে আমাদের নজর রাখা লাগে। এই ব্যাপারে অন্তর দিয়ে সাহায্য করাও সৎসঙ্গের কর্তব্য। একজন সৎসঙ্গী মনে প্রাণে আর একজন সৎসঙ্গীর পাশে দাঁড়ালেই এই অভাব-অনটনের মধ্যেও তা সম্ভব। সপ্রেম সেবা দিয়ে জনগণের কাছ থেকেও সেই সহমর্মিতা লাভ করা যায়।
কথাপ্রসঙ্গে নামধ্যানের প্রসঙ্গ উঠলো।
ঠাকুর বললেন, ঐ নামই হলো চরাচর বিশ্বের প্রতিটি সত্তার মূল ভিত্তি। নামকে জানা মানেই আত্মজ্ঞান লাভ করা। নামই পরমব্রহ্ম। নামকে জানাই ব্রহ্মজ্ঞ হওয়া। আত্মজ্ঞ হওয়াও তাই। বললেন, পুরুষোত্তমই নামের প্রতীক পুরুষ। তিনিই পরমপিতা। তিনি যখন করুণাপরবশ হয়ে লোকত্রাণের জন্যে নরদেহ নিয়ে আসেন, তখন তাঁকে দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে অনুসরণ করে চললে অন্তরে সহজেই নাম জাগ্রত হয়। তখন আত্মার গতি দয়ালধামের দিকে অবাধ হয়, স্বাভাবিকভাবেই। তাই চাই নামী-পুরুষ-যুগপুরুষোত্তমকে। তিনিই পরমপিতার ব্যক্তরূপ-বিশ্বনাথ। যে-ব্যক্তি অনুরাগবশতঃ তাঁর প্রতি যতখানি আত্মসমর্পিত, সে-ব্যক্তি জনগণের কাছে ততখানি আদরণীয়, ততখানি অনুরাগ ও অনুসরণের যোগ্য।
বললেন, 'মানুষের একমাত্র প্রাপ্তব্য হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর লাভের জন্যই মানুষের দেহধারণ। আর যুগ-পুরুষোত্তমই হলেন রক্তমাংসসংকুল আমান ঈশ্বর।'
নাম ও নামীর সঙ্গে প্রতিটি সত্তার সম্বন্ধ নিত্য ও অবিচ্ছেদ্য।
বলে দিলেন, 'মনে রেখো, যাঁর সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নিত্য নয় এবং যিনি চরম-ধামের মালিক নন, তাঁর ধ্যানে মানুষ নিত্য ও চরমধামে উপনীত হতে পারে না। ধ্যেয় ব্যক্তি যদি নামের প্রমূর্ত প্রতীক না হন, তবে শেষ-গন্তব্য নামধামে যাওয়া যায় না।'
একদিন স্বস্ত্যর্ঘ্যঋত্বিক ভারত পরিব্রাজক সুশীল বসু-মশাইয়ের কাছ থেকে আগ্রার সৎসঙ্গ সম্পর্কে তথ্যাদি শ্রবণ করে মন্তব্য করলেন, 'সবই ঠিক আছে, কিন্তু পূর্বতন অবতার বা লোকত্রাতাদের সম্বন্ধে ওঁদের যে ধারণা বলে শুনছি, সেই ধারণা পোষণ করা, সঙ্গত নয়-আমার সঙ্গে মেলে না। আর্যকৃষ্টির মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। প্রথম কথা, ঋষিপারম্পর্য অস্বীকার করা যায় না। এই পারম্পর্য বা পরস্পর-পরিপূরকতা না মানলে সেই ধারাবাহিকতাকে আর মানা যায় না। আর্যকৃষ্টির এই একটা-বড় ব্যাপার- বড় বৈশিষ্ট্য।
ঠাকুর এই প্রসঙ্গে তাঁর নিজস্ব শেষ কথাটা এইভাবে প্রকাশ করে বললেন, 'নামী পুরুষই সকল যুগে সকল মুক্তিকামী মানুষের একমাত্র ধ্যেয় এবং সেই দেহধারী নামাত্মক যুগপুরুষকে ইষ্টরূপে গ্রহণ করে সর্বমনপ্রাণে তাঁর ইচ্ছাকে পূরণ করে চলাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সাফল্য লাভ এবং পরিশেষে পরমধামে পৌঁছানোর একমাত্র পথ। আর্যকৃষ্টি এ ছাড়া অন্য কোন রাস্তাকে স্বীকৃতি দেয়নি।'
একদিন ভক্তদের লক্ষ্য করে বললেন, 'তোমরা হলে মানুষ চরানোর রাখাল। মানুষকে ভালোবেসে আপন বৈশিষ্ট্যে জাগ্রত করে সেই ধাম-অভিমুখী করে তোলো।'
যীশু বলেছিলেন, 'তোমরা এখন মাছ ধরা জেলে, আমি এসেছি তোমাদের মানুষ-ধরা জেলেতে রূপান্তরিত করতে। মানুষকে দীক্ষিত করে করে পরমপিতার চরণমুখী করে তোলাই হবে তোমাদের কাজ।'
ঠাকুর বলে চললেন, 'দেশভাগ হয়ে যে ক্ষতি হবার তা তো হয়েই গেল। এখনও যেটুকু জমি পায়ের নিচে পাওয়া গেছে, তার উপরে দাঁড়িয়ে বান্ধববন্ধনে সকলকে কাছে টেনে একাত্ম হয়ে চলতে চেষ্টা করো। এছাড়া আর বাঁচার রাস্তা নেই। সকলের কানে শুধু ভাষণ না দিয়ে সবাইকে পরমপিতার রস্তায় এককাট্টা করে তোলো।'
'মনে রেখো, রেষারেষি মানেই শক্তিক্ষয়। আমরা অজ্ঞতার বশে অনেক শক্তিক্ষয় করেছি। আর নয়, এবার ইষ্টের পতাকাতলে সকলে সমবেত হও, ভালোবাসা আর পারস্পরিকতায় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ইষ্টপথে চ'লে দেশ ও জাতির বলবর্ধন করাই হোক আমাদের ব্রত। তবে এর মধ্যেই কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে পারবো।'
বললেন, 'শাশ্বত আদর্শ ও নীতিকে বিসর্জন দিয়ে একটা গোঁজামিলের মিল সৃষ্টি করায় কোন সুফল আসে না। প্যাক্ট বা চুক্তি করে শান্তি আনা যায় না। শান্তি ও সংহতি আসে এক আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলার পথে। অন্য রাস্তা নেই।'
মুক্তিসংগ্রামী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকেও এই কথা বুঝিয়ে ছিলেন নানাভাবে। কিন্তু দেশবন্ধু যে পথে অনেকদূর এগিয়ে ছিলেন, সেই জোড়া-তালির রাস্তা ছেড়ে অভিন্ন ইষ্টপুরুষ-পরিপূরণের রাস্তায় সবাইকে নিয়ে চলার আর সময় পেলেন না। তাঁর উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হলো না।
নিজের, দেশের এবং দশের উন্নতি করতে হলে সবার আগে চাই ঐ ইষ্টপুরুষে কেন্দ্রায়িত হয়ে চলা এবং পরিবেশকেও সেই পথে আকর্ষণ করা।
কথাপ্রসঙ্গে একদিন দেশসেবক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বললেন, 'ভারতের উপরে বিপদ আসতে পারে। এ ব্যাপারে সজাগ থাকা লাগে। আমি যা-যা কইছি, সে-সব তো হুবহু ঘটে গেল। তাই মনে হয়, এখন যা-যা কই, সে-সবও ঘটতে পারে। আমি যেমন দেখতে পাই, তেমনই তো বলি। তাই, মনে হয়, আগামী দিনের চেহারা যেমন দেখতে পাচ্ছি, তার মোকাবিলার জন্যে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। বিপদ এসে গেলে আর বিশেষ কিছু করার থাকে না।'✅
10