🎗️প্রেম কী? প্রেমের লক্ষণ কী কী?
🎗️কি-কি রকম সম্বন্ধের ব্যক্তিদ্বয়ের ভিতর প্রেম হইতে পারে?
🎗️প্রেমে প্রিয়র নিকট কোনরকম চাওয়া থাকাই কি সম্ভব নয়?
🎗️'কষ্ট' মানে কী?
🎗️'বৃত্তিভেদ' কী? কী ক'রে হয়?
🎗️'সুন্দর' মানে কী?
🎗️'প্রাপ্তি' মানে কী? 'ভগবৎ-প্রাপ্তি'ই বা কী?
২৪শে এপ্রিল, ১৯৩৪
প্রশ্ন। 'রস' কাহাকে বলে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। 'রস' মানে the sensation which occurs in contact of anything-may occur physically or mentally, অর্থাৎ রস বলিতে বুঝায় সেই অনুভূতি যাহা কোন-কিছুর সংস্পর্শে আসিলে হয়, স্থূলভাবে দেহের মধ্য-দিয়া ও সূক্ষ্মভাবে মননের সাহায্যেও হইতে পারে-ভাবিয়াও রস হয়। তাই, রস-ধাতু মানে আস্বাদন করা।
প্রশ্ন। প্রেম কী? প্রেমের লক্ষণ কী কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। কোনো ব্যক্তিতে (প্রিয়তে) তুষ্ট থাকার ভাবই প্রেম।
প্রেম চায় না প্রেমাস্পদ তাহাকে লইয়া বিব্রত হইয়া থাকে- প্রেমাস্পদ তাহার সেবা দ্বারা তাহাকে তুষ্ট বা পুষ্ট করে। প্রেমাস্পদের তুষ্টি বা পুষ্টিই তাহার কাম্য এবং কৰ্ম্ম,-ইহাতেই তাহার আত্মতৃপ্তি! তাই, প্রেমে ঈর্য্যা, হিংসা বা কষ্ট নাই, অথচ সে তাহার প্রেমাস্পদকে লইয়া সর্ব্বদা বিব্রত থাকিতে চায়-প্রেমাস্পদের জন্য সে যাহা করে তাহার জন্য তাহার বেদনা নাই, হিসাব-নিকাশ নাই, তুলনা নাই। প্রিয়র ঈপ্সিত কৰ্ম্ম করিতে সে ব্যগ্র হইয়া থাকে; তাই, সে সব-সময়ে ক্ষিপ্র। প্রেমে প্রিয়র জন্য নিজের খেয়ালকে palatably sacrifice করে অর্থাৎ তুষ্টি ও তৃপ্তির সহিত বিসর্জন দেয়। প্রেমে তাহার প্রিয়র প্রিয়কে বড়ই ভালবাসে-কারণ, প্রিয় লইয়া প্রেমাস্পদ তুষ্ট থাকেন। প্রেম উন্নতকে বরণ করে, আর স্নেহ অবনতকে উন্নত করে। প্রেমে এমন-কি ভগবানকেও তাহার প্রেমাস্পদেই পেতে চায়। এইগুলি প্রেমের characteristic (লক্ষণ)।
প্রশ্ন। কেহ-কেহ প্রেমাস্পদের ধ্যানমগ্ন হইয়া তাঁহার চিন্তা লইয়া নীরব উপভোগের পক্ষপাতী !
শ্রীশ্রীঠাকুর। প্রেমে প্রেমাস্পদের তুষ্টি ও পুষ্টিই প্রধান এবং প্রথম লক্ষণীয়; তাই সে চায় প্রেমাস্পদের হুকুম তামিল করতে-সে তার নীরব উপভোগেই সুখী হয় না। অর্থাৎ, activity-র ভিতর-দিয়ে (নানা কর্মের মধ্য-দিয়ে) তাঁর ইচ্ছাকে পরিপূরণই তার পরম সার্থকতা। কেন-না, সে কর্ম্মের ভিতর-দিয়ে নিত্য নূতন ক'রে প্রেমাস্পদকে পায়,-আর, সেই পাওয়াতে সে মুগ্ধ, বুদ্ধ এবং শুদ্ধ হয়; তাই, তার কর্মতৎপরতা অত ক্ষিপ্র-অত tremendous (প্রচণ্ড বেগবান)। সে তা'র প্রেমাস্পদের প্রত্যেক ব্যাপারেই থাকতে চায়-তাতে তার প্রয়োজন থাক্ আর নাই থাক্-সর্ব্বদাই প্রস্তুত। সুখেই হোক্ আর আপদেই হোক্ যেখানেই তাঁর progress retarded হ'তে চায় (উন্নতি ব্যাহত হ'তে চায়), প্রেমাস্পদ দেখবে তার প্রেমিক অযুত হস্তীর বল নিয়ে-অযুত আশায়-অযুত ব্যগ্রতায় তাঁকে সার্থক করতে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে; প্রেম তাই সর্ববিজয়ী।
প্রেমে প্রেমিকের প্রতিষ্ঠা অনিবার্য্য, প্রেমিক তাই তাতে জগৎকে সম্মোহিত করে।
প্রেমের জ্ঞান সহজ; কারণ, কিসে প্রেমাস্পদের progress retarded (উন্নয়ন ব্যাহত) হ'তে পারে আর কিসে বা retardation (বাধা) ব্যাহত হ'তে পারে-চিন্তা দ্বারা তার solution ক'রে (সমাধান ক'রে) সব সময়ের জন্য তার প্রস্তুত থাকতে হয়; তাই, তার জ্ঞান সহজ না-হ'য়ে উপায় নাই-তাই, তার চলা, বলা, আচার-ব্যবহার ঐ-প্রকারেই নিয়ন্ত্রিত হয়।
প্রশ্ন। কি-কি রকম সম্বন্ধের ব্যক্তিদ্বয়ের ভিতর প্রেম হইতে পারে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। মঙ্গল করা বা মঙ্গল-চিন্তা স্বভাবসিদ্ধ এবং যাঁহার সংস্পর্শে সে enlightened হয় (উদ্ভাসিত হয়) এমনতর superior-এর (শ্রেষ্ঠের) সহিতই প্রেম সম্ভব।
প্রশ্ন। প্রেমে প্রিয়র নিকট কোনরকম চাওয়া থাকাই কি সম্ভব নয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর। চাওয়া থাকে প্রেমাস্পদের তুষ্টি ও পুষ্টি-আর প্রেমিকের স্বার্থ-ই তাই। সে ঐ প্রলোভনে উদ্দাম, অবাধ এবং দক্ষ হয়-দক্ষ না হ'য়ে তার উপায়ই নাই। যেমন ধরুন, হনুমানের গন্ধমাদন আনয়ন-ঔষধ চিনতে না পেরে পাহাড়-সমেতই নিয়ে হাজির। তাই প্রেমে প্রেমাস্পদের interest-এর against-এ (স্বার্থের বিরুদ্ধে) কোন বাধাই তাকে resist করতে (প্রতিহত করতে) পারে না।
প্রশ্ন। প্রেমাস্পদের নিকট পাইলে খুশি-এমন ভাব থাকে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। পাইলে খুশি কিন্তু আশা রাখে না, আর সেই জন্য অল্পে অত্যন্ত অনুভব করে-অনেকে এত মুখর হয় তাহার গান যেন ফুরায় না।
প্রশ্ন। কোনো-কিছু চাওয়া, না-পাইলে অসন্তোষ বা পাইবার জন্য জিদ একটুও থাকিলে কী বুঝিতে হইবে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। যাহা চায় তাহাতেই সুখ কিন্তু যাহার নিকট চায় তাহাতে সে সুখী নয়, অর্থাৎ ভালবাসা, ভক্তি বা প্রেম তাহার সহিত নাই-এক-কথায়, স্বার্থ-ই তাহার প্রেমাস্পদ। স্বার্থ কখনো তাহার নিজের whims-কে (খেয়ালকে) sacrifice (বিসর্জন) করিতে পারে না, আর ভালবাসা তাহার প্রিয়র interest-এ (স্বার্থের খাতিরে) তাহা sacrifice (বিসর্জন) করিয়া সুখী হয় এবং enlightened হয় (উদ্ভাসিত হয়)। ভালবাসা জিদ করা জানে না।
প্রশ্ন। কেন জিদ করা জানে না?
শ্রীশ্রীঠাকুর। জিদ ক'রে বাধ্য করলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও করার দরুন যদি তাঁর দুঃখ হয় তাই!
প্রশ্ন। কেহ প্রিয়কে নিজের মনের মত ক'রে পেতে চায়, কেহ-বা নিজেকে প্রিয়র মনের মত ক'রে গ'ড়ে তুলতেই ব্যস্ত-তাই ক'রেই খুশি! দু'জনেই তো ভালবাসে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। ভালবাসার জনকে যে নিজের মত ক'রে পেতে চায়, সে তার নিজের মনের ভালবাসার কল্পনাগুলিকেই ভালবাসে; তাই, তার ভালবাসা সকাম-নিজের কামনা, ব্যক্তিতে যা' আছে তা'তে তুষ্ট নয়।
আর, ব্যক্তির স্বভাবে যা' আছে, তাই দ্বিতীয় ব্যক্তির তুষ্টির সামগ্রী; তাই সে নিজের যা'-কিছু তা' দিয়েই তাঁকে পুষ্ট করতে চায় এবং তাতেই তার আনন্দ ও তৃপ্তি-এই হ'চ্ছে real form of love (প্রকৃত প্রেমের রকম)-নিষ্কাম অর্থাৎ তাঁর যাতে ভাল হয় তাই আমার ভাল,-নিজের দিকে নজর দিয়ে সে কোনমতে বিব্রত হ'তে চায় না।
প্রশ্ন। নিজে তাঁর মনের মত হ'লাম কি না-এ হিসাব করে কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর। এ-জাতীয় হিসাব-নিকাশে তার কিছু interest (স্বার্থ) নাই।
প্রশ্ন। কেউ-কেউ ভালবাসার জনকে আরো ভালো হবার জন্য press করে (জিদ করে)-তাকে আরো মহীয়ান্ ক'রে তোলার জন্য সর্ব্বদা ব্যস্ত।
শ্রীশ্রীঠাকুর। এ হ'ল ভালবাসার রীতি-কিন্তু press ক'রে না (জিদ ক'রে না) বা তাকে বিব্রত ক'রেও তোলে না। কিন্তু এমনতর attitude-এ (রকমে) সব-কিছু করে, যা'তে তার ego (অহং) তো wounded (আহত) হয়ই না-বরং elevated হয় (উদ্বর্দ্ধিত হয়)।
প্রশ্ন। কষ্ট, ক্লেশ, বেদনা, ক্লান্তি ইত্যাদি বোধ কি প্রেমের বিরোধী নয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর। যেখানে প্রেম, will (ইচ্ছাশক্তি) সেখানে enormous (বিপুল)। তাই প্রেমে বেদনার কোনো হিসাব-নিকাশ নাই। যেমন, সীতার সন্ধানে গিয়া হনুমান বিপন্ন হইয়াছিল-লঙ্কা পোড়াইতে গিয়া মুখ পুড়িয়া গিয়াছিল, কিন্তু সীতার খোঁজ শ্রীরামচন্দ্রকে জানাইবে এই আনন্দে তাহার ও-সব কিছু মনেই ছিল না।
প্রশ্ন। 'কষ্ট' মানে কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। অন্যের তুলনায় আমি খারাপ এই বিবেচনায় উত্তমে বিরক্তি বা হিংসা, নিজেতে ধিক্কার যখন আসে তখনই কষ্ট হয়। তাই, কষ্ট কথাটা এসেছে কষ-ধাতু হইতে-আর কষ-ধাতুর মানে হিংসা করা।
প্রশ্ন। কষ্ট, ক্লেশ, ক্লান্তি ইত্যাদির বোধ যদি থাকে, তা'হ'লে কী বুঝিতে হইবে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। মনে হয়-প্রেম নাই, তাই will (তীব্র ইচ্ছা) নাই, আছে বাধ্য-বাধ্যকতা-obligation and intention, - তাই কষ্ট, বেদনা, ক্লান্তি, হয়রাণি ইত্যাদির হিসাব-নিকাশ।
প্রশ্ন। Intention বলতে আপনি কী mean করেন (বোঝেন)? Will ও intention-এ তফাৎ কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। Intention-এ মনকে যেন জোর ক'রে কোন দিকে দেওয়া হ'চ্ছে এই ভাব,-স্বতঃপ্রবৃত্তি নয়। Will (ইচ্ছা) স্বতঃপ্রবৃত্তি, rubber-কে(রবারকে) টানার মত নয়।
প্রশ্ন। প্রেমে নাকি surrender (আত্মসমর্পণ) হয়? Surrender বা আত্মসমর্পণ কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। Surrender-এর (আত্মসমর্পণের) রাজত্বেই প্রেমের সিংহাসন। কারণ, প্রেমাস্পদের তুষ্টি বা পুষ্টি ব্যতীত আর অন্য-কিছুতে আত্মতুষ্টি তার স্বভাববিরুদ্ধ-অতএব বেদনার। তাই, surrender-এই (আত্মসমর্পণেই) তার তৃপ্তি, তুষ্টি, পুষ্টি, ইত্যাদি।S
urrender (আত্মসমর্পণ) মানে annihilation নয় (আত্মনাশ নয়)-existence-এর (অস্তিত্বের) অপলাপ নয়। যেমন আমরা খাদ্যে বেঁচে থাকি, তেমনি প্রেমাস্পদে বেঁচে থাকি।
প্রশ্ন। যে নিজেকে অমন surrender করে, সে কি অসীম কষ্টকে বরণ ক'রে নেয় না-সারা জীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভোগবুদ্ধি, সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে কিম্ভুত-কিমাকার হ'তে হয় না কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর। কিম্ভুত-কিমাকারের পরিসমাপ্তি (আত্মসমর্পণে)-তা' সে বোধ করে। তাই, surrender-এ সে-surrender-এ (আত্মবিসর্জনে) surrender কথা নাই, স্বতঃ, স্বভাবতঃ। এটা সে বোধ করে। তাই তা' সহজ।
প্রশ্ন। প্রেম কখনো প্রেমাস্পদের liberty encroach (স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ) করে নাকি?
শ্রীশ্রীঠাকুর। প্রেমাস্পদের liberty encroach করার-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার-কারণই উপস্থিত হয় না। কারণ, প্রেমাস্পদই তার liberty (স্বাধীনতা)-তা'ছাড়া, অন্য liberty (স্বাধীনতা) সে পছন্দই করতে চায় না, তার সমস্ত বৃত্তি সেইখানেই সার্থক; তাই, বৃত্তিভেদ automatically (আপনা-আপনি) এবং imperceptibly (অজ্ঞাতসারে) হয়।
প্রশ্ন। 'বৃত্তিভেদ' কী? কী ক'রে হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর। বৃত্তিগুলি যখন এক-এ উদ্দাম হ'য়ে ওঠে, তার সমস্ত আকাঙ্ক্ষাগুলি এক-এ তৃপ্ত হ'তে চায়-এক-এরই প্রতিষ্ঠা করে, সাহচর্য্য করে, সহানুভূতি করে, পুষ্টি করে-এক-কথায়, সার্থকতা লাভ করে তখনই তার বৃত্তিগুলি ভেদ হয়। তখনই হয়-
"ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্ব্বসংশয়াঃ।
ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্ম্মণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে ।।”
প্রশ্ন। প্রেমিককে কেউ যদি বলে- Surrender বা sacrifice (আত্মবিসর্জন বা আত্মত্যাগ) করেছে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। Surrender বা sacrifice (আত্মসমর্পণ বা আত্মত্যাগ) সে অন্য-চক্ষে দেখে; কেহ বলিলে, বলে সার্থক হইয়াছি-gain করিয়াছি (লাভবান্ হইয়াছি)।
প্রশ্ন। প্রিয়তম নাকি চিরসুন্দর, চিরনবীন-এর তাৎপর্য্য কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। কতকগুলি complex বা গ্রন্থির সমাবেশই মানুষের মন। যে-complex বা বৃত্তি তা'র সম্মুখে আসে, তা'ই তার প্রেমাস্পদে সার্থক হ'য়ে ওঠে; তাই, সে প্রতিনিয়ত তার প্রেমাস্পদকে নূতন-নূতন ভাবে দেখে, বোধ করে ও পায়। আর, মনের সমত্ব established (প্রতিষ্ঠিত) হয় তাঁর সংস্পর্শে তাই সে সুন্দর।
প্রশ্ন। 'সুন্দর' মানে কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। সে-ই সুন্দর হ'য়ে ওঠে যখন তার বৃত্তিগুলি কাহাতেও adjusted (মীমাংসিত), তুষ্ট, পুষ্ট ও সার্থক হয়। Psychical attitude দ্বারা (চিত্তের ভাব দ্বারা) physical adjustment (দৈহিক সমাবেশ) নিয়ন্ত্রিত হয়, অর্থাৎ মনের ভাব যার যেমনতর, physical adjustment-ও-শারীর-পেশীর সমাবেশও তার তেমনতর। অনেক-সময়ে artistically (গঠনের সৌষ্ঠবে) নিখুঁত হ'লেই যে সুন্দর হয় তা' নয়; যেখানে নিখুত মনের বাস অর্থাৎ শুদ্ধ মন, একানুরক্ত মন-তার চলা, বলা, করা তেমনতর হয়; আর তাই সুন্দর-আর তা'তেই সমতা-সত্যিকারের নিখুঁত বলে তাকেই। সত্যিকার (real) মানেই কিন্তু যা'-নাকি মানুষের জীবনকে অক্ষুণ্ণ করে-elevate বা উন্নীত করে-তুষ্ট-পুষ্ট করে-useful to our life (জীবনের পক্ষে সহায়ক)।
প্রশ্ন। প্রেমে নাকি মানুষের বার্দ্ধক্যকেও দূরে সরাইয়া রাখে? তা' কি-ক'রে সম্ভব? বয়স তো হয়ই!
শ্রীশ্রীঠাকুর। বিরহ যদিও বেদনা-মধুর, তথাপি সে বিরহ চায় না। সে চায়-তুমি থাক চিরদিন, আর তোমাকে আমি এমনি করিয়া চিরদিন উপভোগ করি,-অবশ্য, এই উপভোগ তুমি যে আমাকে উপভোগ করিয়া তুষ্ট হও বা হইতেছ এইটাই আমার উপভোগ্য। তাই, সে সব-সময় বার্দ্ধক্যকে ভুলিয়া থাকিতে চায়। আর, মনে যাহা স্থান পায় না, তাহা তাহাকে আক্রমণ করিতেও পারে না। প্রেমাস্পদের কর্ম বা সেবা হইতে বিরত থাকিতে হয়, প্রিয়র কোনো অন্যায় তাহার অনুপস্থিতিতে ঘটে-এই জাতীয় আশঙ্কায় তাহার বহু সেবক থাকা সত্ত্বেও সে সর্ব্বদা প্রস্তুত থাকে। পাছে রোগ-বালাই, আপদ-বিপদ তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিয়া প্রেমাস্পদ হইতে তাহাকে দূরে লইয়া যায় এই ভয়ে-তাহার চাল-চলন এতই বিবেচনাপ্রসূত হয় যাহাতে সে ঐ-রকম অবস্থায় না পড়ে এবং বিপর্যস্ত না হয়, স্বাস্থ্য, বল, তেজ, কৰ্ম্মপটুতা সব-কিছু অটুট রাখা তাহার interest (স্বার্থ) হয়।
প্রশ্ন। 'প্রাপ্তি' মানে কী? 'ভগবৎ-প্রাপ্তি'ই বা কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর। 'প্রাপ্তি' মানে মনে লেগে থাকা-যুক্ত থাকা। আর ভগবত্তা মনে নিরবচ্ছিন্ন লেগে থাকে তাকেই ভগবৎ-প্রাপ্তি বলে।
প্রশ্ন। মনে লেগে থাকাই যদি প্রাপ্তি হয় তবে বিরহে তো মনে লেগে আরো বেশীই থাকে! তাহ'লে 'বিরহ' কা'কে বলে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। মন যখন প্রেমাস্পদে বিশ্রাম লাভ না করে, অর্থাৎ as an entity or bodily (প্রত্যক্ষভাবে- দেহধারী সত্তারূপে) তাঁহাকে না পায় তখনই তাহাকে বিরহ বলে, আর, তখনই মন তাহাকে লইয়া তাহার জন্য উদ্বিগ্ন থাকে।
প্রশ্ন। বিরহের বিপরীত তাহ'লে-?
শ্রীশ্রীঠাকুর। মিলন।
প্রশ্ন। তাঁকে পাইলাম, কি না-পাইলাম-এই চিন্তা প্রেমের বিরোধী কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর। একেবারে! কারণ, প্রেমে সংশয় নাই-তাঁকে পাওয়ার বুদ্ধি নাই; 'আমি তাঁর'-এই তার অস্তিত্ব। তাহ'লে পাওয়া-না-পাওয়ার প্রশ্ন কোথায়! সন্দেহ প্রেমের বিপরীত পথ, ইহা প্রেমকে তমসাচ্ছন্ন করে।
প্রশ্ন। যদি ঐ জাতীয় চিন্তা আসে?
শ্রীশ্রীঠাকুর। তাহা avoidable (পরিহর্তব্য)-avoid করা (পরিহার করা) উচিত।
প্রশ্ন। কেমন করিয়া avoid (পরিহার) করিতে হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর। মনে করুন-আপনার পাশে আপনার বিরক্তিকর এমন-কিছু ঘটিতেছে, যাহার উপরে আপনার কোন হাত (control) নাই। সে-অবস্থায় যেমন করিয়া আপনার মন তাহা ignore (উপেক্ষা) করে এবং আপন কাজে নিযুক্ত হয়।
প্রশ্ন। "এই পাওয়া না-পাওয়ার প্রশ্ন আমার আসে কেন? এ' তো ভারি দুর্ব্বলতা আমার! হে ঠাকুর, আমার এইগুলি দূর ক'রে দাও,"-ইত্যাদি চিন্তা ক'রে ঐ চিন্তাগুলি সরাবার সুবিধা হয় কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর। না, ওদের সরাইবার চিন্তায়ও যদি যুক্ত হওয়া যায়, তাহা-হইলে উহাই মনে আধিপত্য করে বরং আরো বেশী করিয়া। তাই, উপায় ignore করা এবং avoid করা অর্থাৎ উপেক্ষা করা ও দূরে সরাইয়া দেওয়া, এবং করণীয় কর্মে তখনই যুক্ত হওয়া।
প্রশ্ন। অনেকেই শান্তি চায়-'শান্তি দাও, শান্তি দাও' করে। 'শান্তি' কী? মানুষ শান্তি চায় কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর। 'শান্তি' মানে বিশ্রাম। যখনই প্রবৃত্তিগুলি কোন এক-এ সার্থকতা অনুভব করে, এক-এ দাঁড়াইয়া adjusted (মীমাংসিত) হয়, enlightened (উদ্ভাসিত) হয়,- আর তার বৃত্তি জগতে-আর যা'ই কিছু করুক না-এক-এ অটুট থাকে, এককেই সমৃদ্ধ করে এবং সমৃদ্ধ হয়, তাঁকে-নিয়ে সব চায় কিন্তু তাঁকে encroach ক'রে (উল্লঙ্ঘন ক'রে) আর-কিছু চায় না-তখনই মানুষ শান্তির অধিকারী হয়।
আর, যে-মন কিছুকে আশ্রয় করে নাই বা কিছুতে আশ্রয় পায় নাই-সেই মনই শান্তির অন্বেষণ করে!
_____________Narir Pothe End___________
10