- অবগুণ এক ঝাঁকিতে ছাড়তে হয়-পৃষ্ঠা ৭
- ঋত্বিকদের বাড়ী কেমন হবে-পৃষ্ঠা ৮
- মরণ ও স্মৃতিবাহী চেতনা-পৃষ্ঠা ৪
- যজন-যাজন-ইষ্টভৃতি-পৃষ্ঠা ৫
- নিরুপায়ের উপায়-পৃষ্ঠা ৫
- কর্মীদের প্রতি-পৃষ্ঠা ৬, ৯
- মরণে সান্ত্বনাদান-পৃষ্ঠা ৪
- সেবায় লক্ষণীয়-পৃষ্ঠা ৭
- ধর্ম-পৃষ্ঠা ৬
P 1-10
১৪ই পৌষ, সোমবার, ১৩৪৮ (ইং ২৯।১২।৪১)
পঞ্চদশ ঋত্বিক্-অধিবেশন, তাই বাইরে থেকে অনেকে আসছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর মায়ের মতো উৎকণ্ঠা নিয়ে ভক্তগণের আগমন-প্রতীক্ষায় আছেন। প্রত্যেকটি মানুষই যেন তাঁর কাছে সাত রাজার ধন এক মাণিক। দেখামাত্র কত খুশি! শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে তাসুতে ব'সে আছেন। কাশীপুরের ওদিক থেকে বাস আসছে, বাসের যাত্রীদের 'বন্দে পুরুষোত্তমম্' ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত। শ্রীশ্রীঠাকুর আনন্দ-সহকারে ব'লে উঠলেন, 'ঐ আসছে'। তিনি অধীর হ'য়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন-কা'রা এসেছে দেখবার জন্য। ভূষণদাকে বললেন-'তুই এখন ঐ দিকে যা, লোকজন সঙ্গে ক'রে নিয়ে ওদের মালপত্র নামায়ে গেষ্ট-হাউসে জায়গা-টায়গা ঠিক ক'রে দেগা যেয়ে।' ভূষণদা (চক্রবর্তী) গেলেন। কিছু সময় বাদে একসঙ্গে অনেকে এলেন, তাঁদের অনেকের হাতে ফলমূল, তরিতরকারী, মিষ্টি, নতুন চাল, নতুন গুড় ইত্যাদি। শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রীতিঘন মোহনমূর্ত্তি দেখে সকলের মন আনন্দে পরিপূর্ণ। সবাই প্রণাম করবার জন্য ব্যস্ত। তাঁর স্নেহ-কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত হ'য়ে উঠলো-'কি রে! আইছিস্?' 'অমুক কোথায়?' 'সে কখন আসবি?' 'আপনিও আইছেন? বেশ! বেশ!' প্রত্যেকে তা'র আনীত জিনিসপত্র দেখাচ্ছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর সস্নেহে বলছেন-'যা! বাড়ীর ভিতর দিয়ে আয় গিয়ে।' বিভিন্ন এলাকার লোক এসেছেন, শ্রীশ্রীঠাকুর এক-একজনের কাছে সেই-সেই স্থানের অন্যান্যদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। যশোহরের সুরেনদার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, 'সুবোধ আর কালিদাস ক'নে? তা'রা আসেনি?' সুরেনদা বললেন 'হ্যাঁ, তাঁ'রা এসেছেন; সুবোধদা কেষ্টদার বাড়ীতে, কালিদাসদা বঙ্কিমদার বাড়ীতে, একটু পরেই আসবেন।' এইভাবে বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, ২৪ পরগণা, কলকাতা, নদীয়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানের দাদাদের কাছ থেকে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। দাদারা যেমন এসেছেন, তেমনি মায়েরাও এসেছেন শিশুসন্তানসহ। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রীতিভরে সবার দিকে চেয়ে-চেয়ে দেখছেন। তাঁ'র দৃষ্টি করুণায় ভরা, মুখখানি প্রস্ফুটিত শতদলের মতো অনির্বচনীয় লাবণ্যে উদ্ভাসিত। তিনি বাঁধের ধারে তাসুতে তক্তপোযের উপর পাতা শুভ্র শয্যায়, শুভ্রবেশ প'রে বসেছেন। পরণে শান্তিপুরী কালপেড়ে ধুতি, গায় আন্দির হাফ পাঞ্জাবী ও আদ্দির চাদর। তক্তপোযটি বেশ বড়, তার উপর ঝক্ঝকে পরিষ্কার শুভ্র শয্যা। তক্তাপোষ-জোড়া বিরাট উচু সাদা নেটের মশারি ফ্রেমের সঙ্গে টানান, এখন পাশগুলি গুছিয়ে উপরে তুলে রাখা হয়েছে। তাসুর মধ্যে বাহুল্য কিছু নেই। পুবদিকে আছে একটি ঘড়ি, একখানি ক্যালেন্ডার আছে ঘরে। শ্রীশ্রীঠাকুরের চশমা ও দু'-একখানি বই আছে বিছানার পাশে। নীচেয় গড়গড়া, তামাক, টিকে, সুপারীর কৌটা, জলের ঘটি, পিকদানি, দাঁতখোঁটা, শ্রীশ্রীঠাকুরের কালো চটিজুতো, ইত্যাদি। তাসুটি সম্পূর্ণ টিনের-উপরে ও চারপাশে সর্বত্রই টিন, ভিতটি সানের, ভিত তেমন উচু নয়। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে বড়-বড় দরজা আছে, আর পূব ও পশ্চিম দিকে আছে জানালা। চতুদ্দি'কে খোলা, দক্ষিণ দিকে শিশিরস্নাত বিরাট পদ্মার চর, বাঁধের ধারে পুবদিক-বরাবর একখানি কাঠের ঘর, একটু ফাঁকে নিভৃতনিবাস, তার ওদিকে একটা টিনের ছাপরা। উত্তর দিকে সৎসঙ্গ প্রাঙ্গণ, এই প্রাঙ্গণের মধ্যে কয়েকটি বকুল গাছ, তার পুব দিকে হুজুর-মহারাজের মন্দির, তার পাশে সোনালগাছ ও নিমগাছ। মন্দিরের উত্তর দিক্ জুড়ে শ্রীশ্রীবড়মার ঘর, তার সামনের দিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের পিতৃদেবের কুটির, তার উত্তর-পশ্চিম দিকে বিরাট দ্বিতল অট্টালিকা মাতৃমন্দির, পিতৃদেবের কুটিরের সোজাসুজি পশ্চিম দিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের মাতৃদেবীর কুটির, তার একটু এদিকে কাজল ভাইয়ের খড়ের ঘর, তার পাশে কলতলা, কলতলার পাশে সুশীলদার ঘর। লোকসমাগম সত্ত্বেও আশ্রম-প্রাঙ্গণ বেশ নিরিবিলি, কেবল মাঝে-মাঝে এদিক-ওদিক্ থেকে 'জয়গুরু' ও প্রীতি-সম্ভাষণাদি শোনা যাচ্ছে। পাখীর কাকলি, উঠান ঝাড় দেওয়ার শব্দ ও কল থেকে জল তোলার শব্দ ছাড়া অন্য কোন হৈ-হল্লা নেই। কেষ্টদার বাড়ীর ওদিক্ থেকে একটা ভাল ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুরের তাম্রকূট সেবনের মধুর গন্ধ মিলিত হ'য়ে একটা আমেজ সৃষ্টি করেছে। একটু একটু ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে উত্তর দিক্ থেকে, অবশ্য তা' খুব কঙ্কনে নয়। এখন কেবল সূর্য উঠছে, রোদ এসে পড়েছে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিছানায়, গায়ের উপরে। তাঁর সোনার অঙ্গে সোনালী আলো এসে মিশেছে, বড়ই মনোরম লাগছে তাঁকে। কেবলই দেখতে ইচ্ছে করছে। তাঁকে দেখলেই ভাল লাগে, যত দেখা যায়, তত দেখতে ইচ্ছে করে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে মানুষের যতটা ভাল না লাগে, তার চাইতে বেশী ভাল লাগে তাঁকে দেখে। তিনি যে আমাদের সব চাইতে আপন, নিজের থেকেও আপন, তা' তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালে বিশেষ ক'রে বোঝা যায়। তাঁর চোখ, মুখ, নাক, কান, চেহারা তারস্বরে ঘোষণা করে-তিনি আমদের যা'-কিছুর আধার, যা'-কিছুর আশ্রয়, আমাদের অন্তর-পুরুষের ব্যক্ত-প্রতীক তিনিই। তাই, তাঁর সঙ্গে মিলন-মুহূর্ত্ত মানুষের পরম সুখলগ্ন, শুভলগ্ন। এই শুভ সংযোগের জন্য মানুষ যুগ-যুগ জন্ম-জন্মান্তর তপস্যা করে। নানা দিক দেশ হ'তে আগত অগণিত লোকের এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সবাই প্রাণ ভ'রে দেখছেন তাঁকে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
তোর মালা কামানো কেন রে? ২৪ পরগণার একটি ছিপছিপে শ্যামবর্ণ ১৫।১৬ বৎসর বয়স্ক ছেলেকে লক্ষ্য ক'রে হঠাৎ ব'লে উঠলেন ঠাকুর।
আমার বাবা মারা গেছেন।
কী হইছিল রে?
জ্বর, কাশি আরো অন্যান্য উপসর্গ ছিল।
তা'তেই মারা গেল? ভাল ক'রে চিকিৎসা করাসনি?
হ্যাঁ। চিকিৎসা সাধ্যমতো করা হয়েছিল, কিন্তু বাঁচান গেল না। তবে বাবার মৃত্যুসময়ের দৃশ্য অভাবনীয়।
কি রকম?
আপনার অজানা তো কিছুই নয়। আপনিই তো গিয়েছিলেন তখন।
কয় কী রে ডাকাত?
হ্যাঁ। বাবা সকালেই আমাকে ডেকে বললেন দ্যাখ্ খোকা! আমার ডাক এসে গেছে, আজই আমাকে যেতে হবে। আমার যাবার সময় তোরা কান্নাকাটি না ক'রে আমার কাছে ভাল ক'রে নাম করিস্। যাবার বেলায় নাম শুনতে-শুনতে যেন যেতে পারি, আর ঠাকুরের ফটোটা আমার চোখের সামনে রাখিস্ -দয়ালকে দেখতে-দেখতে চ'লে যাব দয়ালের কাছে। তোকে আমি বিষয়-আশয় কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না, কিন্তু তোকে আমার সর্বশ্রেষ্ঠ ধন দিয়ে যাচ্ছি-আর তা' হ'চ্ছে আমার ঠাকুর। ঠাকুরকে ভুলবি না, যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি ঠিকমতো করবি, দেখবি জীবনে এর চাইতে বড় সম্পদ আর কিছু নেই। এই বলার পর বাবার অবস্থা ক্রমশঃ নিস্তব্ধ হ'তে লাগলো। বাবা যা' বলেছেন, সে-সব কথা মাকে না ব'লে আমি কাছাকাছির আরো দু'-একজন সৎসঙ্গীকে নিয়ে বাবার বিছানায় ব'সে উচ্চৈঃস্বরে নাম করতে লাগলাম, আর আপনার ফটোটা বাবা দেখতে পান এমন জায়গায় রেখে দিলাম। বাবা দুই-একবার চোখ মেলে ফটোর দিক চেয়ে দেখছিলেন। আর মনে হ'লো, ভিতরে-ভিতরে নাম করার চেষ্টা করছিলেন। পরে শ্বাসকষ্ট সুরু হ'লো, তবু মাঝে-মাঝে অতিকষ্টে ফটো দেখছেন। আমরা নাম করছি। আমার তখন ভিতর থেকে কান্না ঠেলে আসছে, কিন্তু বাবার কথা স্মরণ ক'রে কাঁদতে পারছি না, নাম করছি। (ছেলেটির চোখ অশ্রুসিক্ত ও কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হ'য়ে উঠলো।) মা এমন সময় এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন, আমি মাকেও নাম করতে বললাম। মা একটু সময় পরে নিজেকে সামলে নিয়ে আমাদের সঙ্গে নাম করতে লাগলেন। বাবা তখন বলছেন-'ঐ দ্যাখ, সোনার রথে ক'রে ঠাকুর আমায় নিতে এসেছেন। দ্যাখ! ঠাকুরের আমার কী অপরূপ রূপ! রোগ-যন্ত্রণার কোন চিহ্ন নেই মুখে। সত্যিই যেন তিনি আপনাকে
দেখছেন। মুখখানি হাসি-হাসি। তিনবার দয়াল-দয়াল ব'লে হাত জোড় ক'রে নমস্কার করলেন, তারপর তাঁর প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। তখন বেলা এগারটা আন্দাজ হবে।............ বাবার কথা মনে প'ড়ে যখনই মন খারাপ হয় তখনই ভাবি, তাঁকে দেখতে পাই না-পাই তিনি আপনার কাছেই শান্তিতে আছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তোর বাবা ছিল পুণ্যাত্মা, তাই অমনতর মৃত্যু হয়েছে। সত্যিকার ইষ্টপ্রাণ যে, মরণকালেও তার ইষ্টের স্মরণ-মনন অব্যাহত থাকে। তবু মৃত্যু মানুষের পক্ষে বড় বেদনাদায়ক। মৃত্যুর মধ্য-দিয়ে মানুষকে চিরতরে হারাতে হয়। তার অস্তিত্ব থাকলেও তার সঙ্গে আমাদের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে না। এইটেই বড় মর্মান্তিক। তাই মানুষ অমৃত-অমৃত ক'রে পাগল হয়। মৃত্যুকে কেমন ক'রে নিকেশ ক'রে সে অমর হবে, তাই তার কল্পনা। মৃত্যুর কাছে বরাবর মার খেয়েও সে পরাজয় স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। মরছে, তবু বলছে 'অমৃত' 'অমৃত'। মানুষের জীবন এমনই চীজ যে তাকে অমৃতকে পেতেই হবে। ও না-পাওয়া পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হবে না। তাই, স্মৃতিবাহী চেতনা যদি আমরা লাভ করতে পারি, তবে মরণকে অনেকখানি অতিক্রম করা হ'লো বলা চলতে পারে।
এর মধ্যে আরো অনেকে এসে প্রণাম করলেন। কেউ-কেউ আবার অন্যদিকে গেলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-চল্! ঐ দিকে যাই। এই ব'লে মাতৃ-মন্দিরের উত্তর দিকে বাবলা-তলায় এসে একখানি বেঞ্চে রোদপিঠ ক'রে বসলেন। সঙ্গে-সঙ্গে সবাই পিছনে-পিছনে আসলেন। তাঁর সঙ্গে একত্র চলার বিরাট আনন্দ আছে, সেই আনন্দ সবার চোখে-মুখে। শ্রীশ্রীঠাকুর এসে বসার পর সবাই তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। সামনে খানিকটা জায়গা ফাঁক রেখে অনেকে বসলেন। সবাই আগ্রহ-উন্মুখ-শ্রীশ্রীঠাকুর কী বলেন-শুনবেন, কী করেন-দেখবেন।
রমেশ (দাস, পূর্বোক্ত ভাইটি) এইবার জিজ্ঞাসা করলেন-আমি এখন কী করব?
শ্রীশ্রীঠাকুর-তুই পড়িস না?
রমেশ হ্যাঁ।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তবে পড়াশুনো করবি। সংসার চলার মতো মোটামুটি সংস্থান আছে তো?
রমেশ বছরের ধানটা হয়, অতি কষ্টে চলতে পারে, আরো কিছু সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর তোদের ঐ দিকে আরো সৎসঙ্গী আছে না? তা'রা আসেনি?
রমেশ আছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন এসেছে। তা'রা এখন গেস্ট হাউসে।
শ্রীশ্রীঠাকুর ফ'কমতো তাদের সঙ্গে ক'রে নিয়ে আমার কাছে একবার আসিস,
আমি তোর মোকাবিলায় তাদের ক'য়ে দেবোনে। আর, তোর ক্ষমতায় যতখানি কুলোয়, তাদেরও দেখবি কিন্তু। মানুষের কাছ থেকে শুধু যদি নিস আর তাদের জন্য কিছু যদি না করিস, তাহ'লে তারা বেশীদিন তোকে টানতে চাইবে না।
রমেশ-আমার আর করার মতো সামর্থ্য কী আছে!
শ্রীশ্রীঠাকুর-ঢের আছে। সব সময় তাদের খোঁজখবর নিবি।
শাকটা, পাতাটা, মূলোটা, কচুটা, যা' পারিস হাতে ক'রে তাই দিবি। তাদের সুখ্যাতি করবি। তারা আনন্দ পায় এমনতর ব্যবহার করবি। পারলে তাদের বাড়ীর ছোট ছেলেপেলেদের একটু-একটু পড়িয়ে দিবি। ইচ্ছা থাকলে কত রকম করা যায়। আর যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি কখনও ছাড়বি না। তোর বাবা একেবারে মোক্ষম কথা ব'লে গেছে। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি যে নিয়মিত করে তার চেহারার মধ্যে একটা দ্যুতি দেখা যায়। সে-দ্যূতি ব'লে দেয় যে, সে পরমপিতার আওতায় আছে, তাই, শয়তান বা গ্রহ তাকে বড় একটা ঘায়েল করতে পারে না।
বিপিনদা (সেন)-ঠাকুর! যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি করে এমন লোককেও তো দুর্ভোগ কম ভুগতে দেখি না!
শ্রীশ্রীঠাকুর-দুর্ভোগ সকলের জীবনেই আসে, কিন্তু তখন যদি বুদ্ধিভ্রংশ হয়, তাহ'লে আরো সর্বনাশ। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি যে করে, তার মগজটা অনেকখানি ঠিক থাকে। তাই, বিপদ-আপদ আরো ঘোরালো হ'য়ে উঠতে পারে না। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি করা, ইষ্টীচলনে চলা মানে, দুর্ভোগকে অতিক্রম করার পথে চলা। দুর্ভোগ মানুষের জীবনে আসবে না, সে কি হয়? তার অতীত কৰ্ম্মফল আছে, অজ্ঞতা আছে, প্রবৃত্তি-চলন আছে, পরিবেশের সঙ্গে • যোগসূত্র আছে-এই সব নানান ছিদ্রের মধ্য-দিয়ে দুঃখ চুইয়ে আসে। দুঃখ চুইয়ে আসার ছিদ্রগুলি বন্ধ করার জন্যই যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি। ইহকালের-পরকালের, আপনার-পরের, এককথায় সবার সব-কালের মঙ্গলের জন্য পালনীয় এই যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি। এই ত্রয়ীর একটাকেও যদি ক্ষুণ্ণ করেন, তাহ'লে ততটুকু সাম্য-হারা হ'য়ে পড়বেন।
বিপিনদা-আমরা যদি যজন ও ইষ্টভৃতি ভাল ক'রে করি, আর যাজন নিয়মিত না করি, তাহ'লে কি দোষ হয়?
শ্রীশ্রীঠাকুর-যাজন না করলে ইষ্ট-উপভোগই স্থবির হ'য়ে ওঠে। যজন যাজনকে সাহায্য করে, যাজন যজনকে সাহায্য করে। একটার অভাবে আর একটা খাটো পড়ে। আর, যাজনের ভিতর দিয়ে পরিবেশকে যদি ধর্মমূখী ক'রে না তোল, তোমার ধর্মও টিকবে না। পরিবেশ আমাদের জীবনের একটা প্রধান অঙ্গ। এই পরিবেশ সম্বন্ধে আমরা যে-দিন থেকে উদাসীন হয়েছি, সেই দিন থেকেই আমরা অনেকখানি ধর্মভ্রষ্ট হয়েছি। তাই, আমরা আজ মনে করি, ব্যক্তিগতভাবে জপধ্যান করলেই ধর্ম' করা হ'লো, তার সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ্বের সঙ্গে আবার সম্পর্ক' কী? কিন্তু সর্বতোভাবে বাঁচাবাড়াই যদি ধর্ম হয়, তবে সে-ধর্ম পরিবেশকে বাদ দিয়ে কিছুতেই হবে না। আর, ধর্মের সঙ্গে মানুষের সর্বাঙ্গীন জীবনবৃদ্ধির যদি কোন সম্পর্ক না থাকে, তবে সে-ধর্মের সঙ্গে মানুষের কোন সম্পর্ক নেই।
কলকাতা থেকে জগৎদা (চক্রবর্ত্তী) বিজ্ঞান-সম্বন্ধীয় একখানা বই নিয়ে এসেছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর বইখানি দেখেই খুশি হ'য়ে বললেন-দে তো দেখি!
রেণুমা (রায়) গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর চশমা প'রে বইটির পাতা উল্টে-উল্টে দেখতে লাগলেন। পরে কেষ্টদার কাছে দিয়ে আসতে বললেন। বললেন-কেষ্টদাকে বলবি প'ড়ে আমার কাছে যেন গল্প করে। অবশ্য এখন নয়-conference (অধিবেশন)-এর পর।
সুবোধদা (সেন) ও কালিদাসদা (মজুমদার)-কে দেখে উল্লসিত হ'য়ে বললেন-আইছিস্? তোদের কথা ভাবতিছিলাম। যা! কেষ্টদার কাছে শোন গিয়ে, অনেক কাজের কথা আছে। কেষ্টদা যা' বুদ্ধি করিছে, ঐভাবে যদি করা যায়, খুব ভাল হবে মনে হয়। তোমাদের কিছু-কিছু কর্মী অন্য জেলার জন্য দেওয়া লাগবিনি। কেষ্টদার ইচ্ছা, এবার বাংলার সব জেলায় কর্মী পাঠায়। ✅
সুবোধদা-আমাদেরই তো আরো কর্মী দরকার।
শ্রীশ্রীঠাকুর (সহাস্যে) বেশ কইছ। তোমরা মুরুব্বি যারা আছ তারা যদি যোগান না দেও, তাহ'লে হবে কী ক'রে?......যা'! কেষ্টদার কাছে শোন গিয়ে, তারপর যুক্তিবুদ্ধি ক'রে যা' ভাল হয় করিস।
সুবোধদা-বাংলার সব জেলায় কর্মী পাঠান হবে এ তো খুর আনন্দের কথা। বিশেষ ক'রে এটা যখন আপনার অভিপ্রেত, যেমন ক'রে হোক করতেই হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তোমাদের যে-সব জেলা থেকে কর্মী কিছু-কিছু ছাড়বে, সেখানে আবার লক্ষ্য রাখতে হবে, তারা আসার দরুণ কাজ যেন hampered (ব্যাহত) না হয়। স্থানীয় wholetime worker (পূর্ণকালীন কর্মী) বাড়িয়েই হোক বা নিজেরা বেশী ক'রে খেটেই হোক, সেটা make up (পরিপূরণ) করা লাগবে। কালিদাস তো লা'ঠেল আছে মন্দ না, ও এই কামে লা'গে গেলি হয়। ওদিকে আছে জাতকাঠ-বামুনের ছাওয়াল, দেখতি গোসাঁই ঠাকুরের মতো লাগে, গোঁফে তাও দিয়ে যেয়ে একজায়গায় দাঁড়ালি মানুষ কর্তা-কর্তা ব'লে পা'র ধূলি না নিয়ে পারবে না। (তাঁর চোখ, মুখ, কণ্ঠস্বর ও হাতনাড়ার ভঙ্গীতে কণাগুলি জীয়ন্ত ছবি নিয়ে ফুটে উঠলো।)
উপস্থিত সকলেই বেশ পুলকিত হলেন। অনেকের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
সুবোধদা (সহাস্যে)-ও তো একরকম wholetime (পূর্ণ কালিক) হ'য়েই আছে। আর, আপনি যা' বলেছেন-সত্যিই ওর আশপাশের বহু গ্রামের লোক, বিশেষতঃ পারশব মোড়লরা ওকে সোনা-কর্তা ব'লে বিশেষ সম্মান করেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন-মাল জোটাইছ ভাল। এখন ভাল ক'রে রপ্ত ক'রে নেও।
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার ওখান থেকে উঠে অতিথিশালার দিকে বেড়াতে বেরুলেন। পেছনে চলেছে শত-শত লোক। দয়াল আনন্দ-মসগুল হ'য়ে গল্প করতে-করতে এগিয়ে চলেছেন। সবারই দৃষ্টি তাঁর দিকে নিবদ্ধ।
যেতে-যেতে রবীনদা (দত্ত) নামক একটি দাদা বলছেন-ঠাকুর! অনেকদিন থেকে ভাবছি, বিড়ি খাওয়াটা ছেড়ে দেব, আগের থেকে কিছু কমিয়েছি, কিন্তু একেবারে ছাড়তে পারছি না।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ছাড়বি তো ঝম্ ক'রে ছেড়ে দিবি। ওইরকম কাথে-কাথে ছাড়া হয় নাকি? কি জানি একটা ছড়া আছে তো?
একটি দাদা-
"একটু ক'রে ধীর চলনে
হয় না অভ্যাস এস্তামাল,
অমনতর চললে বাড়েই
ব্যর্থ বেফাঁস কুজঞ্জাল।
যা' করবি তুই বুঝলি মনে
এক ঝাঁকিতে কর্ তাহা,
সমানে চল্ সেই চলনে
এমন চলাই ঠিক রাহা।"
শ্রীশ্রীঠাকুর-হ্যাঁ। ওইভাবেই করতে হয়। কাটি তো এককোপে।
রামকৃষ্ণ-কথামৃতে একটা সুন্দর গল্প আছে ব'লে শুনেছি। একজনের স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে-অমুক খুব বৈরাগ্যবান, সন্ন্যাসী হ'বে ব'লে দিনক্ষণ দেখেছে, গেরুয়া ছুপিয়ে রেখেছে। তাই শুনে পুরুষটা বললো-ও কখনো সন্ন্যাসী হ'তে পারবে না, ওইভাবে গৃহত্যাগ করা যায় না। স্ত্রী বললো-তবে কিভাবে? পুরুষটা তখনই গামছা কাঁধে বেরিয়ে পড়লো, আর ফিরলো না।
রোদ লাগছে মনে ক'রে একজন শ্রীশ্রীঠাকুরের মাথায় ছাতা ধরলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন-রোদই ভাল লাগছে, আর যদি ধরিসই তবে এমন ক'রে ধর্ যা'তে মাথায় রোদ না লাগে, অথচ গায় রোদ লাগে।
দাদাটি সেইভাবে ছাতা ধরলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর রহস্য ক'রে বললেন-ভাগ্যিস্ তুই আমার কথাটা বুঝলি। কারও-কারও সেবার আগ্রহ এতটা উৎকট থাকে যে, আমার অসুবিধার কথাটা আর বোঝে না। শীতের দিনে হয়তো হাওয়া করতে সুরু ক'রে দিল, বারণ করলে আরো জোরে-জোরে হাওয়া করে। তারা সেবা করে পুণ্যলোভে, আমার সুখসুবিধার দিকে চেয়ে নয়।
সকলের হাস্য।
শ্রীশ্রীঠাকুর আপনমনে বলছেন-এইসব লোভের বালাই নিয়ে মানুষ যতদিন চলে, ততদিন কিন্তু অনুরাগের আনাচে-কানাচেও যায়নি। আর, অনুরাগহারা কসরতে মানুষের জীবন কখনও সহজ হয় না। আবার, সহজ না হ'তে পারলে মানুষ অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে না, যাজনজৈত্র হ'তে পারে না।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথা বলতে-বলতে অতিথিশালার সামনে এসে পড়েছেন। অতিথিশালার দেওয়াল ও মেঝে পাকা, উপরে টিন, চতুদিক বেষ্টন ক'রে ঘর, মাঝখানে খানিকটা খোলা জায়গা।
একদল ঠাকুরকে দেখামাত্র 'বন্দে পুরুষোত্তমম্' ধ্বনি দিয়ে উঠলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, তাই লক্ষ্য ক'রে অন্য সবাই তাদের থামিয়ে দিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরকে একখানা চেয়ার এনে দেওয়া হ'লো, তিনি সেই চেয়ারে বসলেন। মাথায় ছাতা ধরা হ'লো। প্রসন্নতা ও প্রশান্তিতে ভরা মুখখানিকে তাঁর পূর্ণিমার চাঁদের মতো দেখাচ্ছে। চতুদ্দিকে মুগ্ধ মানুষের মেলা। ব'সে খোঁজ নিলেন-কত লোক এসেছে।
ভূষণদা (চক্রবর্ত্তী)-এখানে কয়েক শ' আছেন, তা' ছাড়া ঋত্বিকদের বাড়ীতে-বাড়ীতে গিয়ে অনেকে উঠেছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর-আমার ইচ্ছা ক'রে, প্রত্যেক ঋত্বিকের বাড়ীতে ছোটখাট এক-একটা আনন্দবাজার চলে। বাড়ীতে থাকলে যজমানগুলিকে ভাল ক'রে সেবা দেওয়া যায়, আর খাওয়া-শোওয়া, ওঠা-বসা, যাজন ও আলাপ-আলোচনার ভিতর-দিয়ে অনেক কথা মাথায় গেঁথে দেওয়া যায়। এদের জন্য আলাদা ঘর রাখা ভাল, বিছানা-পত্র রাখা ভাল, বাসন রাখা ভাল। প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের দিকে চেয়েই তেমনতর ব্যবস্থা রাখা দরকার। এইভাবে যজমানদের বাড়ীতে রাখা সব দিক দিয়েই ভাল। তবে তাদের মধ্যে যা'তে কুনোমি না আসে, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ঋত্বিকরা মনে করবে, সৎসঙ্গীমাত্রই ইষ্টের সম্পদ, প্রত্যেকের জন্য তার করণীয় আছে। ফলকথা, কি ঋত্বিক, কি অঋত্বিক, সমগ্র সৎসঙ্গী-মন্ডলীর মধ্যে হৃদ্যতা ও পারস্পরিকতা যত বাড়ে, ততই একটা পারিবারিক সংহতির মতো সৃষ্টি হয়, তা'তে প্রত্যেকে উপকৃত হয়। ঋত্বিকদের বাড়ীতে-বাড়ীতে অনেক লোক থাকলেও, ধঋত্বিকদেরই উচিত অন্যান্য ঋত্বিক ও সৎসঙ্গী-দের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ক'রে দেওয়া। পারস্পরিক আদান-প্রদানের ভিতর-দিয়ে ভালই হয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হয়-কাঁচা মাথা তালবেতাল যাজনের পাল্লায় না পড়ে।
বিপিনদা-'আমার যজমান' 'আমার যজমান' এমন বোধ বেশী থাকা কি ভাল?
শ্রীশ্রীঠাকুর-আমি যদি ঠাকুরের হই, তবে আমার যজমান ভাবায় দোষ নেই। আর আমি যদি ঠাকুরের না হই, তবে আমার যজমান ভাবায় অসুবিধা আছে।
দক্ষিণাদা (সেনগুপ্ত)-কি রকম?
শ্রীশ্রীঠাকুর-আমি যদি ঠাকুরের হই তখন আমার বুদ্ধি থাকে, আমার সব-কিছুকে আমি কিভাবে ঠাকুরের ক'রে তুলতে পারি। আর আমি যদি ঠাকুরের না হ'য়ে আমার প্রবৃত্তির হই, তখন আমার বুদ্ধি হয়, আমার যা'-কিছুকে কেমন ক'রে ঐ প্রবৃত্তির অনুচৰ্য্যী ক'রে তুলতে পারি। তা'তে সবারই কর্ম নিকেশ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ব্রজেনদাকে (চট্টোপাধ্যায়) ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন-ব্রজেনদা! আজ কী আয়োজন?
ব্রজেনদা-আজ আলুকপির ডালনা ও ডাল হ'চ্ছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর খুশি হ'য়ে বললেন-এত লোকের জন্য আলুকপির ব্যবস্থা ক'রে ফেলিছেন, আপনার তো ক্ষ্যামতা কম না।
ব্রজেনদা-আপনার দয়ায় জুটে গেছে।
বিপিনদা (উল্লসিত ভঙ্গীতে)-এবার কেষ্টদা গিয়ে ফরিদপুর টাউন হলে ভাল ক'রে মিটিং ক'রে আসায় আমাদের মুখরক্ষা হয়েছে। গত মিটিংয়ের সময় ঐভাবে বাধা পাওয়ায় আমার মনটা খুব দমে গিয়েছিল।
শ্রীশ্রীঠাকুর কোন উৎসাহ দেখালেন না, একটু কঠোরভাবে বললেন-কেষ্টদাকে না নিয়ে আপনারা নিজেরা-নিজেরাই যদি পারতেন, সেই ভাল ছিল। আর, মন দমে যাবি কেন? আর, এল, মুখার্জীর রায়ের পরেও নাকি অনেকের মন দমে গিয়েছিল। এটা আমার কাছে খুব insulting (অপমানজনক) মনে হয়। Conviction (প্রত্যয়) থাকলে, মানুষ opposition (বিরোধিতা)-র সামনে হৃদ্য বীর্য্যে গ'র্জে ওঠে, সবাইকে বুঝিয়ে সশ্রদ্ধ ক'রে তুলে ছেড়ে দেয়। আমরা যা' করছি, তার মধ্যে চোরায়ে-ছাপায়ে করবার কিছু তো নেই, বাঁচতে গেলে যা' যা' লাগে, তাই করছি, করতে বলছি সকলকে। আমরা অনেক সময় নিজে থেকে মুখ খুলে সব কথা বলি না, তাই পরমপিতা এক-একটা কায়দা-কৌশলের ভিতর-দিয়ে সাধারণের মনে নানা প্রশ্ন জাগিয়ে দেন। ঐ প্রশ্নগুলির আমরা যদি ভাল ক'রে সমাধান দিতে পারি-যুক্তি-বিচার, বিশ্বাস ও আবেগ নিয়ে, তা'তে আমাদের কাজের পক্ষে সুবিধা হয়। শুধু মিঠে বুলি বলাই যাজন নয়, পরাক্রম চাই, প্রত্যয় চাই, তেজ চাই। কিশোরী-ওদের এই জিনিসটা খুব ছিল, গোড়ার আমলে অনন্ত, কিশোরী, গোসাঁই, নফর এরা কি কম কাজ করেছে? আপনার সামনে আপনার আদর্শ ও কৃষ্টি সম্বন্ধে যদি কেউ পাতলা রকমে যথেচ্ছ মন্তব্য বা ব্যবহার করতে সাহস পায়, তার মানে আপনার মধ্যে বিশেষ কোন দৈন্য লুকিয়ে আছে, যা' তাকে অমনভাবে উৎসাহিত করে। বুকে বল যদি না বাড়ে, জায়গামত রুখে যদি দাঁড়াতে না পারেন-ভক্তি-'বিশ্বাসের সম্পদ নিয়ে, তাহ'লে ক্লীবত্ব কিন্তু ঘুচবে না। আর, ক্লীবত্ব যতদিন না যাবে, ততদিন কিছু সৃষ্টি করতে পারবেন না। আপনাদের কোন প্রভাব হবে না, শক্তি হবে না, জাতির স্থায়ী কল্যাণ কিছু ক'রে যেতে পারবেন না। ফাঁকি দিয়ে কিছু হয় না। মনে রাখবেন, চরিত্র-বলই সবচেয়ে বড় কথা।
বিপিনদা-অনেক লোক এমন বেয়াড়া আছে যে যুক্তিবিচার, বিজ্ঞানের ধার ধারে না, নিন্দা-ঠাট্টা করতে পারলেই যেন খুশি।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তার মানে, আপনাদের ব্যক্তিত্বের দ্যূতি কম। আপনাদের দেখে যে-মানুষ যতই বেয়াড়া হোক, তার একটা সম্ভ্রম হবে না কেন, সমীহ হবে না কেন? আমি বলি না যে আপনারা মানুষের সঙ্গে লাঠালাঠি করেন। আপনাদের মধ্যে এমন একটা সৎ-নিষ্ঠ হৃদ্য বীৰ্য্যবত্তা ও পরাক্রম দানা-বে'ধে ওঠা চাই, যার হাপ মানুষের গায়ে লেগে তাদের ছ্যাবলামিকে অনেকখানি সংযত ক'রে তোলে।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথাগুলি বলছেন খুব আবেগের সঙ্গে। তাঁর চোখ-মুখ লাল হ'য়ে উঠেছে। এরপর একবার তামাক খেলেন। 'কিরে, কী খবর?'-গ্রামের মুসলমান গন্ধ সরকারকে দেখে স্নিগ্ধ কণ্ঠে শুধোলেন শ্রীশ্রীঠাকুর।
গন্ধ-ভাল।
পরক্ষণেই 'চল্ যাই' ব'লে উঠে পড়লেন। পিছনে আবার সেই আনন্দ-মধুলুব্ধ মানুষের দল। তাদের চোখে-মুখে এক পরমা তৃপ্তির আবেশ।✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_তৃতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10