📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔶 আগে পারিবারিক সমস্যার সমাধান করে তারপর ইষ্টকাজ করা কি সম্ভব নয় ?
🔶 অহিংসা পরম ধর্ম , হিংসা তো পরম ধর্ম নয় ...
🔶 গ্রহদোষ খণ্ডন কি করে করা যায়...
🔶 ইষ্টের কাজের জন্য বেঁচে থাকতে হবে , এটা খুবই স্বীকাৰ্য , কিন্তু মরণ যদি কোথাও ইষ্টস্বার্থ - প্রতিষ্ঠা ব্যাপারে সহায়ক এবং অনিবাৰ্য প্রয়ােজন হয় , এবং তখনও যদি কেউ বাঁচতে হবেই এই ধুয়ো ধ'রে প্রাণ না দেয় , সেটা কি কাপুরুষতা নয় ?
🔶 যুদ্ধের ফলে যে দারুণ দুর্দিন আসবে , তাতে মানুষ স্ত্রী পুত্ৰাদি নিয়ে একমুষ্টি ভাতের জন্য হয়তো পথে - পথে ঘুরে বেড়াবে , সেই অবস্থায়ও কি ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নী করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে ?
২ রা পৌষ , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৭/১২/৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি , এখন রাত চারটে , প্রকৃতির মধ্যে একটা রহস্যময় স্তব্ধতা বিরাজ করছে , চারিদিকে আধার । সামনের বিরাট চরটা যেন কালোয় মুছে গেছে । কোনদিকে কোন সাড়া - শব্দ নেই , তাসুর টিন থেকে গড়িয়ে - গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা শিশির পড়ছে , তারও শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছে । এত রাতেই উঠে এসেছেন বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , ঈষদাদা ( বিশ্বাস ) , নরেনদা ( চক্রবর্তী ) , বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) ও প্রফুল্ল । তারা বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছেন — কখন শ্রীশ্রীঠাকুর উঠবেন । টান - টান হয়ে শুয়ে আছেন তিনি বিরাট তক্তপোেষ - জোড়া বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে , প্যারীদা শরীরটা মৃদু - মৃদু ঝাঁকিয়ে দিচ্ছেন , যাতে তিনি আরামে ঘুমুতে পারেন । নিদ্রামগ্ন শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছে — তার প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে একটা গভীর প্রশান্তি । বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা , তবু এখান থেকে দূরে সরে গিয়ে কোন ঘরের মধ্যে বসতে ইচ্ছা করছে না কারও । এখানকার বাতাসে যে তার অঙ্গের সুবাস , আবহাওয়ায় তার মধুর স্পর্শ । খানিকটা বাদে শ্রীশ্রীঠাকুরের ঘুম ভাঙ্গলাে । তখন সবাই প্রণাম করলেন তাকে । ঘুম থেকে উঠে কয়েকজনকে বাইরে দাঁড়ান অবস্থায় দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেনবীরেনদা । আপনারা কত সময় আইছেন ?
বীরেনদা — একটু আগে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( ব্যস্তসমস্ত হ'য়ে ) —এই শীতে বাইরে দাড়ায়ে আছেন , ভিতরে আসে বসেননি ক্যান্ । আর , প্রফুল্লটার যেমন সর্দ্দির ধাত , আর একটু পরে ফত - ফত সুরু করে দেবেনে । ভিতরে আসে আরাম করে বসেন । এইরকম হিম লগান ভাল না ।
বীরেনদা — আপনি ঘুমুচ্ছিলেন , তাই ভিতরে আসিনি । আর , তেমন ঠাণ্ডাও না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি ঘুমুচ্ছিলাম , তাতে কি হইছে ? আর , ঠাণ্ডা না , বলেন কি ? আমি তো একেবারে বেহাল হয়ে গিছি । এই শীত পাড়ি দেব কি করে — তাই ভাবছি ।
চলো প্যারীচরণ । পেচ্ছাপ ক'রে আসি — এই ব'লে শ্রীশ্রীঠাকুর চটি পায় দিয়ে উঠে দাড়ালেন , বীরেনদা চটিজোড়া পায়ের কাছে এগিয়ে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বের হবার সঙ্গে - সঙ্গে প্যারীদা গাডু - গামছা নিয়ে বের হলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর প্রস্রাব করে জলের জন্য কোষ করে হাত পাতলেন , প্যারীদা হাতে জল ঢেলে দিতে লাগলেন — এইভাবে সাতবার জল নিলেন । তারপর উঠে চোখমুখ ধুলেন , চোখমুখ ধুয়ে গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছলেন । গামছাটি যেমন ভাঁজ করা অবস্থায় ছিল , তেমনি ভাঁজ করে প্যারীদার হাতে দিলেন । তারপর ঠিক যে পথ বেয়ে যেমন করে প্রস্রাবের জায়গা থেকে রােজ তাসুত্রে আসেন , ঠিক সেই পথ বেয়ে তেমনি ক'রে ফিরে আসলেন ।
এসে বিছানায় ব'সে কথাখানি গায়ে জড়িয়ে গলাটা কাপিয়ে বলছেন কি শীত ! কি শীত ! ও কালীষষ্ঠী , এই শীতে করি কি ? কালীষষ্ঠীমা ( হাসতে - হাসতে ) —কী আর করবেন । কাথা গায়ে দিয়ে , বসে বাবাগাে সঙ্গে গল্প করেন । কথা ক’তি - ক’তি গা গরম হ’য় যাবিনে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( স্ফূৰ্ত্তি সহকারে ) —ঠিক কইছিস । কালীষষ্ঠীর বুদ্ধি আছে । যাক , এইবার একটু তামাক সাজ তো দেখি — এই বলে শ্রীশ্রীঠাকুর হরিপদ দার ( সাহা ) দিকে চাইলেন । চেয়ে দেখেন — হরিপদদার তামাক সাজা হয়ে গেছে । তিনি কলকে নিয়ে আসছেন । তাই দেখে ফিক করে হেসে বললেন বলিতে কাজ বুঝিয়া করিবে সেই সে সেবক নাম । হরিপদকে ও - সব কওয়া লাগে না , ও নিজেই অনেকটা ঠিক পায় কখন কী দরকার । আর , এই শরীর নিয়ে ও যা করে সে একটা miracle ( সিদ্ধাই ) , ঘণ্টার পর ঘন্টা হয়তাে জলই তুলছে । নেশা আছে বলে পারে , নয়তাে শরীরের কথা ভাবতে গেলে ওর flat ( চিৎ ) হ'য়ে পড়ে থাকা লাগে ।
হরিপদদার মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলাে । বিনীতভাবে বললেন— মন যা চায় তা তো পারি না ।
রোখের সঙ্গে বললেন ঠাকুর — পারসি্ না কি শলা ? যা ’ পরতিছিস্ তা ' কয়জনে পরে দেখা তাে দেখি । – এই বলে ললিত ভঙ্গীতে মধুর কণ্ঠে টেনে টেনে বললেন — মুকং করােতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিং , যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ - মাধবম্ ।
দেখতে - দেখতে আবহাওয়াটা যেন রসঘন আনন্দ - মধুর হয়ে উঠল । ওদিকে রাণীমা তখন তার কলের পাড়ের ছােট্ট ঘরখানিতে বসে ভক্তিনম্রচিত্তে বিনতি পাঠ করছেন — প্রেমধারা বরখা কর খোল অমৃতখানা । ইতিমধ্যে শরৎদা ( হালদার ) , সতীশদা ( দাস ) , শৈলেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , যােগেনদা ( হালদার ) , অমরদা ( রায় ) , মানদামা ( প্রফুল্লর মা ) , কালিদাসীমা , সরােজিনীমা প্রভৃতি এসেছেন । সবাই চুপচাপ বসে আছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুরও একটু আনমনা । হঠাৎ অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে ডান হাতখানির মাঝখানের তিনটি আঙ্গল উচু করে বলছেন — দ্যাখ , তােমাদের আমি একটা ছােট্ট কথা বলি — আমার কাছ থেকে যখন যে - নির্দ্দেশ পাও , যে - অভিজ্ঞতার কথা শোন তখনই যদি তা সাধ্যমত অনুশীলন করতে লেগে যাও , অনায়াসে তোমাদের বহু সাধনা সহজ হয়ে যাবে । বেমালুমভাবে কালে - কালে যে এক - একজন কী হয়ে দাড়াবে , তা তােমরা নিজেরা ঠিক পাবে না , কিন্তু ঠিক পাবে দুনিয়া । কিন্তু করার পথে যদি না চল , শুধু শুনলে কিছু হবে না । ওতে না - জেনেও জানার অহঙ্কার হতে পারে , যা চরিত্রকে আরাে দুর্ব্বল করে দেবে । ফলকথা , করার মধ্যদিয়ে ছাড়া বোধও পরিপক্ক হয় না । শুনে - মিলে মামুলি বােধ যা ’ , অসময়ে তা কাজে লাগে না । তখন অভ্যস্ত বোধ , অভ্যস্ত বুলি , অভ্যস্ত চলনই আত্মপ্রকাশ করে । তোমরা কতকগুলি মানুষ যদি দাড়িয়ে যাও , তাহলে আমি সারা দেশ , এমন - কি দুনিয়া সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারি । ( ফুর্তিযুক্তভাবে ) যাবার আগে আমাকে একটু সুখ করে যেতে দাও তােমরা , আমি দেখে যাই যে ভারতের ঘরে - ঘরে আবার নারায়ণ জন্মাচ্ছে , ভারতের তেত্রিশ কোটি লোক আবার দেবতা হয়ে উঠছে , আর সারা দুনিয়া তাদের দেখে শিক্ষা লাভ করছে , তাদের শ্রদ্ধা ক'রে বৰ্ত্তে যাচ্ছে ।
কথা হচ্ছে , এমন সময় কিরণমা ( ভুবনের মা ) তাদের গাছের একটি কচি তকতকে লাউ নিয়ে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দূর থেকে প্রণাম করলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর লাউটি দেখে বালকের মত উল্লসিত হয়ে বলে উঠলেন — বাঃ , বড় বাহারের মাল আনিছিস্ তাে । যা যা , বড়বো’র কাছে দিয়ে আয় গিয়ে । বলবি আজকেই যেন বড়ি দিয়ে ঘন্ট করে ।
মা - টি হাসিখুশি হয়ে লাউ নিয়ে গেলেন বড়মার কাছে ।
কিরণমা শ্রীশ্রীবড়মার কাছে লাউ দিয়ে আবার ফিরে আসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আজকেই বড়ি দিয়ে ঘন্ট করার কথা কইছিস তো ? কিরণমা — হ্যা ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে প্রশ্ন করা হলো — আপনি বলেছেন , পারিবারিক চাহিদার সমাবেশ ও সমাধান করে ইষ্টার্থ - করণে প্রবৃত্ত হ'তে গেলে কোনটাই হয় না , কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে ইষ্টার্থ - করণে নিযুক্ত হলে ধীরে - ধীরে সমাধান আসে । আগে পারিবারিক সমস্যার সমাধান করে তারপর ইষ্টকাজ করা কি সম্ভব নয় ? যদি সম্ভব না হয় তবে আমরা যারা আগে পারিবারিক সমস্যার সমাধান করে ইষ্টকাজ করতে চাচ্ছি — তাদের অবস্থা দাড়াবে কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ইষ্টার্থকরণে জীবনের সবগুলি দিক with a meaning (একটা অর্থ নিয়ে ) adjusted ( নিয়ন্ত্রিত) হয় , প্রয়ােজনগুলিও সার্থকতা মুখর হয়ে ওঠে , প্রবৃত্তিজনিত অবান্তর প্রয়ােজন কমে যায় । আর , হাতে কলমে করে কৃতী হ'য়ে কৃতার্থতার উপঢৌকনে তাকে নন্দিত করার একটা আবেগ সৃষ্টি হয় , তার থেকে আসে inquisitiveness ( অনুসন্ধিৎসা ) । কাজের অন্ধি সন্ধি , ফন্দিফিকির , পারপৰ্য্যক্রমে কোথায় কখন কী করতে হবে , কাকে কী বলতে হবে , কার সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে , অন্তরায়গুলিকে কেমন ক'রে বিন্যস্ত করে profitable ( লাভজনক ) করে তুলতে হবে , সাহায্য কোন্ ভাবে কোন্ source- এ ( মাধ্যমে) ,পাওয়া যাবে , নিজের অভ্যাস - ব্যবহার , চাল চলন কতখানি ঠিক করতে হবে — ইত্যাদি সব সম্বন্ধে তখন একটা সুসমন্বিত ধ্যানশীল কর্মতৎপরতা গজিয়ে ওঠে , এর ভিতর দিয়ে সবটার সমাধান নিয়ে একটা consolidated universe of experience ( দানাবাধা অভিজ্ঞতার দুনিয়া ) ফুটে ওঠে । তাতে থাকে একটা বিরাট wiseness ( প্রজ্ঞা ) সংহত হ'য়ে — মানুষ সুনিয়ন্ত্রিত হয় , সুন্দর হয় , দক্ষ হয় , সাশ্রয়ী হয় , অর্জনপটু হয় , সর্বকাজে সফলতা তাকে দাসীর মত অনুসরণ করে। ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায় । যারা সাংসারিক উন্নতি বা টাকা উপায়ের কথা বড় করে ‘ ভাবে , সেই দিক ঠিক করে পরে ইষ্টের কাজ করতে চায়— there lies their folly (সেখানেই তাদের নির্বুদ্ধিতা ) । যা ’ কখনও হবার নয় , তাই - ই হওয়াতে চায় তারা — তা ’ কি কখনও হয় ? ঠেকে - ঠেকে , ঠকে - ঠকে , ঠোক্কর খেয়ে - খেয়ে পথে আসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাদের । ঐ ঠেকা , ঠকা ও ঠোকাই তাদের মস্ত শিক্ষক । ফলকথা , বৌ - ছেলেপেলের জন্য তাদের গুরু ধরা , অর্থাৎ তারাই তার গুরু , আর যাকে গুরু বলে ধরেছে , তিনি তাদের সেবার একটা উপকরণমাত্র , তবু মন্দের ভাল । বোকারা এইটুকু বোঝে না যে , নারায়ণকে খুশি করতে পারলে লক্ষ্মী আপনি এসে ধরা দেন , আর নারায়ণকে যে তােয়াক্কা করে না , সতী - স্ত্রী লক্ষ্মী কি তার কাছে এগােন ? তিনি তাকে এড়িয়েই চলেন , সে তাকে যতই তোয়াজ করুক না কেন । নারায়ণ মানে বৃদ্ধির পথ , মূৰ্ত্ত নারায়ণে যুক্ত হয়ে তাকেই মুখ্য করে বাস্তবভাবে বৃদ্ধির পথে , বিস্তারের পথে চলতে হবে । তবেই নারায়ণপূজা সার্থক হবে , লক্ষ্মীও বরণডালা সাজিয়ে নিয়ে এসে ধরা দেবেন । এ বাদ দিয়ে উন্নতি যে হয় না , তার কারণ , মানুষ প্রবৃত্তিপন্থী হয়ে পড়লে তার কাছে টাকা হয় বড় , মানুষ হয়ে যায় ছোট , সে মানুষের সংশ্রব হারায় , মানুষকে করে ignore ( উপেক্ষা ) , বৃদ্ধির পথে , বিস্তারের পথে না চ'লে ক্ষয় ও সঙ্কোচের পথেই চলে সে , এইভাবে whith a blind conflict ( অন্ধ সংঘাতের পথে ) ব্যর্থতার দিকেই এগিয়ে যায় । যেখানে পারিবারিক জীবনে সার্থকতা আসে — তারও মূলে হয়তো দেখবে— মা , বাবা বা গুরুর জন্য বৌ , ছেলে , টাকা - পয়সা সব । সেইজন্য জীবনের গােড়ায় আছে ব্রহ্মচর্যাশ্রম , তারপর গাহস্থ । ঈর্ষা , আক্রোশ বা হীনত্ব বৃদ্ধির থেকেও যে মানুষ কোথাও - কোথাও বড় না হয় , কৃতী না হয় , সেবাপ্রাণ না হয় , তাও নয় , কিন্তু ঐ করাটা বা হওয়াটা তার চরিত্রকে সমৃদ্ধ করে না , আর কোন সার্থকতার কেন্দ্র না থাকায় তার জীবনও সার্থক হয়ে ওঠে না , আবার যে প্রবৃত্তির প্ররােচনায় সে বড় হয় , তারই মধ্যে নিহিত থাকে তার বিনষ্টির বীজ । সে হয়তো তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে , মানুষকে আর মানুষ বলে মনে করে না , অত্যাচার , অবিচার বা অপমান করতে তার গায়ে বাধে না , এইভাবে হয়তাে পারিপার্শ্বিককে উৎক্ষিপ্ত করে তােলে , তারই প্রতিক্রিয়ায় আপনার জালে আপনি জড়িয়ে মরে । রাবণের কথাটাই একবার ভেবে দেখ না কেন ? তার মত শক্তিমান ও সম্পন্ন ক’জন ছিল ? শেষটা তার দশা কী হ'লো ? আর , ডাইনে - বাঁয়ে চেয়েও এমনতর দৃষ্টান্ত অনেক দেখতে পাবে । তাই বলি — সুখী হওয়ার , সার্থক হওয়ার এক ছাড়া দুই পথ নেই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে মসগুল হয়ে কথা বলছেন । চকিতে তিনি গড়গড়ার নলটি ছেড়ে , চৌকী থেকে মাটিতে নেমে দাড়ালেন । কী বৃত্তান্ত বুঝতে না পেরে সবাই এদিক - ওদিক চাইতে লাগলেন । মাতৃমন্দিরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণের দিকে চেয়ে তখন দেখা গেল যে শ্রীযুক্ত হেম চৌধুরী মহাশয় ঐ দিক দিয়ে এগিয়ে আসছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বিনীতভাবে আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করলেন , কী দাদা ! সকালে কী মনে করে ? ( অমর - ভাইয়ের ( ঘোষ ) দিকে চেয়ে বললেন ) দাদার জন্য দৌড়ে গিয়ে একখানা চেয়ার নিয়ে আয় ।
অমর ভাই চেয়ার আনতে ছুটলেন । শ্রীযুক্ত হেম চৌধুরী মহাশয় বললেন — না , চেয়ারের দরকার নেই । তুমি বসো । আমি বড় ঠেকায় পড়ে আইছি । আমাকে ভাই তিরিশটে টাকা না দিলে তাে নয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর দাড়িয়ে রইলেন ।
অমর ভাই চৌধুরীমহাশয়কে চেয়ার এনে দিলেন । চৌধুরীমহাশয় চেয়ারে বসার পর শ্রীশ্রীঠাকুর বিছানায় বসলেন ।
ইতিমধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — সুধাকে ডাক দেখি । একজন তাড়াতাড়ি গিয়ে সুধামাকে ডেকে আনলেন । সুধামা আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর আবদারের সুরে বললেন — সুধা ! লক্ষ্মী ! তিরিশটে টাকা দিবি ?
সুধামা হেসে বললেন- দেব , ক’টাকা বললেন , তিন টাকা ?
শ্রীশ্রীঠাকুর হাসতে হাসতে বললেন - তিন টাকা হ'লে কি আর তােকে ডাকি ? তিরিশ টাকা । তুই যে আমার বড় ব্যাঙ্ক । বড় ব্যাঙ্কে কি মানুষ দুই - এক টাকার চেক কাটে ?
সবাই হাসতে লাগলেন ।
সুধামা — আমি জোগাড় করে আনছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যাও , তাড়াতাড়ি কাম সেরে ফেলগে ।
চৌধুরীমহাশয় — তাহলে আমি বাড়ীর দিক যাই । তুমি জোগাড় হ'লে পাঠায়ে দিওনে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( স্মিতমুখে ) —তাহ'লে আসেন গিয়ে ।
চৌধুরীমহাশয় চেয়ার ছেড়ে উঠতেই শ্রীশ্রীঠাকুর আবার উঠে দাড়ালেন । উনি যাবার পর বসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( স্নেহসিক্ত কণ্ঠে ) —দ্যাখ , জমিদারী বল , তেজারতি বল ,
ব্যবসা - বাণিজ্যই বল , বামুনের ব্যবসায়ের মত ব্যবসা নেই — বামুন হ'লাে লোক ব্যবসায়ী । মানুষই তার মূলধন , মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিই তার মুনাফা । মানুষকে যে সুকেন্দ্রিক করে তুলতে পারে , মানুষকে যে আপন করে তুলতে পারে , মানুষকে যে যােগ্য করে তুলতে পারে , তার কিন্তু কিছুরই অভাব থাকে না। ঋত্বিকের কাজ কিন্তু বামুনের কাজ । আদর্শনিষ্ঠ উপযুক্ত - সংখ্যক ঋত্বিক যদি থাকে , আর দেশের রক্তে যদি গোল না ঢুকে থাকে , তাহলে সে - দেশের কোন ভাবনা নেই । তাদের চরিত্র দিয়ে , চলন দিয়ে , জীবনচৰ্য্যা দিয়ে মানুষের মধ্যে আদর্শ , ধর্ম ও কৃষ্টির প্রতিষ্ঠা করে , তারা সব - কিছুই গজিয়ে তুলতে পারে ।
প্রশ্ন — ঋত্বিকরা যদি অনিয়ন্ত্রিত চলনে চলেন , এবং সঙ্গে - সঙ্গে যাজনও করেন , তাতে কি অনেকখানি বিকৃতি সঞ্চারিত হয় না ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — কারও অন্তর্নিহিত ক্লেদের পর্শ লাগলেও , যে- science ( বিজ্ঞান ) , যে - বেদ তারা পরিবেষণ করছে , তা কিন্তু অক্লেদ্য , অদাহ্য , অশেষ্য— তাই এটা মন্দের ভাল । তবে initiation ( দীক্ষা ) হয় , ঠাকুর বস্তুুটা তাতে থাকে , সেই সূত্র , সেই দড়ি বেয়ে মানুষ আদত জায়গায় এসে দাড়াতে পারে । আর , মানুষ একদিনেই তাে পুরােপুরি পরিশুদ্ধ হয়ে যায় না , আরাের ইতি নেই , ইচ্ছা থাকলেই মানুষ এগুতে পারে , ক'রে - ক'রেই এগােয় । তবে , ইষ্টের প্রতি আনুগত্য যদি না থাকে , ইষ্টকে বাদ দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার বুদ্ধিই যদি প্রবল হয় , আত্মসংশোধনের স্পৃহা বা প্রয়াস কিছুই যদি না থাকে , সে যাজন একটু ভয়েরই কথা । তবে , তােমাদের এখানে অমনতর মানুষ টিকতে পারে না । কারও কিছু করা লাগে না , Nature ( প্রকৃতি ) -ই তাকে purge (বহিষ্কার) করে দেয় । সেই গােড়ার আমল থেকেই তাে দেখছি । কী বলেন সুশীল - দা ?
সুশীল - দা ( বসু ) —হ্যা ! এ একটা আশ্চর্য ব্যাপার । আপনি তো কাউকে ফেলেন না , তাড়ান না , সকলকেই কাছে টেনে রাখতে চান । কিন্তু তারা নিজে কেই কেমন ছিটকে পড়ে ।
শৈলেন - দা — যুদ্ধের ফলে যে দারুণ দুর্দিন আসবে , তাতে মানুষ স্ত্রী পুত্ৰাদি নিয়ে একমুষ্টি ভাতের জন্য হয়তো পথে - পথে ঘুরে বেড়াবে , সেই অবস্থায়ও কি ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নী করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে ?
কিংবা কেউ যদি কোথাও অবরুদ্ধ হয় সে কী করবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর তখন দেখিস্ ইভৃতি , স্বস্ত্যয়নী ভাল করে set করবে (মাথায় ঢুকবে ) । ঐ অবস্থায় ভােজ্য , ফল , ফুল , জল কিছু যদি না জোটে , একমুষ্টি বালুও তো নিবেদন করতে পারবে । ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নী করার দরুন যার ভেতর যে energy ( শক্তি ) মজুত হয়েছে , বিপদের সময় তাই - ই তাদের ত্রাণ আনবে । ( প্রফুল্লর দিকে তাকিয়ে ) James কি তাে কইছে ?
প্রফুল্ল - He will stand like a tower when everything rocks around him and when his softer fellow - mortals are winnowed like chaff in the blast . ( যখন সবকিছুর অস্তিত্ব টলায়মান হয়ে উঠবে , এবং শক্তিহীন নির্জীব লােকগুলি ঝড়ের আগে তুষের মত উড়ে যাবে , তখন সে একটা স্তম্ভের মত নিজের শক্তিতে অটল হয়ে দাড়িয়ে থাকবে । )
শ্রীশ্রীঠাকুর — ! সত্যিই তাই । আর তা তােমরা বাস্তবে দেখতে পাবে । ‘ স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ । এতটুকুও করেছে যারা , করে যারা , তারা মহাভয় থেকে ত্রাণ পাবে । কিছু - না’র মধ্যদিয়ে তারা employment (কর্মনিযুক্তি ) , activity ( কাজ ) create ( সৃষ্টি ) করে নেবে , সবাই তখন বুক নিঙড়িয়ে ইষ্টার্ঘ্য দেবে , সেই নিঙড়ান বুক অমৃত সৃষ্টি করবে । সারাদিন পরে বুভুক্ষু পরিবার হয়তাে চার আনা পয়সা পেল , তার থেকেই কিছু নিয়ে সবাই মিলে হাঁটু গেড়ে বসে যদি কয় — ঠাকুর । এই নাও তুমি , আজ যে আমাদের এই - ই সম্বল । তখন সে tragedy ( বিয়ােগবিধুর দৃশ্য ) এমন comedy (মিলনান্তনাটক ) সৃষ্টি করবে যে পারিপার্শ্বিক আপামর সাধারণের কাছে সেই স্থান একটা পুণ্য - তীর্থ হয়ে দাড়াবে , আর ঐ অকিঞ্চন তারাই সেই পূণ্য - তীর্থের জীবন্ত বিগ্রহ ব'লে পরিসেবিত হবে । বুদ্ধি তখন ফুড়ে বেরুবে , তারা পারবে অবস্থার উপর জয়ী হতে । তাই গীতায় আছে — যােগক্ষেমং বহাম্যহং ' ।
বলতে - বলতে শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখমুখ আবেগে জ্বলছে । উপস্থিত সবাই বিস্ফারিত নেত্রে , রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ঐ দিব্য - বাণী শ্রবণ করছেন ।
তার মধ্যে একজন প্রশ্ন করলেন — সমস্ত দেশের হাতে কামান , গোলা - বারুদ , বোমা , কত অস্ত্র ! আমাদের হাতে ঠাকুর কী অস্ত্র আছে ? আমরা আত্মরক্ষা করব কিভাবে ? আমাদের যে এখন তাদের চাইতে উন্নততর অস্ত্র দরকার । যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নী করলে তাে বােমা শুনবে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তােমাদের মহা - অস্ত্র হলো ইষ্টস্বার্থ , ইষ্টপ্রতিষ্ঠা , ঐ যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নী । তোমরা যাজন - জৈত্র হ'য়ে উঠলে কী করে ফেলতে পার তার কি ঠিক আছে ? ( হঠাৎ বুক টান করে বসে , দুটি বাহু বাড়িয়ে আলিঙ্গনের ভঙ্গীতে) জড়িয়ে ধরেই কত মানুষের মন কেড়ে নিতে পার , convince ( কৃতপ্রত্যয় ) করে ফেলতে পার । যে মনের দরুন যুদ্ধ করছে , সে মন বদলিয়ে যুদ্ধ নিবারণ করে জগতে শান্তি এনে দিতে পার । চণ্ডাশোক কিভাবে ধর্মাশােকে পরিণত হ'ল জান তো ? উপগুপ্তের এক গানের তানই তাকে উদ্ধার করে দিল । আর যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নী হ'ল মূল এর থেকেই সব evolve করবে ( গজিয়ে উঠবে ) । বৈশিষ্ট্যপালী , আপুরয়মাণ , ইষ্ট - নিবদ্ধ ব্যষ্টিব্যক্তিত্ব যদি সমষ্টি - ব্যক্তিত্বে এগিয়ে চলে— with untottering active mood ( অনড় সক্রিয় চলনে ) , দেশ আপসে - আপ power ( শক্তি ) , position( মৰ্যাদা ) ও successful crown- এ ( কৃতী রাজমুকুটে ) সুশােভিত হয়ে উঠবে । যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নীর urge ( আকুতি ) ও habit (অভ্যাস ) নিয়ে যদি চল— integrated with all your environment ( সমগ্র পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে অন্বিত সঙ্গতি নিয়ে ) , তাহ'লে material equip ment- এর ( বস্তুুতান্ত্রিক প্রস্তুুতির ) দিক দিয়েও সবাইকে supersede ( অতিক্রম ) করা তােমাদের কাছে একটা problem- ই ( সমস্যাই ) নয় । এখন যাজনে অগি গেথে তোল সব ।
প্রচণ্ড প্রেরণার প্রবাহে সবার অন্তর যেন ফেটে পড়তে চাইছে । চুপচাপ বসে আছেন সবাই , কারও কোন বাক্যস্ফুৰ্ত্তি হচ্ছে না । শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ শৈলমার দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে চপল ভঙ্গীতে বললেন — কিরে , তুই এখানে । আমি তাে দেখতেই পাইনি । আজ কিন্তু নিস্তারিণীকে হারিয়ে দেওয়া চাই ।
শৈলমা ( বীরের ভঙ্গীতে ) —ও আমার সঙ্গে পারে ? আমি তো ইচ্ছে করেই ওকে জিতিয়ে দিই ।
সবাই হো - হাে করে হেসে উঠলেন ।
প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলছে , প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গ উঠছে — আর শ্রীশ্রীঠাকুর বিভাের হয়ে আলাপ - আলোচনা করে চলেছেন । কথা বলছেন , আর কথার মধ্যদিয়ে প্রতি প্রাণে যেন প্রাণ ঢেলে দিয়ে যাচ্ছেন । চোখের দৃষ্টি , মুখের ভঙ্গী , কণ্ঠের মাধুৰ্য্য , অঙ্গের হিল্লোল , অঙ্গুলি - সঞ্চালন — সব - কিছুর ভিতর - দিয়ে এক আনন্দঘন রসলোকের অমৃতস্পর্শ প্রকট হয়ে উঠছে । পূব আকাশে সূর্য জেগে উঠেছে , তার সােনালী কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে মায়ের কুটিরের পাশে ছাতিম গাছের মাথায় । ছাতিমগাছের তলায় একজন গাই দুইছেন — মৃদুমধুর কলকল ধ্বনি আসছে তার । গরুর বাট যখন টনটন করে , তখন তাকে দুইলেই তার সুখ । নিখিল - প্রজ্ঞানময় পুরুষ যিনি , তিনিও দুনিয়াকে তেমনি তার জ্ঞান - ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিতে পারলেই সুখী । জিজ্ঞাসু প্রেমী ভক্তের আগ্রহ এই উন্মোচনকে তরঙ্গায়িত করে তােলে , তাইতো তখন তাঁর কথা লহরের পর লহর তুলে বাঁধহারা হ'য়ে প্লাবনের মত ভেঙ্গে পড়ে , যে শোনে সেই মজে , যে আসে সেই মাতে— অবশ্য যদি তার একটুকু উন্মুখত থাকে । সেই অপরূপ অমৃত প্লাবনের গােমুখী - উৎসের মুখােমুখী হয়ে বসে আছেন সবাই , প্রবল ঝরণাধারায় বেরিয়ে আসছে সুধালহরী — তাই অন্তর - বাহির মগ্ন - মসগুল সবার ।
কেষ্টদা প্রশ্ন করলেন — ইষ্টের কাজের জন্য বেঁচে থাকতে হবে , এটা খুবই স্বীকাৰ্য , কিন্তু মরণ যদি কোথাও ইষ্টস্বার্থ - প্রতিষ্ঠা ব্যাপারে সহায়ক এবং অনিবাৰ্য প্রয়ােজন হয় , এবং তখনও যদি কেউ বাঁচতে হবেই এই ধুয়ো ধ'রে প্রাণ না দেয় , সেটা কি কাপুরুষতা নয় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - মরণটা যদি জীবনবৃদ্ধি বা ইষ্টম্বার্থপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজন হয় — তখন অন্য কথা । তাই গীতায় আছে , ' হতাে বা প্রাপস্যসি স্বর্গং , জিত্বা বা ভােক্ষসে মহীম্ । নচেৎ , অযথা জীবন দেওয়ায় তো কোন লাভ নেই । অবশ্য ইষ্টের কাজ করতে হবে তােমাকে সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে , ঝুকি নিয়ে । প্রতিমুহূর্তে নিজের গা বাঁচাবার দিকে লক্ষ্য প্রবল হ'লে তখন আর কোন কাজ করতে পারবে না । তাই বলে খামাকা বিপদ ডেকে আনবে যে তাও নয় । বেপরােয়া ইষ্টীচলনের সঙ্গে - সঙ্গেই থাকে আবার একটা সুব্যবস্থ সুসঙ্গত গতি । অমনতর চলন যার , তার বুদ্ধি থাকে ইষ্টের কাজ হাসিল করা , তার সেই পথে অন্তরায় যেগুলি সেগুলিকে সে কৌশলেই এড়িয়ে বা নিয়ন্ত্রণ করে চলতে পারে । ( একটু মােড় কেটে বসে মিষ্টি হেসে ডান হাতটি নেড়ে ) -হনুমানের মত অমন ধুরন্ধর আর দেখা যায় না । হনুমান তো গেছে লঙ্কায় । ওকে তো বেঁধে ফেলেছে । ওকে চড়ায় , কিলোয় , মারে ; ও তো ঘাপটী মেরে পড়ে আছে । মার খাচ্ছে , তার জন্য দুঃখু নেই , দুঃখু এই — আমি যে বাধা প'লাম , মা জানকীর উদ্ধারের কী হবে ? ঐ কথা ভাবে আর মাথায় ফন্দী আঁটে — কী করা যায় ? শেষটা একটা বুদ্ধি বার করলো । বললো — আমি তাে গিছি , আমাকে তো মেরেই ফেলতে চাও তোমরা , আর আমার মরাই উচিত । আমাকে তাড়াতাড়ি মেরে ফেলার বুদ্ধি কই তোমাদের । আমার লেজে খুব করে কাপড় জড়াও , যত বেশী কাপড় জড়াতে পার , সেই - ই ভাল । কাপড় জড়িয়ে সেই কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দাও । আগুনে পুড়ে মরাই আমার উপযুক্ত শাস্তি । তখন তো রাক্ষসরা কাপড় এনে স্থূপাকার করে ফেললো । লেজের সঙ্গে পর পর জড়িয়ে ফেললো কাপড়গুলি , পরে ওর কথামত আগুন ধরিয়ে দিল । তখন মরার মত পড়ে আছে , যেন মৃত্যুর অপেক্ষা করছে । আগুন যেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো , ওরা সরে দাড়াল , সেই ফাকে সে ধম্ করে উঠে পড়লাে । উঠে এই লাফ তো সেই লাফ । একবার এই ঘরে গিয়ে পড়ে , পরমুহূর্তে ওই ঘরে গিয়ে পড়ে , এইভাবে সারা লঙ্কা দগ্ধ করে দিয়ে ছাড়লো । এদিকে বেকুবরা তখন হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো । তখন আর করবে কী ? তাদের হাতে তো করবার কিছু নেই , ব'সে ব'সে আপসােস করে ।
হনুমান লঙ্কা দগ্ধ করে সমুদ্রে পড়ে লেজের আগুন নিভিয়ে মা জানকীর কাছে গিয়ে হাজির হলো । তখন সে মহাখুশি , মা’র কাছে দাড়িয়ে আনন্দে লেজ নাড়ছে । মা বললেন , তোমার মুখে কী হলো ? তার যে মুখ পুড়ে গেছে , সেদিক তার খেয়ালই নেই । বিনীতভাবে বললো , ‘ ও কিছু না । এমনই হয় । ইষ্টের প্রতি ভালবাসা যার থাকে , সে ইষ্টকাজ করতে গিয়ে বিপদে পড়লেও , বিপদকে কেমন করে সম্পদে পরিণত করতে হয় , তা সে জানে । সে ফেসে যায় না সহজে । আবার , ঐ কাজের পথে কষ্ট বা বিপদ - আপদ যতই থাক না কেন , তা তাকে দমিয়ে দিতে পারে না । কষ্টের দিকে তার দ্রুক্ষেপই থাকে না , বা ঐ কথা কারও কাছে বলে বাহাদুরী নেবার আকাঙ্ক্ষাও বড় একটা দেখা যায় না । প্রিয়তমের খুশিতেই তার খুশি , আর তাকে খুশি করবার কর্মমাতাল নেশাতেই তার শরীর - মন - মাথা চাঙ্গা হয়ে থাকে ।
প্রফুল্ল - হনুমান লঙ্কা দগ্ধ করলো , আবার শ্রীকৃষ্ণও যুদ্ধে কত লােককে হত্যা করলেন । কিন্তু অহিংসা তাে পরম ধর্ম ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — অহিংসা পরম ধর্ম , হিংসা তো পরম ধর্ম নয় । হিংসাকে অটুট অক্ষত রাখলে তো অহিংসার প্রতিষ্ঠা হয় না । অহিংসার প্রতিষ্ঠার জন্য হিংসাকে সরাসরিভাবে হিংসা করতে হবে , সুস্থতা আনতে গেলে অসুস্থতাকে বধ করতে হবে , সক্রিয়তা জাগাতে গেলে নিস্ক্রিয়তাকে মারতে হবে । আমি তো এইরকম বুঝি । তবে এটা করতে হবে মঙ্গলবুদ্ধি - প্রণােদিত হয়ে । তাই পাপীকে ঘৃণা বা হিংসা না করে , পাপকে ঘৃণা বা হিংসা ক'রে , পাপীকে পাপমুক্ত করে তুলতে চেষ্টা করতে হবে । তাই বলছিলাম , হিংসকের হিংসার প্রতি যদি আমরা অহিংস হই , তবে সেইটেই হবে অহিংসাবিরোধী , অর্থাৎ হিংসাপােষণী আচরণ ।
সুশীলদা - তাহলে Resist no evil ( অসৎকে প্রতিরোধ করো না ) মানে কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার মনে হয় , sentence ( বাক্য ) -টার মধ্যে punctuation ( বিরামচিহ্নপ্রকরণ ) -এ ভুল আছে । জেম্স যেমন বলেছেন— Resist , no evil . সেই কথাটাই ঠিক , অর্থাৎ নিরােধ কর , অসতের অস্তিত্ব থাকবে না । অসৎকে যদি নিরোধ না করি , তাহলে অস্তিত্বধর্মী আমরা যে অনস্তিত্বে বিলীন হয়ে যাব । যীশুখ্রীষ্ট , যিনি কিনা মানব - সত্তার উদ্ধাতা , তিনি অমনতর বলতে চেয়েছেন বলে আমার কিন্তু মনে হয় না । আর , তার নিজের জীবনের আচরণ দেখেও তা বোঝা যায় না । অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি তো বরাবরই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন । সেই যে মন্দিরে গিয়ে দেখলেন , মন্দিরের প্রাঙ্গণে ব্যবসাদাররা দোকান - পাট মেলে মেলা বসিয়ে ফেলেছে , সেখানে তিনি কেমন রুখে দাড়িয়ে সবাইকে ঝেটিয়ে বের করে দিলেন ? এইটে কি resist (নিরোধ ) না করার দৃষ্টান্ত ? তবে মহাপুরুষদের জীবনে একটা ব্যাপার এই দেখা যায় যে , তারা পােকাটি - মাকড়টি পর্যন্ত বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল , কিন্তু নিজেদের কথা তারা মােটই ভাবেন না । অমনভাবে ভাবতে অভ্যস্ত নন তারা , সকলের জন্য ভেবে সকলের জন্য ব্যবস্থা করেই তারা সুখ পান , তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুখ - স্বস্তি বিধানের দায়িত্ব তাই তাদের ভালবাসে যারা , তাদের উপর । তারা যদি তাদের আগলে না রাখে তবে তাদের অস্তিত্ব যে - কোন মুহূর্তেই বিপন্ন হতে পারে । সবার রক্ষায় অমোঘবীৰ্য তারা , কিন্তু আত্মরক্ষায় নিষ্ক্রিয় । তারা ভালবাসার কাঙ্গাল , ভালবেসে কেউ তাদের জন্য কিছু করেছে দেখলেই মহাখুশি । নিজের সম্বন্ধে এতই উদাসীন তারা যে কোনকিছুকে নিজের পক্ষে ক্ষতিকর জেনেও তারা হয়তো অবাধে বলবেন — হ্য । এইটেই হতে দাও , বাধা দিও না , কারণ , সেইটি হ'তে দিলে হয়তো ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ ইচ্ছাপূরণ বা বিশেষ স্বার্থ সিদ্ধির সুবিধা হবে । তাদের কাছে তো সর্বদা— “ Thy necessity is greater than mine . " ( তোমার প্রয়ােজন আমার থেকে বড় ) , তাই আর চাই কি ? তােমার প্রয়ােজন পূরণ হ'লেই হলো , সে আমার জীবনের বিনিময়েও যদি হয় , তাও ক্ষতি কী ? মানুষের জন্য , শুধু মানুষের জন্য কেন , সামান্যতম প্রাণীর জন্য পর্যন্তও তারা ততখানি করতে পারেন — এমনই বেহিসেবী , বেপরােয়া , আত্মভোলা তারা । কিন্তু তাদের সেই ‘ হ'তে দাও , বাধা দিও না কথায় সায় দিয়ে আমরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি , তাদের আদেশ - পালনের দোহাই দিয়ে তাদের জীবনরক্ষায় যত্নবান না হই , তবে সেইটেই হবে গুরু - আনুগত্যের নামে পরম ভণ্ডামী । অমনতর ক্ষেত্রে তাদের আদেশ অমান্য করেও তাদের যদি বাচাই সেই হবে গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা । তারা ক্রোধ দেখালেও শেষ পর্যন্ত খুশিই হবেন তা’তে । তাই বাইবেলের “ Resist no evil " (অসৎকে নিরােধ করাে না ) একথা যীশুখ্রীষ্ট , ব্যক্তিগতভাবে তার উপর যে অন্যায় - উৎপাত আসছিল , সেই প্রসঙ্গে বলেছেন কিনা , সেটাও আমার মাঝে - মাঝে সন্দেহ হয় । তার নিজের উপর অন্যায় হ'লে , সেই অন্যায়ের সম্পর্কে তার মুখ দিয়ে এ - কথাটা বেরােন কিছু বিচিত্র নয় । ল্যাজা - মুড়ো বাদ দিয়ে সেইটেই হয়তো অন্যভাবে চালিয়ে দিয়েছে । তাছাড়া সব evil ( ন্যায় ) -কে সব সময়ে সরাসরি resist ( প্রতিরােধ ) করাও যায় না , অসতের শক্তি যেখানে প্রবল , বিপুল ও পরাক্রমশালী , সুকৌশলে " শক্তিসংহত না করে যদি সেখানে বেকুবের মত বিনা প্রস্তুতিতে হঠাৎ ঘা দিতে যাও , তবে তুমি তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেই , তাছাড়া তােমার উদ্দেশ্যও সফল হবে না ।
অবাঞ্ছিত , প্রতিকূল কিছু ঘটলে মানুষ তাকেও অনেক সময় evil ( দুর্দৈব ) বলে , সেখানে উৎক্ষিপ্ত হয়ে হাত - পা ছুড়ে তাে লাভ নেই । যেটা এসে পড়েছে , তাকে শুভে সুনিয়ন্ত্রিত করা লাগবে এবং যে - কারণে তার আবির্ভাব হয়েছে , তার নিরসনে সচেষ্ট হতে হবে , যাতে অমনটি ভবিষ্যতে আর না ঘটে । অবস্থার তলে পড়ে দিশেহারা হয়ে আবােল - তাবোল পায়তারা ভাজলে হবে না , আস্ফালনেও কাম দেবে না , স্থিরমস্তিষ্কে সেটাকে আয়ত্তে এনে কল্যাণপ্রসু ক'রে তুলতে হবে । তাই আমিও বলেছি , Manage the evil for good ( খারাপ অবস্থাকে শুভপ্রসূ করে পরিচালিত করাে ) । আমার ঐ কথা দেখে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে যদি কেউ বলে — ঠাকুর অসৎকে নিরােধ করতে বলেননি , তাহলে সেটা কি ঠিক হবে ? তাই প্রথমে নির্ণয় করতে হবে — যীশুখ্রীষ্ট কখন , কোন্ অবস্থায় , কী উদ্দেশ্যে , কোন কথা বলেছেন । বাস্তবতা - ভ্রষ্ট হয়ে তথাকথিত দার্শনিকতা হিসাবে যীশুখ্রীষ্ট কিছুই বলেননি , সেভাবে বুঝতে গেলে আমরাও ঠকে যাব !
একদল নামকা-ওয়াস্তে ভক্ত আছে , যাদের কাছে কর্মহীনতার কথা বড়ই প্রিয় । তার সমর্থনে কোন কথা পেলে তারা ফলাও করে ধরে । আমাদের কালীষষ্ঠী কয় ( হাসতে - হাসতে )—
‘ শুধুই মুখের হাই
তােমার জন্য পরাণ কাঁদে ,
দেবার কিছুই নাই ।
' ঐ ধরণের ভক্ত যারা তাদের কাছেই Resist no evil'— ‘ অসৎকে নিরোধ করো না ' — এই অর্থে ভাল লাগে । ভাবে — কাম কি অতো তাফাল দিয়ে ।
সরােজিনীমা বললেন — এইবার উঠবেন না ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( হাসিমুখে ) —তুই এক বেরসিক ।
নেশা করে খােয়াড়ি না ভেঙ্গে উঠলিই হলাে ? তুই বরং তামাক খাওয়া ।
সরোজিনীমা তামাক সাজতে গেলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কেষ্টদার ( ভট্টাচাৰ্য ) দিকে চেয়ে হাসতে - হাসতে বললেন— দেখেন , ও যে আমাকে ওঠার জন্য তাগাদা দিচ্ছে , সে কিন্তু ওর নিজের গরজে । হাগায়ে - মােতায়ে থুয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী যাবে । কিন্তুু বাইরে হয়তাে বলবে— সময়মত না হাগলে ঠাকুরের শরীর খারাপ করবে , তাই বলছি ।
তার প্রীতি - মধুর কটাক্ষ শুনে সবাই মৃদু - মৃদু হাসছেন । সরোজিনীমা - ও কোলকেয় ফু দিতে - দিতে মুখ টিপেটিপে হাসছেন । অবদারের সুরে বললেন সবসময় তাই বুঝি , অজি আমি একটু ব্যস্ত থাকলেও অনেক সময়ে আপনার স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই বলি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( মাথাটা ঝাকিয়ে ) —ব্যস্ততায়ই বল বেশী ।
সরােজিনীমা হার মেনে বললেন — আচ্ছা তাই । আপনি এখন তামাকটা খেয়ে দয়া করে ওঠেন ।
তপােবনের কাজ - কর্ম সম্পর্কে মাঝে - মাঝে বিমলদা ও ক্ষিতীশদার ( সান্যাল ) মধ্যে বচসা হয় — সেই কথা উঠলো । বিমলদা ও ক্ষিতীশদা উভয়েই উপস্থিত । কথাটার অবতারণা করা হলো বেশ একটু মেঘলা মন নিয়ে অনুযােগের সুরে । শ্রীশ্রীঠাকুর মুখে হাসি টেনে বিক্ষোভের আবহাওয়াটাকে হাল্কা করে দিয়ে , উভয়ের দিকে চেয়ে মনােজ্ঞ ভঙ্গীতে ঘাড় নেড়ে - নেড়ে বলতে লাগলেন , —দ্যাখেন , সমুদ্রমন্থনের মত প্রণয় - মন্থনেও সুধা ও বিষ দুই - ই ওঠে । বিষটাকে হজম করতে না পারলে সুধাটাকে উপভােগ করা যায় না । কথায় আছে — এক ঘরে ঘর করতে গেলে ঝগড়া কি হয় না , দুটো কথাও কি তােমার প্রাণে সয় না ? ' — তাই বন্ধুত্ব যেখানে আছে সেখানে মানিয়ে নেয় । ঝগড়া - ঝাটি ক'রে চুপচাপ করে থাকলে — না মিশলে gulf of difference ( বিচ্ছেদের ব্যবধান ) ক্ৰমশঃ বাড়তে থাকে , কিন্তু একজন যদি হেসে কথা কয় , সহজেই মেঘ কেটে যায় , নচেৎ ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে হয়তো জনমের মত বিচ্ছেদ এসে যায় । অবশ্য আপনাদের এখানে অন্য কথা । আপনাদের উভয়ের একই স্বার্থ । ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তো আপনারা ঝগড়া করেন না । আমাদের উভয়েরই উদ্দেশ্য হলো — তপােবনটাকে কেমন করে গড়ে তোলা যায় । এর মধ্যে নিজেদের যে টেক না আছে তাও নয়। বিমলদা ভাবে , ‘ আমি তপােবনের একজন পুরাণ মাষ্টার , ঠাকুরের কাছে শুনিছি , মিলিয়ে হাতে - কলমে করিছি , আমি জানি না ? ক্ষিতীশদা ভাবে “ আমি চুল পাকিয়ে ফেললাম , আমি কি বুঝি না কোন্টা কিভাবে করতে হবে ? আর বিমলদা ঠাকুরের দোহাই দেয় , আমিও কি ঠাকুরের কথা জানি না ? অহং - এ অহং লেগে গেছে । ও কিছু না । আপনাদের উভয়েরই যদি আমার কাজ করবার সত্যিকার আগ্রহ ও ইচ্ছা থাকে , তাহলে দেখবেন , লাঠালঠি করতে - করতে কোন্ সময় নিজেদের অজ্ঞাতে মিলে গেছেন , তখন হয়তাে বিমলদা বাড়ীতে খেয়ে এসে আঁচাবে ক্ষিতীশদার বাড়ীতে , আর ক্ষিতীশদা দাঁতন করতে - করতে যেয়ে মুখ ধােবে বিমলদার বাড়ীতে । ফলকথা , আদর্শ ও উদ্দেশ্য যেখানে এক , সেখানে মতান্তরে মনান্তর হয় না , হ'লেও সাময়িক ও উপরসা , তা আবার মিলনাগ্রহকেই নিবিড় করে তােলে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার উঠে নিভৃত - নিবাসে পায়খানায় গেলেন ।
প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনান্তে শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃমন্দিরের বারান্দায় এসে বসলেন ।
প্যারীদা একটা ওষুধ দিয়ে গেলেন । ওষুধটা খেলেন ।
একে - একে অনেকেই এসে প্রণাম করে যেতে লাগলেন । সম্বিতা ( ৪ বৎসরের মেয়ে ) সেজেগুজে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করতে এসেছে সুষমা - মার সঙ্গে । শ্রীশ্রীঠাকুর মহাখুশি । বলছেন — বা । বা ! কী সুন্দর । কী সুন্দর ।
সম্বিতার মুখখানি আনন্দে ডগমগ হ'য়ে উঠলো ।
ফিলান্থপী অফিস - সংক্রান্ত কয়েকটা ব্যাপার - সম্বন্ধে কী করণীয় বঙ্কিমদা ( রায় ) , শরৎদা ( সেন ) , ভবানীদা ( সাহা ) এসে জেনে গেলেন ।
অবিনাশদা ( ভট্টাচাৰ্য ) আসলেন , তার সঙ্গে কিছু সময় জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা চললো । কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — গ্রহগুলি আমাদের complex ( বৃত্তি ) -কেই represent ( সূচিত ) করে । বিশেষ কোন মানুষ বিশেষ কোন complex- এর ( বৃত্তির ) আওতায় পড়ে কিভাবে চলবে , তার বুদ্ধিবৃত্তি , চিন্তা ও কর্ম তখন কেমন ধাঁজ নেবে , তা ’ predict করা ( আগে থাকতে বলা ) যায় । কিন্তু মানুষ যদি সৰ্ব্বতােভাবে ইষ্টকেন্দ্রিক হয় , তখন কিন্তু সে আর প্রবৃত্তিদ্বারা পরিচালিত হয় না , বরং সব প্রবৃত্তিকেই সে পরিচালনা করে ইষ্টার্থপ্রতিষ্ঠার উপযােগী করে । এমনি করেই মানুষের গ্রহদোষ খণ্ডন এ - ছাড়া অন্য পথ নেই । তাই বলে , “ কিং কুর্ব্বন্তি গ্রহাঃ সর্ব্বে যস্য কেন্দ্রে বৃহস্পতিঃ । বৃহস্পতি মানে সদ্গুরু , জীবনের কেন্দ্রদেশে বসান চাই তাকে , তার ভজনায় তাকেই নিজের ভাগ্যবিধাতা করে ভােলা চাই , নইলে কিন্তু শুধুই দীক্ষা নিলে হবে না । তবে দীক্ষা নিয়ে যারা যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি ঠিকমত করে , তারাও কিন্তু অনেকখানি বেঁচে যায় । সর্ব - ব্যাপারে ইষ্টকে যারা মুখ্য করে চলে , তাদের তাে কথাই নেই । খারাপ কিছু আসলেও তারা তাকে ইষ্টস্বার্থ - প্রতিষ্ঠার মহড়ায় ফেলে ভালর দিকে বাগিয়ে নেয় ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর পর - পর কয়েকটা ছড়া বললেন । প্রফুল্ল সেগুলি টুকে নিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বঙ্কিমদা ( রায় ) , বীরেনদা ( মিত্র ) , চুনিদা ( রায়চৌধুরী ) , কিরণদা ( মুখােপাধ্যায় ) , হরিদা ( গােস্বামী ) প্রভৃতিকে ডেকে বললেন শােন্ তাে দেখি ঠিক হইছে নাকি ।
প্রফুল্ল পড়লেন — ওরা শুনে একবাক্যে বললেন , অতি চমৎকার হয়েছে । এত কঠিন জিনিস যে এত সহজ ও সুন্দর করে এত অল্প কথাতে এমনভাবে দেওয়া যায় , তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না । শ্রীশ্রীঠাকুর — পরমপিতা দিলে হয় , আমি বুদ্ধি করে বা চেষ্টা করে কিছু বলতে পারি না । মানুষ যে বলে , তুমি যন্ত্রী আমি যন্ত্র ’ , সেটা আমার মত করে কেউ বােধ হয় বোঝে না । তােদের বিদ্যা আছে , বুদ্ধি আছে , আমি আকাট মুখ্যু , আমার নেই বলতে কিছুই নেই । তাঁর হাত - ধরা হয়ে থাকি । তিনি যখন যা ’ যােগান , তেমনি বলি , তেমনি চলি । এ ছাড়া আমার উপায়ও নেই ।
তাঁর কথা শুনে সবার চোখ ছলছল করতে লাগলাে , মুখে কেউ কোন কথা বললেন না ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর উঠে একবার পুজনীয় খেপুদার বাড়ীর ভিতর গেলেন । সঙ্গে - সঙ্গে কালিদাসীমা , লীলামা ( মিলনের মা ) , প্রভৃতি গেলেন গাড়ু - গামছা , সুপারির কৌটা , তামাক , জল , দাতখােটা ইত্যাদি নিয়ে । খেপুদার বাড়ীর মধ্যে রাজমিস্ত্রীরা কাজ করছে , ঘুরে - ঘুরে সেই কাজ দেখতে লাগলেন । চেয়ার দেওয়া হলো , তাতে প্রথমটা বসলেন না । ড্রেনের একটা জায়গা দেখে বললেন , ‘ ও নবাব ! এখানটা আর - একটু ঢালু করে না দিলি তাে জল দাড়াবে , মশা - মাছি হবে । এখানটা ঠিক করে দিও ।
নবাব ( বিনীতভাবে ) — ‘ জে ! ঠিক কইছেন ঠাকুর । আমার আগে নজর পড়েনি । ঠাকুর ! একটা জিনিস আমি তান্জব বুনে যাই , আমরা তো এই করেই খাই , বরাবর দেখি — আমাদের কারউ চোখি যে - খুত ধরা পড়ে না , তা কিন্তু আপনার চোখ এড়ায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর উৎসাহ দিয়ে বললেন — তুইও চোখেল আমার থেকে কম না । তাের মত মিস্ত্রী গাওঘরে কমই আছে ।
নবাব বললো — সে আল্লার দয়া আর আপনার আশীর্বাদ ।
তােতা এসে শ্রীশ্রীঠাকুরের গা ঘেসে দাড়িয়েছে , জ্যাঠামশায়কে বাড়ীর মধ্যে দেখে খুব আনন্দ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সােহাগ করে বললেন — বুতর ! বুতর । তুতুন ! তুতুন । তােতা কী খুশি ।
#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1
10