দুর্গানাথ সান্ন্যাল :-
🔷 শ্রীশ্রী ঠাকুর এর দয়ায় দুরারোগ্য আমাশয় থেকে মুক্তি ...
🔷 ১৩২০ বঙ্গাব্দে, রাত্রিবেলা মাতা মনোমোহিনী দেবীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ...
🔷 এ রকম ভাবাবস্থায় পরমপিতার কাছে প্রার্থনা করলে তিনি মঞ্জুর করেন...
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের একান্ত নবীন বয়সে তাঁর মানব সত্তার মধ্যে যাঁরা মহামানবতার প্রকাশ লক্ষ্য করে তাঁতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে তাঁরা বিশেষ উচ্চ শক্তির অধিকারী। পরবর্তীকালে যখন ‘শ্রীশ্রীঠাকুর’ রূপে তিনি প্রতিষ্ঠিত, তখন আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসু ও পিপাসু ব্যক্তিবর্গ তাঁর কাছে এসেছেন স্বাভাবিক প্রেরণায়। কিন্তু একান্ত পরিচিত, নিত্যকার চোখে দেখা তরুণ মানুষটিকে প্রাণের, মনের, আত্মার সবটুকু সঁপে দিয়ে তাঁর হয়ে ওঠার সামর্থ্য যাঁরা লাভ করেছিলেন, নিঃসন্দেহে মানবাত্মার সংকট-বিমোচন-প্রয়াসের ইতিহাসে তাঁদের স্থান অনেকের ঊর্ধ্বে। এই স্মরণীয়দের তালিকায় দুর্গানাথ সান্ন্যালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ি মহকুমার অন্তর্গত সোনারপুর গ্রামের অধিবাসী যাদবচন্দ্র সান্ন্যালের পুত্র দুর্গানাথ ১২৮৮ বঙ্গাদের ১লা বৈশাখ পাবনার অন্তর্গত নাজিরপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। দুর্গার্নাথের মাতামহ ঈশ্বরচন্দ্র অপুত্রক ছিলেন। সেজন্য দুর্গানাথ মাতামহ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারীরূপে নাজিরপুরেই বসবাস করতে থাকেন। শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর নাজিরপুরের জমিদার যাদবচন্দ্র অধিকারীর এস্টেটে নায়েব পদে নিযুক্ত হন। মাতামহের সম্পত্তি এবং নায়েবির উপার্জিত অর্থে তাঁর বৈষয়িক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল। নাজিরপুর সংলগ্ন হিমাইতপুর গ্রামের শিবচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়ের পরিবারের সঙ্গে দুর্গার্নাথের ছিল আত্মীয়সুলভ ঘনিষ্ঠতা। বিশেষত শিবচন্দ্র-গৃহিণী অনুকূল-জননী মনোমোহিনী দেবীর অপূর্ব স্নেহ ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ দুর্গানাথ তাঁকে জননী জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর পুত্র অনুকূলচন্দ্রের অসাধারণ চরিত্র-মাধুর্য ও প্রেমশক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে কেউ কেউ তাঁকে ‘ঠাকুর’ বলে অভিহিত করতেন।
১৩১৪ বঙ্গাব্দে দুর্গানাথ একবার কঠিন পীড়াকবলিত হয়ে পড়েন। কিছুদিন জ্বরে ভোগার পর যা কিছু খান, কিছুই হজম হয় না। ক্রমে দেখা দিল দুরারোগ্য আমাশয়। যত রকম চিকিৎসা সম্ভব, কোনটিই বাদ যায় না, কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হয় না। ক্রমে অবস্থা এমন হল যে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পুরোনো চালের সামান্য ভাত আর ছোট মাছের তেল মশলাবিহীন ঝোল ছাড়া আর কিছুই খেতেন না তিনি, কিন্তু তাতেও রোগের কোন উপশম হল না। এদিকে না খেয়ে খেয়ে ক্রমশ হীনস্বাস্থ্য হয়ে পড়লেন; একান্ত তরুণ বয়সেই শরীর তো ভেঙে পড়লই, তার সঙ্গে সঙ্গে মনও হয়ে পড়ল হতাশায় পরিকীর্ণ। পাবনা ও কলকাতার বিশিষ্ট যত চিকিৎসক, সবাইকে দেখিয়েও কোন ফল লাভ হল না। দীর্ঘ ছ’বছর এভাবে রোগভোগের পর অবশেষে আত্মীয়-পরিজনের পরামর্শে দেওঘরে গিয়ে বাবা বৈদ্যনাথের কাছে ধরনা দিলেন। রোহিণী রোডের ‘ডক্টরস্ লজ’- এ একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন তিনি প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে বৈদ্যনাথ-মন্দিরে ধরনা দেওয়ার সময় আকুলভাবে কুলগুরুর কাছে প্রাপ্ত নাম জপ করতেন। দেওঘরে বালানন্দ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা বালানন্দ স্বামী তখন আশ্রমে বর্তমান ছিলেন। তাঁর কাছেও প্রায়ই যেতেন দুর্গানাথ, কাছে বসে তাঁর আলাপ-আলোচনা শুনতেন আর রোগমুক্তির জন্য মনে মনে প্রার্থনা জানাতেন। কিন্তু আমাশয় রোগ তাঁর বেড়েই চলল, ধীরে ধীরে শরীর ফুলে উঠতে শুরু করল। গভীর নৈরাশ্যে ছেয়ে গেল দুর্গার্নাথের অন্তর, বুঝি এভাবেই অবসান হবে দুর্লভ মানবজন্মের। অবশেষে একদিন গভীর রাতে স্বপ্ন দেখলেন, এক দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ উপবীতধারী ব্রাহ্মণ বলছেন-ভয় নেই রে, বাড়ি ফিরে যা! তোর এ রোগ বাড়ির কাছে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে গিয়ে নাম করলেই সারবে। পরদিন সকালে কিছুটা উৎসাহিত হয়ে মন্দিরে গিয়ে তাঁর তীর্থগুরু দেবীপ্রসাদ পাণ্ডাকে জিজ্ঞাসা করলেন—বাবার আদেশ কীভাবে পাওয়া যায়? পাণ্ডা বলেন—কোন স্বপ্ন দেখেছেন কি? দুর্গানাথ তখন তাঁর স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন। অভিজ্ঞ সেই পাণ্ডা তাঁকে বাড়ি ফিরে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছেই যেতে বললেন।
আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান চিত্তে নিজগ্রাম নাজিরপুরে ফিরলেন দুর্গানাথ সান্ন্যাল। এত কিছুর পর এই অসহ্য রোগের শেষ হবে কিনা ঘরের কাছে নিতান্ত নবীন আবাল্য পরিচিত অনুকূলচন্দ্রের কাছে? সে কি সত্যিই মহাপুরুষ? কেউ কেউ অবশ্য তাকে ‘ঠাকুর’ বলে, গুরু বলেও মানে, কিন্তু মনের সংশয় থেকেই যায়। আবার স্বপ্নাদেশও তো অগ্রাহ্য করতে পারেন না! যাহোক, বাড়ি ফিরে পরদিনই অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করবেন স্থির করলেন। অনুকূল-ভক্ত অনন্তনাথের অগ্রজ অন্নদা রায় ছিলেন দুর্গার্নাথের বন্ধু। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে অনুকূলের বাড়ি যাবেন ভেবে কাশীপুর গ্রামে তাঁদের বাড়ি গিয়ে দেখেন—অনুকূলচন্দ্র সেখানেই উপস্থিত। অনুকূল ও অনন্ত, দু’বন্ধু একসঙ্গে বসে চিঁড়ে আর খাগড়াই খাচ্ছিলেন -তাঁকে দেখেই আনন্দে জড়িয়ে ধরে ‘এই যে দুর্গাদা এসেছেন’ বলে তাঁর মুখে মুঠো করে চিঁড়ে আর খাগড়াই দিতে থাকেন, দুর্গানাথও খেতে থাকেন। তাই দেখে অন্নদা রায় ধমকে বলেন -তোরা করছিস কী? দুর্গাদা আমাশায় শরীর ফুলে মরতে বসেছে, আর তোরা তাকে চিঁড়ে আর খাগড়াই খাওয়াচ্ছিস-তোরা ওকে মারবি নাকি? বকুনি খেয়ে অনুকূল ও অনন্ত চিঁড়ে খাওয়ানো বন্ধ করে অনুকূলের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। দুর্গার্নাথের মনে হল, স্বপ্নাদেশের ব্যাপারটা আগে অনন্তকে জানাবেন। তাঁকে বললেন একবার তিনটে নাগাদ নাজিরপুরে তাঁর বাড়িতে যেতে। তদনুযায়ী অনন্তনাথ দুর্গার্নাথের বাড়ি গেলে তাঁকে নিয়ে বাড়ির কাছে পদ্মার তীরে এলেন দুর্গানাথ। সেখানে বসে বৈদ্যনাথের স্বপ্নাদেশের কথা বিস্তৃতভাবে জানালেন তাঁকে। মহাসাধক অনন্তনাথ তখন ধীরে ধীরে শ্রীশ্রীঠাকুরের সৎনাম সাধনা ও তৎপ্রদত্ত নামজপের সুগভীর তাৎপর্য দুর্গানাথকে বুঝিয়ে বলেন। সেদিন সারারাত অনর্গলভাবে হৃদয় বিনিময় হয় দুজনের; আত্মস্থ মিতবাক্, স্থিতধী অনন্তনাথ দুর্গার্নাথের মনোরাজ্যে এনে দেন আশার নবীন কিরণ, বেঁচে থাকার, বেড়ে ওঠার অলোকময় প্রেরণা।
পরদিন সকালে ঠাকুরের কাছে তাঁকে নিয়ে চললেন অনন্তনাথ। যাওয়ার পথে দুর্গানাথ বলেন, কুলগুরুর মন্ত্রে একবার দীক্ষা নিয়েছি, আর কিন্তু দীক্ষা নিতে পারব না। হিমাইতপুরে ঠাকুরের বাড়িতে পৌঁছনোর পর জননী মনোমোহিনী দেবী অত্যন্ত আদর করে বসালেন তাঁকে, অনেক আশা-ভরসা-সান্ত্বনা দিয়ে দুপুরে সেখানে খেয়ে যেতে বললেন। তিনি মায়ের কাছে গোপনে স্বপ্নের কথা সব খুলে বলেন। এমন সময় হঠাৎ ঠাকুর সেখানে ছুটে এসে হাজির হলেন, বললেন, মা, দুর্গাদার না খাওয়ার দরুন এমন অসুখ হয়েছে, যা ভাল লাগে তাই খাবে, খুব খাবে, তবেই ওর রোগ সারবে।
দুপুরে স্নান সেরে এসে দেখেন মা ঠাকুরের কথা অনুযায়ী আহারের আয়োজন করেছেন। তাঁকে বলেন, নে, খেতে বোস। ঘন ক্ষীর, মোটা আউস চালের ভাত, ছোলার শাক ইত্যাদি তাঁকে খেতে দিলেন মাতৃদেবী, যা সাধারণ ভাবেই যথেষ্ট গুরুপাচ্য, ওঁর পক্ষে তো একান্তই বিষবৎ। ঠাকুরের নির্দেশে এবং মায়ের স্নেহ- অনুজ্ঞায় তিনি নির্দ্বিধায় খেয়ে নিলেন সে-সব কিছু। স্থানীয় ডাক্তার বসন্তকুমার চৌধুরী এরকম খাওয়ার কথা শুনে রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্গানাথকে তিরস্কার করলেন। প্রত্যুত্তরে দুর্গানাথ দৃঢ় কন্ঠে বললেন—ডাক্তারবাবু, আপনাদের কথা অনেক শুনেছি, আর আপনাদের কথা শুনব না। অনুকূল যা বলে তাই খাব, তাই করব। জননী মনোমোহিনী দেবী বললেন-আমার একটা টোটকা জানা আছে, সকালে খালি পেটে উঠে খেতে হয় তিন দিন। সুতরাং মায়ের আদরে, ঠাকুরের আশ্রয়ে কাটল তিন দিন। এই তিন দিন শ্রীশ্রীঠাকুর ও অনন্ত মহারাজের সঙ্গে স্টীমার ঘাটে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, অফুরন্ত গল্প আর রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ঠাকুরের আর এক অন্তরঙ্গ পার্ষদ ভক্তশ্রেষ্ঠ কিশোরীমোহন দাসের বাড়িতে মধ্যরাত পর্যন্ত উতরোল কীর্তন। ছ’বছরের দুরারোগ্য ব্যাধি, দুর্গার্নাথের জীবনীশক্তি যাতে নিঃশেষ প্রায় হয়ে এসেছিল—কোথায় উধাও হয়ে গেল! স্বপ্নাদেশ এভাবে সফল হল তাঁর জীবনে।
শরীরের রোগমুক্তি তো হল, কিন্তু মনে আর এক রোগ বাসা বাঁধল, সে রোগের নাম অনুকূল-প্রেম। এ রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পরিবর্তে পুরোপুরি তাতেই মগ্ন হয়ে যেতে চাইল সত্তা। প্রায় রোজই সকাল-বিকেল দু’বেলা অনুকূল- দর্শন না হলে মন মানে না। প্রায়ই নিমন্ত্রণ করেন অনুকূলচন্দ্র ও অনন্তনাথকে, একসঙ্গে তাঁদের সঙ্গে বসে ইচ্ছেমত আহার করেন।
দিন দশ/বারো পর একদিন সারাদিন একবারও যাওয়া হয়নি হিমাইতপুর দুর্গার্নাথের মনের ভেতরটা আঁকু-পাকু করছে তাঁর জন্য। কিন্তু শরীর একটু খারাপ লাগায় আর গেলেন না, রাতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লেন। হঠাৎ গভীর রাতে বাইরে থেকে ঠাকুরের গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল-দুর্গানাথদা, ও দুর্গানাথদা! তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখেন-লণ্ঠন হাতে একাকী ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন। সাদরে ঘরে নিয়ে এসে বসালেন তাঁকে, তামাক সেজে দিলেন। এর আগে দুর্গানাথ বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার দরুন তাঁর সামনে ঠাকুর ও অনন্ত মহারাজ তামাক খেতেন না। কিন্তু ঐ ক’দিনের ঘনিষ্ঠ মেলামেশায় সে কুণ্ঠার বাঁধ ভেঙে যায়, একসঙ্গে তামাক খেতেন তাঁরা। ঠাকুর বললেন- আপনি আজ গেলেন না, তাই ভাল লাগল না বলে আপনাকে দেখতে এলাম। দুর্গানাথের সমগ্র প্রাণমন ভরে উঠল আনন্দে-মানুষের জন্য মানুষের এত ভালবাসা থাকে! অত রাত্রে দুজনে বসে অনেক গল্প, অনেক কথা হল। গল্প তো ফুরোবার নয়, তবুও তো যেতে হবে। ঠাকুর উঠলেন বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। দুর্গানাথ তাঁকে একলা যেতে দিলেন না, গৃহিণীকে দরজা বন্ধ করতে বলে নিজেও চললেন ঠাকুরের সঙ্গে; বলে গেলেন, পরদিন সকালে ফিরবেন। সারা রাস্তা কথায় কথায় কাটল। ঠাকুরের বাড়ির সামনে পদ্মার পারে একটি ছোট ঘর ছিল, সেখানে ঠাকুর ও অনন্তনাথ প্রায়ই রাত্রে শুতেন; সে ঘরের কাছাকাছি পৌঁছে ঠাকুর বললেন-ঐ ঘরে অনন্ত আছে, ওখানে যান, আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। এই বলে ঠাকুর বাড়ির দিকে গেলেন, দুর্গানাথ ঐ ঘরের সামনে গিয়ে অনন্তনাথকে ডাকলেন। দরজা খুললেন অনন্ত, এবং যৎপরোনাস্তি বিস্ময়ের সঙ্গে দুর্গানাথ দেখলেন ঘরের মধ্যে অনন্তর পাশে দাঁড়িয়ে এ কে! এ যে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র! সদ্য ঘুম ভাঙা মানুষের মতই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। দুর্গানাথ কোনমতে বলেন-কে তুমি? তুমি কী করে এখানে এলে? এই যে আমার সঙ্গে একসঙ্গে আমার বাড়ি থেকে এসে আমাকে অনন্তের ঘরে যেতে বলে চোখের সামনে দিয়ে নিজের বাড়িতে গেলে! আমার বাড়িতে আর বাড়ি থেকে আসার পথে যে এত গল্প হল!
শ্রীশ্রীঠাকুর নিতান্ত ভালমানুষের মত অতি সরলভাবে বললেন- দুর্গাদা, আমি তো কোথাও যাইনি। পাশে দাঁড়ানো অনন্তকে বললেন-অনন্ত, আমি কি কোথাও গিয়েছিলাম? অনন্তও বললেন, কৈ, ঠাকুর তো কোথাও যাননি, আমি আর ঠাকুর তো একসঙ্গে শুয়েছিলাম। সকলের অগোচরে এক সূক্ষ্ম হাসি ছিল কি তখন ঠাকুরের ওষ্ঠাধরে? বাইরে কিন্তু তার প্রকাশ নেই, ছেলে ভোলানোর মত করে বলেন, ও কিছু নয় দুর্গাদা, ও আপনার মনের ভুল।
দুর্গানাথ কি তাই মেনে নিতে পারেন? বাড়িতে ফিরে গেলে যে এখনও তামাকের টিকের উত্তাপ অনুভব করতে পারবেন, যে তামাক দুজনে খেলেন এই একটু আগে! সবই মনের ভুল? মনের ভেতরে যেন ঝড় বইতে শুরু করল। ঠাকুরের আর অনন্তনাথের একটি করে হাত শক্ত করে নিজের দুই বাহুর তলায় চেপে ধরে দুজনকে নিয়ে চললেন ঠাকুরের বাড়ির ভেতরে-যেন সেখানে গিয়ে দেখতে পাবেন সত্যিই আর এক অনুকূল ভেতরে আছেন! ভেতরে ঢুকে দেখেন—সব নিঝুম অন্ধকার, কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। কয়েকবার জোরে জোরে ‘মা, মা’ বলে ডেকেও কারও সাড়া পাওয়া গেল না। বিবশ হয়ে এল তাঁর সর্বশরীর, লুপ্ত হল যেন জাগতিক সমস্ত বোধ। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এ কোন্ মহা অস্তিত্ব! আছড়ে পড়লেন শ্রীশ্রীঠাকুরের পায়ে, কাঁদতে লাগলেন অবরূদ্ধ আবেগের অকস্মাৎ মুক্তিতে, অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলেন-আজ থেকে তুমি আমার কালী, দুর্গা, গৌর, কৃষ্ণ সবই! তুমি দয়া করে এই অধমকে তোমার শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় দাও! ঠাকুর শশব্যস্ত হয়ে তাঁকে তুলে ধরে বললেন-করেন কী দুর্গাদা! আপনি আমার পায়ে হাত দিয়ে এসব কথা কেন বলছেন? প্রবল ভাবোচ্ছ্বাসে দুর্গানাথ উদ্বেল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। ঠাকুর তখন বললেন-মায়ের ওপর হুকুম আছে নাম দেওয়ার। মা দীক্ষা দেবেন। এর পরেও কাটল কয়েকটি দিন। ক্রমেই দুর্গার্নাথের কাতরতা ও আকুলতা চরম পর্যায়ে পৌঁছল। অবশেষে ফাল্গুনের প্রথমে, ১৩২০ বঙ্গাব্দে, রাত্রিবেলা মাতা মনোমোহিনী দেবী ও শ্রীশ্রীঠাকুর উভয়ে পদ্মাতীরের সেই ছোট ঘরে তাঁকে সৎনামে দীক্ষা দিলেন-জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠল তাঁর সমগ্র সত্তা।
প্রকৃতিগতভাবেই দুর্গানাথ অমায়িক, সৎ ও সরল অন্তঃকরণের অধিকারী ছিলেন। সৎনাম গ্রহণ করার পর নিত্য নামধ্যান-সাধনভজনের ফলে এবং শ্রীশ্রীঠাকুর ও জননী মনোমোহিনীর প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও ভালবাসায় তাঁর প্রকৃতির ক্রমোন্নয়ন হয়ে চলে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের মহামানবিক নানা অপরূপ লীলার নিত্য সাক্ষীরূপে ধন্য হয়ে উঠেছিল দুর্গার্নাথের জীবন। দীক্ষাগ্রহণের অব্যবহিত পরে ১৩২০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে একদিন ঠাকুর ও দুর্গানাথ রাতের খাওয়া দাওয়ার পর পদ্মাতীরের ঘরে শোওয়ার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। ঠাকুরবাড়ি থেকে পদ্মাতীরের ঐ ঘরে যেতে বেশ খানিকটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হত। সেই পথে মাঝামাঝি এসে ঠাকুর হঠাৎ বললেন, এই যে যতীশ এসেছে!
-- কোন্ যতীশ?
-- যতীশ ঘোষ।
-- যোগী ঘোষের ছেলে যতীশ ঘোষ?
-- হ্যাঁ।
-- সে তো আজ চার / পাঁচ দিন হল মারা গেছে।
-- এই দেখুন না, আপনার ও আমার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, ঐ চলে গেল কিশোরীর বাড়ি কীর্তন করতে।
-- কী আশ্চর্য! আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তুমি মরা মানুষ দেখতে পেলে কেমন করে?
-- নাম করুন, তবেই আপনিও দেখতে পাবেন ও জানতে পারবেন যে মৃত্যুর পরও জীবিতের মতই তারাও সবকিছুই করে। আপনারা কেউ আমার কাছে এলে আপনাদের মনোভাব যেমন বুঝতে পারি, ওদের বেলায়ও তেমনই। খুব করে নামধ্যান করলে ইহ ও পরলোকের সব তত্ত্ব সহজেই আপনাদেরও জানার পাল্লার মধ্যে এসে যাবে।
অপর একদিন সকাল দশটা নাগাদ ঠাকুর আশ্রমে বসে অনেকের সঙ্গে
কথাবার্তা বলছেন। দুর্গানাথও সামনে উপস্থিত আছেন। হঠাৎ ঠাকুর চেঁচিয়ে উঠলেন—
এই রে, ডুবে গেল, ডুবে গেল! আবার একটু পরেই বলে উঠলেন, নাঃ বেঁচে গেল।
উপস্থিত কেউ কিছু বুঝতে পারলেন না। পরের দিন ঠাকুর হঠাৎই কুষ্টিয়ার দিকে
রওয়ানা হলেন। দুর্গানাথ এবং আরও কয়েকজন সঙ্গে চললেন। কুষ্টিয়া পৌঁছে তাঁরা জানতে পারলেন যে স্থানীয় ইষ্টভ্রাতা প্রফুল্ল রায়ের পাঁচ/ছয় বছরের ছেলে জলে ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে পাওয়া যাওয়ায় ছেলেটি বেঁচে যায়।
১৩২২ বঙ্গাব্দের একটি ঘটনা। পদ্মাতীরের যে ঘরে শ্রীশ্রীঠাকুর এবং অনন্ত মহারাজ থাকতেন, প্রায়শই দুর্গানাথও সেখানে থেকে নামধ্যান করতেন। একদিন রাত্রে ঠাকুর ঘরের মধ্যে চৌকিতে শুয়ে আছেন। নিচে পৃথক পৃথক আসনে বসে অনন্তনাথ ও দুর্গানাথ নামধ্যানে রত। রাত্রি প্রায় দেড়টা নাগাদ অকস্মাৎ ঠাকুর চৌকি থেকে নেমে দরজা খুলে ছুটতে শুরু করেন আর অবিরাম বলতে থাকেন পরমপিতা, তোমার কাজ কী করে করব—লোক পাচ্ছি না—। হতচকিত ও সন্ত্রস্ত অনন্ত এবং দুর্গানাথও তাঁর পেছনে ছুটতে থাকেন, কিন্তু তাঁর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেলেন তাঁরা। চোখের নিমেষে বহু দূরে চলে গেলেন ঠাকুর। তাঁরা সেই অভিমুখে ছুটতে ছুটতে বেশ কিছুটা গিয়ে দেখলেন নদীতীরে শ্মশানের কাছে বালির চরে আকাশের দিকে মুখ করে হাত দুটি ঊর্ধ্বে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, সর্বাঙ্গ কাঁপছে থরথর করে, বেদনাপীড়িত কন্ঠে উন্মত্তের মত বলে চলেছেন- হে পরমপিতা! মানুষ পেলাম না! আমি থেকে কী করব? আমি যাই! আমি যাই!
এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে বিমূঢ় অনন্তনাথ ও দুর্গানাথ ঠাকুরের পায়ে পড়ে পা দুখানি জড়িয়ে ধরে আকুলভাবে কাঁদতে কাঁদতে আর্তকণ্ঠে বলতে লাগলেন - ঠাকুর, আমাদের ছেড়ে যেও না, আমাদের কাঁদিয়ে যেও না, আমরা তাহলে তোমার। অভাবে বাঁচব না। ঠাকুরের অঙ্গস্পর্শে তাঁদের শরীরও কাঁপতে লাগল থরথর করে। এরপর এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা হল তাঁদের সামনে। বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাঁরা দেখলেন-শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখমণ্ডল থেকে সার্চলাইটের মত তীব্র এক অপূর্ব জ্যোতিরশ্মি নির্গত হয়ে আকাশ স্পর্শ করল—সে আলোকের আভায় অন্ধকার রাত্রেও আকাশের মেঘগুলো সাদা, গোলাপি নানা রঙে রঙীন হয়ে দেখা যেতে লাগল। তাঁর সমগ্র মুখমণ্ডল অপরূপ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে, বিশেষত প্রশস্ত ললাটখানি যেন আয়নার মত স্বচ্ছ প্রতিভাত হচ্ছে। ভাবনার অগম্য, বোধের অতীত এই অভিনব অভিরাম দৃশ্যে অভিভূত, বিহ্বল হয়ে পড়লেন দুই ভাগ্যবান ভক্ত। নিত্য যিনি ধরাছোঁয়ার মধ্যে রয়েছেন, তাঁর সর্বসীমা অতিক্রমকারী অমিত প্রসার দর্শনে শিহরিত হয়ে উঠল তাঁদের সমগ্র সত্তা। কিছুক্ষণ পরে অস্তমিত হল সেই বিভা, কমে আসতে লাগল ঠাকুরের শরীরের কম্পন; ক্রমশ তাঁর পার্থিব চেতনা ফিরে আসতে লাগল এবং দেহখানি অবশ হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। অনন্ত মহারাজ ও দুর্গানাথ দু’দিক থেকে তাঁকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল তাঁর অবস্থা।
নামধ্যানে দুর্গানাথের অনুরাগ ক্রমে আরও বৃদ্ধি পেতে লাগল। শ্রীশ্রীঠাকুর ও অনন্তনাথের সঙ্গে রাত্রে থাকাকালীন তো বটেই, নিজের বাড়িতে থাকলেও রাত্রে বসে গভীর নামধ্যানে ডুবে যেতেন। ১৩২৬ বঙ্গাব্দ। একদিন রাত আড়াইটে নাগাদ নিজের পৃথক বিছানায় বসে নামধ্যানে তন্ময় হয়ে গেলেন দুর্গানাথ। ক্রমশ বাইরের সমস্ত শব্দ লুপ্ত হয়ে অভ্যন্তরে অনাহত শব্দ জপ হতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তাঁর সুগভীর তন্ময়তায় ব্যাঘাত ঘটাতে লাগল কী এক কোলাহল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, তাঁর তিন শিশু পুত্র মাঝরাতে জেগে উঠে হুড়োহুড়ি শুরু করেছিল, ছোটরা প্রায়শই যেমনটি করে থাকে, এবং তাদের মা তাদের থামাবার জন্য প্রহার করায় তিনজন একসঙ্গে কাঁদতে শুরু করেছে। তাদের সম্মিলিত কান্নার আওয়াজই তাঁর কানে পৌঁছে অনাহত শব্দ জপে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে তীব্র বিরক্তি এবং ক্রোধ আবির্ভূত হল তাঁর মনে। হাতজোড় করে পরমপিতার কাছে প্রার্থনা জানালেন- সাধনার বিঘ্নস্বরূপ এমন সন্তানে তাঁর আর দরকার নেই, শেষ হোক এরা! এরপর ছেলেরা চুপ করে গেল, তিনিও আবার জপধ্যানে মন দিলেন। কিন্তু মন যেন আর ঠিক লাগল না, কী যেন এক তালভঙ্গ হয়ে গেল। মানসিক এক ধরনের অস্বস্তি বোধ হতে লাগল দুর্গানাথের।
পরদিন ভোরে শঙ্কিত বিস্ময়ে দেখলেন, তিন পুত্রেরই ভীষণ সর্দিকাশি ও জ্বরবিকার। প্রবল আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তাঁর পিতৃহৃদয়-এ কী সর্বনাশ করেছেন তিনি! তবে কি তাঁর মুখনিঃসৃত কথাই ফলতে চলেছে? সেই মুহূর্তে ছুটলেন ঠাকুরের কাছে। দূর থেকেই মনে হল যেন বড় গম্ভীর, থমথমে ঠাকুরের মুখখানি। কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললেন, ওষুধ চাইলেন ছেলেদের জন্য। আরক্তিম মুখে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-দুর্গানাথদা, এ আপনি বড়ই অন্যায় কাজ করেছেন। একেবারে এরকম ভাবাবস্থায় পরমপিতাকে জানিয়েছেন! আপনি একা উদ্ধার হতে চান, আর আপনার নিকটতম পারিপার্শ্বিক-যারা আপনার পরমপিতার দান-তাদের মৃত্যু চান! এ এখন কেমন করে রক্ষা করা সম্ভব হবে?
নিজের অপরাধের জন্য তীব্র অনুশোচনায় পুড়ে গেল দুর্গার্নাথের হৃদয়, কাতরভাবে ঠাকুরের পা দুখানি ধরে ক্ষমা চেয়ে পুত্রদের প্রাণ ভিক্ষা করতে লাগলেন। ঠাকুর বললেন, পরমপিতার কাছে যখন জানিয়েছেন, তখন তিনি অন্তত একজনকে নেবেনই, আর দুজনকে ফিরিয়ে দেবেন। এখন আপনি ঠিক করুন, কাকে দেবেন। দুর্গানাথ আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন-তুমি বাঁচাও! তুমি বাঁচাও! ঠাকুর বললেন, সবার ছোটটিকে অল্পদিন লালন-পালন করেছেন, ওকে পরমপিতা নিলে ব্যথা একটু কম লাগবে, ও- ই যাক। এ কথা বলে সকলের জন্যই ওষুধ দিলেন।
দেখা গেল, বড় ছেলে দুটো অল্পদিনের মধ্যেই সেরে উঠল, কিন্তু ছোটটির অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে লাগল। আত্মীয়স্বজন বিশেষভাবে বলতে লাগল অন্য ডাক্তার দেখানোর জন্য। কিন্তু দুর্গানাথ ঠাকুর ব্যতীত আর কোন চিকিৎসককে ডাকতে সম্মত হলেন না। পরিশেষে তাঁর আত্মীয় অমরেন্দ্রনাথ লাহিড়ি ও গিরীন্দ্রনাথ লাহিড়ির পীড়াপীড়িতে পাবনার তদানীন্তন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক আনন্দনাথ রায় ঠাকুরের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা করতে সম্মত হওয়ায় দুর্গানাথ তাঁকে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেই চিকিৎসক স্থানীয় কিছু লোকের কথায় প্রভাবিত হয়ে ঠাকুরের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ দিলেন এবং দুর্গানাথের আপত্তি সত্ত্বেও আত্মীয়পরিজন ছেলেটিকে সে ওষুধ খাওয়ালেন। এরপরই তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ল। দুর্গানাথ ঠাকুরকে সব কথা জানালেন। তিনি বললেন, আপনি তাকে বাঁচাতে চাইলে কী হবে, পরমপিতা তাকে নেবেন, তাই আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও চিকিৎসার বিভ্রাট ঘটল। আগামীকাল ঠিক এগারোটায় তার মৃত্যু হবে, আর যদি আপনি পীড়াপীড়ি করে আমাকে তার আগে আপনার বাড়িতে নেন, তবে সে আগেই মারা যাবে।
পরদিন সকাল দশটায় ঠাকুরের বাল্যকালের শিক্ষক পঞ্চানন মৈত্র ঠাকুরকে গিয়ে জানালেন যে দুর্গানাথ সান্ন্যালের পুত্রের অবস্থা খুব খারাপ, ঠাকুর যেন একবার যান। শ্রীশ্রীঠাকুর কিশোরীমোহন দাস সহ সেখানে যাওয়ার আধ ঘন্টা পর ঠিক এগারোটার সময় দুর্গার্নাথের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রটির মৃত্যু হয়। কিন্তু দুর্গার্নাথের অন্তর আশ্চর্য রকমের অবিচল, শান্ত হয়ে গেল, সব শোকতাপ তাঁর কে যেন হরণ করে নিয়েছে!
প্রায় বারোটা নাগাদ ঠাকুর সেখান থেকে নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। সেদিন বিকেলেই দুর্গানাথ ঠাকুর-বাড়িতে গেলেন। সেখানে কয়েকজন ইষ্টভ্রাতা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দুর্গাদা, আপনি কি দেবতা? আপনার চেহারায় তো শোকতাপের কোন চিহ্নও নেই, আর এদিকে ঠাকুর আপনার ওখান থেকে ফিরে এসে কী কান্না কাঁদলেন! সেজন্য তাঁর খাওয়াদাওয়া হতে আজ সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। দুর্গানাথ অন্তরের মধ্যে অনুভব করলেন, নামধ্যানে অর্জিত অমোঘ শক্তির অসতর্ক প্রয়োগে তাঁকে যে অকালে একটি সন্তান হারাতে হল, সেই সন্তান হারানোর বেদনা তাঁর হয়ে বহন করলেন ভক্তের ভগবান শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
দুর্গানাথের আত্মীয় এবং সহপাঠী গিরীন্দ্র লাহিড়ি দুর্গানাথের কিছু জমিজমা কৌশলে দখল করে নিয়েছিলেন; বৈষয়িক কূটবুদ্ধিসম্পন্ন গিরীন্দ্র দুর্গানাথের ঠাকুরকেন্দ্রিক চলনা ভাল চোখে দেখতেন না। প্রায়ই বলতেন, নিজের জোতজমা বাড়িঘর দেখ না, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে নিয়েই মজে আছ। আমি তোমাকে এই আশ্রম ছাড়াবই। উত্তরে দুর্গানাথ বলেন- আমার ঠাকুর দয়াল, তুমি আমার আত্মীয় ও সহপাঠী বন্ধু, আমিও শপথ করে বলছি, তোমাকে তাঁর শ্রীচরণতলে নেবই নেব।
ঠাকুরের কাছে গিয়ে দুর্গানাথ গিরীন্দ্র লাহিড়ি সম্পর্কে তাঁর শপথের কথা জানানোতে ঠাকুর বললেন-সে তো এ জন্মে আমাকে ধরতে পারবে না, পরজন্মে ধরবে। সামনে ছিলেন অনন্তনাথ। তিনি ঠাকুরকে বললেন-দুর্গাদা যখন বলে ফেলেছে, তখন তো তা করতেই হয়। শ্রীশ্রীঠাকুর স্মিতভঙ্গীতে অনন্তনাথকে বলেন, তুমি কিংবা দুর্গাদা, এই দুজনের কারও কথায়ই সে দীক্ষা নেবে না; তবে কুষ্টিয়ার সতীশ জোয়ারদারকে যদি আনতে পার, তাহলে তার কথায় দীক্ষা নিতে পারে।
ঠাকুরের নির্দেশে সতীশ জোয়ারদারকে আসার কথা জানিয়ে চিঠি লিখে সেটি ডাকে দিতে গেলেন দুর্গানাথ গিরীন্দ্র লাহিড়িকে সঙ্গে নিয়ে। গিয়ে দেখেন, যে বাড়িতে পোষ্ট অফিস, সেই যোগেশ চৌধুরীর বাড়িতেই সতীশ জোয়ারদার বসে আছেন। তাঁকে দেখেই তো দুর্গানাথের প্রাণ আনন্দে নেচে উঠল। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে সতীশের কাছে তাঁর আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি জানালেন যে সকালে নামধ্যান করার সময় শুনতে পেলেন ঠাকুর বলছেন, শিগগির এই অবস্থায়ই এখানে চলে আসুন, আমার এখানে কাজ আছে। তৎক্ষণাৎ একবস্ত্রে রওনা হয়ে তিনি ঠাকুরের কাছে চলে আসেন। ঠাকুরকে প্রণাম করা মাত্র তিনি সতীশকে কাশীপুরে যোগেশ চৌধুরীর বাড়িতে যেতে বলেন, কিন্তু কী কারণে, তা কিছু বলেন নি। একথা শুনে দুর্গানাথ গিরীন্দ্র লাহিড়ি সম্বন্ধে সব কথা তাঁর কাছে খুলে বললেন।
যোগেশ চৌধুরীর বাড়িতেই গিরীন্দ্র লাহিড়ি, সতীশ জোয়ারদার ও দুর্গানাথ সান্ন্যাল দ্বিপ্রাহরিক আহার সমাধা করলেন। তারপর শুরু হল নানা কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা। ঐ এক দুপুরে সতীশ জোয়ারদারের কাছে ঠাকুর-বিষয়ক আলোচনা শুনে গিরীন্দ্রর মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা দিল। সন্ধ্যার মুখে মুখে তিনি বললেন, চলুন যাই, ঠাকুরের কাছে গিয়ে আলাপ আলোচনা করি। একসঙ্গে সকলে আশ্রমে এসে দেখলেন, চালাঘরে কীর্তন চলছে। দুর্গানাথ মহা উৎসাহে কীর্তনে যোগ দিলেন, আর সতীশ গিরীন্দ্রকে নিয়ে গেলেন ঠাকুরের কাছে। কীর্তন চলল রাত বারোটা পর্যন্ত। কীর্তন শেষ হওয়ার পর দুর্গানাথ জানতে পারলেন, গিরীন্দ্রর দীক্ষা হয়ে গেছে। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে গিয়ে দেখলেন ঠাকুর মাতৃক্রোড়ে উপবিষ্ট, গিরীন্দ্র সামনে বসে অঝোরে কাঁদছেন। এতদিনকার সঞ্চিত যত মালিন্য বুঝি ধুয়ে যাচ্ছে সেই অবাধ ধারায়। দুর্গানাথকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলেন গিরীন্দ্র-ভাই দুর্গা, আমি না জেনে এতদিন তোকে কত গাল দিয়েছি, আর তুই-ই আজ আমার জীবন ধন্য করলি - জীবনে সত্যিকার আনন্দ দিলি! ইষ্টপ্রাণের ইষ্টায়নের শপথ পূর্ণ হল এভাবে।
ক্রমেই শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি ভক্তি-ভালবাসা-বিশ্বাসের গভীরতা আরো থেকে আরোতর হয়ে উঠতে লাগল দুর্গার্নাথের চিত্তে। পরিবারবর্গ নাজিরপুরে থাকলেও তিনি প্রায় বেশির ভাগ সময়ই ঠাকুর-সান্নিধ্যে হিমাইতপুরে কাটাতেন। নামধ্যান, ভজনকীর্তন, উচ্চ ভাবের আলোচনা, সর্বোপরি জগৎমোহন ঠাকুরের সুতীব্র আকর্ষণ সব মিলিয়ে অন্তরে তাঁর গভীর আনন্দের প্লাবন বয়ে যেত। একদিন নাজিরপুর থেকে হিমাইতপুর যেতে যেতে গ্রামে প্রবেশের মুখে তাঁর কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হল। মনে হল, গ্রামখানি যেন আশঙ্কিত, বিষাদমলিন। শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে যাওয়ার পর অযোধ্যা-প্রবেশোন্মুখ ভরতের যেমন বোধ হয়েছিল যে অযোধ্যা নিষ্প্রাণ, দীর্ণ, নিরানন্দ, তার গাছপালা নিস্পন্দ, পাখিরা কাকলিশূন্য, পথ জনহীন, দুর্গানাথের যেন অকস্মাৎ সেরকম একটা অমঙ্গল আশঙ্কার অনুভব হল। তিনি এগোতে লাগলেন শঙ্কিত চিত্তে। ঠাকুরের বাড়ির কাছাকাছি অগ্রসর হয়ে দেখেন, জননীদেবী মলিন মুখে সম্বিৎহীন দৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দু’গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা। সে দৃশ্যে তাঁর বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে উঠল, দ্রুত পায়ে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মাতা মনোমোহিনী দেবী প্রকৃতিস্থ হয়ে ম্লানমুখে বললেন- আয় বাবা। কিন্তু তাঁর সেই প্রাণভরানো উচ্ছ্বসিত আদরমাখা ডাক এ নয়, এ যেন এক বিষাদপ্রতিমার যান্ত্রিক স্বর। কী হয়েছে মা-গভীর উদ্বেগে জিজ্ঞাসা করেন দুর্গানাথ। মা উদগত অশ্রু সম্বরণ করে উত্তর দেন,- আমাদের জমি কাল নীলাম হয়ে যাচ্ছে সব-
— সে কী, কত টাকা অনাদায়ে?
— ষোলশ টাকা।
— মা, আমি কি তোমার ছেলে নই, আমাকে কেন কিছু বলনি?
— কী আর বলব বাবা।
— তুমি চিন্তা কোরো না মা, আমি ব্যবস্থা করছি।
— সে কী বাবা, এতগুলো টাকা-
— তুমি দ্যাখই না। -এই বলে দ্রুত পায়ে নিজের গৃহে ফিরলেন দুর্গানাথ।
সম্পন্ন গৃহস্থ হলেও এককথায় ষোলশ টাকা জোগাড় করা, বিশেষত গ্রামের বাড়িতে, তখন সহজসাধ্য ছিল না। বাড়ি ফিরে যেখানে যা আছে কুড়িয়ে বাড়িয়ে ষোলশ টাকা একত্র করে ছুটলেন আবার হিমাইতপুর। মায়ের হাতে সেই টাকা তুলে দিয়ে তবে তিনি নিশ্চিন্ত। রক্ষা পেল নীলামের হাত থেকে সে জমি।
শ্রীশ্রীঠাকুর পরবর্তীকালে কতবার যে এ কাহিনী কত লোককে বলেছেন তার ঠিক নেই। বলতেন-দুর্গানাথদা অসময়ে আমাদের যা উপকার করেছেন তা বলে শেষ করা যায় না। দুর্গানাথ অবশ্য খুব সঙ্কোচ বোধ করতেন অপরের সামনে এ ঘটনার উল্লেখে। পরবর্তীকালে ঠাকুর পরিবারের জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় তিনি দেখাশুনা করতেন।
১৯৪৬ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে শ্রীশ্রীঠাকুর দেওঘর চলে আসার পর দুর্গানাথও সপরিবারে চলে আসেন দেওঘর। ঠাকুরের থেকে বেশি দূরে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। ঠাকুরকে ভালবেসে, তাঁর পায়ে নিঃশেষে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই ছিল তাঁর পরম আনন্দ, চরম পরিতৃপ্তি। দেওঘরে আসর পর সৎসঙ্গের নবপর্যায় সূচিত হয়; বহু ক্লেশ অতিক্রম করে নবীন উৎসাহে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গড়ে তোলেন নতুন প্রতিষ্ঠান। সকলের সঙ্গে একসঙ্গে দুর্গানাথও ভাগ করে নেন আশ্রমিক জীবনের কৃচ্ছতা, অটল ইষ্টানুরাগে বহন করেন ইষ্টপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব। পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিচিত্রবর্ণ বহু লীলার সাক্ষী, তাঁর একান্ত অন্তরঙ্গ ভক্ত দুর্গানাথ সান্ন্যাল- এর জীবনাবসান হয়।
______________________________
#দুর্গানাথ_সান্ন্যাল
10