🕉︎ আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথম খণ্ড
✮ সব অবতারই কি সমান ?
✮ অক্ষমতার সঙ্গে হীনম্মন্যতা কেমনভাবে জড়িত...
২০ শে অগ্রহায়ণ , শুক্রবার , ১৩৪৮ ( ইং ৫/১২/১৯৪১ )
আজও বঁধের ধারে তাসুতে প্রাতঃকালীন বৈঠকে অনেক কথাবার্তা হলো । প্রফুল্ল — ইষ্টভৃতি কিছুদিন করলেই তাে সহজ হয়ে যায় , খুব effort ( প্রচেষ্টা ) কিছু করতে হয় না , তাতে কি আমাদের উন্নতি হয় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— Normal ( সহজ ) হ'লেও একটা superfluity of energy (উদ্বৃত্ত শক্তি ) থেকেই যায় , এবং সব কাজেই তার সাহায্য পাওয়া যায় । ইষ্টভরণ - ধান্ধা যার মন - মাথা জুড়ে থাকে , তার প্রবৃত্তিগুলিও ধীরে - ধীরে সুবিন্যস্ত হয়ে ওঠে , তার সবকিছুর মধ্যদিয়ে একটা একসূত্রনিবদ্ধ সমাহার হ'তে থাকে , তাই বোধও তেমনি করে ফুটে ওঠে । তা ছাড়া , সে শুধু ভাব বিলাসী হয় না , তার ভাবা , করার মধ্যে একটা সঙ্গতি থাকে । এইভাবে জীবনে কৃতকাৰ্যতার পথ তার খুলে যায় । নিত্য ইষ্টভােগের নৈবেদ্য নিবেদন ক'রে একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায় । প্রসাদের মধ্যে প্রসারও আছে । দিয়ে পুষ্ট করার মধ্যেই পেয়ে পুষ্ট ও উন্নত হওয়ার পথ আছে । আবার , ইষ্টভৃতি ক্রম বর্ধমান ক'রে রাখতে হয় , অমনতর প্রচেষ্টা নিয়ে চললে , অমনতর তপস্যারত থাকলে তার উন্নতি অনিবার্য । ভােজ্যটা বা পয়সাটা ইষ্টভৃতির মূল কথা নয় , ওর মূল কথা হলাে ইষ্টকে দেওয়ার আবেগ , তাকে না দিয়ে , না খাইয়ে আমার ভাল লাগে না , তাই সর্বাগ্রে আমার তার সেবার আয়োজন । ঐ আবেগ যখন মানুষের অন্তরে নেশার মতাে পেয়ে বসে , সে তখন তার সব করার ভিতর - দিয়ে তাকেই অর্ঘ্য - নন্দিত করতে চায় , জীবনে যেন তার একটা অফুরন্ত উৎসাহ জেগে যায় ।
★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★
অক্ষমতার সঙ্গে হীনম্মন্যতা কেমনভাবে জড়িত সেই সম্বন্ধে কথা উঠলো ! শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — মানুষ চায় appreciation ( গুণগ্রহণ - মুখর স্তুতি ) , চায় পারিপার্শ্বিক তাকে তারিফ করুক , কিন্তু দুর্বলতা , অক্ষমতা , অলসেমি থাকলে মানুষ তো ছাড়ে না ! তখন ঐ অক্ষম যারা , তাদের অনেকেই নিজেদের সংশোধন না করে বরং জোর করে নিজেদের নিজের establish ( প্রতিষ্ঠা ) করতে চেষ্টা করে , অনেক সময় অন্যকে খাটো ক'রে নিজেদের বড় করতে চায় । এমনতর দেখলে বুঝতে হবে — ঐ অক্ষমতার হাত থেকে তাদের আর রেহাই নেই । কিন্তু যারা নিজেদের অক্ষমতাকে অতিক্রম করতে ইচ্ছুক , কেউ তাদের দোষ ধরলে তারা তা বিনীতভাবে স্বীকার করে , তাদের হীনম্মন্যতা অতাে উগ্র হয় না , এদের উন্নতি তাই আশা করা যায় । প্রকৃত সক্ষম যারা, বিশেষতঃ শ্রেয়ানুপূরণ আবেগে দক্ষ ও যােগ্য হয়ে ওঠে যারা , তাদের হীনম্মন্যতার বালাই থাকে না , তারা মানুষের প্রশংসার কাঙ্গাল হয়ে ঘুরে বেড়ায় না , তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে প্রিয়পরমকে খুশি করা , তার খুশিতেই খুশি তারা । আবার , তিনি যদি তােয়াজ বা তারিফ না করেন , বাহবা না দেন তাতেও তাদের দুঃখ নেই । তিনি সুখী হ'লেই হ'লো — এই তাদের মনোভাব । নিজেদের জন্য কিছুই চায় না তারা । তারা কিন্তু নিজেদের চলন - চরিত্র কর্শের ভিতর যদি ঐ তার সুখ , স্বাচ্ছন্দ্য ও তৃপ্তির ব্যাঘাতী কিছু ধরতে পারে তারা , তখনই অনুতাপে তাদের বুক জ্বলে যায় , নিজেদের পরিশুদ্ধ না করা পর্যন্ত তারা শান্তি পায় না । তাই এমনতর যারা , দুর্বলতা , অক্ষমতা বা হীনম্মন্যতা তাদের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারে না । স্বতঃই তাদের সমান - সমান বা তাদের চাইতে যোগ্যতর যারা , তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ হয় এবং অপেক্ষাকৃত কম যােগ্যতা যাদের , তাদের প্রতি সহানুভূতি - সম্পন্ন হয় । তাদের চেষ্টা থাকে , কেমন - ক'রে সেবা - পরিচর্যায় যোগ্যতর করে তুলবে তাদিগকে । যারা হীনম্মন্যতা থেকে যােগ্যতা আহরণ করে , তারা কিন্তু প্রায়শঃই এমনটা পারে না । তারা নিজেদের বাহাদুরি প্রমাণ করবার জন্য অন্যের মনে আঘাত দিয়ে উৎসাহ - উদ্দীপনাকে অনেক সময় থেতলে দেয় । অশা , ভরসা , ঘূৰ্ত্তি ও প্রেরণা জুগিয়ে দরদী বন্ধুর মতাে হাত ধরে উপরে টেনে তুলতে পারে না । তাই আমার মনে হয় , যে - যোগ্যতা অন্যকে যােগ্য করে তুলতে পারে না , তাও অযোগ্যতারই সামিল । অবশ্য , মানুষের শ্রদ্ধা , ইচ্ছা ও চেষ্টা না থাকলে বাইরে থেকে কেউ কিছু করে দিতে পারে না ।
পর - পর প্রশ্ন চলতে লাগলাে । ক্রমে ভিড় বাড়তে লাগলাে । সবাই শীতে জড় - সড় হয়ে বসেছেন । তারপর আলাপ - আলোচনার ভিতর - দিয়ে এমন একটা জমাট আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে যে , যিনি একবার এসে বসেছেন তার অরি ওঠার সাধ্য নাই । কথার মধ্য দিয়ে তিনি যেন নিজের প্রাণ সবার প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন — হাবে , ভাবে , ভঙ্গীতে , কণ্ঠস্বরে , চাউনির ভিতরদিয়ে । তার নিতি নব নটলীলা — প্রতিটি মুহর্তে অনবদ্য , অনুপম , অপূর্ব । তাই , কখনও তাকে পুরান মনে হয় না , পুরাতন হ'য়েও চির - নূতন তিনি , চির অনাবিষ্কৃত তিনি , বিস্ময়ের নূতন শিহরণ নিয়ে প্রতিমুহূর্তেই থমকে দাড়াতে হয় তার সম্মুখে । তার সান্নিধ্যে যে - সুখ , সে যেন পাহাড়ে ওঠার সুখের মতাে , তাতে ক্লেশ আছে , তপস্যা আছে , বোধির রাজ্যে ধাপে - ধাপে এগিয়ে যাবার অনন্দ আছে । আরাে আছে বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকের জন্য দায়িত্ব - গ্রহণের আনন্দ । দুঃস্থ , আতুর , অনাথ , প্রয়োজনপীড়িত ক্রমাগত তার কাছে এসে ভিড় ক'রে দাঁড়ায় । তিনি পরস্পরকে দিয়ে পরস্পরের সেবা করিয়ে নেন , প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহায় । হয় , যার যতটুকু যােগ্যতা আছে , তাই নিয়ে পারিপার্শ্বিকের সহযােগিতায় সে অনেকখানি করতে পারে । এইভাবে দুর্বল শক্তিমান হয় , স্বার্থান্ধ ব্যক্তি প্রেমিক ও সেবাবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে ওঠে , অনিয়ন্ত্রিত , অপচয়প্রবণ ব্যক্তিও সুনিয়ন্ত্রিত , উপচয়ী হয়ে ওঠে , সমাজ - শক্তি এন্তার উন্নতির পথে এগিয়ে চলে ।
শরৎদা প্রশ্ন করলেন — সব অবতারই কি সমান ? শক্তির তারতম্য তো থাকেই । —সবার মধ্যে সব aspect ( দিক ) তাে দেখা যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— সকলেই পূর্ণ , সবাই বরিষ্ঠ , বড় কথার মধ্যে রয়েছে পরিপূরণ । যখন যেমন প্রয়ােজন তখন তেমন আবির্ভাব — যুগপ্রয়ােজন পরিপূরণের জন্য । যুগে - যুগে সেই একজনই আসেন , পূর্বতন ও পরবর্তীর মধ্যেই রয়েছে অচ্ছেদ্য সঙ্গতি । বিবর্তনের ধারা এইভাবে এগিয়ে চলেছে । তাই , একজনকে খাটো ক'রে আর - একজনকে বড় করার প্রচেষ্টা ভাল নয় । শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে রামচন্দ্রকে দেখি না , বুদ্ধদেবের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকে খুজে দেখি না — এই যে দোষ । বর্তমানের মধ্যে পূর্ব তনকে খুজে দেখার বুদ্ধি যদি আমাদের থাকে , তাহলে তার মধ্যে পূর্বতন প্রত্যেককে আমরা পেতে পারি এবং তাকে কেন্দ্র করে সমগ্র মানব - সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠতে পারে — প্রত্যেকে স্ব - স্ব বৈশিষ্ট্যে অক্ষুন্ন থেকে । ‘ স পূর্বেষামপি গুরু কালেনবচ্ছেদাৎ । আপনার মধ্যে আপনার বাবা আছেন , ঠাকুরদা আছেন , পূর্ব - পৰ্ব পুরুষ সবাই আছেন — তাদেরই বিবর্তিত রূপ আপনি । পরবর্তীও তেমনি পূৰ্ব্ববর্তীর বিবর্তিত রূপ । আজকের দিনে তাই পূর্ব্ববর্ত্তী কোন অবতার - মহাপুরুষকে যদি বুঝতে চাই , তবে বর্তমান পূরয়মাণ অবতার - মহাপুরুষ যদি কেউ থাকেন , তার মধ্যে দিয়েই বুঝতে পারব । নচেৎ তার মর্ম্মকেন্দ্রের সন্ধান পাব না । প্রেরিত , তথাগত , অবতার - মহাপুরুষ বা পুরুষােত্তম যাঁরা , তাদের প্রত্যেকের মধ্যে সব aspect- ই ( দিকই ) থাকে ; affair ( বিষয় ) দরকার , তখন টের পাওয়া যায় , নচেৎ প্রয়ােজনােপযােগী কতকগুলি aspect ( দিক ) prominent ( প্রধান ) ও active ( সক্রিয় ) দেখা যায় , অন্য সব aspect ( দিক ) -এর spark ( ঝলক ) মাঝে - মাঝে দেখা যায় । অবতার - মহাপুরুষ ছাড়া আর একদল আছেন পাবক - পুরুষ —বিশেষ - বিশেষ গ্লানি নিরাকরণের জন্য তারা আসেন , তাদের মধ্যে সব দিককার অমনতর সুসঙ্গত সুসম্পূর্ণ সমাবেশ দেখা যায় না । তবে পূৰ্ব্বতনের প্রতি আনুগত্য তাদের মধ্যে পরিস্ফুট থাকেই কি থাকে ।
একজন তামাক সাজতে গিয়ে পর - পর দেশলাইয়ের চারিটি কাঠি খরচ করলেন । শ্রীশ্রীঠাকুরের তা ’ নজর এড়ায়নি , বললেন — এ দেখে বোঝা যায় , তুমি মিতব্যয়ী কতখানি । ছোট - ছোট ব্যাপারগুলি ঠিক করে ফেল , তাহ'লে বড় ব্যাপারে আটকাবে না ।
শরৎদা এইবার প্রশ্ন করলেন — মীরাবাঈ - এর জীবনে দেখতে পাই , তার এক ইষ্ট , স্বামীর অন্য ইষ্ট । স্বামীর প্রতি টান নেই , কিন্তু স্বামীর প্রতি টান নিয়ে স্বামীর through- তে ( ভিতর দিয়ে ) ইষ্টানুসরণ করাই তাে বিধি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— Through ( ভিতর - দিয়ে ) নাই , in co - ordination with husband ( স্বামীর সহযােগে ) এই পর্যন্ত । ইষ্টানুসরণের অধিকার সবারই আছে , স্বামী ইষ্টানুসরণ না করলেও মেয়েরা করবে এবং স্বামীকে সেই পথে আনবে । মীরাবাঈ তো প্রকৃতপক্ষে গিরিধারীলালের সঙ্গে wedded ( পরিণয়নিবদ্ধ ) হ'য়ে গিয়েছিল । তাকে ওখানে বিয়ে দেওয়াটাই ঠিক হয়নি । আবার , রাণা যদি গিরিধারীলালের ভক্ত হতাে তাহলে সােনায় সোহাগা হতো , সে তার ভক্তিপথের সহায় হতো এবং সেইজন্য মীরা তার প্রতি স্বতঃই অনুরক্ত হয়ে উঠতাে , ইষ্টানুরাগের সঙ্গে সঙ্গতি নিয়ে স্বামী - অনুরাগ গজিয়ে উঠতাে তার ভিতর , এতে তার ভক্তি - জীবন সমৃদ্ধতর হ'তে বই ক্ষুন্ন হতাে বলে আমার মনে হয় না । ইষ্টার্থ - অপূরণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দুনিয়ার যত - কিছুর সঙ্গেই আমরা সম্বন্ধান্বিত হই না কেন , তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই । নানা ব্যক্তি , বিষয় ও ব্যাপারকে ইষ্টানুগ নিয়ন্ত্রণে যতইা আমরা সুবিন্যস্ত করে তুলতে পারি , ততই আমাদের ব্যক্তিত্ব বিস্তার লাভ করে এবং ইষ্টানুরাগও গভীরতর হয়ে ওঠে , এবং ধর্ম্মের উদ্দেশ্য যে সপরিবেশ বাঁচা - বাড়া — তাও সার্থক হয় ঐ পথেই । নচেৎ পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কহারা জীবন কিন্তু ধর্ম নয় । তাই বলে ইষ্টনিষ্ঠা ব্যাহত হয় যাতে তেমনতর সংসর্গে ঢলে পড়াও কিন্তু ঠিক নয় । সেই আশঙ্কায়ই মীরা হয়তো রাণার সংসর্গ সযত্নে পরিহার করে চলেছে । কিন্তু রাণার স্বীয় ইষ্টের প্রতি তীব্র অনুরাগ যদি থাকত তাহ'লেও হ'তো , পরস্পর পরস্পরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতাে , তার মধ্যদিয়ে মিল হতাে । তাই বিয়ে - থাওয়া ব্যাপারে বর্ণ - বংশ ইত্যাদি যেমন দেখা দরকার , সঙ্গে - সঙ্গে ছেলে ও মেয়ের প্রকৃতি - সঙ্গতিও দেখা দরকার ।
10